যত কাণ্ড কার্শিয়াংয়ে!
অমর্ত্য
বন্দ্যোপাধ্যায়
১
আমাদের
সকলেরই বয়স বেড়েছে। যদিও, চল্লিশ পেরোলেও
ফেলুদার এখনও চালশে ধরেনি। লালমোহনবাবুকে এখন সবসময় হাতে একটা লাঠি রাখতে দেখা
যায়। যদিও, তাতে ভর দিতে খুব একটা দেখা যায় না। বয়স জিজ্ঞেস করলে বলেন, “আটষট্টি”;
আর লাঠি নিয়েছেন কেন সেই প্রশ্ন করলে কটমট করে তাকান। বলেন, “আত্মরক্ষা’কে লিয়ে!
বঙ্গাল কা অস্ত্র!” ফেলুদা এখন মোবাইল নিয়েছে বটে, কিন্তু এখনও অবধি সে কাউকে
ট্যুইট করেছে বা ফেসবুকে এ্যাকাউন্ট খুলেছে বলে শোনা যায়নি। আমার একটা ফেসবুক
এ্যাকাউন্ট থাকলেও অচেনা কেউ সেটাকে আমার এ্যাকাউন্ট বলে চিনতে পারবে না। কাজেই
নিশ্চিন্ত। লালমোহনবাবু শুনেছি আজকাল নেটফ্লিক্স আর আমাজন প্রাইমের সমস্ত ওয়েব
সিরিজগুলোকেই নাকি খুব মন দিয়ে ফলো করছেন। প্রখর রুদ্রকে নিয়ে পুলক ঘোষাল সম্প্রতি
ওঁকে একটা ওয়েব সিরিজ বানানোর কথা বলেছেন। তাই লালমোহনবাবুকে এখন খুব মন দিয়ে সেই
জঁরটাকে ফলো করতে হচ্ছে। সেদিন আমাদের বাড়িতে এসে দুঃখ করছিলেন, “কী আর বলব তপেশভাই, ঘেন্না ধরে গেল। শুধু কয়েকটা অন্ধকার অন্ধকার ঘরে বসে
বিচ্ছিরি কয়েকটা ইংরেজি গালিগালাজ করবে আর শোঁ শোঁ করে
হাইওয়েতে গাড়ি চালিয়ে কয়েকটা ধুমধাড়াক্কা অ্যাক্সিডেন্ট,
ব্যস! হয়ে গেল ওয়েব সিরিজ। কোথায় আমাদের প্রখর রুদ্র – একেকটা অভিযানে ফ্রম
সুমাত্রা টু সুমেরু কভার করে ফেলত, আর এদের যেন শহর ছাড়িয়ে একটু দূরে কোথাও যাবার
ইচ্ছেটুকুও নেই! অথচ পুলক হতভাগার বক্তব্য অনুযায়ী, এখন নাকি এই ওয়েব সিরিজ
ব্যাপারটাই সর্বত্র সেলিং লাইক হট কচুরিজ।” ভদ্রলোক মনের দুঃখে শ্রীনাথকে চা দিতে
বলেন। লকডাউন হয়ে ইস্তক নিউমার্কেটে কলিমুদ্দির দোকানটাও বন্ধ হয়ে গেছে। এখন তাই
স্থানীয় কোম্পানির ডালমুটেই ভদ্রলোককে ভরসা রাখতে
হচ্ছে; আর হ্যাঁ ওদিকটা বলতে ভুলে গেছি – ভদ্রলোক এখন অ্যাম্বাসাডর ছেড়ে একটা ওয়াগন-আর নিয়েছেন। রংটা যদিও সবুজই রয়েছে। ‘গ্রিণটা বড়ো সুদিং।’ হরিপদবাবুর চুলে পাক ধরতে শুরু
করেছে। ওঁর ছেলে জার্মানিতে পিএইচডি করতে গেছে। ফেলুদারই বন্ধু স্নেহাশিস,
প্রেসিডেন্সি ছাড়ার পর ওখানকার ম্যাক্স
প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। সেই সূত্রে
ফেলুদাই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সব মিলিয়ে আমরা এখন নিজেদেরকে বেশ নিজেদের মতো
করে গুছিয়ে নিয়েছি। চার্টার্ড শেষ করে
আমিও একটা বিলিতি ফার্মে চাকরি করি এখন।
গত
শনিবারে আমাদের রজনী সেন রোডের বাড়িতে বসেই আড্ডা হচ্ছিল। লালমোহনবাবুই প্রথম
কথাটা পাড়লেন, “তারপর ফেলুবাবু, আমার তো বলতে নেই - ভ্যাকসিনেশনের দুটো ডোজই হয়ে
গেছে। তপেশবাবু আর আপনিও তো সেদিন কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজ নিয়ে এলেন। তা অনেকদিন তো এভাবে ঘরে বসে আছি। একটু কোথাও কাছেপিঠে ঘুরে-টুরে এলে হত না?”
ফেলুদা
খুব আয়েশ করে তার গদিওলা ইজিচেয়ারটায় গা হেলিয়ে দিয়ে বসে জিজ্ঞেস করল, “এখনও তো
সেভাবে লকডাউনই ওঠেনি। ট্রেনও তো চলছে না। এই অবস্থায় আপনি কোথায় যাবার কথা
বলছেন?”
“বেশি দূরে কোথাও না মশাই, আর ট্রেন না চললেও প্লেন তো উড়ছে – তার সঙ্গে সঙ্গে
এও তো আপনি নিশ্চিত জানেন যে, ওয়েব সিরিজের গল্প লেখার অ্যাডভান্স পারিশ্রমিকটা যবে থেকে হাতে পেয়েছি সেদিন থেকেই বেশ কিছুটা অতিরিক্ত
ক্যাশ আমার ব্যাঙ্কে জমা হয়ে রয়েছে। এখন, আপনাকে আর তপেশভাইকে বাদ দিয়ে তো আর আমি
কিছুই করতে পারি না। কাজেই,” ভদ্রলোক ব্যাগ থেকে একটা ব্রাউন পেপারের খাম বের
করেন, “এতে আমাদের তিনজনের টিকিট রয়েছে, ফ্রম ক্যালকাটা টু বাগডোগরা। আগামী
মঙ্গলবারের ফ্লাইট। সকাল ন’টায়
দমদমে রিপোর্টিং। এক সপ্তাহ পরের রিটার্ন টিকিটও ওর
সঙ্গেই দেখবেন জোড়া রয়েছে। আপনি প্লিজ না করবেন না স্যার।” ভদ্রলোক কাঁচুমাচু মুখে
ফেলুদার দিকে তাকান।
ফেলুদা
রীতিমতো চমকে গিয়ে বলে ওঠে, “সে কী! আপনি এরই মধ্যে একেবারে টিকিটেরও ব্যবস্থা করে ফেলেছেন? আগামীকাল অবধি তো
এমনিই লকডাউন রয়েছে। কাল থেকে যদি আবার কড়াকড়ি বাড়িয়ে দেয়?”
“কিচ্ছু
বাড়বে না স্যার, আপনি আমার উপরে পুরো ভরসা করতে পারেন,” ভদ্রলোক স্বভাবসিদ্ধ
ভঙ্গিতে বলেন, “আমাদের পাড়ার যতীন মুখুজ্যে, ওর ছোটো জামাই তো সরকারি অফিসার। নতুন রাইটার্স বিল্ডিংয়ে মুখ্যসচিবের চেম্বারের
পাশেই নাকি ওর ঘর। সেই যতীন মুখুজ্যেই গতকাল জানাল
যে, পরশু থেকেই নাকি বিধিনিষেধ অনেকটা শিথিল করে দেবে। কাজেই আর দুশ্চিন্তা নেই।
একটু শরীর আর মনটাকে এইবেলা রিফ্রেশ করে আসি চলুন।”
ফেলুদার
বোধহয় ব্যাপারটা তখনও পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছিল না। খাম থেকে প্লেনের টিকিটগুলোকে
বের করতে করতে সে জিজ্ঞেস করল, “আর তোপসে যদি এখন অফিস থেকে ছুটি না পায়? সেই
ব্যাপারটা ভেবে দেখেছেন কি?”
লালমোহনবাবু
কিছু বলার আগেই আমার মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে গেল, “সে আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব
ফেলুদা। এক বছরের উপর হয়ে গেল ওয়ার্ক ফ্রম
হোম চলছে। সাত দিন ছুটি এখন আমি আরামসে নিতে
পারি।”
লালমোহনবাবু
ফেলুদার দিকে তাকিয়ে চওড়া হাসি হাসেন, ভাবখানা এমন - যে দেখলেন তো, কী বলেছিলুম! ফেলুদা তখনও যেন কীসব ভেবে
চলেছে, “আর এখন যে প্লেনে উঠতে গেলে কীসব
টেস্টের রিপোর্ট-টিপোর্ট দিতে হচ্ছে শুনলাম?”
“ও নিয়ে
আপনি একদম চিন্তা করবেন না ফেলুবাবু। ইন্ডিগোতে
টিকিট কেটেচি, পুষ্পক ট্র্যাভেল এজেন্ট থেকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে
আগের দিন রাত্তিরে ওরাই বাড়িতে এসে স্যাম্পল নিয়ে যাবে। সকালে ফ্লাইটে ওঠবার সময়
এয়ারপোর্টের হেল্প ডেস্ক থেকেই হাতে হাতে রিপোর্ট ধরিয়ে দেবে। এগুলো আজকাল কোনো সমস্যাই নয় মশাই,” লালমোহনবাবু সহাস্যে বলেন, “টিভিতে শোনেননি? আমরা তো
এখন ডিজিটাল যুগের বাসিন্দা মশাই!”
ফেলুদা
টিকিটগুলোকে আবার খামের ভিতরে চালান করে দেয়, “বেশ বুঝলাম। তাহলে আপনার কথাই রইল। কিন্তু
যাওয়াটা হচ্ছে কোথায়?”
লালমোহনবাবু
জবাব দেন, “কার্শিয়াং থেকে আরও খানিকটা উপরে। মিরিক লেকের নাকি একটা চমৎকার বার্ডস
আই ভিউ পাওয়া যায়। পুলক ছোকরারই পরিচিত বন্ধু একজন, নাম জয়ন্ত সেনাপতি। তাঁরই একটা
বাংলো রয়েছে ওখানে। একটু দূরেই ওঁদের নিজস্ব চা-বাগান। পুলকই বলল, ‘লালুদা, এই
সময়টাই বেস্ট। বর্ষা ঢুকব ঢুকব করলেও এখনও তেমনভাবে ঢোকেনি। পাহাড়ে বসে কুয়াশার
আসা-যাওয়া দেখবে, চা খাবে আর ওয়েব
সিরিজের স্ক্রিপ্টটা সাজিয়ে ফেলবে।’ না আর কী করে বলি বলুন?”
ফেলুদা
মাথা নেড়ে বলল, “বেশ। তাহলে ওই কথাই রইল। মঙ্গলবার সকাল। আপনিই আমাদের পিকআপ করছেন
তো?”
