![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjblkBMxcPWFfBbSS8jOc0UK8USupczY2SbdSntzI9LCy2YVCUSuObyznIVKiVRaygLtKto6yLPksKaZ9cZXDik2ftqXOY2BLp3-v1W4tYWYp3NZWY5po_Z_88Z0q_RoZNvr5Dy6Z7txTw/s640/Ai.jpg)
অ্যাই
চুমকি চট্টোপাধ্যায়
অরণ্যর মন খুব খারাপ। বাবার বদলি হয়ে গেছে সেই দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার হাসনাবাদ বলে এক গ্রামে। কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হবে ফাইনাল পরীক্ষাটা
হয়ে গেলেই। ফোর থেকে
ফাইভে উঠবে এবার। অরিজিৎ, অর্ঘ্য, বেদান্ত, সোমরূপ - এদের খুব মনখারাপ; ওরা অরণ্যর খুব ভালো বন্ধু যে! আর সবচাইতে বেশি মনখারাপ পুষ্পলের। পুষ্পল অরণ্যর বেস্ট ফ্রেন্ড। হবেই তো। পাশাপাশি বাড়ি, তায় আবার একই ক্লাস। সবসময়েই তো দেখা হচ্ছে। অন্য বন্ধুরা মজা করে বলে, ‘অরণ্যে পুষ্প ফুটেছে!’
এখন আরও বেশি বেশি সময় একসঙ্গে থাকছে
দুই বন্ধু। গুরুজনরাও কিছু বলছেন না। তাঁরাও তো বোঝেন এদের মনের কষ্ট। সবসময় তো আর গুরুজনরা গব্বর সিং নন।
চলে এসেছে অরণ্যরা হাসনাবাদে। অরণ্যরা মানে হল, ওর মা, বোন আর পিসিম্মা। আর বাবা তো বটেই। বাবার জন্যেই তো আসা অমন সুন্দর জায়গা
ছেড়ে। ধ্যাত, ভাবলেই
মনটার ওজন বেড়ে যায়। পুষ্পল তো ওকে ওদের বাড়িতে থেকে যাবার
কথা বলেছিল। কিন্তু মা
শুনেই আঁতকে উঠে বলল, “সে কী কথা! আমরা সবাই ওখানে থাকব আর তুই এখানে পড়ে থাকবি অন্যের
ঘাড়ে, তা আবার হয় নাকি?”
পড়ে থাকা তাও আবার ঘাড়ে, ব্যাপারটা ঠিক বোঝেইনি অরণ্য। তবে সত্যি কথা বলতে কী, মাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না অরণ্য। তাই ‘না রে, আমি না থাকলে মা’র খুব কষ্ট হবে’ বলে নাকচ করেছে পুষ্পলের প্রস্তাব।
অরণ্যর বাবা বিডিও। তাই সরকারি কোয়ার্টার পান যেখানেই
বদলি হন। এখানেও পেয়েছেন। কোয়ার্টারটা ভারি সুন্দর। একতলা, কিন্তু ইছামতী নদীর পাড়ে। দূরে বাংলাদেশের সীমানা দেখা যাচ্ছে। তাই দেখে বাবা আর পিসিম্মা কেমন কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। আগে ওখানেই বাড়ি ছিল কিনা। ও তোমাদের তো পিসিম্মা কে, তা বলাই
হয়নি। পিসিম্মা
হলেন বাবার পিসি। উনি আমাদের
সঙ্গেই থাকেন।
বাড়ির সামনে একটু খালি জায়গা আছে। দু’চারটে বুনোফুলের গাছও আছে। আর আছে একটা মস্ত বড়ো নিমগাছ। মা তো মহাখুশি খালি জমি দেখে। বলেই দিয়েছে, ওই জমিতে কিচেন গার্ডেন হবে। আর পিসিম্মা বলেছেন নিমের হাওয়া গায়ে
লাগা ভালো। অরণ্যর বোন
পাপড়ি তো ওই জমিতে চরকিপাক খাচ্ছে সারাক্ষণ। কেন যে আগের বিডিও এই কোয়ার্টারে থাকত
না!
বাবা বলল, “ওনার বাড়ি ছিল কাছেই, টাকীতে। তাই বাড়ি থেকেই যাতায়াত করতেন।”
সবই তো ভালো কিন্তু যেদিন প্রথম এল
ওরা, সেদিন বাড়িতে পা দিয়েই কেন যে পিসিম্মা বলে উঠলেন, “উঁহু, বাড়িটা তো সুবিধের লাগছে না কানু। শরীরটা কেমন ভার হয়ে গেল।”
“কী যে বল পিসিমা! এত সুন্দর কোয়ার্টার কোনওদিন পাইনি। একতলা বলে হতে পারে একটু ড্যাম্প। তাই তোমার অমন লেগেছে,” কানাইবাবু হালকা করে দেন পিসিমার ভারি
কথা।
এখানে এসেও আশেপাশের প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপ পরিচয়
হয়েছে ওদের। অরণ্য আর
পাপড়িরও বন্ধুবান্ধব হয়েছে। তবুও পুরনো বন্ধুদের খুব মিস করে অরণ্য। বিশেষ করে পুষ্পলকে। এখানকার খবর জানিয়ে একটা চিঠি লিখেছে
ওকে।
কাল মায়ের হিরের নাকছাবিটা পড়ে গেছে
কোথাও। খুব মনখারাপ
মায়ের। পিসিম্মা
বলছে, “বলেছিলাম
না, বাড়িটা সুবিধের
নয়? দেখলে তো?
আসতে না আসতেই ক্ষতি!”
মন অরণ্যরও খারাপ। মায়ের কষ্ট কষ্ট মুখ দেখতে ওর একদমই ভালো লাগে না। খুঁজে দিতে পারতাম যদি, ভাবতে ভাবতে
জানলার পাশে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল। একটা কাক কোথা থেকে বিকট স্বরে কা কা করতে করতে জানলার কাছে চলে এল। ‘অ্যাই যাহ্’ বলতেই উড়ে গেল অবশ্য, কিন্তু চিরুনিটা গেল হাত থেকে পড়ে
ড্রেসিং টেবিলের তলায় ঢুকে। ওহ হো, ইউনিফর্ম পরে নিচু হয়ে খুঁজতে বেশ ঝামেলা। নিচু ড্রেসিং টেবিলের তলায় হাত ঢোকালেও
হাতে নোংরা লাগবে। তাই পালকের
ডাস্টারের পেছনটা তলায় ঢুকিয়ে দেয় অরণ্য। টেনে আনে আস্তে আস্তে। চিরুনি তো বেরোলই, তার সঙ্গে বেরোল মায়ের নাকছাবি। হৈ হৈ কান্ড বাড়িতে। সবাই খুব প্রশংসা করল অরণ্যর। মা তো আদরে আদরে ভরিয়ে দিল। কিন্তু অরণ্যর মনে একটা খটকা রয়েই
গেল। চিরুনিটা
হালকা জিনিস নয় খুব একটা। আবার
গোলও নয় যে গড়িয়ে কিছুর তলায় ঢুকবে। কী করে ঢুকল কে জানে! তবে ঢুকে লাভই হয়েছে। মায়ের নাকছাবিটা পাওয়া গেছে।
এখানেও কিছু বন্ধু হয়েছে অরণ্যর। কিন্তু এদের খেলাধুলো একটু আলাদা। একটা খেলা যেমন শিখেছে অরণ্য, ভাঙা টালির টুকরো জলে এমনভাবে ছুঁড়তে হবে
যে ওটা ব্যাঙের মতো লাফিয়ে
লাফিয়ে বেশ খানিকটা যাবে। মন্দ
লাগে না
অরণ্যর। তবে সবেতেই
মনে হয় পুষ্পল থাকলে ভালো হত।
কাল স্কুলে সাধারণ জ্ঞানের দশ নম্বরের
ক্লাস টেস্ট আছে। উফ্, এই সাবজেক্টগুলোর মাথামুন্ডু
বোঝে না
অরণ্য। হাত কাটলে কী করবে, বমি হলে কী করবে, খাবার কীভাবে জীবাণুমুক্ত রাখবে - সবই যদি আমরাই করব তাহলে ডাক্তারবাবু
কী করবে? বিরক্ত লাগছে। যদি জানা যেত কোন দু’টো প্রশ্ন আসবে, বাঁচা যেত। বইটা সামনে খুলে এসব আবোল-তাবোল ভেবে যাচ্ছে অরণ্য। হঠাৎই খেয়াল করে ওর বোনটি ওর স্কেলটা
নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। বোধহয় বেড়াল তাড়াবে।
“অ্যাই, অ্যাই, দে আমার স্কেল,” বলে চেঁচিয়ে ওঠে অরণ্য। পাপড়ি স্কেলটা ফেরত দিয়ে দৌড় লাগায়। অরণ্য আবার বইয়ে মন দেয়। ফ্যানের হাওয়ায় বইয়ের পাতা উলটে ‘তোমার পাড়া কীভাবে পরিচ্ছন্ন রাখবে’তে আটকেছে। দূর, এসব আসবে না বলে আবার প্রথমদিকের পাতা খোলে
অরণ্য। কিন্তু বই
থেকে হাত সরাতে না সরাতেই আবার পাতা উলটে সেই চ্যাপ্টারেই আটকায়। ‘আরে, হল কী রে! পাতা এমন ফরফরিয়ে উল্টোচ্ছে
যেন ঝড় বইছে।’
কী মনে হল, চ্যাপ্টারটা একবার চোখ বুলিয়ে
নিল অরণ্য। পরদিন ক্লাস টেস্টের প্রশ্ন দেখে চোখ কপালে অরণ্যর। ‘তোমার বাড়ির আশপাশ কীভাবে পরিচ্ছন্ন রাখবে তা নিজের ভাষায়
লেখ।’ এটা
কীরকম হল? যে চ্যাপ্টারটা বারবার খুলে যাচ্ছিল, সেটা থেকেই প্রশ্ন!
স্কুল থেকে ফেরার পথে মাথার মধ্যে
এই ব্যাপারটাই পাক খেতে থাকে অরণ্যর। কোনও যুতসই উত্তর খুঁজে পায় না ও। তবে টেস্টটা ভালোই দিয়েছে ভেবে খুশি হয়।
সামনের জমিটাতে মা বেশ কিছু সব্জির
গাছ লাগিয়েছে। লাউ, কুমড়ো,
বেগুন, টমেটো,
কাঁচালঙ্কা। তার
সঙ্গে ক’টা
গোলাপ, গাঁদা আর বেলফুলের গাছও আছে। অরণ্য আবার স্কুল থেকে বিশাল বড়ো পাতার মানিপ্ল্যান্ট-এর শেকড়সুদ্ধু ডাল নিয়ে এসেছে। ওদের স্কুলের পেছনে অশ্বত্থ গাছটাকে
বেড় দিয়ে উঠেছে এই বিশাল পাতাওয়ালা মানিপ্ল্যান্ট। ওর মনে হয়, মানিপ্ল্যান্ট বাড়িতে থাকলে অনেক টাকা
হবে। শেকড়টা
মাটিতে পুঁতে দেয় অরণ্য। কিন্তু
এটা তো লতানে গাছ। কীসে
লতিয়ে তুলবে সেটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায়। একটা লাঠি পেলে হত। কাঁধে স্কুলের সাদা শার্টটা ফেলে বাড়ির
ভেতর রওনা দেয় অরণ্য।
নিমগাছের তলায় দেখে একটা কাঠবেড়ালি। “অ্যাই বোনটি, দেখে যা, কাঠ...” বলতে না বলতেই কাঠবেড়ালি তো হাওয়া
আর একটা দমকা বাতাসে ওর কাঁধ থেকে শার্টটা নিচে পড়ে গেল। ‘এই রেহ্! গেল দাগ লেগে। মা দেবে আজ’ ভেবে নিচু হয়ে শার্টটা তুলতে যেতেই
চোখে পড়ে একটা নিমডাল পড়ে আছে একটু দূরে।
‘আরে, এটা দিয়েই তো গাছটাকে লতিয়ে দেওয়া
যাবে!’ তাড়াতাড়ি
নিমডালটা তুলে নেয় অরণ্য।
আচ্ছা, কীরকম যেন হচ্ছে ব্যাপারগুলো! যা চাইছে তাই যেন হয়ে যাচ্ছে। কেউ যেন আড়াল থেকে সাহায্য করছে। ভাবতে থাকে অরণ্য।
বাবা অফিস থেকে ফেরার পর অরণ্যর ভাবনাগুলো
বলে বাবাকে। বাবা একটু
হেসে বলে, “মন্দ
কী! ভালোই তো। যা চাইছিস হয়ে যাচ্ছে।” অরণ্যর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দেয়
ওর বাবা।
আজ রবিবার। অরণ্য ঘুম থেকে উঠেই বাগানে গেছে দেখতে
ওর মানিপ্ল্যান্ট কেমন
আছে। পাপড়িও গেছে
পেছন পেছন। গিয়েই গাছে
যে দু’তিনটে
লঙ্কা হয়েছে, সেগুলো তোলার চেষ্টা করতেই
বিরক্ত হয়ে অরণ্য বলে, “অ্যাই, ভেতরে যা শিগগিরি। মা খুব বকবে গাছে হাত দিলে।”
বলতেই একটা হাওয়ার ঝলক যেন টের পেল
অরণ্য। কিন্তু
কই, গাছের পাতা
তো নড়ছে না একটাও! বিচ্ছিরি
গরম তো! একটা খটকা লাগছে এবার। ওর মানিপ্ল্যান্ট ঠিক আছে দেখে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ার
টেবিলে বসে ভাবতে থাকে অরণ্য। হঠাৎই ওর মনে হয় ‘অ্যাই’ শব্দটা বললেই কি ঘটনাগুলো ঘটছে? একবার দেখবে ‘অ্যাই’ বলে এখন? কেউ নেই আশেপাশে। কেমন যেন ভয় ভয় করছে এখন।
“অ্যাই,” ফিসফিস করে বলে অরণ্য। নাহ্, কিছুই তো হল না। তার মানে কিছু নয়। এমনিই ঘটেছে ওসব। যাক গে, এবার একটু ম্যাপ নিয়ে বসতে হবে। কাল আবার পড়া ধরবে সুনীল স্যার। বেশ রাগী। আর পড়া না পেরে বকা খেতে একটুও ভালো
লাগে না
অরণ্যর। ভারতবর্ষের
আউটলাইন
ম্যাপগুলো তো এখানেই ছিল! টেবিলে রাখা খাতা বই ওলটপালট করে খুঁজতে থাকে অরণ্য। গেল কই? না পেলে... চোখ ছলছল করে ওঠে ওর। টেবিলের পাশেই রাখা খাটে উপুড় হয়ে
শুয়ে পড়ে। বাবা কত্তগুলো
ম্যাপ এনে দিয়েছিল। ইস্, কাল
ডবল বকা! স্যারের আর বাবার।
হঠাৎই অরণ্যর চোখ পড়ে বিছানার ওপর
দিয়ে হেঁটে যাওয়া শুঁয়োপোকাটার দিকে। এই সেরেছে। নিশ্চয়ই বাগান থেকে এসেছে। লাফিয়ে খাট থেকে নেমে টেবিল থেকে স্কেলটা
নিয়ে ফেলতে গিয়ে দেখে ওটা তখন গদির নিচে নেমে গেছে। তাড়াতাড়ি গদিটা ওঠাতেই দু’টো জিনিস দেখতে পায় অরণ্য। শুঁয়োপোকা আর ওর ভারতের আউটলাইন ম্যাপগুলো। যাতে সোজা থাকে তাই গদির তলায় রেখে
দিয়েছিল ও নিজেই।
শুঁয়োপোকাটা ফেলে দিয়ে ম্যাপ নিয়ে
বসে অরণ্য। উঁহু, কিছু
তো আছেই। শুঁয়োপোকাটা
গদির তলায় না ঢুকলে তো আর ও গদি তুলে দেখত না! তার মানে... ইয়েস, ‘অ্যাই’ আছে। তখন যে ফিসফিস করে ডেকেছিল, তাতেই
ও এসেছিল। যেই হোক এই ‘অ্যাই’, সবসময় অরণ্যর উপকারই করে।
তুমি খুব ভালো গো ‘অ্যাই’। হাওয়াতেই ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দেয় অরণ্য। একটা হাওয়ার ঘূর্ণি যেন অরণ্যকে ঘুরে
ঘুরে নেচে চলে যায়। আনন্দে কী
করবে বুঝে পায় না
ও।
পুষ্পলকে চিঠি লিখতে বসেছে অরণ্য।
প্রিয় বন্ধু পুষ্পল,
জানিস, এখানে আমি খুব ভালো একটা বন্ধু পেয়েছি। তার নাম অ্যাই। এই নামে ডাকলেই ও আসে। কী যে ভালো তোকে বোঝাতে পারব না। আমি যখনই কোনও অসুবিধায় পড়ছি, অ্যাই আমায় হেল্প করছে। তুই শিগগিরি আয় এখানে। অ্যাই কে তোকে দেখাতে পারব না কিন্তু বুঝতে পারবি তুই। চলে আয় তাড়াতাড়ি।
ইতি -
অরণ্য
_____
ছবিঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
onobodyo sundor
ReplyDeleteবেশ
ReplyDelete