![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEg9d5kBRlRVGEvAQlnuHs1xNqoUym0unxB9YkEJ6KiyaXT6OgjHQNmthhiVOvZH89bXIZQM1ATfB4fgdUmZIhQNdMW8bvRDFJ0P_Q5qrqVGxZQ7HBqNvTEjaPLrECRlIxa51ga5MROGU6k/s400/Rosik+Sayan.png)
রসিক সায়ন
অমিতাভ
প্রামাণিক
আমাদের সায়নদা খুব রসিক,
রসায়নের ছাত্র ছিল তো। এখন অবশ্য মাথাটা একটু বিগড়েছে, মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে
বিড়বিড় করে কী সব বলতে বলতে যায়। আমরা জিজ্ঞেস করলে কখনো বলে, চুপ কর, না হলে সব
গোলমাল হয়ে যাবে; হয় ছন্দ মিলবে না, নয়তো অন্ত্যমিল। ছড়া কাটছি, বুঝলি? পরে বলব।
পরে আর
কিছুই বলে না। পরে যদি আমরা ধরেও পড়ি, মুখটা ভাজামাছ উলটে খেতে পারে না এমন ভাব
করে বলে, কোন ছড়াটা বল তো? আমাদের ছোট নদী? কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ি?
সেদিন আমরা
একসাথে অনেক জন ছিলাম, একসঙ্গে গুলতানি মারছিলাম। হঠাৎ রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ সায়নদার। এসেই
বলল, একটা উদ্ভট গল্প শুনবি?
আমরা মনে
মনে বললাম, তোমার সব গল্পই তো উদ্ভট, এ আর এমন কী? সেটা অবশ্য ওকে বললাম না। বদলে
বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলো।
সায়নদা বলল,
না, আমি পুরোটা বলব না। তোরাও বলবি। মানে যত উদ্ভট বলতে পারিস।
আমরা বললাম,
মানে? আমরা তোমার মত বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারি না। তুমি এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াও,
তোমার অনেক স্টক। আমরা ওসব কোত্থেকে পাব?
সায়নদা বলল,
আরে, ঐখানেই তো মজা। সবাই সব জায়গায় ঘুরে দেখার সুযোগ পায় নাকি? তাই বলে কি কল্পনা
করা যায় না? চাঁদের বুড়ি যে চরকা কাটে, সেটা জানতে কি চাঁদে ডেলি প্যাসেঞ্জারি
করতে হয়?
আমরা চুপ
করে থাকলাম। সায়নদা বলল, চল একটা কাল্পনিক পিকনিকের কথা ভাবা যাক। পিকনিকে কারা
যাবে বল দিকি?
আমরা বললাম,
আমরা সবাই যাব।
সায়নদা বলল,
ধুর, তোরা বুঝছিস না। তোরা তো মনে মনে যাবিই। এমন একটা চরিত্রের নাম বল, যাকে তোরা
পিকনিকে পাঠাতে চাস। যা খুশি।
আমাদের
মধ্যে মলি বলে উঠল, চারমূর্তি, সায়নদা। ওরা পিকনিকে গেলে দারুণ মজা হবে।
সায়নদা বলল,
বেশ। কিন্তু আমি তো বললাম, একটা চরিত্র। চারমূর্তি কি একটা? ঠিক আছে, আমি প্যালারামকে
বেছে নিলাম। এবার বল, কীসে চড়ে যাবে?
আমাদের
স্মার্ট বয় পটা বলল, ষাঁড়ে চড়ে।
এক্সেলেন্ট,
সায়নদা উত্তর শুনে ভীষণ খুশি। বলল, পটা, তুই চকলেট পাবি। মনে কর, তুই বাংলাদেশে
বসে আছিস। কোথাকার চকলেট চাস?
পটা বলল,
ইন্ডিয়ান ক্যাডবেরি। আমি ভীষণ দেশপ্রেমিক। এটা আমাকে বদলাতে রিকুয়েস্ট করো না।
ঠিক আছে।
মনে কর, তুই একটা ডিটেকটিভ। সব জায়গায় ক্লু খুঁজে বেড়াস। পিকনিকে গিয়েও খুঁজবি।
তবে এতজন যদি একসাথে পিকনিকে যায়, ষাঁড়ে চড়ে কি যাওয়া যাবে? বড় গাড়ি চাই, তাই না?
আচ্ছা, সে না হয় হ’ল, সঙ্গে কী কী যাবে?
রুবি বসে
ছিল চুপ করে। আমরা ওকে রুবি রায় বলে খ্যাপাই, তবে ও মোটেই ললিত-লবঙ্গলতা নয়, বেশ
মোটাসোটা। বেশ করুণ স্বরে রুবি বলল, মগ তো নিতেই হবে। আর বালিশ।
সবাই হেসে
উঠল ওর কথায়। অফ কোর্স, যদি বাই চান্স বড়-বাইরে পেয়ে যায়, মগ না থাকলে মহা সমস্যা।
রুবি বলল,
হ্যাঁ, আর হজম করার জন্যে সোডার বোতল।
সায়নদা বলল,
রাইট, সোডার মগ না নেওয়াই ভাল। কী কী খাওয়া হবে পিকনিকে?
পেটুক জনতা
হাজার জিনিসের নাম বলতে লাগল। সায়নদা বলল, শোন, উদ্ভট মানে যে সেটা অকথ্য অখাদ্য
বস্তু হতেই হবে, তার তো মানে নেই। জার্মান আরশোলা শুনতে উদ্ভট হলেও জার্মানিতে কি
আরশোলা সেল হয়, না ওটা আমরা খাই? খাদ্যবস্তুর নাম বল।
অমনি আমাদের
আর্যভট বলে উঠল, ফ্রাই। বড় সাইজ। আর্যভট মানে ওর নাম আর্য ভট্টাচার্য, আমরা ওকে
আর্যভট ছাড়াও ওর পৈতেকে সম্মান দিতে বামুন বলে ডাকি। ওর দাদুর দাদু নাকি
ন্যায়তীর্থবিশারদ না কী একটা ছিলেন।
রুবি বলল,
ম্যাকডোনাল্ডের ঐ ফালতু আলুভাজা? সিলি! অত কিপ্টে কেন তুই, বামুন? অন্তত ফিশফ্রাই
না হলে পিকনিক জমে? আন্টিকে বলতে হবে, আমাদের জন্যে এক টিন ভর্তি করে অনেক কিছু
বানিয়ে দিতে।
আচ্ছা, ঠিক
আছে, নো ঝগড়া। সায়নদা ম্যানেজ করার চেষ্টা করে, এবার বল, ড্রেসকোড কী হবে? কী কী
পরে যাবে জনগণ?
গড়গড় করে
সাজেশন আসতে লাগল। কেউ বলল, শীতকাল তো, শাল গায়ে চাপাতে হবে। একজন বলল, হ্যাঁ, তার
সাথে টাই, বেশ উদ্ভট হবে তাহলে। অন্য আর একজন বলল, সঙ্গে জিন্স। সঙ্গে সঙ্গে পাশ
থেকে কে বলে উঠল, গ্যালিস দেওয়া হলেই জমবে ভাল।
মলি বলল,
ইস, এইসব পরে পিকনিক? আমি বাবা এর মধ্যে নেই।
অন্যরা তাকে
আওয়াজ দিতে দিতে বলল, তুই একটা আস্ত ন্যাকা। দেখছিস উদ্ভট গল্প হচ্ছে, বলে কিনা,
আমি নেই! ঠিক আছে, তুই নর্মাল কাপড় পরেই যাস।
মলি বলল, তাই
তো যাব। তোদের ঐ উদ্ভট ড্রেস কে বানিয়ে দেবে?
কে আবার?
টেলার ডাকব আমরা, বলে উঠল আয়েশা। আমাদের দলের সবচেয়ে রূপসী জেনানা।
আর রাস্তাটা
কেমন হবে? ডেসক্রাইব কর দেখি।
পটা বলল,
কেমন আবার? গ্রামের মাটির রাস্তা যেমন হয়। গাড়ির চাপে রাস্তা দেবে না গেলেই হ’ল।
রুবি আর মলি তো পাশাপাশি বসবে। গাড়িতেই যদি যাই, হঠাৎ হঠাৎ জার্ক না করলেই মলির
পক্ষে ভাল।
ঠাট্টাটা যে
তাকে নিয়ে বুঝতে পেরেই রুবি বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব আওয়াজ দিচ্ছিস। আমি তো তোদের
জায়গাও খেয়ে নেব রে, যদি ছোট গাড়ি হয়। ছেলেরা সবাই
এ ওকে কোলে নিয়ে বসবি, না হ’লে তো মজাই হবে না। যারা কোলে নিতে পারবি, তারাই
একমাত্র যেতে পারবি, কেননা ফেরার পথে তো উল্টোটা হবে। যারা যাওয়ার পথে কোলে
নিয়েছে, ফেরার সময় তারা কোলে বসবে।
আমাদের
উদ্ভট গল্প বেশ চলছিল। হঠাৎ পকেট থেকে পেন বের করে খসখস করে কী যেন লিখতে শুরু করল
সায়নদা। আমরা বললাম, কী লিখছ, সায়নদা? ও বলল, চুপ কর, না হলে সব গোলমাল হয়ে যাবে,
হয় ছন্দ মিলবে না, নয়তো অন্ত্যমিল। ছড়া কাটছি, বুঝলি?
বুঝলাম,
সায়নদার স্ক্রু আবার ঢিলে হতে শুরু করেছে। এতক্ষণ ভালই
ছিল, এই বুঝি গেল।
আমরা চুপ
করে দেখতে থাকলাম। সায়নদা বলতে লাগল, হেলে সাপ দেখেছিস? ওরা কি হাই তোলে? আমরা এ
ওর দিকে তাকালাম। মরেছে। এবার বুঝি পুরো পাগল হয়ে গেল। প্রায় মিনিটখানেক চুপ করে
থেকে আবার বলল, বিড়ালে কি লাথি মারে? আমরা উঠে পড়ার তোড়জোড় করতে লাগলাম। এবার যদি
আমাদের কামড়ে দেয় সায়নদা!
আমাদের উঠতে
দিল না অবশ্য। খসখস করে লেখাটা শেষ করেই বলল, শোন, এইটা হচ্ছে পদ্যটা, যেটা
পিকনিকে গিয়ে পড়া হবে। তোরা সবাই মিলে বানালি তো এইমাত্র, আমি জাস্ট ওটাকে পদ্য
করে দিলাম। তাকিয়ে দেখি এইগুলো লেখা –
হাই
তোলে হেলেসাপ, লাথি মারে বিড়ালে
বড়ো কার নাই
যদি, অক্স কেন ফিরালে?
নিওনা সোডার
মগ, আলু সিলি, ফিস ফ্রাই
শাল
গায়ে খেলে ক্লু কি আর পাবে পটা, হায়?
কাল স্ক্যান
করে দিস, টাই বেঁধে ভ্যানতাড়া
করে ক্রোড়ে
নিবি ম্যান, আয়রে কাবিল যারা।
ন্যাকাও কাপড়
পরে, জিন্সের গ্যালিসে
জার্মান আরশোলা
সেল হয় বালিশে।
ব্রাহ্মণ কিপ্টে
না, রুবি রায় বেশ স্ট্রং
ইঁটের
মতন জার্ক নাইবা মলির ঢং।
টিঁকে
গেল রুথলেস রোডখানা, প্যালাভাই,
শিল্পীরা ক্যাডবেরি
খেতে ইন্ডিয়া যায়।
টিন
ভরা আন্টির, কত কিছু সে নানা –
টেলারের আয়োজন
করে এক জেনানা।
আমরা বললাম,
এটা কী, সায়নদা?
সায়নদা একটা
রহস্যময় হাসি হেসে বলল, ঐ তো, ছড়া। বললাম না, ছড়ার জগৎ বড় মোহময়।
আমরা বললাম,
কিন্তু এটাতে এ রকম কিছু কিছু শব্দের তলায় দাগ দিয়ে রেখেছ কেন?
সায়নদা বলল,
রেখেছি ইচ্ছে করেই। বুঝতে পারলি না, না? রসায়নে পিরিয়ডিক টেবল পড়েছিস? তলায় দাগ
দেওয়া শব্দগুলো হচ্ছে সেই টেবলের এলিমেন্টগুলোর নামের অপভ্রংশ, দ্যাখ পর পর
সাজানো। একটা দুটো না, পিরিয়ডিক টেবলের ওপরের পাঁচখানা পিরিয়ডের চুয়ান্ন খানা এলিমেন্টের
নাম এতে পর পর আছে। বুঝতে পারছিস? হাই হচ্ছে হাইড্রোজেন, হেলেসাপ মানে হিলিয়াম,
লাথি লিথিয়াম, বেড়াল বেরিলিয়াম, বড় বোরন, কার কার্বন, নাই নাইট্রোজেন, অক্স
অক্সিজেন – এইভাবে সব পরপর আছে। পড়লেই বুঝে ফেলবি। একেবারে এই জেনানা মানে জেনন
অবধি, বলে আয়েশার দিকে তাকাল সায়নদা।
আয়েশা
কাগজটা ওর হাতে নিয়ে বলল, তাই তো, তার মানে ফিরালে হচ্ছে ফ্লুওরিন, নিওনা নিয়ন,
সোডা সোডিয়াম, মগ ম্যাগনেশিয়াম।
নাদুস নুদুস
রুবি রায় আয়েশার হাত থেকে কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল, এ মা তাই? দেখি আমিও পারি কিনা।
এই তো আলু অ্যালুমিনিয়াম, সিলি সিলিকন, ফিসফ্রাই ফসফরাস, শাল সালফার। এই ক্লু কী
রে?
ডিটেকটিভ
পটা বলল, ক্লু খুঁজে পেলি না? ক্লোরিন রে। আর মানে আর্গন এবং পটা মানে আমি হচ্ছি
পটাশিয়াম।
সবাই কাগজটা
হাতে নিয়ে পরপর তলায় দাগ দেওয়া শব্দগুলো যে যে এলিমেন্টের নাম, সেগুলো জোরে জোরে
পড়তে লাগল। মলি বলল, আরে, সায়নদা এইভাবে গুলতাপ্পি দিতে দিতে আমাদের কেমিস্ট্রি
পড়িয়ে দিলে?
আমি আবার
কোথায় পড়ালাম, তোরাই তো সব নিজে নিজেই শিখে নিলি! তবে যা লিখেছি, আমাকে এর একটা
কপি স্ক্যান করে দিয়ে দিস, নইলে সব হারিয়ে যাবে। কাল মানে ক্যালশিয়াম আর স্ক্যান
মানে স্ক্যান্ডিয়াম সেটা তো এখন বুঝেই গেছিস। সত্যি, রোজ যে কত কী হারিয়ে ফেলি, তা
আর কহতব্য না, বলে হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তার দিকে
চলে গেল রসিক রসায়নবিদ সায়নদা।
______
No comments:
Post a Comment