জটায়ু তাঁর সেই বিখ্যাত জটায়ু-সুলভ
ভঙ্গিতে বলে ওঠেন, “নিশ্চয়ই! অ্যাট এইট
ফিফটিন শার্প।”
উনি
বেরিয়ে যেতেই, আমি সঙ্গে সঙ্গে ল্যাপটপ খুলে ছুটির দরখাস্তটা লিখতে শুরু করলাম।
মনে মনে বেশ একটা উত্তেজনাকর অনুভূতি হচ্ছিল। হঠাৎ এতদিন পর, আবার আমরা থ্রি
মাস্কেটিয়ার্স একসঙ্গে! এটা ভাবতেই ভীষণ ভালো লাগছিল।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই দরখাস্তটা লিখে পাঠিয়ে দিলাম। কালকে সকালেই লন্ড্রি থেকে গিয়ে
গরম জামাকাপড়গুলোকে নিয়ে আসার একটা বন্দোবস্ত করতে হবে।
২
বাড়ির
নাম ‘মেঘবিতান’। বাগডোগরা থেকে গাড়ি নিয়ে এখানে আসতে এতটুকুও অসুবিধে হয়নি। সেই
তিস্তা নদী আর সেবক ব্রিজ। গ্যাংটকে গণ্ডগোল আর দার্জিলিং জমজমাটের স্মৃতিগুলোকে
খুব মনে পড়ছিল। ফেলুদা গোটা রাস্তা ধরেই নতুন একটা বই পড়তে পড়তে এসেছে। ‘দ্য রাইজ
এ্যান্ড ফল অব দ্য থার্ড রাইখ’। লেখকের নামটা এখন আর খেয়াল করতে পারছি না।
গাড়িতে
আসতে আসতেই ফেলুদা বলছিল, “আশ্চর্য মানসিকতার হয় এই একেকজন ডিকটেটরেরা। ধরাকে
সরাজ্ঞান করে যেমন, আবার অন্যদিকে একেকজন মানুষের প্রতি কী অগাধ বিশ্বাস। যুক্তিবোধের ছিটেফোঁটাটুকুও তখন আর তাদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া
যায় না। যেমনটা হিটলার বিশ্বাস করেছিল গোয়েরিং অথবা হিমলারকে। অনেকেই বলে এখন, হিটলারের চাইতেও নাকি আসলে শতগুণে বেশি নৃশংস ছিল এই গোয়রিং আর হিমলার। ইতিহাস এখন এই সমস্ত কিছুকে নিয়েই আবার
নতুন করে গবেষণা শুরু করতে চেষ্টা করছে।”
“এসব কি
আপনার হাতের ওই বইটাতে রয়েছে নাকি মশাই?” লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করেন।
“সবটা
নয়, তবে কিছু কিছু উল্লেখ রয়েছে,” ফেলুদা
জবাব দেয়।
আমি জানি
যে ইদানীং ফেলুদা ভীষণভাবে হিটলার আর জার্মানির ইতিহাস নিয়ে মেতে উঠেছে। এর কোনো বিশেষ কারণ আছে বলে অবশ্য জানা নেই আমার। তিনটে নাগাদ আমরা মেঘবিতানে এসে পৌঁছলাম।
জয়ন্তবাবুদের
এই বাড়িটা দোতলা। প্রায় একটা প্রাসাদের মতোই। বাইরের
দেয়ালগুলো পাথরের। ভিতরে কাঠ আর সিমেন্ট দু’রকম জিনিসই
ঘর তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে। বাড়ির
সামনেও বেশ খানিকটা ছড়ানো কম্পাউন্ড। আমরা আসব বলে ওঁরা দু’জনেই নিচে নেমে এসে আমাদের জন্য মূল
ফটকের বাইরেটায় অপেক্ষা করছিলেন। বাড়িতে লোক বলতে ওঁরা দু’জন। জয়ন্তবাবু আর ওঁর ছেলে সুরঞ্জন। ছেলের বয়স আন্দাজ তিরিশ-বত্রিশ হবে।
জয়ন্তবাবুর স্ত্রী বছর পাঁচেক হল গত হয়েছেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার আগে অবধি নাকি উনি
পুনার ওদিকে মহারাষ্ট্রের কোনো জায়গাতে
কফির ব্যাবসা করেছেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার
পর সেই পাট চুকিয়ে এখন নিজভূমে ফিরে এসে এই চায়ের ব্যাবসাতে হাত দিয়েছেন। বাড়ির সামনের রাস্তা ধরে খানিকটা এগোলেই একটা টিলার
কাছাকাছি পৌঁছোনো যায়। সেই টিলার উপর থেকে সত্যি
সত্যিই মিরিক লেকের একটা আশ্চর্য সুন্দর বার্ডস আই ভিউ রয়েছে। পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর
হয়ে যাবে বলে আমরা পথেই একটা ধাবাতে লাঞ্চ করে নিয়েছিলাম। এখন মেঘবিতানের সামনে
লনে বসেই রঙিন ছাতার তলায় চা খেতে খেতে আলোচনা হচ্ছিল।
“আপনি
কিন্তু দিব্যি লোক মশাই। জীবনে চা, কফি দুটোরই ব্যাবসা করলেন?” লালমোহনবাবু সহাস্যে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলেন।
“এই যে
চা’টা খাচ্ছেন এও কিন্তু আমাদেরই বাগানের। অনেক রকমের চা এক্সপোর্ট করি আমরা। এই
ভ্যারাইটিটার মার্কেটে নাম হচ্ছে রয়্যাল গোল্ড। খুব ফাইন লিভস হয় এটার, আর তেমনিই
ফ্লেভার,” জয়ন্তবাবুর কথায় একটা গর্ব ঝরে পড়ে। ফেলুদা যদিও মকাইবাড়ির ভক্ত, কিন্তু সেও চায়ে একটা চুমুক দিয়ে বলল, “বেড়ে।” জয়ন্তবাবু সলজ্জভাবে হাসেন।
সুরঞ্জন একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। সে বোধহয় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পছন্দ করে না। একটুক্ষণ উশখুশ করতে করতে সে বলল, “আমি একটু
হেঁটে আসছি বাবা। বেশিদূর যাব না। তোমার বাজার থেকে
কিছু লাগবে কি?” জয়ন্তবাবু মাথা নেড়ে ‘না’ বললেন। সুরঞ্জন চলে গেল। জয়ন্তবাবু
কিছুক্ষণ ওর চলে যাবার পথের দিকে চেয়ে রইলেন। “ওর মা চলে যাবার পর থেকেই ও কেমন
যেন একটু একলা হয়ে গেছে। দোষের নয় বোধহয়। সমবয়সি বন্ধুও তেমন কেউ নেই এখানে। বাগানের কাজ নিয়ে সারাটা দিন পড়ে থাকে। কিন্তু সন্ধেটায় যেন দম আটকে আসে। বুঝতে পারি ওর অসুবিধেটা।” জয়ন্তবাবুর গলাটা একটু বিষাদগ্রস্ত হয়ে এসেছে।
“সে যা
হোক,” কথা বলতে বলতেই জয়ন্তবাবু উঠে দাঁড়ালেন হঠাৎ, “আপনাদের সঙ্গে আরেকজনের আলাপ
করিয়ে দিই।” ততক্ষণে বড়ো গেটটা ঠেলে যিনি ঢুকে এসেছেন,
তাঁরও বয়স জয়ন্তবাবুর আশেপাশেই। ব্যাকব্রাশ
করা চুল। লম্বা সুপুরুষ চেহারা। টকটকে গায়ের রঙ। “দীননাথ
লাহিড়ী,” জয়ন্তবাবু আলাপ করিয়ে দেন, “এখানকার প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। যদিও, বলতে নেই
ইনিও আমারই মতো দীর্ঘদিন মহারাষ্ট্রে কর্মরত ছিলেন; আবার আমারই সঙ্গে প্রায় একই
সময়ে ইনিও বাংলায় ফিরেছেন। কাজেই আমাদের সম্পর্কটা অনেকদিনের।”
দীননাথবাবু
সুরঞ্জনের ফেলে যাওয়া চেয়ারটায় আরাম করে বসলেন।
“যা বলেছ
জয়ন্ত,” বেয়ারার রেখে যাওয়া নতুন চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিতে নিতে দীননাথবাবু
বলেন, “তা এনাদেরকে তো ঠিক চিনলাম না।”
“এনারা
আজই এসেছেন,” জয়ন্তবাবুই আলাপ করিয়ে দেন, “ইনি প্রদোষ মিত্র, স্বনামধন্য ডিটেকটিভ। লালমোহন
গাঙ্গুলী, প্রথিতযশা সাহিত্যিক; আর এ হল তপেশ – তপেশরঞ্জন মিত্র।
প্রদোষবাবুর খুড়তুতো ভাই, এবং পেশাগত ভাবে চার্টার্ড
অ্যাকাউন্ট্যান্ট।”
আমরা হাত তুলে একে একে নমস্কার করি।
“তা বেশ,
তা বেশ,” ভদ্রলোকও প্রতিনমস্কার করেন, “আজ কিন্তু বেশিক্ষণ বসব না। একবার একটু বাজারের দিকে যেতে হবে। কয়েকটা জিনিস কেনার আছে।
তা এনারা যদি কাল একবার আমার বাড়িতে চলে আসেন, এই ধরুন সন্ধের দিকটাতে এলেন; জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে কিন্তু। আসলে এখানে গল্প করার মতো
সঙ্গী তো তেমন পাই না। আপনারা এলে ভালোই লাগবে।”
লালমোহনবাবু
সঙ্গে সঙ্গে সবার আগে বলে উঠলেন, “এতে অন্তত আমার তো কোনোই আপত্তি থাকতে পারে না মশাই। আপনি কী বলেন, ফেলুবাবু?”
ফেলুদা কিছু
বলবার আগেই দীননাথবাবু অদ্ভুত একটা
দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলেন, “শুধু তাই-ই নয়, আপনি যখন ডিটেকটিভ – কাল আপনি এলে
আমার ভালোই লাগবে। আসলে, কিছুদিন ধরে কেউ বা কারা
আমাকে হুমকি চিঠি দিচ্ছে। আমি প্রথমে ব্যাপারটাকে অতটা আমল দিইনি। কিন্তু
আপনি যখন এসেই পড়েছেন, এই বিষয়ে একবার আপনার পরামর্শ নিতাম।”
জয়ন্তবাবু এই কথাতে যেন বেশ খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন বলে মনে হল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস
করলেন, “কই, তুমি তো আমাকে কিছু বলোনি এই ব্যাপারে? পুলিশকে জানিয়েছ?”
দীননাথবাবু
সহাস্যে বলেন, “আরে অত ঘাবড়ানোর মতো কিছু হয়নি। স্থানীয় কেউ বদ রসিকতা করেছে কোনো কারণে। তুমি এত টেনশন কোরো না তো।”
“চিঠিগুলো
সঙ্গে আছে আপনার?” ফেলুদা জিজ্ঞেস করে।
“এখন তো
সঙ্গে নেই। তবে কাল আপনি আমার বাড়িতে এলে পরে, নিশ্চিত দেখাতে পারব,” দীননাথবাবু জবাব দেন।
“তাহলে
ওই কথাই রইল,” ফেলুদা জয়ন্তবাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনিও যাবেন তো?”
জয়ন্তবাবু
হেসে বলেন, “সে আর বলতে। এমনিতেও বাগানে সন্ধের পরে আর কোনো কাজই থাকে না। সন্ধেগুলো তাই এমনি সময়ও আমি মাঝেমধ্যে দীননাথের বাড়ি চলে যাই। ও-ও চলে আসে এখানে। কাজেই এটা কোনো কথাই নয়। কাল সন্ধে
সাতটায় পৌঁছোচ্ছি তাহলে?”
দীননাথ
মাথা হেলিয়ে সায় দেন। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে তিনি উঠে পড়েন। সূর্য ডুবে এসেছে।
রাত্রে
শোবার সময় লালমোহনবাবু ফিসফিস করে আমাকে বললেন, “হাইলি সাসপিশাস! আমার মন বলছে এই
হুমকি চিঠির অন্তরালে জয়ন্তবাবুও জড়িয়ে থাকতে পারেন। চিঠির কথাটা শুনে ওনার রিঅ্যাকশনটা দেখলে? পাকা অপরাধীরাই কেবল ওইভাবে অভিনয় করে সত্যিটাকে চাপা দেওয়ার
চেষ্টা করে।”
ফেলুদার
কান সজাগ। সে ওপাশ থেকে কথাটা শুনতে পেয়ে বলল, “আঃ লালুদা! আপনার স্বভাব আর পালটাল
না। এখনও তেমন কোনো অপরাধই ঘটেনি আর আপনি কিনা
আমাদের গৃহস্বামীকে অপরাধী প্রমাণ করতে শুরু করে দিলেন!”
লালমোহনবাবু
চুপ করে গেলেন। ফেলুদা চাদরটাকে গায়ের উপরে টানতে টানতে বলল, “নিশ্চিন্তে ছুটিভোগ
করুন মশাই। এখন এখানে কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা
একটা কিছু ঘটে গেলে আপনার ওয়েব সিরিজ লেখা মাথায় উঠে যাবে তো!”
লালমোহনবাবু
সটান বিছানার উপরে উঠে বসে বললেন, “তার মানে আপনি ঘটনা এক্সপেক্ট করছেন?”
“আপাতত
আমি ঘুম এক্সপেক্ট করছি লালমোহনবাবু। আর কিচ্ছু না।”
ভদ্রলোক
আবার গুম মেরে গিয়ে চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমার মন বলছিল যে, ফেলুদা একটা
কিছু নিশ্চয়ই আন্দাজ করেছে। আর যেখানে আমরা তিনজন রয়েছি – সেখানে একেবারে
নির্ভেজাল ছুটিভোগ আর কবেই বা হয়েছে? আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। আমার মন বলছিল
একটা কিছু ঘটবে, আর সেটা কালই। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেই জানি
না। সকালে ফেলুদার ডাকে ঘুম ভাঙল।
৩
“তোপসে,
ওঠ শিগগির। দীননাথবাবু খুন হয়েছেন,” কথাটা শুনেই আমি তড়াক করে বিছানার উপরে উঠে
বসলাম।
“খুন!”
“হ্যাঁ,
আজ সকালে উনি রোজকার মতো চা’বাগানের দিকটায় হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। সেই সময় পিছন থেকে
এসে মাথায় বাড়ি মেরে খুন। পুলিশ এসেছে। জয়ন্তবাবু ইতিমধ্যেই স্পটে চলে গেছেন।
আমরাও বেরুব।”
আমি
পাশের খাটের দিকে চেয়ে দেখলাম লালমোহনবাবুও ঘুম ভেঙে উঠে বসেছেন। একবার শুধু অস্ফুটে কী যেন বললেন। আমার শুনে মনে হল উনি
যেন বলছেন, “মার্ডার এ্যাট মেঘবিতান!”
কার্শিয়াং
থেকে যে বড়ো রাস্তাটা এসেছে, সেই রাস্তাটাই
সটান বাজার ছাড়িয়ে এসে চা’বাগানের উদ্দেশে চলে
গেছে। মেঘবিতানে আসতে গেলে বড়ো রাস্তা
ছেড়ে বাঁ দিকের একটা রাস্তা ধরে অল্প উঠে আসতে হয়। এই রাস্তাটাই আবার চলে গেছে
একটা টিলার উপরে মিরিক লেকের ভিউ পয়েন্ট অবধি। চা’বাগানের রাস্তার উপরেই খুনটা
হয়েছে। এই রাস্তাটা চা’বাগানে গিয়েই শেষ। কাজেই গাড়িঘোড়া বড়ো একটা চলে না। এছাড়াও অত সকালে
প্রাতঃভ্রমণকারীদেরও যে খুব একটা ভিড় থাকে তা নয়। ছোট্ট জনপদ। ট্যুরিষ্ট স্পটও নয়।
সেজন্য মানুষের ভিড় একেবারেই নেই। স্থানীয় বাসিন্দারাই মূলত থাকেন এখানে।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখলাম জয়ন্তবাবু গম্ভীর মুখে পায়চারি করছেন। দু’জন পুলিশ কনস্টেবল আর অফিসার ইন চার্জ দাঁড়িয়ে। একজন ফোটোগ্রাফার তখন
বিভিন্ন অ্যাঙ্গল থেকে মৃতদেহের ছবি তুলছেন, যেমনটা সব খুনের ক্ষেত্রেই করা হয়ে থাকে। সুরঞ্জনকে কোথাও দেখলাম না।
স্থানীয় দু-চারজন কুলিমজুর গোছের লোকজন
এদিক-সেদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। কেবল আরেকজন
ভদ্রগোছের মানুষকে দেখলাম একজন কনস্টেবলের সঙ্গে কথা বলছেন। ফেলুদা জয়ন্তবাবুর
দিকে এগিয়ে গেল।
“বিশ্রী
ব্যাপার,” ফেলুদা কিছু বলার আগেই জয়ন্তবাবু বললেন, “দীননাথকে যে কেউ এভাবে খুন
করতে পারে বিশ্বাস হচ্ছে না।”
“পুলিশ
কিছু সাসপেক্ট করছে?”
“এখনও
অবধি তো নাথিং,” জয়ন্তবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বলেন, “এই ছোট্ট জায়গাতে আর কাকেই বা
সাসপেক্ট করবে বলুন।”
“আপনার
ছেলেকে দেখছি না?”
“ও তো
সকালে উঠেই খবরটা পেয়েছে, কিন্তু তারপর ওর কয়েকটা কীসব জিনিস আসার ছিল কার্শিয়াং থেকে। সেগুলো
আনতে হবে বলে ও সকালেই শহরে চলে গেছে। তাছাড়া এসব
খুন রক্ত, কারই বা ভালো লাগে বলুন?”
“হুঁ,” ফেলুদা মাথা নেড়ে সায় দেয়, “আর ওই ভদ্রলোককে তো চিনলাম না?” সে অন্য
ভদ্রলোকটির দিকে আঙুল দেখায়। তিনি তখনও সেই কনস্টেবলটির সঙ্গে ব্যস্তসমস্তভাবে কথা
বলে যাচ্ছেন।
“উনি
এখানে নতুন এসেছেন। তাও অবশ্য মাসপাঁচেক হয়ে গেল বোধহয়। ওনার নাম মনোময়। মনোময়
চৌধুরী বোধহয়। সেভাবে আলাপ হয়নি এখনও। বাজারের দিকে বাসা নিয়েছেন। আগে নাকি
কলকাতার কোন সওদাগরি আপিসে চাকরি করতেন। এখন রিটায়ার
করে এখানে সেটল করার কথা ভাবছেন।”
“আই সি,”
ফেলুদা এবার অফিসার ইন চার্জের দিকে এগিয়ে যায়।
অফিসার
ইন চার্জ এক কথাতেই ফেলুদাকে চিনে ফেললেন। নাম বীরেন্দ্র চট্টরাজ। আগে নাকি
কলকাতার শ্যামপুকুরে ছিলেন। সেই সময় চাঁদনি চক এলাকাতে, একটা জোড়া খুনের মামলার
বিষয়ে ফেলুদাকে জড়িয়ে পড়তে দেখেছিলেন। কাজেই নতুন করে আর ফেলুদাকে নিজের পরিচয়
দিতে হল না।
“আপনার কী মনে হচ্ছে সবকিছু দেখে?” ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
“ব্লান্ট
কোনো হাতুড়ি বা হামানদিস্তা জাতীয়
বস্তু দিয়ে খুনটা করা হয়েছে। এখন খুনী যদি মার্ডার ওয়েপনটাকে ওই পাশের খাদে ফেলে
দিয়ে থাকে, তাহলে সেটাকে পাবার আর কোনো চান্স
প্রায় নেই বললেই চলে। খুনটা হয়েছে সকাল সাড়ে পাঁচটা থেকে ছ’টার মধ্যে। তখন এমনিতেই লোকজন প্রায় ছিলই না এই চত্বরে। তবে
দীননাথবাবু যে এরকম সকাল সকাল করেই হাঁটতে বেরুতেন, সে খবর
পেয়েছি।”
“ওনার
বাড়িতে আর কেউ আছেন? খবর দেওয়া হয়েছে?”
“এখানে
তো উনি একেবারে একাই থাকতেন। একটা ঠিকে কাজের লোক ছিল কেবল। খোঁজখবর করে দেখতে হবে
এবার যে ওনার আত্মীয়পরিজন কেউ দেশবিদেশের কোথাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নাকি। নয়তো বডি
রেখে দিতে হবে। অনেক ঝামেলা সে সব,”
ভদ্রলোক একটা ক্লান্ত নিঃশ্বাস ছাড়েন।
“হুমম
বুঝলাম,” ফেলুদা ঘাড় নাড়ে। এই সময় হঠাৎ মনোময় চৌধুরী বলে যে ভদ্রলোক, তিনি আমাদের
দিকে এগিয়ে আসেন।
“বাঙালি তো – ট্যুরিস্ট?” লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে
প্রশ্নটা করা হয়েছে।
“আজ্ঞে,
আপনিও?” লালমোহনবাবু পালটা জিজ্ঞেস করেন।
“ঠিক তা
নয়। আমি এখানকারই বাসিন্দে। তবে বেশিদিনের
না। এই মাসপাঁচেক হল এসেছি,” ভদ্রলোকের কথার মধ্যে কেমন যেন একটা টান আছে লক্ষ
করলাম।
“টেরিবল
ব্যাপার,” ভদ্রলোক বলেন। আমরা ঘাড় নেড়ে সায় দিই। এই কথার কোনো উত্তর হয় না। লালমোহনবাবুই ফস করে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি চিনতেন নাকি
ভদ্রলোককে?”
“উঁহুঃ,”
মনোময় চৌধুরী জবাব দেন, “আলাপ ছিল না। কেবল বাজারে দূর থেকে এক-দু’বার দেখেছি। কখনও কথা হয়নি।”
এর মধ্যে ফেলুদাও আমাদের দিকে এগিয়ে এসেছে।
“আমার
নাম মনোময় চৌধুরী,” ভদ্রলোক আমাদেরকে নমস্কার করেন,
“আপনারা?”
“আমি
প্রদোষ মিত্র, আমার ভাই তপেশরঞ্জন মিত্র, আর ইনি আমাদের বন্ধু লালমোহন গাঙ্গুলী,”
ফেলুদাই আলাপ করিয়ে দেয়।
“নাইস টু
মীট ইউ, সো নাইস টু মীট ইউ,” ভদ্রলোক হেসে বলেন। জয়ন্তবাবু
ইতিমধ্যে বাড়ি ফিরবেন ফিরবেন করছেন। উনি হাঁক দিয়ে আমাদেরকে বলেন, “মিস্টার
গাঙ্গুলী, মিস্টার মিত্তির – আমি এগুলাম। আপনারা ধীরেসুস্থে আসুন।” ফেলুদা হাত নেড়ে সম্মতি জানাল।
মনোময়
চৌধুরী বললেন, “একটু নেমে গেলেই একটা ভালো চায়ের দোকান আছে। চা চলে তো আপনাদের?”
লালমোহনবাবু
ঘাড় নাড়বার আগেই ফেলুদা জবাব দেয়, “হ্যাঁ চলে বৈকি, এই চায়ের দেশে এসে চা চলবে না,
তাও কি হয়?”
চা খেতে
খেতেই মনোময়বাবুর সঙ্গে আলাপ হল। ভদ্রলোক কলকাতায় একটা আধাবিলিতি বেসরকারি ফার্মের
অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। বললেন দিশিবিলিতি গোয়েন্দা গল্পের
নাকি পোকা একেবারে। তাই সকালে খুন হয়েছে শুনেই দেখতে চলে এসেছিলেন।
“এমনি এই
জায়গাটা কিন্তু ভীষণ শান্ত, নিরিবিলি, চুপচাপ গোছের। খুন তো দূর অস্ত, তেমন বড়ো কোনো চুরি-ছিনতাইও এখানে কখনও হয়েছে বলে তো শুনিনি। সেখানে একেবারে খুন,”
ভদ্রলোক বেশ এক্সাইটেড হয়ে পড়েছেন বুঝতে পারছিলাম। কেবল লালমোহনবাবুকে কেমন যেন
একটু মনমরা বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু মনোময়বাবুও বেশি সময় নিলেন না। চা শেষ করে, “আমাকেও একবার নিচে পোস্ট অফিসে যেতে হবে। পার্সেল
আসার আছে একটা,” এই বলে হাঁটতে হাঁটতে নিচে নেমে গেলেন। আমরাও মেঘবিতানে ফিরে এলাম।
৪
“আপনার
মনখারাপের কারণ কী, সেটা আমি কিছুটা আন্দাজ করতে
পেরেছি লালমোহনবাবু,” ফেলুদা তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলে হঠাৎ।
আমরা
তিনজনে সেই ঢিলাটার উপরে বেড়াতে এসেছিলাম। বিকেল হয়ে এসেছে। দূরের
পাহাড়ের গায়ে সূর্যের শেষ আভাটুকু এখনও লেগে রয়েছে। অনেকটা দূরে আর অনেকটা নিচে
মিরিক লেকের বিশাল জলের অংশটাকে দেখা যাচ্ছে। শেষ বিকেলের আলো পড়ে সোনালি জল যেন
এতটা দূর থেকেও চকচক করছে। লালমোহনবাবু মুচকি হেসে ফেলুদার দিকে তাকালেন, “সে তো আপনি ধরে ফেলবেনই আমি জানতাম। তপেশভাই কি আন্দাজ করতে পেরেছে?”
আমি
বললাম, “এত দিশিবিলিতি গোয়েন্দা গল্পের পোকা হয়ে, আজীবন কলকাতাতে কাটিয়ে পরেও
স্বনামধন্য জটায়ুর নামটুকুও কেউ শুনল না – এতেই
বুঝি খটকা লেগেছে আপনার?”
“একজ্যাক্টলি!”
ভদ্রলোক রীতিমতো রোষের সঙ্গে বলে ওঠেন, “শুধু আমিই বা কেন, অক্রূর নন্দী, জীবন
সেনগুপ্ত, নরেশ চাকলাদার! এঁদের একজনেরও লেখা পড়েনি – অথচ নিজেকে বলে কিনা
গোয়েন্দা কাহিনির ভক্ত – এও কি বিশ্বাস করতে হবে?”
ভদ্রলোক
রীতিমতো চটে গেছেন বুঝলাম। ওনাকে শান্ত করতে তাই কথা ঘোরাতে চাইলাম, “কিন্তু এদিকে
খুনটা তাহলে কে করল আপনার মতে? এই মনোময় চৌধুরীকেই কি আপনার এই ব্যাপারে সন্দেহ
হয়?”
“উঁহুঃ,
ওই অপরাধের বিদ্যে নিয়ে খুন করা চলে না। সবকিছুরই একটা প্রস্তুতি আছে, একটা
পড়াশুনো বলে ব্যাপার আছে। তবে আমার মনে হয় যে সু-” এই ‘সু’ অবধি বলে ভদ্রলোককে
থেমে যেতে হল কারণ ফেলুদা হাত তুলে ওনাকে থামতে ইঙ্গিত করেছে। টিলা বেয়ে ততক্ষণে আরেকজন
পরিচিত মানুষ আমাদের দাঁড়ানোর জায়গাটাতে উঠে এসেছেন। ফেলুদাই
অল্প হেসে সম্বোধন করল, “আসুন সুরঞ্জনবাবু –
কার্শিয়াংয়ের কাজ মিটল আপনার?” কাষ্ঠ হেসে সুরঞ্জন অল্প করে মাথা হেলাল, “আজ্ঞে
হ্যাঁ। এসে গেছে সব কিছু। চা’বাগানেরই কিছু জিনিসপত্র
আসার ছিল।”
“বেশ,” ফেলুদা
সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল, “বেশ জায়গা কিন্তু – মিরিক লেকের ভিউটা সত্যি অসাধারণ।
আপনিও বুঝি বিকেলের দিকে এখানে চলে আসেন মাঝে মাঝে?”
“আমি
প্রায় রোজ বিকেলেই এখানে এসে একা কিছুক্ষণ করে বসে থাকি,” সুরঞ্জন বলে, “মনটা
শান্ত হয়ে যায় এখানে এলে পরেই।”
“সত্যিই,”
ফেলুদা পালটা জিজ্ঞেস করে আবার, “এই দীননাথবাবুকে তো আপনারা নিশ্চয়ই অনেক দিন থেকে
চিনতেন। এখানে সেটল করার সময়েই কি আলাপ?”
“দীননাথ
জেঠুর সঙ্গে আমাদের বহুদিনের সম্পর্ক। পুনাতে থাকতেই ওনার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।
এমনকি আমার মা’কেও উনি দেখেছিলেন,” সুরঞ্জন বলে। ফেলুদা যেন একটু অবাক হয়েছে বলে
মনে হল, “সেই মহারাষ্ট্রে থাকার সময় থেকেই আপনাদের পরিচয়?”
“একদমই
তাই,” সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে সুরঞ্জন।
“আই সি,”
ফেলুদা সুরঞ্জনের চোখের দিক থেকে দৃষ্টি নামিয়ে খাদের দিকে তাকায়, “এখন ওনাকে কেউ
কেন খুন করতে চাইবে – এই বিষয়ে আপনি কি কোনোরকম আলোকপাত করতে পারেন?”
সুরঞ্জন
দু’পাশে মাথা নাড়ে, “আমি এখনও
ব্যাপারটাকে বিশ্বাসই করতে পারছি না।”
লালমোহনবাবু
সুরঞ্জনের অলক্ষ্যে খপ করে আমার ডান হাতটাকে চেপে ধরলেন। এখনও ভদ্রলোক ফেলুদার
থেকেও এক ধাপ এগিয়ে আগেভাগেই খুনি ঠিক করে
ফেলতে চেষ্টা করেন। অনেকবার ফেলুদার বকুনি খেয়েও এই স্বভাব যায়নি তাঁর। আরও দু-চারটে এলোমেলো কথার পর সুরঞ্জন চলে গেল। ফেলুদা তখনও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে
খাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি জানি যে এই সময়টায় ফেলুদাকে একদম বিরক্ত করতে নেই।
আমরা তাই ফেলুদাকে ঘরে রেখেই সেদিন সন্ধ্যায় একটু নিচের বাজারটা থেকে ঘুরে এলাম। কিন্তু সেদিন রাত্তিরেই আরও একটা ঘটনা ঘটে
গেল।
আমরা যে
ঘরটায় ছিলাম, আয়তনে সেটা প্রকাণ্ড বললেও
অত্যুক্তি হয় না। একটা ডবল বেড খাটের সঙ্গে আরও একটা ক্যাম্পখাট ঢুকিয়ে আমাদের
তিনজনের শোবার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আমি সেই ক্যাম্পখাটটাতে শুয়েছিলাম। কিন্তু কীসের যেন
আওয়াজে অনেক রাত্তিরে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল হঠাৎ। চোখ খুলে দেখলাম ফেলুদা নিঃসাড়ে
কখন যেন জানলার কাছটাতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। লালমোহনবাবু অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। আমি খুব
সন্তর্পণে উঠে আস্তে আস্তে ফেলুদার পাশটাতে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিচে কম্পাউন্ডের বড়ো গেটটার
কাছেই হঠাৎ করে যেন একটা আলোর ঝলক দেখলাম বলে মনে হল। অন্ধকারে চোখটা একটু সয়ে
যেতেই দুটো অবয়বকে আলাদা করে চিনতে পারলাম। একজন তো সেই বেয়ারাটা, যে সকাল সন্ধে আমাদের খেয়াল রাখে, চা-জলখাবার দিয়ে যায়। জয়ন্তবাবুর বক্তব্য অনুসারে সে
নাকি বাগানেরও টুকটাক কাজকর্ম দেখাশোনা করে। নরবু না কী যেন নাম, বাগানের কুলি
লাইনের কাছেই নাকি ওর ঘর। কিন্তু এত রাত্তিরে নরবুই বা কেন হঠাৎ মেঘবিতানের ফটকের
বাইরে দাঁড়িয়ে? এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে কীসের ব্যাপারে কথা বলতে আসবে? আর তার চেয়েও আশ্চর্য বিষয় হল, অন্য যে
অবয়বটিকে আমরা নরবুর সঙ্গে কথা বলতে দেখছিলাম, তিনি
আর কেউই নন – জয়ন্তবাবু স্বয়ং। আমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ফেলুদার দিকে তাকালাম। “শুয়ে
পড় এবার, যা দেখবার দেখা হয়ে গেছে,” চাপা
গলায় ফেলুদা আমাকে নির্দেশ দিল। আমি অস্ফুটে
বললাম, “আর তুমি? তুমি ঘুমোবে না?” “ঘুমোব!” ছোট্ট করে জবাব পেলাম। আমি
খাটে ফিরে এসে আবার শুয়ে পড়লাম। ফেলুদাও দেখলাম জানলার পাশ থেকে সরে এসেছে। শুয়ে
শুয়ে একেকটা মিনিটকে যেন একেকটা ঘন্টা বলে মনে হচ্ছিল। মিনিট দশেক কেটে যাওয়ার পরে
হঠাৎ যেন অনেক দূর থেকে কারও একটা
তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার শুনলাম বলে মনে হল। স্পষ্ট করে বুঝতে পারলাম না। ফেলুদার দিকে
তাকাতে দেখলাম সেও টান হয়ে বিছানার উপরে আধশোয়া হয়ে বসেছে। আমার দিকে চোখে চোখ
পড়তেই সে হাত নেড়ে আমাকে শুয়ে পড়তে বলল। এত কিছুতেও লালমোহনবাবুর ঘুম ভাঙেনি। আমি
আবার চোখ বুজে শুয়ে পড়লাম। শোবার আগে ফোনের ঘড়িতে
দেখেছিলাম, রাত সাড়ে তিনটে। সকালের আগে আমারও আর ঘুম ভাঙল না।
৫
দীননাথবাবু
যেখানে পড়েছিলেন তার থেকে কিছুটা এগিয়ে, মোটামুটি এক-দেড়শো ফুট মতো দূরত্বে নরবুর
দেহটা পড়েছিল। এবারে আর হামানদিস্তা নয়। একটা সস্তা নেপালি কুকরির হাতল নরবুর পিঠ থেকে উঁচিয়ে রয়েছে। সে উপুড় হয়ে পড়েছিল।
“এক
আঘাতেই সাবাড়! কোনো পাকাপোক্ত খুনির কাজ বলেই মনে হচ্ছে মশাই,” বীরেন্দ্র চট্টরাজ মন্তব্য করেন, “এমন
আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে খুনটা করেছে যে বলার নয়।” ভদ্রলোক মাথা নাড়েন।
“কুকরির
হাতলে কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্টস বা তেমন কোনো সূত্র?” ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
“কিচ্ছু
না, হাতে গ্লাভস পরা ছিল। একেবারে নিট অ্যান্ড ক্লিন কাজ সেরেছে।”
ফেলুদার
কপালে সেই বিখ্যাত তিনটে ভাঁজ। জয়ন্তবাবু আর ওঁর ছেলে একটুখানি দূরে দাঁড়িয়েছিলেন।
মনোময় চৌধুরীও খবর পেয়ে এসে পড়েছেন। তিনি লালমোহনবাবুকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করলেন
দেখলাম। জটায়ুও স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হাত-পা
নেড়ে তাঁকে কীসব যেন বোঝাতে শুরু করলেন। ফেলুদা
জয়ন্তবাবুর দিকে এগিয়ে গেল।
“আপনি
খুবই আপসেট বোধহয়?”
“সে আর
বলতে। এভাবে পর পর দু’দিনে দু’জন চেনা মানুষকে যদি চলে যেতে
দেখি,” ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন।
“আপনার
কাউকে সন্দেহ হয়?”
“কাকে
সন্দেহ করব বলুন? তাছাড়া দুটো ঘটনার মধ্যে আমি তো কোনো যোগসূত্রই খুঁজে পাচ্ছি না।”
“নরবুর
ঘরটা যেন কোথায়?”
“এই তো,
এই রাস্তা দিয়ে একটু এগোলে পরেই - উপরে বাঁ হাতে পড়বে।”
“আচ্ছা।
ও কি ঘরে একাই থাকত?”
“এক ভাই
আছে, দার্জিলিংয়ে। এখানে তো একাই দেখেছি।”
“আচ্ছা।”
ফেলুদা
আমার দিকে এগিয়ে এল। “একবার নরবু আর দীননাথবাবুর বাড়িতে যাওয়া দরকার। বীরেনবাবুকে
বললে আশা করছি রাজি হয়ে যাবেন। তোরা মেঘবিতানে ফিরে যা।”
“লাঞ্চের
সময় ফিরবে তো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“যদি না
ফিরি, জয়ন্তবাবুকে বলবি একটা বিশেষ কাজে আমি কার্শিয়াং চলে গেছি। বিকেলের মধ্যেই
ফিরব।”
“আচ্ছা
বেশ, তাই বলব তাহলে।”
“ফোনে
যোগাযোগ করে নেব। চিন্তা করিস না।”
ফেলুদা
বীরেনবাবুর দিকে চলে গেল। লালমোহনবাবু তখনও মনোময় চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে চলেছেন।
আমার দিকে চোখ পড়তে হাত নেড়ে কাছে আসতে বললেন।
“আজও একটু
চা হবে নাকি?”
“ফেলুদার
বোধহয় একটু কাজ আছে। আমি আর আপনি যেতেই পারি।”
“তাহলে
তাই হোক না কেন? অবশ্য আপনার যদি কোনো আপত্তি
না থাকে তাতে,” লালমোহনবাবু মনোময়বাবুকে জিজ্ঞেস করেন।
“এতে
আবার আমার কী আপত্তি থাকবে মশাই? চলুন, আমরা
এগোই তাহলে আস্তে আস্তে।” ভদ্রলোক সহাস্যে বলেন। আমরা তিনজনে মিলে ফিরতে শুরু করি।
জয়ন্তবাবু আর সুরঞ্জন তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে। বোধহয় নরবুর শেষকৃত্য কী হবে, পোস্টমর্টেম ইত্যাদিতেও ওনারা একটু সঙ্গে থাকতে চান। হাজার হোক নরবু
তো ওদের কাছেই কাজ করত। আমরা নেমে যাচ্ছি দেখতে পেয়ে জয়ন্তবাবু বলেন, “লাঞ্চের সময়
দেখা হচ্ছে। আমি প্লিজ একটু এদিকটা সামলে নিই। বুঝতেই তো পারছেন।” আমরা হাত তুলে
ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করলাম। ফেলুদাকে তখন একবার দেখলাম একজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে
আরও উপরে চা’বাগানের দিকে যাচ্ছে। লালমোহনবাবু নাগাড়ে মনোময়বাবুর সঙ্গে কথা বলে
চলেছেন। আমি মনে মনে এই দু’দিনের
ঘটনাগুলোকে সাজিয়ে নিতে চেষ্টা করছিলাম।
বিকেল
অবধিও কিন্তু ফেলুদা ফিরল না। আমি আর লালমোহনবাবু মেঘবিতান থেকে আরেকটু উপরে উঠে
গিয়ে যে টিলাটা রয়েছে সেখানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছিলাম।
“যাই বলো
আর তাই বলো তপেশভাই, আমার কিন্তু এই দুটো খুনের ব্যাপারেই জয়ন্তবাবুকে সন্দেহ
হচ্ছে,” ভদ্রলোক ফিসফিস করে বলেন।
“কিন্তু
জয়ন্তবাবু হঠাৎ এদেরকে খুন করতে যাবেনই বা কেন? মোটিভটা কী ওনার?”
“সেও আমি
ভেবে দেখেছি,” লালমোহনবাবু চোখ গোল গোল করে
বললেন, “সুরঞ্জনের মা অথবা জয়ন্তবাবুর স্ত্রী কীভাবে মারা গিয়েছিলেন আমরা সেটা জানতে পেরেছি কি?”
“উঁহুঃ,”
আমি ঘাড় নাড়ি।
“এখন
দেখো, দীননাথবাবু আর জয়ন্তবাবু দু’জনেরই
কিন্তু সেই মহারাষ্ট্র থেকে পরিচয়। ধরো যদি সেখানে থাকাকালীন দীননাথবাবুর তরফে কোনো ওষুধের বিষক্রিয়ার কারণে বা ভুল চিকিৎসার ফলে জয়ন্তবাবুর স্ত্রী মারা গিয়ে
থাকেন; আর সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই আজ জয়ন্তবাবুও দীননাথবাবুকে মাথায় বাড়ি মেরে
পালটা খুন করেছেন, আমার এই ভাবনাটা কি
নেহাতই উড়িয়ে দেবার মতো?”
“তা নয়,”
আমি মাথা চুলকোই, “কিন্তু নরবু’র ব্যাপারটা তাহলে এখানে কীভাবে যোগ হচ্ছে?”
“হয়তো
নরবু দীননাথবাবুকে খুন হতে দেখে ফেলেছিল। তাই জয়ন্তবাবু আর সাক্ষীর শেষ রাখতে
চাননি।”
“তাই যদি
হবে তাহলে গতকাল রাতে নরবু ওভাবে জয়ন্তবাবুর সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে আসবে
কেন?”
এবারে
লালমোহনবাবু একটু চমকালেন, “কাল রাত্তিরে? কখন?”
আমি
সংক্ষেপে গত রাত্তিরের ঘটনাটা ওনাকে বলে দিলাম। ভদ্রলোক উত্তেজনার বশে হাতের
লাঠিটাকে আপন মনে হাতের মধ্যে ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, “হাইলি সাসপিশাস। নরবু কি
তাহলে জয়ন্তবাবুকে ব্ল্যাকমেল করতে চেয়েছিল? আর তারই মাশুল দিতে হল তাকে?”
লালমোহনবাবু
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই চড়াই পথ বেয়ে ফেলুদাকে উঠে আসতে
দেখলাম। আমাদের দেখে সে সহাস্যে বলল, “কী রে?
রহস্যের জট কতদূর?”
আমি
আন্দাজ করলাম যে ফেলুদা এই রহস্য সমাধানের অনেকটা কাছ অবধি পৌঁছিয়ে গেছে। আমরা কেউ
কিছু বলার আগেই সে বলল, “জলদি নিচে চল
সবাই। মেঘবিতানে চায়ের তোড়জোড় হচ্ছে। দুপুরের খাওয়াটা কার্শিয়াংয়েই সেরে নিয়েছি।
কিন্তু এখন একটু জয়ন্তবাবুর রয়্যাল গোল্ড ফ্লেভার জিভে না পড়লে চলছে না।”
রাস্তা
দিয়ে নেমে আসতে আসতে দেখলাম মেঘবিতানের গেটের ঠিক সামনেটায় দাঁড়িয়ে সুরঞ্জন কতগুলো
পাহাড়ি লোমশ ভুটিয়া কুকুরকে ভেঙে ভেঙে বিস্কুট খাওয়াচ্ছে। লালমোহনবাবু একটু আড়ষ্ট
হয়ে গেলেন।
“সে কী মশাই, আপনার তো ষাঁড়ে এ্যালার্জি ছিল জানতাম। এখন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে
কি কুকুরেও?”
ভদ্রলোক
ফেলুদাকে থামিয়ে দেন, “দূর মশাই, ওগুলোকে কি আপনার কুকুর বলে মনে হচ্ছে নাকি? বাপ রে বাপ! চেহারাগুলোকে লক্ষ করে দেখেছেন? একটা নয় দুটো
নয়, উফফ - একেবারে চার-চারটে ওইরকম – কুকুর হলে কি আর ভয়
পেতাম নাকি? রাত্তিরবেলা আমার কথাগুলোকে মিলিয়ে নেবেন ফেলুবাবু, চাঁদ উঠলেই ওগুলো
সব একেকটা ওয়্যারউলফ!”
ফেলুদা
কোনোমতে হাসি চাপে। “অতিরিক্ত নেটফ্লিক্স দেখার ফল,” সে মৃদু একটা মন্তব্য করে
সামনে এগিয়ে যায়।
“খুব
কুকুর ভালোবাসেন বুঝি?” ফেলুদা সুরঞ্জনকে জিজ্ঞেস করে।
“আজ্ঞে
হ্যাঁ,” সুরঞ্জন একগাল হাসে। হাসলে ওকে বেশ দেখায়, “এদের সঙ্গে আমার বেশ ভাব।”
“সে তো
বুঝতেই পারছি,” ফেলুদাও গায়ের কাছে চলে আসা একটা মিশমিশে কালো ভুটিয়া কুকুরের
মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়।
“আচ্ছা
আপনার মা কীভাবে মারা গিয়েছিলেন বলুন তো?”
দুম করে হঠাৎ জটায়ু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। ফেলুদাও
চমকে গিয়ে অপ্রস্তুত।
কাষ্ঠ
হেসে সুরঞ্জন জবাব দেয়, “মেডিসিন পয়জনিং। ভুল ইঞ্জেকশন পড়েছিল কোনোভাবে। তারই রিঅ্যাকশনে হার্ট এ্যাটাক হয়ে যায়।”
লালমোহনবাবু
জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকান। ফেলুদা আবার কুকুরদের সম্পর্কে সুরঞ্জনকে মামুলি
কিছু প্রশ্ন করতে শুরু করেছে।
ইতিমধ্যে কম্পাউন্ডের বাগানে চায়ের সরঞ্জাম সাজানো হয়ে গেছে। আমরা আস্তে আস্তে
সেদিকেই এগিয়ে গেলাম।
রাত্তিরে
শুয়ে শুয়ে ফেলুদা লালমোহনবাবুর পুরো হাইপোথিসিসটাকে মন দিয়ে শুনল। তারপর বলল,
“কিন্তু, এত সহজেই যদি সমস্তটা বোঝা যেত - তাহলে আপনার অনুমানের ভিত্তিতে আমার
খটকাগুলোকে একটু ব্যাখ্যা করে দিতে পারেন কি?”
“কী খটকা আপনার?” জটায়ু টান হয়ে
বসে জিজ্ঞেস করেন।
“নরবুর
ডান হাতটা লক্ষ করেছেন?”
“ডান
হাত, কই না তো!”
“হোয়াটস্যাপে
মনোময়বাবুর প্রোফাইল নেমটাকে লক্ষ করেছেন?”
“উঁহুঃ!”
“কম্পাউন্ডের
আউটহাউসে রাখা জয়ন্তবাবুর চায়ের বাক্সগুলোকে লক্ষ করেছেন?”
“চায়ের
বাক্স? কেন কী আছে তাতে?”
ফেলুদা
জবাব না দিয়ে বলে চলে, “শেষ প্রশ্ন তোপসেকে। সেদিন রাত্তিরে কম্পাউন্ডের ভিতরে বা
বাইরে জয়ন্তবাবু আর নরবুকে ছাড়াও তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে কি কোনোভাবে দেখতে পেয়েছিলিস?” আমি বোকার মতো ঘাড় নাড়লাম।
“এসব তো
লক্ষ করতে হবে। নইলে সবটাই যে আবার উটের পাকস্থলী হয়ে যাবে।”
মৃদুস্বরে
এই কথাটা শুনে জটায়ু আরও ভালো করে উঠে বসে সহাস্যে,
উজ্বল চোখে কেমন যেন একটা অদ্ভুত
দৃষ্টিতে ফেলুদার দিকে তাকালেন, “হেঃ, যা বলেছেন মশাই! খুব মনে পড়ে জানেন, আজও -
সেইসব দিনগুলোকে,” ভদ্রলোক বেশ যেন একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন বলে মনে হল। তারপরেই
অবশ্য তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “সে যা হোক – আপনার গলায় যখন আবার এতদিন পরে হঠাৎ
সেই বহুকালের পরিচিত তিব্বতি বাঁশির
সুর শুনতে পাচ্ছি, আমার মন বলছে যবনিকা পড়তে আর বেশি দেরি নেই। সত্যিই কি তাই?”
ফেলুদা
বালিশের উপরে মাথা এলিয়ে দিয়ে শুতে শুতে বলল, “এখন কেবল আলোর আভাস মাত্র দেখতে
পেয়েছি। আরও একটু ঘটনা না এগুলে পরে কিছুই বলা সম্ভব হচ্ছে না।”
আমি কাঠ
হয়ে শুয়ে রইলাম। পর পর দু’রাত্তিরেই এই মেঘবিতানের আশেপাশে
দু-দুটো খুন হয়ে গেছে। ফেলুদার গলায়
সেই তিব্বতি বাঁশির সুর। ঘটনা আরও এগুবে বলে
ফেলুদা সন্দেহ করছে। রহস্য কি তাহলে সত্যিই ভেদ হয়ে এল? নাকি আবারও কোনো নতুন কিছু ঘটবে আগামীকাল? জানলার বাইরেটায় নিকষ কালো অন্ধকার।
৬
“খুন!
খুন!” পাহাড়িয়া সকালের নিঃস্তব্ধতাটুকু যেন ভেঙে খান খান হয়ে গেল।
আমাদের
ঘুম ভাঙল সুরঞ্জনের চিৎকারে। ধড়মড় করে বিছানার উপরে উঠে বসতে বসতে লালমোহনবাবুই
সবার প্রথমে বলে উঠলেন, “হ্যাটট্রিক! হ্যাটট্রিক এ্যাট মেঘবিতান!” খুনের সঙ্গে
হ্যাটট্রিকের সম্পর্কটা প্রথমে বুঝতে পারিনি। তারপর বুঝলাম পর পর তিন রাত্তিরে তিন-তিনটে খুন হয়ে গেল বলেই ভদ্রলোকের
এই প্রতিক্রিয়া। আমি ফেলুদার দিকে তাকালাম।
তার কপালে সেই বিখ্যাত তিনটে ভাঁজ দেখব আশা করেছিলাম। অথচ দেখলাম সে বেশ শান্তভাবেই জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তারপর
উঠতে উঠতে সে বলল, “নিচে যাওয়া যাক। আশা করি পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছে।”
নিজের
ঘরেই খুন হয়েছেন জয়ন্ত সেনাপতি। চিত হয়ে শুয়েছিলেন ভদ্রলোক। বুকের উপরে সেই
গতকালের মতোই একটা সস্তা নেপালি কুকরির
হাতল উঁচিয়ে রয়েছে। রক্ত গড়িয়ে বিছানার অনেকটা ভিজে গেছে। লালমোহনবাবু অল্প
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েই ঘরের বাইরে চলে গেলেন। এসব দৃশ্যকে উনি কোনোদিনই বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারেন না। আমারও
গা’টা কেমন জানি গুলিয়ে উঠছিল। কেবল ফেলুদা অনেকক্ষণ ধরে ঝুঁকে ঝুঁকে কীসব যেন দেখল। তারপর সুরঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বলল, “পুলিশকে জানানো হয়েছে তো?”
সুরঞ্জন মৃদুস্বরে বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ, হয়েছে। পুলিশ এখনই এসে পড়বে।” ফেলুদা
বিছানার পাশের টেবলে রাখা একটা ওষুধের শিশি দেখতে পেয়ে সুরঞ্জনকে জিজ্ঞেস করল,
“আপনার বাবা কি ঘুমের ওষুধ খেতেন?” সুরঞ্জন
মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।
বাইরের
কম্পাউন্ডের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ফটক ঠেলে মনোময়বাবু ঢুকছেন। এত তাড়াতাড়ি উনি কী করে খবর পেয়ে গেলেন বুঝতে পারলাম না। উনি সামনের জমিটা পেরিয়ে সোজা বাড়িতে
ঢুকে এলেন। ফেলুদা আমাকে চাপা স্বরে বলল, “একটু নজর রাখিস তো লোকটার উপর।” আমি
মাথা নেড়ে সায় দিতে দিতেই দেখতে পেলাম চড়াই রাস্তাটা ধরে পুলিশের জিপটাও ক্রমশ উঠে
আসছে। মনোময়বাবু আমাদের দিকে তাকিয়ে, “কী কাণ্ড দেখেছেন, আপনারা তো আবার ছুটি ভোগ করতে এসেছিলেন! তাই না?” বলতে বলতে
জয়ন্তবাবুর ঘরে ঢুকে গেলেন। ফেলুদা এদিকে পুলিশের জিপটার দিকে এগিয়ে গেল।
বীরেনবাবু
জিপ থেকে নেমে এসে ফেলুদাকে কী যেন
বললেন। তারপর দু’জনে মিলে হঠাৎ কম্পাউন্ডের সেই আউটহাউসটার
পিছনে চলে গেলেন। আমি কী করব ভাবছি, এমন সময় উপর থেকে
শুনতে পেলাম লালমোহনবাবু হাঁক দিচ্ছেন, “ও তপেশভাই, শিগগির করে একবার এসো তো। আমার
ফোনটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে! কিছুতেই আর অন হচ্ছে না!” কোনোমতে দৌড়ে গিয়ে ফোনটাকে চালু করছি, দেখলাম চার্জ একেবারে তলানিতে – জানলা
দিয়ে তক্ষুনি নজরে পড়ল মনোময়বাবু হন হন করে
উতরাই রাস্তাটা দিয়ে নেমে যাচ্ছেন। “ফোনটাকে চার্জে দিন, চার্জ শেষ হয়ে গেছে বলে
মনে হচ্ছে,” বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে এক দৌড়ে নেমে এসে “ফেলুদা!” বলে হাঁক দিতে যাব -
বড়ো রাস্তা থেকে একটা জিপ স্টার্ট
দেবার শব্দ হল। আমি বুঝলাম মনোময়বাবু পালালেন। ফেলুদাও তখন এক লাফে আউটহাউস থেকে বেরিয়ে এসেছে। বীরেনবাবুও সেই সময় ওর
ঠিক পিছনেই ছিলেন; আর ঠিক তখনই এও দেখলাম যে চল্লিশ পেরিয়েও ফেলুদার ফিটনেসে
এতটুকুও মরচে পড়েনি। “ক্যুইক! বীরেনবাবু জিপ স্টার্ট করুন!” ফেলুদা এটা বলতে বলতেই
দেখলাম, ওর সঙ্গে সঙ্গে আমরা দু’জনও যেন
কীভাবে তারই মধ্যে এক দৌড়ে গিয়ে পুলিশের জিপে উঠে পড়েছি। লালমোহনবাবুও কি ভাগ্যিস ফোনটাকে চার্জে
বসিয়ে একটা কিছু আঁচ করে আমার ঠিক পিছন পিছনই দেরি না করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে
এসেছিলেন। পাহাড়ি রাস্তায় আমাদের জিপের দৌড় শুরু হল। সঙ্গে বীরেনবাবু এবং আরও দু’জন পুলিশের কনস্টেবল।
পাহাড়ি
রাস্তায় জোরে জিপ চালিয়ে কাউকে ধাওয়া করার অনুভূতিটা যে বাস্তবে ঠিক কীরকম, সেটা যে সেই রাস্তায় কোনোদিনও
গাড়ি চালায়নি তাকে কেবল শব্দ আর অক্ষরের মাধ্যমে পুরোপুরি বোঝানোটা একেবারেই
অসম্ভব। পাকদণ্ডি বেয়ে শোঁ শোঁ করে গাড়িটা নামছে।
কার্শিয়াংয়ের দিকে কিছুটা এগোতেই নিচে একটা
বাঁকের মুখে মনোময়বাবুর গাড়িটাকে চোখে পড়ল। হুডখোলা একটা নিসান জিপ। গাড়িতে
ভদ্রলোক একাই রয়েছেন দেখলাম। উনিই চালাচ্ছেন। বীরেনবাবু এ্যাক্সিলারেটরে চাপ বাড়িয়ে দিলেন। গোঁ গোঁ করে আমাদের জিপ ছুটে চলল। মনোময়বাবুও টের
পেয়েছেন যে ওনাকে ধাওয়া করা হয়েছে। উনিও গতিবেগ বাড়ালেন। বীরেনবাবু দাঁতে দাঁত
চেপে বললেন, “আশা করি ব্যাটার পাহাড়ি রাস্তায় ড্রাইভিংয়ের অভিজ্ঞতা আছে। নয়তো
যেভাবে চালাচ্ছে, যে কোনো সময়ে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাবে।” বীরেনবাবুর এই কথাটা শেষ হতে না হতেই আমরা উপর থেকে
দেখলাম আরেকটা বাঁকের মুখে মনোময়বাবুর জিপ হাই স্পিডে ঘুরতে গিয়ে একটা বিশাল মালবাহী ট্রাকের একেবারে সামনেটায় পড়ে গেল।
সেটাকে কোনোমতে বাঁচাতে গিয়ে মনোময়বাবু সটান
ওই গতিতেও গাড়িটাকে জোর করে ঘোরাতে গেলেন। বোল্ডার ভেঙে ছিটকে জিপটা সোজা একেবারে
পাশের খাদে গিয়ে পড়ল, আর পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাতে আগুন ধরে গেল। বীরেনবাবু
স্টিয়ারিংয়ের উপরে হতাশ হয়ে একটা জোরালো চাপড় মারলেন, “উফফ! ঠিক সেই ফাঁকি দিয়েই
পালাল!”
ফেলুদার
মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার মুখেও স্পষ্ট হতাশার ছাপ। সে মাথা নেড়ে একবার কেবল
বলল, “সাবাস!”
লালমোহনবাবুর
দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি হাতের লাঠিটাকে মুঠোর মধ্যে জোরসে আঁকড়ে ধরে বসে আছেন,
চোখ বন্ধ। বীরেনবাবু গাড়িটাকে আস্তে আস্তে অকুস্থলের কাছে নিয়ে গিয়ে সাবধানে সাইড
করে দাঁড় করালেন।
৭
মেঘবিতানের
সকাল। মনোময়বাবুকে বাঁচানো যায়নি। হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতেই উনি মারা গিয়েছিলেন।
মেঘবিতানের বৈঠকখানা ঘরে আমি, ফেলুদা, লালমোহনবাবু আর বীরেনবাবু হাজির। সুরঞ্জনও
একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জয়ন্তবাবুর দেহ কার্শিয়াংয়ের মর্গে নিয়ে যাওয়া
হয়েছে। হাতঘড়িটা একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে, ফেলুদাই প্রথম কথা বলতে শুরু করল। ঘরে তখন
পিন পড়লেও বুঝি বা তার শব্দ শোনা যাবে।
“আজ আমরা
এখানে এসেছি কেবল একটা নয়,
তিন-তিনটে খুনের রহস্য ভেদ করতে। তিনটে খুন যে অবশ্যই
পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, সেটা
নিশ্চয়ই এখন আর আলাদা করে এই ক্ষেত্রে বলে দিতে হবে না। কিন্তু এদের
ভিতরকার যোগসূত্রটা যে ঠিক কোথায়,
সেই বিষয়ে নিশ্চিত করেই একটু আলোকপাত
করা প্রয়োজন। প্রথম এবং শেষ যে দু’জন খুন হলেন, অর্থাৎ কিনা দীননাথ
লাহিড়ী এবং জয়ন্ত সেনাপতি – এঁরা দু’জনেই ইতিপূর্বে মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা ছিলেন
এবং একই সঙ্গে দু’জনেই এই উত্তরবঙ্গে এসে নতুন করে সেটল করেছিলেন। কিন্তু তার
চেয়েও যেটা গুরুত্বপূর্ণ, দু’জনেই কিন্তু সেই মহারাষ্ট্রে থাকার সময় থেকেই
পরস্পরের পরিচিত ছিলেন। সেটা আমি পরে জানতে পেরেছি। এখানেই প্রশ্ন আসে যে, সেই
পরিচিতিটা কি নেহাতই কাকতালীয় – নাকি তার পিছনে অন্য কোনো কারণ ছিল?” ফেলুদা একটু
থামে, “সুরঞ্জনবাবু, আপনি এই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করতে পারেন?”
“কই, না তো! হ্যাঁ,
দীননাথবাবু মহারাষ্ট্রেও আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। ওইটুকুই। এর বেশি তো আমি কিছু
বলতে পারব না,” সুরঞ্জন ভাবলেশহীন মুখে জবাব দেয়।
“বেশ,” ফেলুদা আবার বলতে শুরু
করে, “তাহলে আমরা নরবুর খুনের বিষয়ে চলে আসি। নরবুর দেহটা যখন উপুড় হয়ে পড়েছিল, ওর
ডান হাতের উপরে একটা ছোট্ট উল্কি করা ছিল। আমি সেটাকে নজর করেছিলাম। সাধারণ একটা
উল্কি। কিন্তু, সেখান থেকেই আমার সন্দেহটা আরও গভীর হয় কারণ, লেখাটা কিন্তু বাংলা
বা নেপালি ছিল না। বরং ভাষাটা ছিল মারাঠি। সুতরাং যে তিনজন এক্ষেত্রে খুন
হলেন, তিনজনের সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে মহারাষ্ট্রের সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে। হ্যাঁ,
জয়ন্তবাবুর উপরে তখনও কোনোরকম হামলা না হলেও, দীননাথবাবু এবং নরবু, দু’জনেরই এই
মহারাষ্ট্র কানেকশন আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। সেই সময় আমাদের সঙ্গে আলাপ হয় মনোময়
চৌধুরীর। হোয়াটস্যাপে মনোময়বাবুর নম্বর সেভ করতে গিয়ে লক্ষ করি যে, তিনি তাঁর
প্রোফাইল নেমের জায়গাতে লিখে রেখেছেন মনোময় সঞ্জয় চৌধুরী। এভাবে হঠাৎ করে নামের মাঝখানে
সঞ্জয় চলে আসার কারণ কী? স্বীকার করছি, আমি নিজেও সেটাকে প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে
খেয়াল হল, মহারাষ্ট্রের প্রবাসী বাঙালীরা যদি দীর্ঘদিন বংশপরম্পরায় সে রাজ্যে
কাটান – তাহলে, অনেকেই স্থানীয় রীতিনীতি বা অভ্যাস অনুসারে নিজেদের নামের সঙ্গে
নিজেদের বাবার নামকেও এইভাবে জুড়ে দিতে পছন্দ করেন। অথচ মনোময়বাবুর প্রাথমিক বয়ান
অনুসারে তিনি আজীবন কলকাতার বাসিন্দা। এই সমস্ত বিষয়কে প্রাথমিক ভাবে লক্ষ
করেছিলাম বলেই আমি বীরেনবাবুকে অনুরোধ করি, দীননাথ লাহিড়ী, নরবু এবং মনোময় চৌধুরীর
ছবি এবং অন্যান্য ডিটেলস - ইত্যাদি মহারাষ্ট্র পুলিশের সঙ্গে শেয়ার করতে। হ্যাঁ,
লালমোহনবাবু,” ফেলুদা জটায়ুর দিকে তাকিয়েও মৃদু হেসে বলে, “আজীবন কলকাতায় কাটিয়ে, নিজের
বয়ান অনুযায়ী গোয়েন্দা উপন্যাসের চরম ভক্ত হয়েও, জটায়ু অথবা রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজের
নাম না শোনাটাও আমার কাছে অদ্ভুত বলে মনে হয়েছিল।” লালমোহনবাবু একগাল হেসে সকলের
দিকে তাকান।
“এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে,”
ফেলুদা কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সেখান থেকে একটা ছোট্ট কাচের শিশি বের করে আনল,
“প্রথম দিন এখানে আসার পর বিকেলে চা খেতে খেতে যখন বাগানে বসেছিলাম, এই জিনিসটা
আমার পায়ের তলায় পড়ে যায়। প্রথমে অতটা আমল না দিলেও জিনিসটাকে কুড়িয়ে রেখে
দিয়েছিলাম। এটা একটা ওষুধের ভায়াল। হঠাৎ এ জিনিস মেঘবিতানের বাগানে কেন? আপনি কি
কিছু বলতে পারেন এই বিষয়ে?” ফেলুদা আবার সুরঞ্জনের দিকে তাকায়।
“আমি এই বিষয়ে কিছুই বলতে
পারব না। হয়তো বাবার কোনো ওষুধের দরকার হয়েছিল, মনের ভুলে সেটা বাগানে কোনোভাবে
পড়ে গেছে...”
“মিথ্যে বলছেন আপনি,” ফেলুদা
সুরঞ্জনকে তার বক্তব্য শেষ করতে দেয় না, “তাহলে, বাগানের আউটহাউসে চা প্যাকিংয়ের
বাক্সতে ওই পরিমাণ কাগজের কুচি ঠাসা থাকে কেন? চা তো আর আপেল বা আনারস নয় যে
কাগজের কুচি ভরা প্যাকিং বাক্সতে করে পাঠাতে হবে।” সুরঞ্জন নিরুত্তর।
“বেশ তাহলে আমিই বলছি,”
ফেলুদা আরও বলে চলে, “আজ ভোরে আপনাদের বাগানের প্যাকিং ইউনিটে হানা দিয়ে পুলিশ অন্তত
তিন কার্টুন জাল ওষুধ আর ইঞ্জেকশন উদ্ধার করেছে। চায়ের ব্যাবসার আড়ালে এই জাল
ওষুধেরই কারবার চালাচ্ছিলেন আপনার বাবা এবং আপনি, যেমনটা আপনারা মহারাষ্ট্রেও
চালাতেন! আর সেই বিষ ইঞ্জেকশনেরই বলি হয়েছিলেন আপনার মা স্বয়ং।” একটু থেমে ফেলুদা
তারপরেই বলে ওঠে, “যে কারণে আপনি আপনার বাবাকে খুন করতে চেয়েছিলেন।”
ঘরে তখন যেন বাজ পড়েছে।
সুরঞ্জন কিছু বলার চেষ্টা করলেও ফেলুদা তাকে থামিয়ে দেয়, “আপনি বলবেন তাহলে এখানে
মনোময়বাবুই বা কোথা থেকে এলেন। সেই প্রশ্নেরও উত্তর আমিই দিচ্ছি। মহারাষ্ট্র পুলিশ
মনোময় চৌধুরীর ছবি দেখে প্রথমে চিনতে পারেনি। কিন্তু পরে তারা মনোময় চৌধুরীকে
আইডেন্টিফাই করতে পারে। ২০১৮ সালে মহারাষ্ট্রের ঘাটকোপারের কাছে হাইওয়ের উপরে একটা
গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। সেই গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টের কারণে মনোময় চৌধুরী
গুরুতরভাবে জখম হয়। প্লাস্টিক সার্জারির ফলে তার মুখের আদলও অনেকটাই বদলে যায়। যে
কারণে জয়ন্ত সেনাপতিও দূর থেকে দেখে তাকে চিনতে পারেননি। অথচ আপনি তাকে ঠিকই
চিনেছিলেন। মহারাষ্ট্রে আপনাদের জাল ওষুধের কারবারের বিপক্ষ দল হিসেবে যারা কাজ
করত, তাদেরই অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ছিল এই মনোময়। আমার অনুমান এখানে আসারও অনেক আগে
থাকতেই, আপনি তলে তলে মনোময়ের দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। বাবার অবর্তমানে আপনি
চেয়েছিলেন আপনার কারবারকে ওদের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে। এতে আপনার বাবা কোনোদিনই রাজি
ছিলেন না। অথচ আপনার বাবা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি যে, নিজের ছেলেই তলে তলে
বিপক্ষ দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের ঘটনা ঘটে যায় ২০১৪ সালের ১০ই
ডিসেম্বর। ইঞ্জেকশন বদলাবদলি হয়ে যাওয়াতে দীননাথ লাহিড়ী, হ্যাঁ তিনি এবং নরবুও
আপনাদের ব্যাবসার অন্যতম সহযোগী ছিলেন; সেই দীননাথ লাহিড়ী ভুল করে আপনার বাবার
জন্য রাখা ঘুমের ওষুধের বিষ ইঞ্জেকশনকে নিজের হাতে আপনার মায়ের শরীরে পুশ করেন।
স্ত্রীর মৃত্যুর জন্যও জয়ন্তবাবু বিপক্ষ দলের কার্যকলাপকেই প্রাথমিকভাবে সন্দেহ
করেন এবং দীননাথের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যাবসাকে বাংলায় গুটিয়ে আনার বিষয়ে
সিদ্ধান্ত নেন। ঘুণাক্ষরেও তিনি - একবারের জন্যও, আপনাকে বা দীননাথবাবুকে সন্দেহ
করেননি। সেই দিন থেকেই দীননাথ লাহিড়ী এবং জয়ন্ত সেনাপতি চিরকালের মতো আপনার খতম লিস্টে
উঠে যান।” ফেলুদা একটু বিরতি নেয়। সুরঞ্জন মাথা নিচু করে তখনও একভাবে বসে আছে।
“এখানে এসে অনেকদিন ধরেই আপনি
কাজটা সেরে ফেলার মতলব করছিলেন, কিন্তু কিছুতেই সে কাজ হয়ে উঠছিল না দেখে মনোময়
চৌধুরীও এখানে এসে হাজির হয়। দীননাথবাবুর খুনটা আমার ধারণা মনোময়বাবুই করেছিলেন।
কোনোভাবে নরবু সেটাকে আঁচ করেছিল বলেই পরশু রাত্তিরে সে জয়ন্তবাবুকে এসে সে কথা
জানায়। আউটহাউসের আড়াল থেকে আপনি নরবুর কথা শুনেছিলেন। এদিকে জয়ন্তবাবুকে খুনের
জন্যও অস্ত্র কেনা হয়ে গিয়েছিল। সেই অস্ত্র দিয়েই আপনি সেদিন রাত্তিরে নরবুকে খুন
করেন। পরের দিন কার্শিয়াং থেকে দ্বিতীয় কুকরিটা কেনা হয়। জয়ন্তবাবুর মৃত্যু
নিশ্চিত করার জন্য গতকাল রাত্তিরে আপনি মনোময়বাবুর সঙ্গে ষড় করে বাবার ঘুমের
ওষুধের জায়গায় বিষ বড়ি রেখে দেন। আমার ধারণা পোষ্টমর্টেম হলেই বেরুবে যে
জয়ন্তবাবুর মৃত্যু হয়েছে বিষে, কুকরির আঘাতে নয়। কুকরির আঘাত কেবল আপনার
প্রতিশোধস্পৃহারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কিন্তু এখানেই চালে সামান্য ভুল করে ফেলে
মনোময়। আমার ধারণা অসাবধানে সে বিষ বড়ির শিশিটাকে একবার হাত দিয়ে ধরে ফেলেছিল কোনোসময়।
সে কারণেই আজ সকালে তড়িঘড়ি এসে শিশিটাকে সে সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিল। নয়তো আজ দুপুরেই
জলপাইগুড়ি থেকে তার বাস ধরার কথা ছিল। এখানে আসার কোনো পরিকল্পনাই ছিল না তার।
সুরঞ্জনবাবু? ঠিক বলছি তো আমি?” ফেলুদা থেমে সুরঞ্জনের দিকে তাকায়। কোনো সাড়া পায়
না।
“সুরঞ্জনবাবু!”
চেয়ার থেকে সুরঞ্জনের দেহটা
গড়িয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে।
“সায়ানাইড ক্যাপসুল! ওহ – আমি
কী নির্বোধ!” ফেলুদা প্রচন্ড জোরে হাতের তালুতে একটা ঘুসি মারল। লালমোহনবাবু আমার
পাশে বসে আবার কাঠ হয়ে গেছেন। ফেলুদা দু’হাতে নিজের মুখ ঢাকল। বীরেনবাবু উঠে
দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি থানা থেকে তাহলে মর্গের গাড়িটা আবারও পাঠিয়ে দিচ্ছি।”...
...সেদিন মেঘবিতানের হত্যাকাণ্ডের
ইতিহাস এভাবেই শেষ হয়েছিল। কিন্তু আমাদের গল্পের আরও খানিকটা এখনও বাকি থেকে গেছে।
পরিশিষ্ট
বাগডোগরা এয়ারপোর্টে আমরা
বসেছিলাম। লালমোহনবাবু নতুন কেনা নেপালি কুকরিটাকে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন।
“ওটাকে লাগেজে চালান করে দিন লালমোহনবাবু,” ফেলুদা বলল, “ওই কুকরি নিয়ে তো আর
আপনাকে প্লেনে উঠতে দেবে না।”
“কুছ পরোয়া নেই, এখনও সময়
হয়নি। সময় হলে ঠিক পাঠিয়ে দেব লাগেজে,” জটায়ু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেন,
“জানেন কি মশাই, সেদিনই খবর নিলাম - আমাদের পুলক ছোকরার সঙ্গেও এই জয়ন্ত সেনাপতি
ভদ্রলোকের নাকি মুম্বাইতেই প্রথম আলাপ। শহরটার চরিত্র আর বদলাল না,” লালমোহনবাবু
হতাশ সুরে বলেন।
“সে আর বলতে, আপনিই তো
বলেছিলেন – মান হল গিয়ে বেঙ্গলে, আর মুম্বাইতে হল গিয়ে মানি,” ফেলুদা জবাব দেয়,
“মানি যেখানে, সেখানে কি আর মান বা প্রাণের কথা নিয়ে ভাবতে আছে?”
“তা হয়তো নেই, কিন্তু আরও
একটা বড়ো কাঁচা কাজ করে ফেলেছিল এই মনোময় আর সুরঞ্জন। কী বলুন তো দেখি মশাই?” জটায়ু
জিজ্ঞেস করেন।
ফেলুদা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়,
“কী বলুন তো?”
“আপনার মতো একজন গোয়েন্দা
আসছেন জেনেও ঠিক এই সময়েই এদেরকে খুনগুলোকে করতে হল? শেষ পর্যন্ত তো সেই কারণে
নিজেদের প্রাণগুলোকেও খোয়াতে হল একে একে এই চক্করে। কোনো মানে হয় এটার?”
লালমোহনবাবু বলেন।
ফেলুদা স্মিত হেসে বলে, “হয়
এরা কাজ সেরে পালাত, নয়তো এদেরকে মরতেই হত। আমার হাতে ধরা দেবার কোনো ইচ্ছে অন্তত
এদের ছিল না।”
“সে কী মশাই, এদেরকে কি আপনার
কাছে ‘ফিঁদায়ে হামলা’-র মতো করে পাঠানো হয়েছিল নাকি? আত্মঘাতী হানাদারদের মতো?”
জটায়ুর মুখে হাসি, কপালে ভাঁজ।
“অনেকটা তাই। একমাত্র জয়ন্ত
সেনাপতিকেই খুনের ছক ছিল সুরঞ্জনের। পরে দীননাথের নাম ওর সঙ্গে যোগ হয়। নরবুর
খুনটা নেহাতই ঘটনাচক্রে। কিন্তু আমি আসব এটা খবর পাওয়ার পরই যে এই খুনগুলোকে সেরে
ফেলবার ব্যাপারে উপরতলা থেকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত এখন,”
ফেলুদা উজ্জ্বল চোখে আমাদের দিকে তাকায়, “আজ সকালে বীরেনবাবুও আমার অনুমানকে
কনফার্ম করেছেন।”
“সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছিল?
কোথা থেকে দেওয়া হয়েছিল?” আমি প্রশ্ন করি এবার।
ছোট্ট করে উত্তর আসে,
“মহারাষ্ট্র, ঘাটকোপার।”
“কে দিয়েছিল সেই সংকেত মশাই?”
লালমোহনবাবু আর সাসপেন্স ধরে রাখতে পারছেন না। ফেলুদা তাই আরও খানিকটা সময় নেয়,
“কে আর দেবে মশাই? এই মনোময়ের যে বস, সেই দিয়েছিল।”
“আমার মাথা কাজ করছে না
ফেলুদা, নামটা প্লিজ বলবে কি?” আমি প্রায় চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলাম।
ফেলুদা চেয়ারটা থেকে উঠে
দাঁড়িয়ে ট্রাভেল ব্যাগটা কাঁধে নিতে নিতে বলল, “বড়ো পুরোনো বন্ধু আমাদের। তোরাও চিনিস
ভালো করেই। ওঁর নাম মগনলাল। মগনলাল মেঘরাজ। বয়স হলেও এখনও দিব্যি জাল ওষুধের
কারবারে রাজপাট খুলে বসেছে। সামনের মাসে একবার মুম্বাইতেও যেতে হতে পারে বোধহয়।
দেখাই যাক!”
লালমোহনবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠতে
গিয়েও ধপ করে বসে পড়লেন। আমি আবার আমার কানে সেই তিব্বতি বাঁশির
সুর শুনতে পাচ্ছিলাম।
----------
ছবি – সুমিত রায়
No comments:
Post a Comment