গল্প:: বেলপাতা - শঙ্কর চ্যাটার্জী


বেলপাতা
শঙ্কর চ্যাটার্জী

আজ নীলষষ্ঠী বউ অর্ডার করল, “ফুলের দোকানে গিয়ে আকন্দ ফুল, বেলপাতা কিনে নিয়ে এসো
দোকানে গিয়ে দেখি রেশন দোকানের মতো লাইনকোথায় করোনা? এদিকে বিজ্ঞানী, ডাক্তার, সরকার সবাই মিলে মাথার চুল ছিঁড়ছে! ভিড় করতে নিষেধ করছেদূরত্ব বজায় রাখতে বলছে আর আমরা এখানে ঘেঁষাঘেঁষি করে লাইন দিয়ে ফুল কিনছি
আধঘন্টা বাদে ফুলওয়ালার সামনে আসার সৌভাগ্য হলততক্ষণে আমার মাস্ক ঘামে ভিজে সপসপ করছেনাকে জল ঢুকে সুড়সুড় করছেভগবানকে ডাকছি - যেন হাঁচি না আসে! তাহলে আর দেখতে হবে নাএখান থেকে সোজা হাসপাতালে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাবে
দোকানদারকে ফর্দ অনুযায়ী বলতে ছোট্ট জবাব দিল, “বেলপাতা ছাড়া সব দিচ্ছিওটা ফুরিয়ে গেছে
যাহ বাবা! বেলপাতাই তো আসল জিনিসও ছাড়া শিবঠাকুর সন্তুষ্ট হয় নাকি?
পিছনের লোক ঠ্যালা মেরে বলল, “এই মড়কের সময়ে শিবঠাকুর ঠিক বুঝবে
দেখলাম, কথা বাড়ালে বাকিগুলো যদি ফুরিয়ে যায়? তখন বাড়িতে আমারই গুষ্টির পুজো হয়ে যেতে পারেবেলপাতা ছাড়াই শুধু আকন্দ ফুলের মালা আর ধুতরো ফুল নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম
হঠাৎ খেয়াল পড়ে গেল, দেবুদের পুকুরের ধারে একটা বেলগাছ আছেযেমন ভাবা তেমন কাজযদি ওখানে বেলপাতা পেয়ে যাই, বউয়ের চোখে হিরো হয়ে যাব
বেলা সাড়ে এগারোটা বাজেপুকুর ধারে এলামবেশ নিরিবিলি জায়গাটাএকটা স্যাঁতসেঁতে ভাব! পুকুরটা ছোটো ছোটো কচুরিপানাতে ঢাকাহঠাৎ দেখলে একটা সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ বলে মনে হবেএক হাতে আমার ফুলের প্যাকেটপাঞ্জাবি আর প্যান্ট পরা ছিপছিপে চেহারা আমারবয়স একটু বেশি হলেও, চেষ্টা করলে ঠিক বেল গাছে উঠে যাবঘাড় উঁচু করে দেখলাম - পাতাগুলো উঁচুতে হয়ে আছেএকটু উঠতে হবেমুখের মাস্কটা খুলে পকেটে ঢোকালামফুলের প্যাকেট পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে গাছে ওঠার চেষ্টা করলামপায়ের চটি খুলিনিকোথায় বেল কাঁটা ফুটে যাবে তার ঠিক নেই
কয়েক হাত উঠেই হাঁফ ধরে গেলমনে হয় নিচের ডালের পাতাগুলো ইতিমধ্যে কেউ পেড়ে নিয়ে গেছেআর এক হাত উঠলেই কিছু পাতা নাগালে পেয়ে যাব
সবে পায়ের চাপ দিয়েছি ডালেতে! আচমকা দেখি সাদা খেটো ধুতি পরা একটা বুড়ো উঁচু ডালে বসে পাতা পাড়ছে! তার মানে আমি যদি যাই ডালে ডালে, বুড়ো ভাম চলে পাতায় পাতায়! এই ব্যাটা বুড্ঢা-টাই নিচের ডালের পাতাগুলো পেড়েছে - বিক্রি করার জন্যেবরং ওই ব্যাটাকেই বলি, সতেজ দেখে কিছু পাতা আমাকে পেড়ে দিতেআমার খাটনি বাঁচবে
গাছ থেকে নেমে এসে গলা খাঁকারি দিতেই সাদা শনের মতো চুলওয়ালা বুড়োটা নিচে আমার দিকে তাকালবুড়ো হলে কী হবে? আমার থেকেও অনেক উঁচুতে সরু ডালে উঠেছে আমার গলার আওয়াজে ওপর থেকে বলল, “মুখে মাস্ক নেই তোর?
এ আবার কী বলে? মাস্ক পরে গাছে চড়ব? এদিকে নিজের মুখেও কিছু নেইতার ওপর আমাকে তুই-তোকারি করছেখেঁকিয়ে উঠে বললাম, “তোমার মুখ তো দেখছি দিব্যি খোলাআমার পকেটে মাস্ক আছেআর তুমি দেখছি খালি গা!”
ওপর থেকে সে দাঁত খিঁচিয়ে হেসে বলল, “আজ পর্যন্ত কোনো ব্রহ্মদত্যিকে মাস্ক পরতে দেখেছিস? এদিকে তুই আমার বাড়ির ভেতরে বাইরের চটি পরে, মাস্ক ছাড়া কোন আক্কেলে ঢুকেছিস? এবার যদি আমাদের দৈত্যকুলে ওই মারণ রোগ ছড়ায়? তোকে তাহলে আমরা ছাড়ব না
ওর কথা শুনে প্রথমটা ভয় পেলেও নিজেকে সংযত করলামএ ব্যাটা মনে হয় কোনো ছিঁচকে চোরবেল গাছকে নিজের বাড়ি বলছে? যেন পৈতৃক সম্পত্তি? আমাকে ফালতু ভয় দেখাবার চেষ্টা করছেদাঁড়াও, তোমায় দেখাচ্ছি মজা! আমিও অনেক ভূতের গল্প লিখিওসব ছেঁদো কথায় ভুলছি নাতাছাড়া এই ঠা ঠা পড়া রোদ্দুরে ব্রহ্মদত্যি কোথা থেকে আসবে? তাই বলে উঠলাম, “দাঁড়া, গাছের মালিক দেবুকে ডাকছিপাতা চুরি করা বেরিয়ে যাবে” আমিও তুই-তোকারিতে নেমে এসেছি
“কী? আমি পাতা চোর? এত বড়ো অপমান! তোকে প্রমাণ দেখাচ্ছি আমি কে!” খ্যানখেনে গলায় ওপর থেকে বলল
পরক্ষণেই আমার চোখের সামনে দিয়ে গিরগিটির মতো সরসর করে মগডালে উঠে গিয়ে, আকাশের দিকে মুখ উঁচু করে দু-হাত ছড়িয়ে এক সেকেন্ড দাঁড়ালআমি ভাবছি, কেরামতি দেখাতে গিয়ে না পড়ে! তারপর খিটকেল বুড়োটা একটা সাদা বকের আকার ধারণ করে আকাশের দিকে উড়ে গেল
আমার চোখ-মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেলআতঙ্কে হাত-পা কেমন যেন অবশ অবশ লাগতে শুরু করলভাগ্যিস, আগেই গাছ থেকে নেমে এসেছিলামনাহলে এই দৃশ্য দেখে গাছ থেকে পড়ে কোমর ভাঙতকোনোরকমে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ির দিকে চললাম...পকেটে হাত দিয়ে দেখি ফুলের প্যাকেট ভ্যানিশ...এবার ব্রহ্মদত্যির ভয়ের থেকেও বাড়ির ভয় আরও বেশি করে শরীরে জাঁকিয়ে বসলস্ত্রীর রাগান্বিত মুখটা চোখে ভেসে উঠল
কিন্তু, বাড়িতে ঢুকতেই বউ হাসি হাসি মুখে বলল, “একজন তোমার থেকেও বয়স্ক লোক, হাঁটু পর্যন্ত ধুতি পরা, একটু আগে এক প্যাকেট তাজা আকন্দ ফুলের মালা আর সঙ্গে একগাদা টাটকা বেলপাতা দিয়ে বলে গেল তুমি নাকি ওনার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছ” হতবাক হয়ে গেলেও মনে মনে সেই ব্রহ্মদত্যি মশাইকে প্রণাম জানালাম
----------
ছবি – সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী

No comments:

Post a Comment