বিজ্ঞান:: নবপত্রিকাঃ দেবী দুর্গারূপে উদ্ভিদশক্তির আরাধনা - সৌম্যকান্তি জানা


নবপত্রিকাঃ দেবী দুর্গারূপে উদ্ভিদশক্তির আরাধনা

সৌম্যকান্তি জানা

মহালয়ার ঊষালগ্নে যখন বেতার-মূর্চ্ছনায় আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয় সুপ্রীতি ঘোষের গাওয়া ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ তখন থেকেই মনে হয় আগমণীর সুরে সারা ভুবন যেন মেতে উঠেছেবর্তমানের প্রযুক্তি-নির্ভর আধুনিক প্রজন্মই হোক কিংবা ভোরের আলো ফোটার আগে অন্ততঃ একদিনের জন্য ঘুম ভেঙে উঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-র অননুকরণীয় কন্ঠে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শোনা আমাদের প্রজন্মই হোক, মহালয়া থেকেই মেতে ওঠে পুজোর আনন্দেদ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের জলদগম্ভীর গলায় ‘জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী’ শুনতে শুনতে মনে হয় যেন সত্যিই জেগে উঠেছে মা দুর্গা। আর তার সাথে জেগে উঠেছে আমাদের সবার মনের বাগিচায় ঘুমিয়ে থাকা শিউলি ফুলের কুঁড়িগুলো, আর হৃদয়ে দোলা দিয়ে যাচ্ছে কাশফুলের দোলা।

তারপর ঠিক সাত দিনের অপেক্ষা। ঢাকে কাঠি পড়ে। মহাসপ্তমীর সকালে নবপত্রিকাকে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শুরু হয় দেবীর আনুষ্ঠানিক আবাহন। প্রথমে পুরোহিতমশাই নবপত্রিকাকে নিজে বয়ে নিয়ে যান কাছাকাছি কোনও নদী বা পুকুরে। ছোটো থেকে আমরা অবশ্য নবপত্রিকাকে কলাবউ হিসেবে বেশি করে চিনি। আসলে কলা গাছের সাথে মূল সহ আরও আটটি গাছের চারা সাদা অপরাজিতা লতা ও হলুদে সিক্ত সুতো দিয়ে বেঁধে তৈরি করা হয় নবপত্রিকা। এই আটটি গাছ হল কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মানকচু ও ধান। সংস্কৃত শ্লোকে এই নয়টি উদ্ভিদ এভাবে উল্লেখিত হয়েছে –“রম্ভা, কচ্বী, হরিদ্রা চ জয়ন্তী বিল্বদাড়িম্বৌঅশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা” পেছনে পেছনে ঢাকিরা ঢাক বাজাতে বাজাতে যায়। আর মহিলারা যায় উলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনি করতে করতে। নদী বা পুকুরে নবপত্রিকাকে স্নান করানোর পর নতুন লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরিয়ে নবপত্রিকাকে আনা হয় মন্ডপে। তারপর স্থাপন করা হয় দেবীর ডানদিকে একটি কাঠের সিংহাসনে। তারপর পুজোর ক’টা দিন দুর্গার সাথে সাথে কলাবউয়েরও পুজো করা হয় এবং একসাথেই বিসর্জন দেওয়া হয়। অনেকের ভুল ধারণা আছে যে কলাবউ বা নবপত্রিকা হল গণেশের বউ। কিন্তু গণেশের বউ হল রিদ্ধি ও সিদ্ধি। নবপত্রিকা হল গণেশের জননী।

আসলে কলাবউ বা নবপত্রিকা হল মা দুর্গার আর এক রূপ। সহজ কথায় বললে, মা দুর্গার এই রূপটি হল জীবনদায়ী উদ্ভিদরূপ। প্রাচীনকাল থেকে হিন্দু ধর্মে ভূমিকে মাতা হিসেবে গণ্য করা হয়ে এসেছে, আর সেই মাতার সন্তান হল ভূমিজাত উদ্ভিদকুল। খাদ্য হিসেবে শুধু নয় জীবনদায়ী ঔষধ হিসেবেও উদ্ভিদের গুরুত্ব প্রাচীন কাল থেকে ভারতীয় মুনি-ঋষিদের অবগত ছিল। আর তাই ন’টি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদশক্তির সাথে আধ্যাত্মিক চেতনাশক্তির মেলবন্ধন ঘটেছে এই নবপত্রিকার আরাধনার মধ্যে দিয়ে।

মজার ব্যাপার হল দেবী দুর্গার নয়টি রূপ নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়। আবার দেবী দুর্গার প্রত্যেকটি রূপ এক একটি শক্তির আধার হিসেবে আরাধ্য। যেমন কলা হল শক্তিদাত্রী ব্রহ্মাণী, কচু হল দীর্ঘায়ুদাত্রী কালিকা, হলুদ হল বিঘ্ননাশিনী উমা, জয়ন্তী হল কীর্তিস্থপয়িতা কার্তিকী, বেল হল লোকপ্রিয়া শিবানী, ডালিম হল শক্তিদাত্রী রক্তবীজনাশিনী, অশোক হল শোকরহিতা দুর্গা, মানকচু হল সম্পদদায়ী ইন্দ্রাণী এবং ধান্য হল প্রাণদায়িনী মহালক্ষ্মী। আধ্যাত্মিকতার পর্দা সরিয়ে আমরা বরং দেখে নেওয়ার চেষ্টা করি নবপত্রিকায় এই ন’টি উদ্ভিদ সংযোজনের সার্থকতা কতটুকু।


প্রথমে শক্তিদাত্রী কলা। পাকা কলায় সুক্রোজ বা চিনি থাকে শতকরা ২৫-২৮ ভাগ। ফলে দ্রুত শক্তি পেতে গেলে ফল হিসেবে কলার জুড়ি নেই। খেলোয়াড়েরা খেলার মাঝে তাই খাবার হিসেবে কলা পছন্দ করেন। শুধু কি সুক্রোজ? পাকা কলায় ভিটামিন এ, থিয়ামিন, রাইবোফ্ল্যাভিন ও ভিটামিন সি এবং খনিজ উপাদান হিসেবে ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, ফসফরাস ও আয়রন প্রচুর থাকে। সবজি হিসেবে কাঁচকলা, বিচি কলা, কলার মোচা ও থোড় অত্যন্ত উপাদেয় ও পুষ্টিকর খাদ্য। আর তাই কলাকে খুবই যুক্তিযুক্তভাবে শক্তিদাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কলার কান্ড, ফুল ও ফল সবই ভেষজগুণযুক্ত। কান্ড থেকে তৈরি টনিক স্কার্ভি, কলেরা ও গণোরিয়া রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। মোচার রস ঘিয়ের সাথে মিশিয়ে নিয়মিত সেবন করলে মধুমেহ রোগ (ডায়াবেটিস টাইপ ২) সারে।

এবার দীর্ঘায়ুদাত্রী কচু। প্রধানতঃ গ্রীষ্মমন্ডলীয় উদ্ভিদ কচু যে কোনও মাটিতে জন্মাবার ক্ষমতা ধরে। এমনকি জলমগ্ন মাটিতেও কচু ফলতে পারে। মাটির তলায় কচুর কন্দ থেকে গেলে পরের বছর সেখান থেকেই আবার গাছ বেরোয়। সুতরাং কচু তো দীর্ঘ আয়ুবিশিষ্ট উদ্ভিদ বটেই। কচু চাষে তেমন কোনও খরচ বা ঝামেলা নেই বললেই চলে। অথচ কচুর পুষ্টিগুণ অসাধারণ। আলুর প্রায় সমপরিমাণ শতকরা ২১ গ্রাম শর্করা থাকে কচুতে। ক্যালরি মূল্যও আলুর সমান, প্রতি ১০০ গ্রামে ৯৭ কিলোক্যালোরি। এছাড়া যথেষ্ট পরিমাণে ফসফরাস, ক্যালশিয়াম, লোহা, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ভিটামিন এ ইত্যাদি থাকে। গ্যাস্ট্রিক আলসারের রোগীদের পক্ষে কচু খুব ভালো খাবার কারণ এতে প্রায় ১৭-২৫% অ্যামাইলেজ উৎসেচক থাকে। কাঁকড়া বিছা বা বোলতার কামড়ে কচুর কন্দের রস লাগালে উপকার পাওয়া যায়। এই রস পুঁজ ও ব্যথা দূর করে। কচু ডাঁটা ও পাতা সবজি হিসেবেও খাওয়া হয়। কাটা জায়গায় কচু ডাঁটার রস লাগালে রক্তপাত বন্ধ হয়। এমনকি আয়ুর্বেদে বলা আছে এই রস প্রয়োগ করে অর্শ সারানো যায়।


হলুদের গুণাবলীর কথা শিক্ষিত-অশিক্ষিত সমস্ত ভারতবাসীই কম-বেশি জানেন। রান্নার অত্যাবশ্যকীয় মশলা ছাড়াও এর জীবাণুনাশক গুণাবলী কারও অজানা নয়। প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়ানাশক ও ছত্রাকনাশক হিসেবে হলুদের জুড়ি মেলা ভার। মাছ-মাংসে জীবাণুনাশক হিসেবে নুন ও হলুদ মাখিয়ে অনেকক্ষণ সংরক্ষণ করা যায়। কাটা-পোড়া জায়গায় হলুদবাটা লাগালে তাড়াতাড়ি ব্যথা ও দাগ সেরে যায়। কাঁচা হলুদবাটা নিয়মিত গায়ে মাখলে ত্বক ফর্সা ও লাবণ্যময় হয়। ত্বকের যে কোনও রোগ ও সর্দি-কাশি নিরাময়ে হলুদ খুব ভালো কাজ দেয়। স্তন ক্যানসার, অগ্ন্যাশয়ের ক্যানসার, প্রস্টেট ক্যানসার, ডায়াবেটিস ও মানসিক অবসাদের চিকিৎসায় হলুদের উপকারী ভূমিকা আজ স্বীকৃত। নিয়মিত কাঁচা হলুদবাটা খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মনে হয় এজন্যই হিন্দুধর্মে বিয়ের আগে গাত্রহরিদ্রা অনুষ্ঠানে, অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানে পুত্রসন্তানকে হলুদবাটা মাখানো বা পয়লা বৈশাখে কাঁচা হলুদ মেখে স্নান করার পেছনে জীবাণু নাশ করার বৈজ্ঞানিক কারণ নিহিত। সমস্ত পুজো-আচ্চায় তাই মাঙ্গলিক উপকরণ হিসেবে হলুদ আবশ্যিক। সুতরাং যথার্থভাবেই হলুদ হল বিঘ্ননাশিনী।

বাংলায় জয়ন্তী নামের গাছ অনেকের কাছে অপরিচিত হলেও ধৈঞ্চা বা ধঞ্চে নামটা মোটেই অপরিচিত নয়। সংস্কৃতে ‘জয়ন্তিকা’ শব্দ থেকে জয়ন্তী নামের উদ্ভব। এরা সবরকম আবহাওয়ায় ও সবরকম মাটিতে জন্মায়। নোনা মাটি, ক্ষার মাটি, জলমগ্ন মাটি, অনাবৃষ্টিতে খটখটে শুকনো মাটি – সব মাটিতেই জয়ন্তী মানিয়ে নেয়। জয়ন্তী গাছ হল শিম পরিবারের উদ্ভিদ। আর শিম পরিবারের সব গাছের বৈশিষ্ট্য হল এরা মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমান বৃদ্ধি করে। এর পাতা, ফুল ও ফল মাটিতে অসাধারণ সবুজ সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ জয়ন্তী গাছ মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধিতে খুবই প্রয়োজনীয় উদ্ভিদ। তাই মাটির গুণবর্ধক হিসেবে মনে হয় জয়ন্তী গাছকে কীর্তিস্থপয়িতা বলা হয়েছে। কচি সবুজ টাটকা পাতা পুষ্টিকর পশুখাদ্য। জয়ন্তীর কান্ড জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর কান্ড থেকে যে আঁশ পাওয়া যায় তা দিয়ে মাছ ধরার জাল, ব্যাগ ইত্যাদি তৈরি হয়। এই আঁশ পাটের আঁশের চেয়ে শক্ত। এ ছাড়া বীজ থেকে গঁদ তৈরি হয়।


গ্রীষ্মে বেলের পানা অর্থাৎ বেলের সরবৎ এক অসাধারণ পানীয়। প্রখর তাপে দগ্ধ হবার পর এক গ্লাস বেলের পানা শুধু মনের শান্তি আনে না, শরীরের আরামও আনে। সুতরাং বেল আমজনতার পছন্দের ফল হবে – এ আর নতুন কথা কী! সুতরাং বেলকে ‘লোকপ্রিয়া’ হিসেবে উপস্থাপন করা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। বেলের আঠা ও পেকটিনেই নিহিত আছে এর অসামান্য ভেষজ গুণ। দীর্ঘস্থায়ী পেটখারাপ বা আমাশায় বেল খুব উপকারী। কাঁচা বা আধপাকা বেল ক্ষিদে বাড়ায় ও খাবার-দাবার হজমে সাহায্য করে। এছাড়া বেল, বেলপাতা ও বেলের শিকড়ের জীবাণুনাশক শক্তিও প্রমাণিত।


ডালিমকে বলা হয়েছে শক্তিদাত্রী রক্তবীজনাশিনী। রক্তবীজ মানে হল অসুর। এক্ষেত্রে অসুর মানে যদি আমরা ধরে নিই রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু, তবে ডালিমরূপে দেবী দুর্গার রক্তবীজনাশিনী রূপকে তুলনা করা অত্যন্ত সঙ্গত হয়েছে। কারণ ডালিমের রসের রয়েছে ভাইরাস প্রতিরোধী, বীজের তেলে রয়েছে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী এবং শুকনো মূল ও ছালে রয়েছে কৃমিনাশক গুণ। লিভারের সুরক্ষায়, অকাল বার্ধক্য রোধে, দাঁতের রোগ প্রতিরোধে, ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে ও বমিভাব দূর করতে ডালিম খুব কার্যকর। ডালিমে উপস্থিত লোহা ও ফোলিক অ্যাসিড রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে। ডালিমে পলিফেনল যৌগ বেশি পরিমাণে থাকায় অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াকে প্রতিরোধ করতে পারে। সাধারণ সর্দি-কাশি সারাতে ডালিমের রস ভালো কাজ দেয়। তাছাড়া প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় ডালিম ক্যানসার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। ডালিমের রস রক্তে এল ডি এল কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে হৃদরোগ ও সেরিব্রাল স্ট্রোক প্রতিরোধেও সাহায্য করে। হাড় গঠনেও ডালিমের অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে, কারণ এতে যা ফসফরাস আছে (প্রতি ১০০ গ্রামে ৭০ মিগ্রা) তা সমপরিমাণ কমলা, আপেল ও আমের চেয়ে চারগুণ, আতা ও আঙুরের চেয়ে চারগুণ এবং কুল ও আনারসের চেয়ে সাতগুণ বেশি। সুতরাং ডালিম তো অবশ্যই শক্তিদাত্রী ফল।

হিন্দুদের কাছে অশোক এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বৃক্ষ বসন্তে এর নয়নলোভন পুষ্পশোভা যে দেখে তার শোক দূর হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। অশোক ফুল হল প্রেমের প্রতীক। কামদেবের পঞ্চশরের অন্যতম শর ছিল এই ফুলেই সজ্জিত। পুরাণে কথিত আছে যে গৌরীদেবী এই গাছের তলায় তপস্যা করে শোকমুক্ত হয়েছিলেন এবং সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। গৌতম বুদ্ধ লুম্বিনী উদ্যানে জন্মেছিলেন অশোক গাছের তলায়আবার মহাবীর অশোক গাছের তলায় তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেন। রামায়ণে রাবণ যে সীতাকে অপহরণের পর অশোকবনে বন্দী করে রেখেছিলেন তা-ও সবার জানা। খাদ্য হিসেবে না হলেও ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে অশোকের ছালের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকে হয়ে আসছে। ঠান্ডা লাগা, যন্ত্রণা, প্রস্রাবে জ্বালা, অকাল গর্ভপাত, জরায়ুর সমস্যা, অর্শ, অ্যালার্জি, আমাশা ইত্যাদি রোগ নিরাময়ে অশোক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি কৃমিনাশক ও হৃদরোগের প্রতিষেধক হিসেবেও ভালো কাজ করে।

অল্প খরচে ও অল্প সময়ে মানকচুর উৎপাদন খুব ভালো হওয়ায় চাষি যে বড়ো অঙ্কের লাভের মুখ দেখবে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এজন্য যথার্থই মানকচুকে সম্পদদায়ী সবজি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। পানের বরোজের পাশে বা পরিত্যক্ত অফসলী জমিতে অনায়াসে মানকচু চাষ করা যায়। এক একটা মানকচুর ওজন হয় গড়ে ৮-১০ কেজি। মানকচুর চাষে কোনও রাসায়নিক সার বা বিষ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ফলে মানকচুর চাষ মানে ন্যূনতম লগ্নিতে বিপুল আয়। কচুর দুনিয়ায় কিন্তু মানকচুর মান সবচেয়ে বেশি। তবুও মানকচু সম্বন্ধে আমাদের একটু নাক সিঁটকানো ভাব আছে। মনে হয় ক্যালসিয়াম অক্সালেটের উপস্থিতির জন্য গলা চুলকানোই এই উপেক্ষার কারণ। যাইহোক, সবজি হিসেবে মানকচু যেমন খুবই পুষ্টিসমৃদ্ধ, তেমনই অসাধারণ ভেষজগুণসম্পন্ন। এতে স্টার্চের পরিমাণ খুব বেশি, প্রায় আলুর সমান। এছাড়া ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লোহা, নিয়াসিন ও থিয়ামিন যথেষ্ট বেশি পরিমাণে রয়েছে। মানকচু পাতলা করে কেটে রোদে শুকিয়ে রান্না করে খেলে শোথ ও উদরী রোগ সারে। অর্শ, কোষ্ঠবদ্ধতা, লিভারের সমস্যা ও আমাশয় নিরাময়ে মানকচু খুব কার্যকরী। বার্লির বিকল্প হিসেবে অশক্ত ব্যক্তি ও রোগীদের মানকচু চূর্ণ খাওয়ানো যায়। মানকচুর ডাঁটা সেঁকে তার রস কানে দিলে কানে পুঁজ পড়া বন্ধ হয়। মানকচুর শেকড় বেটে তার রস পুরানো ঘায়ে লাগালে তাড়াতাড়ি ঘা শুকিয়ে যায়।


নবপত্রিকার শেষতম উদ্ভিদশক্তি হল ধান। শুধু ভারতবাসীর নয়, বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রধান খাদ্য হল ধানজাত খাদ্য। এশিয়া মহাদেশের প্রথম আবাদী ফসল হল ধান। আর ধানের জন্মভূমি তো আমাদের ভারতবর্ষ। বিদেশের কথা বাদই দিলাম, আমাদের দেশে ধান থেকে নানা পদ তৈরি হয় – ভাত, পিঠে, পায়েস, ইডলি, ধোসা ইত্যাদি। গরিব মানুষ একমুঠো ভাত খেতে পেলেই খুশি। ভাতের ফ্যান গবাদি পশুর উপাদেয় খাদ্য। ধানের তুষ থেকে জ্বালানি, গবাদি পশুর খাদ্য ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ তেল হয়। আবার শুকনো ধান গাছ অর্থাৎ খড় থেকে গবাদি পশুর খাদ্য, কাগজ, মাদুর, বোর্ড, খেলনা, প্রতিমার কাঠামো, পানের বরোজের আচ্ছাদন, জ্বালানি, জৈব সার – কত কী তৈরি হয়। পুজোয় আলপনা দেওয়া হয় চালের বাটা দিয়ে। আর হিন্দুদের যে কোনও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে ধান-দূর্বা তো আবশ্যিক উপকরণ। সুতরাং ধান যে প্রাণদায়িনী মহালক্ষ্মী হিসেবে বিবেচিত হবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

আমরা বাঁচার জন্য খাবার খাই, খাবার খাওয়ার জন্য বাঁচি না। আর আমাদের বাঁচার প্রধান খাদ্যশস্য ধান উৎপাদন হয় এই শরৎকালে। আর তাই মনে হয় অধিকাংশ গবেষক নবপত্রিকার পুজোকে প্রকারান্তরে শস্যদেবীর পুজো বলেই মতপ্রকাশ করেছেন। বিখ্যাত গবেষক, প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও সাহিত্যিক ডঃ শশিভূষণ দাশগুপ্তের মতে, “এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্যদেবীরই পূজা। পরবর্তীকালের বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। .... বলাবাহুল্য এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটা সচেতন চেষ্টা। এই শস্যদেবী মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ। সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও সেই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে।” দেবী দুর্গার আর এক নাম শাকম্বরী। শাক অর্থাৎ উদ্ভিদকে গুরুত্ব দিয়েই যে দুর্গার এরূপ নামকরণ হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং নবপত্রিকা প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে যে প্রকারান্তরে দেবী দুর্গার উদ্ভিদশক্তির আরাধনা করা হয় সে ব্যাপারে আর সংশয় থাকে না।
______
ছবিঃ আন্তর্জাল

1 comment:

  1. চমতকার লেখা। তথ্যসমৃদ্ধ অথচ সুখপাঠ্য। এ মেলবন্ধন পড়তে সহজ হলেও কলমে তৈরি করা সহজ নয়। অবশ্য সৌম্যকান্তির সে গুণ সবারই জানা।

    ReplyDelete