জাদু
জল
চুমকি
চট্টোপাধ্যায়
অভ্রদের পাড়ার একমাত্র মিষ্টির দোকান ‘শিবদুর্গা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। বহু
পুরোনো দোকান। নামের সাইনবোর্ডে লেখা আছে, প্রতিষ্ঠাতা: গদাইচন্দ্র নস্কর। সন: ১৯৪৮।
এরপর দু’প্রজন্ম এসে
গেছে এই ব্যাবসায়। কিন্তু গোল বেঁধেছে চতুর্থ প্রজন্মের ছেলে সার্থককে নিয়ে। সে
কিছুতেই মিষ্টির দোকানে বসবে না। তার স্বপ্ন আকাশছোঁয়া। বারো ক্লাসে পড়ে। সার্থকের
ইচ্ছে ডব্লু বি সি এস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরি করার।
তাহলে এই দোকানের কী হবে? এখন সার্থকের বাবা নিমাইবাবু বসেন দোকানে। কিন্তু তাঁরও
বয়েস হচ্ছে। শরীরও জুতের থাকে না সবসময়। সার্থকের দিদি আছে। তার বিয়ের কথাবার্তা চলছে।
নিমাইবাবুর মোটে ইচ্ছে নয় যে, তার মেয়ে সম্পূর্ণা দোকানে বসুক।
পাড়াতেও এই খবরটা চাউর হয়ে গেল। এক মুখ থেকে অন্য মুখে যেতেই কথা পালটে যায়।
এক্ষেত্রেও সেটাই হল। পাড়ার লোক শুনল, শিবদুর্গা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার বন্ধ হয়ে যাবে। চোখে অন্ধকার
দেখল অনেকেই। যাদের রোজ সকালের জলখাবার ছিল এই দোকানের কচুরি আর জিলিপি,
তারা মুষড়ে পড়ল। পাড়ার লোকজন নানারকম
পরামর্শ দিতে থাকল নিমাইবাবুকে।
একদিন দুপুরে দোকান বন্ধ রেখে বাড়িতে খেতে গেছেন নিমাই নস্কর। এমন সময় দরজায়
কড়া নাড়ার শব্দ। নিমাইবাবুর মেয়ে দরজা খুলে দেখে, একজন বয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে বোঁচকা-বুঁচকি নিয়ে।
সম্পূর্ণা চেনে না সেই বয়স্ক মানুষটাকে। ভেতর থেকে নিমাইবাবু জিজ্ঞেস করলেন,
“কে এসেছে সম্পু?”
“আজ্ঞে, আমি
ঘনশ্যাম গো। বারিপদা থেকে আসছি।”
“ভেতরে নিয়ে আয়।”
নিমাইবাবুর বাবা কানাইচন্দ্র নস্করের আমলে এই বাড়িতে থাকত ঘনশ্যাম দাস।
সংসারের খুঁটিনাটি থেকে বাজার করা, রেশন ধরা, বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়া সবই করত এই ঘনশ্যাম।
দেশ থেকে হঠাৎ চিঠি এল, ঘনশ্যামের
স্ত্রী খুব অসুস্থ। ও না গেলে হয়তো বাঁচবে না। বাড়ির লোকজনের যত অসুবিধেই হোক না
কেন, এইরকম
পরিস্থিতিতে তো আর না ছেড়ে উপায় থাকে না! পরের দিন উড়িষ্যার বারিপদায় চলে গেল
ঘনশ্যাম।
তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। ঘনশ্যামের স্ত্রী বেশ কিছুদিন হাসপাতালে কাটিয়ে
বাড়ি ফিরলেও ঘনশ্যাম আর ফিরল না এই বাড়িতে। ওর ছেলেরা ওকে আসতে দিল না। জমি ছিল
কিছু। সেই জমিতে চাষের কাজ করতে দেশেই থেকে গেল সে।
“দেশে গিয়ে তো আর ফিরলে না ঘনাদা। কত অসুবিধে হয়েছিল এখানে তুমি জানো?” বিটনুন আর লেবুর রসে জারানো জোয়ান মুখে ফেলে বলল নিমাই
নস্কর।
“সে কী আর আমি বুঝিনি ছোটোকত্তা! ছেলেগুলান আটকে দিল, আসতে দিল না গো। অনেক
করে বলেছিলাম ওদের। তা বলে, অন্যের
কাজ তো করলে এত বচ্ছর, এবার
একটু নিজের জমি-বাড়ির দিকে নজর দাও। কী বলব বলেন কত্তা।”
“তা এত বছর পরে আবার ফিরলে যে? এখন ছেলেরা আসতে দিল?”
“ছেলেদের বিয়ে হয়ে নাতিপুতি হয়ে গেছে। আমাকে বলেছিল এই বয়েসে গিয়ে আর কী
উপকারে লাগবে ওদের, যেও না। কিন্তু আমার মনটা ভীষণ টানল ছোটোকত্তা! কেন জানি না,
মনে হল তোমাদের লোকের খুব দরকার। তাই চলেই এলাম। যদি বলো তো ফিরে যাব ’খন।”
লোকের দরকার কথাটা শুনেই নিমাইবাবুর দোকানের ভবিষ্যতের কথা মাথায় এল। তাই তো! ঘনাদাকে তো দোকানে বসানো যায়। যদিও যথেষ্ট বয়েস
হয়েছে। তাও ঘনাদা থাকলে ওঁর নিজের একটু জিরেন হবে মাঝে মধ্যে। সব দিক ভেবে বললেন, “কষ্ট করে এসেছ যখন তখন আবার ফেরত যাবে কেন। আমাদের
দোকানটার দেখাশোনা করো বরং।”
“তোমার বউ কেমন আছে সেটাই তো জানা হল না,” নিমাই-গিন্নি গিজ্ঞেস করলেন।
“আপনাদের আশীর্বাদে সে ভালো আছে গো মা। নাতিপুতি নিয়ে সংসারে মজে আছে। খুব বড়ো
অসুখ হয়েছিল গো। ডাক্তার আশা দিতে পারেনি প্রথমে। যা হোক,
ধীরে ধীরে সেরে উঠেছে। সে অনেক ব্যাপার। পরে
একদিন বলব ’খন।”
শিবদুর্গা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দায়িত্ব ঘনশ্যামের কাঁধে চাপিয়ে ক’দিনের জন্য
তীর্থে গেলেন নিমাইবাবু। বহু বছর বেড়াতে যাওয়া হয় না তাদের। ঘনশ্যামের আশ্বাসে
নিশ্চিন্ত হয়ে বেনারস রওনা হলেন নিমাইবাবু এবং তার গিন্নি।
পরদিন ভোরবেলা দোকানে চলে গেল ঘনশ্যাম। দোকান ধোয়ামোছা করে পরিষ্কার করল।
জালার জল ফেলে দিয়ে টাটকা জল ধরল রাস্তার টিউবওয়েল থেকে। জালা
বিড়ের ওপর বসিয়ে তার গায়ে সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক চিহ্ন আঁকল যত্ন করে। জালার ওপরে
সরা চাপা দিয়ে তার ওপর রাখল মা কালীর পায়ে ছোঁয়ানো একটা ফুল।
সময়মতো হালুইকরেরা মিষ্টি দিয়ে গেল। পরিচ্ছন্নভাবে সে সব সাজিয়ে,
নিজে চা-পাউরুটি খেয়ে খদ্দেরদের জন্য
দোকানের শাটার তুলে দিল ঘনশ্যাম।
পাড়ার একমাত্র মিষ্টির দোকান হওয়াতে বিক্রিবাটা ভালোই হত বরাবর। মিষ্টির
কোয়ালিটিও ঠিকঠাক। মিষ্টির ব্যাপারে ঘনশ্যাম হালুইকরদের আরও কিছু নির্দেশ দিল।
খদ্দের আসতে শুরু করল।
অনেকেই দোকানের বেঞ্চিতে বসে কচুরি-জিলিপিসহ আরও দু-একটা মিষ্টি খেয়ে যায় সকাল
সকাল। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। খেয়েদেয়ে মাটির গ্লাসে জল খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে
বাড়ি ফিরে গেল তারা। বাড়ির জন্য খাবার নিতে ভুলল না।
পাড়ার অনেক বয়স্ক বাসিন্দা চিনতে পারল ঘনশ্যামকে। যারা চিনল না,
ঘনশ্যাম নিজেই তাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করে
নিল। কয়েক দিনেই পাড়ার মানুষের প্রিয় হয়ে উঠল ঘনাদা।
সেদিন শুক্রবার। অনেকেই সন্তোষী মাতার পুজো করে। পল্টু এসেছে তার বৌদির জন্য
লাড্ডু আর বোঁদে নিতে। ঘনাদার সঙ্গে দিব্যি ভাব হয়ে গেছে ওর।
“ঘনাদা, দশটা
লাড্ডু আর আড়াইশো বোঁদে দাও।”
“বৌমা পুজো করবে তো? দাঁড়াও,
হাত ধুয়ে দিচ্ছি। মায়ের পুজোর প্রসাদ হবে
তো। তা পল্টুবাবু, তোমার
মুখখানা এমন শুকনো লাগছে কেন? রাতে ঘুমোওনি নাকি?”
“না গো ঘনাদা। বাবার শরীরটা ভালো নেই। কাল রাতে তাই ঘুম হয়নি।”
“কী হয়েছে বাবার?”
“পেটের সমস্যা গো। আমাশা, পেট কামড়ানো।”
“ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাওয়াও। সঙ্গে গরম রসগোল্লা। বাড়ি থেকে একখানা কাচের
গেলাস এনে দিয়ে যাও আমাকে। বিকেলে রসগোল্লা নিতে আসবে যখন,
তখন জলসমেত নিয়ে গিয়ে বাবাকে খাইয়ে দিও।
ঠিক হয়ে যাবে।”
বিকেল চারটের সময় এসে গরম রসগোল্লা আর কাচের গ্লাসে ঘনাদার দেওয়া জল নিয়ে গিয়ে
বাবাকে খাইয়ে দিল পল্টু। গেলাসে জলের ব্যাপারটায় প্রথমে একটু খটকা লেগেছিল ওর।
তারপর ভেবেছিল মাটির জালার জলে কোনো গুণাগুণ থাকতে পারে হয়তো যা পেটের সমস্যায় কাজ
করে।
পরের দিন পল্টু এসে ঘনশ্যামকে জানিয়ে গেছিল যে ওর বাবা ভালো আছে। ধন্যবাদ
দিয়েছিল ঘনাদাকে।
পল্টুর মুখে ঘনাদার টোটকার কথা শুনে মিনতি বর্মন এলেন শিবদুর্গা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে।
পাঁচটা কাজু বরফি কিনে ঘনশ্যামকে বললেন, “পল্টুর মুখে শুনলাম আপনার টোটকায় ওর বাবা সেরে উঠেছেন। আমার
হাঁটুতে বড্ড ব্যথা। অনেক ব্যথার ওষুধ খেয়ে, তেল মালিশ করেও কমছে না। কোনো টোটকা আছে কি এর?”
“টোটকা কিছু নেই মা। আপনার ব্যথা তো অনেক পুরোনো। তাই কমতে একটু সময় লাগবে।
তবু আমি বলে দিচ্ছি, দেখুন
করে, যদি কাজ হয়। ছোটো
এক টুকরো কাগজে আপনি লিখবেন, ‘আমার হাঁটুর ব্যথা কমে গেছে।’ কাচের গেলাসে এক গেলাস জল
নেবেন। সেই লেখা কাগজের টুকরোখানা গেলাসের গায়ে সাঁটিয়ে দেবেন। তিন ঘন্টা মতো রেখে
দিয়ে জলটা খেয়ে নেবেন। খাবার সময়তেও গেলাসখানা মুখের সামনে এনে এই কথাটাই বলবেন।
এভাবে সাত দিন করে দেখুন কিছু ফল পান কিনা।”
দিন দশেক পরে মিনতি বর্মন দোকানে এলেন। খুব খুশি। বললেন,
“ঘনশ্যামদা, আপনার কথামতো জল খেয়ে আমার হাঁটুর ব্যথা অনেকটা কমে
গেছে। জল দিয়ে যে ব্যথা কমানো যায় সে তো জানতামই না।”
“যাক মা জননী। আপনি ভালো আছেন এটাই বড়ো কথা। আপনি এই চিকিৎসা চালিয়ে যান।
দেখবেন, ভালো থাকবেন।”
একটা পাড়ার সব মানুষই তো আর ভালো হয় না। মেলানো-মেশানো মানুষ থাকে। কেউ ভালো,
কেউ মন্দ। এই পাড়ার শম্ভু সিংহ তেমনি একজন
মন্দ স্বভাবের মানুষ। কেবক লোকের খুঁত ধরে বেড়ায়।
সকালবেলা বেনুর চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে বলল, “পাড়ায় একজন তন্ত্র-মন্ত্র জানা লোক এসেছে। সে আবার
তুকতাক করতে শুরু করেছে। জানো?”
পশুপতিবাবু সবে টোস্ট বিস্কুটটা চায়ে ডুবিয়েছেন, শম্ভু সিংহর কথা শুনে থমকে গেলেন। টোস্টটা গলে পড়ল
চায়ের মধ্যে।
“পাড়ায় তান্ত্রিক? কই
দেখিনি তো? কে সে?”
“আরে মশাই তান্ত্রিক কিনা জানি না। তবে কী সব মন্ত্র পড়া জল খাওয়াচ্ছে লোকজনকে, আর তাতে নাকি রোগ সেরে যাচ্ছে। এসব বুজরুকি চলতে
দিলে তো মুশকিল।”
“তা সে ব্যক্তিটি কে?” নগেন
সামন্ত জিজ্ঞেস করল।
“ওই তো ঘনশ্যাম না কী নাম, শিবদুর্গায় বসছে এখন।”
“ঘনশ্যাম তো নিমাই নস্করের বাড়ির পুরোনো কাজের লোক। দেশে চলে গেছিল,
ফিরে এসেছে। সে তুকতাক করে?”
“তাই তো শুনলাম। পল্টু বলল, ঘনশ্যমের দেওয়া মন্ত্র পড়া জল খেয়ে ওর বাবা নাকি সেরে
উঠেছে। আরও কারা কারা সব খেয়েছে জল।”
“ও বাবা, এ তো
ডেঞ্জারাস! তবে তো ওই দোকানের মিষ্টি খাওয়া যাবে না আর! সেখানেও কী তুক করে রেখেছে
কে জানে,” পশুপতিবাবু ভয় পেয়ে বললেন।
“হ্যাঁ, দোকানে
গিয়ে বলতে হবে ওকে যে, এ
পাড়ায় এ সব চলবে না,” ডেঁটে বলে উঠল শম্ভু সিংহ।
সেদিন সন্ধের মুখে শম্ভু সিংহ চার-পাঁচজন সাকরেদ নিয়ে এসে হাজির হল শিবদুর্গা
মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। ঘনশ্যাম তখন ঠাকুরকে ধুপ দেখাচ্ছিল।
“বলুন দাদা, কী
দেব?”
“কিছু নিতে আসিনি, কথা
বলতে এসেছি।”
একটু ঘাবড়ে গিয়ে ঘনশ্যাম বলে, “আচ্ছা। তা বলুন কী বলবেন।”
“আপনি তুকতাক করেন শুনলাম।”
“তুকতাক করি মানে?”
“কী সব মন্ত্রপূত জল-টল দেন লোকজনকে খেতে। তাতে নাকি রোগ সেরে যায়। এটা তুকতাক
নয় তো কী?”
“আমাকে ক্ষমা করবেন দাদা। মন্ত্র কিছু জানি না। ঘটনাটা বলি তবে। বেশ কিছু বছর
আগে আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়েছিল। সে সময়ে আমি নিমাইবাবুদের বাড়িতে কাজ করতাম। বউয়ের
খবর পেয়ে দেশে ফিরছি। ট্রেনে এক ভদ্দরলোকের সঙ্গে আলাপ হল।
“কথায় কথায় আমার বউয়ের অসুখের খবর শুনে আমাকে বলল বাড়ি গিয়ে কাচের গেলাসে এক
গেলাস জল নিয়ে সেই জলের দিকে তাকিয়ে বউয়ের নাম নিয়ে বলবে,
অমুক সেরে গেছে,
ভালো আছে। আরও ভালো হয় যদি এক টুকরো কাগজে
এই কথাগুলো লিখে গেলাসের গায়ে চিপকে তিন-চার ঘন্টা রেখে দাও। তারপর সেই জল বউকে
খাইয়ে দিও। এভাবে টানা কিছুদিন চালাও।
“আমি বাড়ি ফিরে দেখি ছেলেরা বউকে হাসপাতালে ভরতি করে দিয়েছে। ভালো হয়ে বাড়ি
ফিরলেও উঠতে পারত না। আমি তখন সেই ভদ্দরলোকের কথামতো জল খাওয়াতে লাগলাম। বললে
বিশ্বাস যাবেন না দাদা, এক
সপ্তাহের ভেতর আমার বউ চাঙ্গা হয়ে গেল।
“আমি ভদ্দরলোককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, জলের এত ক্ষমতা আছে যে রোগ সারিয়ে দেবে?
তাহলে তো পৃথিবীর মানুষ রোগ-ব্যাধিতে মরত
না।
“উনি বললেন, জলের
মনে রাখার খেমতা খুব বেশি। তুমি জলকে ভালো কথা বলে খেলে সে তোমার ভালো করবে,
খারাপ কথা বলে খেলে সে ক্ষতি করবে। এ সব ক’জন
জানে যে কাজে লাগাবে। যা বলছি করে দেখো, ফল পাবে।
“আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ দাদা, অত বুঝিনি, তবে কাজ যে হয়, সেটা বুঝেছি। আমি যেটাতে উপকার পেয়েছি সেটা আর
পাঁচজনকে বলব না কেন বলুন। এ তো তুকতাক নয়।”
“এটা একটা কথা হল। জলকে বললে কাজ হয়ে যাবে!”
সবাই হো হো করে হেসে উঠল। শম্ভুর এক চেলা বলল, “তা আপনি মিষ্টিকেও এসব বলেন নাকি দাদু?”
“বললে কোনো ক্ষতি নেই ভাই। যদিও মিষ্টি আমি তৈরি করি না। আমি যা বললাম,
এ তো কোনো কঠিন কাজ নয়। তোমরা সকলেই
পরীক্ষা করে দেখতে পারো। শুধু যে রোগ সারে তা নয়, যা কিছু তোমার দরকার অথচ তুমি পাচ্ছ না,
তাই লিখে জলের গেলাসে চিপকে দিয়ে দেখতে
পারো। লাভ না হলেও ক্ষতি হবে না, এটুকু বলতে পারি।”
কেটে গেছে অনেক ক’টা দিন। নিমাই নস্কর আর তার স্ত্রী তীর্থ সেরে ফিরে এসেছেন।
শিবদুর্গা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের নাম এখন সারা তল্লাটের সবাই জানে। দূর দূর থেকে
মানুষ আসে এই দোকানের মিষ্টি কিনতে, ঘনশ্যামের সঙ্গে কথা বলে জলের জাদু ক্ষমতা জানতে। সবাই বলে,
এই দোকানের মিষ্টি খেলেও নাকি অসম্ভব
তৃপ্তি হয়।
আসলে মিষ্টি গোছাতে গোছাতে ঘনশ্যাম বলে, ‘সকলের ভালো হোক, সবাই সুস্থ থাকুক।’ কখনও বা ঈশ্বরের নাম করতে করতে মিষ্টি সাজায় তাকে।
দত্ত বাড়ির ছোটো ছেলে অর্ণব পড়া শেষ করে কানাডা থেকে ফিরেছে। এ কথা সে কথায়
ঘনশ্যামের জলের জাদুর কথা জানতে পারে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারতে মারতে ঘনশ্যামের
কথা ওঠে। সুজন বলে, “মানুষের
কনফিডেন্স লেভেলের কী অবস্থা ভাব, জল খেয়ে বলছে অসুখ সেরে গেছে। যদিও লোকটাকে বুজরুক বলা যায়
না, কারণ টাকাপয়সা তো কিছু নেয় না।”
মুচকি হেসে অর্ণব বলে, “ওয়াটার
হ্যাজ ট্রিমেন্ডাস মেমরি মাই ফ্রেন্ড। জল সত্যিই রহস্যে ভরা। ঠিকভাবে কাজে লাগালে
ইট ক্যান ডু মিরাকল। মিষ্টির দোকানের ভদ্রলোক সেটাই করছে। ইট ইস ভেরি সায়েন্টিফিক।
আর তাই ওনার সমালোচনা করা বন্ধ কর।”
পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। অনেক বদল এসেছে মিশন পাড়ায়। কত মানুষ চলে গেছে,
নতুন মানুষ এসেছে। রাস্তাঘাট বদলেছে,
দোকানপাট আধুনিক হয়েছে। শিবদুর্গা মিষ্টান্ন
ভাণ্ডার কিন্তু স্বমহিমায় আছে আজও। সার্থক শেষ অবধি মত বদলেছে। নতুন নতুন আইডিয়া
নিয়ে ব্যাবসায় এসেছে।
এখন শিবদুর্গার তিনটে ব্রাঞ্চ। আরও বাড়াবার ইচ্ছে আছে ওর। অতি বৃদ্ধ হয়ে
যাওয়ায় ঘনশ্যাম দেশে ফিরে গেছে। সার্থককে শিখিয়ে দিয়ে গেছে মানুষকে ভালো রাখার মন্ত্র।
সার্থক জানে, মানুষের
শরীরে সত্তর ভাগই জল। তাই সবার ভালো চাইলে নিজেও ভালো থাকা যায়।
----------
ছবি - নচিকেতা মাহাত
চুমকি-ম্যাডাম, আপনার "জাদু জল" পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি বললে কম বলা হবে,এমন আপাত সামান্য বিষয় নিয়ে এরকম অভিনব প্লট-তৈরি এবং সে-প্লটের ওপর যে মুনশিয়ানায় পরিবেশন করেছেন এই জাদু-গল্প, তা সত্যিই অতুলনীয়!পাঠককে টেনে ধরে রেখে দিয়েছেন এবং শেষ করেছেন যা বলে, ওর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারত না। মানুষের শরীরের শতকরা সত্তর ভাগই হল জল। অসাধারণ গল্প। আমি আপনার গল্পের জাদুতে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছি এখনও। ঘনশ্যামকে আমি দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে।
ReplyDeleteKhub sundor.. jol e jibon
ReplyDeleteবাহ্ খুব সুন্দর। সত্যিই খুব ইউনিক কনসেপ্ট।
ReplyDeleteমুগ্ধ হলাম গল্পটি পড়ে!
ReplyDelete