ভীমবেটকা
অমিয় আদক
মনে কর
বেরিয়েছ ফ্যামিলি ট্যুরে, অনেক দূরে। দিন দুপুরে রেলগাড়ি ছুটছে তার আপন খেয়ালে। তার
শব্দ ধাক্কা মারছে গাছ আর পাহাড়ের দেয়ালে। গভীর বনের মধ্যে দিয়ে চলমান ট্রেনে বেশ
মজায় আছ। কানে এল বিকট শব্দ। ট্রেন ব্রেক কষে ধীরে ধীরে থেমে গেল। বনের মধ্যেই কেউ
কেউ সাহস করে নামলেন। জানা গেল ইঞ্জিনের গণ্ডগোল। ইঞ্জিন সারাইয়ের চেষ্টা চলছে।
কাছের জংশন থেকে আলাদা ইঞ্জিন চাওয়া হয়েছে। যে ভাবেই হোক তিন-চার ঘন্টার আগে ট্রেন
ছাড়তে পারবে না।
তুমি
এবং তোমার সমবয়সি আর এক সহযাত্রী সাহস করে বনের মধ্যে কিছুদূর গিয়ে খুঁজে পেলে ছোটো
পাহাড়ের গুহায় পাথরের দেয়ালে আঁকা আছে বেশ কিছু পরিচিত প্রাণীর ছবি। তোমরাই
আবিষ্কার করে ফেললে প্রাচীন গুহামানবের আস্তানা। তাহলে কেমন লাগবে বল তো? নিশ্চয়
ভালো লাগবে?
ঠিক
এমনি ভাবেই আবিষ্কৃত হয়েছিল ভীমবেটকার গুহাবসতিগুলো। সময়টা ১৯৫৭ সাল।
পুরাতত্ত্ববিদ ডঃ বিষ্ণু শ্রীধর ওয়াকঙ্কর চলেছিলেন ভূপাল বা ভোপাল। পথে বিন্ধ্য
পর্বতের ঢালে অবস্থিত রাতাপানি জঙ্গল। জঙ্গলের দক্ষিণ থেকেই সাতপুরা শৈলশিরাগুলি।
সেই জঙ্গলের মাঝেই ট্রেনের ইঞ্জিন গেল বিগড়ে।
জায়গাটা
ছিল ভোপাল থেকে ৪৫ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে রায়সেনা জেলায়। ওবেদুল্লাগঞ্জ শহর থেকে মাত্র
দশ কিমি দূরে। কোনো উপায় না পেয়ে নতুন ইঞ্জিন পাঠানোর অনুরোধ করা হল ভোপালে। নতুন
ইঞ্জিন আসা এবং ট্রেন চালু হওয়ার মাঝে বেশ কয়েক ঘন্টা সময় লাগল।
সেই
বিরক্তিকর পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পেতে ডঃ ওয়াকঙ্কর নেমে হাঁটা দিলেন গ্রাম্য পথ
ধরে বনের মধ্য দিয়ে। কিছু দূর গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে নজরে এল ছোটো ছোটো টিলার আকারের কিছু
পাহাড়। স্থানীয় মানুষদের কাছে জানতে পারলেন, স্থানটির নাম ভীমবেটকা। ভীমবেটকা
নামের কারণ তাঁর আগেই জানা ছিল। মহাভারতের দ্বিতীয় পাণ্ডব মহাবীর ভীম নাকি বনবাস
কালে এখানের পাথরের আসনে বসতেন। সাধারণ মানুষের সেই বিশ্বাসের ভিত্তিতেই জায়গাটার
নাম ভীমবেটকা।
তিনি
এগিয়ে চললেন সেই টিলা আকৃতির পাহাড়ের কাছে। গিয়ে দেখলেন সেখানে পাহাড়ি গুহা।
সেইরকম কয়েকটা গুহা দেখে তাঁর মনে হল এখানে এক কালে মানুষ বসবাস করত। সেই সব গুহার
দেয়ালে দেখতে পেলেন বেশ কিছু প্রাণীর ছবি। সেই গুহাচিত্রগুলির সঙ্গে তিনি স্পেন
এবং ফ্রান্সে দেখা গুহাচিত্রের মিল খুঁজে পেলেন। এমন কয়েকটা গুহা দেখেই তিনি ফিরে
এলেন। আরও ঘন্টাখানেকের অপেক্ষার পর নতুন ইঞ্জিন এল। তারপর আবার ট্রেন ছুটল ভোপাল।
তার
কিছুদিন পরেই তিনি পুরাতাত্ত্বিক গবেষণার দল সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন রাতাপানির
জঙ্গলে। ভীমবেটকার কাছাকাছি আরও গুহাবসতির সন্ধানে। সেই দলের কাছে ভীমবেটকার আগেকার
পরিচয় ছিল একটি বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত স্থান। কিন্তু ভীমবেটকায় তাঁরা বৌদ্ধ
ধর্মের সঙ্গে স্থানটির কোনো সম্পর্ক খুঁজে পেলেন না।
কারণ
ভীমবেটকা বিষয়ে আগে সংগৃহীত তথ্যে ভুল ছিল। ভীমবেটকা পাহাড় এবং ভোজপুর হ্রদের
কাছাকাছি অঞ্চলের ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহের সময় কিনকেড সাহেব স্থানীয় অধিবাসীদের
সাহায্য নিয়েছিলেন। স্থানীয় অধিবাসীরা তাঁকে ভুল তথ্য সরবরাহ করেছিলেন। তাঁরা
স্থানটিকে বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্থান হিসাবেই জানিয়েছিলেন। তাই ভারতীয়
পুরাতত্ত্ব বিভাগের তথ্যভাণ্ডারে ১৮৮৮ সালে কিনকেড সাহেব প্রদত্ত তথ্যে ভুল থেকেই
গিয়েছিল।
ডঃ
বিষ্ণু শ্রীধরের সঙ্গে আসা গবেষক দল রাতাপানির জঙ্গলের ছোটো বড়ো গুহার আঁধারে
লুকিয়ে থাকা গুহাচিত্রের খোঁজ পেলেন। সেই দলের অনুসন্ধান এবং দিনরাতের পরিশ্রমের
সুফল হিসাবে পৃথিবীর মানুষ এবং পুরাতাত্ত্বিকদের সামনে হাজির হল বিশ্বের আর এক
বিস্ময়কর পুরাতাত্ত্বিক সম্ভার।
ভীমবেটকার
কাছাকাছি অঞ্চলে পাঁচ শতাধিক গুহায় প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের আঁকা অসংখ্য বিভিন্ন ধরনের
ছবি খুঁজে পাওয়া গেল। তার সঙ্গে পাওয়া গেল ইতিহাসের অনেক উপাদান। পাওয়া গেল সেই সব
প্রাচীন মানুষের জীবনযাত্রার ধরন এবং সভ্যতা বিকাশের ধারাবাহিকতার সঙ্গে ছবিগুলির
সম্পর্ক।
হাজার
হাজার বছর ধরে সেই সব প্রাচীন শিল্পীরা অসংখ্য ছবি এঁকে রেখেছিলেন।
তাতে আছে শিকারের ছবি, সমবেত নাচের ছবি, বিভিন্ন চেহারার আলপনা, বিভিন্ন জীবজন্তুর ছবি - যেমন বাইসন, হরিণ, হাতি, বাঁদর, বাঘ, গণ্ডার, ঘোড়া, ময়ূর ইত্যাদি।
অনেক
বছর ধরে ছবিগুলো নিয়ে চলল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ছবিগুলিতে কার্বন পরমাণুর
অস্তিত্ব এবং তাদের আইসোটোপের বয়স থেকে নিরূপিত হল ছবিগুলোর বয়স। দীর্ঘ গবেষণার
দ্বারা প্রমাণিত হল ছবিগুলির প্রাচীনত্ব। অবশেষে ইউনেস্কো দুই হাজার তিন সালে
ভীমবেটকাকে বিশ্ব ঐতিহ্য প্রদর্শক্ষেত্র হিসাবে স্বীকৃতি দিল। বিশ্বের গুহাচিত্রের
তালিকায় স্পেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে ভারতের
নামও সংযুক্ত হল।
সেই
সব ছবি দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। এখন থেকে ত্রিশ হাজার বছরের পুরোনো ছবিও
পাথরের দেয়াল জুড়ে আছে। আবার
সেখানে আড়াই হাজার বছর আগের ছবিও আছে। তাই সেই সব ছবি থেকে তাদের সমাজ জীবনের, সভ্যতার উন্নতির বিকাশ, তাদের শিকারি জীবন ছেড়ে কৃষিনির্ভর জীবনে আসার হদিস, তাদের উৎসব অনুষ্ঠানে সমবেত নাচ গানের ব্যবহার ইত্যাদি
বিষয়ও আমরা জানতে পারলাম। ত্রিশ হাজার বছরের পুরোনো ছবিগুলো যেন একসঙ্গে অনেক কথা
আমাদের জানাতে চাইল। একটা প্রাচীন সময়ের ইতিহাস আমাদের সামনে হাজির।
পুরাতাত্ত্বিক
গবেষণা থেকে এই অঞ্চলটিতে প্রস্তর যুগের সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা খুঁজে পাওয়া গেল।
এখানেই পৃথিবীর প্রাচীনতম পাথরের দেয়াল এবং পাথরের মেঝের নিদর্শন মিলল। এখানকার
সবচেয়ে পুরোনো ছবির বয়স ত্রিশ হাজার বছরেরও বেশি। তাও পুরাতাত্ত্বিক গবেষণায়
প্রমাণিত।
পাথর
বাঁধানো মাঝারি সরু রাস্তা। সেই রাস্তায় যানবাহন নিষিদ্ধ। পায়ে হেঁটে অনুচ্চ গাছের
ছায়ামাখা রাস্তায় এগিয়ে চললাম। গাইড আমাদের সঙ্গে। আমরা এলাম সবচেয়ে
প্রাচীন ছবির সামনে। প্রথম আবাস গুহাতে প্রাচীন গুহামানবের জীবনযাত্রাকে দেখানো
আছে তিনটি মূর্তির মাধ্যমে। একটি শিকাররত পুরুষ মূর্তি। অন্যটি মাতা সন্তানকে সঙ্গে
নিয়ে খাদ্য তৈরিতে ব্যস্ত। সেই গুহার উপরের অংশেও বাঘ, বাইসনের রেখাচিত্র দেখা গেল। এই ছবিগুলো প্রধানত গাঢ় সবুজ
অথবা লাল রঙের রেখাচিত্র। রেখাচিত্রের বিষয়বস্তু প্রধানত বাইসন, বাঘ, গন্ডার
জাতীয় বৃহদাকার বন্যজন্তু। পুরাতাত্ত্বিকদের মতে ছবিগুলি উচ্চ প্যালিওলিথিক যুগের
মানুষের আঁকা।
মধ্যপ্রস্তর
যুগে আঁকা ছবিগুলি আকারে ছোটো জীবজন্তুর ছবি, মানুষের শিকাররত থাকার ছবি এবং
মানুষের ব্যবহৃত লাঠি, বর্শা, তীরধনুক ইত্যাদির ছবি। আবার সমবেত নাচ, বাদ্যযন্ত্র,
মৃত পশু কাঁধে শিকারি মানুষ, মৃতদেহ সমাহিত করার ছবি ইত্যাদি।
পৃথিবীর
অন্যান্য স্থানে তাম্রযুগের যে ধরণের ছবি পাওয়া গেছে, এখানে সেই সব ছবির মতোই ছবি
পাওয়া গেছে। সেই সব ছবি থেকে অনুমান করা হয়েছে তখনকার মানুষ মালওয়া মালভূমির
কৃষিজীবীদের সঙ্গে বিনিময় প্রথায় যোগাযোগ রাখত।
বেশ
কিছু গুহায় প্রাচীন লিপি, ধর্মচিহ্ন, যক্ষমূর্তির ছবি, ঘোড়সওয়ারের ছবি, রথের ছবি
আছে। এই ছবিগুলিতে ব্যবহৃত রঙ মূলত লাল, হলুদ এবং সবুজ। এই ছবিগুলিকে ইতিহাসের
প্রাচীন যুগের ছবি হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
বেশ
কিছু ছবি জ্যামিতিক জ্ঞানপুষ্ট এবং তুলনায় সুসংবদ্ধ। ছবিতে ব্যবহৃত রঙ মূলত ম্যাঙ্গানিজ,
হেমাটাইট এবং কাঠকয়লার গুঁড়ো থেকে তৈরি। সেই ছবিগুলোকে ইতিহাসের মধ্যযুগের আঁকা
ছবি হিসাবে মনে করা হয়।
পর পর
কাছাকাছি সব গুহাগুলোতেই গেলাম। গাইড আন্তরিকতার সঙ্গেই ছবিগুলোর
কথা শোনালেন। গুহাচিত্রগুলো দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে পারিনি। অতীত যেন আমাদের
চোখের সামনে জীবন্ত দাঁড়িয়ে। একটা অজ্ঞাত সময়কে জানার
উত্তেজনায় মনের ভিতর তখন টগবগে। ভীমবেটকার সব কটি আবাসগুহা আমরা দেখলাম। ক্যামেরায় ছবি আর
গাইডের বিবরণী মাথায় ভরে নিলাম। যখন এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম তখন সূর্যদেব লাল গোল থালার মতো
দিগন্ত-ঘাটে প্রায় নামতে চলেছেন।
ভীমবেটকায়
যাওয়ার উপায় - হাওড়া থেকে শিপ্রা বা অন্য কোনো এক্সপ্রেসে ভোপাল যাওয়া যায়। তাছাড়া
কলকাতা থেকে ভায়া মুম্বাই বা ভায়া দিল্লি বিমানেও ভোপাল পৌঁছানো যায়। রাজধানী শহরে
ভালো মাঝারি হোটেলের অভাব নেই। ভোপাল থেকে ট্যাক্সিতে ভীমবেটকার দূরত্ব পঞ্চাশ
কিমির কাছাকাছি। সময় লাগে দু’ঘন্টার কিছু বেশি। সঙ্গে দরকার ছোটো ছাতা অথবা মাথায়
টুপি। পায়ে হালকা স্নিকার থাকাই ভালো। আর ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা অথবা মোবিক্যাম
থাকলেই চলবে। নভেম্বর
থেকে মার্চের মধ্যেই এখানে বেড়াতে যাওয়ার সঠিক সময়।
----------
ফোটো - লেখক
No comments:
Post a Comment