ভুলোদার ভূত ধরা
মহুয়া ব্যানার্জী
এক
পাড়াময়
হই চই পড়ে গেছে। ভুলোদা নাকি প্রতিজ্ঞা করেছেন পাড়ায় যে ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে
তা নাকি তিনি সমাধান করবেন। আজ একমাস হল পাড়ার অনেকেই নাকি সন্ধের পর আদাড়ে বাদাড়ে
ভূত দেখতে শুরু করেছে। যারা যারা ভূত দেখেছে তাদের বাড়ি থেকে নানা খাবারদাবারও
উধাও হয়ে গেছে সেই সময়। সে সব শুনে পাড়ার বয়স্করা সিদ্ধান্তে এসেছেন যে এ নাকি পেটুক
বলরামের ভূত। কবে মরে ভূত হয়েছে তবু লোভ মরেনি। আসলে সেবার রথের মেলায় বাজী ধরে একশোটা
চপ, দু’কিলো কাঁঠাল, সাড়ে পনেরো কেজি জিলিপি আর মাত্র দুশোটা রসগোল্লা খেয়ে বাড়ি
ফিরে তিন সের ঘন দুধের পায়েস খেয়ে ফেলেছিলেন। তারপর সেই যে ‘হেউ হেউ হিয়াক,
হুইইয়া্ক, হেউ হেউ’ করে বিচিত্র শব্দের গোটা তিনশো ঢেকুর তুলে ঘুমোলেন, আর সে ঘুম
ভাঙেনি। দু’কিলো রাবড়ি লুকিয়ে রেখেছিলেন, সেটা আর খাওয়া হয়নি। তাই নাকি তার অতৃপ্ত
আত্মা ফিরে এসেছে। পাড়ার লোকেরা ভূত দর্শনের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাই পালা করে
এখন ভালো ভালো খাবারদাবার ভূতের উদ্দেশ্যে রেখে দেন। জায়গা অবশ্য ভূতবাবাজিই বলে
দিয়েছিলেন। সে হল গিয়ে এক সপ্তাহ আগের কথা। সেদিন
ঘোর অমাবস্যার রাতে ঘোষ গিন্নি উঠোন পেরিয়ে কলঘরে যাচ্ছিলেন প্রকৃতির ডাকে। সেই
সময় তিনি তার ছানি পড়া দুই চোখে মোটা কাচের চশমার ভেতর দিয়ে পষ্ট দেখলেন এক দল
নেংটি পরা কঙ্কালসার ভূত কলঘরের পাশের নিমগাছের তলায় নেত্য করছে। তিনি এসব দেখে
মুচ্ছো যাবেন যাবেন করছিলেন, সেই সময় কে যেন কচি, নাকি গলায়
ছড়া কাটল -
‘হিহি হিহি চিঁহি,
মনটা আমার মিহি।
শ্মশান ঘাটের পাশ
আমার বসবাস।
যদি দাও আমায় ভোজ,
তবে দেব না দেখা রোজ।’
এইসব
দেখে শুনে ঘোষ গিন্নি ‘ও কত্তা ও কত্তা’ বলতে বলতে একেবারে শোবার ঘরে সরুপানা ঘুমন্ত
কত্তার টিংটিঙে পায়ের ওপর তাঁর চার মন দেহখানা নিয়ে ধপাস করে পড়লেন। সদ্য
অবসরপ্রাপ্ত দমকল কর্মী নরেশ ঘোষ ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে জেগে এমন অনাসৃষ্টি কাণ্ডতে
ঘাবড়ে গিয়ে পানি লাও, পাইপ লাগাও, আগুন, আগুন, এইও এইসব বলে চেঁচাতে লাগলেন। তারপর
একটু ধাতস্থ হতে গিন্নির মুখে সব শুনে খানিকক্ষণ হুতুম প্যাঁচার মতো থম মেরে বসে
রইলেন। তারপর সোজা অলিম্পিকে গোল্ড মেডেল পাওয়া দৌড়বীরের মতো এক ছুটে ঠাকুর ঘরে
গিয়ে সেই যে দোর দিলেন সকালের আগে আর খুললেন না। তার পরদিন গ্রামের বটতলার পাশে
নরু দর্জির দোকানের দরজায় ভূতের লেখা নোটিস আটকানো আছে দেখা গেল। সেখানে লেখা
‘গ্রামের শেষ প্রান্তে বড়ো ঝিলের পাশে যে জঙ্গল শুরু হয়েছে সেখানে পালা করে বেশ ভালোমতো
খাবার রেখে আসতে হবে।’ নিচে আবার বেশ হিজিবিজি করে ভূতের সইও আছে। সেই থেকে সবাই
মিলে খাবার রেখে আসতে শুরু করে, তাই ভূত বাবাজি আর কারও বাড়িতে হামলা করে না।
সবই
ঠিক চলছিল, বাদ সাধল ভুলোদা। যখন হাড়কিপটে ভুলোদার পালা এল, তখন তিনি প্রথমে অরাজি
হলেও সকলের কাকুতি মিনতিতে রাজি হলেন। সেদিন তার বাড়ি থেকে ভূতের জন্য দুটো ফুলুরি
রাখা হয়েছিল। ব্যস, তাতে ভূত বাবাজি অপমানে বেগুনি হয়ে আবার নোটিস দিলেন যে ভুলোদাকে শাস্তিস্বরূপ দু’দিন
ধরে প্রচুর ভালো খাবারদাবার রাখতে হবে। এই নোটিসে বেদম খেপে ভুলোদা ভীষণ প্রতিজ্ঞা
করলেন যে ভূতকে তিনি ধরে জেলে পুরেই ছাড়বেন।
সকলে
তাকে বারণ করলেও তিনি শুনবেন না। এমনিতে ভুলোদা সব কিছু ভুলে যান। ছোটো বেলায়
মাথায় তাল পড়ে নাকি তার ঘিলু নড়ে গিয়েছিল। তারপর থেকেই
মাঝে মাঝেই কোনো না কোনোভাবে ধাক্কা খেয়ে তার ঘিলু নড়ে যায়। আর তার ফলে গোটা
কচিপাঁঠা পাড়াকে তার ফল ভুগতে হয়। কিন্তু এবারে তিনি কিছুতেই ভুলছেন না তার
প্রতিজ্ঞার কথা।
গ্রামে
সকলের মুখে ভুলোদার এহেন প্রতিজ্ঞার কথা শুনে বৃদ্ধ কবিরাজ মশাই খুক খুক করে কেশে
ভুলোদার সত্তর বছরের বুড়ি পিসিমাকে শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ভুলোর কি ঘিলু নড়া
রোগটা ইদানীংকালে বেড়েছে?” ব্যস, যায় কোথায়! কানে খাটো পিসিমা তো হাই মাউ করে
কান্না জুড়লেন, “ও গো কী সব্বোনাশ হল গোওওওও। আমার
ভুলোর আবার ঘিলু নড়েছে। কোবরেজ মশাই বলে দিয়েছেন এ আর সারবে নাআআ।” কবিরাজ
মশাই এই শুনে পুরো ভেবলে গেলেন। কানে কম শুনলে কী হবে, ভুলোদার পিসিমা খুবই রাশভারী ও জাহাঁবাজ মহিলা। তার দাপটে এই কচিপাঁঠা গ্রামের সকলেই খুব ভয়ে ভয়ে থাকে। চুরাশি বছরের বৃদ্ধ কবিরাজ হরেরাম বাবুর এমনিতেই পেটের ব্যারাম। পিসিমার এহেন অভিযোগে এবং যাত্রাপালার
রাবণ আর মহিষাসুরের সম্মিলিত আওয়াজের মতো চিৎকার করে কান্নার জেরে ওনার পেটের ভেতরটা কেমন গুড়গুড় করে উঠল। কাঁধের ঝোলা
থেকে টুক করে একটা ‘গুড়গুড়ি চুপ’ নামের বড়ি খেয়ে নিলেন। এটা ওনার নিজের আবিষ্কার।
আসলে কিন্তু হজমের আর পেটব্যথার ওষুধ মিশিয়ে বানানো, কিন্তু গাঁয়ের লোকেদের কাছে
নিজের সম্মান রাখতে এই ছল আর-কি। তা সেই বড়ি খেয়ে একটু মনে বল আর পেটে থল পেতেই তিনি
মিনমিন করে বলে উঠলেন, “যাচ্চলে! আমি আবার কখন এসব বললাম?” বলেই পাড়ার নাপিত ঘন্টের
দিকে সমর্থনের আশায় তাকালেন। ঘন্টে পিসিমাকে থামানোর জন্যে বেশ চেঁচিয়েই বলে উঠল, “আরে
না না, আজ ভুলোদা আমার কাছে চুল কাটতে এসেছিলেন। বটগাছের ছায়ায় ইটের ওপর বসে বেশ
আয়েশ করে চুল কাটাচ্ছিলেন। তা সেই সময় রামু ধোপার গাধাটা হঠাৎ ওনার বাঁ কানটা
চিবুতে শুরু করে। তাতেই ঘাবড়ে গিয়ে যেই ভুলোদা লাফ মেরে উঠতে যাবে, সোজা বটগাছের
ডালে ধাক্কা খেয়েছে। অমনি বটগাছের ফোকর থেকে একটা কাক মাথায় ঠক ঠক করে ঠোকর
মেরেছে। তাতেই মনে হয় আবার ভুলোদার ঘিলু নড়েছে।” একটানে
কথাগুলো বলে হাঁপ ছাড়ল ঘন্টে।
কাকে
কেন ঠোকর দিল? পিসিমার হুংকারে ঘাবড়ে গিয়ে ঘণ্টে বলে, “আমি কী জানি? বোধহয় ঠুকে
পরখ করে দেখছিল মাথাটা বাসা বানানোর উপযুক্ত কিনা।” সে
সব শুনে পিসিমার মনে হল সব দোষ রামুর গাধার। না ও কান চিবুবে, না কাকে ঠোকর মারবে,
না ভুলোদার ঘিলু নড়বে। ঘিলু নড়ল বলেই না বাছা আমার অমন ভীষণ প্রতিজ্ঞা করল। এই বলে
তিনি চললেন দারোগার কাছে রামুর গাধার নামে নালিশ করতে। তার পেছু পেছু গোটা পাড়ার
সব বয়সি ছেলের দলও চলল মজা দেখতে। চোর ডাকাতের নামে নালিশ করতে দেখে এসেছে এতদিন, কিন্তু
গাধার নামে নালিশ! সে না জানি কী ব্যাপার হবে। তাই সকলে মহা উৎসাহে থানার দিকে
চলল। মাঝপথে বদন ব্যান্ডওয়ালাও জুটে গেল। সে এক হই হই কাণ্ড শুরু হল মাছিমারা
গ্রামের কচিপাঁঠা পাড়ায়।
দুই
এদিকে
দারোগা ভোম্বলবাবু মুগের ডাল, আলুপোস্ত, চাপড়
ঘন্ট, পোনামাছের কালিয়া আর ইলিশ মাছ দিয়ে কচুর লতি সহযোগে সবেমাত্র
দু’থালা ভাত খেয়ে উঠেছেন। সেই
সকাল ন’টায় দু’ডজন লুচি আর আলুর দম খেয়ে চেয়ারে বসে বসে গ্রামের উন্নতির কথা ভাবছিলেন। তাই
তো তেনার দুপুরের আহার সারতে চারটে বাজল।
তারপর
থানার চেয়ারে বসে তিনি ওই অল্প একটু দিবানিদ্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এই
মাছিমারা গ্রামে এক মাস হল তিনি এসেছেন। বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা এই গ্রাম বড়োই
শান্ত। লোকজনও সাদাসিধে, ভালোমানুষ গোছের। চুরি-টুরি হয় না, কারণ মাত্র দুটি চোর
আছে এখানে। তারা দিনের বেলায় এই থানায় ঠিকে কাজ
করে, ফাইফরমাশ খাটে, গারদের ভেতর পরিপাটি বিছানা করে ঘুমোয় আর রাত হলে বাপ-ঠাকুরদার
শেখানো বিদ্যে ভুলে গেল কিনা পরখ করতে যায়, অর্থাৎ চুরি প্র্যাকটিস করে।
কিন্তু চুরির সব মাল এই থানাতেই নিয়ে জমা করে, কারণ এখানেই তাদের বাস। দিনের
বেলা গ্রামের লোক নিজেরাই এসে নিজেদের জিনিসপত্র খুঁজে বুঝে নিয়ে যায়,
দারোগাবাবুকে কোনোরকম বিরক্ত করে না। এরকমই চলে আসছে অনেকদিন ধরে। তিনি নিজেও তাই
এই ব্যবস্থায় আর আপত্তি করেননি। তাই বিনা পরিশ্রমে আর চার বেলা সুখাদ্যের কারণে
কোনো সমস্যা নেই।
কেবল
ওই কচিপাঁঠা পাড়ার ভূতের ব্যাপারটা ছাড়া। অবশ্য ওটা তার এক্তিয়ারে পড়ে না। ওই
ব্যাপারটার সমাধানের জন্যে তিনি চুপি চুপি পাতিরাম ওঝাকে খবর দিয়েছেন। কিছু একটা
সমাধান যে হবেই সে ব্যাপারে দারোগাবাবুর দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে পাতিরাম ওঝার ওপর।
কিন্তু ব্যাটাচ্ছেলে নাকি এখন গ্রামে নেই। তার মামিমার খুড়তুতো জামাইয়ের পাড়াতুতো
পিসিকে নাকি ‘ও মা গো’ ভূতে ধরেছে। তিনি নাকি থেকে থেকেই ‘ও মা গো’ বলে মূর্ছা
যাচ্ছেন। তাকে দেখতেই পাতিরাম মামাবাড়ি গেছে। কবে আসবে কে জানে! এই লকডাউন তো উঠল।
এবার বোধহয় আসবে। এদিকে থানার পেছনেই আবার জঙ্গল মতন আছে। সেটাই একটু ভয়ের।
এসব
ভাবতে ভাবতেই ভরা পেটে কেমন একটা ঝিমুনি আসায় দারোগা ভোম্বলবাবু একটু হালকা করে ঘুমিয়ে
পড়েছিলেন। সেই আবছা ঘুমের ঘোরে দারোগাবাবু দেখতে পেলেন গ্রামের লোকেরা যেন ব্যান্ডপার্টি
নিয়ে তাঁকে বরণ করে নিতে আসছে। সামনে একটা গাধা জোরে জোরে বলছে ‘দারোগা বাবু মাইকি
জয়।’
এই
ভারী ভালো ব্যাপারখানা দেখে তাঁর মোটা গোঁফের আড়ালে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল। গর্বে
বুক ফুলে উঠব উঠব করছে, সেই সময়ে কে যেন তাঁর কানে সুড়সুড়ি দিতে লাগল। তাঁর
আবার কানে কাতুকুতুর ধাত আছে। তাই
হি হি করে হেসে চোখ খুলতেই সামনে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখলেন। তাঁর
দিবানিদ্রার সুযোগে কচিপাঁঠা পাড়ার লোকেরা সদলবলে থানার ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
একপাশে
তাঁর থানার সবেধন নীলমনি দুই চোর খ্যাচা আর বোঁচা কেমন ভেবলে বসে আছে। ঘন্টে
নাপিত তার ঝোলা থকে কাঁচি বের করে বোঁচার অমন বাবুই পাখির বাসার মতো চুল কাটতে শুরু
করেছে। সেই শোকে মুহ্যমান হয়ে বোঁচা গালে হাত
দিয়ে হা করে কাঁদতে যাচ্ছিল। কিন্তু
কবিরাজ মশাই তার দাঁতে ব্যথা ভেবে একটা ‘দন্ত চমৎকার’ বড়ি টুপ করে তার মুখে ফেলে দিলেন। অমনি
বোঁচা চোখ বুজে হাসিমুখ করে ওটা চুষতে লাগল। বেশ
ঝাঁজ ঝাঁজ মিষ্টি মিষ্টি খেতে। এতে
করে বোঁচার চুল কাটতে ঘন্টের বেশ সুবিধা হল। সে গদগদ
ভাবে বলে উঠল, “আমার সেলুনে এবার এই খাইয়েই চুল কাটব।” এদিকে
এসবের মাঝেই বদন ব্যান্ডওয়ালা বেশ উৎসাহ নিয়ে তার জগঝম্প বাজনা বাজিয়ে চলেছে। সেই ‘প্যাঁ পোঁ, ঝিকি নাকি ঝম ঝম, ঢিক্কু
চিক্কা, ঢিক্কা চিকা’ বাজনার তালে তালে
গ্রামের লোকজন থানার ভেতরেই বেশ বিসর্জনের নাচ নাচছে। পিসিমা
হাত-পা নেড়ে প্রাণপণে কী একটা বোঝানোর চেষ্টা করছেন।
এই হট্টগোল
থামানো তাঁর কাজের মধ্যে পড়ে কি পড়ে না এইটা ভাবতে ভাবতেই সন্ধে নামল। ততক্ষণে
সবাই ক্লান্ত হয়ে এলিয়ে পড়েছে। রামুর
গাধা পুরোনো ফাইল পত্তরে মনোযোগ দিয়েছে। সেই
সময় হঠাৎ থানার পেছনের জংলা জায়গাটা থেকে ভুলোদার হুংকার শোনা গেল। যেন
কাউকে প্রচণ্ড ধমক দিচ্ছেন। সেই
শুনে সবাই ব্যস্ত হয়ে তখন সেদিকে ছুট লাগাল।
দূর
থেকে সবাই দেখতে পেল জঙ্গুলে জায়গাটায় কারা যেন নড়াচড়া করছে। ‘ভূ ভূ ভুউউউত’ বলে ঘন্টে আর রামু চেঁচাতে যাচ্ছিল,
কিন্তু দারোগাবাবুর এক ধমকে চুপ করে গেল। দারোগা
ভোম্বলবাবু ফিস ফিস করে বললেন, “ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। কাদের
এত সাহস হল যে আমারই নাকের ডগায় আমার থানার পেছনে আস্তানা গেড়েছে!” এই বলে সবাইকে নিয়ে
তিনি ঝোপঝাড় পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকলেন।
কিছুটা
গিয়েই সবাই থমকে দাঁড়াল। সামনেই জঙ্গলের
ভেতরে ত্রিপল আর বাঁশ দিয়ে কেমন একটা ছাউনি মতো করা। তার
নিচে কঙ্কালসার কতগুলো মানুষ অনেকটা জায়গা ছেড়ে ছেড়ে বসে। মাস্ক
পরা কিছু ছেলেমেয়ে সেই ভূতের মতো লোকগুলোর পাতে খাবার তুলে দিচ্ছে।
ঠিক
সেই জায়গাতেই ভুলোদা দাঁড়িয়ে রাগে গরগর করতে করতে চেঁচাচ্ছে। ঘন্টে
বলে, “আরে, এ তো ভূতেদের জন্যে দেওয়া খাবারগুলো।” ভুলোদা
বলে, “হতচ্ছাড়া, এরাই ভূত সেজে খাবার আদায় করে। দারোগাবাবু, এদের এখুনি জেলে পুরে দিন।”
ঠিক
তখনই ছেলেমেয়েগুলো পরস্পরের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে মাস্ক খুলতেই দেখা গেল, আর কেউ নয়,
তারা হল বিটকেল আর পাটকেল, ভূলোদার দুই বিচ্ছু ছেলে আর পাড়ার আরও কয়েকজন ছেলেমেয়ে। তাদের
সঙ্গে পাতিরাম ওঝাকেও সাহায্য করতে দেখা যাচ্ছে।
দারোগাবাবু
কিছু করা বা বলার আগেই পাটকেল বলে ওঠে, “এরা সবাই আশেপাশের গ্রামের
লোক। জনমজুরি করে, লোকের বাড়ি ফাইফরমাস খেটে, স্টেশনে, বাজারে ঠেলায় করে খাবার বিক্রি করে কোনোমতে পেট চালাত। কিন্তু
করোনা ভাইরাসের জন্য লকডাউনে এদের সেই কাজগুলোও আর নেই। কীভাবে
বাঁচবে এরা? তাই এদের বাঁচাতেই আমরা এই বুদ্ধি এঁটেছিলাম। এমনিতে
তো তোমরা কেউই সাহায্য করতে না।”
বিটকেল
বলে, “আমাদের বন্ধুরা সবাই আমাদের সঙ্গে আছে। পাতিরাম
ওঝা কাকুই তো ভূত সাজানোর বুদ্ধি দিল। ওঝা
কাকু কোথাও যায়ইনি। বড়ো ঝিলের পাশের জঙ্গল থেকে তোমাদের রাখা
খাবারগুলো আমরাই চুপি চুপি এখানে নিয়ে আসি রোজ। সব বুদ্ধিই
ওঝা কাকুর।” পাতিরাম ওঝা মুখ নিচু করে একধারে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবছে
এইবারে নির্ঘাত তাকে জেলে পুরে দেবেন দারোগাবাবু।
ভুলোদা
চেঁচিয়ে ওঠে, “গেল গেল সব গেল। বলি
এদের মাস্ক কই? শুধু ফাঁকা ফাঁকা করে বসলে হবে?”
পাটকেলের
এক বন্ধু বলে ওঠে, “যাদের খাবার কেনার পয়সা নেই তারা মাস্ক কী
করে কিনবে? আমরা শুধু এদের হাত ধোয়ার আর খাওয়ার ব্যবস্থা করতে
পেরেছি।”
বিটকেল
অমনি এক ধমক দিয়ে বলে, “নিজেদের মাস্ক কই? এই
যে এক গাদা লোক জন মিলে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছ। তোমরাই
তো করোনা ছড়াবে মনে হচ্ছে। সব নিয়মকানুন
জলাঞ্জলি দিয়ে আবার বড়ো বড়ো কথা।”
এ কথা
শুনে মাথা নিচু করে চুপ করে থাকেন দারোগাবাবু। তিনি
যে নিজের কাজটা আদৌ করেননি তা বেশ বুঝতে পারছেন। তাই
চুপ করে থাকা ছাড়া তার আর উপায় নেই। গ্রামের
সকলেও বেশ লজ্জিত। কেউ পকেট হাতড়ে মাস্ক বের করে, তো কেউ গামছায় মুখ ঢাকে।
“ছোটো
ছোটো ছেলেগুলোর এত বড়ো মন। অথচ
আমরা গ্রামের বড়োরা কেবল নিজেদের খাওয়াপরা নিয়েই ব্যস্ত,” বলে উঠল রামু ধোপা। সবাই
ওর কথায় লজ্জা পেল। এবার থেকে অকারণ খাওয়াটা কমাতে হবে দেখছি, মনে মনে বলেন দারোগাবাবু।
তারপর
বললেন, “পাটকেল, বিটকেল, তোমরা এইসব ফন্দি আঁটার
আগে আমায় বলতে পারতে। আমি
সাহায্য করতাম। যাই হোক, আজ থেকে গ্রামের সবাই মিলে এদের
থাকা খাওয়ার ভার নেবে। আমি তোমাদের
কথা দিলাম।” গ্রামের বাকিরাও সায় দিল দারোগাবাবুর কথায়। ভূত
ধরার প্রতিজ্ঞা যেভাবেই হোক রক্ষা হল বলে ভুলোদাও সব মেনে নিলেন।
থানার
পাশে আজকাল এক মস্ত ছাউনি হয়েছে। অসহায়
মানুষগুলো আজকাল ওখানেই দু’বেলা পেটপুরে খেতে আসে। দারোগাবাবুর
চেষ্টায় তাদের জন্য মাস্ক আর স্যানিটাইজারের ব্যবস্থাও হয়েছে। এখন
এই গ্রামে আর ভূতের উৎপাত নেই। সবাই
মিলেমিশে খুব ভালো আছে।
----------
ছবি – সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment