অনুবাদ গল্প:: ছত্রধরবাবু - রোয়াল্ড ডাহল :: অনুবাদ: প্রতীক কুমার মুখার্জি


ছত্রধরবাবু
[মূল গল্প: দ্য আমব্রেলা ম্যান - রোয়াল্ড ডাহল]
অনুবাদ: প্রতীক কুমার মুখার্জি

গতকাল সন্ধ্যায় মা ও আমার সঙ্গে যে কিম্ভূত কাণ্ডটা ঘটে গেল, সেটা তোমাদের যতক্ষণ না বলতে পারছি আমার পেট ফেঁপে রয়েছে, হাসিতে হাঁসফাঁস করছে ভিতরটা! আমায় চেন না বুঝি? দাঁড়াও বলি - আমি তোমাদের মতোই বারো বছরের একটি পুঁচকে মেয়ে। মায়ের বয়স চৌত্রিশ বছর হলেও, লম্বায় আমি মায়ের মাথা প্রায় ছুঁই ছুঁই।
গতকাল বিকেলে, মায়ের সঙ্গে আমি লন্ডন শহরে গিয়েছিলাম দাঁতের ডাক্তার দেখাতে। একটি দাঁতে একটি ছোট্ট ফুটো খুঁজে পাওয়া গেল। পিছন দিকের দাঁত হওয়ার জন্য আমাকে বেশি ব্যথা না দিয়ে, ডাক্তারবাবু সেটার ব্যবস্থা করে ফেললেন খুব কম সময়ে। তারপর একটা ক্যাফেতে ঢুকে আমি ব্যানানা স্প্লিট নিয়ে বসলাম, আর মা এক মগ কফি নিয়ে। সেগুলো শেষ করে যখন উঠব উঠব করছি, ঘড়িতে তখন প্রায় সন্ধে ছ’টা।
ক্যাফে থেকে বেরিয়ে দেখি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মা বলল, “আমাদের একটা ট্যাক্সি ধরতে হবে” বৃষ্টি ততক্ষণে জোরকদমে হাজির, আমাদের পরনে সাধারণ কোট ও হ্যাট ভেজার হাত থেকে বাঁচার কোনো ব্যবস্থাই নেই!
আমি বললাম, “বৃষ্টি থামা পর্যন্ত আমরা তো ক্যাফেতে ফিরে গিয়ে সেখানেই অপেক্ষা করতে পারি, তাই না?” আসলে আমার আরেকটা ব্যানানা স্প্লিট খাওয়ার লোভ বাড়ছিল সেটা এত ভালো ছিল যে একটায় মন মানাতে পারছিলাম না!
“এই বৃষ্টি সহজে থামার নয়,” মা বলল, “আমাদের তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে
তুমুল বৃষ্টির মধ্যে আমরা ফুটপাথের উপর একটা খালি ট্যাক্সির জন্য অধীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। এদিকে ওদিকে অনেক ট্যাক্সি চলাচল করলেও, সেগুলো সব যাত্রী নিয়ে নিজের রাস্তায় চলেছে। মা’র কথায় হতাশা ফুটে ওঠে, “ইশশ, আমাদের যদি ড্রাইভার সমেত একটা গাড়ি থাকত, কী যে ভালো হত!
ঠিক তখনই, আমরা তাঁকে দেখতে পেলাম। ছোটোখাটো মানুষটি, এবং বৃদ্ধ অন্ততপক্ষে বছর সত্তর বয়স তো হবেই, তার বেশি হলেও অবাক হবার কিছু নেই! আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে, অত্যন্ত ভদ্রভাবে নিজের হ্যাট এক হাতে একটু উপরে উঠিয়ে অভিবাদন জানিয়ে মাকে বললেন, “দয়া করে আমার কথা শুনবেন? আশা করি আপনি আমার একটা কথা নিশ্চয় শুনবেন” তাঁর কুঁচকানো গোলগাল গোলাপি রঙের মুখে একটি মানানসই সাদা গোঁফ, আর বরফের মতো সাদা মোটা মোটা ভ্রূ দুটি মিলে এক অসহায় অভিব্যক্তি সৃষ্টি করেছিল।
তিনি নিজের মাথার উপর ধরে রেখেছিলেন একটি ছাতা, এবং সেটির সাহায্যে, ঐ প্রচণ্ড বৃষ্টিতে তখনও পর্যন্ত ছিলেন শুকনো খটখটে।
মা ভীষণ গম্ভীরভাবে এবং ঠান্ডা মাথায়, মাত্র একটা শব্দে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিল, “বলুন
“আমি কি আপনার কাছে একটা ছোট্ট উপকারের আশা রাখতে পারি?” তিনি বললেন, “বিশ্বাস করুন, আমি একটা অতি সামান্য উপকারের কথা বলছি
আড়চোখে দেখলাম, মা সেই ভদ্রলোকের দিকে ভয়ংকর সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এমনিতেই আমার মা অত্যন্ত সন্দেহবাতিকগ্রস্ত এক মানুষ। বিশেষ করে দুটি জিনিসের প্রতি তার প্রবল সন্দেহ অচেনা মানুষ এবং সিদ্ধ ডিম। ডিম ছাড়াবার সময় মা সেটার উপরের অংশটুকু কেটে ফেলে, চামচ দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ডিমের ভিতরে কী আছে খোঁজার চেষ্টা করে যেন সেটার মধ্যে কোনো ইঁদুর বা অন্য কিছু লুকিয়ে বসে আছে! আর অচেনা মানুষের ক্ষেত্রে মা একটি নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলে, ‘যে মানুষের ব্যবহার যত ভালো হবে, জানবে সে ততই সন্দেহজনক চরিত্র!’ এই বিশেষ ভদ্রলোকটির ব্যবহার অমায়িক। তিনি অত্যন্ত ভদ্র। তাঁর কথাবার্তা, সাজপোশাক সব কিছুই নিটোল, নিখুঁত। তিনি সত্যিই একজন ভদ্র মানুষ। যে কারণে আমি তাঁর সম্পর্কে এই কথা জোর দিয়ে বলছি, তা হল তাঁর জুতোজোড়া। মায়ের অত্যন্ত প্রিয় একটি বাক্য হল, ‘একজন মানুষের জুতো বলে দেয় যে সে প্রকৃত একজন ভদ্রলোক কিনা!’ এই ভদ্রলোকের পায়ে ছিল চকচকে পালিশ করা, বাদামি চামড়ার দামি জুতোজোড়া।
“সত্যি বলতে কী,” ভদ্রলোক বলছিলেন, “আমি নিজের দোষেই বিপদে পড়েছি। একটু সাহায্য চাই। আপনাকে বলছি, বিশ্বাস করুন, আমি বেশি কিছু চাইব না। আপনার কাছে সেটা অতি সামান্য হলেও, তাতেই আমার বিপদ কেটে যাবে। বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, আমার বয়সি মানুষজন কোনো কিছুই ভালো করে মনে রাখতে পারে না
এতদূর পর্যন্ত শোনার পর, চোয়াল শক্ত করে মা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভদ্রলোকের দিকে সটান তাকিয়ে থাকল। আমার মায়ের এই বরফশীতল চাউনি একটি ভয়ংকর বস্তু এতে অতি সাহসী মানুষের হাঁটুও কেঁপে যেতে বাধ্য। একবার দেখেছিলাম, মায়ের এই বিশেষ চাউনির সামনে পড়ে, আমার স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা পর্যন্ত তোতলাতে শুরু করেছিলেন এবং তাঁর জোরালো বক্তব্য রীতিমতো আমতা আমতা করে পেশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু ফুটপাথের ধারে, মাথার উপর এক হাতে তুলে ধরা ছাতা নিয়ে বৃদ্ধ ভদ্রলোকের ক্ষেত্রে কোনো বিকার ঘটল না! তিনি অতি সদাশয়ভাবে, মিষ্টি হেসে বললেন, “আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন ম্যাডাম, প্রকাশ্য রাজপথের উপর কোনো সম্ভ্রান্ত ভদ্রমহিলাকে দাঁড় করিয়ে নিজের বিপদের কথা বলে বিব্রত করার বদ অভ্যাস কিন্তু আমার নেই
“আমি সেটা আশাও করি না!” মা ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল।
মায়ের এই অকারণ অভদ্রতায় আমার ভীষণ লজ্জা লাগছিল। মনে হচ্ছিল মাকে ডেকে বলি, “উফ মা, দোহাই তোমার, ইনি একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক, যার ব্যবহার অত্যন্ত সুন্দর ও মিষ্টি, এবং সত্যি করেই উনি কোনো বিপদে পড়েছেন হয়তো। দয়া করে তোমার এই অমানুষিক অভদ্রতা বন্ধ করো” কিন্তু সাহস করে কথাগুলো বলতে পারলাম না আমি।
ভদ্রলোক তাঁর ছাতাটি এক হাত থেকে অন্য হাতে চালান করে বললেন, “জানেন, আগে কখনও এই ধরনের ভুল হয়নি আমার
“কী ধরনের ভুলের কথা বলতে চাইছেন আপনি?” কঠিন গলায় প্রশ্ন করল মা।
“আমার ওয়ালেট,” তিনি বললেন হতাশভাবে, “নিশ্চয় সেটা অন্য কোনো কোটের পকেটে রয়ে গেছে। আচ্ছা বলুন তো, এটা আহাম্মকের মতো কাজ কি না?
তখন মা জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি আমার কাছে টাকা চাইছেন?
“ছিঃ, ছিঃ, ঈশ্বরের দোহাই, না, না!” আর্তনাদ করে উঠলেন ভদ্রলোক, “জীবনে যেন আমাকে এই পরিস্থিতিতে পড়তে না হয় কখনও!”
“তাহলে আপনার দাবিটা কী?” মা ঝাঁঝিয়ে উঠল, “তাড়াতাড়ি বলুন। আমরা দু’জনে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে, এই প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ক্রমেই ভেজা কাকের মতো হয়ে যাচ্ছি!
“বুঝতে পারছি ম্যাডাম,” তিনি বললেন, “এবং ঠিক সেই কারণেই আমি আমার এই ছাতাটি আপনাকে দিতে চাইছি, যাতে বৃষ্টির থেকে আপনারা মাথা বাঁচাতে পারেন, এমন কি বরাবরের জন্যে রাখতেও পারেন, যদিযদি শুধু
“যদি শুধু কী?” তিতিবিরক্ত হয়ে মা প্রশ্ন করল।
“যদি এই ছাতার বদলে আপনি আমাকে মাত্র এক পাউন্ড দিতে পারেন, যাতে আমি ট্যাক্সি ধরে নিজের বাড়ি পৌঁছোতে পারি
মায়ের সন্দেহ তখনও যায়নি। “যদি আপনার কাছে টাকা না থেকেই থাকে,” মায়ের প্রশ্ন, “তাহলে বাড়ি থেকে এত দূরে এলেন কীভাবে?
“হেঁটে এসেছি,” তিনি নির্বিকারভাবে উত্তর দিলেন, “প্রতিদিন আমি হাঁটতে বেরোই, এবং হাঁটা শেষ হলে ট্যাক্সি ধরে বাড়ি ফিরে যাই। বছরের প্রতিদিন আমি এই কাজ করে থাকি এ আমার অভ্যাস
“তাহলে এখন আপনি কেন হেঁটে হেঁটে নিজের বাড়ি ফিরতে পারছেন না?” মায়ের প্রশ্ন উড়ে এল
“ইশশ, তাই যদি পারতাম!” তিনি আক্ষেপ করলেন, “সত্যিই যদি হেঁটে ফিরতে পারতাম আমি। বয়সের ভারে পারি না ম্যাডাম, এই দুর্বল পা দুটি সেই চেষ্টায় বাদ সাধে। আর আজ আমি এমনিতেই অন্যদিনের চাইতে বেশি হেঁটে ফেলেছি!
মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ঠোঁট কামড়াতে থাকল। মায়ের মনটা যে নরম হতে শুরু করেছে, সেটা আমার চোখ এড়াল না এবং এই মওকায় ছাতার সঙ্গে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, সেটাও এই প্রলোভনের যথেষ্ট কারণ বলে মনে হতে লাগল।
“এটি কিন্তু অসাধারণ একটি ছাতা,” ভদ্রলোক বললেন।
“সেটা আমি আগেই দেখেছি,” এই প্রথম মায়ের গলা নরম শোনাল
“এটি পুরোপুরি সিল্কের,” তিনি যেন লোভ দেখালেন।
“সেটাও আমার নজরে পড়েছে!
“তা হলে ভাবছেন কেন ম্যাডাম, নিয়ে নিন,” তিনি বললেন, “আমি সত্যি কথা বলছি, এটি কিনতে আমার বিশ পাউন্ডের বেশি খরচা হয়েছে, কিন্তু এই মুহূর্তে এটি আমার কাছে অপ্রয়োজনীয় আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে এবং এই ক্লান্ত শরীরকে বিশ্রাম দিতে হবে
লক্ষ করলাম মায়ের হাতটা পয়সার বটুয়া খোলার জন্য নিশপিশ করছে। আমাদের দু’জনের চোখাচোখি হয়ে গেল। আমিও তখন চোয়াল শক্ত করে মাকে সেই বরফশীতল চাউনিটাই ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম এবং মা বুঝতে পেরেছিল আমি ঠিক কী বলতে চাইছি। আমি বলছিলাম, মা, এইভাবে একজন অতি ভদ্র, সম্ভ্রান্ত, ক্লান্ত বৃদ্ধের অবস্থার সুযোগ নেওয়া ঠিক হচ্ছে না। এটা কোনোভাবেই ভালো কাজের মধ্যে পড়ে না। মা থামল, তারপর আমার দিকে ঘুরে তাকাল। তারপর সেই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার মনে হয় না এভাবে আপনার কাছ থেকে এত দামি ছাতাটি নেওয়া আমার উচিত হবে। তার চেয়ে বরং আমি আপনাকে ট্যাক্সি ভাড়াটুকু দিয়ে দিচ্ছি, আপনি সাবধানে বাড়ি ফিরুন
“না, না, না!” তিনি তীব্র প্রতিবাদ করলেন, “তার প্রশ্নই ওঠে না! আমি এই কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারব না! হাজার বছর পরেও না! আমি ওভাবে আপনার কাছ থেকে টাকা নিতে পারব না! দয়া করে এই ছাতাটি নিন ম্যাডাম, বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পান!
মা আমার দিকে এমনভাবে বাঁকা চোখে তাকাল, যেন বিশাল এক যুদ্ধজয় করে ফেলেছে। মায়ের চোখ বলছিল আমাকে, দেখেছ? তোমার ভাবনা ভুল ছিল। উনি চাইছেন এই ছাতাটি আমি নিয়ে নিই ওনার কাছ থেকে।
বটুয়ার মধ্যে থেকে খুঁজেপেতে একটা এক পাউন্ডের নোট বার করে এনে ভদ্রলোকের দিকে বাড়িয়ে ধরল মা। তিনি সেটি নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের হাতে ছাতাটা ধরিয়ে দিলেন। পাউন্ডের নোট পকেটে ঢুকিয়ে, আবার হ্যাট একটু উঠিয়ে অভিবাদন জানিয়ে, সামনে ঝুঁকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন, “অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে ম্যাডাম!” তারপর আমাদের সামনে থেকে চলে গেলেন।
“এসো সোনা, ছাতার তলায় এসো, তাহলে আর ভিজবে না,” মা আমাকে ডাকল, “আমাদের ভাগ্যটা ভালোই! জীবনে কখনও সিল্কের ছাতা ব্যবহার করিনি। আমাদের এই জিনিস কেনার ক্ষমতা নেই!
“তুমি ওনার সঙ্গে প্রথম থেকে ওরকম বিশ্রীভাবে ব্যবহার করছিলে কেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“আমি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম যে ভদ্রলোক একজন প্রতারক বা ঠকবাজ নন,” মা বলল, “এবং আমি নিশ্চিত হয়েছি। উনি সত্যি করেই একজন নিপাট ভদ্রলোক। খুব আনন্দ হচ্ছে যে ওনার মতো মানুষকে কিছুটা হলেও সাহায্য করতে পারলাম!
“সত্যিই গো মা!” আমিও সুর মেলালাম মায়ের সঙ্গে।
“একজন যথার্থ ভালোমানুষ,” মা বলে চলেছে, “উনি অবশ্যই যথেষ্ট বিত্তবান, নইলে এই রকম একটা দামি ছাতা ব্যবহার করতে পারেন না। আমি অবাক হব না, পরে যদি শুনি যে উনি একজন বিশেষ উপাধিধারী বিশিষ্ট মানুষ যেমন স্যার হ্যারি গোল্ডসওয়ার্থি বা সেরকম কিছু!
“তাই নাকি মা!
“এই ঘটনা তোমার কাছে এক দুর্দান্ত শিক্ষা হয়ে থাকবে,” মা উদাত্তস্বরে বলে চলেছে, “কখনও তাড়াহুড়ো করবে না। কোনো মানুষের সম্বন্ধে ধারণা করার আগে, যতক্ষণ দরকার ভাবার, চিন্তা করার সময় নেবে। তাহলেই আর কখনও ভুল হবে না
“ঐ দেখো,” আমি বললাম, “ঐ যে উনি যাচ্ছেন!
“কোথায়?
“ঐ যে উনি রাস্তা পার হচ্ছেন। দেখো মা, উনি কত তাড়াতাড়ি হাঁটছেন!
আমরা দু’জনে দেখলাম কী অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় উনি ব্যস্ত রাজপথ পেরিয়ে গেলেন এক পলকের ভিতর! রাস্তা পেরোবার পর, তিনি বাঁদিকে ঘুরেই তড়বড় করে হাঁটতে শুরু করলেন আবার।
“ওনাকে দেখে তো সেভাবে ক্লান্ত বলে মনে হচ্ছে না আমার, তোমার কী মত, মা?
মায়ের দিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
“আমার তো এটাও মনে হচ্ছে না যে উনি ট্যাক্সি ধরার কোনো চেষ্টা করছেন,” আমি বললাম।
আমার মা কাঠের মতো শক্তভাবে, অনড় হয়ে রাস্তার ওপাশে খুব জোরে হেঁটে চলা ভদ্রলোকের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। তাঁকে আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। তাঁর যেন প্রচণ্ড তাড়া আছে! তিনি ফুটপাথের উপর দিয়ে যেন উড়ে চলেছেন, অন্যান্য পথচারীদের অবলীলায় এড়িয়ে, হাত-পা প্রবলভাবে দোলাতে দোলাতে ঠিক যেমন সৈন্যরা জোরকদমে কুচকাওয়াজে যায়।
“নির্ঘাত লোকটার কোনো মতলব আছে!” মায়ের মুখ আবার পাথরের মতো শক্ত।
“কিন্তু কী সেটা?
“আমি কী করে জানব?” মা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “কিন্তু আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। এসো আমার সঙ্গে” মায়ের হাত ধরে আমরা রাস্তা পার করলাম। তারপর বাঁয়ে ঘুরলাম।
“তুমি কি ওকে দেখতে পাচ্ছ?” মা জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, ঐ তো! সামনের গলি থেকে ডানদিকে ঘুরছে!
আমরাও সেই জায়গায় এসে ডানদিকে ঘুরে গেলাম। ছোটোখাটো মানুষটা আমাদের প্রায় বিশ গজ আগে আগে চলেছে। খরগোশের মতো তুড়ুক তুড়ুক করে এমন দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে যে আমাদের পক্ষে তার সঙ্গে তাল মেলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। বৃষ্টি নেমেছে মুষলধারে, আগের তুলনায় অনেক বেশি জোরে, এবং আমি দেখতে পাচ্ছিলাম লোকটির ভিজে যাওয়া হ্যাট থেকে বৃষ্টির জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে তার কোট ভিজিয়ে দিচ্ছে সমানে। আমরা কিন্তু আমাদের নতুন সিল্কের ছাতার নিচে দিব্যি আরামে, শুকনো অবস্থায় ছিলাম।
“লোকটা কী চায় কে জানে?” মা বলে উঠল।
“যদি হঠাৎ করে পিছনে ঘোরে, আমাদের দেখতে পেয়ে যাবে তো!” আমি বললাম।
“দেখলে দেখবে, তাতে আমার কিছু এসে যায় না!” মা বলল, “ও আমাদের কাছে মিথ্যে কথা বলেছে। বলেছিল যে ও আর হাঁটতে পারছে না, কিন্তু এখন ও আমাদের নাকে দড়ি দিয়ে ছোটাচ্ছে! ও একটা নির্লজ্জ মিথ্যেবাদী! ও একটা প্রতারক!
“তাহলে তুমি যে বললে উনি একজন উপাধিধারী বিশিষ্ট মানুষ!” আমি বললাম।
“চুপ করে থাকো!
পরের মোড়ে, লোকটা আরও একবার ডানদিকে ঘুরে গেল। তারপর বাঁয়ে। তারপর আবার ডানে!
“আমি ওকে ছাড়ব না!” মা হাঁফাতে হাঁফাতে বলল।
“কোথায় গেল লোকটা?” আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, “ওকে তো আর দেখতে পাচ্ছি না!
“ঐ যে ওই দরজাটার ভিতর ঢুকেছে!” মা বলল, “আমি পরিষ্কার দেখেছি! ওই বাড়িটার মধ্যে! হায় ভগবান! এটা তো একটা রেস্তোরাঁ!
বাড়িটার সামনে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা রয়েছে, “রেড লায়ন!
“তুমি নিশ্চয় বাড়িটার ভিতরে যাবে না মা!
“না! আমরা বাইরে থেকে নজর রাখব
রেস্তোরাঁর সামনের দিকটা একটা বিশাল কাচের জানালা, যেখান থেকে ভিতরের সমস্ত কিছু একটু চেষ্টা করলেই দেখা যায়। যদিও কাচে কিছুটা ময়লা ও বাষ্প জমে আছে, তাও একেবারে কাছে গেলে ভিতরটা পরিষ্কার দেখা যায়।
আমরা জড়োসড়ো হয়ে সেই জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে ভিতরে নজর রাখছিলাম। আমি মায়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেছিলাম। বৃষ্টির বিশাল বিশাল ফোঁটাগুলো আমাদের ছাতার উপর টপ টপ করে ঝরে পড়ছিল।
“ওই যে লোকটা,” আমি বলে উঠলাম, “ওইখানে!
বাইরে থেকে যে বিশাল ঘরটা দেখতে পাচ্ছিলাম, সেটা মানুষের ভিড়ে গিজগিজ করছিল, এবং আমাদের ছোটোখাটো মানুষটি ঘরের একেবারে মাঝখানে বসে ছিল। এখন তার শরীরে হ্যাট ও কোট কোনোটাই ছিল না, এবং সে ভিড় ঠেলে ঠেলে এগিয়ে চলেছিল। সে যখন অর্ডার দিল, আমি তার ঠোঁট নড়তে দেখলাম। ওয়েটার অর্ডার নেওয়ার কয়েক মুহূর্ত পরেই ফিরে এল
কাউন্টারের উপর লোকটা এক পাউন্ডের সেই নোটটা রেখে দিল
“ওটা আমার দেওয়া সেই পাউন্ডটা!” মা ফিসফিসিয়ে বলে উঠল, “ভগবানের দোহাই, লোকটার সাহস বলিহারি!
“পাত্রের মধ্যে কী রয়েছে?” আমি প্রশ্ন করলাম।
“আইসক্রিম!” মা বলল।
কাউন্টারের লোকটা কিন্তু সেই পাউন্ডের থেকে কোনো পয়সা ফেরত দেয়নি।
“লোকটা নিশ্চয় ট্রিপল স্কুপ নিয়েছে!” মা বলল অস্ফুটে।
“ট্রিপল মানে কী?
“সাধারণত যতটা দেয় তার তিনগুণ,” মা উত্তর দিল।
লোকটা বাটিটা এক টানে তুলে নিয়ে, মাত্র এক মিনিটের মধ্যে অত বড়ো আইসক্রিমটা শেষ করে ফেলল!
