মরুতীর্থ হিংলাজের পথে
জয় শাহ
অনুবাদঃ শিশির বিশ্বাস
হিংলাজ মন্দিরে মা হিংলাজ এবং ভৈরব অর্থাৎ মহাদেবের স্বয়ম্ভু শালগ্রাম শিলা |
(অনুবাদকের কথাঃ মরুতীর্থ হিংলাজ বলতেই আমাদের মনে পড়ে তন্ত্রসাধক লেখক
অবধূতের ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ উপন্যাস অথবা সেই কাহিনি নিয়ে তৈরি বিখ্যাত সিনেমার
কথা। বর্তমান পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের এক দুর্গম অঞ্চলে এই সতীপীঠ সাধারণ
তীর্থযাত্রীদের কাছে নানা কারণে কখনোই তেমন পরিচিতি পায়নি। দেশবিভাগের পরে চলে
গিয়েছিল আরও অগোচরে। কিন্তু সময় বদলেছে। বর্তমান ভ্রমণকাহিনিটি তারই ফসল। প্রসঙ্গত বলা দরকার, ইংরেজিতে লেখা মূল
ভ্রমণকাহিনির হুবহু অনুবাদ আমি করিনি। করিনি লেখাটিকে আরও রসসিক্ত করার তাগিদে।
বাদ গিয়েছে অপ্রয়োজনীয় কিছু অংশও। তবে মূল বিষয়বস্তু থেকে বিচ্যুত হইনি। ভ্রমণকাহিনির দ্বিতীয় অংশটি আমার কাছে
বেশি আকর্ষণীয় মনে হলেও লেখক সেটি বড্ড সংক্ষেপে সেরেছেন। আমি নিরুপায়।
আর একটি কথা। আমেরিকার নাগরিক শ্রী জয় শাহ সরাসরি ওদেশ থেকে আসার কারণে কিছু
সুবিধা পেয়েছেন ঠিকই, তবে ভারত থেকে হিংলাজ দর্শন তুলনায় কিছু কঠিন হলেও অসম্ভব
নয়। করাচীর স্বামীনারায়ণ মন্দির থেকে বছরে দু’বার তীর্থযাত্রার ব্যবস্থা করা হয়।
ভিসার সমস্যা মেটানো গেলে তাদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। নবরাত্রি উৎসব উপলক্ষে
অক্টোবর-নভেম্বর মাসে কলকাতা থেকেও কখনও গ্রুপ ট্যুরের ব্যবস্থা করা হয়।)
(১)
শেকড় এদেশের গুজরাটে হলেও পাকেচক্রে আমেরিকার বাসিন্দা সেই ১৯৬৮ সাল থেকে।
দেশে আসা হত কদাচিৎ। কিন্তু সেটা হঠাৎই নিয়মিত হল গুরুদেব আন্নাজির সংস্পর্শে আসার
পর। বিজাপুরে তাঁর আশ্রমে এরপর প্রতিবছর আসতেই হত। আমার চারধাম তীর্থযাত্রা ওই
সময়। ভেতরে তাগিদটা বাড়ছিল। গুরুদেব দেহ রাখার পরে ২০০৬ সালে গুরুমাতা আক্কাজি
একদিন যখন আমাকে পাকিস্তানে হিংলাজ তীর্থ দর্শনের জন্য বললেন, সম্মতি জানাতে দেরি
করিনি।
হিংলাজ তীর্থ পাকিস্তানের কোথায়, কীভাবে যেতে হয় জানা ছিল না তখন। গুরুমাও
বলতে পারেননি। শুধু জানিয়েছিলেন ১৯৮০ সালে ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন একবার তাঁরা
পাকিস্তান গিয়েছিলেন। সেবার অনেক চেষ্টা করেও সেদেশের প্রশাসনের অসহযোগিতার কারণে
হিংলাজ দর্শন হয়ে ওঠেনি।
হিংলাজের পথে হামিদ ওমরের সঙ্গে লেখক জয় শাহ (ডান দিকে) |
যাই হোক, এরপর যখন ভাবতে শুরু করেছি, প্রতিবছর বিজাপুরের আশ্রমে যখন আসা হয়
সেখান থেকেই হিংলাজ দর্শনে রওনা হব। কিন্তু গুরুমা আপত্তি করলেন। সরাসরি নিউ ইয়র্ক থেকেই তিনি হিংলাজ দর্শনে
যাবার জন্য বললেন।
তীর্থস্থানটি পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে। এর বাইরে কোনও তথ্য তখনও জোগাড় করা যায়নি।
অগত্যা গুগল সার্চ–এর স্মরণ। কিন্তু গোড়ায় তাতেও বিশেষ সুবিধা হয়নি। শুধু
জানা গেল করাচীর স্বামীনারায়ণ মন্দির থেকে বছরে দু’বার হিংলাজ যাত্রার ব্যবস্থা
করা হয়। সারাবছর স্থায়ী কোনও পূজারীও নাকি সেখানে থাকে না। ইমেলে যোগাযোগ করা হল।
কিন্তু অপেক্ষাই সার। কোনও উত্তরই পাওয়া গেল না।
এই সময় গুগল সার্চ থেকেই খোঁজ পাওয়া গেল করাচীর ‘অফ–রোডার্স ক্লাব’ নামে এক ভ্রমণ সংস্থার। ওরা নিজেদের গাড়িতে
টুরিস্টদের বিভিন্ন স্থানে ঘুরিয়ে নিয়ে আসেন। তখনই তাঁদের মেল করা হল। কয়েকদিনের
মধ্যেই উত্তর। সংস্থা থেকে জনৈক সলমন আলির ঊষ্ণ আমন্ত্রণ, চলে আসুন শাহ সাহেব।
আপনাকে হিংলাজ দর্শন করিয়ে দেব।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাবার প্রশ্ন ছিল না। তবুও এর মধ্যে আকস্মিকভাবে আরও একটি
যোগাযোগ হয়ে গেল। তিনি মিঃ খালিদ মাহমুদ। এক আমেরিকান সংস্থার করাচী শাখার
ম্যানেজিং ডিরেক্টর। আমার স্থির বিশ্বাস, প্রায় অযাচিত এই যোগাযোগটি গুরুমার
আশীর্বাদের কারণেই।
এরপর ভিসার পর্ব শেষ করে একদিন চেপে বসলাম পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার
লাইনসের করাচীর ফ্লাইটে। এখানে আমার স্ত্রী অনুর কথা একটু বলতেই হয়। এভাবে হুট করে
পাকিস্তানে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক স্থানে যেতে দিতে একেবারেই ইচ্ছে ছিল না তার।
কিন্তু নির্বিরোধী মানুষটি একবারও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। শুধু নিউ ইয়র্ক এয়ারপোর্টে
বিদায় জানাতে এসে হাত ধরে বলেছিল, “কথা দাও, করাচী বাজারে ক্যামেরা হাতে বেপরোয়া
ঘোরাঘুরি করবে না। আর যা অভ্যাস তোমার, হুট করে মেয়েদের ছবি তুলতে যেও না, প্লিজ।
জায়গাটা আমেরিকা নয়। বিপদ হতে পারে।”
স্ত্রীর আশঙ্কার আরও কারণ, মাত্র দু’দিন আগে করাচীর
ইউ.এস.এ কনসুলেটে মৌলবাদীরা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। আমার কর্মস্থল থেকেও যাত্রা
বাতিল করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কর্ণপাত করিনি আমি।
করাচীর রত্নেশ্বর মহাদেব মন্দির। আসলে এটি একটি প্রাকৃতিক গুহা। প্রবাদ‚ গুহাটি সমুদ্রের তলা দিয়ে চলে গেছে হিংলাজ মন্দির পর্যন্ত। |
বলা বাহুল্য‚ স্ত্রী অনুকে আশ্বস্ত করেই প্লেনে
উঠেছিলাম সেদিন। দিনটা ২০০৬ সালের ২২শে মার্চ। করাচী এয়ারপোর্টে যখন নামলাম, রাত
প্রায় একটা। ভ্যাপসা গরমের রাত। এয়ারপোর্টের বাইরে আসতেই দেখি আমার নাম লেখা
প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন।
মিঃ খালিদ মাহমুদ জানিয়েছিলেন বটে, এয়ারপোর্টে লোক পাঠাবেন। কিন্তু সত্যিই
এতটা ভাবিনি। এরপর গাড়িতে বসার কিছুক্ষণ পরেই ড্রাইভারের মোবাইলে একটা ফোন এল। দু’চার কথা বলে তিনি সেটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। করাচী অফিসে মিঃ খালিদ মামুদের
সেক্রেটারি মিস ডায়না জোন এই রাত দু’টোয় খোঁজ নিচ্ছেন আমি ঠিকমতো পৌঁছেছি কিনা।
সেই সঙ্গে জানালেন ড্রাইভারকে নির্দেশ দেওয়া আছে, পাকিস্তানে অবস্থানকালীন কয়েকটা
দিন ব্যবহারের জন্য আই.এস.ডি সুবিধাযুক্ত একটি ফোন আমাকে দেবেন। মিঃ মাহমুদের ইচ্ছে আমি যেন আজই বাড়িতে
স্ত্রী–পরিজনদের সঙ্গে কথা বলি।
হায়, গত ৪২ বছরে ভারতে অনেকবার তো এসেছি। এমন উষ্ণ আন্তরিক অভ্যর্থনা কখনও
পাইনি।
পরেরদিন মিস ডায়না জোন হোটেলে এলেন আমার খোঁজ নিতে। লাঞ্চের পর নিয়ে গেলেন
ক্লিফটন বিচে রত্নেশ্বর মহাদেব মন্দিরে। ইংরেজ আমলে গুহার ভিতর সুপ্রাচীন এই
মন্দিরটি হঠাৎই আবিষ্কার হয়। প্রবাদ, দীর্ঘ গুহাটি নাকি সমুদ্রের তলা দিয়ে চলে
গেছে হিংলাজ মন্দির পর্যন্ত। মহাদেব এই পথেই হিংলাজদেবীর সাথে মিলিত হয়ে থাকেন।
মন্দির দর্শনের পর যাওয়া হল করাচীর এমপ্রেস মার্কেটে। স্থানীয় মানুষের কাছে ‘বড়ি বাজার’। বেশ ঘিঞ্জি
এলাকা। বাজারের ভিতর
মানুষের ভিড় আর চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে সরগরম। হিংলাজমাতার পুজোর জন্য নেওয়া হল শুকনো ফল। কিছু বেশিই নিতে হল। তীর্থ সেরে
যাওয়ার কথা বিজাপুরে গুরুমার আশ্রমে। নিউ ইয়র্কে পরিজন, বন্ধুবান্ধবের জন্যও পুজোর
প্রসাদ নিতে হবে। এছাড়া কেনা হল হিংলাজ মায়ের চুড়ি, কাপড় আর সিঁদুর। গোটা বারো
নারকেল। হিংলাজ দর্শনে যাব শুনে বাজারে একজন অতি আন্তরিকভাবে বললেন, “একটা অনুরোধ
করি সাহেব, একটু হুঁশিয়ার থাকবেন। খুন-জখম লেগেই থাকে ওদিকে।”
করাচীর এমপ্রেস মার্কেট (বড় বাজার)। ইনসেটে ওই মার্কেটে ব্যস্ততা। |
বিকেলে মিঃ খালিদ মাহমুদ স্বয়ং দেখা করতে এলেন। বোটে করাচী বন্দরের সমুদ্রে
তাঁর সঙ্গে প্রমোদভ্রমণ হল অনেকটা সময়। অনেক গল্প। রাতে তাঁর বাড়িতে ডিনারের নিমন্ত্রণ। অত রাতে
করাচী পৌঁছে দিনটা যথেষ্টই ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে। আগামীকাল ভোরেই রওনা হতে হবে।
তাছাড়া আমি ভেজিটেরিয়ান। সেটা না ভেঙে স্যুপ আর স্যালাড জাতীয় হালকা ডিনারের জন্য
বলেছিলাম। উনি হেসে বললেন, “চিন্তা নেই ফ্রেন্ড। আমরাও কিন্তু ভেজিটেরিয়ান।”
সেই সন্ধেয় শুধু চমৎকার ডিনার নয়, খালিদ মামুদের পরিবারের সঙ্গে পরিচয়পর্বও এক
সুখস্মৃতি। মিঃ মাহমুদ আর তাঁর স্ত্রী লায়লা দু’জনের পড়াশুনা নিউ জার্সির রটগার্স ইউনিভার্সিটিতে। সেখানেই পরিচয়। ওদের মেয়ে
রাভি আর তার সর্বক্ষণের সঙ্গী কুকুর লুনাকে নিয়ে কোথা দিয়ে সময় পার হয়ে গেল টেরই
পাইনি।
সামান্য তাল কেটে গেল মুম্বাইয়ের সিনেমার কথা উঠতে। হঠাৎ বলে ফেলেছিলাম‚ ‘কভি খুশি কভি গম’ সিনেমাটি দেখার আগে অমিতাভ বচ্চনকে চিনতাম না।
শুনে লায়লার তো প্রায় আকাশ থেকে পড়ার জোগাড়। খানিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে শেষে
রীতিমতো ক্ষুব্ধ কণ্ঠে ব্যক্ত করলেন‚ তেমন সুযোগ হলে তিনি মিঃ মনমোহন সিংকে (তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী) জানিয়ে
দেবেন, এমন মানুষকে যেন নেক্সট টাইম মুম্বাই এয়ারপোর্টে নামতে দেওয়া না হয়।
বুঝতে পারছিলাম, অমিতাভ বচ্চনের একান্ত অনুরাগী মহিলা আমার কথায় শুধু দুঃখ নয়
বেজায় ক্ষুব্ধও হয়েছেন। এরপর সেই সন্ধ্যায় তাঁকে বোঝাতে যথেষ্টই বেগ পেতে হয়েছিল। আসলে ১৯৬৮ থেকে দেশের বাইরে নিজের
কর্মক্ষেত্র নিয়ে ব্যস্ত। হিন্দি সিনেমার তেমন ভক্তও নই। তবু রাজ কাপুর, দিলীপ
কুমার, দেবানন্দ, নার্গিসের মতো পুরনো দিনের শিল্পীদের চিনলেও পরের প্রজন্মের
অনেকের ছবিই দেখা হয়ে ওঠেনি।
করাচীর সেই ভ্রমণ সংস্থা ‘অফ–রোডার্স ক্লাব’ থেকে মিঃ সলমন আলি আমাকে হিংলাজ দর্শন করাবার
দায়িত্ব দিয়েছিলেন সংস্থার জনৈক হামিদ ওমরকে। পরেরদিন ভোরে হামিদ ওমরের ছেলে খালিদ
গাড়ি নিয়ে হোটেলে পৌঁছে গেছে। দেরি না করে রওনা হয়ে পড়লাম।
আগে শুনেছিলাম, হিংলাজ দর্শনের জন্য জিপে আমার সঙ্গে দু’জন গাইড তথা গার্ড দেওয়া হবে। কিন্তু মিঃ ওমরের বাড়িতে এসে দেখি প্রায় এলাহি
ব্যবস্থা। জিপ এবং এস.ইউ.ভি মিলিয়ে দশটি গাড়ি আর তিরিশজন মানুষের এক বিশাল দল আমার
অপেক্ষায় বসে আছে সেখানে। আসলে কাজের মানুষ হামিদ ওমর তাঁদের অফ–রোডার্স ক্লাবের তরফ থেকে ইতিমধ্যে জুটিয়ে ফেলেছেন আরও একঝাঁক ভ্রমণার্থী।
বর্তমানে মরুতীর্থ হিংলাজের পুরো অঞ্চলটি ঘোষিত জাতীয় উদ্যান। হিঙ্গুল ন্যাশনাল
পার্ক উৎসাহী ভ্রমণার্থীদের জন্য এক আদর্শ স্থান। খ্যাপাটে এক আমেরিকানবাবু হিংলাজ
দর্শনে যাচ্ছেন জেনে চলে এসেছেন আরও অনেকে।
কট্টর ভেজিটেরিয়ান সেই খ্যাপাটে আমেরিকানবাবুর ব্রেকফাস্টের জন্য হামিদকন্যা
মেহেরা তৈরি হয়েই ছিল। পৌঁছোবার অল্প পরেই ধোঁয়া ওঠা সবজিসহ গরম আলু-পরোটা নিজেই
পৌঁছে দিয়ে গেল। উচ্চশিক্ষিত‚ রুচিসম্পন্ন এই পরিবারটির সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়। এরপর যত ঘনিষ্ঠ হয়েছে, মুগ্ধ হয়েছি বলা যায়।
মেহেরা বোস্টনে পড়ে। ডকুমেন্টারি ছবি তৈরি নেশা। খালিদ, যে আমাকে হোটেল থেকে নিতে
এসেছিল অস্ট্রেলিয়ায় এম.বি.এ পড়ছে। আর ছোটোছেলে আমেরিকা থেকে টেক্সটাইল
ইঞ্জিনিয়ার।
যাত্রাপথে স্ত্রী সাবিহাকে নিয়ে হামিদ আমার গাড়িতেই ছিল। সেইসময় একটু একটু করে
শুনেছি এসব। সস্ত্রীক মানুষটিকে সারাটা সময় আমার খুঁটিনাটি সমস্যা নিয়েও বিচলিত
হতে দেখেছি। তাঁদের সেই
আন্তরিকতায় মনে হয়েছে পূর্বজন্মে আমরা নিশ্চয় দুই সহোদর ভাই ছিলাম। হিংলাজ মায়ের
আশীর্বাদে সেই ভাইকে খুঁজে পেয়েছি আবার। সেই সম্পর্ক আর ছিন্ন হয়নি তারপর। হামিদ
সপরিবারে বারকয়েক ঘুরে গেছে আমেরিকায় আমার কাছে। কী আনন্দ যে পেয়েছি তখন!
ব্রেকফাস্ট সারা হবার পর আর দেরি করা হয়নি। লম্বা পথ। হামিদ আমাদের নিয়ে যখন
যাত্রা শুরু করল, সকাল ন’টা।
পথে দেহাতি যাযাবর পরিবার |
হিংলাজ মন্দির বেলুচিস্তানে হিঙ্গুল নদীর কাছে। সিঁদুরের আর এক নাম হিঙ্গুল।
এই হিঙ্গুল থেকেই মা হিংলাজ নাম। হিঙ্গুল নদী গঙ্গার মতোই পবিত্র। স্নান করলে
সর্বপাপ মুক্ত হওয়া যায়। পুরাণ অনুসারে দক্ষযজ্ঞর পরে সতীর ছিন্ন অংশ ছড়িয়ে পড়েছিল
৫২টি বিভিন্ন স্থানে। তারই একটি এই হিংলাজ। সেকালের সবচেয়ে দুর্গম তীর্থক্ষেত্র। অনেকের মতে শ্রেষ্ঠ সতীপীঠ।
হিংলাজ মন্দির করাচী শহর থেকে প্রায় ২৫০ কিমি পথ। আগে এই পথ খুবই কষ্টসাধ্য
ছিল। কিন্তু চিনের সহযোগিতায় সম্প্রতি নতুন পাকা সড়ক তৈরি হয়েছে। মসৃণ গতিতে এসি
গাড়ি ছুটছে সেই পথ দিয়ে। হামিদ ওমর হঠাৎ মজা করে বললেন, “জয়‚ আপকো পুণ্য পুরা নেহি হোগা। সির্ফ আধা হি
মিলেগা।”
কারণটাও বুঝিয়ে দিল। তীর্থযাত্রায় প্রকৃত পুণ্য পেতে হলে কষ্ট করতে হয়। আগেকার দিনে হিংলাজ মাতার
দর্শন ছিল খুবই কষ্টকর। তেমন রাস্তা ছিল না। প্রায় পুরোটাই মরুভূমি। মূলত রাজপুত
জাতির পুণ্যার্থী মানুষ এই পথে তীর্থযাত্রায় আসতেন। পায়ে হেঁটেই। বড়জোর সঙ্গে থাকত কিছু গো-শকট আর উট। চল্লিশ
থেকে পঞ্চাশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় কয়েক সপ্তাহের যাত্রাপথ। কী ভয়ানক কষ্ট
করে মানুষগুলো হিংলাজ তীর্থে পৌঁছতেন, ভাবাও যায় না। তার উপর পথে লুঠেরা ডাকাতের
উপদ্রব। আর আজ আমাদের তীর্থযাত্রা ঝকঝকে পথে এসি গাড়িতে। ঘণ্টায় ৮০ - ১০০ কিমি
বেগে। কী করে পুরো পুণ্য মিলবে?
মানতেই হল। বিনীতভাবে শুধু বললাম, “একদম ঠিক হামিদ। তবে আমার বিশ্বাস, আমার
গুরুমা, যিনি আমাকে হিংলাজ দর্শনে পাঠিয়েছেন, এই সুবিধাটুকু তিনিই করে দিয়েছেন।
পুণ্যর ব্যাপারটা তিনিই বুঝে নেবেন।”
পথের অদূরে গুটি কয়েক ঘর নিয়ে ছোট একটি গ্রাম |
করাচী জেলার সীমানা ছাড়াবার পর থেকেই পথে জনমানুষ প্রায় বিলীন হয়ে এল। রুক্ষ,
প্রায় মরুভূমি অঞ্চল। কদাচিৎ সাত–আটজন ভবঘুরে যাযাবর
মানুষের এক আধটি দল। সঙ্গে উট। পথের ধারে তাদের দু’একটা ঝুপড়ি। কখনও হঠাৎই গোটাকয়েক দেহাতি ঘরবাড়ি। সংখ্যায় বড়জোর আট দশটি।
এগুলিই নাকি গ্রাম। সব মিলিয়ে বিশ–তিরিশজন মানুষের বাস হয়তো। এছাড়া দু’দিকে যতদূর চোখ যায় রুক্ষ জনশূন্য প্রান্তর। করাচীর সীমানা অতিক্রম করার আগে
কেন প্রতি গাড়িতে অতিরিক্ত তেল নেওয়া হয়েছে বোঝা গেল এবার। ঝকঝকে ফাঁকা রাস্তা
হলেও গাড়ি তেমন নেই। তাই পেট্রোল পাম্পও নেই। শুধু ক্বচিৎ এক আধটা মালবোঝাই ট্রাক। অধিকাংশ ট্রাকের
গায়ে নানা রঙের ছবি আঁকা। এমন বিচিত্র ছবি বিদেশে তো নয়ই, ভারতেও বেশি দেখিনি।
পথেই থামা হল এক জায়গায়। কাছেই পাকিস্তান এয়ারফোর্সের ঘাঁটি। আকাশে একঝাঁক
যুদ্ধবিমানের মহড়া চলছে তখন। তাকিয়ে দেখার মতো। ক্যামেরা বের করে সঙ্গীদের অনেকেই ছবি তুলতে ব্যস্ত। স্টিল
আর ভিডিও। ইচ্ছে থাকলেও আমার কিন্তু ভরসা হল না। তীর্থ করতে এসে জেলখানায় যাবার
মতলব না করাই ভাল। বরং ভেবে স্বস্তি হচ্ছিল অন্য এক কারণে। আসার আগে, এমনকি করাচী
পৌঁছেও অনেকেই পথের নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। হিংলাজ যাত্রার এই পথ যতই
ঝকমকে হোক, সাধারণ যাত্রীদের কাছে মোটেই নিরাপদ নয়। ডাকাতি, লুঠতরাজ নিত্য–নৈমিত্তিক। কিন্তু গুরুমায়ের আশীর্বাদে তেমন কিছুতে এখন পর্যন্ত পড়তে হয়নি।
যাই হোক, এরপর থামা হল এক ঝুপড়ি চায়ের দোকানের সামনে।
পথের ধারে ধু–ধু
প্রান্তরের মাঝে গোটাকয়েক বাবলাজাতীয় গাছের তলায় দড়ির খাটিয়া পাতা ধাবাগোছের এক
চায়ের ঠেক। এই চড়া দুপুরে প্রায় শান্তির নীড়। চায়ের গ্লাস হাতে ফের চাঙা হয়ে উঠতে
দেরি হয়নি তাই। আর হঠাৎ এতগুলি খদ্দের পেয়ে সন্দেহ নেই, চাঙা চায়ের ঠেকের মালিকও।
ঝুপড়ি ধাবায় সাময়িক চা পানের বিরতি |
এরপর চলতে চলতেই চোখে পড়ল দূরে পথের বাঁদিকে টিলা আকারের ছোটো দু’টো পাহাড়।
জানা গেল, আমরা হিংলাজ মন্দিরের অনেকটাই কাছে এসে পড়েছি। ক্রমে টিলা–পাহাড়ের সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। কখনও তারই ফাঁকে একঝলক মনোমুগ্ধকর আরব সাগরের বেলাভূমির দৃশ্য। হাতে সময় কম,
তাই থামার উপায় নেই। এরপর পথের দু’দিকেই শুরু হল পাহাড়ের সারি। একদিকের পাহাড়
আর পাঁচটা পাহাড়ের মতো হলেও অন্যদিকের পাহাড় বালি আর মাটির। হাজার হাজার বছর ধরে
জমে ওঠা এমন মাটির পাহাড় আগে দেখিনি। জোরালো বাতাসে সেই মাটির পাহাড়ের গায়ে রকমারি খাঁজ আর খোঁদলের মনোমুগ্ধকর
নক্সা।
বেলুচিস্তানের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল বর্তমানে ঘোষিত জাতীয় উদ্যান। ছয় হাজার বর্গ
কিমি আয়তনের হিঙ্গুল ন্যাশনাল পার্ক। তাই ভ্রমণার্থীদের জন্য রয়েছে কিছু
বাধ্যবাধকতা। আমাদের গাড়ির কনভয় এসে থামল এক রেঞ্জ অফিসে। ঢোকার আগে এখানে নাম
লেখাতে হবে। মেনে চলতে হবে কিছু নিয়মকানুন।
অল্প পরেই পার হতে হল হিঙ্গুল নদী। ব্রিজে সদ্য মেরামতির কাজ। দেখে বোঝার উপায়
নেই বর্ষায় এই হিঙ্গুল নদীর জল কখনও বেড়ে ওঠে ৫০–৬০ ফুট পর্যন্ত। ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজ প্রায় প্রতিবছরই মেরামত করতে হয়। নদী পার হয়ে গাড়ি ডানদিকে
বাঁক নিতেই চোখে পড়ল পথের পাশে প্রমাণ সাইজের এক বোর্ডঃ নানী মন্দির।
পথের শেষ পর্বে পথ ধুলোয় প্রায় অন্ধকার |
স্থানীয় বালুচ সম্প্রদায়ের মুসলমানদের কাছে হিংলাজ মন্দির ‘নানী মন্দির’ নামেই পরিচিত। মা হিংলাজ তাদের কাছে ‘নানী বিবি’।
মন্দিরের কাছে এসে পড়েছি বুঝে ভিতরে উত্তেজনা বাড়তে শুরু করলেও মূল সড়ক ছেড়ে
আসার পর পথের অবস্থা তখন একেবারেই আহামরি নয়। শুধু ধুলো আর ধুলো। এরই মধ্যে পথের পাশে পড়ল ছোটো এক লেক। তাতে নাকি কুমিরের বাস। পাশে সেই মর্মে
সতর্কতা বোর্ড। ধুলোয় ভরা প্রায় ১০ কিমি দীর্ঘ সেই পথ শেষ করে একসময় আকাঙ্ক্ষিত
হিংলাজ মায়ের মন্দির।
(অনুবাদকের সংযোজনঃ অঞ্চলটি অঘোরী নামেও পরিচিত। ‘অঘোরী’
এক তান্ত্রিক সম্প্রদায়েরও নাম। সম্ভবত একসময় এখানে তাদের সাধনক্ষেত্র ছিল।
হিংলাজ মন্দির সতীপীঠ হওয়ার কারণে এমন সম্ভাবনা যথেষ্টই। বর্তমানে এখানে ছোটো এক
গ্রামে কিছু বালুচ উপজাতির বাস। হিংলাজ মায়ের মন্দির তারাই সারাবছর দেখাশুনা করেন। হিংলাজ মা তাদের কাছে ‘নানী বিবি’।)
হিংলাজ তথা স্থানীয় মানুষের নানী মন্দির আর মাত্রই পাঁচ কিমি |
কতটা বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে ভাবতেও পারিনি তখন। বরাবর শুনে
এসেছি, হিংলাজ মন্দিরের বর্তমানে বড়োই দুরবস্থা। হেলায় পড়ে থাকা পুণ্য এই সতীপীঠে
বর্তমানে নিয়মিত পুজোর ব্যবস্থাও নেই। বন্য শ্বাপদের রাজত্ব। কিন্তু ভুল ভাঙতে
দেরি হল না। তাকিয়ে দেখি অদূরে বিশাল আকারের তিনটি ভলভো বাস দাঁড়িয়ে। মন্দিরের
কাছে হিংলাজ মায়ের কীর্তনের সঙ্গে জনাকুড়ি গুজরাটি মহিলার ‘গরবা’
নাচ চলছে। বলা বাহুল্য, ওই দৃশ্য দেখে প্রায় হতবাক হয়ে
গিয়েছিলাম। জানা গেল, তিনটি ভলভো বাসের যাত্রীরা তিনদিন হল এখানে তীর্থ করতে
এসেছেন। আজও থাকবেন। পাকা সড়ক আর স্থানটি জাতীয় উদ্যান ঘোষিত হবার কারণে বর্তমানে
হিংলাজ মন্দির দর্শন অনেক সহজ হয়ে গেছে। বছরে দু’বার উৎসবের সময় কয়েক হাজার পুণ্যার্থীর সমাগম
হয়। ভারত থেকেও কিছু পুণ্যার্থী আসেন তখন।
মন্দিরের দিকে এগোচ্ছি, একটি ছোটখাটো মানুষ, গায়ে উত্তরীয়, ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ বলে সামনে এসে দাঁড়ালেন। জানতে চাইলেন, পুজো দিতে চাই কি
না।
দলের সবাই তখন একসাথে মন্দিরের দিকে পা বাড়িয়েছি। পরনে অন্যদের মতোই
শার্টপ্যান্ট। তার মধ্যে থেকে চল্লিশ বছরের উপর আমেরিকা প্রবাসী মানুষটিকে তিনি
কীভাবে সেদিন বেছে নিয়েছিলেন, তা তিনিই জানেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত, গুরুমাই তাঁকে
পাঠিয়েছিলেন। মানুষটি আমেদাবাদের বৈদিক টোলে সাত বছর সংস্কৃত এবং বৈদিক শাস্ত্র
চর্চা করেছেন। এখানে এসেছেন ভলভো বাসের যাত্রীদের সঙ্গে। বলা বাহুল্য, তিনিই এরপর আমার
জন্য পুজোর ব্যবস্থা করলেন।
উনি প্রথমে আমাদের পাহাড়ের উপরে গুজরাটি সম্প্রদায়ের ‘মেলদীমাতা’, তারপর কালীমায়ের মন্দিরে নিয়ে গেলেন।
জামাপ্যান্ট ছেড়ে আমি এবার একটা সিল্কের ধুতি পরে কালীমন্দিরের কাছে একটি পুকুরে
ডুব দিয়ে স্নান সেরে নিলাম। উনি মন্ত্র উচ্চারণ করে এরপর আমাকে উপরে হিংলাজ
মন্দিরে নিয়ে গেলেন। এখানেও মন্দিরের সামনে ছোটো এক পুকুর। জলে ছোটো ছোটো মাছ ঘুরে
বেড়াচ্ছে। ফের এখানেও স্নান সারা হল। তারপর মূল মন্দিরে প্রবেশ।
হিংলাজ মায়ের মন্দির পাহাড়ে বড়ো আকারের একটি উন্মুক্ত গুহার ভেতর। সম্প্রতি গুহার মেঝে ঝকঝকে সেরামিক টাইল দিয়ে
বাঁধানো হয়েছে। লাগানো হয়েছে দরজা। বড়ো একটি ঘণ্টা উপর থেকে ঝুলছে। পূজারী শঙ্খ
এবং ঘণ্টাধ্বনির মধ্যে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
মন্দিরের ভেতর তিনধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাঁধানো উঁচু চাতালের উপর মা হিংলাজ এবং ভৈরব
অর্থাৎ মহাদেবের সিঁদুর মাখানো স্বয়ম্ভূ শালগ্রাম শিলা। চাতালের নীচে সিঁড়ির
দুইপাশে কাঠের দরজা লাগানো দু’টি চৌকো ফোকর। ফোকরদু’টি চাতালের নীচে পাহাড়ের ভেতর
২০–৩০ ফুট দীর্ঘ একটি অর্ধবৃত্তাকার গুহার দুই মুখ। হিংলাজমায়ের পুজো দেবার আগে
পুণ্যার্থীকে আড়াই থেকে তিন ফুটের মতো চওড়া ওই গুহার একমুখ দিয়ে ঢুকে অন্যমুখ দিয়ে
বেরিয়ে আসার নিয়ম। বিশ্বাস, তাতে পাপমুক্ত হওয়া যায়।
হিংলাজ মন্দিরে মূল বেদী। সিঁড়ির দুই পাশে গুহার দুই দরজা। বাঁ দিকেরটি ভিতরে প্রবেশের জন্য। ডান দিকেরটি বেরিয়ে আসার জন্য। |
বলা বাহুল্য, কাজটি সহজ নয়। ঘন অন্ধকারের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে গুহার একমাথা
থেকে অন্যমাথা পর্যন্ত যেতে হবে। বিষাক্ত পোকা, মাকড়শা তো বটেই, সাপখোপ থাকাও
বিচিত্র নয়। অনেকেই এড়িয়ে যায়।
সঙ্গী পাকিস্তানী বন্ধুরা সবাই তখন তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তাদের অনেকেই ভাবতে পারেননি লম্বা, ভারি
শরীরের খ্যাপাটে আমেরিকানবাবুটি শেষপর্যন্ত সাহস করে উঠতে পারবেন কিনা। ততক্ষণে
আমি অবশ্য মনস্থির করে ফেলেছি। গুহার ভেতর ঢুকতে পরনে সেলাইবিহীন একটি কাপড় ছাড়া
পুণ্যার্থীর সঙ্গে অন্যকিছুই রাখা যাবে না। সেইভাবেই তৈরি হয়ে মা হিংলাজ আর
গুরুমাকে স্মরণ করে একটু পরেই ঢুকে পড়লাম ভেতরে। গোড়ায় সামান্য ভয় থাকলেও সেটা
কেটে যেতে সময় লাগেনি। বিশ্বাস ছিল, গুরুমার যখন ইচ্ছে, তিনিই রক্ষা করবেন। ঘন
অন্ধকারে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে গুহা পার হয়ে আসতে সময় লেগেছিল মিনিট পনেরোর মতো।
যখন অন্যমুখ দিয়ে বের হয়ে আলোর পৃথিবীতে এসে পৌঁছলাম, মনে হল, সত্যিই যেন
পুনর্জন্ম হয়েছে আমার।
পূজারী আশীর্বাদ করে জানালেন, গত সাতজন্মের পাপ ধুয়ে গিয়ে আজ মাতৃজঠর থেকে
পুনর্জন্ম হল আমার। উপস্থিত পাকিস্তানি বন্ধুরা কিন্তু উৎসাহে জানিয়ে দিলেন, “সাত
নয় জয় সাহেব, তোমার বিগত চৌদ্দজন্মের পাপ আজ মা হিংলাজ নিশ্চয় ধুয়ে দিয়েছেন।” বেচারি পূজারী অবশ্য প্রতিবাদ করে জানালেন,
চৌদ্দ নয়, শাস্ত্র অনুসারে এতে সাতজন্মের পাপ থেকেই মুক্ত হওয়া যায়।
বালিতে গাড়ির চাকা বসে গিয়ে বিপত্তি! |
যাই হোক, পূজারী এরপর আমার হাতে একটি তুলসীমালার মতো মালা দিয়ে সারাজীবন গলায়
ধারণ করতে বললেন। স্থানীয় গাছের কাঠ থেকে তৈরি এই মালা হিংলাজে পুজো দিতে এসে
স্বয়ং রামচন্দ্রও নাকি ধারণ করেছিলেন। অতঃপর তৈরি করা হল ছোটো এক যজ্ঞবেদি। করাচীর বাজার থেকে আনা উপচারগুলো দিয়ে মা
হিংলাজ আর ভৈরবের স্বয়ম্ভূ শিলার সামনে পূজার পর্ব সম্পূর্ণ করলেন তিনি।
অচল গাড়ি ফের সচল করার ব্যবস্থা |
ফের জানা গেল, পুরাকালে স্বয়ং রামচন্দ্রই নয়, পরবর্তীকালে এখানে হিংলাজমায়ের
পূজা দিতে এসেছেন আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন গুরু নানক আর
সুফি সাধক রুমীর মতো ব্যক্তিও।
এবার ফেরার পালা। ভলভো গাড়ির তীর্থযাত্রীরা আমাকে রাতের ডিনারে নিমন্ত্রণ
করেছিলেন। কিন্তু উপায় নেই। আমার পাকিস্তানি সহযাত্রীদের আজ আরও প্রোগ্রাম রয়েছে।
রাতে হিঙ্গুল নদীর ধারে শুধু ক্যাম্প নয়, রয়েছে আরও অনেক রোমাঞ্চ। অগত্যা বিদায়
নিয়ে এলাম।
(২)
তীর্থদর্শন শেষ হতেই অফ–রোডার্স ক্লাবের গাড়ির কনভয় এবার সত্যিকারের অফ–রোড
অর্থাৎ রাস্তা ছেড়ে বে-রাস্তায় তার অভিযান শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই মালুম পাওয়া গেল বালিয়াড়ির
বিভীষিকা কাকে বলে! মাইলের পর মাইল শুধু উঁচুনিচু বালিয়াড়ি। দশ গাড়ির কনভয় ছুটেছে
তারই ভিতর দিয়ে। কোথাও দু’চারটে আধ-শুকনো কাঁটা ঝোপ, ক্বচিৎ এক আধটা
বাবলাজাতীয় গাছ। আলগা বালির ভেতর চাকা বসে ঘন ঘন বিপত্তি। কিন্তু তাতে
অফ–রোডার্সের দল হাল ছাড়ার পাত্র নয়। গাড়ির চাকা হঠাৎ কোথাও বসে গেলেই মোটর লাগানো
হাইড্রোলিক জ্যাক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কয়েকজন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মুশকিল আসান। দরকারে ‘হেঁইও—হেঁইও’
রবে গাড়ি ঠেলে তুলেও দেওয়া হচ্ছে। কষ্ট নয়, বরং মজাই বেশি।
অফ–রোডার্স ক্লাবের এক রাতের আস্তানা |
হিঙ্গুল নদীর ধারে ক্যাম্প সাইটে যখন পৌঁছনো গেল সূর্যদেব পাটে বসেছেন তখন।
প্রায় দিগন্তের কাছে। দৌড়ঝাঁপ করেই খাটানো হল গোটা দশেক তাঁবু। একপাশে বড়ো এক
উনুন। সঙ্গে বাবুর্চি রয়েছে। অনতিবিলম্বে শুরু হয়ে গেল রান্নার তোড়জোড়। আমার জন্য ভেজ ডিনার হামিদভাই অবশ্য
বাড়ি থেকেই করে এনেছেন।
ইতিমধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে। সামনে অগ্নিকুণ্ড ঘিরে একদঙ্গল মানুষের গান,
নানা গল্প। সময় কোথা দিয়ে উধাও হতে লাগল হদিস করার উপায় ছিল না। আমেরিকা প্রবাসী
শহুরে কাঠখোট্টা মানুষ আমি। সারা সপ্তাহ ব্যস্ত নিজের কর্মক্ষেত্রে। এমন অভিজ্ঞতার
স্বাদ আগে পাইনি। রাতের ঘন অন্ধকারে পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে হিঙ্গুল নদী। মাথার উপর
নিকষ অন্ধকার আকাশে অসংখ্য তারার ফুলঝুরি। সামনে স্তিমিত অগ্নিকুণ্ড। সদ্য পরিচিত
একঝাঁক আপনজনের সঙ্গে সেই রাতের আনন্দ ভোলার নয়।
অনেক রাতে ঘুমোতে গেলেও ঠিক পাঁচটায় উঠে পড়তে হল। আজকের দিনটা ঠাসা প্রোগ্রামে
ভরা। তৈরি হতেই হাতে পৌঁছে গেল চা কিংবা কফি। দলের সঙ্গে ছিলেন অফ–রোডার্স ক্লাবের
পাপ্পুসাহেব। ৭০ বছরের প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর মানুষটি সেই ভোরেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন
গাড়িগুলো নিয়ে। দেখে নিচ্ছেন প্রতিটি গাড়ির কলকব্জা। পরিষ্কার হচ্ছে বালিতে বোঝাই
এয়ার ফিল্টার। রাতে কয়েকটি
গাড়ির চাকা নদীতীরের নরম মাটিতে বসে গিয়েছে। লোক লাগিয়ে ঠেলে তোলা হচ্ছে সেগুলো। তারই ফাঁকে মানুষটি নিজের ১৯৪৭ সালের
জিপের আয়নায় কামিয়ে নিয়েছেন দাড়ি। ব্রেকফাস্টের জন্য দিব্যি দু’টি ডিমও সেদ্ধ করে
ফেলেছেন সেই গাড়ির আয়নার সাহায্যেই।
হিঙ্গুল নদীর তীরে ভোরের আলো তখন যথেষ্টই নরম। চলছে চা–কফির তোড়জোড়। |
পাপ্পুসাহেব যখন গাড়ি নিয়ে ব্যস্ত, অনেকেই তখন স্নান সারতে হিঙ্গুল নদীর জলে
গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। নবীনদের উৎসাহই বেশি। নদীর মাঝে জেগে ওঠা পাথরে বসে তাদের
কয়েকজনের হইহই চলছে।
সাঁতার জানা নেই। কাদা ভরা পিছল মাটি–পাথর। জলের
গভীরতাও সর্বত্র সমান নয়। আমাকে গড়িমসি করতে দেখে সবাই উৎসাহ দিচ্ছিল। হিঙ্গুল
নদীর জল গঙ্গার মতোই পবিত্র। অগত্যা সহজ পথটাই বেছে নিতে হল। নদীর পাড়ে বসে গায়ে জল ঢেলেই স্নানের কাজ
সেরে ফেললাম। সকালের ঠাণ্ডা জলে শরীর জুড়িয়ে গেল যেন।
ভোরে হিঙ্গুল নদীর স্নিগ্ধ জলে স্নান পর্ব। |
স্নান সারা হতেই সকালের ব্রেকফাস্ট পর্ব। তারপর ফের একদফা চা–কফি। ইতিমধ্যে পাপ্পুসাহেবের তত্ত্বাবধানে গাড়ির কাজ শেষ হয়েছে। গাড়িগুলোকে
পাশাপাশি রেখে সামনে সবাইকে দাঁড় করিয়ে ছবি নেওয়া হল এবার। একটি স্মরণীয় মুহূর্ত।
এরপর যাত্রা শুরু। আমরা প্রথম যাব ‘চন্দ্রগুপ’। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো জীবন্ত মাড ভলকানো
অর্থাৎ ‘পঙ্কোদগারী গিরি’।
(অনুবাদকঃ পাকিস্তানের হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এটি ‘বাবা চন্দ্রকূপ’ অর্থাৎ
চন্দ্রবাবার কুণ্ড নামেও পরিচিত। প্রতিবছর নবরাত্রি উৎসবের সময় পাকিস্তানের হাজার
হাজার হিন্দু তীর্থযাত্রী হিংলাজমাতার পুজো দিতে আসেন। ভারত থেকে কিছু
তীর্থযাত্রীও আসেন ওই সময়। হিংলাজমায়ের পুজো দেবার আগে তাঁরা আসেন এই চন্দ্রবাবার
কুণ্ডে। প্রায় হাজার ফুট উঁচু মাড ভলকানোর উপর নারী–পুরুষ নির্বিশেষে পায়ে হেঁটে ওঠেন। এজন্য কখনও উপর থেকে মোটা দড়ি পাহাড়ের গা
বেয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়। তীর্থযাত্রীরা প্রয়োজনে সেই দড়ির সাহায্যও নিয়ে থাকেন। কুণ্ডে নারকেল, ফুল, মিষ্টি প্রভৃতি নিবেদন
করা হয়।)
চন্দ্রগুপের পরে দ্বিতীয় মাড ভলকানো ‘রানি’। দু’টি মাড ভলকানোই এখনও জীবন্ত। উদ্গিরণ করে
চলেছে শীতল কাদা। লক্ষ লক্ষ বছর
ধরে সেই কাদা জমে তৈরি হয়েছে জমাট কাদার পাহাড়। ‘চন্দ্রগুপ’ বেশি উঁচু। খাড়াইও
বেশি। তুলনায় ‘রানি’ অনেক ছোটো।
উৎসাহে কম বয়সীদের অনেকেই ছুটল চন্দ্রগুপের শীর্ষে চড়ার জন্য। কয়েকজন দুঃসাহসী
জিপে চড়ে রিভার্স গিয়ারে পাহাড়ের কতটা ওঠা সম্ভব সেই চেষ্টায় লেগে পড়ল। আমি অবশ্য
‘চন্দ্রগুপ’ নয়, উঠলাম তুলনায় ছোটো ‘রানি’র উপর।
জিপে রিভার্স গিয়ারে চন্দ্রগুপ–এর শীর্ষে ওঠার দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা |
টিলার শীর্ষে বড়ো এক কুণ্ড। তরল কাদা টগবগ করে ফুটছে। আসলে তরল কাদা ফুঁড়ে ভূ–জঠর থেকে অনবরত বুদবুদ আকারে বের হয়ে আসছে হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস। প্রবাদ,
এই কুণ্ডে কোনও পুণ্যবান নারকেল দান করলে সেটি ভেসে থাকবে। অন্যথায় যাবে ডুবে।
করাচীর বাজারে বারোটি নারকেল কিনেছিলাম। তাড়াহুড়োয় ভুল করে হোটেলে ফেলে এসেছি। তাই
আর পরীক্ষাটি সম্ভব হল না। সম্ভবত গুরুমারও ইচ্ছে নয়। হয়তো তেমন পুণ্যবান হতে পারিনি এখনও।
ইতিমধ্যে ঘড়ির কাঁটা প্রায় তিনটের ঘরে। ফিরতে হবে। সুতরাং আমাদের গাড়ির কনভয়
এবার করাচীর দিকে। পথেই এক ধাবায় চায়ের বিরতি। বিকেলের সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে
দিগন্তের কাছে লাল রং ছড়াতে শুরু করেছে। প্রায় স্বপ্নের মতো দু’টো দিন। শুধু তীর্থ
দর্শনই নয়, নতুন বন্ধুদের আন্তরিক সাহচর্য সহজে ভোলার নয়।
রানি মাড ভলকানো শীর্ষে বুদবুদ ওঠা তরল কাদার কুণ্ড |
বিদায় নিয়ে আগামীকাল সকালেই মুম্বাইয়ের ফ্লাইট। হিংলাজ দর্শন সেরে যেতে হবে
বিজাপুরে গুরুমাতার আশ্রমে। ফেলে যাওয়া দু’টি চমৎকার দিনের স্মৃতি হামিদকন্যা
সহযাত্রী মেহেরার তোলা ভিডিও ও স্টিল ছবিগুলি। এডিট করে না পাঠানো পর্যন্ত অপেক্ষা
করতেই হবে।*
_____
*ফটোঃ মূল ভ্রমণকাহিনি এবং অন্যান্য ওয়েবসাইটের সৌজন্যে
খুব সুন্দর! অনেক ধন্যবাদ শিশির বাবুকে এমন সুন্দর অনুবাদ করার জন্য।
ReplyDeleteখুব সুন্দর। অনেক অনেক ধন্যবাদ শিশির বাবুকে আমাদের মত মানস ভ্রমন কারীদের এত সুন্দর উপহার দেওয়ার জন্য
ReplyDelete