পাতা ঝরার আগে
কেয়া মুখোপাধ্যায়
কেয়া মুখোপাধ্যায়
নিউ ইয়র্কের জে.এফ.কে-তে নামবে প্লেনটা। জিকোর উইন্ডো সিট।
জানলার কাচে নাক ঠেকিয়ে ঠায় বসেছিল জিকো। বাবার প্রোজেক্ট এক্সটেন্ডেড হয়েছে বলে
পুজোর আগে ফেরা হবে না বাবার। তাই পুজোর দিনগুলো বাবার সঙ্গে কাটাবে বলে মার সঙ্গে
জিকো যাচ্ছে নিউ ইয়র্কে।
জিকোর ঘাড়ের ওপর দিয়ে মা-ও বেশ কয়েকবার উঁকি দিয়েছে জানলা দিয়ে।
কী একটা গানও গুনগুন করছিল: “কে যেন আবির ছড়িয়ে দিল…।” সত্যি যেন আবির ছড়ানো! আকাশ থেকেই চোখে পড়ছে নিচে গাছগুলোতে
হোলি খেলা হয়েছে! কিছু পাতায় যেন একেবারে সোনার রঙ। লাল-কমলা-হলুদ-পার্পল-গাঢ় খয়েরি - একসঙ্গে কত যে উজ্জ্বল রং মিলে মিশে আছে! মা
বলেছে বছরের আর অন্য কোনও সময়ে নয়, এদেশটায় শুধু শরতকালেই এমন রঙের উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে প্রকৃতি।
গাছের পাতায় পাতায় কী বাহার! এ বলছে আমায় দেখো,
ও বলছে আমায় দেখো!
অনেক নিচে যত দূর চোখ যায়,
লাল কমলা হলুদের হাতছানি। মাঝে মাঝে জেগে
আছে উজ্জ্বল গাঢ় সবুজ। তাতে যেন লাল হলুদের বাহার আরও বেশি ফুটে উঠেছে!
আহা! নাওয়া খাওয়া ভুলে সারাদিন তাকিয়ে থাকা
যায়! পৌঁছে
গিয়েই ড্রইংখাতা আর প্যাস্টেল কালার নিয়ে বসে গাছের ছবি আঁকবে জিকো।
কিন্ত এই শরৎকাল,
আমেরিকায় যাকে বলে ফল সিজন,
সেই শরৎকাল এলেই গাছের পাতারা অমন রঙিন
হয়ে যায় কেন? মা বাবার কাছ থেকে জেনে নিয়েছে জিকো। চলো, আমরাও দেখি ঠিক
কী কারণে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ে ম্যাজিক রঙ গোটা শরৎ ঋতু জুড়ে।
শরৎকালে দিন ক্রমশ ছোট হয়ে যেতে থাকে। তাপমাত্রা কমে আসে, রাত লম্বা হয়। প্রকৃতির এই পরিবর্তনে,
ঠাণ্ডার স্পর্শ পেয়ে,
গাছপালা বুঝতে পারে শীত আসছে। প্রস্তুত
হতে হবে। ঘর গুছোতে হবে! দীর্ঘ শীতকাল জুড়ে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার
জন্যে গাছেরা ডরম্যান্ট বা সুপ্ত অবস্থায় নিয়ে যেতে চায় নিজেদের। মেটাবলিজম বা বিপাক
প্রক্রিয়ার অধিকাংশই বন্ধ করে দিয়ে চেষ্টা করে শীতকালটুকু কোনওরকমে কাটিয়ে দিতে।
শীতের প্রস্তুতিতে শুধু উত্তর গোলার্ধেই প্রতি বছর ঝরে যায় কয়েক বিলিয়ন টন পাতা।
কিন্তু পাতা ঝরার আগে অনেক জায়গায় প্রকৃতির নিয়মে ঘটে যায় এক আশ্চর্য সুন্দর রঙিন
ম্যাজিক। ঘন সবুজ পাতার রং যায় বদলে। সবুজ হয়ে ওঠে উজ্জ্বল হলুদ,
কমলা কিংবা লাল। আসলে পাতার এই রং বদলের
কারণ হল পাতার পিগমেন্ট বা রঙ্গক কণার পরিবর্তন।
পাতার সবুজ কণা ক্লোরোফিল। পাতার ওপর এসে
পড়া সূর্যের আলো থেকে লাল আর নীল আলো শুষে নেয় ক্লোরোফিল। তাই পাতা থেকে প্রতিফলিত
আলোতে লাল আর নীলের অনুপস্থিতিতে পাতাকে সবুজ দেখায়। ক্লোরোফিলের অণুগুলো বেশ বড়সড়
(C55H70MgN4O6)। গাছের কোষে কোষে ভরা যে জলীয় দ্রবণ,
তাতে এই অণু দ্রবীভূত হয় না। বরং কোষের
ভেতরে ডিস্কের মত আকারের যে ক্লোরোপ্লাস্ট, তার মেমব্রেন বা আবরণীর গায়ে লেগে থাকে
তারা।
এই ক্লোরোপ্লাস্টেই হয় ফটোসিন্থেসিস বা
সালোক সংশ্লেষ। এই পদ্ধতিতেই আলোক শক্তি পাল্টে যায় রাসায়নিক শক্তিতে।
ক্লোরোপ্লাস্টের ভেতরে ক্লোরোফিল কণার মাধ্যমে শুষে নেওয়া আলোই গাছকে শক্তি যোগায়
কার্বনডাই অক্সাইড আর জলকে অক্সিজেন এবং কার্বোহাইড্রেটে (Cx(H2O)y)রূপান্তরিত করার। ফর্মুলায় লিখলে
ব্যাপারটা এইরকম -
x CO2 + y H2O + (light + chlorophyll) --> x O2 + Cx(H2O)y
এটা এক ধরণের এন্ডোথার্মিক
ট্রান্সফর্মেশন বা তাপশোষী পরিবর্তন। ক্লোরোফিলের শুষে নেওয়া আলোক শক্তি পাল্টে
যায় কার্বোহাইড্রেট (সুগার বা শর্করা এবং স্টার্চ)-এর রাসায়নিক শক্তিতে। এই রাসায়নিক শক্তিই
গাছের বেড়ে ওঠা, ফুল ফোটানো, বীজ তৈরি করার মতো জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো চালায়।
ক্লোরোফিল খুব একটা স্থায়ী যৌগ নয়।
পরোক্ষভাবে আলোই গাছের পাতার এই ক্লোরোফিলের সংখ্যা বা মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে থাকে।
সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় ক্লোরোফিল ভেঙে যায়। পাতার ক্লোরোফিলের নির্দিষ্ট পরিমাণ
বজায় রাখতে গাছেরা ক্রমাগত ক্লোরোফিল উৎপাদন করে চলে। তার জন্যে চাই সূর্যের আলো
আর উষ্ণ তাপমাত্রা। তাই গ্রীষ্মকালে ক্লোরোফিল যেমন ক্রমাগত ভেঙে যায়,
তেমনি নতুন করে গাছের পাতায় আবার উৎপন্নও
হয়।
অনেক গাছেই আর এক ধরণের রঙ্গক কণা থাকে -
ক্যারোটিন। ক্যারোটিন কণা শুষে নেয় নীলচে-সবুজ আর নীল আলো। ক্যারোটিন কণার
প্রতিফলিত আলোকে হলুদ দেখায়। ক্যারোটিন অণুও বেশ বড় (C40H56)। অনেক গাছেরই ক্লোরোপ্লাস্টে ক্যারোটিন থাকে। কমলা রঙ্গক
কণার নাম জ্যান্থোফিল।
ক্যারোটিন আর ক্লোরোফিল যদি একইসঙ্গে
একটা পাতায় থাকে, এরা দুটিতে মিলে তখন পাতার ওপর এসে পড়া সূর্যের আলো থেকে লাল, নীলচে সবুজ আর নীল আলো শুষে নেয়। গাছের পাতা থেকে প্রতিফলিত
আলোকে তখন সবুজ দেখায়। ক্যারোটিন আসলে এই শোষণে সহায়তা করে থাকে। ক্যারোটিন যে
আলোক শক্তি শোষণ করে, সেটা সে ট্রান্সফার করে দেয় ক্লোরোফিলকে। আর ক্লোরোফিল সেটা
ব্যবহার করে সালোক সংশ্লেষে।
ক্যারোটিন কিন্তু যৌগ হিসেবে ক্লোরোফিলের
থেকে অনেক বেশি স্থায়ী। পাতা থেকে ক্লোরোফিল উধাও হলেও ক্যারোটিন
কিন্তু থেকে যায়। ক্লোরোফিলের অনুপস্থিতিতে পাতায় থেকে যাওয়া ক্যারোটিনের জন্যেই পাতাকে
হলুদ দেখায়।
ক্লোরোফিল আর ক্যারোটিন ছাড়াও তৃতীয়
একধরণের কণা থাকে গাছের পাতায়। অ্যান্থোসায়ানিন। নীল,
নীলচে সবুজে আর সবুজ আলো শুষে নেয় এরা।
তাই এই কণা আছে এমন পাতা থেকে প্রতিফলিত আলোকে লাল দেখায়।
ক্লোরোফিল আর ক্যারোটিনের মতো
অ্যান্থোসায়ানিন কিন্তু কোষের আবরণীতে আটকে থাকে না। এরা দ্রবীভূত থাকে কোষরসে। অ্যান্থোসায়ানিন
রঙ্গক কণা থাকায় গাছের পাতার রঙ ঠিক কেমন দেখাবে, সেটা নির্ভর করে কোষরসের pHএর ওপর। কোষরস যথেষ্ট অ্যাসিডিক হলে
অ্যান্থোসায়ানিন কণাওয়ালা পাতার রঙ দেখায় উজ্জ্বল লাল। ততটা অ্যাসিডিক না হলে রং
হয় পার্পল ঘেঁষা। এই অ্যান্থোসায়ানিনের জন্যেই কিন্তু আপেলের খোসার রং লাল কিংবা
পাকা আঙুরের রং পার্পল। কোষরসের কয়েকটা প্রোটিন আর শর্করার রাসায়নিক বিক্রিয়াতেই এই
অ্যান্থোসায়ানিন তৈরি হয়। কোষরসে শর্করার ঘনত্ব যথেষ্ট পরিমাণে বেশি না হলে এই
বিক্রিয়াটা হয় না। আলোর উপস্থিতিও এই বিক্রিয়াতেও খুব অপরিহার্য। অনেক সময় আমরা যে
দেখি একটা আপেলের এক দিক লাল আর অন্য দিকটা সবুজ - সেও কিন্তু আলোর জন্যেই। লালচে দিকটা
সূর্যের আলো পেয়েছিল, আর সবুজ দিকটা ছিল ছায়ায়।
গ্রীষ্মকালে গাছের পাতা একেবারে যেন
দারুণ ব্যস্ত কারখানা। ক্লোরোফিলের ওপর আলোর বিক্রিয়ায় কার্বন
ডাই অক্সাইড আর জল থেকে ক্রমাগত শর্করা উৎপাদন করে চলে। ক্লোরোফিলের জন্যেই সবুজ
দেখায় পাতা। কিছু গাছ, যেমন ধরো বার্চ কিংবা কটনউড-এ ক্লোরোফিলের পাশাপাশি
ক্যারোটিনও থাকে। ক্যারোটিন নীলচে সবুজ আলো শোষণ করায় এইসব গাছের পাতা আরও উজ্জ্বল
সবুজ দেখায়। গাছের মূল দিয়ে শুষে নেওয়া জল আর
নিউট্রিয়েন্ট বা পুষ্টি চলে যায় প্রথমে শাখা-প্রশাখা আর তারপর পাতায় পাতায়। সালোক
সংশ্লেষে তৈরি হওয়া শর্করা পাতা থেকে যায় গাছের অন্যান্য অংশে। খানিকটা রাসায়নিক
শক্তি ব্যবহার হয় গাছের বৃদ্ধিতে, আর বাকিটুকু সঞ্চয় হতে থাকে।
শরৎকালে দিন ছোট হতে থাকে। দিনের দৈর্ঘ্য হ্রাস পাবার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা আর আলোর
পরিমাণও কমে যায়। তাই এ সময়ে কমে যায় ক্লোরোফিল তৈরি। আরও কিছু পরিবর্তন আসে গাছে। তার একটা হল, গাছের শাখা আর পাতার বোঁটার মাঝখানে
একরকম কর্কের মত আবরণী স্তর তৈরি হওয়া। এই আবরণী থাকার জন্যে গাছের পাতায় পুষ্টির
সরবরাহ ব্যাহত হয়। পুষ্টি কমে যাওয়ার ফলে পাতায় ক্লোরোফিল তৈরি কমে যায়। তার ফলে
সবুজ রং ক্রমশ গাঢ় থেকে হালকা হয়ে আসে। ক্লোরোফিল যত কমতে থাকে,
বার্চ বা হিকরির মতো গাছ,
যাদের পাতায় ক্যারোটিন থাকে,
তারা তখন সবুজ থেকে উজ্জ্বল হলুদ হয়ে
ওঠে।
কিছু গাছের পাতায় শর্করার ঘনত্ব যত বেড়ে
যায়, ততই
বেশি করে সেই শর্করা, রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি করে ফেলে অ্যান্থোসায়ানিন।
অ্যান্থোসায়ানিনের উপস্থিতিতে হলুদ পাতা হয়ে ওঠে লাল। রেড মেপল, রেড ওক, আর
সুম্যাক গাছে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্থোসায়ানিন তৈরি হয় বলে শরতের ল্যান্ডস্কেপে
সবচেয়ে উজ্জ্বল লাল আর পার্পল রঙে দেখা দেয় এরা।
শরতে গাছপালার এই রঙ কিন্তু পুরোপুরি
নির্ভর করে আবহাওয়ার ওপর। কম তাপমাত্রায় ক্লোরোফিল ভেঙে যায়। আর তাপমাত্রা ফ্রিজিং
তাপমাত্রার ওপরে থাকলে গাছ অ্যান্থোসায়ানিন তৈরি বাড়িয়ে দেয়। উজ্জ্বল সূর্যের
আলোতেও ভাঙে ক্লোরোফিল আর সেইসঙ্গে অ্যান্থোসায়ানিন তৈরি বেড়ে যায়। আবার খুব শুকনো
আবহাওয়াতেও কোষরসে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়, ফলে তখনও অ্যান্থোসায়ানিন তৈরি বাড়ে। ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কানাডিয়ান
মেপল বা রেড মেপল, অটাম ফ্লেম, বাউহিল, ব্র্যান্ডিওয়াইন, নর্থউড কিংবা অক্টোবর
গ্লোরি গাছগুলো হয়ে ওঠে আগুনে লাল। কিন্তু সময়ের আগেই তুষারপাত হলে ফিকে হয়ে যায়
লাল রঙ। বৃষ্টির দিন কিংবা মেঘলা আকাশ হলে ফল কালার আরও গাঢ় হয়। তাহলে বোঝা
যাচ্ছে, শুকনো আবহাওয়া, পরিষ্কার আকাশ, রোদেলা দিন
আর তারপর ঠাণ্ডা, শুকনো রাত এলেই সবচেয়ে উজ্বল শরতের রঙ ছড়িয়ে পড়ে প্রকৃতির বুকে।
গাছের পাতা শুধু খাদ্য প্রস্তুতই করে না,
পাতার পত্ররন্ধ্রগুলো গাছের অতি
প্রয়োজনীয় গ্যাস বিনিময় করে (শ্বসন), অতিরীক্ত জলীয় বাষ্প ছেড়ে দেয়,
গাছের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করে!
গাছ যাতে দ্রুত জলীয় বাষ্প না হারাতে
পারে, শীতের
প্রাক্কালে তাই গাছেদের বন্ধ করে দিতে হবে পত্ররন্ধ্রের জানালাগুলো!
হরমোন, এনজাইম-এর পরিবর্তন হয়, আরএনএ
সিন্থেসিসও বন্ধ হতে থাকে। অন্যদিকে বেড়ে
যায় অ্যাবসিসিক অ্যাসিড আর ইথিলিন। এই ইথিলিন পাতার বোঁটায় অ্যাবসিসান স্তর গঠনে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। গাছের শরীর বা শাখা-প্রশাখা থেকে দ্রুত পাতা খুলে ফেলে
দিয়ে শরীরকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই তৈরি হয় অ্যাবসিশান স্তর। একসময় শুকনো পাতা মরে
যায়। তারপর ঝরে যায় সেইসব বাদামি রঙের পাতা। ঐ যে বললাম, পাতার বোঁটার কাছে নরম
কর্কের যে স্তর জমেছিল, সেটা তখন শক্ত হয়ে গিয়ে জায়গাটাকে রক্ষা করে,
যাতে ওই জায়গা দিয়ে গাছের শোষিত জল
বেরিয়ে যেতে না পারে।
এ ব্যাপারে বহু বর্ষজীবী চওড়া পাতাওয়ালা
বৃক্ষ আর গুল্ম-জাতীয় গাছপালাই বেশী সক্রিয়।
বর্ষজীবী গাছেরা তো ফুল, ফল আর কখনো বীজ তৈরি করেই মারা যায়। পাইনের মত চিরসবুজ বা
সূচ আকারের পাতাওয়ালা গাছের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া কাজ করে না। চিরসবুজ প্রজাতিগুলো এতে অংশ নেয় না। এদের মেকানিজম কোন পরিবর্তনকে একেবারে সরাসরি নাকচ করে দেয়। তেমনি চিরসবুজ গাছপালা বরফের আস্তরণে ঢেকে গিয়েও, বিপাক
নিস্ক্রিয় হয়ে পড়লেও, রঙ বদলায় না এদের।
জিকোর ইচ্ছে, এবার নিউ ইংল্যান্ডে এক রঙ
বাহারি শারদ-সফরের। তাই কোন প্রজাতির গাছের রঙ কেমন হয়, তার একটা লিস্ট বানিয়ে
ফেলেছে জিকো। মিলিয়ে দেখবে ওখানে গিয়ে।
ওক – লাল, খয়েরি, তামাটে রঙ
হিকরি - সোনালি ব্রোঞ্জ রঙ
অ্যাসপেন বা ইয়েলো পপলার - সোনালি হলুদ
ডগউড - পার্পল ঘেঁষা হলুদ
সাউথুড আর ব্ল্যাক টুপেলো - ক্রিমসন লাল
মেপল গাছের পাতার রঙ আবার পালটে পালটে যায়
এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে।
রেড মেপল - উজ্জ্বল লাল
সুগার মেপল - কমলাটে-লাল
ব্ল্যাক মেপল - উজ্জ্বল হলুদ
জিকোকে বাবা বলেছে,
আজকাল শুধু এই ফল কালার দেখতেই আমেরিকার নিউ ইংল্যান্ড, মিশিগান, উইস্কনসিনে অগুনতি
ট্যুরিস্ট আসেন। শুধু উইস্কনসিনেই প্রতি ফল সিজনে ট্যুরিস্টরা ১ বিলিয়ন ডলারেরও
বেশি। ঠিক কখন আর কীরকম আবহাওয়াতে কোন কোন প্রজাতির গাছে শরত-রঙের এই আশ্চর্য
ম্যাজিক দেখা যাবে সেসবের খবরাখবর দিতে আমেরিকার এই সব রাজ্যে আছে বিশেষ হটলাইন।
ফোন করলেই প্রকৃতির রঙ বদলানোর সব খবর চলে আসে হাতের মুঠোয়।
আর একটা মজার ব্যাপার আছে। এই রঙ পাল্টানো শুরু হয়
উচ্চতা অনুযায়ী। যদি একটা টাইম ল্যাপস ফটোগ্রাফির ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে দেখা
যাবে সর্বোচ্চ উচ্চতাতেই প্রথম শুরু হয় রং-বদল। তারপর প্রতি সপ্তাহে মোটামুটি
হাজার ফিট করে নামতে থাকে রঙ-বাহার। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচুতে
যে রঙের ছোঁয়া লাগে, নভেম্বর নাগাদ তা নেমে আসে সমতলে।
জিকো এবার নিউ
ইংল্যান্ডেই ফল কালার দেখবে মা বাবার সঙ্গে। কিন্তু প্রকৃতির এই রঙ বদল শুধু
আমেরিকাতেই নয়। দেখা যায়দুনিয়ার নানা প্রান্তে। উত্তর জাপান, পূর্ব চিন, উত্তর
ইউরোপ আর দক্ষিণ গোলার্ধেও প্রকৃতি তার রঙের প্যালেট উজাড় করে সাজিয়ে তোলে শরৎকাল।
নতুন কিছু শিখলেই জিকোর মনে নানান প্রশ্ন
উঁকি-ঝুঁকি দেয়। এবারেও ঠিক তাই। অনেক প্রশ্ন গিজগিজ করছে মাথায়। টুকটাক জিজ্ঞেসও
করে ফেলছে। যেমন ধরো, অ্যান্থোসায়ানিন নামের ওই কণা থাকলে কিছু গাছের যদি এতই
সুবিধে হয়, তাহলে অনেক গাছ কেন সেই কণা একেবারেই তৈরি করে না? কিংবা আরও অনেক বেশি
পাতা সবসময়েই লাল রঙের হয় না? অথবা, এমন গাছও কি আছে যাদের ওই অ্যান্থোসায়ানিন
কণাটা থাকে না, তবু তারা লাল রঙের?
আসলে ফুল হয় এমন ধরণের গাছের একটা খুব বড়
গ্রুপ, যাদের বিজ্ঞানসম্মত অর্ডার হ’ল ক্যারিওফাইলেলস, তারা একেবারেই
অ্যান্থোসায়ানিন তৈরি করতে পারে না। তবু
সেসব গাছে লাল রঙ দেখা যায়। কিন্তু সেখানে রঙ্গক কণাটা একেবারে আলাদা, তার নাম
বিটানিন। এর উদাহরণ বিট। ওদিকে নাইট্রোজেন-ওয়ালা বিটানিন-এর আলো শোষণকারী ধর্ম
একেবারে অ্যান্থোসায়ানিনেরই মতো। তাহলে কি এদের অণুগুলো অ্যান্থোসায়ানিনের মতোই
কাজ করে? কীভাবে এল এরা? অনেকসময় অ্যান্থোসায়ানিনকে প্রোমোট করে যেসব জিন, তারা
ফুল কিংবা গাছের অন্যান্য অংশ তৈরিতেও সাহায্য করে থাকে। সেইজন্যে কি অ্যান্থোসায়ানিন-ওয়ালা গাছেদের সার্ভাইভ করার সম্ভাবনা
অ্যান্থোসায়ানিন-হীন গাছের তুলনায় বেশি হবে? এগুলো নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। সাধারণ
গাছের সঙ্গে তুলনা করে দেখা হচ্ছে জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড গাছের, যাদের
অ্যান্থোসায়ানিন তৈরির জিনে মিউটেশন করা হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতেই হয়তো প্রকৃতির
রঙ-বদলের আরও অনেক অজানা খবর জানতে পারব আমরা।
এখন বরং জিকোর সঙ্গে আমরাও দেখি নানা
প্রজাতির গাছের, নানা রঙের ম্যাজিক।
_____
ছবিঃ লেখক
খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লাম লেখাটা। অবশ্য আমি বটানির কিছুই বুঝি না, তবে প্রকৃতির সৌন্দর্যবোধের সাথেও যে বিজ্ঞান এভাবে জড়িয়ে আছে জেনে অবাক হলাম। ফল-এর সৌন্দর্য আমেরিকায় দেখা হয়নি এখনও, তবে কাজাখস্তানের আলমাটি শহরে একটু-আধটু দেখেছি। আর একটা কথা, ক্যারোটিন কি C40H36 না C40H56, একটু দেখে নিও, টাইপো হয়ে গেছে হয়ত।
ReplyDeleteপল্লবদা,ঠিক বলেছ-ওটা টাইপো,ক্যারোটিন C40H56 হবে। কাজাখস্তানের ফল-এর কথা লিখো সময় পেলে। অনেক ধন্যবাদ।
Deleteঠিক করে দেওয়া হয়েছে।
Deleteeto tothypo somriddho othocho boring hoy ni eto tukuo, khub akorshoniyo presentation, asha kori khude gyanpipasu der o valo lagbe khub.
ReplyDeleteঅজস্র ধন্যবাদ।
Deleteতাহলে জিকো এবার নিউহ্যাম্পশায়ার আসছে? এই লেখাটা আমি অনেকদিন মনে রাখব, অনেক কিছু জানতাম না আজ শিখলাম
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ…
Deleteঅনেক ধন্যবাদ…
Delete