“কী অসহ্য ব্যাপার!” মা ফুঁসে উঠল, “এক পাউন্ড খরচ করে কেনা অত সুন্দর, অত বড়ো জিনিসটা এক মুহূর্তের মধ্যে এভাবে কেউ শেষ করে ফেলে?
“ওটার দাম কিন্তু মাত্র এক পাউন্ড নয়,” আমি বললাম, “ওটার জন্য ওর বিশ পাউন্ড দামের একটা সিল্কের ছাতাও জলে গেছে!
“সত্যি, ঠিক বলেছ তুমি!” মা বলল, “লোকটার মাথায় নির্ঘাত গণ্ডগোল আছে!
খাওয়া শেষ করে ছোটোখাটো মানুষটি উঠে দাঁড়িয়েছিল এক মুখ হাসি নিয়ে, তার গোলাপি গোলগাল মুখে আনন্দ ও পরিতৃপ্তির সোনালি আলো যেন খেলা করে বেড়াচ্ছে। আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম সে জিভ বার করে নিজের সাদা গোঁফে কয়েকবার বুলিয়ে নিল যেন সেই অসামান্য আইসক্রিমের শেষ ফোঁটাটুকু জিভ দিয়ে ভিতরে শুষে নিতে চায়!
তারপর, সেই টেবিল থেকে ভিড় ঠেলতে ঠেলতে আবার সে এগিয়ে যেতে লাগল কোট র‍্যাকের দিকে, যেখানে তার হ্যাট ও কোট ঝুলিয়ে রাখা ছিল। সে একে একে সেগুলি পরে ফেলল। তারপর সেই কোট র‍্যাকে রাখা অনেকগুলো ভিজে ছাতার মধ্যে থেকে, অবলীলায় ও অত্যন্ত ভাবলেশহীনভাবে একটি ছাতা তুলে নিয়ে এমনভাবে বেরিয়ে গেল, যাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ থাকা সম্ভব নয়।
“দেখতে পেলে ও কী করল?” প্রায় চিৎকার করে উঠল মা, “তুমি কি দেখতে পেলে ওর কারসাজিটা?
“শশশ!” আমি ফিসফিসিয়ে বললাম, “ও কিন্তু বেরিয়ে আসছে!
আমরা আমাদের ছাতাটা নামিয়ে নিয়ে নিজেদের মুখ প্রায় ঢেকে ফেললাম, শুধু উঁকি মেরে দেখতে লাগলাম। সে শান্তভাবে বেরিয়ে এল এবং আমাদের দিকে তাকিয়েও দেখল না! নতুন ছাতাটি মাথার উপর ধরে সেই এক গতিতে হুড়মুড়িয়ে আবার সেই রাস্তা ধরেই ফিরতে লাগল।
“তাহলে এই হল এনার কারসাজি!” মা বলে উঠল।
“অসামান্য!” আমি বললাম, “তুলনাহীন!
আবার তাকে অনুসরণ করতে করতে আমরা সেই বড়ো রাস্তায় ফিরে এলাম, যেখানে তার সঙ্গে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। অবাক হয়ে দেখলাম, আবার এক পাউন্ডের বিনিময়ে, সেই নতুন ছাতাটি আরেকজন পথচারীকে গছিয়ে দেওয়ার সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকল সে। এর পরের শিকার একজন রোগা, লম্বা মানুষ, যার কাছে কোট বা হ্যাট কোনোটাই ছিল না। অসাধারণ দক্ষতায় বিনিময় শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে, আমাদের ছোটো ওস্তাদ ব্যস্ত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল! কিন্তু এবার, সম্পূর্ণ অন্যদিকে!
“দেখলে, লোকটা কি প্রচন্ড চালাক?” মা বলল, “ও কিন্তু কখনও এক রেস্তোরাঁয় দ্বিতীয়বার যায় না!
“ওর এই বিটকেল কাণ্ডকারখানা তো সারা রাত ধরে চলতে পারে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ,” মা বলল, “নিশ্চয় পারে, কিন্তু আমি বাজি ধরতে পারি, এরকম বৃষ্টির দিনের অপেক্ষায় ও চাতকপাখির মতো হা-পিত্যেশ করে বসে থাকে!
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment