অপরাজিত:: অলিম্পিক মশাল - সায়ন তালুকদার


অলিম্পিক মশাল
সায়ন তালুকদার

পেকহ্যামের বেলেনডেন রোড দিয়ে ছুটছেন সুপারস্টার। গায়ে সাদা ট্র্যাক স্যুট। বুকের উপর লেখা রিলে নম্বর ০৬৩। কখনও ধীর গতিতে ছুটলেন, গতি আরও কমিয়ে খানিক হাঁটলেনও, তারপর ফের দৌড়োতে শুরু করলেন। ভক্তদের দেখে হাত নাড়লেন। প্রায় ৩০০ মিটার দৌড়োনোর পর, মশাল তুলে দিলেন পরের জনের হাতে। মিশে গেলেন উচ্ছ্বসিত জনতার ভিড়ে। ছবি তুলতে দিলেন ইচ্ছেমতো। বললেন, “জীবনের সেরা ঘটনা। দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরে আমি গর্বিত।স্বীকার করলেন, “এই বয়সে এতটা দৌড়োনো খুব কষ্টকর। কিন্তু চারপাশ থেকে সবাই খুব উৎসাহ দিচ্ছিল। বিদেশের মাটিতে এমন ঘটনায় আমি সত্যিই বিস্মিত। অলিম্পিকের মশাল হাতে দৌড়োবো, কোনোদিন ভাবিনি।
২০১২ লন্ডন অলিম্পিক্সের মশাল দৌড়ে সামিল হয়ে এমনই অনুভূতি হয়েছিল শাহেনশাহ অমিতাভ বচ্চনের।

‘ম্যাজিক ল্যাম্প’-এর বন্ধুরা, সদ্য শেষ হল টোকিও অলিম্পিক ২০২০। পদক তালিকায় প্রথম পঞ্চাশে স্থান করে নিয়েছে আমাদের দেশ ভারতবর্ষ। সেই উদ্দেশ্যেই আজ অলিম্পিক মশালের প্রসঙ্গ উত্থাপন।
তোমাদের অনেকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, কবে থেকে শুরু হল অলিম্পিকে এই মশাল জ্বালানোর রীতি? কোথায়ই বা এর সূত্রপাত?
ইতিহাস ও পুরাণের পাতায় চোখ রাখলে জানা যায়, পশ্চিম গ্রিসের অলিম্পিয়া নামক এক জায়গায়, আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে প্রাচীন অলিম্পিকের সূচনা হয়েছিল। সেখানেই ঘন্টাখানেকের একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে সূর্যের আলো থেকে জ্বালানো হয় সেই অগ্নিশিখা, যা ক্রীড়ানুষ্ঠান শেষ হবার আগে পর্যন্ত কখনোই নেভে না। আগুন জ্বালানো হয় মাটিতে রাখা একটি অবতল আয়না থেকে। এতে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে এমন তাপের সৃষ্টি করা হয় যা থেকে মশাল জ্বালানো যায়। এগারোজন মহিলার মধ্যে থেকে একজন শিখা প্রজ্জ্বলন করেন।
এরপর তা থেকে জ্বালানো হয় আরেকটি অলিম্পিক মশাল - যা তুলে দেওয়া হয় একজন ক্রীড়াবিদের হাতে। এ ছাড়াও তুলে দেওয়া হয় একটি জলপাই গাছের শাখা। আরেকজন উড়িয়ে দেন একটি সাদা পায়রা, যা শান্তির প্রতীক।
এই অলিম্পিয়াতেই ৭৭৬ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে শুরু হয়েছিল প্রাচীন যুগের অলিম্পিক - যা অনুষ্ঠিত হত প্রতি চার বছর অন্তর। সেখানে ছিল গ্রিক দেবতাদের রাজা জিউসের মন্দির এবং তার সম্মানেই অনুষ্ঠিত হত ক্রীড়ানুষ্ঠান। আজ সেই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

প্রাচীন অলিম্পিকে মশাল দৌড়ের প্রচলন থাকলেও, আধুনিক অলিম্পিকের শুরুতেই সেই সংস্কৃতি উধাও হয়ে যায়। ১৯২৮ সাল থেকে অলিম্পিক মশাল পুনরায় চালু হলেও, ছিল না মশাল দৌড়ের কোনো ব্যাপারই। এই মশাল দৌড় শুরু হয়েছিল নাৎসি জমানায়। উনিশশো ছত্রিশ সালে বার্লিন অলিম্পিকে নাৎসি জোসেফ গোয়েবলসের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় অলিম্পিকে মশাল দৌড়। গ্রিস থেকে মশাল বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে পৌঁছয় বার্লিনে। গ্রিস থেকে বার্লিন - দীর্ঘ তিন হাজার একশো সাতাশি কিলোমিটার পথ তিন হাজার তিনশো একত্রিশজন দৌড়বীরের হাত ধরে তা পৌঁছয় অলিম্পিকের মূল স্টেডিয়ামে। পরবর্তীতে অলিম্পিক মশাল দৌড় শুধুমাত্র স্থলপথে নয়, জলপথে এমনকি আকাশপথেও পৌঁছেছে বিভিন্ন দেশে। প্রথমবার ১৯৪৮ সালে অলিম্পিক মশালকে ইংলিশ চ্যানেল পার করাতে ব্যবহৃত হয়েছিল নৌকা। ১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে আকাশপথে পাড়ি দিয়েছিল মশাল। এমনকি ১৯৭৬ সালে রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে অলিম্পিকের শিখার প্রেরণ করা হয়েছিল ও তা প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল।
১৯২৮ সালে আমস্টারডাম অলিম্পিকে চালু হয় অলিম্পিক মশাল। মজার ব্যাপার, মশালের ওজন ও দৈর্ঘ্য এক থাকলেও, বদলেছে মশালের উপকরণের তালিকা। ১৯৪৮-এ লন্ডন অলিম্পিকে সাতচল্লিশ সেন্টিমিটার লম্বা ও নশো ষাট গ্রাম ওজনের মশাল তৈরি হয়েছিল হিডুমিনিয়াম-অ্যালুমিনিয়ামের সংকর ধাতু দিয়ে। ১৯৫৬-তে মেলবোর্ন অলিম্পিকে সেই উপকরণ বদলে হয় ম্যাগনেশিয়াম-অ্যালুমিনিয়াম। এরপরও বদলেছে উপকরণ। এমনকি মশালের শিখাও তৈরি হয়েছে বিভিন্ন উপকরণে। কখনও ব্যবহৃত অলিভ অয়েল, কখনও বা প্রপিলিনের মতো তরল গ্যাস।
অলিম্পিকের সংখ্যা যত বেড়েছে, বেড়েছে পথ এবং একই সঙ্গে বেড়েছে মশালবাহকের সংখ্যাও। ২০০৪-এ মশাল দৌড় প্রথমবার বিশ্বের সব প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়। আটাত্তর দিনে মশালের বিশ্ব ভ্রমণে আটাত্তর হাজার পথ মশাল অতিক্রম করে এগারো হাজার তিনশো মশাল বাহকের হাত ধরে।
তোমরা হয়তো অনেকেই জানো, অলিম্পিকের রেওয়াজ অনুযায়ী আয়োজক দেশের মূল স্টেডিয়ামে মশাল দৌড়ের শেষে অলিম্পিক কলড্রন বা বিশাল কড়াইয়ের মতো অলিম্পিক মশালের আধারে আগুন জ্বালান বিখ্যাত কোনো ক্রীড়াবিদ। যেমন - ১৯৫২ সালে মশালের শিখা জ্বালিয়েছিলেন পাভো নুরমি। ১৯৯২-এ প্লাতিনি, ১৯৯৬-এ মহম্মদ আলি।
বিভিন্ন দেশের মধ্যে কুটনৈতিক বিভিন্ন সংঘাত জারি থাকলেও অলিম্পিকের ময়দানে তারা একত্রিত হয়। অলিম্পিকের মশাল এই ঐক্যের প্রতীক হিসেবে আলোকিত হয়, সমাপনী অনুষ্ঠানের আগে পর্যন্ত যে আগুন নেভে না, রয়ে যায় অনির্বাণ।
অলিম্পিকের খাতা খুলে বসলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে হাজারো ইতিহাসের ঘটনা। আবার কখনও সময় পেলে তোমাদের সঙ্গে সেই সব কথা ভাগ করে নেব’খন।
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment