ইচ্ছাশক্তি
নির্মাল্য সেনগুপ্ত
এক
“ইচ্ছাশক্তি জানিস, বিনু? ইচ্ছাশক্তির মতো ক্ষমতা
আর কিছুতে থাকে না। ওটা একবার রপ্ত করে ফেললেই
দেখবি আমার সব শেখা হয়ে গেছে।”
আমি হাসলাম। বললাম, “তোর
আরও কিছু শেখার বাকি আছে? এরপর তো তুই হুডিনিকেও ছাড়িয়ে চলে যাবি। এমনিতেই বিশ্বজুড়ে তো নাম করে ফেলেছিস। আর কী বাকি?”
অমিয় মাথা নেড়ে বলল, “না রে ভাই। তোর কাছে আর কী লুকোব! সত্যি বলতে, গোটা দশেক হাতসাফাই ছাড়া
কিছুই শিখতে পারিনি আমি। স্টেজে যা যা দেখাই সবই আধুনিক যন্ত্রপাতি আর আলো-আঁধারির খেলা। তুই হুডিনির ওই
বিখ্যাত ম্যাজিকটার কথা জানিস, যেটার
কৌশল আজ অবধি কেউ বের করতে পারেনি?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
“ম্যাজিক সম্পর্কে আমার দৌড় খুব কম রে। যদিও তোর থেকে গল্প শুনে শুনে এত
ইন্টারেস্টিং লাগে যে বহুবার ভেবেছি ম্যাজিক নিয়ে একটা দারুণ গল্প লিখব। কিন্তু
দুঃখের বিষয় হল, মানিকবাবু ম্যাজিক বিষয়টা নিয়ে এত গল্প লিখে গেছেন যে ওটায় আর হাত
দেওয়ার জায়গাই খুঁজে পাই না। তবে
একদমই যে জানি না তা নয়। ছোটোবেলায় দাদু দু’তিনটে ম্যাজিকের বই কিনে
দিয়েছিলেন। যদিও তার অধিকাংশই বিজ্ঞানের
ম্যাজিক। একটা এখনও মনে আছে। একখানা জলভর্তি গ্লাসের উপর একটা তাস চাপা রেখে
গ্লাসটা চটজলদি উলটে দিয়ে হাত সরিয়ে নিলেও একফোঁটা জল পড়বে না।”
অমিয় হাসিমুখে বলল, “একদম
ঠিক। কারণ, তাসের উপর বায়ুর ঊর্ধ্বমুখী চাপ
জলের নিম্নমুখী চাপের থেকে বেশি। আমরা যা যা ম্যাজিক দেখাই সবই বিজ্ঞানের এরকম
ছোটখাটো বিষয়কে বিরল পদ্ধতিতে দেখানো। আর কিছু হাতের কৌশল। কিন্তু ইচ্ছাশক্তির
ব্যাপারটা আলাদা। হুডিনির সেই বিখ্যাত ম্যাজিকটা হল,
ওনাকে একটা লোহার সিন্দুকের মধ্যে ঢুকিয়ে শেকল দিয়ে বেঁধে সমুদ্রের মাঝখানে ফেলে
দেওয়া হয়। ফেলার কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায় তিনি হাসিমুখে সমুদ্রের তীরে ঘুরে
বেড়াচ্ছেন। এই ম্যাজিকটার রহস্য আমি কিছুতেই উদ্ঘাটন করতে পারিনি। কেউই পারেনি আজ
অবধি। এখানেই আমার মনে হয় হুডিনি সেই ইচ্ছাশক্তিকে
অর্জন করতে পেরেছিলেন, যা আমরা কেউ পারি না। তাই উনি কিংবদন্তী।”
আমি বললাম, “ইচ্ছাশক্তি
বলতে কি মনের জোর?”
অমিয় বলল, “অনেকটা তাই।
মানে, তুই যদি তোর কনসেনট্রেশন পাওয়ার একশো গুণ বাড়িয়ে নিতে পারিস, তবে দৈহিক
ক্ষমতার বাইরে গিয়ে তুই কোনও কাজ করে
দিতে পারবি। আমার কাছে ‘আ কালেকশন অফ লেজেন্ডারি ম্যাজিকাল পাওয়ার’ নামের একটা বই আছে। রেয়ার কালেকশন। সেটার মাহাত্ম্য হল, তাতে কোনও ভুয়ো কথা লেখা নেই। সবকিছু
নির্জলা সত্য। তাতে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ম্যাজিকের বিবরণ এবং কৌশল সম্বন্ধে লেখা
আছে। শুধু দুটো ম্যাজিক বাদে। এক হল হুডিনির ওই
বিখ্যাত খেলা, আরেকটা হল ভিয়েতনামের ‘দিয়াম ফিং’ নামের ম্যাজিশিয়ানের অদ্ভুত এক
যাদু। সেই ভদ্রলোক লোহার একটা চামচের দিকে মিনিট দুয়েক তাকিয়ে থাকতেন। চামচ মাঝখান দিয়ে বেঁকে ভাঁজ হয়ে যেত। আজকের দিনে এই ম্যাজিক আমরা
হাতসাফাইয়ের জোরে দেখাতে পারি সহজেই। কিন্তু এই ভদ্রলোক কোনও হাতসাফাই করতেন না। কাউকে চামচটা ধরে দাঁড় করিয়ে স্রেফ তাকাতেন। কাজ শেষ।
উনিই প্রথম এই ইচ্ছাশক্তির কথা বলেন।”
আমি চোখ বড়ো বড়ো করে বললাম, “এরকম হলে তো
মারাত্মক হয়ে যাবে রে! উনি তো শুধু চামচ বাঁকাতেন। কেউ
যদি এই ক্ষমতা পেয়ে ব্যাঙ্কের লকারের দরজা বা সিক্যুরিটি গার্ডের বন্দুকের নল
বেঁকিয়ে ফ্যালে তো ব্যস, হয়ে গেল।”
অমিয় ভাবুক দৃষ্টিতে আমার
দিকে তাকিয়ে বলল, “এইসব ক্ষমতা কি যে সে লোকের আসে রে বিনু? যাদের আসে তারা সেগুলো
ভালো দিকে চালনা করে। তাদের ব্রেইনের
গঠনই সেরকম হয়। অর্থের দিকে লালসা থাকে না। যেমন
ধর, আইনস্টাইন। ইচ্ছাশক্তির মতো প্রবল ক্ষমতা না থাকলে কেউ ওসব আবিষ্কার করতে পারে? আজ যে বিজ্ঞানের এত
ছড়াছড়ি, এত অদ্ভুত ক্ষমতা, তা তো মানুষেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। এই নশ্বর দেহে মাথাটাই
আসল। কাজে লাগাতে হয়।”
আমি গম্ভীর হয়ে চোখ পিটপিট
করলাম।
অমিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে
বলল, “শৈশবে আমাদের সবার ব্রেইনেই এই আশ্চর্য ক্ষমতাটা থাকে। আমারও ছিল। সে
প্রমাণও আমি একবার পেয়েছি। কিন্তু বড়ো হওয়ার
সাথে সাথে এত জটিলতা বাড়ে যে সব ক্ষয়ে যায়। যাই হোক, বাকি দুজনের পাত্তা নেই কেন
এখনও? সাড়ে বারোটা বেজে গেছে তো!”
আমি ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ছোটোবেলায়
তুই ইচ্ছাশক্তির প্রমাণ পেয়েছিলি? বল, বল সেই গল্প।”
আমার কথায় বাধা দিল কলিং বেলের আওয়াজ। দরজা খুলে দেখি, অসিত। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
হাসলাম আমি। তারপর বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
দুই
এই গল্পটার শুরু আজ থেকে
প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে। আমাদের চারজনের বয়স তখন সাড়ে তিনের কাছাকাছি। অমিয় সেন,
অসিত মজুমদার, প্রণব বসু এবং আমি, সুবিনয় দাসগুপ্ত। স্কুলের প্রথমদিন আমরা চারজনই
জায়গা পেয়েছিলাম ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে। আমার তখন স্কুলের ভয়ে হাত পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে
যাচ্ছে। আমার বাঁদিকে ছিল প্রণব। সে নিঃশব্দে
অঝোর নয়নে কাঁদছিল। অমিয় আর অসিতেরও তথৈবচ দশা। কিন্তু এই ভয়
বা দুঃখটা ছিল মাত্র একটা ক্লাসের। তারপর থেকেই আমরা হয়ে যাই গলায় গলায় বন্ধু।
আমরাই স্কুলে প্রথম কাগজ কেটে মেমোরি গেম, চোর-পুলিশ, কাটাকুটি খেলা শুরু করি।
বন্ধুত্বের সাথে সাথে
আমাদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি মারপিট
ইত্যাদি লেগেই থাকত। বিশেষ করে আমার আর অমিয়র দু’দিন অন্তর হত রক্তারক্তি কাণ্ড। অমিয়র ঘুষিতে আমার নাকের উপরের হাড়টা এখনও
একটু বাঁকা। আমার ধাক্কায় বেঞ্চের কোণায় মাথা ঠুকে অমিয়র ভ্রূর ডানদিকে তিনটে সেলাই পড়ে। এই বয়সেও সেই দাগ সুস্পষ্ট। তবে সারাস্কুলে আমার
থেকে বেশি মারকুটে কেউ ছিল না। বহু
ছেলের অভিভাবকরা আমার মা-বাবার কাছে নালিশ করতে আসতেন ফি দিন। শুধু প্রণবের গায়ে
আমি কোনওদিন হাত তুলিনি। প্রণব ছোটোবেলা থেকেই বাক্শক্তিহীন। গলা দিয়ে একফোঁটা আওয়াজ বেরোয় না ওর। তবে কানে শুনতে পায় সাধারণ মানুষের মতনই।
একবারই প্রণবের উপর খুব
রাগ হয়েছিল আমার। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় আমার
ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকা চুরি করে সে। তবে বাকিরা মারমুখী হলেও আমিই সেদিন ওকে
বাঁচাই। অসিতও আমার দৌরাত্ম্য থেকে পার পেয়েছিল একটা সময় পর। মাধ্যমিকের পর একদিন
আমরা চারজন নদীর ধারে পিকনিকে গেছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করি অসিত নেই। তারপর রক্তাক্ত
অবস্থায় একটা গাছের পেছন থেকে তাকে উদ্ধার করি।
ব্রহ্মতালু ফেটে রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। তারপর থেকেই অসিতের সামান্য মানসিক বিকৃতি
দেখা দেয়। একটু ক্ষ্যাপাটে হয়ে পড়ে। তখন থেকে আমি ওকে আগলে রেখেছিলাম স্কুলের শেষদিন
অবধি। ক্ষ্যাপাটে হলেও অঙ্কে বিশাল মাথা ছিল ওর। স্কুলের পর অসিত জার্মানি চলে যায়
মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে।
কলেজ শেষে আমরা চারজনই
ছিটকে যাই নিজেদের পেশার খাতিরে। অমিয়র ছোটোবেলা
থেকেই ম্যাজিকের ঝোঁক। স্কুল-কলেজেও সে নিয়মিত ফাংশনে ম্যাজিক দেখাত। কলেজের পরই
প্রথমে এক ম্যাজিশিয়ানের অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরি নেয় সে। এখন সারা বিশ্বজুড়ে তার
নাম। অসিত বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার। প্রণব পদার্থবিদ্যায় এম.এস.সি. করে এখন পুরুলিয়ার এক মূক ও বধির স্কুলে ফিজিক্সের শিক্ষক আর আমি লিখি। লেখার জগতে মোটামুটি ভালোই নাম
হয়েছে এখন। আগে একটা খবরের কাগজের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। এখন সেই চাকরি থেকে স্বেচ্ছা-অবসর নিয়ে শুধু লেখালিখিতেই মন দিয়েছি।
প্রচুর ঝগড়া মারপিট হলেও আমাদের চারজনের বন্ধুত্ব একটুও কমেনি কোনোদিন। চিরকালই
চিঠির মাধ্যমে এবং ইন্টারনেট এসে যাওয়ার পর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে আমরা যোগাযোগ রেখেছিলাম। গতমাসে ঠিক হয়, অনেক হয়েছে এবার একত্রিত হতেই হবে। তখনই ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান হয়। অসিতই
দেয় প্ল্যানটা। আমরা বাকিরা রাজি হয়ে
যাই। ঠিক হয়, প্রথমে কলকাতায় আমার বাড়িতে দেখা
করব। পরেরদিন বেরিয়ে পড়ব। জায়গা ঠিক হয় উত্তরবঙ্গে।
রিশপ পাহাড়। আমাদের সবারই পাহাড় বড়ো পছন্দের।
অমিয় এতদিন ছিল
আমস্টারডামে। কলকাতা এসেছে দু’দিন আগে।
এই দু’দিন আমরা প্রচুর আড্ডা মেরেছি। আজ
অসিত আর প্রণবের আসার কথা। অসিত থাকে জার্মানিতে। প্রণবের আসতে সন্ধে হবে। আটটায় তার ট্রেন হাওড়া ঢোকার কথা।
অসিত ঘরে ঢুকে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাপ রে! কী নিচু
ছাদ। একটু বেশি লম্বা হলেই তো মাথা ঠুকে যাবে।”
তারপর অমিয়র দিকে তাকিয়ে
বলল, “কী, ম্যাজিশিয়ান? ম্যাজিক করে একটা
সিগারেট দাও দেখি।”
অমিয় একটা সিগারেট অসিতের
দিকে বাড়িয়ে বলল, “এত দেরী হল যে? ফ্লাইট লেট করল নাকি?”
অসিত সিগারেট ধরাতে ধরাতে
একটু লাফিয়ে উঠে বলল, “ফ্লাইটে কে এসেছে? আমি তো
উড়ে এলাম।”
আমি হেসে বললাম, “ক্ষ্যাপা
কোথাকার। বস, বস। খাবি কিছু?”
অসিত জোরে জোরে মাথা নেড়ে
বলল, “হ্যাঁ, একটু ডাল ভাত খাওয়াবি? রঙটা মনে আছে এখনও। গন্ধটা ভুলে গেছি।”
আমরা দু’জনে হো হো করে হেসে উঠলাম।
তিনজনে সারাদিন গল্প করে
কাটিয়ে দিলাম। অমিয়ই সবথেকে বেশি গল্প শোনাল। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ম্যাজিক শোয়ের গল্প। আমি আমার লেখা দু’একটা
গল্প শোনালাম। গল্পের শেষে অসিত বাচ্চাদের মতন হাততালি দিল। প্রণব ঢুকল সাড়ে ন’টার সময়। ওকে দেখে যে কী আনন্দ হল আমার! শ্যামবর্ণ মুখ। আজও চোখগুলো এত উজ্জ্বল যেন কথা বলে ওঠে। প্রণব ঘরে ঢুকেই
তার ঝোলা থেকে তিনটে প্যাকেট আমাদের তিনজনের হাতে ধরিয়ে দিল। আমি প্যাকেট খুলে
দেখলাম তার মধ্যে ঝকঝক করছে একটা সোনালি রঙের বিখ্যাত কোম্পানির কলম। অমিয়র
প্যাকেটে ছিল একটা দামী স্যুট আর অসিতের জন্য একটা বিদেশী কোম্পানির জুতো।
প্রণব কথা বলতে না পারলেও
কোনওদিনই ওর আমাদের আড্ডায় অসুবিধে
হয়নি। সবথেকে মনোযোগী শ্রোতা। এছাড়া ওর ইশারাগুলোও
আমরা বুঝতে পারি। চারজনকে দেখে মন ভরে গেল আমার। প্রথমদিনের সেই লাস্ট বেঞ্চের কথা
মনে পড়ে গেল।
আমি বললাম, “এবার অমিয়
আমাদের একটা ম্যাজিক দেখাবে।”
বাকিরাও সায় দিল।
অমিয় পকেট থেকে একটা ছোট্ট
কাগজের টুকরো বের করে আমায় দেখাল। কাগজটা সাদা। সেটা দু’ভাঁজ করে ধরতে দিল প্রণবকে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা শব্দ ভাব
মনে মনে।”
আমি ভাবলাম। অমিয় বলল, “এবার শব্দটা প্রণবকে কানে কানে বল।”
আমি তাই করলাম। অমিয় এবার
কাগজটা খুলে দেখাতে বলল। অবাক হয়ে দেখলাম সেই শব্দটাই লেখা আছে কাগজে। অসিত
হাততালি দিয়ে উঠল।
অমিয় অল্প হেসে অসিতের
দিকে তাকিয়ে বলল, “কী রে, এবার বলে দিবি না কী করে
করলাম?”
আমি আর প্রণব চোখাচোখি
করলাম। পুরনো ঘটনা। মাধ্যমিকের পর একবার স্কুল ফাংশনে অমিয় ম্যাজিক দেখাচ্ছিল।
একটা ম্যাজিকের পর অসিত দর্শকের মধ্য থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ম্যাজিকটার কৌশলটা বলে দেয়।
অমিয়ই প্র্যাকটিসের সময় কৌশলটা বলেছিল অসিতকে। সকল দর্শক হো হো করে হেসে ওঠে। অমিয়
লজ্জায় কান লাল করে স্টেজ ছেড়ে চলে যায়।
আমি ব্যাপারটা ঘোরানোর
জন্য বললাম, “বন্ধুগণ, এবার ঘুমনো যাক। এমনিতেই তোরা
দুজন ক্লান্ত জার্নির জন্য। কাল আবার সন্ধেবেলা
ট্রেন। ঘুমোও সবাই। তোমাদের বিছানা করা আছে।”
সবাই উঠে পড়ল। যাওয়ার আগে
অসিত আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে, “অমিয়
তো এখনও খচে আছে দেখছি আমার উপর। পাহাড় থেকে
ধাক্কা না মেরে দেয়,” বলে খিক খিক করে হাসতে হাসতে চলে গেল।
আমি হাসলাম। আমাদের
বন্ধুত্বটা সত্যিই অদ্ভুত।
তিন
রিশপের কটেজে যখন পৌঁছলাম
তখন সূর্য অস্তের পথে। চারদিকে মেঘ কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। কটেজের বারান্দা থেকে
নিচে তাকালেই অতলস্পর্শী খাদ। চারদিকে গাছপালা। মাঝে মাঝে
পাতার উপর শুভ্র বরফকুচি। নভেম্বর মাস। কটেজের খানসামা বলল, রাতের দিকে উষ্ণতা শূন্যের নিচে নেমে যায়। আমার এখনই দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছিল।
রিশপ একটা পাহাড়ের চূড়া।
আমাদের কটেজটা জনবসতি থেকে বেশ কিছুটা দূরে। কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে অন্য কোনও কটেজ নেই। সামনে ছোট্ট একটা স্টেশনারি দোকান
যাতে পাউরুটি, বিস্কুট, চাউমিন ইত্যাদি পাওয়া যায়। সেটাও বন্ধ হয়ে গেল সাতটার পর।
আমরা গোটা কটেজটাই ভাড়া করে নিয়েছি। কটেজটাও আয়তনে ছোট্ট। দোতলায় পাশাপাশি চারটে ঘর। ঘরগুলো বেশ বড়ো। একটা
খাট, একটা আলমারি। আলমারির
মাথায় কয়েকটা পুরনো লোহার বিশালাকৃতি ট্রাঙ্ক। তার মধ্যে বালিশ, কম্বল রাখা থাকে। সব মিলে ব্যবস্থা ভালোই। তবে বিদ্যুতের
খুব অসুবিধে শুনলাম। নিচে খানসামা থাকে একজন। সন্ধে আটটা নাগাদ আমাদের খাবার দিয়ে সে শুতে চলে গেল। আমরা প্রচুর গল্প করে
এগারোটা নাগাদ শুয়ে পড়লাম যে যার ঘরে। প্রবল ঠাণ্ডা এবং তা উত্তরোত্তর বেড়েই
চলছিল। দুটো সোয়েটার পরে মোটা কম্বলের তলায় ঢুকেও
আমার শীত কমছিল না। কাঁপতে কাঁপতে কখন যে ঘুমিয়ে
পড়েছি মনে নেই।
সকালবেলা ঘুম ভাঙল ছ’টা নাগাদ। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি কুয়াশায় আচ্ছন্ন। শীতের পরিমাণও
কমেনি একফোঁটা। আমি উঠে পড়ে একটা চাদর জড়িয়ে দরজাটা
খুললাম। কিছু একটা পায়ে ঠেকল।
ছোট্ট একটা খাম। গোলাপি
রঙের। অবাক হয়ে হাতে তুললাম। সেটা খুলে দেখলাম ভেতরে একটা ছোট্ট চিরকুট, তাতে বিচ্ছিরি হাতের লেখায় লেখা ‘পুলিশ’ এবং তার নীচে ‘৭০০’।
অবাক হয়ে গেলাম। এর মানে
কী? বাকিরা ঘুমোচ্ছে। মোবাইল বের করলাম পকেট থেকে। এখানে টাওয়ারের বেশ প্রবলেম।
তিন চারবার চেষ্টা করাতে অমিয়র ফোন লাগল। ঘুম জড়ানো গলায় সে উত্তর দিল।
“উঠে পড়। সাতটা বাজে।”
মিনিট দুয়েক পরে পাশের
দরজাটা খুলল। আমি ততক্ষণে অসিত আর প্রণবকেও তুলে ফেলেছি ঘুম থেকে। খানসামা চার কাপ চা রেখে চলে গেল।
আমি ভর্তি চায়ের কাপটা দু’হাত দিয়ে ধরে তালুটা গরম করতে করতে বললাম, “একটা অদ্ভুত জিনিস পেয়েছি আজ।”
অমিয় জিজ্ঞেস করল, “কী?”
আমি কাগজ সমেত চিরকুটটা
বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে। অমিয়
কাগজটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, “পুলিশ? এর মানে কী? ‘৭০০’ বিষয়টাই বা
কী?”
অসিত অমিয়র হাত থেকে
কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে দেখতে থাকল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, “আমি কী করে জানব? দরজার সামনে কেউ রেখে গিয়েছিল।
ঘুম থেকে উঠেই দেখলাম।”
অসিত চায়ে একটা চুমুক দিয়ে
বলল, “এই, আমাদের খানসামাটা কি বাঙালি? বাংলা তো বলতে পারে দেখলাম। ‘চায়’ নয়, ‘চা’ বলল। তবে গলার টান তো নেপালিদের
মতোই।”
আমি বললাম, “সে বাঙালি হোক বা না হোক, হঠাৎ আমাকে সে পুলিশ লিখে চিঠি দেবে কোন দুঃখে?”
প্রণব একবার হাতে নিয়ে
দেখল কাগজটা।
অমিয় খানসামাকে ডাকল। বেঁটেখাটো
লোকটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল।
“জি সাব।”
“আপ বঙালী
হ্যায় ক্যায়া?”
“না সাব। পাহাড়ি।”
“আচ্ছা। এই কাগজটা দেখুন
তো। এটা কোত্থেকে এল?”
খানসামা চিরকুটটা হাতে
নিয়ে দেখে ফেরত দিয়ে বলল, “মালুম নেহি সাব। বোধহয় আগের হপ্তায় যে বাঙালিবাবুরা এসেছিলেন, তাঁদের কিছু হবে। ফেলে গেছেন।”
অমিয় মাথা নেড়ে বলল, “তাই
হবে। সবথেকে কাছে কটেজ কোথায় আছে এখান থেকে?”
“সামনের টিলার ওইদিকে সাব।
আধাঘণ্টা লাগবে হেঁটে যেতে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি
যান।”
অমিয় কাগজটা বাইরে ফেলে দিয়ে
বলল, “ঠিকই বলেছে। আগের কোনও গেস্টের
কিছু হবে। ফেলে গেছে বোধহয়। বাদ দে, এই নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করিস না আর।”
আমি বললাম, “ঠিক আছে, বাদই
দিলাম।”
সারাদিন ভালই কাটল। আমরা
চারজনে মিলে পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটলাম। মাঝখানে একবার বরফ পড়তে শুরু করেছিল টুপটাপ,
মিনিট পাঁচেকের জন্য। অসিত হাঁ করে বরফ খেল কিছুটা। অমিয় একটা গাছের পাতা হাতে
নিয়ে মুঠো করে, দু’সেকেন্ড পর মুঠো খুলে অন্য একটা
গাছের পাতা বের করে দেখাল। প্রণব ইশারায় আমাদের ওর স্কুলের একজন দশ বছরের ছাত্রের
আসুরিক শক্তির গল্প শোনাল। দুপুর একটা
নাগাদ আমরা কটেজে ফিরে এলাম। এতক্ষণ পাহাড়ি রাস্তায়
হাঁটাহাঁটির ফলে শীতটাও কম লাগছিল এখন আমার। এর মধ্যে আমরা টিলার ওই পারের
কটেজগুলোও দেখে এসেছি। বেশ কয়েকটা বাঙালি পরিবার
আছে সেখানে। কয়েকটা গুজরাতি পরিবারও দেখলাম।
দুপুরে ঝিলম থাপা (আমাদের
খানসামা, তার নাম জানা হয়েছে) মাংস রেঁধেছিল। তা
ঠিকমতো সেদ্ধ না হলেও খেতে অমৃত লাগল। আমার একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছিল।
বললাম, “ঘণ্টাখানেক একটু গড়িয়ে নেওয়া যায়
কি?”
বাকিরা আমার প্রস্তাবে
সম্মতি দিল।
চার
ঘুমটা ভাঙল দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দে। খুলে দেখি অমিয়। বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে
একটা গোলাপি চিরকুট। আমি আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে জিজ্ঞাসা করলাম, “আবার ওটাকে
কুড়িয়ে আনলি কোত্থেকে?”
অমিয় বলল, “এটা তোর
চিরকুটটা না বিনু। এটা আমার দরজার সামনে ফেলে রাখা হয়েছে। এই দ্যাখ।”
আমি চমকে উঠে ওর হাত থেকে
চিরকুটটা কেড়ে নিলাম। খুলে দেখলাম, তার মধ্যেও
একটা ছোট্ট কাগজের টুকরো। তাতে লেখা ‘বাবু’, তার একটু নীচে লেখা ‘১০০০’।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে
বললাম, “এই কথাগুলোর মানে কী? কেউ
ইয়ার্কি মারছে আমাদের সঙ্গে?”
অমিয় রেগেমেগে বলল, “যে
মারছে হাতের সামনে পেলে তার হাড় গুঁড়ো করে
দেব। অমিয় সেনকে চেনে না সে। এখনও রোজ সকালে দেড়ঘণ্টা
ওয়েট লিফটিং করি।”
আমি হাত দেখিয়ে বললাম,
“উত্তেজিত হোস না, আগে বোঝার চেষ্টা করি। আমরা
বাদ দিয়ে তো কেউ নেই এখানে। আর আগের গেস্টেরও তো হতে পারে এটাও।”
অসিত আর প্রণবও তাদের ঘর
থেকে বেরিয়ে এসেছিল। অসিত কাগজটা হাতে নিয়ে
চোখ বড়ো বড়ো করে দেখল। আমি দেখলাম ভয়ে তার মুখ কালো হয়ে এসেছে। অসিত ঢোঁক গিলে
বলল, “বিনু, এগুলো কী? আমার ভয়ে লাগছে। ইংরেজি
ভূতুড়ে সিনেমাগুলোতে এসব হয়। আমি বরং কাল ফিরে যাই। পরের উইকে আমার একটা প্রজেক্ট
আছে। সেটার কিছু কাজ বাকি এখনও আমার।”
অমিয় ধমক দিয়ে বলল, “এই
পাগলা, চুপ কর তুই। আমার সাথে ইয়ার্কি
মারা অত সহজ নয়। এই নম্বরটার মানে কী? ১০০০? বাবু কার নাম?”
হঠাৎ করে বিদ্যুতের মতো আমার মাথায় একটা খেয়াল এল। আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললাম, “চোর-পুলিশ!”
অসিত আমার দিকে তাকিয়ে অবাক
হয়ে বলল, “মানে?”
আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম,
“মনে নেই? আমাদের সেই ছোটবেলার খেলাটা? চোর-পুলিশ-ডাকাত-বাবু? চারটে চিরকুটে চারটে
লেখা থাকবে। সবাই একটা করে তুলবে। বাবু যে হবে সে পাবে হাজার পয়েন্ট। আর পুলিশকে
বলতে হবে কে চোর, কে ডাকাত। ঠিক বললে পুলিশ পাবে সাতশো, আর না পারলে চোর তিনশো আর
ডাকাত পাঁচশো পয়েন্ট পাবে। আমরা চারজনেই তো
স্কুলে সারাদিন খেলতাম।”
প্রণব হাত নেড়ে আমার কথায়
সায় দিল। অসিতও চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সত্যিই তো। প্রথমেই
তো বোঝা উচিত ছিল।”
অমিয় ভারি গলায় বলল, “কিন্তু আমাদের সাথে চোর-পুলিশ কে
খেলতে চাইছে? আমাদের মধ্যেই কি কেউ?”
আমার বুকের মধ্যে কেমন
একটা করে উঠল। এই খেলাটা দিয়েই তো আমাদের বন্ধুত্বের সূচনা ছিল।
প্রণব কখন তার ঘরে গিয়েছিল
খেয়াল করিনি। হঠাৎ সে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এল আমাদের দিকে। আমি দেখলাম তার হাতে একটা
বাক্স। রঙ্গিন কাগজে মোড়া। যেমন জন্মদিনে গিফট প্যাক করে দেওয়া হয়।
আমরা নির্বাক হয়ে তাকালাম
তার দিকে। প্রণব বাক্সটা খুলল কাগজটা ছিঁড়ে। তারপর কিছু একটা বের করে আনতেই অসিতের
মুখ থেকে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল। আমি দেখলাম সেটা একটা রুমাল, যার রঙ এককালে পুরোটাই সাদা
হলেও আপাতত প্রায় সবটুকুই লালচে বাদামী হয়ে আছে। আর সেই লাল রঙটা আর কিছু নয়,
শুকিয়ে যাওয়া রক্ত। রুমালটা দেখে মনে হচ্ছে বহু পুরনো।
অমিয় আমাদের চমকে দিয়ে
চেঁচিয়ে উঠল, “ঝিলম, ঝিলম...”
কিছুক্ষণ পর ঝিলম থাপা হন্তদন্ত হয়ে উঠে এল উপরে। অমিয় এগিয়ে গিয়ে তার চোখের সামনে রুমালটা ঝুলিয়ে চিৎকার করে বলল, “মশকরা
পেয়েছ আমাদের সঙ্গে? ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা? এসব কী হচ্ছে?”
ঝিলম থাপা প্রথমে চমকে
গেছিল। তারপর দৃঢ়তার সাথে বলল, “আমি কিছু জানি না সাব। আমরা পাহাড়ি। ইমানদার মানুষ। গেস্টদের সাথে মজাক করি না। এর থেকে পেট চলে আমাদের। আপনাদের মধ্যেই কেউ দিল্লাগি
করছে।”
অসিত আস্তে আস্তে বলল,
“তোরা কী করবি জানি না, আমি কাল নেমে যাচ্ছি। যেমন
করেই হোক। ঝিলম, আমার ঘরের বুকিং কাল অবধি।”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে
বললাম, “একসাথে এসেছি, একসাথেই যাব। আমরাও নেমে যাব কাল।”
আমি প্রণবের দিকে তাকালাম।
সেও মাথা নাড়ল। অমিয় কিছু বলল না।
চারজন আমার ঘরে এসে বসলাম।
বহুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলছিল না। রিশপে কারেন্টের খুব অভাব। বেশিরভাগ সময়ই থাকে না। ঝিলম এসে দুটো মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখে গেল। রাত বাড়ার
সাথে সাথে শীতও বেড়ে চলল গতকালের মতনই।
প্রথম মুখ খুলল অমিয়, “আমার মনে হয় আমাদের মধ্যেই কাজটা করছে কেউ। কিন্তু কেন?”
আমি অমিয়র দিকে তাকিয়ে
বললাম, “কী, বলছিস কী তুই? বাচ্চাদের মতন
করিস না। আমাদের মধ্যে কেউ কেন করতে
যাবে এসব?”
অমিয় আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে
তাকিয়ে বলল, “যদি বলি তোর গল্পের প্লটের অভাব হয়েছে? এসব সাজিয়ে আমাদের ভয় দেখিয়ে
একটা মোক্ষম গল্প বাঁধতে চলেছিস?”
আমি অবজ্ঞার হাসি হেসে
বললাম, “তুই বোধহয় এখনও জানিস না আমার
খ্যাতি সম্পর্কে। গল্প লেখার জন্য এসব ছেলেমানুষি করতে হয় না আমাকে। তবে যা ম্যাজিকের মতো জিনিসপত্র ঘটছে তাতে সন্দেহ হওয়ার হলে কিন্তু...”
অমিয় আমাকে থামিয়ে বলল,
“ম্যাজিক? ম্যাজিক সম্বন্ধে তোর দৌড় ওই তাস আর জলের গেলাস। এই জায়গাটায় আসার
প্ল্যানও তো তোর। বাড়ি বুকিংও তো তুইই করেছিস। আমরা তো থাকি না এ দেশে। ওই
ঝিলম থাপার সঙ্গে কী সাঁট করেছিস আমরা জানব কী করে?”
আমি বললাম, “তুই হয়তো ভুলে যাচ্ছিস ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যানটা আমার নয়, অসিতের ছিল। আমি শুধু অপশন
দিয়েছিলাম কোথায় যাওয়া যায়। তুইই আমাকে বলেছিলিস সব বুক করে রাখতে।”
অসিত ভয়ার্ত গলায় বলল,
“আমাকে কেন টানছিস এর মধ্যে? তোরাই তো দেখা করতে চেয়েছিলি। তাই...”
অমিয় হঠাৎ অসিতের দিকে
তাকিয়ে বলল, “কী, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব? ক্ষ্যাপামি
বেড়ে গেছে নাকি এতখানি? ছোটবেলার খেলা আবার খেলতে ইচ্ছে করছে নাকি? দেখাব খেলা
কাকে বলে? দেখবি?”
আমি দেখলাম অসিতের মুখটা
পাংশু হয়ে গেছে। প্রণব অমিয়র সামনে এসে হাতজোড় করে দাঁড়াল নীরবে।
“সরে যা!” অমিয় এক ধাক্কা মেরে ফেলে দিল প্রণবকে।
“অমিয়, সাবধান!”
অমিয় আমার দিকে তাকিয়ে
দেখল ওর সোয়েটারের গলার কাছটা আমার হাতের মুঠোয় খিমচে ধরা। আমার চোখ, আর হাতের
পাকানো মুঠোর দিকে তাকাল একবার। মোমবাতির অল্প আলোয় দেখলাম ওর চোখের আগুনটা নিভে
এল। ও আজও জানে, আমি যতই নরম হই না কেন, এখনও গায়ের জোরে আমার কাছে হার মানবে।
আমি অমিয়র সোয়েটার ছেড়ে
দিলাম। অমিয় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি শুতে চললুম।” তারপর বাকি তিনজনের দিকে একবার বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
আমরা তিনজনে গল্প করার
চেষ্টা করলাম কিছুক্ষণ। কিন্তু আড়ষ্টতা এসে পড়েছিল। ভয়, উত্তেজনা, সন্দেহ সবকিছু মিশে
গিয়ে বন্ধুত্বটা হারিয়ে যাচ্ছিল কোনওভাবে। যা
আমি গত পঁয়ত্রিশ বছরে টের পাইনি।
আধঘণ্টা পর বাকিরা চলে
গেল। যাওয়ার সময় অসিত আমার দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিলে বলল,
“আচ্ছা, চোর আর ডাকাত কি তবে আমি আর প্রণব? তোকে ধরতে হবে
কোনটা কে?”
আমার ক্লান্ত লাগছিল।
বললাম, “এই নিয়ে আর ভাবিস না।
আজকের রাতটা যাক। সকালে তো ফিরেই যাব।”
অসিত মাথা নিচু করল। তারপর
বলল, “সরি, আমার জন্যই এসব হল। ঘুরতে আসার কথাটা তো সত্যিই আমি বলেছিলাম। কী
করে বুঝব বল তখন যে এসব ভূতুড়ে কাণ্ড হবে...”
প্রণব ওর কাঁধে হাত রাখল।
আমি বললাম, “যা, ঘুমিয়ে পড়। শুভরাত্রি।”
আমি শুয়ে পড়লাম। রক্তমাখা
রুমালটা দেখার পর থেকে যে আমারও অল্প ভয় লাগছে সেটা মিথ্যে নয়। তার থেকেও যা
ভাবাচ্ছে সেটা হল, সত্যিই কি আমাদের মধ্যে কেউ করছে এটা? কেন করছে? শুধুই মজা? নাকি অন্য কোনও কারণ?
শুয়ে শুয়ে ভাবতে ভাবতে
হঠাৎ মনে হল, জানালার কাছে যেন কে দাঁড়িয়ে আছে। কম্বলের মধ্যে দিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি একটা কালো মুখ। চোখগুলো জ্বলছে। প্রণব! হঠাৎ পাহাড়ের নীরবতা
খান খান করে সে তারস্বরে হাসতে শুরু করল...
আমি চমকে উঠে বসে দেখলাম,
ফোন বাজছে। হাঁফ ছাড়লাম। স্বপ্ন ছিল। গলা শুকিয়ে এসেছে। ক’টা বাজে? সকাল হয়ে গেল নাকি? নাহ, বাইরে
ঘুটঘুটে অন্ধকার। কার ফোন এত রাতে?
মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি,
অসিত। রিসিভ করলাম। “হ্যালো!”
“বিনু, আমার ঘরে একটা
চিরকুট... তাতে লেখা... আহহহ...”
একটা তীব্র আর্তনাদ আর ধুপ
করে পড়ে যাওয়ার শব্দ। ফোনটা কেটে গেল। আমার রগ শক্ত হয়ে গেল। অসিতের কিছু হলে ছাড়ব না কাউকে। কম্বলটাকে
ছুঁড়ে সরিয়ে দিয়ে উঠে আমি দৌড়লাম দরজার দিকে। বাইরে বেরিয়ে পাশের ঘরের দিকে তাকিয়ে
দেখলাম, অমিয়র দরজা হাট করে খোলা। ঘরে কেউ নেই। আমি দৌড়লাম অসিতের ঘরের দিকে। দরজা
ভেজানো। ছিটকিনি দেওয়া নেই। আমি দরজা ঠেলে ঢুকলাম।
“অসিত...”
মাথায় একটা প্রবল বেগে
আঘাত লাগল। মেঝেতে পড়ে গেলাম তৎক্ষণাৎ।
পাঁচ
চোখটা খোলার চেষ্টা করতেই
মাথায় ভয়ানক ব্যথা লাগল। বাঁ চোখের উপরেই লেগেছে আঘাতটা। রক্ত চুইয়ে নেমে চিবুক
হয়ে পায়ের পাতায় পড়েছে। মাথা ঘুরছে তীব্রবেগে। মনে হচ্ছিল আবার অজ্ঞান হয়ে যাব।
অনেক কষ্টে চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করলাম। মোমবাতির আলো। তাতেই বুঝলাম আমার থেকে দু’ফুট দূরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে
বসে আছে অমিয়। হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। চিবুক বুকে ঠেকে আছে। সারামুখ রক্তে ঢাকা।
সামনের দেওয়ালে আলমারির গায়ে আধশোয়াভাবে পড়ে আছে প্রণব। তারও গালের একপাশ রক্তে
ভেসে যাচ্ছে। সারা সোয়েটার রক্তে লাল। তবে বুকের ওঠানামা দেখে বোঝা যাচ্ছে বেঁচে আছে। হাত পা বাঁধা। তার পাশেই উপুড় হয়ে শুয়ে আছে
অসিত। তার দেহ সম্পূর্ণ নিথর। বাঁধনও নেই শরীরে।
আমার বুক কেঁপে উঠল।
চিৎকার করে উঠলাম, “অসিত...!”
আমাকে অবাক করে তড়াক করে
উঠে বসল অসিত। খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, “আরে, তুই উঠে গেছিস? বাকিরা উঠছে না কেন? দাঁড়া দেখি তো...”
অসিত একটা জলের বোতল হাতে
নিয়ে এগিয়ে গেল অমিয়র দিকে। ঠাণ্ডা জলের ছিটে অমিয়র মুখে লাগতেই সে শব্দ করে জেগে
উঠল। একইভাবে প্রণবকেও জাগাল অসিত।
আমার ব্যথায়, দুঃখে গলা
দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না। অনেক কষ্টে বললাম, “এসব কী
অসিত? তার মানে তুই...”
“ইয়েস। আমিই। এসব আমারই
কাজ। অবাক হলি নাকি?”
অমিয় চেঁচিয়ে উঠল,
“স্কাউণ্ড্রেল...”
তার গলা ভেঙে গেছে। আমি
যতটা সম্ভব জোরে ডেকে ওঠার চেষ্টা করলাম, “ঝিলম, ঝিলম...”
অসিত আবার হেসে উঠে বলল,
“লাভ নেই বিনু, লাভ নেই। তাকে আমি ঘুম পাড়িয়ে এসেছি যে! ঘুম ভাঙলেও আসার অবস্থায় থাকবে না। হাত
পা বাঁধা যে!”
আমার কান্না পেয়ে গেল। অস্ফুটে
জিজ্ঞাসা করলাম, “কিন্তু কেন?”
অসিত হঠাৎ ছুটে এসে আমার
ক্ষতস্থানে একটা আঙুল চেপে ধরে কর্কশ স্বরে বলল,
“কেন? কেন? মনে পড়ে সেই দিনটা? সেই
পরীক্ষার পরে পিকনিক? আমি একটা বাড়ির নিচ দিয়ে
গঙ্গা দেখতে দেখতে এগোচ্ছিলাম, উপর থেকে কেউ একটা থান ইট ছুঁড়ে মারল আমার মাথায়।
পারলি না চিনতে ওই রক্তমাখা রুমালটা? আজ
থেকে বাইশ বছর আগে ওই রুমালটাই মাথায় চেপে রক্ত থামানোর চেষ্টা করেছিলাম আমি। আমার
তারপর থেকেই সব গণ্ডগোল হয়ে গেল। আমি চাইলে কী না হতে পারতাম! তোদের সবার থেকে অনেক, অনেক বিখ্যাত গণিতজ্ঞ। পারলাম
না। আমার ব্রেইনের মেনিনজেসে এমন একটা আঘাত হল যে বেশিক্ষণ
কনসেনট্রেট করার ক্ষমতা চলে গেল আমার। বেশি ভাবলেই আমার মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যায়।
সব নষ্ট হয়ে গেল। সব...”
আমি যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে
বললাম, “কিন্তু তার জন্য আমাদের সাথে এরকম করছিস কেন তুই? আমরা তো বন্ধু তোর!”
“বন্ধু? তোরা বন্ধু? আমি
ভুলিনি বিনু। আমরা ছাড়া কেউ ছিল না ওখানে।
তোদের মধ্যেই কেউ উপর থেকে ইটটা ফেলেছিল আমার মাথায়। তুই ফেলিসনি আমি জানি। তুই
ভালবাসতিস আমায়। এখনও বাসিস। কিন্তু তুই
জানিস কে ফেলেছিল ইটটা। কে বিনু? প্রণব, না অমিয়? কে?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “আমি
জানি না, বিশ্বাস কর! কেউ ফ্যালেনি। বাড়ি থেকে কোনও ইট ভেঙে পড়েছিল হয়তো। আমরা
বন্ধু তোর।”
“ভুল উত্তর,” অসিত উঠে আমার পেটে একটা লাথি মারল। আমি ককিয়ে উঠলাম। এরপর সে চলে গেল ঘরের কোণার দিকে। ফিরে আসার পর দেখলাম,
মোমবাতির আলো যাতে প্রতিফলিত হয়ে ছিটকে যাচ্ছে তা একটি চকচকে ভোজালি।
অসিত ভোজালির ফলাটা আমার
গলায় ঠেকিয়ে বলল, “পুলিশ, বল, কে চোর? কে ডাকাত? সেই পুরনো খেলা। মনে পড়ে? বল বল।
পারলে সাতশো বছর বাঁচো। না পারলে...”
অসিত একটু চাপ দিল। আমার
গলা থেকে অল্প একটু রক্ত বেরিয়ে গড়িয়ে
পড়ল বুকে।
“আমি, আমি ফেলেছিলাম। ওকে ছেড়ে দে।”
অমিয় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“মনে পড়ে, তুই আমাকে পাঁচশো লোকের সামনে অপদস্থ করেছিলি ম্যাজিকের ট্রিকটা বলে দিয়ে? আমি বিশ্বাস করে
শিখিয়েছিলাম তোকে। তখন থেকেই আমি ঠিক করেছিলাম প্রতিশোধ নেব। কিন্তু আমি
ছুঁড়িনি ইটটা। আমি প্রাণপণে চেয়েছিলাম তোর ক্ষতি হোক। তখনই
দেখলাম, একটা ইট ভেঙে পড়ল তোর মাথায়।
ইচ্ছাশক্তি। ওই একবারই পেরেছিলাম।”
অসিত ঘৃণাভরে তাকাল ওর
দিকে। আমি অবাক হয়ে গেলাম। অমিয় তাহলে এটার কথাই বলছিল? ইচ্ছাশক্তি! যার প্রমাণ ও একবার মাত্র পেয়েছে!
অসিত গজরাতে গজরাতে বলল,
“তোদের কাউকে বিশ্বাস করি না আমি।
একটাকেও ছাড়ব না। সবক’টাকে মারব।”
অসিত প্রণবের চুলের মুঠি
টেনে ধরে ওর গলায় ভোজালিটা ধরল। প্রণবের চোখ ভয়ে বড়ো হয়ে গেল। আমি কাতর গলায় বললাম, “ওকে ছেড়ে
দে অসিত। ও কথাটুকুও বলতে পারে না। ওকে
মারিস না।”
অসিত নৃশংসভাবে বলল,
“চোখের সামনে দেখবি এক এক করে কীভাবে
মারব...”
ভোজালির ফলাটা ছুঁয়ে আছে
প্রণবের কন্ঠনালী। আমার
চোখ ফেটে জল এল। অসিতের পেছনে একটা আলমারি। তার
মাথায় একটা লোহার ট্রাঙ্ক। আমি সেটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সত্যিই কি হয় ইচ্ছাশক্তি বলে কিছু? ওটা যদি কোনোভাবে পড়ে অসিতের মাথায়... অমিয়র কথা যদি সত্যি হয়! এরকম কিছু ঘটতে পারে না কি? এভাবে
অনিচ্ছার মৃত্যু হবে আমাদের? তবে ওই বইটায় লেখা সব কথা ভুয়ো?
আমাকে অবাক করে ট্রাঙ্কটা
ধুপ করে পড়ল অসিতের মাথায়। আচমকা ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ায় অসিত তাল সামলাতে না পেরে
মাটিতে পড়ে গেল। তারপরে অবাক হয়ে উঠে বসল। আমি দেখলাম...
ভোজালির ফলাটা আমূল বিঁধে
গেছে ওর বুকের বাঁদিকে। হুমড়ি
খেয়ে পড়ে যাওয়ার সময় কোনোভাবে বুকে ঢুকে গেছে।
অসিতের দেহটা এলিয়ে পড়ল
মেঝেতে।
ছয়
এরপর কীভাবে নিজেদের বাঁধনমুক্ত করে পুলিসের সাহায্য নিয়ে সবকিছু মেটালাম সে আরেক
গল্প। এই ঘটনার মাসখানেক পরে আমি এয়ারপোর্টে এসেছিলাম অমিয়কে ছাড়তে। এখন ও
পুরোপুরি সুস্থ। সবথেকে বেশি আহত ওই হয়েছিল। এগারোটা সেলাই পড়ে কপালে। আমারও চারটে
সেলাই কপালে আর দুটো গলায়। প্রণবেরও
আমারই মতন। রিশপের কটেজের খানসামা ঝিলম থাপাকেও আহত করেছিল অসিত। তবে এখন আমরা সবাই
একদম ফিট। প্রণব তো দু’সপ্তাহ আগেই ফিরে গেছে পুরুলিয়া।
অমিয় আমাকে জড়িয়ে ধরল
যাওয়ার সময়। তারপর বলল, “দেখলি তো বিনু, ইচ্ছাশক্তি তোরও আছে। দু-দু’বার প্রমাণ পেলাম যে ইচ্ছাশক্তি
হয়। একবারের জন্য এতকিছু কাণ্ড হল, আর একবারের জন্য সেই কাণ্ড থেকে প্রাণে
বাঁচলাম। তবে শক্তি যে সবসময় ভাল বিষয়ের জন্য খরচ করতে হয় সেটার প্রমাণ পেলাম আমরা
আবার। এবার আমি এর রহস্য ভেদ করবই। ভাল থাকিস বিনু। চলি।”
আমি বাড়ি ফিরে এলাম। একমাস
কিচ্ছু লিখিনি। আবার লেখা শুরু করতে হবে। শেষ অবধি সবকিছু ভালোয় ভালোয় মিটে গেল।
শুধু এর দিন তিনেক বাদে
একটা চিঠি পেলাম। প্রণব পাঠিয়েছে। তাতে টাইপ রাইটারে লেখা...
আদরের বিনু,
দুটো কথা তোকে বলার আছে।
ভেবেছিলাম কোনোদিন বলব না, তবে
এখন মনে হচ্ছে বলে দেওয়াই ভালো। অমিয়র ইচ্ছাশক্তি আছে কি না জানি না, তবে এই ঘটনার জন্য আসলে দায়ী আমি। ছোটোবেলার সেই পিকনিকে অসিতের মাথায় ইটটা আমিই ছুঁড়েছিলাম। তার কারণও ছিল
প্রতিশোধই। তোর মনে আছে একবার তোর ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকা চুরির অপবাদ জুটেছিল
আমার মাথায়? সেই চুরিটা আমি করিনি। করেছিল অসিত। আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম। ওই
আমার ঘাড়ে দোষটা চাপিয়ে দেয়। আমি বলার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার অক্ষমতার জন্য
সেদিন কোনও সুযোগই পাইনি। সবাই এমন মারমুখী
হয়ে উঠেছিল যে ভয়ে আর কিছুই বলতে পারলাম না। তাই
সেদিন বদলা নেওয়ার সুযোগটা পেয়ে আর হাতছাড়া করিনি।
ও হ্যাঁ, রিশপের কটেজে
অসিতের উপর ট্রাঙ্কটা পড়ে যাওয়াটাও বোধহয় ইচ্ছাশক্তি নয়। আমি তোর চোখ দেখেছিলাম স্থির
হয়ে আছে আলমারির উপর দিকে। কিছু না বুঝেই মরিয়া হয়ে আমি পিঠ দিয়ে আলমারিতে ধাক্কা
মারি, ট্রাঙ্কটা পড়ে যায়। তবে ভোজালিটা কোন শক্তির জন্য ওর বুকে ঢুকেছিল জানি না। যাই হোক, এই দুটো ঘটনাই আশা করি তোর আর আমার মধ্যেই
থাকবে। ভালো থাকিস। যোগাযোগ রাখিস।
ইতি -
তোর স্নেহধন্য বন্ধু, প্রণব
_____
ছবিঃ সম্বুদ্ধ বিশী
ভালই
ReplyDeleteভালো গল্প।
ReplyDelete