গল্পের ম্যাজিক:: অসীমবাবুর ব্যাপারটা - শোভন নস্কর

অসীমবাবুর ব্যাপারটা

শোভন নস্কর

গতবছর ছুটিতে হঠাৎ মাসতুতো দাদার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। বিয়ে থা কিছু করেননি। পেশায় ডাকাবুকো পুলিশবয়সে আমার থেকে অনেক বড়ো হলেও বন্ধুর মতো সবকিছুই শেয়ার করেন। দিলখোলা মানুষভেবেছিলাম গরমের ছুটিতে দাদার কাছে বেশ কয়েকটা ক্রাইম কেস শুনবতারপর কোনও পত্রিকায় ঝেড়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু সে আর হল কই? দাদা তখন ব্যস্ত রেললাইনের ধারে এক খুনের কেস নিয়েতিনদিন বসে বসে গান্ডেপিন্ডে খাওয়া আর শোওয়া ছাড়া যখন কোনও কাজ হচ্ছে না, তখন ভাবলাম বিদায় নেব দাদা মুচকি হেসে বললেন, “দাঁড়া, তোকে একটা জিনিস দেখাচ্ছি” বলেই পুরনো একটা ফাইল বার করলেন।
“এই দ্যাখ,” বলেই ফাইলটা খুললেন“আমার জীবনে যা কয়েকটা ইন্টারেস্টিং কেস পেয়েছি সেগুলো সব এতে লেখাপড়তে পারিস, তবে মোস্ট ইন্টারেস্টিং ঘটনা হল এইটা।” বলেই দুটো সাদা কাগজ বের করে দিলেন। তাতে দেখলাম কারও হাতে একটা গল্প লেখা। দুপুরবেলায় আয়েস করে পড়লাম এবং স্তম্ভিত হয়ে গেলাম তেমন ঘটনা জীবনে কোনওদিন শুনিনি সেটাই তোমাদেরকে বলছি। বেশিরভাগটাই কারও লেখা গল্প। কিছু জায়গায় আমি একটু পরিবর্তন করেছি গল্পের স্বার্থে

শরৎচন্দ্রের বইটা পাশের টেবিলে রেখে দিয়ে অসীমবাবু আরাম কেদারায় ভালো করে হেলান দিয়ে বসলেনপড়ন্ত বিকেলে জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকালেন। গলি রাস্তা, লোকজনও অনেক কম। বসে বসে ভাবতে লাগলেন কী জীবন তিনি চেয়েছিলেন আর কী পেলেনছোটোবেলা থেকেই তিনি সাহিত্য, শিল্প এসব নিয়ে থাকতে পছন্দ করতেনইচ্ছা ছিল বড়ো সাহিত্যিক হবেনকিন্তু রাশভারী বাবার সামনে সে ইচ্ছাকে বর্জন করেছিলেনছিল একটা বড়ো মুদির দোকানভবিতব্য মেনে নিয়ে তিনি সেই ব্যবসায় লেগে পড়লেনমন দিয়ে ব্যবসাটা করলেনক্রমশ সেই ব্যবসা বাড়তে বাড়তে এখন তিনি কোটিপতি কলকাতার ওপরেই এখন তিনটে দোকান। একটামাত্র ছেলেকেও বিয়ে দিয়েছেনএখন তাঁর বয়স বাষট্টিব্যবসা ছেলের হাতে তুলে দিয়ে মনে করলেন এইবার শেষজীবনটা নিজের মতো করে বাঁচবেনসাহিত্যচর্চা করবেন আর গান শুনে কাটাবেন। পরিবারের সেখানে আপত্তি ছিল না, আপত্তিটা এল তখনই যখন ছেলে-বউ শুনল তিনি তাঁর বাগানবাড়িতে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন অনেক শখ করে তিনি শহর থেকে দূরে একটা বাগানবাড়ি বানিয়েছিলেন। মাঝেসাঝে পিকনিক করতে যেতেন বটে, কিন্তু পাকাপাকি থাকার কথা শুনে ছেলের তীব্র আপত্তিবাবাকে সে খুব ভালোবাসে তাই ওই বনজঙ্গলের মধ্যে থাকতে দিতে রাজী নয়শুনে অসীমবাবু ঘাড় নাড়িয়ে বললেন, “আহা আমি একা কোথায়, তোর মাও থাকছে তো!”
এতে ছেলের আপত্তি বাড়ল বই কমল নাবিরক্ত হয়ে বলল, “না বাবা, মা কোথাও যাবে না
ছেলের বউ হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, “বাবা আপনার যত্নে কোনও ত্রুটি হচ্ছে না তো!”
তিনি আর কথা বাড়ালেন নাআরাম কেদারায় শুয়ে ভাবতে লাগলেন, তাঁর নিজের ইচ্ছার কি কোন দাম নেই? নিজের সাথে দ্বন্দ্ব করতে লাগলেন মনে মনেকখনও নিজের কাছে হেরে যাচ্ছেন কখনও মন শক্ত করছেনভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়লেন খেয়াল নেইসন্ধ্যা হয়ে এলে অসীমবাবুর বউ সুমিত্রাদেবী এলেন চা নিয়েতিনি খুব শান্ত স্বভাবেরসংসারটা নিজে হাতে সামলেছেন, কিন্তু কোনওদিন অশান্তি হতে দেননি বাড়িতেএখন এই বয়সে এসে এ কী উদ্ভট ঝামেলায় পড়লেন! একটু রাগ এনে বললেন, “আচ্ছা, তুমি কী শুরু করেছ বলো তো?”
অসীমবাবু গম্ভীরভাবে চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “দেখ সুমিত্রা, আমার ছোটবেলাটা শুধু বাবার আজ্ঞা পালন করতে করতে চলে গেছেতবুও আমি সবকিছু করেছি। কোনওদিন রাগ আক্ষেপ সামনে আনতে দেইনিসংসারের সব সামলালাম, এবার নিজের মতো করে বাঁচব কিছুদিনএই বয়সে এসেও ছেলেমেয়েদের কথা শুনতে হবে বলছো?”
তাই বলে তুমি ওই বাগানবাড়িতে থাকবে? আর কোনও জায়গা নেই? কেমন জায়গা তাও ভালো করে জানা নেইআশেপাশে কোনও গ্রামও তো নেই
“আমি অমনই একটু শান্ত পরিবেশ চাই। সাহিত্যচর্চা করবখুব শখ একদিন কিছু লিখে নিজের বই বার...”
“বেশ, থাকো তোমার বই নিয়েআমি কিন্তু থাকব না বলে দিচ্ছি ওই আগানবাগানেছেলে-বউ ছাড়া থাকতে পারব না এই বয়সে। দুদিন যাক, সুড়সুড় করে চলে আসবে,” বেশ বিরক্ত হয়েই কথাগুলো বললেন সুমিত্রা
অসীমবাবু শুধু মুখের দিকে তাকালেন কিছু বললেন না

জায়গাটা উত্তর চব্বিশ পরগনার হরিপুর এলাকায়জায়গাটা এতটাই প্রত্যন্ত যে ওই নামে কোনও এলাকা আছে তাই কেউ জানে নাবনজঙ্গলে ভর্তিমানুষের ছাপ বলতে মাঝে মাঝে কিছু পোড়োবাড়ি দেখা যায়কোনও এককালে হয়তো এখানে অনেক লোক থাকত অসীমবাবুদের কলকাতা থেকে এখানে আসতেই বিকেল হয়ে গেলগাড়ি থেকে নেমে হাত তুলে একটু আড়ামোড়া খেলেন অসীমবাবু। বেশ মুক্তির গন্ধ পাচ্ছেন তিনি। ছেলে, ছেলের বউ, সুমিত্রা সব এসেছেন ছাড়তেশেষ অবধি বাবার কাছে হার মেনে ছেলের মুখটা গম্ভীরএকটা চাকর ঠিক করে দিয়েছে সে নাম শ্যাম কালো কুচকুচে দোহারা চেহারা তার হাট এখান থেকে চারমাইল দূরে। দুদিন অন্তর এসে খাবারদাবার দিয়ে যাবে, ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে অসীমবাবু একগাল হেসে বললেন, “আরে, অত ভাবিস না তো! তোর বাবা এখনও ম্যারাথন দৌড় দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বুঝলি?”
ছেলে বিরক্ত হয়ে বলল, “দেখ বাবা, কিছু হলেই ফোন করবেআমার এক বন্ধু আছে পাশের শহরে, সে এসে নিয়ে যাবে
“ঠিক আছে, ঠিক আছে অত ভাবিস না তো!”
সবাই এক এক করে বিদায় নিলসুমিত্রা খুব অভিমান নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেনকোনও কথাই বলেননি

