ব্যাবসাদার ব্যবসা
সুস্মিতা কুণ্ডু
ব্যাবসাদা
আমাদের বড়োজেঠুর মেজো ছেলে। আমাদের বিশাল একান্নবর্তী পরিবারে জেঠতুতো-খুড়তুতো-পিসতুতো-সেজকাকিমার
ফুলদার ছোটোশালিতুতো ভাইবোনের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তবু তারই মধ্যে ব্যাবসাদা
নিজগুণে নিজের আসল নামখানা গুম করে দিয়ে এই নকল নামটিকে অমর করতে সফল হয়েছে। নামের
কারণটা জলবৎ তরলং। ব্যাবসাদা ব্যবসা করতে ভালোবাসে, তাই ব্যবসার গায়ে একটা বাড়তি
আ-কার লাগিয়ে ওর নাম হয়ে গেছে ব্যাবসাদা। নামটা দেওয়ার কৃতিত্ব আমাদের ঠাকুর্দার।
আর বেশি গল্প এগোনোর আগে একটু ঠাকুর্দা আর আমাদের কথা বলে নিই বরং। কারণ একবার
ব্যাবসাদার ব্যবসার গল্পের গলিতে ঢুকে গেলে সেখান থেকে বেরোনোর পথ মেলা দুষ্কর।
আমাদের
এই বিশাল পরিবারের হর্তাকর্তাবিধাতা ঠাকুর্দা যে বছর পঞ্চভূতে বিলীন হলেন ঠিক তার
পরের বছরই আমি ইহজগতে পদার্পণ করি। তাঁর সঙ্গে চাক্ষুষ সাক্ষাতের সৌভাগ্য আমার তাই
ঘটেনি। অবিশ্যি গরমের ছুটির খাঁ খাঁ দুপুরে চিলেকোঠার ঘরে আমি তপু ট্যাঁপা বিল্লি
চারজন মিলে একবার প্ল্যানচেট করার চেষ্টা করেছিলুম। প্রাণপণে ঘন্টাখানেক স্বর্গত
ঠাকুর্দার নাম জপ করার পর গোয়ালঘরের টিনের চালে হুড়মুড় করে কিছু একটা লাফিয়ে
পড়েছিল। সেই আওয়াজে ঠাকুমার পেয়ারের বরদাসুন্দরী গাই জাবরকাটা থামিয়ে হাম্বা করে
গলা ফাটিয়ে ডাক ছেড়েছিল। বরদাসুন্দরীর ডাকে মেজোজেঠি চমকে উঠে আমসত্ত্বর বয়াম
মাটিতে ফেলে ভেঙে ফেলেছিল। আরও অনেককিছু কার্যকারণ সম্বন্ধিত অশৈলী ঘটনা সেদিন
ঘটেছিল যার দায় কোনোভাবেই আমাদের কাঁধে বর্তায় না। তবুও জানি না কেন আমাদের কান
মুচড়ে ঠাকুমার কৃত্তিবাসী রামায়ণের লাল মলাট বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
সেদিন
সন্ধেবেলায় হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসে ট্যাঁপা কানে হাত বুলোতে বুলোতে একবার বলার
চেষ্টা করেছিল যে আমাদের প্ল্যানচেট নির্ঘাৎ সফল হয়েছিল। গোয়ালঘরের ছাদে নির্ঘাৎ
ঠাকুর্দাই এসেছিল। তপু তখন ট্যাঁপার অন্য সাদা কানটায় আরেক মোচড় দিয়ে গোলাপি রঙ
ধরিয়ে খেঁকিয়ে বলেছিল, “ঠাকুর্দার ভূত খামোখা গোয়ালঘরের ছাদে কেন হাইজাম্প প্র্যাকটিস করতে যাবে!”
আমাদের
এই শতকৌরবের মতো গণ্ডা গণ্ডা ভাইবোনের সমুদ্রে আমরা চারমূর্তি সমবয়সি, তাই আমরা এক দল
এক মত অভিন্ন হৃদয় ইত্যাদি ইত্যাদি। একই ক্লাসের স্টুডেন্টও বটে আমরা। বিল্লি
অবশ্য পড়ে অন্য স্কুলে, মেয়েদের স্কুলে। বাকি আমরা তিনজন এক
গোয়ালের গরু। তবে ওরই মধ্যে তপু আর ট্যাঁপার সাপে-নেউলে সম্পর্ক। এ পূবে গেলে ও
পশ্চিমে যায়। আর বিল্লি একটু নিরীহ ধরনের। সবারই মন জুগিয়ে চলতে ভালোবাসে। তাই দু’জনকেই খুশি করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। বিল্লির ধারণা স্বর্গ অনেক উঁচুতে
তো তাই সেখান থেকে নামতে গিয়ে একটু বেশি জোরেই দাদু লাফ মেরেছেন বুঝি। এই শুনে তপু
দাঁত কিড়মিড় করে ফের প্রশ্ন তুলেছিল ঠাকুর্দা লাফালেনই যদি তবে গোয়ালঘরের চালে
কেন! সটান চিলেকোঠার ঘরের মাথাতেই লাফাতে পারতেন। বিল্লির কথায় একটু আশার আলো
দেখতে পেয়ে ট্যাঁপা আরেকবার মরিয়া চেষ্টা করে আত্মপক্ষ সমর্থনের। বলে, “ঠাকুর্দার চশমাটা তো বাড়িতেই থেকে গেছে। ঠাকুমা নিজের তোরঙ্গয় পুরে খাটের
তলায় রেখে দিয়েছে নাকি ঠাকুর্দার ব্যবহারের নানা জিনিস। সেইজন্যই ঠাকুর্দা অত উঁচু
থেকে ঠিক টার্গেট করতে পারেনি কোনটা চিলেকোঠার ছাদ আর কোনটা গোয়ালঘরের।”
একটা
হাতাহাতির উপক্রম হওয়ার আগেই আমি থামাই এই বলে যে, “ছাদে কে
ঝাঁপ দিয়েছিল সেটা বড়ো কথা নয়। ট্যাঁপার কথামতো ঠাকুর্দার ভূত হতে পারে, আবার
রতনকাকা কাল বাঁশের লগা দিয়ে যে হনুমানটাকে পেয়ারা গাছ থেকে খেদিয়েছিল সেটাও হতে
পারে। আসল কথা হল বড়োরা আমাদের ‘চিলেকোঠার ঘরে কী করছিলি’
জিজ্ঞেস করামাত্রই যে তোরা ‘একতাই বল’ ভুলে গিয়ে হাঁউমাঁউ করে এ ওর ঘাড়ে দোষ দিতে শুরু করলি সেটা কি ঠিক হল?
এমন করলে এই রাবণের গুষ্টির মতো বড়ো সংসারে আমরা নিজেদের দাবিগুলো
টিকিয়ে রাখতে পারব তো? নাকি চিরকালই বড়োদের কানমলা খেয়ে যাব?”
আমার
লম্বাচওড়া গেরামভারী বক্তিমে শুনে তিন মক্কেলই আর কথা না বাড়িয়ে লজ্জায় রাঙা হয়ে
ব্যাজারমুখে অঙ্কে মন দিল।
তো
এই হলুম আমরা চারমূর্তি। নিজের মুখে নিজের সুনাম করতে চাইনে, কিন্তু আমি ওই চার জনের
দলের দলপতি গোত্রের হুব্বা খানিকটা। ফেরত আসি ঠাকুর্দার কথায় যাঁর অশরীরীর সঙ্গে
আমাদের মোলাকত হতে হতেও হয়নি একটা গোদা হনুমানের জন্য। ঠাকুর্দার নানারকম বিচিত্র
গুণের মধ্যে একটা ছিল বাড়ির খুদে সদস্যগুলোর নামকরণ। তাদের প্রতিবাদ করার গলা নেই;
তাদের মা-বাপেরা সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত, তাই ডাকনাম নিয়ে
মাথা ঘামানোর সাধ বা ফুরসত দুটোর কোনোটাই নেই। সেই সুযোগে ঠাকুর্দা একের পর এক
নাতি-নাতনির শৈশব দুর্বিষহ করে তুলেছেন বিটকেল সব নামের খোঁচায়। আমাদের সব্বার বড়ো
দিদি, বড়োজেঠুর বড়ো মেয়ে, ব্যাবসাদার আপন দিদি, সব্বার আগে কপাল পোড়ে তার। আর ঠাকুর্দারও নামেখড়ি অর্থাৎ নামকরণের
হাতেখড়ি শিখাদিদি মানে বড়োদিদিকে দিয়েই। বড়দি জন্মেছিল বর্ষাকালে, তাই ছোটো
থেকেই সর্দির ধাত। ঠাকুর্দা একদিন তাকে ডাকলেন শিকনি। শিখা থেকে দিদি উড়োজাহাজের
গতিতে হয়ে গেল শিকনিদি। সারাজীবন সর্দি আর ‘শিকনি’ নিয়ে ভুগে অবশেষে এই সেদিন বিয়ের পর বড়দি হুমকি দিয়েছে এ বাড়ির কেউ যদি
ওর নতুন শ্বশুরবাড়ির লোকের সামনে ‘ও শিকনি, জামাইয়ের পাতে
আরেকটা মাছের মুড়ো দে’ বলে ডাক দেয় তাহলে সে বাপের বাড়িকে
ত্যাজ্য বাপের বাড়ি ঘোষণা করবে।
বয়সের
হিসেবে বড়দির পরের জন হল মেজোজেঠুর বড়ো ছেলে, লালনদাদা। লালনদাদার মা মানে আমাদের মেজোজেঠি,
দাদার কোমরে সর্বদা একটা তামার কয়েন লাল ঘুনসি দিয়ে বেঁধে রাখতেন।
একদিন দাদা শুধু ইজেরটি পরে খেলছে দাওয়ায়, এমন সময় ঠাকুর্দা সেখানে বসে মুড়ি
চিবোতে চিবোতে বললে, “এই লালতামাং,
হেঁশেল থেকে একটা কাঁচালঙ্কা নিয়ে আয় তো!”
ব্যস!
দাদার কপাল পুড়ল। দাদার চোখগুলোও নেপালিদের মতো একটু ছোটো ছোটো ছিল কিনা!
একে
একে সব ভাইবোনদের নামের সাড়ে সর্বনাশ ঘটিয়ে ঠাকুর্দা থামলেন ঠিক তপু জন্মাবার মাস
আষ্টেক আগে, পাকস্থলীর আলসারে অল্প দিন ভুগেই সব শেষ। এরপর ধরাধামে এলাম আমরা
চারমূর্তি, তপু, ট্যাঁপা, তারপর আমি আর
বিল্লি। তপু আর ট্যাঁপা আমার সেজজেঠুর দুই যমজ ছেলে। জন্মানোর পর পর দু’জন এক্কেবারে একরকম দেখতে ছিল। আলাদা করে চেনা যেত না, নাম ছিল তপু আর টুপু। একদিন দু’জনের একজন দুম করে
পড়ল খাট থেকে। কপালের এক পাশটা ট্যাঁপারির মতো ফুলে গেল। শোধ নেওয়ার জন্য নাকি
জানিনে, শিকনিদিদি আর লালতামাংদাদা মিলে তারপর থেকে ওকে ডাকতে শুরু করল ট্যাঁপা
বলে। তপু টুপু হয়ে গেল তপু আর ট্যাঁপা।
তপু
আর আমি জোর বাঁচা বাঁচলেও ফেঁসে গেল বেচারি বিল্লি। বিল্লি আমাদের বড়োপিসির মেয়ে।
বড়োপিসেমশাই মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ, তাই বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরেই থাকেন।
পিসের মা-বাবা বহুকাল আগেই গত হয়েছেন। চার ভাই যে যার আলাদা সংসার। পিসিকে তাই
ঠাকুর্দা নিজের বাড়িতেই রেখে দিয়েছিলেন। আমাদের বড়োপিসেমশাই খুব মজাদার মানুষ আর
পিসের চোখের মণি দুটো ছিল কটা, উজ্জ্বল পীতবর্ণ। নিজের বাবা-মা ছিল না বলে শ্বশুরকে
বাবার মতো ভালোবাসতেন পিসে। ঠাকুর্দাও নাকি বড়োজামাইটিকে বড়ো স্নেহ করতেন। মজা
করে বলতেন, “সুপ্রকাশ, তোমার যদি মেয়ে
হয় তবে তারও বিয়ে দিয়ে নাতনি নাতজামাই আমার কাছে রেখে দেব। কিছুই দেব না তোমায়। আর
তোমার মতো কটা চোখ হলে নাতনির নাম দেব বিল্লি।”
জন্মের
আগেই কপাল পুড়ল বেচারা বিল্লির। শ্বশুরের কথা মনে করে ওই ডাকনামটাই বহাল করলেন
পিসেমশাই মেয়ের জন্য।
যাই
হোক আমাদের কথা, ঠাকুর্দার কথা, অনেক হল, এবার
ফিরে আসি ব্যাবসাদার গল্পে। আগেই বলেছি ব্যাবসাদা আমাদের বড়োজেঠুর মেজো ছেলে।
মানে আমাদের শিকনিদির আপন মেজোভাই। ঠাকুর্দা বাকি সকলের নামকরণ যেমন নানা অভ্যাস
বা শারীরিক বৈশিষ্ট্য দেখে করেছিলেন ব্যাবসাদার নামটা ঠিক সেভাবে হয়নি। বরং নামটা
নানাপথে গড়িয়ে আজকে এই অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। ব্যাবসাদা যখন খুব ছোট্টটি তখন একবার
মাটির উঠোনে পেয়ারাগাছের গোড়ায় খেলতে খেলতে একটা বড়োসড়ো পেয়ারাপাতা কচি কচি
হাতে করে ধরে চিবোতে শুরু করেছিল। অদূরেই ঠাকুর্দা দাওয়ায় বসে পরোটা আর কালোজিরে
দিয়ে সাদা আলুর চচ্চড়ি খাচ্ছিল। হয়তো ঠাকুর্দাকেই নকল করছিল নাকি কে জানে। আর যায়
কোথায়! ঠাকুর্দা বলে উঠল, “বড়ো বৌমা,
তোমার ব্যাবলা যা পেয়ারাপাতা চিবোচ্ছে, দু’দিন বাদে না ব্যা ব্যা করে ডাক ছাড়ে!”
এখানে
বলে রাখি বড়োজেঠুর বড়ো ছেলে, মানে শিকনিদি আর ব্যাবসাদার মাঝের দাদার নাম ঠাকুর্দা
রেখেছিল তবলা। দাদার মাথায় জন্মের অনেকদিন পর অবধিও নাকি চুল ছিল না, কাজেই
ঠাকুর্দার রসিকতা থেকে তাকে বাঁচায় কার সাধ্য!
শিখার
নাম শিকনি, দেওরপো লালনের নাম লালতামাং এবং ফের নিজের ছেলের নাম তবলা হয়ে যাওয়ার পর
বড়ো জেঠিমা আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। তাই মেজো ছেলে জন্মাতে তবলার সঙ্গে মিলিয়ে
হাবলা গোবলা এসব নামকরণ হয়ে যাওয়ার আগেই ঝটপট তার ডাকনাম রেখে দিয়েছিল বুবলা। কিন্তু সবই ওই কপাল আর
শ্বশুরের খেয়াল।
ছেলের
ডাকনাম বুবলা থেকে হয়ে গেল ব্যাবলা। দিন যায়, শিকনি লালতামাং তবলা ব্যাবলা সব বড়ো
হয়। ব্যাবলার মধ্যে অদ্ভুত প্রতিভা দেখা দেয়। সে যা পায় তাই বেচে দেয়। কখনও পয়সার
বিনিময়ে, কখনও জিনিসের বদলে, কখনও বা কোনো খাটুনির কাজ করিয়ে নেওয়ার বদলে। তার
সর্বপ্রথম খদ্দের হল ভাইবোনেরা। মার্বেলটা ব্যাট-বলটা ঘুড়ি-লাটাইটা এই সব এক
বিকেলের জন্য ধার দেওয়ার বদলে খাবার সময় ডিমের কুসুমটা মাছের মুড়োটা মাংসের
ঠ্যাংটা বাগিয়ে নেয়। কখনও বা নিজের চুরি করা আচারের ভাগ দিয়ে তার বদলে উচ্ছেসেদ্ধ
চিরতার জল ভাইবোনেদের গিলিয়ে দেয়। এগুলো তো তাও ছিঁচকে কাজ। ব্যাবলা যত বড়ো হতে
লাগল তত আরও আরও প্রতিভার ছাপ রাখতে শুরু করল। ইস্কুলে অন্য ছেলেদের অঙ্ক দেখানো, পরীক্ষার সময়
টুকলি কাগজ সাপ্লাই করা এইসবের বিনিময়ে টুকটাক পয়সা নেওয়া শুরু করল। অতি চালাক ব্যাবলাদার
ফাঁদে পা দিয়ে ছেলেপিলেরা টিফিনের আলুকাবলি খাওয়ার পয়সা জমিয়ে ব্যাবলাদাকে
গুরুদক্ষিণা দিয়ে তার বদলে না পড়ে টুকে পরীক্ষায় পাশ করতে লাগল। ব্যাবলাদা
ইস্কুলে নতুন সাইড বিজনেস শুরু করল। যে পেয়ারাপাতা চিবিয়ে ব্যাবলা নাম পেল দাওয়ার
সেই পেয়ারা গাছের পেয়ারা রোজই ব্যাগে করে নিয়ে গিয়ে ইস্কুলে বিক্রি করতে শুরু করল
সস্তায়। ভাইবোনদের কাউকে গাছ থেকে পেয়ারা খাওয়া তো দূর, ছুঁতেও দিত না।
এমন
গুণের খবর হল গিয়ে ছাইচাপা আগুনের মতো। কিছুদিন পর ব্যাবলাদার ইস্কুলের
ভূগোলের অবনী স্যার তথা মেজোজেঠুর ছোটোবেলার বন্ধুর মারফত সেই ছাইচাপা আগুনের
ধোঁয়া বাড়ি অবধি উড়ে এল। আর যায় কোথায়! বড়োজেঠু আর মেজোজেঠুর জোড়া কঞ্চির বেত
ভাঙল ব্যাবলাদার পিঠে। ঠাকুর্দা মানুষটা রগড় করে মজার মজার নাম দিয়ে জ্বালাতন
করলেও নাতি নাতনিদের বড্ড ভালোবাসতেন। সবার মারমুখী হাত থেকে ব্যাবলাদাকে উদ্ধার
করার পর তার পিঠে নিজের হাতে তুলোয় করে লাল ওষুধ লাগাতে লাগাতে ঠাকুর্দা বললেন, “বুঝলি ব্যাবলা,
তোর নামটা আমিই ভুল দিয়ে ফেলেছি। তাই তোর এত ভোগান্তি! আজ থেকে তোকে আমি ব্যাবসা
বলে ডাকব। যার মাথায় এত সদাগরি বুদ্ধি তার নাম ব্যাবসা না হয়েই যায় না!”
ব্যাবলাদার
মাথার যে চার আনাটুকু সুস্থ ছিল সেটুকুও গেল ঠাকুর্দার কথা শুনে। বাকি সব ভাই
বোনেরা নিজেদের ডাকনামগুলোকে চরম অপছন্দ করলেও ব্যাবলাদা নিজের নতুন নামটিকে
মনেপ্রাণে আপন করে নিল। মনে মনে বলল, “আজ থেকে আমি ব্যাবসা দ্য ব্যবসাদার!”
* * *
এ
সবই অবশ্য আমাদের জন্মের আগের ঘটনা, তাই আমরা যা শুনেছি ওই বেশিটাই ব্যাবসাদার
মুখে, অল্পস্বল্প এর ওর তার থেকে। সেইদিনের পর থেকে ব্যাবসাদা ব্যবসায়
নিবেদিতপ্রাণ। দিন রাত শয়নে স্বপনে জাগরণে ব্যাবসাদা নানারকম আইডিয়া খুঁচিয়ে বার
করতে থাকে মাথা থেকে। সেই আইডিয়ার ঠ্যালায় বাড়ির সকলের নাকানিচোবানি অবস্থা হলেও
ঠাকুর্দার প্রশ্রয়ের জন্য কেউ কিস্যুটি করতে পারে না। এর বছরখানেকের মধ্যে অবশ্য
ঠাকুর্দা ইহলোকের মায়া ত্যাগ করায় ব্যাবসাদার ব্যবসাদারীতে বেশ ভাঁটা পড়ে যায়।
কিন্তু ফল্গুধারার মতো ব্যাবসাদার মনে যে বাণিজ্যনদীর চোরাস্রোত বইছে তাকে আটকানো
কী মুখের কথা! তাই মাঝে মধ্যেই ব্যাবসাদার উদ্ভট নানারকম দোকানদারি চলতেই থাকে।
এতদিনে
অবশ্য ব্যাবসাদা অনেকটা বড়ো হয়ে গিয়ে, আমাদের মতো আরও গোটাকয়েক এণ্ডিগেণ্ডি
ভাইবোনেদের দাদা হয়ে গিয়ে ধারেভারে অনেকটা বেড়েছে। আগের মতো ছেলেমানুষি ব্যবসা আর
করে না। এখন নানারকম ভারিভরকম কথাবার্তা বলে সব ব্যবসা নিয়ে। সেদিন বিকেলে আমরা
চারমূর্তি কয়েত বেল মাখা জিভে চেটে টাকনা দিচ্ছি। তপু ট্যাঁপা যথারীতি কারটা কম
কার ভাগে বেশি সেই নিয়ে খেয়োখেয়ি করছে। নিরীহ বিল্লি বেচারি তাদের থামাতে নিজের
ভাগ থেকে একে একবার আর ওকে একবার দিতে দিতে পুরো কয়েত বেলটাই দান করে ফেলেছে
প্রায়। আমি ওদিকে চোখ দু’টো আধবোজা করে বেড়ালের পিঠেভাগের
মজা নিচ্ছি। বড়োসড়ো সমস্যা না হলে আমি নাক গলাইনেকো, মজা
নিয়েই ক্ষান্ত থাকি।
ব্যাবসাদা
হঠাৎই ছাদে এসে হাজির। এসেই আমার হাত থেকে নুন তেলে জারানো কাঁচালঙ্কা দেওয়া
কয়েতমাখাসহ খোলাটা টেনে নিয়ে বলল, “ব্যবসাটা একটা আর্ট বুঝলি! সবার দ্বারা হয় না।
এবার তাই ঠিক করলাম ওই আর্ট নিয়েই কাজ করব। ছবি! মডার্ন আর্ট! বুঝতে পারলে যা দাম,
বুঝতে না পারলে তার চার গুণ বেশি দাম।”
আমার
এমনিতেই রাগটা বেজায় ধরেছিল, তাই ফোড়ন কাটলুম, “কিন্তু তুমি তো একদম আঁকতে পারো না বলেই তো উচ্চমাধ্যমিকে জীবনবিজ্ঞানে...”
আমার
কথা শেষ হওয়ার আগেই ব্যাবসাদা আমায় থামিয়ে বলল, “কোথায় মডার্ন আর্ট আর কোথায় ব্যাঙের
পৌষ্টিকতন্ত্র! বাঙালীর এই জন্যই ব্যবসা হল না! শুধু শিল্প শিল্প করলেই হবে?
শিল্পকে বেচতেও তো হবে! তবেই না লক্ষ্মী সরস্বতী দুই বোনে ঘরের
উঠোনে চু-কিতকিত খেলবে। তোরা দেখ শুধু, যা ব্যবসা করব না আমি!
তাক লাগিয়ে ছাড়ব!”
তাক-ই
লাগল বটে। পুরোনো ভাঁড়ার ঘরের তাকে তাকে রঙ তুলি ক্যানভাস জমতে লাগল। ইজেলে
ক্যানভাস দাঁড় করিয়ে বায়োলজি প্র্যাকটিক্যালের পুরোনো অ্যাপ্রন পরে ব্যাবসাদা আঁকা
শুরু করল। এমন ছবি আঁকতে হবে যার মানে বোঝা যাবে না! ডান হাত বাঁ হাত মায় দাঁতে
করে তুলি ধরে নিনজা টেকনিকে আক্রমণ শুরু করল ক্যানভাসের ওপর। কখনও চোখ বেঁধে, কখনও
দশ হাত দূর থেকে সার্কাসের ছুরির খেলার মতো তুলি ছোঁড়ে ক্যানভাসে। কখনও আবার
ছোটোকাকার আড়াই বছরের মেয়ে তিতলির হাতে তুলি দিয়ে তাকে ক্যানভাসে বেদম আঁকচেরা
কাটতে দেয়। কানে বিড়ির মতো তুলি গোঁজা। অ্যাপ্রন টপকে রঙের ছিটেয় ব্যাবসাদার মুখ
হাত চুল সব রঙিন রামধনু হয়ে গেছে। মাসখানেক এই রঙদার দমদার লড়াইয়ের পর ব্যাবসাদা
গোটাকুড়ি চিত্রবিচিত্র ক্যানভাস নিয়ে মোড়ের মাথায় দিনুদার চায়ের ঠেকের ভাঙা
বেঞ্চে দোকান দিল।
একদিন
দু’দিন
তিনদিন... শেষমেষ এক হপ্তা পর দিনুদা কাঁচুমাঁচু মুখে দুটো লেড়ো বিস্কুট আর মাটির
ভাঁড়ে চা দিয়ে ব্যাবসাদাকে বলল, “ব্যাবসা
দাদাবাবু, এগটা কতা কই কিচু মনে কইরেন না। এই অপ্দ্যাবতার মতো ছবিগুলান দেকলে পরে
আমার দোকানটেয় মোট্টে খদ্দের আসচেনেকো। যদি অন্য কোতাও...”
অগত্যা
ব্যাবসাদার সেই ভয়ঙ্কর সব মডার্ন আর্টের নমুনা আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের সকলের
ঘরের দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের পাশে একটা করে শোভা পেতে লাগল। একমাত্র তিতলি
ছাড়া এই ঘটনায় কেউ বিশেষ খুশি হতে পারল না।
এদিকে
মাথায় রঙের কুটকুটুনির জ্বালায় ব্যাবসাদা গেল জগন্নাথের সেলুনে। সেলুন থেকে
কদমছাঁট দিয়ে ফিরে মিয়োনোমার্কা ব্যাবসাদা কেমন হঠাৎ চনমনিয়ে উঠল। ফের ভাঁড়ারঘরের
তাকের রঙ-তুলি-ক্যানভাস-ইজেলের জায়গা ফাঁকা হয়ে সেখানে নানা রকম আকারের আয়তনের কাচের
শিশি। কোনোটা ফাঁকা, কোনোটায় নানা বর্ণ গন্ধ গাঢ়ত্বওয়ালা তরল। এতেই রক্ষে নেই, শেকড় বাকড় পাতা
ফুলও হাজির হল। কাচের বিকারের তলায় বুনসেন বার্ণার জ্বেলে সাংঘাতিক বৈজ্ঞানিক
পরীক্ষা চলতে লাগল। গন্ধে টেকা দায়। বাড়ির লোক ব্যাবসাদার মাথা থেকে ব্যবসার ভূত
নেমে বিজ্ঞানের বাই চেপেছে ভেবে নিজেদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। আমরা
চারমূর্তি থাকতে না পেরে চেপে ধরলুম ব্যাবসাদাকে। বিজ্ঞান না কচুপোড়া, কী বেচবার ফিকির করছে বলতেই হবে।
ব্যাবসাদা
অতি সাবধানি হাতে ভাঁড়ার ঘরের দরজায় খিল এঁটে বলতে শুরু করল, “জগন্নাথের সেলুনে চুল
কাটতে গিয়ে লাইন দিয়ে বসে থেকে থেকে বুদ্ধিটা মাথায় এল বুঝলি। বয়সকালে জীবনের
সবচেয়ে বড়ো সমস্যাটা কী, জানিস? রোগজ্বালা
অসুখবিসুখ নয়, চুল পাকা আর টাক পড়া। হাজার হাজার টাকা লোক
টাকের পেছনে ঢালছে। আর সাদা চুলের ক্যানভাসে কালো করার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মডার্ন আর্ট
আর কিছু নেই বুঝলি? তাই আমি ঠিক করছি চুল কলপ করার আর টাকে
চুল গজানোর তেল বার করব। এমন কলপ হবে চুলে যে, সে রং কাপড়
কাচা সাবান দিয়ে ঘষলেও উঠবে না। আর টাকে এমন চুল গজাবে যে লোহার চিরুনি লাগবে
আঁচড়াতে।”
ব্যাবসাদার
এ হেন বিজনেস প্ল্যান শুনে আমাদের চারমূর্তির বাক্যি হরে গেছে। এ ওর মুখ চেয়ে
সুড়সুড় করে ভাঁড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম।
এরপরের
কাহিনি বড়ো দুঃখের। কতকটা কী হইতে কী হইয়া গেল, কেহই তল পাইল না, ধরনের কাণ্ড ঘটল। ফের দিনুদার চায়ের ঠেকে ব্যাবসাদা শিশিবোতল সাজিয়ে বসল।
টাকে চুল গজানোর আর পাকাচুল কাঁচা করার মহৌষধ। তপু-ট্যাঁপার বাবা মানে সেজোজেঠুর
বন্ধু অনিমেষজেঠু আর আমার বাবার বন্ধু নরেনকাকু, আরও সব বাবা জ্যাঠাদের বন্ধুরা
যাদের মাথার চুল পাতলা হতে শুরু করেছে, রুপোলি রেখা দেখা
দিতে শুরু করেছে সবাই-ই দিনুদার ঠেকে চা খেতে এসে ব্যাবসাদার ওষুধ কিনে নিয়ে গেল,
বাবা-জ্যাঠাদের হাজার বারণ সত্ত্বেও। ভেবেছিল বুঝি বাবারা হিংসে করে
শুধু নিজেরাই ভালো ভালো ওষুধ মাখার ধান্দা করেছে। কিন্তু ঠিক এক সপ্তাহ পরে
অনিমেষজেঠু আর নরেনকাকু এসে বৈঠকখানার ঘরে হাজির। একজন নিজের মাথার
টাকের দিকে আঙুল দেখিয়ে ভেউভেউ করে কাঁদে তো অন্যজন কুচকুচে কালো মাথা দেখিয়ে রাগে
চেঁচায়।
আমরা
পড়ি কি মরি করে ব্যাবসাদাকে ডাকতে গিয়ে দেখি সে ভাঁড়ারঘরে লুকিয়ে বসে। আমরা
ডাকতে ভ্যাবলা হেসে বলল, “আসলে অনিমেষকাকুর পাকা চুলের ওষুধ আর নরেনকাকুর টাকে চুল গজানোর ওষুধের
শিশি দুটো উলটোপালটা দিয়ে ফেলেছিলুম।”
ও
হরি! ওই একজনের টাকে চুল গজানোর ওষুধের ঠেলায় অন্যজনের পাকাচুল সব ঝরে গেছে। আর
যার টাকে চুল গজানোর কথা সে অন্যজনের পাকা চুল কালো করার তেল মেখে মাথায় পোড়া
ভাতের হাড়ির মতো রং করে বসে আছে।
আগের
বারের মডার্ন আর্ট দেয়ালে ঝুলিয়ে বাবা-জ্যাঠারা ক্ষান্ত দিলেও এবারে এত সহজে ছাড়
পেল না ব্যাবসাদা। কঞ্চির বদলে পিঠে চ্যালাকাঠই ভাঙত, নেহাতই ঠাকুমা বাঁচাল তাই।
তবে রোজ রোজ ব্যবসার এত লাভ লোকসানের ঠ্যালা সামলাতে না পেরে ব্যাবসাদাকে
ছোটোকাকার শ্বশুরবাড়ি সেই আসামে কাকিমার বাপের বাড়ির কাঠের ব্যবসার কাজে পাঠিয়ে
দেবে বলে মনস্থির করল সবাই।
* * *
ব্যাবসাদার
এই গতি আমরা কেউই মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না। শেষমেষ বড়োজেঠিমা বাবা-জ্যাঠাদের
লুকিয়ে শিকনিদির শ্বশুরবাড়ির পাড়ার নামকরা ফটিক ওঝার বাড়ি খবর পাঠালেন। সেই
ছোটোবেলা থেকে যে ব্যবসাভূত চেপেছে ছেলের মাথায় এটাই তার একমাত্র দাওয়াই। সোমবারের
সকালে সবাই আপিসকাছারি বেরিয়ে গেলে পরে এল ফটিক ওঝা। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমরা
চারমূর্তি দাঁত ঝনঝন পেট কনকন মাথা টনটন নানা অজুহাতে ইস্কুল কামাই করলাম সেই
দৃশ্য দেখব বলে। নেহাতই ছাপোষা লোক ফটিক ওঝা। একটা কালো ফোলিওব্যাগ বগলে বীমা
কোম্পানির এজেন্টের মতো খানিকটা। সে এসে সোজা গিয়ে হাজির ভাঁড়ারঘরে যেখানে
ব্যাবসাদাকে চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে বাড়ির মহিলামহল। ঠাকুমা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে
বললে,
“ছেলেটাকে বেশি কষ্ট দিও না বাবা।”
ফটিক
ব্যাগটা খুলে আকুপাংচারের মতো ক’টা ছুঁচ বার করে প্যাঁক প্যাঁক করে ব্যাবসাদার এদিকে
ওদিকে কয়েকবার ফুটিয়ে দিল। তিরিক্ষে ঝাঁঝালো গন্ধওয়ালা এমন একটা বিতিকিচ্ছিরি
জিনিস শোঁকালো ব্যাবসাদাকে যে বেদম হাঁচি শুরু হল, আর থামেই না। ফোলিও ব্যাগ
গুটিয়ে নিয়ে ফটিক বললে, “ঠাগমা! আপনাদের
ছেলে একন তিনদিন হাঁচবে। হেঁচে হেঁচে ওই সব ভূত ছুঁচের ফুটো দিয়ে বেইরে যাবে। আমার
দক্কিনাটা...”
এই
বলে কড়কড়ে পাঁচটি হাজার টাকা নিয়ে ফটিক ধাঁ।
ছাদের
চিলেকোঠার ঘরে বসে ব্যাবসাদার অনর্গল হাঁচির মধ্যেই তপু বলে চলে, “সব বুজরুকি,
পয়সা লোটার ছল। আমরা যখন প্ল্যানচেট করে ঠাকুর্দার ভূত নামাতে গেলুম
তার বেলায় কানমলা খেলুম আর ওই ফটকে ওঝা ব্যাবসাদাকে হাঁচিয়ে ভূত ঝেড়ে পেল পাঁচ হাজার
টাকা!”
ট্যাঁপা
বলল, “আমার মনে হয় সব কিছুর মূলে ওই ঠাকুর্দাই। ঠাকুর্দা যদি ব্যাবসাদার নাম
ব্যাবসা না রাখত তাহলে তো ওর মাথায় ব্যবসার ভূত চাপত না! চল না আরেকবার প্ল্যানচেট
করি। এবার চিলেকোঠার মাথায় একটা লাল নিশানা রেখে দেব যাতে ঠাকুর্দা পথ চিনতে ভুল
না করে।”
তপু
যথারীতি খেঁকিয়ে বলল, “ঠাকুর্দার ভূত এসে কী করবে? ব্যাবসা ভূতের সঙ্গে
কবাডি খেলবে নাকি হাঁচি ভূতের সঙ্গে কুমিরডাঙ্গা খেলবে? তোর
যখন মাথায় চোট লেগেছিল তখনই আদ্দেক বুদ্ধি টায়ার লিক করা হাওয়ার মতো বেরিয়ে গেসল।
ওইজন্য এত বাজে বকিস ট্যাঁপা।”
বিল্লি
ব্যাবসাদাকে জেঠিমার পুরোনো কাপড়ের আরেকটা টুকরো ছিঁড়ে এগিয়ে দিতে দিতে বলে, “তোরা থামবি?
সোমুকে বলতে দে। সোমুর নাম ঠাকুর্দার নামে রাখা তাই ওর ডিসিশনই
ফাইনাল।”
হ্যাঁ
আমার নাম ঠাকুর্দার নামেই বটে। তাঁর নাম ছিল সোমেশ্বর। শিকনিদিদি তবলাদাদা কেউই
আমার নাম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে বেশি সাহস পায়নি, তাই সোমু হয়েই থেকে গেছি।
বেচারা
ব্যাবসাদাকে দেখে বড্ড মায়া লাগল, সত্যিই রুমালেও আর কুলোচ্ছে না হাঁচি। বললুম, “তা মন্দ বলেনি ট্যাঁপা, ঠাকুর্দার ভূত যদি সত্যি
সত্যি আসে তাহলে বলব একবার টাইম মেশিনে চেপে সেই ব্যাবসাদার পেয়ারাপাতা চেবানোর
দিনটায় যেতে। ঠাকুর্দার ভূতই একমাত্র জ্যান্ত ঠাকুর্দাকে বোঝাতে পারবে যাতে
বুবলাকে ব্যাবলা নামে না ডাকে। না থাকবে ব্যাবলা, না হবে ব্যাবসা আর না আসবে আজকের
এই দিনটা।”
তপু
খুঁতখুঁত করে উঠল, “ভূতেরা টাইম মেশিন কোথায় পাবে শুনি?”
কিন্তু
তপুকে থামিয়ে ব্যাবসাদা চেঁচিয়ে উঠল ‘ই উ রে কা!’ তাকিয়ে
দেখি তার হাঁচি থেমে গেছে, চোখমুখ জ্বলজ্বল করছে। বলে উঠল, “অ্যাদ্দিনে আমি সঠিক ব্যবসার সন্ধান পেয়েছি। ভূতের
ব্যবসা। ভূতই সকলের ভূত ভবিষ্যৎ বাতলে দেবে। ওই ব্যাটা ফটিক ওঝা পাঁচ মিনিট অং বং
চং করে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে গেল পকেট কেটে। হেঁচে হেঁচে ভূত বেরোবে! ব্যাবসা দ্য
ব্যবসাদারকে বিজনেস শেখাতে এসেছে ফটিক ওঝা! কই তোরা শিগগির সব প্ল্যানচেটের
সরঞ্জাম পাত দেখি। ঠাকুর্দার আশীর্বাদ নিয়েই শুরু করব নতুন ভূত-ব্যবসা।
হ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁচ্চোওও!”
ব্যাবসাদার
মুখের কথা আর নাকের হাঁচি খসামাত্র কে যেন দুড়ুম করে লাফ মারল গোয়ালঘরের ছাদে।
বরদাসুন্দরীর বকনা বাছুরটা হ্যাম্ব্যাঁঅ্যাঁ করে কঁকিয়ে উঠল। আর ছাদের কার্নিশের কাসুন্দির
বয়ামটা পড়ে ঝনঝন করে চুরমার হয়ে গেল।
----------
ছবি – সুকান্ত মণ্ডল
[বিঃ দ্রঃ ম্যাজিক ল্যাম্প
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি বানানবিধি অনুসরণ করে। সেই অনুযায়ী Business অর্থে ‘ব্যবসা’ ভুল বানান, সঠিক বানান ‘ব্যাবসা’ – মূল শব্দ
‘ব্যবসায়’-এর কথ্য রূপ। গল্পের স্বার্থে এখানে পুরোনো বানান ‘ব্যবসা’ রেখে দেওয়া
হয়েছে।]
No comments:
Post a Comment