গোঁসাইজি
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
“ঝিকরহাটি এসে গেল গো! কী ঠিক
করলা তা’লে?”
নৌকার দুলুনিতে একটু
ঢুলুনিমতো এসে গিয়েছিল ঋষিবরের। কানের কাছে ডাকটা শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে
বসল। যোগেশবাবুর হাট থেকে নৌকো ছেড়েছে সেই বিকেল তিনটে হবে তখন। বেলাবেলি আমিনাবাদে
পৌঁছে যাবার কথা। কিন্তু ওই যে বলে না, কপালের লেখন! সে যাবে কোথা? ঘাট ছাড়তেই সেই
যে হাওয়া পড়ল, আর তার নড়নচড়ন নেই। ভাটার রায়মঙ্গলের বুকে কেবল হাতের জোরে উজানে
নৌকো ঠেলে তোলা যে কী বেজায় কাজ সে যে জানে সে জানে। অতএব
মাঝিকে দোষ দেয় না ঋষিবর।
জোলো হাওয়া ছাড়ছিল নদীর বুক
থেকে। টিয়া পাটাতনের ওপরে কুঁকড়ে-মুকড়ে শুয়ে আছে। ঠান্ডা লাগছে বোধহয়। ঋষিবর
কাঁধের চারহাতি গামছাটা তার গায়ে ঢেকে দিতে দিতে একটা হাই তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে
দেখল একবার। তারা দেখলে সময়ের একটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু ও হরি! সে গুড়েও
বালি। মেঘে থমথম করছে একেবারে।
“ন’টা বাজে প্রায়। আমিনাবাদে
পৌঁছুতে পৌঁছুতে দশটা বাজবে গিয়ে। বাসটাস পাবা না কিন্তু,” মাঝি যেন তার মনের
কথাটা পড়ে নিয়েই বলে উঠল হঠাৎ।
নদীর একেবারে ধার ঘেঁষে ঘেঁষে
নৌকো চলছিল। সুঁদুরি, গরান, হেঁতালের ঝোপগুলো জলের ওপরে হাত বাড়িয়ে বসে রয়েছে
একেবারে। সেইদিকে তাকিয়ে ঋষিবরের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল একবার। রাতের জঙ্গল সে
চেনে না তা নয়। এই ষোলো বছর বয়সেই কাকার সঙ্গে বেশ কয়েকবারই রাতেরবেলা আতাখালির
খাল বেয়ে মাছ মারতে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকেছে। কিন্তু বোনকে নিয়ে একা একা এই জঙ্গলে -
কেন যে মরতে বুক ফুলিয়ে বাবাকে বলতে গেছিল!
“দ্যাখো বিপদ! কী করি তাহলে
বল তো? আমিনাবাদে গিয়েই না হয় একেবারে...” তার গলাটা একটু কেঁপে গিয়েছিল মনে হয়।
সেটা খেয়াল করে মাঝি হাসল,
“শোন বলি বাপধন, ভয় করলেই ভয়। আমিনাবাদের
ঘাটে গিয়ে সারারাত বোনকে নিয়ে বসে থাকবা যে, তাতে বিপদ আরও বেশি। গত বেস্পতিবার ও
ঘাটে বাঘে হাটফেরতা মানুষ নিয়েছে। তাছাড়া সকালে বাস ধরে আসবে তো ফের ইদিকেই
গোরাগঞ্জের বাজারে। ঝিকরহাটি নেমে গেলে বরং, পা চালিয়ে গোরাগঞ্জ আধাঘন্টার রাস্তা। মামার
বাড়ি পৌঁছায়ে বেশ করে খেয়েদেয়ে ঘুমাবা’খন।”
ভয় কথাটা শুনেই ঋষিবরের বুকের
ভেতরটা চাগিয়ে উঠল একেবারে। লোকটা বলে কী, অ্যাঁ? পাটাতনের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে গলাটা
যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে সে বলল, “চলো তাহলে, এখানেই ভেড়াও। খেয়াঘাট কদ্দুর?”
কথা বলতে বলতেই মাঝি লগি মেরে
নৌকো এনে পাড়ে ভিড়িয়ে দিয়েছে। এইখানটায় খানিকটা জায়গা জঙ্গল সাফ করে কাঁচা ঘাট। একটা
মুখ বাড়িয়ে থাকা শেকড়ের গায়ে নৌকো বাঁধতে বাঁধতে সে বলল, “খেয়াঘাট আর এইখানে কোথা
পাবে? গ্রামের লোকে বাগদার চারা ধরতে নামবার জন্যে ওই একটু ঘাটলামতো করে রেখেছে।
ওই দিয়ে নেমে যাও সটান। তোমার বোনকে আমি - আরে আরে, অমন লাফ দেয় নাকি? সাক্ষাৎ
প্রেমকর্দম বাবা! সাবধান!”
আর সাবধান! ঋষিবর ততক্ষণে
সটান এক লম্ফ মেরে নৌকো থেকে তলার কাদার ওপর গিয়ে পড়ে হাঁটু অবধি ডুবে গেছে।
“হা হা। থাকো এখন ওইভাবে
দাঁড়িয়ে খানিক। আমি আগে তোমার বোনকে নামাই,” বলতে বলতে সন্তর্পণে কাদার ওপর পা
রেখে টিয়াকে কোলে করে নিচে নামিয়ে আনল মাঝি। তারপর হাতের লগিটা ঋষিবরের দিকে
বাড়িয়ে ধরে বলল, “নাও, ধরে সাবধানে উঠে এস দেখি - রামোঃ! কাদায় যে একেবারে
মাখামাখি হয়ে গেছ গো!”
সে কথা অবশ্য সত্যি। কুপির
আলোয় তার রূপ দেখে সদ্য ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা টিয়া হি হি করে হাসি জুড়েছে।
তার দিকে ফিরে মুখ ভেঙচে নিল
একবার ঋষিবর। ওইটুকু মেয়ে, এখনও ঋষিবরের কোলে কোলে ঘোরে, কিন্তু বদমাশের ধাড়ি
একটা।
“সাবধানে চলে যাবা। বাঁধের
ওপর ওপর সিধে পথ। কোনও ভয় নাই,” নৌকা ঠেলে জলের ভেতর এগিয়ে দিয়ে তার ওপরে বেয়ে
উঠতে উঠতে মাঝি বলে যাচ্ছিল, “মোটে ভয় পাবা না। এ আমাদের গোঁসাইজির এলাকা। তিনি
থাকতে কোনও ভয় নাই। তিনপো পথ পেরোলে তেনার আস্তানা পড়ত। এখন আর...”
মাঝির শেষ কথাগুলো হুড়হুড়িয়ে
বয়ে চলা জোলো হাওয়ায় ভেসে গেল। টিয়া ঋষিবরের জামার খুঁট ধরে টানছিল, “ও দাদা, ভয়
লাগে যে!”
“ভয় কী রে পাগলি?” ঋষিবর তাকে
সান্ত্বনা দিল, “শুনলি না গোঁসাইজি আছে! সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। আয়, কাঁধে উঠে বোস
দেখি! লম্বা লম্বা পায়ে এক্ষুনি দেখবি পৌঁছে যাব।”
ঋষিবরের পিঠ বেয়ে টিয়া তার
কাঁধে উঠে ঘোড়া হয়ে বসল। দাদা যা বীর! তার কাঁধে উঠে বসলে সে দুনিয়ায় আর কাউকে ভয়
করে না।
ভাটায় জল নেমে গেছে অনেকদূর।
বাঁধের ঠিক নিচে বাইনের ঘন জঙ্গলের ভেতর থেকে কাদার সোঁদা সোঁদা গন্ধ উঠছিল। আকাশে
মেঘ ফেটে একটু একটু চাঁদের আলো আসছে। সেই আলোতে পায়ের পাশে পাশে গেঁওয়ার ঝোপের সার
চলেছে যদ্দূর চোখ চলে। আধমাইলটাক পথ হাঁটবার পর কাঁধের ওপর থেকে টিয়াকে নিচে
নামিয়ে দিয়েছিল ঋষিবর। প্রথম প্রথম একটু ভয় পাচ্ছিল টিয়া, কিন্তু এখন আধো আঁধারে
চোখ সয়ে যেতে টরটরিয়ে দিব্যি হাঁটছে আগে আগে। পথের পাশে বাইনের বনে হাজার হাজার
জোনাকি ঝিলমিল করে জ্বলছিল। মাঝে মাঝে উড়ে এসে চোখের সামনে সবজেটে আলোর ঝিলিক দিয়ে
যাচ্ছে। সেই দেখতে দেখতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে টিয়া বলে, “ও দাদা, ঘুমুরের লতা রে!”
“ঘুমুরের লতা আবার দেখলি
কোথা?”
“ওই যে, দ্যাখ দ্যাখ, গর্জন
গাছটার গোড়ায়।”
ঋষিবর চোখ টানটান করে চাইল।
নাহ্, মেয়েটার চোখের জোর আছে বটে! ঠিক লক্ষ করেছে অন্ধকারে!
“টিয়া, এখন একদম বায়না করবি
না বলছি!” ঋষিবর আগেই সাবধান হয়ে গেল। যা বায়নাবাজ মেয়ে! ঋষিবর কাজেকম্মে জঙ্গলে
বেরোলেই ওই ঘুমুরের ফলের বায়না করবে। তারপর জোনাকি ধরে শুকনো ফলের খোলের ভেতর পুরে
ঝুমকো আলো বানিয়ে খেলবে।
“ও দাদা, দে না! একটা এনে
দে!”
“না। তোকে একলা এখানে দাঁড়
করিয়ে রেখে আমি কিছুতেই নিচে নামছি না। ওসব পরে হবে’খন।”
“দিবি না তো? আমি কিন্তু
তাহলে...’’ টিয়ার গলায় ফোঁপানোর আওয়াজ উঠছিল। এই একটা জায়গাতেই ঋষিবর একেবারে কাত।
মা মরা বোনটা কাঁদলে পরে তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে।
“আচ্ছা, ঠিক আছে ঠিক আছে।
দাঁড়া চুপটি করে। আমি...” বলতে বলতে বোনের হাতটা ছেড়ে ঋষিবর পথের পাশটা দিয়ে নামতে
যাবে, ঠিক তক্ষুনি সামনে বাইনের জঙ্গলে খড়মড় করে একটা শব্দ উঠল। বুনো একটা গন্ধ
ছড়াচ্ছিল চারদিকে। কিন্তু তার পরেই দুপদুপ করে পায়ের শব্দ উঠল পাশের জঙ্গলে আর
সেইসঙ্গে একটা গম্ভীর গলার শব্দ ভেসে এল, “খবরদার!”
ঋষিবর তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এসে
বোনের হাতটা ধরে ছুট লাগাবে কি না তাই ভাবছে, এমন সময় বাইনের জঙ্গল সরিয়ে একটা
লম্বা মানুষ বের হয়ে এল। খালি গা। একহারা চেহারা। চুলদাড়ির
জঙ্গলে ঢাকা মুখটার ভেতর থেকে চোখদু’টো জ্বলজ্বল করে তাদের দেখছে।
জঙ্গল ছাড়িয়ে বাঁধের ঠিক নিচে
এসে দাঁড়িয়ে লোকটা তীব্র চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। টিয়ার ফোঁপানি
তাতে আরও বেড়ে গেল। সেইদিকে ফিরে কী যেন একটু ভাবল লোকটা। তারপর ফের জঙ্গলের দিকে
নেমে গেল। ফিরে এল যখন, তখন তার একহাতে ঘুমুরের শুকনো ফলে ভরা একটা লতা আর
অন্যহাতে পাতার পুঁটুলিতে একরাশ জোনাকি। রাস্তার ওপর সেদু’টো নামিয়ে রেখে সে
ঋষিবরের দিকে তাকিয়ে বলল, “বন গরম আছে। বড়মেঞাঁ খাপ পেতেছিল। কাছেই আছে এদিক
সেদিক। বলি শোন, একটু এগিয়ে হাতের ডাইনে গোঁসাইয়ের ঘর পাবি। সেইখানে গিয়ে চুপ করে
বসে থাক। তিন প্রহরের শেয়াল ডাকলে পথে বের হবি। তার আগে নয়। আর
শোন, ঘরের কোনোকিছু নেয়া বারণ, এই বলে দিলাম।”
ঘুমুরের লতায় আটকানো ফলগুলো
থেকে সবজেটে আলো ছড়াচ্ছিল। একেকটা শুকনো ফলের মাথাটা ছাড়িয়ে, ভেতরের বীজগুলো ফেলে
দিয়ে টিয়া তার মধ্যে দু’টো করে জোনাকি ঢুকিয়ে দিয়েছে। পাতলা খোসার মধ্যে দিয়ে তাদের
আবছা সবজেটে আলো বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল ঘরের মধ্যে।
ঋষিবরের
অবশ্য সেদিকে নজর ছিল না। গোঁসাইজির ঘরটাকে ঠিক ঘর বললে ভুল হবে। বাঁধ থেকে অনেকটা
নিচে, ঝুপসি একটা গর্জনগাছের নিচে একটা অন্ধকার ঝোপের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
পাতলা বাঁশের বেড়া। চালের ওপর গোলপাতার ছাউনি। দেয়ালের ধারে একটা বেদি। তার ওপরে
একটা বল্লম পোঁতা রয়েছে। মাকড়শার জালে ভরা। কবেকার পুরনো কিছু শুকনো ফুলটুলও দেখা
যায় তার গোড়ায়। লোকজন বোধ হয় অবরে-সবরে এখানে পুজো দিতে আসে। পাল্লা ছাড়া দরজাটা
দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কান খাড়া করে বসেছিল ঋষিবর। জঙ্গলের শব্দ
শুনছে। জঙ্গল কথা বলে। তার ভাষা বুঝলে রাতবিরেতে সেখানকার অনেক খবর পাওয়া যায়।
ঋষিবর খানিক খানিক বুঝতেও শিখেছে আজকাল।
হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে কোথায় একটা
শেয়াল ফিঁয়াও ফিঁয়াও করে ভয় পাওয়া ডাক ডেকে উঠল। টিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে কখন যেন। তাকে
কাছে টেনে নিয়ে কান খাড়া করে রইল সে। ডাকটা আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে। বড়মেঞাঁ
তাহলে এলাকা ছেড়ে অন্যদিকে পা দিয়েছে বোধহয়। মনের ভেতর জমে ওঠা ভয়টা একটু হালকা হল
ঋষিবরের। রাত তিন প্রহর কখন হবে কে জানে! ঘুম আসছিল তার।
টিয়ার পাশে শুয়ে পড়তে গিয়েও
কী যেন ভেবে ফের উঠল সে। খালি হাতে শোয়া ঠিক হবে না এখানে।
ঘুমুরের হালকা আলোয় ঘরের এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হঠাৎ তার চোখটা গিয়ে পড়ল বেদির
ওপর পোঁতা বল্লমটার দিকে। আলগা করে বসানো ছিল বেদির মাটিতে। হালকা টান দিতেই উঠে
হাতে চলে এল সেটা।
মুঠো করে ধরা ডান্ডাটা থেকে
একটা আশ্চর্য উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছিল তার সারা শরীরে। অন্ধকারের মধ্যেও নাড়াচাড়া করলেই
ঝিকিয়ে উঠছে বল্লমের ফলাটা। বুকের মধ্যে একটা দারুণ সাহস তৈরি হচ্ছিল ঋষিবরের। এমন
একটা অস্ত্র হাতে পেলে বাঘ তো বাঘ, স্বয়ং দুশমনকেও সে পরোয়া করে না। আর ঠিক তখনই
জঙ্গল কাঁপিয়ে জেগে উঠল তিন প্রহরের শেয়াল ডাক। বাইরে মেঘ ফেটে চাঁদের আলো জেগেছে।
বল্লমটা বাগিয়ে ধরে টিয়ার পা ধরে ঝাঁকুনি দিল ঋষিবর। টিয়ার ঘুম বড়ো পাতলা। এক
ঝাঁকুনিতেই উঠে বসেছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে, “সকাল হয়ে গেল নাকি?”
“ধুস্! সকাল কোথা? চাঁদ
উঠেছে। তিন প্রহরের শেয়াল ডেকেছে। চল বেরিয়ে পড়ি।”
“ও দাদা, সকাল হলে পরে বেরোলে
হয় না?”
ঋষিবর হাসল, “বোকা মেয়ে। কান
পেতে শোন, জঙ্গল ঠান্ডা হয়ে গেছে। লোকটাও বলেছিল না, তিন প্রহরের শেয়াল ডাকবার পর
আর ভয় নেই? তাছাড়া এই অস্ত্রটা তো সঙ্গে রইলই!”
বল্লমটার দিকে একঝলক তাকিয়েই
হঠাৎ ভিতু গলায় টিয়া বলল, “কিন্তু লোকটা যে বলল ঘরের কোনোকিছু নেয়া...”
“বাদ দে তো ওসব কথা! এমন একটা
অস্ত্র নিয়ে বেরোলে জঙ্গলে ভয় থাকবে না দেখিস। তাছাড়া, চুরি তো আর করছি না, দায়ে
পড়ে সঙ্গে নিচ্ছি কেবল। পরে কখনও এসে ফেরত দিয়ে ন’সিকের পুজো চড়িয়ে গেলেই হল। নে
চল। তোর ঘুমুরের লতা নিয়ে নে।”
আকাশের মেঘ কেটে গেছে
একেবারে। ক্ষয়াটে চাঁদটা পশ্চিমের দিকে একটু হেলে ঝুলে আছে একটা রাক্ষসের মুখের
মতন। জঙ্গল ক্রমশ ঘন হয়ে উঠে ঝুঁকে আসছিল চারপাশে। সেখানে ইতিউতি নীল সবুজ চোখ
জ্বলে। দূর থেকে তারা তাকিয়ে দেখে শুধু। বল্লম হাতে ঋষিবরের কাছে এগোয় না।
রাস্তাটা উঠে নেমে এঁকেবেঁকে
কোনদিকে যে এগোচ্ছে ঋষিবর কিছুই বুঝতে পারছিল না। খানিক এগোবার পরেই তার দিকটিক সব
গুলিয়ে একশা। মনে হচ্ছিল রাস্তাটা যেন প্রাণ পেয়ে জেগে উঠে তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে
নিজের ইচ্ছেমতো কোনও একটা দিকে।
“ও দাদা, কোলে নিবি? পায়ে
ব্যথা করছে যে!” হঠাৎ টিয়ার গলা পেয়ে চমক ভাঙল ঋষিবরের। রাত তিন প্রহরের পর থেকে
হাঁটছে। এতক্ষণে তো সকাল হয়ে যাবার কথা! চাঁদ ডুবে যাবার কথা। কিন্তু কই? চাঁদটা
তো সেই একই জায়গায়, একই ভাবে...
“ও দাদা...”
পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে
টিয়া তাকে ডাকছিল। ছোটো ছোটো দু’টো পায়ে আর সে চলতে পারছে না।
“আয়, কাঁধে ওঠ দেখি!” বলতে
বলতে নিচু হয়ে পথের ওপর বসে পড়ল ঋষিবর। শরীরে তারও
ক্লান্তি আসছে ঝেঁপে। আর, বসে পড়েই হঠাৎ চমকে উঠল সে। তার সামনে, পথের ওপর পড়ে আছে
সেই সবজেটে আলো জ্বলা ঘুমুরের লতাটা!
টিয়াও এইবারে সেটা দেখতে
পেয়েছে। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে খুশি খুশি গলায় বলে, “এই তো পেয়েছি। ঘরটা থেকে বেরিয়ে
একটু দূরে গিয়েই হাত থেকে খসে পড়েছিল কখন যেন। টের পাইনি।”
টিয়ার কোনও কথা আর কানে
যাচ্ছিল না ঋষিবরের। উঠে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক ঘুরে তীক্ষ্ণ চোখে দেখছিল সে। বেশি
কসরৎ করতে হল না অবশ্য। একটু পরেই তার চোখে পড়ল, পেছনে অনেকটা দূরে হাতের বাঁয়ে গোঁসাইজির
সেই ঘরটার হাঁ করে খুলে থাকা অন্ধকার দরজাটা দেখা যাচ্ছে। শেষরাত্রের হাওয়া লেগে
তার গোলপাতার চালে শনশন শব্দ উঠছিল। জঙ্গল এইখানে একেবারে ঝুঁকে এসে পড়েছে মাথার
ওপর। খানিক আগে ছেড়ে যাওয়া রাস্তাটাই কেমন যেন বদলে গিয়েছে একেবারে।
হঠাৎ সামনের বাইনের জঙ্গল
থেকে চিতল হরিণের তীক্ষ্ণ কুউ কুউ শব্দের সাবধানবাণী ভেসে এল। সাক্ষাত মৃত্যুকে
সামনে দেখলে ওরা এইভাবে ডেকে অন্যদের সাবধান করে দেয়। বোঁটকা গন্ধের ঝলকটা ঠিক
তক্ষুনি তাদের দু’জনের নাকে এসে লাগল। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতের বল্লমটা শক্ত
করে চেপে ধরল ঋষিবর। টিয়া চিৎকার করে উঠছিল। তাকে কাছে টেনে এনে একহাতে তার মুখটা
চেপে ধরে রেখে গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে ঋষিবর বুঝতে চাইছিল কোনদিক থেকে আসছে গন্ধটা।
তবে সেজন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা
করতে হল না তাকে। হঠাৎ একটা আকাশ কাঁপানো গর্জন ছেড়ে পাশের বাইন ঝোপের ভেতর থেকে
তার সামনে হাত দশেক দূরে লাফিয়ে এসে দাঁড়াল বাঘটা। সন্ধের পর থেকে বহুক্ষণ ধরে সে
এই মানুষদু’টোকে অনুসরণ করে এসেছে। এইবারে সুযোগ এসেছে তার।
একহাতে টিয়ার মুখটা ধরে রেখেই
তাকে আড়াল করে দু’পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে ডানহাতে বল্লমটা মাথার ওপর উঁচিয়ে ধরল
ঋষিবর। তার গায়ের পেশিগুলো শক্ত হয়ে উঠেছে। আর তারপর, তাকে খানিকটা অবাক করে দিয়ে
তার নিজের গলা থেকেই একটা গর্জন জেগে উঠল, “আয় দেখি, কত সাহস! গোঁসাইয়ের বল্লমের
কামড় খাবার শখ জেগেছে তোমার! আয় দেখি।”
নিচু হয়ে বসে পড়েছে বাঘটা।
ক্রুর ঠান্ডা দু’টো চোখ তার দিকে স্থির। লালা ঝরছে মুখ দিয়ে। আস্তে আস্তে লেজটা
নাড়াচ্ছে এপাশ ওপাশ। ঋষিবরের মনটা আশ্চর্যরকম ঠান্ডা হয়ে গেল। এবারে এ লাফাবে। ন’দশ
মণ ওজনের জন্তুটা যখন ঘাড়ে এসে পড়বে তখন বল্লম গেঁথে দিতে পারলেও তার থাবার হাত
থেকে প্রাণে বাঁচবে না সে। কিন্তু টিয়াকে বাঁচাতে হবে যে করে হোক। নিজের প্রাণ যায়
যাক, বাঘকেও সে প্রাণ নিয়ে ফিরতে দেবে না আজ।
গরগর করে আওয়াজ করছিল বড়মেঞাঁ।
হঠাৎ সে আওয়াজটা বদলে গেল তার। আকাশফাটা একটা গর্জন করে উঠল সে মুখটা ওপরের দিকে
তুলে। আর সঙ্গে সঙ্গে পাশের জঙ্গল থেকে একটা লম্বা
অন্ধকার মূর্তি এক লাফে বের হয়ে এসে ঋষিবরের হাত থেকে বল্লমটা ছিনিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে
পড়ল তাদের মাঝখানে। লোকটার গম্ভীর গলার হাঁকে থরথর করে কেঁপে উঠছিল যেন শেষরাত্রের
বন। চাঁদের আলো মেখে চুলদাড়িগুলো উড়ছিল তার মাথা ঘিরে। ধ্বকধ্বক করে জ্বলছে যেন
তার চোখদু’টো।
বাঘ এই নতুন উৎপাতটাতে কেমন
যেন হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল। লাফটা না মেরে ফের ঝুঁকে বসে পড়েছে। তার সামনে উবু হয়ে
বসে পড়েছে সন্ধেবেলায় জঙ্গলে দেখা সেই লোকটাও। বাঘটার চোখে চোখ রেখে বল্লম বাগিয়ে
তার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছিল সে। মুখে তার যেন কথার তুবড়ি ফুটছে, “তফাৎ যা
সুদর্শন, এরা আমার আশ্রয়ে আছে। প্রাণে
বাঁচতে চাইলে চলে যা।”
ঋষিবর তখন উৎসাহ পেয়ে গেছে।
লোকটার সঙ্গে গলা মিলিয়ে বকাঝকার তুবড়ি ফুটছে তার মুখেও।
এইবারে দেখা গেল, বড়মেঞাঁ
একটু ইতস্তত করতে লেগেছে। মাথা ঘোরায় ইতিউতি। ফ্যাঁচফ্যাঁচ শব্দ করে মুখে। এপক্ষের
চিৎকার তাই দেখে আরও ক’গুণ বেড়ে উঠল। ঠিক তক্ষুনি হঠাৎ ঋষিবরের হাত একটু আলগা
হয়েছে আর সঙ্গে সঙ্গে মুখের বাঁধন সরিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় প্রাণপণে ডুকরে উঠেছে টিয়া।
তার তীক্ষ্ণ আওয়াজে হঠাৎ করে
যেন চমকে জেগে উঠল জঙ্গলের রাজা। একটা হাঁক ছেড়ে ছোট্ট একটা লাফ দিল সে। লোকটাও গা
ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে এবারে। পেছনে হাত বাড়িয়ে ঋষিবরদের একধাক্কায় বেশ খানিকটা
দূরে ছিটকে ফেলে দিল সে। তারপর বল্লমটাকে উলটে নিয়ে তার লোহাপাকানো মুঠটা এগিয়ে
ধরল সামনে। বাঘটা ততক্ষণে একেবারে তার গায়ের ওপর এসে পড়েছে। পায়ের একটা ছোট্ট
দোলানিতে সরে গেল সে একটুখানি। আর যেতে
যেতেই লোহার মুঠটা দিয়ে বাঘের নাকে সজোরে ঘা মারল একটা। সবচেয়ে নরম জায়গাটাতে ঘা
খেয়ে যন্ত্রণার একটা আওয়াজ ছাড়ল জন্তুটা। একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তার পাশ দিয়ে
লাফিয়ে ঋষিবরদের দিকে এগোতে যাবে, অমনি ফের তার পথ আগলে দাঁড়াল লোকটা। আবার সেই
একই জায়গাতে নিখুঁত লক্ষ্যে আছড়ে পড়ল দ্বিতীয় ঘা।
হালকা ছোটো ছোটো লাফে লোকটা
বাঘটাকে ঘিরে ঘুরছিল। আর বারংবার সজোরে আঘাত করে যাচ্ছিল তার নাকে, মুখে। একটা
ঘা-ও লক্ষ্যচ্যুত হচ্ছিল না। হাজার চেষ্টাতেও বাঘটা তাকে ছুঁতে পারছিল না। তার
বাধা পেরিয়ে এগিয়েও যেতে পারছিল না মাটিতে পড়ে থাকা দুই সহজ শিকারের দিকে।
অবশেষে রণে ভঙ্গ দিল বনের
রাজা। একটু পিছিয়ে গিয়ে ঘুরে তাকাল উলটো করে বল্লম ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার
দিকে। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে নেমে গেল বাঁধের পাশে দাঁড়ানো বাইনের গভীর জঙ্গলে।
মাটিতে পড়ে থাকা ঋষিবর তখন
উঠে বসেছে। বাঘের চাইতেও এই মানুষটাকে তার কেন যেন অনেক বেশি ভয় লাগছিল। টিয়াকে দু’হাতে
প্রাণপণে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে জুলজুল করে সে চায় মানুষটার দিকে।
লোকটা এবার ঘুরে দেখল তাদের
দিকে। পেছন থেকে ঝরে পড়া অস্তগামী চাঁদের আলোয় তার উড়ন্ত চুলদাড়ির চারপাশে একটা
সোনালী আভা তৈরি করে দিয়েছে। মুখটা অন্ধকারে চোখে পড়ে না। শুধু চোখে পড়ে জ্বলজ্বলে
চোখদু’টো। সেখানে তখন একটু আগের রাগরাগ ভাবটা আর একেবারেই নেই। হাসিহাসি চোখে
তাদের দিকে দেখছিল মানুষটা। তারপর ভারী মোলায়েম গলায় বলল, “ঘরের কোনোকিছুতে হাত দিতে
মানা করেছিলাম না? কথা শুনিসনি তো? তাই তো ফের ফিরে আসতে হল। সুদর্শন আজ তিনশো বছর
ধরে আমার এই ঘর পাহারা দিচ্ছে। আজ আমি না এলে তোদের আর প্রাণ নিয়ে ফিরতে হত না
এখান থেকে। এখন এখানে বসে রাতটা পার করে ঘরের ছেলে ঘরে যা। আর ভয় নেই।”
বল্লমটা হাতে ধরে আস্তে আস্তে
হেঁটে অন্ধকার মানুষটা তার অন্ধকার ঘরের দিকে চলে গেল। ঋষিবরের চোখ ভেঙে তখন ঘুম
নেমে আসছিল।
“আরে, এই দ্যাখো কান্ড!
রাস্তার মধ্যে দু’টো ছোঁড়াছুঁড়ি পড়ে পড়ে ঘুমায়! এই ওঠ ওঠ!”
কে যেন ধাক্কা দিচ্ছিল তার
গায়ে। ঋষিবর আড়মোড়া ভেঙে চেয়ে দেখল। সূর্য অনেকটা ওপরে উঠে গেছে। শুনশান রাস্তায়
একলা একটা মানুষ একটা সাইকেল ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে তাদের ডাকছিল।
উঠে বসতে বসতে চারদিকে তাকিয়ে
ঋষিবর জিজ্ঞেস করল, “লোকটা কোথায় গেল?”
“লোক আবার কোথা? এ পথে মানুষজন
মোটে চলে না। আমি শটকাটে যাব বলে এদিকে এসেছি, তাই দেখতে পেলাম। রাত্তিরটা কি
এইখানেই শুয়েছিলিস নাকি? ধন্যি সাহস বাপু!”
ঋষিবর আনমনে মাথা নেড়ে উত্তর
দিল, “গোঁসাইজির ঘরে ছিলাম কাল রাত্রে। তারপর তিন প্রহর পার হতে...”
গোঁসাইজি নামটা শুনে লোকটা কেমন
যেন চমকে উঠে কপালে হাত ঠেকাল একবার। তারপর তার কথাটা শেষ করতে না দিয়েই জিজ্ঞেস
করল, “গোঁসাইজির ঘর? কোথা? তুই দেখেছিস?”
“হ্যাঁ গো। ওই
তো ওখানে...” বলে খানিক দূরের সেই ঘরটার দিকে আঙুল তুলে দেখাতে গিয়ে একটু থতমত
খেয়ে গেল ঋষিবর।
কাল যেখানে ঘরটা ছিল সেখানে এখন
সূর্যের আলো মাখা রায়মঙ্গলের গভীর জল থইথই করছে।
_____
ছবিঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
উফফ!
ReplyDelete:D
ReplyDeleteWow!
ReplyDeleteDarun
ReplyDeleteKhub bhalo laglo...
ReplyDeleteকেয়া বাত্
ReplyDeleteদারুন !!!
ReplyDeleteদুর্দান্ত !!
ReplyDeleteবাঘ আর ভুত। বেশ পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
ReplyDeleteDarun..Darun...
ReplyDelete