অ্যাডভেঞ্চার স্কোয়্যার
দেবলীনা দাস
১
বলরাম মুখুজ্যের অঙ্কের কোচিং ক্লাস ছুটি হওয়ার সময়টায় দোলতলার
মাঠ যেন ছোটোখাটো একটা মেলার রূপ ধারণ করে। বারো-তেরো বছর বয়সি দশ-পনেরোটা বাচ্চাকাচ্চা
মিলে যে অত্তখানি আওয়াজ বের করতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল।
ওদের মধ্যে সব চেয়ে নিরীহ চেহারার লিকপিকে ছেলেটাই দলটার অঘোষিত
পান্ডা। তার ডান হাত তারই মামাতো বোন, তার হাবভাব দেখলে মনে হয় কোনো
উচ্চিংড়ে বেজায় পুণ্য করে মনুষ্যজন্ম নিয়েছে। এক
মুহূর্ত কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়ানো তার ধাতে নেই। ঝালমুড়ি
আর আচার সহযোগে হাহা হিহি সারা হয়ে গেল যখন,
সাঙ্গোপাঙ্গরা সব বাড়ির পথ ধরল,
সবার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে এক পাক বাঁই করে ঘুরে নিয়ে সেই চিনি
বলল, “চল
ভটাই, ব্যানার্জী
ভিলায় যাই। সন্ধে হতে অনেক দেরি, একটু দেখে ঘুরে ঠিক সময়ে বাড়ি
পৌঁছে যাব’খন।”
অর্কপ্রভর ডাক নাম ভটাই কেন হল সে কথা বিদ্বজ্জনে বলতে পারবেন।
মোদ্দা কথা হল, গোটা গ্রাম তাকে ভটাই নামেই চেনে। এমন
কী স্কুলে শিক্ষকও রোল কলের সময় নাম ডাকেন ভটাই ভৌমিক। নাক
চুলকে কান চুলকে চোখ সরু করে বিড়বিড় করে কীসব হিসেবনিকেশ করল ভটাই, তারপর মাথা হেলিয়ে বলল, “চল যাওয়া যাক।
কিন্তু কোনো গন্ডগোল হলে?
গল্পের বইতে লেখে না,
পরিত্যক্ত বাড়িতে সমাজবিরোধীরা ঘাঁটি গেড়ে থাকে সব?”
চিনির চোখ চকচক করে ওঠে। হাততালি
দিয়ে তিড়িং করে লাফিয়ে ওঠে সে, বলে, “তাহলে তো দারুণ হয়! ওদের ধরিয়ে দিয়ে আমরা প্রাইজ-টাইজ পাব বেশ!”
প্রাইজের নামে ভটাই বিশেষ উৎসাহিত হয় না। পড়াশুনো
খেলাধুলো আঁকা সব মিলিয়ে বছরে বেশ কয়েকখানা প্রাইজ সে অমনিই পেয়ে থাকে।
মাঠ পেরিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে সে বলে,
“দূঃ, প্রাইজ কী করব। বরং
একটা ভূত থাকলে দারুণ হয়!”
চিনি ভাইকে আশ্বস্ত করে,
বলে, “আচ্ছা তোর প্রাইজটা আমাকে দিয়ে দিতে পারিস, আমি কিছু মনে করব না।
তুই ভূতটা নিস। ছোটকা
তো বলে ভূত আছে।”
ভটাইয়ের মুখ ভেটকে যায়। বলে, “ছোটোমামার কথা ছাড়! জানালার কাচে নিজেকে দেখে ভয়ে
অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছিল মনে নেই! চিৎকার করার আগেই চিৎপাত!”
চিনি হি হি হেসে ওঠার আগেই ভটাই বিনা নোটিশে ভুস করে ভূগহ্বরে
প্রবেশ করল। আগাছার ফাঁকফোকর দিয়ে একটা
গর্ত মতো ঠাহর হয়েছিল বটে, কিন্তু সেটা মানুষ ঢুকে যাওয়ার মতো বড়ো হবে সেটা দু’জনের কেউই
বুঝতে পারেনি। গর্তের সামনে বসে বারকয়েক ভটাই
ভটাই করে ডেকে সাড়া না পাওয়ায় চিনিও সাতপাঁচ ভেবে শেষে পাতালপ্রবেশ করল।
এবং অবতরণ করল সোজা ভটাইয়ের পিঠের ওপরে। লাথি
খেয়ে হজম করার লোক ভটাই নয়, সে ও চটাস পটাস এলোপাথাড়ি কিল ঘুসি চালাল কতক।
ব্যাপারটা আরও খানিক চলত,
কিন্তু মাঝপথে কে যেন মিহি গলায় “অ বাবা, তোমরা আবার কারা” বলে ওঠায়
নেহাত অনিচ্ছেয় দু’পক্ষ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হল।
২
কান পেতে ভালো করে খানিকক্ষণ শোনার চেষ্টা করে দু’জনে।
ভটাই জিজ্ঞেস করে, “কে?” চিনি ভটাইকে জিজ্ঞেস করে,
“গলাটা শুনতে নাকি নাকি লাগল?”
অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে একটু,
তার ওপর কোথা থেকে একটা নরম আলো জ্বলে উঠেছে।
সেই আলোতেই লোকটাকে দেখতে পেল ওরা। গলাটা
কেশে ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিয়ে লোকটা বলল, “কোথায় নাকি, অ্যাঁ? আর তোমরা দুম করে এসে পড়লে কোত্থেকে শুনি?”
চুপ করে থাকা চিনি বা ভটাই,
কারোরই ধাতে নেই, কিন্তু লোকটাকে এমন আজব দেখতে যে দু’জনের মুখেই কথা জোগাল না কিছুক্ষণ।
লম্বায় চিনির মতো, সিড়িঙ্গে চেহারা, মাথায় পাতলা চুল, মাছি গোঁফ। কাঁচা
হলুদ রঙের গেঞ্জি পরা, তাতে
লেখা ‘লাইফ ইজ ফান’। তার সঙ্গে কটকটে লাল ঢোলা পাজামা
পা ছাড়িয়ে লুটোচ্ছে প্রায়। তার
নিচ থেকে কোনোমতে উঁকি দিচ্ছে শুঁড়ওয়ালা সোনালি জুতো। দুই
ভাইবোনে একযোগে প্রশ্ন ছোড়ে। ভটাই
জানতে চায়, “আপনি
ভূত?”
চিনি শুধোয়, “আপনি
সার্কাসের জোকার?”
লোকটার মুখচোখ লাল হয়ে মাথার চুল ক’গাছি খাড়া হয়ে যায় প্রায়।
কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে বলে মনে হয় ভটাইয়ের।
রাগে বাড়ির পোষা হুলোটার মতো গরগর করতে করতে সে বলে, “অ্যাঁ, কী অপমান, অ্যাঁ! ভূত! জোকার! শুনে রাখো তাহলে, আমি হলুম দৈত্য! আলাদিনের প্রদীপ পড়োনি? সেই রকম দৈত্য!”
চিনি সন্দেহ প্রকাশ করতে ছাড়ে না,
“দৈত্য?? দৈত্য মানেই তো বিশাল চেহারা
হয়! আপনি কি মিনিদৈত্য, মিনি বাসের মতো?”
রাগ থেকে লোকটার মুখচ্ছবি দুঃখে চলে যায় এক লাফে।
ঘ্যানঘ্যান করে বলে, “তোমরা ভারি অভদ্র তো!
কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া, ছোটো দৈত্যকে ছোটো বলতে নেই,
পড়োনি? দেখেই মনে হচ্ছে ফি বছর ক্লাসে ফেল করো!”
প্রতিবাদে ভাইয়ের রেজাল্ট সম্বন্ধে দু’কথা বলার ইচ্ছে ছিল চিনির, কিন্তু ভটাই নিজেই তাতে বাদ
সাধে। ভূত না হোক, দৈত্যই সই।
এমন সুযোগ ছাড়তে আছে?
মিষ্টি মিষ্টি করে বলে,
“দৈত্যদা, আপনি প্রদীপের মধ্যে থাকেন,
সত্যি?”
লোকটা একটু শান্ত হয়,
বলে, “না না, প্রদীপ-টদীপ এখনকার যুগে সেইরকম ভালো পাওয়া যায় নাকি! এখানে আসার আগে আমি একটা পেতলের
কলসির মধ্যে থাকতাম। ব্যানার্জীবাবু প্রথম প্রথম
একটা ঘিয়ের বোতলে রাখতেন আমাকে। কিন্তু
ঘি ঘি গন্ধে আমার গা গুলোয়। ওসব
ঝামেলায় না গিয়ে আমি এখন বাইরেই থাকি। সে
আমার কথা ছাড়ো, তোমরা
এখান থেকে বেরোবে চলো। তোমরা এখানে থাকলে লোকগুলোকে
ধরা মুশকিল হবে আমার।”
চশমার আড়ালে চিনির চোখ গোল হয়। বলে, “কোন লোক দৈত্যদা? সমাজবিরোধী??”
লোকটা বিরক্ত হয়ে বলে,
“আঃ, দৈত্যদা আবার কী কথা!
সহবতের অভাব আছে দেখছি!
আমার নাম আজু, আজুদা বলো। লোকগুলো
চোর। খালি বাড়ি পেয়ে চোরাই মাল লুকিয়ে
রাখে এখানে, তাস
জুয়া খেলে, টাকাপয়সা
ভাগ বাঁটোয়ারা করে। আমি ক’দিন বেড়াতে গেছিলাম, জমিয়ে বসেছে তার মধ্যে।
ফাঁদে পড়ুক একবার, তারপর দেখিয়ে দিচ্ছি!”
৩
দৈত্য, তার ওপরে আবার চোর ডাকাত!
সোনায় সোহাগা! অ্যাডভেঞ্চার স্কোয়্যার যাকে বলে!
আনন্দে খানিক নেচে নেয় চিনি। আজু
হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, ভটাইকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,
“একটু খ্যাপাটে, নয়?”
ভটাই ঘটঘট করে ঘাড় নাড়িয়ে সায় দেয়। পড়ে
পাওয়া দৈত্যকে চটাবে কে! জিজ্ঞেস করে, “ও আজুদা, আমরা থাকি? চোর ধরতে তোমাকে সাহায্য করব?”
চিনিও প্রশ্নবাণ শানায়, “তুমি
কি এখানেই থাক আজুদা? একা
একা থাক? ব্যানার্জীদাদু কোথায় চলে গেছেন
গো? ওঁর কি সত্যিই একটা পোষা কুমির
ছিল?”
আজু হ্যা হ্যা করে হাসে। বলে, “ধ্যাস, কোথায় কুমির।
ও তো আমি। এই
দেখ, দাঁড়াও।”
বলে ফস করে কোথায় গায়েব হয়ে যায় সে। দুই
ভাইবোন এদিক ওদিক খুঁজেও দেখতে পায় না কিছু। মিনিট
দুয়েক পরে আবার শূন্য থেকে ফিরে আসে আজু। বুক
ফুলিয়ে বলে, “কেমন
দিলাম?”
ভটাই মিনমিন করে, “কী
দিলে? কুমির দেখতে পেলাম না তো!”
বিরক্তিসূচক শব্দ করে আবার হাওয়ায় মিলিয়ে যায় আজু।
এবার খুব খুঁটিয়ে দেখে একটা টিকটিকিকে দেখতে পায় দু'জনে। টিকটিকিটা
একটু পরেই ভোল পালটে আজু হয়ে যায়। আমতা
আমতা করে ভটাই বলে, “আজুদা, ওটা কুমির হল না, টিকটিকি হল।”
আজুর আত্মবিশ্বাসে একটু ভাটা পড়ে। বলে, “ওই হল।
আসলে অনেক দিন চেহারা বদল করার দরকার পড়ে না তো।
কুমির দেখিনি কত দিন। টিকটিকি
বরং শ’খানেক আছে এ বাড়িতে। রোজ
ওই দেখে দেখে গুলিয়ে গেছে আর কী।”
কথার মাঝে বেশ জোরে একটা গুড়গুড় শব্দ ওঠে।
আজু চমকে উঠে ইতিউতি তাকায়,
বলে, “বাঘ-টাঘ নাকি?” ভটাই লজ্জা পেয়ে বলে,
“আমার পেট ডাকল আজুদা। খিদে
পেয়েছে খুব, কিছু
খাবার হবে?”
আজু বুক ঠুকে বলল, “খুব
হবে! ব্যানার্জীবাবু
বিশাল বড়ো বিজ্ঞানী ছিলেন জানো না?” খাবারের সঙ্গে বিজ্ঞানের কী সম্পর্ক বুঝতে না পারলেও মাথা ঝাঁকায়
দুই ভাইবোন।
আজু চোখ বন্ধ করে হাত পাতে,
আর যেন মন্ত্রবলে হাতের মধ্যে একটা বিশাল সাইজের আম এসে উদয় হয়।
ভটাই একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলে,
“খোসা না ছাড়িয়ে খাব কী করে?
চুষে খেতে হবে?” আজু দাঁত বের করে বলে,
“কলার খোসা যেমন করে ছাড়ায়,
তেমন করে ছাড়াও।” ভেবলে যাওয়া ভটাই খোসা ছাড়াতেই খুব
সন্দেহজনক একটা গন্ধ পায়। চিনিও পায়, এবং দু’পা পিছিয়ে দাঁড়ায়।
ভটাই পড়েছে মহা মুশকিলে,
চেয়ে নেওয়া খাবার, না খেলে দৈত্য যদি খেপে যায়। চেহারায়
ছোটোখাটো হলেও লোকটার কিছু যে ক্ষমতা আছে সে তো বোঝাই গেছে। এমতাবস্থায়
ভটাই বোনকে সুখাদ্যের ভাগ দিতে চায়। চিনি
সেয়ানা মেয়ে, সে
হাত-পা নেড়ে বলে, “তুই
খা তুই খা, আমার
ঝালমুড়ি খেয়ে থেকে কেমন অম্বল হচ্ছে।”
অগত্যা আজব ফলটায় কামড় বসাতেই হয় ভটাইকে। কামড়ে
গিলতে অবশ্য পারে না, থু
থু করে ফেলে দিতে হয়। যেমন পাকতে পাকতে পচতে বসা
কলার মতো গন্ধ, তেমনই
তার স্বাদ। আজুকে খুব অখুশি দেখায়, সে বলে, “ফেলে দিলে তো! এটা ব্যানার্জীবাবুর যুগান্তকারী
আবিষ্কার, নাম
হল আমলা। আমের মতো দেখতে, কলার মতো খেতে।”
ভটাইয়ের গা গুলিয়ে বমি আসছে। সে
কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “আমলা
মানে তো আমলকী! আর
এটা যুগান্তকারী কী করে হয়! আমের মতো দেখতে আর পচা কলার মতো খেতে ফল কে খেতে চাইবে, কেনই বা চাইবে!”
চিনি চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ে,
“তুমি তো দৈত্য আজুদা,
ইচ্ছে করলেই তো তুড়ি মেরে থালা ভর্তি ভোজবাড়ির খাবার এনে ফেলতে
পারো। আনো না প্লিজ, আনো না!”
আজুর মুখ সংশয়ী দেখায়। আমতা
আমতা করে বলে, “আসলে
আমার তো খেতে লাগে না, খাবারদাবার
চোখেই দেখিনি অনেক দিন। ব্যানার্জীবাবু থাকতে খাবার
ম্যাজিক করতে হত রোজই। কিন্তু উনি আমাকে বাড়ি পাহারায়
বসিয়ে সেই যে গেলেন - আচ্ছা, দেখি দাঁড়াও, কী মনে পড়ে।”
ভটাই চিনিকে ঠেলা দেয়। “কেন
বললি, আবার
টিকটিকি কেসের মতো কিছু করে বসবে শেষে!”
তা কেস আর কিছু হয় না। তার
আগেই গর্তের বাইরে কিছু লোকজনের গলা পাওয়া যায়। আজু
চোখ খুলে লাফিয়ে ওঠে, বলে, “ওই যে, ওই যে, চোরগুলো এসে গেছে! তোমরা সরো সরো, ওই পেছন দিকে সিঁড়ি আছে, সিঁড়ি ধরে বাড়ির ভেতরে উঠে
যাও! এহ, কী যে প্ল্যানখানা বানিয়েছিলাম, তোমাদের সঙ্গে বকতে গিয়ে সব
ভুলে গেছি!”
৪
আজু প্ল্যান ভুলে গেলে কী হবে,
চিনি আর ভটাইয়ের মাথায় তো সদাসর্বদাই প্ল্যান গিজগিজ করে৷ ভটাই
লাফিয়ে উঠে বলে, “তুমি
কুমির হয়ে যাও আজুদা।” আজুর মুখে কিন্তু কিন্তু ভাব দেখে চিনি বলে, “আরে কুমির কেমন হয় মনে না
পড়লেই বা কী, বিশাল
সাইজের সবুজ রঙা টিকটিকি হয়ে যাও না! নিজের ইচ্ছেমতো ভয়ানক দেখতে হয়ে যাও!”
কথাটা মনে ধরে আজুর। পালটে
যাওয়ার আগমুহূর্তে সে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, কুমীরের মুখ দিয়ে কি আগুন বেরোয়?” চিনি আর ভটাই সোৎসাহে বলে ওঠে,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব বেরোয়!”
টিকটিকির গায়ে সবুজ রঙ করে তাকে কুমিরের চেয়েও দ্বিগুণ বড়ো করে
দিলে যা হয়, তার
সঙ্গে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে আজু যে রূপ ধারণ করল,
সেটা দেখলে তাবড় তাবড় সাহসী মানুষ ভিরমি খাবে।
মুখে বড়ো বড়ো দাঁত, মাথায় আবার তিনখানা শিং। চিনি
আর ভটাই মুচ্ছো যেত, যদি
না জীবটার গলা দিয়ে আজুর স্বরে প্রশ্ন আসত,
“কেমন লাগছে বলো তো?”
লাগছে খোলতাই, কিন্তু সে কথা আজুকে জানানোর সুযোগ হয় না আর।
তার আগেই গর্তের মধ্যে ধাঁই ধপাধপ করে খান তিনেক মুশকো লোক এসে
পড়ে। আজু সঙ্গে সঙ্গে খেল দেখানো
শুরু করতেই পারত, কিন্তু
তা না করে সে একটু সময় নেয়। লোকগুলো
একটু ধাতস্থ হয়ে উঠে বসে আজুর চেহারাখানা দেখে আঁতকে উঠবে,
তবে তো আনন্দ! নাহলে এত খাটনি করে লাভ কী!
তা আঁতকে ওঠে লোকগুলো। ভয়ানক
প্রাণীটার থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রচেষ্টায় একে অন্যের ঘাড়ে উঠে পড়ে প্রায়।
আজু দেখে এই মোক্ষম সময়,
ঘ্রেঁয়াও করে একখানা রক্ত জল করা ডাক ছেড়ে সে মুখ দিয়ে উগরে দেয়
আগুনের হলকা। আগুনের রঙটা বেশি উত্তেজনার
কারণেই সবজেটে হয়ে গিয়ে থাকবে, তাতে লোকগুলোর ভয় কিছু কমে না। ভয়ে
হাঁউমাঁউ করতে করতে হাঁচোড়পাঁচোড় করে গর্তের মুখের দিকে উঠি কি পড়ি করে দৌড়োয় তারা।
তাদের এক সেথো বাইরে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের হাঁক পাড়ছিল, তাকে চিৎকার করে জানান দেয়, “পালা বাবলু পালা, ভেতরে ডাইনোসর!”
বাবলু “কিন্তু মালগুলো যে রয়ে গেল” গোছের কিছু বলে আপত্তি তুলতে
যাচ্ছিল, কিন্তু
গর্তের মুখ থেকে আজু ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে। ধাবমান
বন্ধুদের সঙ্গ নেওয়া হয় না বাবলুর, অজ্ঞান হয়ে ওখানেই পড়ে যায় সে।
চিনি আর ভটাইও বেরিয়ে আসে আজুর পেছন পেছন।
তাদের প্রাইজরা দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে দেখে দু’জনে ক্ষিপ্র গতিতে
আধলা ইঁট পাথর যা পায় তুলে নেয়। তারপর
গ্রামবিখ্যাত টিপে বাবলুর বন্ধুরাও অচিরেই ধরাশায়ী হয়। দড়ি
ব্যাপারটা ঠিক কীরকম হয় সেটা আজুকে মনে করানোর পর তাদের বেঁধে ফেলতে বেশিক্ষণ লাগে
না। উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে ফুটতে
ভটাই বলে, “পুলিশকে
খবর দিই আজুদা?”
আজু বারণ করে না, কিন্তু বলে, “দেখো, আমার কথা বলবে না একদম!
ওপরে ওদের চোরাই মাল রাখা আছে,
সে সব দেখিয়ে দিও। সব
মিটলে পরে এসে ঘুরে যেও, তোমাদের পিঠ চুলকোনোর মেশিনটা দেখাব,
দেখবে সে কী আশ্চর্য জিনিস!”
এই না বলে হুস করে ছোট্ট হয়ে টিকটিকি হয়ে যায় আজু।
চলে যায় না, বলে, “তোমরা পুলিশ ডেকে আনো,
আমি এদের পাহারা দিই ততক্ষণ।”
উল্কার বেগে গ্রামের দিকে ছোটে দুই ভাইবোন।
তাদের হা হা হাসি ছড়িয়ে পড়ে দোলতলার মাঠে।
মিনি সাইজের দৈত্য বন্ধু,
দৈত্যাকার টিকটিকি, চার-চারটে চোর, মায় চোরাই মাল অবধি - এত আনন্দ দুটো ছোট্ট বুকে ধরানো যায় নাকি! ছড়িয়ে দেওয়াই সব চেয়ে ভালো!
----------
ছবি - রাজা আক্তার
No comments:
Post a Comment