সমুদ্রগুপ্তের খাতা
রাজা সমুদ্রগুপ্ত
সহেলী চট্টোপাধ্যায়
ভালো আছ তো বন্ধুরা? আমি
সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত চলে এসেছি নিজের খাতা নিয়ে আরও একবার শুধুমাত্র তোমাদেরই জন্য।
এতদিন তোমাদের অন্যান্য রাজাদের গল্প শুনিয়েছি। আজ আমার
নিজের কথা বলতে খুব ইচ্ছা করছে। গুপ্তবংশের
একজন শ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলাম আমি মহারাজ সমুদ্রগুপ্ত।
গুপ্তবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন
শ্রীগুপ্ত (২৪০ - ২৮০ খ্রিস্টাব্দ)। গুপ্তবংশের প্রথম সার্বভৌম রাজা ছিলেন
প্রথম চন্দ্রগুপ্ত (৩২০ - ৩৪০ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ছিলেন ঘটোৎকচগুপ্তের পুত্র। প্রথম
চন্দ্রগুপ্ত মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করেন সর্বপ্রথম।
প্রথম চন্দ্রগুপ্ত অর্থাৎ, আমার পিতা আমাকেই সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। তিনি প্রকাশ্যভাবে
এই ঘোষণা করলে আত্মীয়-স্বজন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। আমার
আগের নাম ছিল কচ। আমার মা ছিলেন লিচ্ছবি রাজকন্যা কুমারদেবী। আমাকে লিচ্ছবি
দৌহিত্রও বলা হয়। রাজ্যজয়ের পর আমি সমুদ্রগুপ্ত নাম নিই। এলাহবাদ স্তম্ভলিপি থেকে
আমার সম্পর্কে বহু মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। লিখেছিলেন আমার সভাকবি হরিষেণ। আমার
দিগ্বিজয়ের পর সংস্কৃত ভাষায় তা রচিত হয়। প্রশস্তির পংক্তি-সংখ্যা
৩৩।
আমার শাসনকাল নিয়ে
পণ্ডিতদের মধ্যে অনেক বিতর্ক আছে। ৩২০ থেকে ৩৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত
আমি ক্ষমতায় ছিলাম। ৩৮০-তেই আমার মৃত্যু হয়। পরবর্তী সম্রাট হন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। যাকে তোমরা
বিক্রমাদিত্য নামেই চেন। তাঁর নামে
অনেক গল্প প্রচলিত আছে। সিংহাসনে
বসে আমি দিগ্বিজয়ের নীতি গ্রহণ করেছি। চেয়েছিলাম সমগ্র ভারতে নিজের আধিপত্য বিস্তার
করতে। আর্যাবর্তের নয়জন রাজাকে পরাজিত করি। এই নয়জন রাজা ছিলেন রুদ্রদেব, মতিল,
নাগদত্ত, চন্দ্রবর্মণ, গণপতিনাগ, অচ্যুত, নাগসেন, নন্দীন, বলবর্মণ। এই সমস্ত
রাজাদের পরাজিত করে কিছুদিন পুষ্পনগরে বিশ্রাম নিই। অচ্যুত ছিলেন অহিচ্ছত্রের
রাজা, নাগসেন ছিলেন গোয়ালিয়রের পদ্মাবতীর
নাগবংশের রাজা। গণপতি ছিলেন মথুরার রাজা। রুদ্রদেব ছিলেন বাকাটক বংশের রাজা।
চন্দ্রবর্মণ ছিলেন বাংলার সুশুনিয়া রাজ্যের অধিপতি।
গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলের
ওপর অধিকার সুদৃঢ় করার পর এবার আটবিক রাজ্যগুলো জয় করি। জব্বলপুর,
গাজীপুর অঞ্চলে এই রাজ্যগুলো অবস্থিত
ছিল।
এরপর দক্ষিণ ভারতের দিকে অগ্রসর হই। দক্ষিণ ভারতের বারোজন রাজাকে
পরাজিত করি। এরা হলেন কোশলের মহেন্দ্র, মহাকান্তারের ব্যাঘ্ররাজা, কৌরলের মন্তরাজ,
কোট্টরের স্বামীদত্ত, এরণ্ডের দমন, কাঞ্চীর বিষ্ণুগোপ, অভমুক্তার নীলরাজ,
কুস্থলাপুরের ধনঞ্জয়, পিষ্টপুরের মহেন্দ্রগিরি, বেঙ্গি-রাজ হস্তীবর্মণ, পলঙ্করাজ
উগ্রসেন প্রমুখ। বিজিত রাজ্যগুলো নিজ
রাজ্যভুক্ত না করে বিজিত রাজ্যের রাজাদের কাছ থেকে আনুগত্যের শপথ নিয়েই খুশি ছিলাম
আমি। কারণ, বুঝেছিলাম যে সুদূর পাটলিপুত্র থেকে দক্ষিণ ভারতের ওপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য
বজায় রাখা সম্ভব নয়।
পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের
সীমান্ত অঞ্চলের যথা, সমতাত, কামরূপ, নেপাল, মালব, অর্জুনয়ন, আভীর ইত্যাদি রাজ্যের
রাজারাও আনুগত্য স্বীকার করে নেয়।
দিগ্বিজয় সম্পন্ন হবার পর
অশ্বমেধ যজ্ঞ করি। যজ্ঞের স্মৃতি রক্ষার্থে
স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করি। নিজে ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বী ছিলাম, কিন্তু অন্য ধর্মের প্রতিও
শ্রদ্ধাশীল ছিলাম।
বৌদ্ধ গ্রন্থকার বসুবন্ধু
ছিলেন আমার মন্ত্রী। আমার খ্যাতি ভারতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। সিংহলরাজ মেঘবর্মণ
বুদ্ধগয়ায় একটি বৌদ্ধসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করার অনুমতি
চেয়ে আমার কাছে প্রচুর উপহার সমেত দূত
পাঠিয়েছিলেন। আমি অনুমতি দিই। প্রায় এক হাজার
মহাযান মতাবলম্বী এই সঙ্ঘে বাস করতেন।
মালয়, জাভা, সুমাত্রা প্রভৃতি
হিন্দু উপনিবেশগুলির ওপরও রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপন করেছিলাম আমি। মৌর্য
সাম্রাজ্যের পতনের পর আমি সমুদ্রগুপ্তই ভারতে এক
সার্বভৌম রাজশক্তি স্থাপন করেছিলাম। সমুদ্রগুপ্ত এই অভিধার অর্থ হল সমুদ্র দ্বারা
আমি সুরক্ষিত ছিলাম। আমার রাজ্য জয়ের
খ্যাতি চার সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ‘এলাহবাদ
প্রশস্তি’-তে আমাকে বলা হয়েছে
‘সর্বরাজোচ্ছেত্তা’ অর্থাৎ, সকল
রাজার উচ্ছেদকারী। ‘বিক্রমাঙ্ক’, ‘পরমাঙ্ক’ প্রভৃতি উপাধি ধারণ করেছি
আমি।
শুধু যোদ্ধা নই, কবি ও
সঙ্গীতজ্ঞও ছিলাম। আমার বীণাবাদনরত মূর্তি
আমার সঙ্গীত প্রীতির পরিচয় দেয়। ‘এলাহবাদ প্রশস্তি’-তে আমাকে ‘কবিরাজ’ বলা হয়েছে।
আমিই সর্বপ্রথম সম্পূর্ণ
ভারতীয় মুদ্রার প্রচলন করেছিলাম। আমার মুদ্রায় বিদেশি কোনও দেবদেবীর প্রতিচ্ছবি নেই। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গঙ্গা ইত্যাদি দেবীর মূর্তি ছিল। শাসক
হিসেবেও সফল হয়েছিলাম।
আমার কথা অনেকক্ষণ বললাম।
পরেরবার তোমাদের বিক্রমাদিত্য’র গল্প শোনাব। সমুদ্রগুপ্তের
খাতা তোমাদের কেমন লাগছে অবশ্যই জানিও। আজ এই পর্যন্তই। ভালো
থেকো সবাই।
_____
No comments:
Post a Comment