বায়োস্কোপ:: সিনেমা: CJ7 - রিভিউ: সোনাল দাস


সিনেমাঃ CJ7 (2008)
Director: Stephen Chow
Stars: Stephen Chow, Yuqi Zhang, Jiao Xu
আলোচনাঃ সোনাল দাস

হলিউডের কল্পবিজ্ঞানের ছবিতে যে সকল ভিন-গ্রহের জীবেরা পৃথিবীর বুকে এসেছে তারা অধিকাংশই পৃথিবীর নানারকম ক্ষতিসাধন করেছে। হয় তারা গুঁড়িয়ে দিয়েছে প্রথম বিশ্বের নানান কীর্তিমান স্তম্ভ, সৌধ, মূর্তি। নয় তছনছ করেছে শহরের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্রিজ এবং যানবাহন। এককথায় এদেরকে মোটেই ভালো এলিয়েন্ বলা চলে না। তবে ব্যতিক্রম আছে বৈকি! 1982 সালে বিখ্যাত পরিচালক Steven Spielberg আমাদের উপহার দিয়েছিলেন E.T. নামক এক বন্ধুসুলভ গ্রহান্তরের প্রাণীকে। তারপর কেটে গেছে বেশ অনেকগুলো বছর। কিন্তু E.T-র মতন এমন বন্ধুসুলভ ভিন-গ্রহের প্রাণীর সন্ধান খুব একটা পায়নি সিনেমাবিশ্ব। 2008 সালে হংকং-এর পরিচালক Stephen Chow-এর হাত ধরে তারা ফের পেল CJ7 নামের এক বন্ধুসুলভ গ্রহান্তরের জীবকে। আজ এই CJ7-এর গল্পই তোমাদের বলব ম্যাজিক ল্যাম্পের পাতায়।

এই ছবির মূল কেন্দ্রীয় চরিত্র চাও তি (Stephen Chow) এবং তার নয় বছরের ছেলে ডিকি (Xu Jiao)চাও তি এক দরিদ্র নির্মাণ শ্রমিক (construction worker) এবং তার স্বপ্ন তার ছেলে যেন স্কুলে ভালোভাবে পড়তে পারে। তাই সে যা উপার্জন করে তার বেশির ভাগটাই সে সঞ্চয় করে রাখে ছেলের পড়াশুনার জন্য। কিন্তু স্কুলে ডিকিকে তার স্কুলের বন্ধুরা মোটেই ভালো চোখে দেখে না, সুযোগ পেলেই  তারা তাকে নানারকম ভাবে অপদস্থ করে থাকে। একমাত্র তার ক্লাসের এক ম্যাডাম খুব স্নেহ করে, এই যা। এরকম ভাবেই চলছিল ডিকি আর তার বাবার জীবন।


একদিন স্কুলে তার এক বন্ধু CJ One নামের একটি খেলনা রোবট নিয়ে আসে। সবাই সেই খেলনাটার খুব তারিফ করে এবং সেটি ডিকিরও খুব মনে ধরে। একদিন সে তার বাবার সাথে একটি ডিপার্মেন্টাল স্টোরে যায় এবং সেখানে সে দেখতে পায় CJ One নামের ওই খেলনা রোবটটিকে। সঙ্গে সঙ্গে সে বায়না জুড়ে দেয় তাকে ওই খেলনাটা কিনে দিতেই হবে, কিন্তু এত দামি খেলনা কেনা চাও তির পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। অনেক বুঝিয়েও যখন ডিকি নাছোড় বায়না করে যাচ্ছিল তখন অবস্থা আয়ত্তে আনতে তার বাবা সকলের সামনে তাকে মারতে বাধ্য হয়। কিন্তু মনে মনে সে খুব কষ্ট পায় ছেলের সাথে এমন আচরণ করার জন্য।
সেদিন রাতে কাজ সেরে ফেরার পথে চাও তি ঢুঁ মারে বাড়ির কাছের একটা আস্তাকুঁড়ে। এখানে সে মাঝে মাঝেই আসে এবং সংগ্রহ করে তার প্রয়োজনীয় নানারকম জিনিসপত্র; যা অনেকেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে। যেমন এর আগে সে নিজের জন্য জোগাড় করেছে নানান টুকিটাকি সামগ্রী, ঘরোয়া যন্ত্রপাতি এবং ডিকির জন্য বাতিল হয়ে যাওয়া জামাকাপড়। অর্থাভাবের জন্যই সে এইসকল জিনিসপত্র জোগাড় করে, আর তাকে সারিয়ে বা ঠিক করে কাজের উপযোগী করে নেয়।
আজকেও সে মগ্ন হয়ে খুঁজছিল সেরকমই কোনো বাতিল জিনিস ওই আস্তাকুঁড়ে, আর সেই সময় তার চোখ চলে গেল একটা সবুজ রঙের গোলাকার বলের দিকে। বলটা অনেকটা জলভরা ডাবের মতন দেখতে কিন্তু সম্পূর্ণ গোলাকার ও খুব মসৃণ। আর বলটার মাথার দিকে অনেকটা চাবির মতন দেখতে একটা অংশ আছে। চাও তি সেটিকে বাড়ি নিয়ে আসে আর তার ছেলের হাতে তুলে দেয়। ডিকি এই সবুজ বলটা দেখে খুব একটা খুশি না হলেও সেটিকে গ্রহণ করে। আর সেদিন সন্ধেতে তাদের বাড়িতে ঘটে এক অদ্ভুত ঘটনা। সবুজ বলটা হঠাৎ করে রূপ পরিবর্তন করতে করতে একটা অদ্ভুত ছোট্ট জীবের আকার ধারণ করে। ডিকির জীবটিকে খুব পছন্দ হয়ে যায় আর খুশি হয়ে তার নাম রাখে CJ7


এরপর ডিকি বেশ কিছুক্ষন CJ7-এর সাথে খেলা করে ঘুমোতে যায় আর একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। সে দেখে এই এলিয়েন জীবটি তাকে স্কুলে খুব পপুলার করে তুলছে আর পরীক্ষাতে দারুন মার্কস আনতে ভীষণ ভাবে সাহায্য করছে। ছবির এই স্বপ্নের অংশটা ভীষণ মজাদার এবং স্বপ্নের কিছু কিছু দৃশ্য "ম্যাট্রিক্স" এবং "মিশন ইম্পসিবল ২" নামের জনপ্রিয় দুটি ছবির অ্যাকশন দৃশ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নেওয়া হয়েছে। ছবির এই অংশে স্পেশাল এফেক্টসকে এতো সুন্দরভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে দেখতে ভীষণ ভালো লাগবে।


কিন্তু বাস্তব আর কবে স্বপ্নের মতন হয়েছে। ডিকির এই ধারণা খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে যায় যখন সে দেখে এই এলিয়েন জীবটি মোটেই সেরকম কোনও স্পেশাল ক্ষমতা-সম্পন্ন নয়। ফলে তার সব রাগ গিয়ে পরে CJ7 এর ওপর। CJ7 তো সেইসময় ভয়ে পালাতে পারলে বাঁচে ডিকির হাত থেকে। চাও তি এসে পড়ায় সেই যাত্রায় কোনোরকমে সে রক্ষা পায়। কিন্তু ডিকির এই নতুন খেলনাটির দিকে নজর পড়ে যায় তার স্কুলের কিছু দুষ্টু বন্ধুদের। তারা যেভাবেই হোক কব্জা করতে চায় CJ7 কে ডিকির স্কুল ব্যাগ থেকে। সেই চেষ্টায় তারা দ্রুত সফলতা লাভ করলেও ম্যাগি নামের এক বিশালাকৃতির স্কুল সহপাঠীর সহায়তায় ডিকি ফিরে পায় তার প্রিয় CJ7 কে।


এদিকে স্কুলের পরীক্ষাতে ভালো নম্বর না পাওয়া সত্ত্বেও ডিকি তার বাবাকে বলে পরীক্ষাতে সে ১০০ তে ১০০ পেয়েছে। চাও তি আনন্দে সেই খবর তার কর্মক্ষেত্রের সকল শ্রমিকদের জানাতে থাকে। কিন্তু তার বস কিছুতেই মানতে চায় না যে ডিকি পরীক্ষাতে ফুল মার্কস পেয়েছে, এই নিয়ে বসের সাথে চাও তির বিবাদ বাধে এবং রেগেমেগে সে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে বাড়ি ফিরে আসে। আর ডিকির কাছ থেকে জানতে চায় সে সত্যিই পরীক্ষাতে ১০০ তে ১০০ পেয়েছে কিনা? ডিকি তখন তাকে সত্যি কথাটা বললে চাও তি ভীষণ রেগে যায় এবং CJ7 কে তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়। আর বলে সে আর কোনোদিন CJ7-এর সাথে খেলতে পারবে না যদি না সে নিজের চেষ্টায় পরীক্ষাতে ৬০-এর ওপর স্কোর করতে পারে।
পরের দিন চাও তি ডিকির টিফিন বাক্সটা দিতে এসে উপস্থিত হয় তার স্কুলে এবং সেটি তুলে দেয় মিসেস ইয়েন নামের এক স্কুল টিচারের হাতে। তারপর তার নিজের কর্মক্ষেত্রে ফিরে পুনরায় যোগ দিতে চায় কাজে, আর ক্ষমা প্রার্থনা করে তার বসের কাছে। তার বসও সব কিছু ভুলে চাও তি কে কাজে বহাল করে নেয়। সেদিন স্কুলের পরীক্ষাতে ডিকি ৬৫ স্কোর করে আর সেই আনন্দ সংবাদটি মিসেস ইয়েন যখন চাও তিকে ফোন করে জানাতে যান তখনই জানতে পারেন দুঃসংবাদটি। চাও তি কর্মক্ষেত্রে এক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।
চাও তির নিথর দেহটিকে যখন ধরাধরি করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয় তখন তার ব্যাগের পিছন থেকে উঁকি মারে CJ7এইসময় ডিকি ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়ে, আর অনুশোচনা করতে থাকে বাবাকে মিথ্যা কথা বলার জন্য। CJ7কে সে বার বার বলতে থাকে সে আর কখনও এমন কাজ করবে না যদি CJ7 কোনোভাবে তার বাবাকে বাঁচিয়ে দেয়। এরপর ঘটে সেই চমকপ্রদ ঘটনাটি, CJ7 নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি ট্রান্সফার করে দেয় চাও তির শরীরে। সমস্ত শক্তি ক্ষয় করে CJ7 ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে আর অন্যদিকে প্রাণ ফিরে পায় ডিকির বাবা।
ডিকি তার বাবাকে ফিরে পেলেও CJ7-কে হারানোর দুঃখ ভুলতে পারে না। তাই সে CJ7-এর দেহটিকে কাপড়ে মুড়ে নিজের গলার পেনডেনট করে নেয়। আর স্বপ্ন দেখে CJ7 চিরনিদ্রা কাটিয়ে আবার ফিরে আসছে তার কাছে।


এতটা পড়ে নিশ্চয়ই খুব মন খারাপ হয়ে গেল তোমাদের CJ7-এর কথা ভেবে। হ্যাঁ, এই জায়গাটা দেখতে গিয়ে চোখে জল চলে আসে বৈ কি, কিন্তু ছবির শেষটা মোটেই দুঃখজনক নয়। গল্পের শেষে দেখা যায় একটা স্পেস-শিপ থেকে নেমে হাজার হাজার বিভিন্ন রঙের CJ7-এর মতন ছোট ছোট প্রাণী হাসি মুখে ছুটে আসছে ডিকির দিকে।
সেটা কীভাবে সম্ভব হল তা জানার জন্য অবশ্যই দেখে নিও Stephen Chow পরিচালিত এই মজাদার কল্পবিজ্ঞানের ছবিটি। youtube-এ গিয়ে অনলাইনেও দেখতে পারো এই ছবিটি। টাইপ কোরো "CJ7 Movie". আর দেখে তোমাদের কেমন লাগল তা জানিও আমাদের ম্যাজিক ল্যাম্পের পাতায়। পুজোতে সবাই খুব ভালো থেকো আর চুটিয়ে আনন্দ কোরো।

এই ছবির কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা  -

১)  Shaolin Soccer (2001) এবং Kung Fu Hustle (2004) নামক জনপ্রিয় ছবির পরিচালক Stephen Chow ছিলেন বিখ্যাত পরিচালক Steven Spielberg-এর অন্ধ ভক্ত। ওনার বিখ্যাত ছবি E.T. the Extra-Terrestrial (1982) থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে Stephen Chow বানিয়েছেন এই CJ7 (2008) নামক ছবিটি। এই ছবিটিকে Steven Spielberg এর প্রতি Stephen Chow-এর শ্রদ্ধার্ঘও বলা যেতে পারে। কোরিয়ানরা গর্ব করে এই ছবিটিকে বলে থাকেন "কোরিয়ানদের E.T."

২) চাও তির নয় বছরের ছেলে ডিকি (Xu Jiao) চরিত্রে যে অভিনয় করেছে সে ছেলে নয়, আসলে একটি মেয়ে!

৩) এই ছবিতে পরিচালক Stephen Chow তার Shaolin Soccer (2001) মুভির কিছু জনপ্রিয় দৃশ্যের মজাদার অনুকরণ করেছেন যা ছবিতে দেখে বেশ মজা লাগবে।

৪) এই ছবিটি BAFTA Awards ২০০৬তে সেরা ছবির তালিকাতে মনোনীত হয়েছিল। Best Foreign Language ছবি হিসাবে জিতে নিয়েছে Blue Ribbon Awards; Chunyan Awards; Neuchâtel International Fantastic Film Festival সহ নানা পুরস্কার।
______

7 comments:

  1. khub manograhi ebong tothya bahul lekha..... khub valo laglo...
    chotobelar anondomela te jesomosto review gulo thakto tar sathe khub mil pelam ebong anondo pelam....thanks

    ReplyDelete
    Replies
    1. Onek dhonyobad aapnar mulyoban motamot jananor jonyo :)

      Delete
    2. Onek dhonyobad aapnar mulyoban motamot jananor jonyo :)

      Delete
  2. Bhishon sundor lekha...jemon mishti golpo, thik temon kore sajye galpo ta tule dhora hoyeche.Sotyie darun laglo!

    ReplyDelete
    Replies
    1. খুব ভাল লাগল জেনে,অনেক ধন্যবাদ :)

      Delete