সাতটার মধ্যেই ডিনারটা সেরে নিলেন অসীমবাবুচাকর শ্যাম সব গুছিয়ে সাইকেলে বাড়ি চলে গেল। তিনি জানালার ধারে এসে বসলেনএকটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন যেন সারাজীবনের কারাবাস থেকে মুক্তি পেলেন। কাল অথবা পরশু পূর্ণিমাআম-সুপুরিগাছে ভরা উঁচু পাঁচিল দেওয়া বাগানটা ঝকঝক করছে চাঁদের আলোয়। সাথে চরম নিস্তব্ধতা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে লাগলেনকিন্তু বারবার সুমিত্রার মুখটা মনে পড়তে লাগলযাই হোক, সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন কখন সে খেয়াল আর হল না
সকাল হতেই ভূত দেখার মতন চমকে উঠলেন অসীমবাবুএ যে সুমিত্রা! বেশ সুন্দর শাড়ি পরে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে। বেশ ভড়কে গিয়ে বললেন, “তু-তুমি কখন এলে?”
সুমিত্রা হা হা করে হেসে উঠলেন, “কখন আবার? রাতেই ফিরলাম। কিছুদূর গিয়েই খোকাকে বললাম দিয়ে আসতেআমি ছাড়া তোমাকে কে সামলাবে বল তো? ফিরে এসে দেখি যা ভেবেছিলাম তাইবাবু দরজা খুলে রেখে দিব্যি চেয়ারে বসে ঘুমুচ্ছেনখোকাকে ডাকতে বারণ করলামওই ধরে তোমাকে বিছানায় শুইয়ে চলে গেলমুখ ধুয়ে নাও, চা করছি
অসীমবাবু মুচকি হাসলেনবিয়ের পর থেকে একা থাকেননি। এবারও বউ তাকে ছেড়ে যায়নিতাছাড়া বহুদিন পর সুমিত্রার মুখে হাসি দেখতে পেলেন এমন পরিবেশে মন উৎফুল্ল হয়ে ওঠেঝপ করে মুখ ধুয়ে স্নান সেরে নিয়ে চেয়ারে বসলেনসুমিত্রা চা আর গরম গরম লুচি নিয়ে এসে হাজির।
“ওমা! এসব জিনিস কথায় পেলে?”
কেন, শ্যাম দিয়ে গেল যে বাজার করে! সেই ছ’টায় এসেছিল, তুমি তখন ঘুমিয়েবাজারটা দিয়ে বলল, কাল আসবে
“বাহ্‌! বেশ বেশ শ্যামবাবু বেশ কাজের মানুষ আছেন বলতে হবে
সুমিত্রাও স্নান করে এসেছিলেনখুব সুন্দর লাগছিল তাকেঅসীমবাবু দেখে গুনগুন করে গান গাইতে লাগলেনআহা, কতদিন সংসারের চাপে গান গাওয়াটাও ভুলে গেছিলেনপাশাপাশি বসে মাঝে মাঝে বউয়ের দিকে ফিরে গান গাইছিলেন আর একটা করে লুচি গালে দিচ্ছিলেনচমৎকার রান্না হয়েছেসাথে জানালা দিয়ে মনোরম দৃশ্যবললেন, “সুমিত্রা মনে আছে, যখন তোমাকে প্রথমবার দেখতে গিয়েছিলাম তখন তুমি কত ছোটো ছিলে?”
“হুম, মনে আছে
“বাবার সাথে গিয়েছিলাম দেখতেবাড়ি এসে হুকুম ছিল তোমাকেই বিয়ে করতে হবে। বেশ রাগ হয়েছিল জানো?”
“কেন?” বেশ উৎসুক হয়ে বললেন সুমিত্রা
“আরে, তখন আমার বয়স মাত্র একুশ। চোখে তখন কত স্বপ্নকিন্তু বিয়েটা করতেই হলঅবশ্য তুমি সব ভালোই সামলেছিলে, তাই দুঃখ পাইনি
সুমিত্রা মুচকি হাসলেন
সারা সকাল অসীমবাবু রবীন্দ্রনাথ নিয়েই কাটিয়ে দিলেন কিন্তু মন বসাতে পারলেন নাদুপুরে খেয়ে একটু বসেছিলেন পড়তে এমন সময় মনে হল তাঁর কিছু সাহিত্যরচনা করা উচিত কিন্তু সাদা পাতায় খসখস করে এক লাইনের বেশী এগোল নাসুমিত্রার সাথে গল্প করতে করতেই সময় চলে গেলবিকাল হলে পায়ে জুতোটা গলিয়ে হাঁটতে বেরোলেন বউকে নিয়েএভাবে একা বহুদিন বউকে নিয়ে হাঁটেননি

বাড়িটা আগে নাকি অন্য কারোর ছিলএকতলা বাড়ি, কিন্তু অনেকগুলো ঘরবয়স প্রায় বছর চল্লিশ হবে তবে অসীমবাবু অনেক পরিচর্যা করেছেন সামনের বারান্দা থেকে একটা পাকা রাস্তা সারা বাগান ধরে চলেছেচারপাশে আম-জামগাছে ভর্তিধার দিয়ে সুপুরি আর নারকেলগাছ। সূর্যটা পশ্চিমদিকে হেলে গিয়েছেগাছের ছায়াগুলো লম্বা লম্বা হয়ে গেছে ক্রমশ অন্ধকার হতে লাগলএখন বেলা অনেকটাই ছোটো হয়ে গিয়েছেআধঘন্টা হাঁটাহাঁটির পর বাগানের ভেতরে একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন দুজনে। পুরনো দিনের কত কথা চলতে লাগলসব অসীমবাবুই বলে গেলেন একা একাসুমিত্রাদেবী শুধু মুচকি হেসে সায় দিলেন ক্রমশ রাত গভীর হতে লাগল যেন উঠতেই ইচ্ছা করছিল না অসীমবাবুর। মাঝে বউ বললেন, “চল না এবার ওঠা যাকচা-টা খাবে চল।”
অসীমবাবু বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন, “কেন, কী হয়েছে বল তো? এতদিন বাদে এভাবে বসলাম, এত তাড়া কীসের?”
“কত রাত হয়ে গেছে দেখ
“তাতে কী? চাঁদের আলো আছে তো!”
“না না, জানো, জায়গাটা ভালো নয়
“কেন, কী হয়েছে?”
“অন্ধকার আর এই বাগান, কেউ থাকে এভাবে?”
“উফ্‌, তুমি না! এখনও তেমনই রয়েছএমন সুন্দর পরিবেশ কখনও পাবে তুমি? আকাশে বড়ো চাঁদ, চারদিক নিস্তব্ধ, ঠাণ্ডা ঠান্ডা হাওয়া আর এই ছাতিমফুলের গন্ধআহ্‌! সাহিত্যিকরা এমন জায়গা পেলে উঠতেই চাইত না
“হা হা হা... তুমি সাহিত্যিক বুঝি?”
“ন-না, ঠিক তা নইতবে ওনাদের মতন হওয়ার চেষ্টা করছি
“বেশ তো, কী লিখবে?”
“হুম, ভাবছি একটা গল্প লিখব
“কীসের?”
“ধরো একটা হাসির বা ভূতের
“বেশ বেশঠিক আছে, কালকের মধ্যেই তোমাকে একটা গল্প দেব
“বল কী! তুমি গল্প জানো নাকি?”
“জানি না মানে! কত্ত লিখতাম যখন সারদাবালা স্কুলে পড়তাম
“সারদাবালা? আমি জানতাম তুমি ভবানীপু...”
“ও হো ওখানেও পড়েছি ম্যাট্রিক দেওয়ার পরসারদা তো ছিল ক্লাস টেন পর্যন্ত
“আচ্ছা। বুঝলাম। তাহলে একটা রিকোয়েস্ট আছে
“বলো
“গল্পটা তুমি লেখ তোমার নামেই গল্পটা বেরোলে দারুণ হবে
শুনেই সুমিত্রা হা হা করে করে হেসে উঠলেনসে হাসি যেন চারদিকে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল আকাশ বাতাসেছাতিমফুলের গন্ধটা তীব্র হতে লাগল। সুমিত্রার গায়ের রংটা যেন আরও নীল হতে লাগল। অসীমবাবু চমকে উঠলেন

পরদিন সকালে আমার দাদা ওখানে কয়েকজন পুলিশ নিয়ে গিয়েছিলেন দু’টো দেহ উদ্ধার করতে। বাগানবাড়ির বাইরে ছাতিমগাছের ডালে শ্যামকে আর বাড়ির ভেতরে নারকেলগাছের মাথায় স্বয়ং অসীমবাবুকে পাওয়া যায়দু’টো মৃতদেহই ছিল রক্তশূন্য অবস্থায়অসীমবাবুর ছেলেকে দেখা যায় একা একা কাঁদতেশুধু সুমিত্রাদেবী এই দু’টো কাগজ দাদার হাতে দিয়ে বললেন, “এই সুমিত্রাকে খুঁজে দিতে পারবেন?”
এরপর দাদা প্রায় দু’বছর ধরে কেসটার তদন্ত করেও কোনও কুলকিনারা পাননি
_____
ছবি - লেখক

1 comment: