ভ্রমণ:: টো টো কাহিনি - তাপস মৌলিক


তিরিশ বছর আগের কথা। কলেজে পড়ি, হোস্টেলে থাকি। পড়াশুনো তো ঘন্টা করি! খালি আড্ডা, সিনেমা আর দু’দিন ছুটি পেলেই ক’জন বন্ধু মিলে যেখানেসেখানে বেরিয়ে পড়া, ঘুরতে। কিন্তু ঘুরব যে, পকেট তো ঢুঢু! প্রধান ভরসা তাই এগারো নম্বর, শোওয়ার জন্য হট্টমন্দির খুঁজি, খাওয়ার জন্য ‘যত্রতত্র’ নামের কোনও হোটেল। সদ্য লায়েক হয়েছি, দুনিয়ার কাউক্কে পরোয়া করি না, যদি কেউ উলটো গায় তো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দি।
তখন ভাবতাম হুজুগ, নেশা। এখন বুঝি, নিজেদের অজান্তেই কখন যেন কলেজ ছাড়িয়ে আদি ও অকৃত্রিম এই পৃথিবীর পাঠশালার ছাত্র হয়ে গেছিলাম...

অযোধ্যা কাণ্ড
রেডি-স্টেডি-গো

জনগণ যেভাবে বেড়ানোর প্ল্যান করে, আমরা করি তার উলটোলোকে গরমে যায় শীতের দেশে আর শীতকালে গরমের দেশে। আমরা খুঁজে খুঁজে এমন জায়গা বার করলাম, এই গরমে সেখানে লোকে বেড়াতে যাবে কি, স্থানীয় মানুষই পালাতে পারলে বাঁচে।
       আমাদের বেড়ানো মানে পরীক্ষার পর। ফেব্রুয়ারি-মার্চে যতই মনোরম আবহাওয়া, কোকিলের ডাকাডাকি ইত্যাদি থাকুক না, বেড়াতে যাওয়ার চিন্তা মাথায় এলেই সটান ফেল করে যাওয়ার সম্ভাবনা। আবার নেশাটা এমন চেপেছে মাথায় যে পরীক্ষার পরও কোথাও বেড়াতে না গেলে শোকে-দুঃখে সামনের বছর পড়াশোনাই হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে।
       সুতরাং – যাব। কোথায়? অযোধ্যা পাহাড়। দারজিলিং-টিংয়ে যাওয়ার পয়সা নেই। থাকার জায়গাও পাব কিনা সন্দেহ – এত ভিড়! সমুদ্রের ধারেও একই অবস্থা। ভাস্কর তাই বলল, “অযোধ্যা পাহাড় চল। এই গরমে ওখানে কেউ যাবে না। ফাঁকা থাকবে। অফ সিজন বলে সস্তাও হবে।”
       অযোধ্যা পাহাড়ের কেবল নামটুকুই শুনেছি আমরা, আর জানি জায়গাটা পুরুলিয়ায়। শঙ্কর বলল, “পাহাড় যখন নাম দিয়েছে একদম সমতল নিশ্চয়ই হবে না, একটু উঁচুনিচু হবেই। গাছপালাও আশা করি থাকবে। দু’একটা ঝরনা পাওয়া গেলে তো পোয়া বারো, তলায় দাঁড়িয়ে স্নান করা যাবে। দেখাই যাক না গিয়ে।”
       বাইশে মে পরীক্ষা শেষ গরমের ছুটি পড়ে গেল। দু’দিন বাড়িতে মুখ দেখিয়ে চব্বিশে হোস্টেলে ফিরে এলাম। হোস্টেল ফাঁকা। সবাই বাড়ি চলে গেছে। ক্যান্টিনও বন্ধ। সব শুনশান। একা একা ভূতের মতো অপেক্ষা করে যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছি যে - শঙ্কর-ভাস্কর আর এলো না আজ, নিশ্চয়ই বাড়ি থেকে ব্যাগড়া দিয়েছে – তখন রাত সাড়ে দশটার সময় বাবুরা এলেন। ভাস্করের কাঁধে একটা শান্তিনিকেতনি ঝোলা ভর্তি কাঁচা পেয়াজ। বাড়িতে নাকি বলেছে, গরমের দেশে যাচ্ছিস, কাঁচা পেয়াজ সঙ্গে রাখিস। ভাস্কর তাই তিন কিলো কিনে এনেছে, মাথাপিছু এক কিলোশঙ্কর বলল, অযোধ্যা পাহাড় নিয়ে সব রিসার্চ-টিসার্চ কমপ্লিটওখানে নাকি একটা ইয়ুথ হোস্টেল আছে, থাকার কোনও চিন্তাই নেই।

       পরদিন ভোর ছ’টায় বর্ধমান লোকাল ধরলাম। ট্রেন ছাড়তেই তারস্বরে তিনজনের গান শুরু হলটিকিট নেই, তাই গানই ভরসা! বিশেষ করে ভাস্কর যদি গান গায় তাহলে টিকিট চেকার ত্রিসীমানায় ঘেঁষে না। বর্ধমান থেকে আরেক ট্রেনে দুর্গাপুর। তখন বাজে এগারোটা। এবার পুরুলিয়া যেতে হয়। একটা বাস পেলাম। অন্য সময় হলে ছাদেই উঠতাম, কিন্তু রোদে চাঁদি ফেটে যাওয়ার জোগাড়। অগত্যা ভিড় গুঁতিয়ে ভেতরে ঢুকতে হল।
       ভেতরে দমবন্ধ ভিড়। তিনজনই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘেমে ঝোল। এমন সময় ভাস্কর ব্যাগ থেকে একটা কাঁচা পেয়াজ বার করে বাধ্য ছেলের মতো খোসা-টোসা ছাড়িয়ে খেতে আরম্ভ করল, আর তাই দেখে শুরু হল শঙ্করের হাসি ছোঁয়াচে রোগের মধ্যে হাই-এর পরই বোধহয় হাসি। একটু বাদেই যা ভয় পাচ্ছিলাম তাই হল। ভাস্কর হাসতে শুরু করল, শেষে আমিওআমাদের হাসি একবার শুরু হলে থামা মুশকিল। কিছুক্ষণ পর আর হাসছি কেন মনে থাকে না, তাই থামব কেন সেটাও মাথায় আসে না। আশেপাশে যারা বসে বা দাঁড়িয়ে ছিল তারা প্রথমে নিজেদের সাজপোশাক ইত্যাদি ভালো করে পরীক্ষা করে তারপর একে অন্যকে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। অনেক গবেষণা করেও কোনও হাসির উৎস খুঁজে না পেয়ে কেউ বাইরের দৃশ্যে মন দিল, কেউ বা ঘুমের চেষ্টায় চোখ বুজল। কেবল এক ভদ্রলোক আমাদের দিকে এমন কটমট করে তাকাতে লাগলেন যেন এখুনি ভস্ম করে দেবেনআমাদের অট্টহাসি তখন প্রায় ক্লাইম্যাক্সে, পেট ব্যথা হয়ে গেছে হাসতে হাসতে। হঠাৎ লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে ভাস্করের জামা খামচে ধরলেন, “হাসছিস কেন? অ্যাঁ? ইয়ার্কি পেয়েছিস?” তাঁর চেহারা বেশ তাগড়াই, গায়ে জোর আছে বোঝা যায়কিন্তু ভাস্করের হাসি থামবে কি, বাড়ল আরওজামা ধরে দু’বার ঝাঁকুনি দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, “অসভ্য জানোয়ার! ফের হাসি?”
শঙ্কর তড়িঘড়ি গিয়ে ছাড়াল ভাস্করকে, “আহা, ঘাবড়াচ্ছেন কেন! আমরা কি আপনাকে দেখে হেসেছি? আমি হাসছি ওকে দেখে, ও হাসছে আমায় দেখে। আপনাকে নিয়ে হাসব কেন? আপনিই বলুন না, আপনাকে দেখে কি হাসি পায়?”
ততক্ষণে আশেপাশের লোকজন জোর করে তাঁকে বসিয়ে দিয়েছে। বসে বসে তিনি গজরাতে লাগলেন, “আবার বলে ঘাবড়াচ্ছেন কেন! হ্যাঃ! ঘাবড়াব আমি? তোদের মতো পাঁচটাকে...” - এই বলে নিজের কীর্তিকাহিনি শুরু করলেন। বোঝা গেল তিনি পুলিশের লোক
ভাস্কর তখনও মাঝেমধ্যে খুক্ খুক্ করছিল, তাই দেখে শঙ্কর এক ধমক লাগাল, “আবার হাসছিস? জানিস না – যত হাসি তত কান্না, বলে গেছে রাজেশ খান্না?”
ব্যাস, আর যায় কোথা! ফের অট্টহাসি।

পুরুলিয়া

দু’টো নাগাদ পুরুলিয়া পৌঁছলাম। খিদেয় তখন আমাদের পেট চুঁইচুঁই করছে। বাসস্ট্যান্ডেই একটা ঝুপড়ি হোটেলে ঢুকলাম। বাইরে লু বইছে। ভেতরে আরও গরম। তবে অন্ধকার অন্ধকার বলে একটু স্বস্তি – চোখের আরাম। স্কুলের ক্লাসরুমের মতো কাঠের ফুলবেঞ্চি – হাফবেঞ্চি পাতা। খাওয়াদাওয়া যে খুব জমল তা নয়, চলে যায় আর কি! ভাত, ডাল আর একটা তরকারি। মাছ নেই। ভাস্কর মাছ খাবে বলছিল। হোটেলকাকু বলে, “মাছ কোথায়? জলই নেই তো মাছ! এ বছর একদিনও বৃষ্টি পড়েনি এখনও। খাল, বিল, পুকুর সব শুকিয়ে পচে বরবাদ হয়ে গেছে। মাছ বলতে কলকাতা থেকে বরফ দেওয়া মাছ আসে, তার বারো আনা রাস্তাতেই গরমে খারাপ হয়ে যায়।”
       হোটেলকাকুর কাছে অনেক তথ্য পাওয়া গেল। এমন ভাবলেশহীন মুখে ভাস্কর ‘হোটেলকাকু হোটেলকাকু’ করছিল যে ভদ্রলোকের মনে একবারও সন্দেহ হল না ভাস্কর ইয়ার্কি করছে। কলকেতার তিনটে দামড়া দামড়া ছেলে ওকে কাকু বলছে, খুশিতে গদ্গদ। এখান থেকে বাসে যেতে হবে বাঘমুন্ডি। ঘন্টা দেড়-দুই লাগবে। তারপর পাহাড়ে ওঠার হাঁটাপথ। ষোলো কিলোমিটার হাঁটলে অযোধ্যা পাহাড়ের মাথায় ইউথ হোস্টেল। রাস্তায় জিপও চলে।
হোটেলকাকু বললেন, “আপনারা তো আর অত হাঁটতে পারবেন না! আর এখন বাস ধরে বাঘমুন্ডি পৌঁছে জিপ পাবেন কিনা সন্দেহ। তার চে আজ এখানে থেকে যান। কাল সকালে যাবেন।”
এসব নেগেটিভ কথাবার্তা শুনেই আমরা তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম। জিপের সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক? পয়সা কোথায় যে জিপ ভাড়া করব? আমরা যাব এগারো নম্বরে।
       বাঘমুন্ডির বাস তখন ছাড়ছে। সে যা বাস! চলে এই যথেষ্ট। চলে অবশ্য মন্দ নয়। কিন্তু দরজা –জানালা সব খোলা; হা হা করে গরম হাওয়া ঢুকছে। একটু পরেই গরম কাকে বলে টের পেলাম। রাস্তার দু’পাশে ফাঁকা মাঠ। এদিকসেদিক ছড়ানো ছেটানো ক’টা গাছ। রোদের তেজে মাঠের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। হাওয়ার ঝাপটায় মনে হচ্ছে বুকের ভেতর অবধি শুকিয়ে যাচ্ছে। বাসে লোক বেশি নেইবেশিরভাগই স্থানীয় আদিবাসী, গরিব মানুষসিটে বসার মতো আত্মবিশ্বাসটুকূও তাদের নেই। সিট ফাঁকা পড়ে আছে, তারা জড়সড়ো হয়ে মেঝেতে বসে। তবে ওদের একটা টেকনিক খুব কাজে লাগল আমাদেরগামছা ভিজিয়ে নিংড়ে নিয়ে মাথায়-মুখে জড়িয়ে বসলাম। কী আরাম! এতক্ষণ যে গরম হাওয়া সোজা ঝাপটা মারছিল চোখেমুখে সেটা এয়ারকন্ডিশনড হয়ে গেল। শঙ্করের অবশ্য এসব দেহাতি টোটকা পছন্দ হল না। সে টুপি, সানগ্লাস ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

       একটু পরেই সমতল মাঠে ঢেউ খেলে গেল। রাস্তায়ও ঢেউ লেগেছে। বাসের সামনের জানালা দিয়ে সোজা তাকালে রোমাঞ্চকর লাগছে। সটান নাকবরাবর কালো রাস্তা। দু’পাশে গাছ। কখনও রাস্তা নিচের দিকে ডাইভ দিচ্ছে, আবার কখনও ওপরে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে। নিচ থেকে মনে হচ্ছে ওখানেই সব শেষ। দু’পাশে ছোট ছোট টিলা আরম্ভ হয়েছে। এমন সময় শঙ্কর জানালা দিয়ে দূরে দেখিয়ে বলল, “ওই দ্যাখ!”
পাহাড়। সবুজ পাহাড়ের রেঞ্জ গোটা উত্তরপশ্চিম দিগন্ত জুড়ে। মাঠ থেকে ওঠা ভাপে অল্প অল্প কাঁপছে। ডানদিকের টিলাগুলোর সাইজ আস্তে আস্তে বাড়ছে। কয়েকটা বেশ উঁচু পাহাড় রাস্তার খুব কাছে এসে পেছনে সরে গেল। তবে সবই মাটির পাহাড়। গাছপালা দিয়ে ঢাকা। পাথর নেই। শঙ্কর বলল, “দূর, এরকম বোকা বোকা পাহাড় আমার ভাল্লাগে না। রক চাই। মাসল চাই। এই পাহাড়গুলো সব বাচ্চা। হাত-পা এখনও নরমসরম, মাসল গজায়নি।”
ভাস্কর বলে, “বাচ্চা কী রে! এগুলো তো হিমালয়ের চেয়েও পুরোনো!”
শঙ্কর বলল, “তাহলে সব রক হাওয়ায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে মাটি হয়ে গেছে।”
তক্কাতক্কির মধ্যেই ডানদিকের সিনারিতে এমন একটা পরিবর্তন এল যে তর্ক আপনি থেমে গেল। রাস্তা থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে একটা বিশাল রকফেস সোজা নব্বুই ডিগ্রীতে ওপরে উঠে গেছে। বিরাট এক রকি পাহাড়ের রেঞ্জ। সবচেয়ে উঁচু চুড়োটা দেড়হাজার ফিট মতো হবে। আমরা যেদিকটা দেখছি সেদিক একেবারে ভার্টিকাল। মাঝে মাঝে ফাটল আছে, তাতে কিছু ঘাস গজিয়েছে, গাছপালার প্রশ্নই নেই। বাসের এক দাদুকে জিগ্যেস করে জানা গেল পাহাড়টার নাম মাঠাবুরু। শঙ্কর অমনি লাফিয়ে উঠল, “মাঠাবুরু! আমি জানি। এখানে রক ক্লাইম্বিং কোর্স হয়। বাবলিদারা এসেছিল।”
       তারপর শঙ্করকে আর দেখে কে! এই খাড়াই রকফেসেও কীভাবে ফাটল ধরে ধরে পিটন পুঁতে, রোপ লাগিয়ে, ক্যারাবিনার বেঁধে রক ক্লাইম্বিং করতে হয় তা আদ্যোপান্ত আমাদের বুঝিয়ে ছাড়ল। বুঝলাম ওর বাবলিদার কাছে শুনে শুনেই শঙ্কর রক ক্লাইম্বিং-এ এক্সপার্ট হয়ে গেছে। ভাস্কর তখন নেশাখোরের মতো আপনমনে গান গেয়ে চলেছে –
‘আকাশে সবুজ মেঘ, জলে ছায়া লাল
সেই জলে স্নান করে হরিদাস পাল’
ভাস্কর যখন গান গায়, বুঝতে হবে সে বেশ খোশমেজাজে আছে।


বাঘমুন্ডি

মিনিট পনেরোর মধ্যে বাঘমুন্ডি এসে গেল। নামলাম। ঘড়িতে বাজে সাড়ে চারটে। বাসরাস্তা থেকে ডানদিকে একটা কাঁচা রাস্তা বেরিয়েছে। মোড়ে পাঁচ-ছ’টা মাটির দেওয়ালের দোকানঘর। খড়ের চালা, সামনে বারান্দার ওপর বাঁশের খুঁটির ঠেকনা। একটা মিষ্টির দোকান, একটা পান-বিড়ির, একটা মুদির, একটা কাপড়ের আর বাঁশের বেঞ্চিপোঁতা চায়ের দোকান একটাচার-পাঁচজন লোক ওই চায়ের দোকানেই বাসের জন্য বসে ছিল। বাস চলে গেল। ধোঁয়া, ডিজেলের গন্ধ আর ধুলো থিতিয়ে যেতেই জায়গাটা চুপচাপ হয়ে গেল। বাস থেকে নামল যারা তারাও দেখি এদিকওদিক হুশহাশ করে হারিয়ে গেল। এতক্ষণে মনে হল ব্যাপারটা বেশ জমেছে। বেড়ানোর মুডটা আসছে।
       ভাস্কর বলল, “চল, আগে চা খাই।”
চায়ের দোকানেই চোখেমুখে একটু জল দিয়ে বেশ পোসকের ঝরঝরে লাগল। বেঞ্চিতে একটি লোক বসে আছেন। খালি গা, ধুতি পরা, তবে হেটো-মেঠো নয়, বেশ ভদ্দরলোক। চা খেতে খেতে জিগ্যেস করলাম, “এই মাটির রাস্তাই কি অযোধ্যা পাহাড় গেছে?”
ভদ্রলোক বললেন, “হ্যাঁ, আপনারা কোথায় যাবেন?”
       “অযোধ্যার ইউথ হোস্টেলে যাব।”
       “আজ তো আর জিপ পাবেন না, ফের কাল সকালে।”
       “জিপ কী হবে? হেঁটেই যাব।”
       “তিনটে নাগাদ ডেপটি রেঞ্জার সাহেব ওপরে গেলেন; তখন এলে তাঁর জিপে চলে যেতে পারতেন। আজ আপনাদের এখানেই থাকতে হবে।”
       “এখানে থাকার জায়গা কোথায়?”
       “জায়গা বলতে এই দোকানঘর। সন্ধ্যেকালে এসে পড়লে এখানেই থাকে সব।”
       শঙ্কর বলল, “তবেই হয়েছে! ভাস্কর, চল চল তাড়াতাড়ি কর। আজই পৌঁছতে হবে ইউথ হোস্টেল
       ভদ্রলোক পান চিবোতে চিবোতে বললেন, “পৌঁছটে টো রাটটির হয়ে যাবে।”
       “কেন? কতক্ষণ লাগে? ষোলো কিলোমিটার না?”
       “আমাডের টো ডেড়-ডু ঘন্টা লাগে। জঙ্গলের মঢ্যি ডিয়ে যাই। শর্টকাট হয়।”
       আমাদের হাঁটার স্পিড ভালোই। দু’ঘন্টা লাগলেও সাড়ে ছ’টা-পৌনে সাতটায় পৌঁছে যাওয়ার কথা। মে মাসের শেষ। বেলা বেশ বড়ো এখন। তাছাড়া একটু পশ্চিমেও এসেছি। সাড়ে ছ’টা অবধি আলো থাকা উচিততাই জলের বোতল ভরে নিয়ে চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। ভদ্রলোক পেছন থেকে বললেন, “সাবধানে যাবেন দাদারা। জন্তুজানোয়ার আছে।”
       ভাস্কর বলল, “হাতি মেরা সাথি, ভালু মেরা নাতি।”

লাল মাটির রাস্তা। জিপের আর গরুর গাড়ির চাকার দাগে ভর্তি। বহুদিন বৃষ্টি না হওয়ায় দু’পাশে গাড়ির চাকায় ধুলো হয়ে গেছে। গোড়ালি ডুবে যায় ধুলোতে। মাঝখানটা তবু একটু আঁটো আছে, ধুলো কম। দু’তিন সারি বাড়িঘর পেরোতেই বাঘমুন্ডি গ্রাম শেষরাস্তার দু’পাশে ফাঁকা চাষের খেত, সামনে জঙ্গলভরা পাহাড়। চাষের খেতগুলোর ওধারেও দূরে দূরে কতগুলো গ্রাম দেখা যাচ্ছে। রাস্তা থেকে নেমে গরুর গাড়ির চাকার দাগ সেসব দিকে গেছে। হাল্কা কথাবার্তার আওয়াজ আসছে গ্রামগুলো থেকে। হাওয়া দিচ্ছে ভালোই, তবে এখন আর হলকা নয়, বেশ আরামই লাগছে।
       ধুলোর চোটে তাড়াতাড়ি হাঁটার উপায় নেই। জঙ্গলের দিক থেকে একপাল গরু নিয়ে একজন হেটো-মেঠো সাঁওতাল দাদু মাঠ ভেঙে আসছিলেন। রাস্তায় উঠে আমাদের মুখোমুখি হতেই ভাস্কর ধরল দাদুকে, “সর্দার, জঙ্গলের রাস্তাটা কোনদিকে?”
       “কোথায় যাবেন?”
       “অযোধ্যা পাহাড়সোজা রাস্তায় যেতে তো প্রচুর সময় লাগবে, জঙ্গলের রাস্তাটা কোনদিকে?”
       “এই টেলিগ্রাফের লাইন ধরে চলে যান। ওই বরাবরই রাস্তা, একেবারে সিধে বনবাংলো গেছে।”
       “কতক্ষণ লাগবে?”
       “তা সন্ধে তো হবেই! একটু তাড়াতাড়ি চলবেন, তালেই হবে।”
       টেলিগ্রাফের খুঁটিগুলো এতক্ষণ রাস্তার পাশে পাশে পোঁতা ছিল। একটু দূরে দেখলাম ডানদিকে মাঠে নেমে সোজা জঙ্গলের দিকে চলে গেছে। ভাস্কর বলল, “আইডিয়া মন্দ নয়! টেলিগ্রাফ লাইন সাধারণত শর্টেস্ট রুটে যায়। ওটাকে ফলো করলেই হবে।”
       রাস্তা ছেড়ে মাঠে নেমে পড়লাম; ধুলোর হাত থেকে অন্তত রেহাই। তিন-চারশো মিটার পরেই মাঠ শেষ হয়ে জঙ্গল শুরু হয়ে গেল। রোদ যদিও পড়ে এসেছে, ছায়া পেয়ে হাঁটতে আরও সুবিধে হল। পায়ে চলা সরু রাস্তা; তবে বেশ ভালোই ব্যবহৃত হয়। স্থানীয় লোকেরা বোধহয় বড়রাস্তা কেউ মাড়ায় না। ও রাস্তা তো অনেক ঘুরে ঘুরে পাহাড় পেঁচিয়ে উঠেছে। গাড়ি ওঠার সুবিধের জন্য চড়াইও বেশি রাখা যায়নি। আর এই সুঁড়িপথ চলেছে একদম খেয়ালখুশিমতো। প্রথম চড়াইটা উঠতেই তার বিশেষত্ব টের পেলাম। চড়াই বলে চড়াই! হাঁপিয়ে ঘেমেনেয়ে একাকার কাণ্ড!

শর্টকাট

কিছুক্ষণের মধ্যেই জঙ্গল ঘন হয়ে এল। পেছনদিকে তাকালে আর সমতল দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে গভীর জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়। উল্টোদিকের পাহাড়টার চুড়োর কাছে গাছগুলোয় তখনও রোদ আছে, কিন্তু আমরা যে রাস্তা ধরে হাঁটছি সেখানে ক্রমশ ছায়া ঘন হয়ে আসছে। ভাস্কর বলল, “তাড়াতাড়ি চল, জঙ্গলে তাড়াতাড়ি সন্ধে হয়।” তাড়াতাড়ি তো চলব, কিন্তু পারলে তো! একে তো সারা শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম বইছে, পা বেয়ে ঘাম নেমে জুতোর মধ্যে প্যাচপ্যাচ করছে, তার ওপর চড়াই। হাঁফ ধরছে, জলতেষ্টা পাচ্ছে। পাহাড়ি রাস্তায় চলে কি আর অভ্যেস আছে? কাঁধের ব্যাগটা ভয়ানক ভারি লাগছে। রাগ হচ্ছে এত ফালতু জিনিস বয়ে এনেছি বলে। তার মধ্যেই যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি হাঁটার চেষ্টা করছি, সন্ধের আগে যাতে পৌঁছনো যায়।
       আগে আগে ভাস্কর হাঁটছিল। বেশ চলছিলাম। হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে পড়ে বলে উঠল, “দেখেছ কান্ড!” আমি আর শঙ্কর ওর কাছে যেতেই ব্যাপারটা বুঝলাম। এতক্ষণ রাস্তাটা টেলিগ্রাফের লাইন বরাবর এগোচ্ছিল। এখানে দেখি তারটা একটা খাদ পেরিয়ে ওপাশের পাহাড়ে চলে গেছে। এদিকের পাহাড়ে একটা পোল, ওপারের পাহাড়ের মাথায় আরেকটা। রাস্তাটাও অবিশ্যি সেদিকেই গেছে। তবে তারের মতো অত সহজে নয়। ঘুরতে ঘুরতে নিচে নেমে গেছে একেবারে খাদে, তারপর খাড়া উঠেছে আবারতার মানে একটা টেলিগ্রাফের খুঁটি পেরোতে কমপক্ষে আধঘন্টা লাগবে আমাদেরএকেই বলে শর্টকাট!


       নামা শুরু করলাম। এটা অনেক সহজ। হাঁপাতে হয় না। দুদ্দাড় করে নেমে গিয়ে একেবারে খাদে। এখানে প্রায় অন্ধকারই হয়ে এসেছে। বড়ো বড়ো গাছ, কাঁটাঝোপ। টেলিগ্রাফের তার আর দেখা যাচ্ছে না। তবে রাস্তা তো ওদিকেই গেছে, চড়াই উঠলেই ফের পেয়ে যাব। খাদটা দিয়ে মনে হয় বর্ষাকালে জল বয়। বোল্ডার ছড়ানো ইতস্তত, মাটিটা কীরকম কাদা-কাদা, তবে জল নেই।
       আবার চড়াই। আবার হাঁপানো, ঘাম, কষ্ট। আমার জুতোটায় মনে হচ্ছে ফোসকা পড়ছে পায়েকিন্তু এখন আর ওসব ভাবার সময় নেই। হাঁইহুঁই করে খালি উঠছি। কিছুটা উঠেই টেলিগ্রাফের তার ফের দেখা গেল। নিশ্চিন্ত লাগল একটুরাস্তা ঠিকই আছে। মনে হচ্ছে ওই তারটাই আমাদের লাইফলাইন! কিন্তু পোলটা আসছে না কেন? এত সময় তো লাগার কথা নয়! কতক্ষণ যাবৎ শুধু চড়াই ভেঙেই চলেছি! অধৈর্য লাগছিল খুবআসলে চড়াই ভাঙার সময় মনে হয় যেন রাস্তা আর ফুরোচ্ছে না। যে হারে গলদঘর্ম হচ্ছি সে তুলনায় এগোচ্ছি তো সামান্য!
       একটা মোড় ঘুরে ভাস্কর বলল, “ঐ তো পোল।” দেখা গেছে পোলটা। কিন্তু পোলের কাছে গিয়েই একটা আর্তনাদ করে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ল ভাস্কর, “আবার!”
ফের একই গল্প। টেলিগ্রাফের তার লাফ দিয়েছে সামনের পাহাড়ের চুড়োয়। মাঝখানে গভীর জঙ্গলে ভরা খাদ। রাস্তা নেমেছে সেদিকে। আমরাও হতাশ হয়ে বসে পড়লাম। এ তো দেখি বেশ ঝকমারি ব্যাপার হল! কতবার এমন ওঠানামার খেলা চলবে কে জানে! “বাজে ক’টা?” ঘড়ি দেখলাম। “সাড়ে ছ’টা।” তার মানে দেড়ঘন্টা অলরেডি হেঁটে ফেলেছি। কিন্তু কত কিলোমিটার এসেছি এতক্ষণে? চার-পাঁচ কিলোমিটারের বেশি তো কিছুতেই নয়মানে অর্ধেক রাস্তাও আসিনি এখনওসন্ধে হয়ে গেছে। একটু পরেই সব অন্ধকার হয়ে যাবে।
       বললাম, “ফিরে যাবি নাকি?”
       “কোথায়? কলকাতায়?”
       “না, বাঘমুন্ডি, চায়ের দোকান। অন্ধকার হয়ে এল তো! এরপর আর কিছুই দেখা যাবে না।”
       ভাস্কর বলল, “দেখার কী আছে? শুধু তো জঙ্গল! দেখিসনি নাকি কোনওদিন? কাল সকালে আবার দেখিস, চোখ ভরে।”
       “চুলোয় যাক জঙ্গল। টেলিগ্রাফের তারটা দেখতে না পেলে হাঁটব কী করে?”
       “আরে রাস্তা তো একটাই। তারের জন্য অত চিন্তা কীসের? আর ফিরবি যদি তবে এই খাদটা পেরোলি কেন? আগে বলতে পারিসনি? তাহলে তো এতটা চড়াই ঠ্যাঙাতে হত না।”
       শঙ্কর বলল, “ওই চায়ের দোকানে থাকাও যা, এখানে সারারাত বসে থাকাও তা। ফিরে গেলে কাল তো আবার এতটা রাস্তা ঠ্যাঙাতে হবে। আর জঙ্গলে কখনও একেবারে নিশ্ছিদ্র, ঘুটঘুটে অন্ধকার হয় না। জিম করবেট পড়িসনি? তারার আলো, গ্রহের আলো, আকাশের আলো, জোনাকির আলো। চাঁদের আলো তো ছেড়েই দিলাম। বনের রাস্তাঘাট অন্ধকারেও দেখা যায়। শিকারিরা তো রাতের বেলাই বন চষে বেড়ায়।”
       ভাস্কর বলল, “তাছাড়া টর্চের আলো আছে।”
       আমার গেল মাথা গরম হয়ে। যেন আমার জন্যই যত বিপত্তি! জিম করবেট পড়েই যদি করবেট হয়ে যেতাম তবে তো আর চিন্তাই ছিল না, আইনস্টাইনের ফর্মুলা মুখস্থ করেই আইনস্টাইন হয়ে যেতাম। রেগেমেগে উঠে পড়ে প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে বললাম, “চল তাহলে, ওঠ। এখানে বসে আর সময় নষ্ট করিস না
ভাস্কর বলল, “দাঁড়া দাঁড়া, জিরিয়ে নি। অত তাড়া কীসের? সারারাত তো পড়েই রয়েছে। তারপর কাল সারাদিন। তারপর আবার সারারাত। গেলেই হল। এমন করছিস যেন সন্ধে হলেই বাড়ি ফিরে পড়তে বসতে হবে। দেরি হলে বাড়ির লোকে খুঁজতে বেরোবে। এখানে আমাদের খোঁজার কেউ নেই। সন্ধে নেই, রাত্রি নেই, রাস্তা নেই। ফ্রি। আমরা যা খুশি করব।”
       বললাম, “চায়ের দোকানের লোকটা জন্তুজানোয়ারের কথা বলছিল মনে আছে? বড়ো জানোয়ার ছেড়ে দে। গরমকাল। দু’একটা গোখরো সাপই যথেষ্ট। একেবারে ফ্রি করে দেবে আমাদের।”
       এবার ভাস্কর উঠল, “নাঃ, ঠিকই বলেছিস। চল হাঁটি

       আবার নামতে শুরু করলাম। তবে আগের মতো হুড়মুড় করে নামতে পারছি না আর, কারণ রাস্তা ভালো দেখা যাচ্ছে না; আর যত নিচে নামছি অন্ধকার তত গভীর হচ্ছে, গাছপালা ঘন হচ্ছে। রাত্রিও নেমে গেছে। একটু পরেই টর্চ জ্বালতে হল। নইলে আর এক পাও ফেলা যাচ্ছে না। আকাশের দিকে তাকালে এখনও আলো আলো লাগছে বটে, কিন্তু রাস্তায় এমন অন্ধকার যে দু’হাত দূরের জিনিসও ভালো দেখা যাচ্ছে না। টর্চ জ্বেলে চলতে অবশ্য তেমন অসুবিধে নেই
       এবার আর অত নিচে নামতে হল না, কেননা রাস্তাটার দেখলাম একটু বুদ্ধি হয়েছে। আগেরবার যেমন টেলিগ্রাফের তারকে ফলো করতে গিয়ে সোজা গোঁৎ খেয়ে খাদে নেমে ফের একলাফে পাহাড়ে চড়েছিল, এবারে আর সে গোঁয়ার্তুমি করেনি। একটু নেমে তারপর মোটামুটি একই উচ্চতায় পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে বেড় দিয়ে সামনের পাহাড়ে চলে গেছে। তাতে হাঁটতে একটু বেশি হবে, কারণ তারের লাইন যদি হয় একটা বৃত্তের ব্যাস (2r) তাহলে রাস্তাটা পরিধির অর্ধেক (3.14r), অর্থাৎ দেড়গুণেরও বেশি। কিন্তু লাভ হল, চড়াই-উতরাইটা কম।
       হাঁটছি তো হাঁটছি, হাঁটছি তো হাঁটছি। জঙ্গল মনে হচ্ছে শেষ হবার নয়। কোনওদিকে কোনও আলোর রেখা নেই, কোনও গ্রাম বা মানুষজনের চিহ্নমাত্র নেই। শুধু ঘন অন্ধকার জঙ্গল। শঙ্করকে ভাবলাম জিগ্যেস করি তার প্রকৃতির আলো কী হল! কিন্তু কথা বলতেও আর ভাল্লাগছে না। খাওয়ার জল শেষ, দরদর করে ঘামছি। একটু হাওয়া নেই, গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। চারদিক তাই অসম্ভব নিস্তব্ধ; শুধু আমাদের তিনজনের জুতোর আর হাঁসফাঁস হাঁপানোর একটানা আওয়াজ।
       টানা একঘন্টা হাঁটার পর থামলাম। থামতেই হল, কেননা রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে গেছে। একটা ভাগ গেছে বাঁদিকে, আরেকটা খাড়া চড়াই ওপরদিকে। ভাস্করকে জিগ্যেস করলাম, “এবার?”
ভাস্কর বলল, “এবার বসব। অনেক হেঁটেছি, আর পারছি না।”
শঙ্কর বলল, “হিসেবমতো বাঁদিকেই যাওয়া উচিত আমাদের।”
       “কেমন হিসেব? অন্য রাস্তাটা চড়াই বলে?”
       “সেটাও একটা ফ্যাক্টরচোখের সামনে যদি দুটো রাস্তা থাকে, একটা সোজা একটা শক্ত, তাহলে সোজাটা বাছাই বুদ্ধিমানের কাজ।”
       “বুদ্ধি না মুন্ডু! নিচের দিকে নামার রাস্তা সবসময়ই সোজা, ওপরে ওঠার রাস্তা শক্ত।”
       “বেশি ফিলজফি করিস না। আমি বলছি সায়েন্স। রাস্তাটা টেলিগ্রাফের তারকে বাঁদিকে রেখে ডানদিক দিয়ে ঘুরতে শুরু করেছিল, তাই তারের লাইনে পৌঁছতে গেলে হিসেবমতো বাঁদিকেই যাওয়া উচিত।”
       “গত একঘন্টা যে হাঁটলি, রাস্তাটা কখন কখন কত ডিগ্রি করে কোনদিকে বাঁক নিয়েছে হিসেব রেখেছিস? হয়ত আমরা ঠিক তারের নিচেই বসে আছি, হয়ত তার ছাড়িয়ে আরও বাঁদিকে চলে এসেছি। আর টেলিগ্রাফের তারটাকে তোরা দু’জন এত গুরুত্ব দিচ্ছিস কেন বুঝছি না। কোথাকার এক গেঁয়ো ভূত বলল আর আমরাও নেচে নেচে তার দেখতে দেখতে চললাম! আজ যদি ওই সাঁওতালদাদুর সঙ্গে দেখা না হত আমাদের, নাই হতে পারত, তাহলে হয়ত টেলিগ্রাফের লাইনটাকে খেয়ালই করতাম না আমরাএকেবারে অযোধ্যা পাহাড়ে পৌঁছে আবিষ্কার করতাম – আরে, এখানে টেলিগ্রাফ লাইন চলে এসেছে!”
       “ঠিক আছে, তোর যুক্তিটা কী শুনি? খামোখা চড়াই ভাঙতে যাব কেন?”
       ভাস্কর বলল, “আমার সিক্সথ সেন্স বলছে ওদিকেই যেতে হবে।”
       “ধুর ধুর, যুক্তি-টুক্তির বালাই নেই, সিক্সথ সেন্স! যত্তসব আনসায়েন্টিফিক ব্যাপার।”
       “হোয়্যার সায়েন্স এন্ডস, ফিলজফি স্টার্টস। তোর ইচ্ছে হয় তুই যা না বাঁদিকে, কে বারণ করেছে?”
       “ঠিক আছে, তোরা বোস এখানে। আমি একটু এগিয়ে দেখে আসি।”
       শঙ্কর বাঁদিকের রাস্তা ধরে টর্চ জ্বেলে এগিয়ে গেল। আমরা হাত-পা ছড়িয়ে বসলাম। তর্কাতর্কি শেষ হতেই জায়গাটা দুম করে চুপ মেরে গেল। অন্ধকার আর নৈঃশব্দ একলাফে যেন আমাদের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। টর্চটা টানা একঘন্টা জ্বলেছে, তাই এখন নিভিয়ে রেখেছি। ব্যাটারি বাঁচাতে হবে। নিস্তব্ধতার সঙ্গে কানটা সয়ে যেতেই একটা আওয়াজ কানে এল। হালকা একটানা জলের আওয়াজ। ঝরনা আছে কাছেই। শঙ্করও পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল। বলল রাস্তাটা মোড় ঘুরেই একটা ঝরনার জলে নেমে গেছে। ঝরনায় জল বেশি নেই, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে সময়কালে ভালোই থাকে।
       সবারই তখন তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। জলের বোতল অনেক আগেই খালি। তাই জল পাওয়ার আশায় লাফ দিয়ে উঠলামবাঁদিকের রাস্তা ধরে মোড়টা ঘুরতেই শব্দটা জোরালো হয়ে কানে এল। একটু পরেই ঝরনাটা দেখলাম, কিন্তু এখানে জল ভরতে গেলে একটু কসরত করতে হবে। জল এখন কম বলে শুধু মাঝামাঝি জায়গা দিয়ে পরিস্কার জল বয়ে যাচ্ছে, দু’পাশে অনেকটা জায়গা ছোট ছোট জমা জল আর প্রচণ্ড পেছল শ্যাওলাধরা পাথরে ভর্তি। তার ওপর জায়গাটা ভয়ানক খাড়াই। পা পিছলে গেলে নিচে কোথায় গিয়ে পড়ব টর্চের আলোয় তার হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। খুঁজে খুঁজে একটা মোটামুটি সেফ জায়গা বার করা গেল, যেখানে আছাড় খেলেও একেবারে নিচে চলে যাবার চান্স নেই। তারপর পাঁচ মিনিট অবিরাম জলপান এবং জলের বোতল ভরা। এত জল খেলাম যে পেটে হাত বোলাতে বোলাতে আর বিশাল সব ঢেঁকুর তুলতে তুলতে ফিরে এসেই হাত-পা ছড়িয়ে ফের বসে পড়লাম। ক্লান্তিতে শরীর ছেড়ে দিয়েছে। শঙ্কর বলল, “এবার?”
       ভাস্কর বলল, “এবার বিশ্রাম। জল খাওয়ার পর বেশি হাঁটাহাঁটি করলে পেট ব্যথা করবে। চড়াই ওঠা তো একদম বারণ।”
       সামনের চড়াইটার দিকে তাকালেই আমার বিরক্ত লাগছে। আবার! তার চেয়ে এখানেই শুয়ে থাকি। শঙ্কর বলল, “আমার তো ঘুম-ঘুম পাচ্ছে।” বলে ব্যাগটা মাথায় দিয়ে শুল। আমিও চুপ মেরে গেলাম। নৈঃশব্দ নেমে এল আবার। শুধু ঝিঁঝিঁর নানারকম ডাক আর ঝরনার একটানা আওয়াজ। এতক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে ঝিঁঝিঁর ডাকটা তেমন খেয়াল করিনি, মনে হচ্ছিল কানেই বুঝি তালা লেগেছে। ভাস্করও শুয়ে পড়েছে। শুধু মাঝে মাঝে দু’পা দিয়ে পাথরের ওপর ধপাধপ ধপাধপ আওয়াজ করছে। বলল সাপ থাকলে ভয়ে পালাবে। জায়গাটা বিশ্রাম নেবার পক্ষে ভালোই। বেশ খানিকটা এলাকা গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের কবল থেকে পাথরের দল ছিনিয়ে নিয়েছে। বড়ো বড়ো বোল্ডার। ওপরে খোলা আকাশ। অজস্র তারা, নিকষ কালো আকাশে ফুটে আছে। শঙ্করকে জিগ্যেস করতে যাচ্ছিলাম তারার আলো আর গ্রহের আলোর রঙের তফাৎ জানে কিনা, কিন্তু হঠাৎ একটা বিকট আওয়াজে বনের নিস্তব্ধতা চিরে ফালাফালা হয়ে গেল। আমি আরেকটু হলে উলটে পড়ে যাচ্ছিলাম। ভাস্কর ধড়মড় করে উঠে বসল। শঙ্কর আলসেমি জড়ানো গলায় বলল, “ময়ূরের ডাক। শুনিসনি আগে?”
       “ময়ূর? তাই বল, শুনেছি কিনা মনে পড়ছে না।”
       ময়ূরটা আরও দু’তিনবার ডাকল। একবার ডাকে, আর কয়েক সেকেন্ডের জন্য সমস্ত ঝিঁঝিঁর ডাক থেমে যায়। সে এক অসহ্য নীরবতা। পাঁচ-দশ সেকেন্ড পরে ঝিঁঝিঁরা ফের ডাকতে শুরু করে, আমাদের মনেও একটু সাহস আসে। কিন্তু ময়ূরটা খামোখা ডাকাডাকি করছে কেন? এই রাত্তিরবেলা? প্রায় আটটা বাজে। আমাদের মতো ওরও কি খিদে পেয়েছে? শঙ্কর বলল, “খিদে না, ভয় পেয়েছে। বড়ো কোনও জানোয়ার দেখেছে। হয়ত ঐ ঝরনায় জল খেতে এসেছে। জিম করবেট পড়িসনি? করবেট অবশ্য এই ডাক শুনেই বলে দিতেন জানোয়ারটা হাতি না ভাল্লুক, মদ্দা না মাদী – আরও কত কী!”
       শঙ্করকে জিগ্যেস করলাম, “এই জঙ্গলে কী কী জানোয়ার আছে জানিস?”
       “ঠিক জানি না, কিছু কিছু শুনেছি। ভাল্লুক আর বুনো শুয়োর তো এসব জঙ্গলে থাকেই, দলমা পাহাড় থেকে হাতির পাল আসে মাঝে মাঝে। বাঘ-টাঘ মনে হয় নেই।”
       “এখানে এভাবে বসে থাকাটা কি ঠিক হচ্ছে?”
       “কোথায় যাবি? এ জায়গাটা তবু পরিষ্কার। চারদিক দেখা যাচ্ছে, কাছে জল আছে। রাস্তায় তো আরও জঙ্গল, যেন দু’পাশ থেকে চেপে ধরছে। আর, কদ্দূর এসছি কতটা বাকি কিছুই তো বুঝতে পারছি না। এখানকার লোকেদের ব্যাটা টাইমের কোনও আন্দাজই নেই। বলে কিনা দেড়-দু’ঘন্টা লাগবে!”
       “আগুন জ্বালালে হয় না? জন্তুজানোয়ার তাহলে কাছে ঘেঁষবে না।”
       “ধুর! গরমে এমনিতেই সেদ্ধ হয়ে গেলাম, আবার আগুন?”
       ভাস্কর হঠাৎ উঠে বসে বলল, “দাঁড়া দাঁড়া, বকবক করিস না, আওয়াজটা শুনতে দে ভালো করে।”
       “কীসের আওয়াজ?”
       “থামলে তো শুনতে পাবি!”
       থামলাম। কান পাতলাম। বুক দুরদুর করছে। কীসের আওয়াজ কে জানে! কিছুই তো বুঝছি না। হঠাৎ আওয়াজটা ঝরনার জলের আওয়াজ ছাপিয়ে বেশ জোর হয়ে গেল আর আমাদের চারপাশের ঝোপজঙ্গল, গাছপালা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। জিপের আওয়াজ। তীব্র হেডলাইটের হঠাৎ ঝলকানিতে চোখে ধাঁধা লেগে গেল। জিপটা আমাদের মাত্র একশো ফুট মতো ওপর দিয়ে রাস্তা ধরে হুশ করে নিচের দিকে নেমে গেল। নামছে বলে ইঞ্জিন শুধু আইডলিং করছে, খুব মৃদু আওয়াজ, দূর থেকে তাই বুঝতেই পারিনি। শঙ্কর বলল, “ডেপুটি রেঞ্জার সাহেব ফিরে গেলেন।”
       ভাস্কর তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, “ওপরেই জিপরাস্তা। চল।”
       বলার আগেই উঠে পড়েছি আমরাদুদ্দাড় করে চড়াই ভেঙে পাঁচ মিনিটে জিপরাস্তায় উঠে এলাম। জিপের আওয়াজ ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে। পেট্রলের মিষ্টি গন্ধ হাওয়ায় ভাসছে তখনও। নিচে জিপের হেডলাইট দেখা যাচ্ছে, বন আলো করে নেমে যাচ্ছে ঘুরতে ঘুরতে।
       তখন আমাদের পায় কে! হাঁটা তো নয়, প্রায় দৌড়। এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায়। কোথায় ক্লান্তি, কোথায় কী! ইউথ হোস্টেলের কল্পিত নরম সাদা বিছানার আকর্ষণ আমাদের সমস্ত ক্লান্তি ভ্যানিশ করে দিয়েছে। রাস্তা একটু একটু চড়াই উঠেছে, কিন্তু আমাদের কাছে সে চড়াই তখন সমতল প্রান্তর। শুঁড়িপথের চড়াই আর এ চড়াই! ছোঃ! মিনিট পনেরো পর একটা বাঁক ঘুরতেই গ্রামের আলো দেখতে পেলাম। পৌঁছে গেছি! অবশেষে! তারস্বরে গান আরম্ভ হল –
‘রামের কোমরে ঝামুরঝুমুর হাতে ধনুর্বাণ
রাম কান্দে, লক্ষ্মণ কান্দে, কান্দে হনুমান
রামের কোমরে ঝামুরঝুমুর।।’
       ভাস্কর বলল, “এটা কী ঝুমুর গান?”
       “না, অযোধ্যায় এসেছি তো, তাই রাম-লক্ষ্মণের কথা খুব মনে পড়ছে।”

ইউথ হোস্টেল

কিন্তু গ্রামের আলো দেখা আর গ্রামে পৌঁছোনোর মধ্যে অনেক ফারাক। হাঁটছি তো হেঁটেই যাচ্ছি। পথে পড়ল বনবাংলো। দেখলাম টেলিগ্রাফের শেষ খুঁটিতে সেখানে তার এসে পৌঁছেছে। ভাস্কর বলল, “ঐ যে তোর টেলিগ্রাফ। হয়েছে?”
ইউথ হোস্টেল আরও মিনিট দশেক পরে। পৌঁছলাম যখন প্রায় সাড়ে ন’টা।
       কেয়ারটেকার সাহেব তখনও অফিসঘরে মোমবাতি জ্বেলে কী পড়াশুনো করছিলেন। আমাদের দেখে থ, “এত রাতে? আপনারা? কোত্থেকে?”
       “বাঘমুন্ডি।”
       “বাঘমুন্ডি? কীসে এলেন এখন?”
       “কীসে আর? হেঁটে!”
       “এত রাত হল যে? কখন রওনা দিয়েছেন?”
       “পাঁচটা হবে। রাত কোথায় হল? সবে তো সাড়ে ন’টা!”
       “এখানে এইই মাঝরাত। সন্ধেবেলা কেউ এ রাস্তায় আসে? ষোল কিলোমিটার রাস্তা, চারঘন্টা তো লাগবেই। জঙ্গলের রাস্তায় এলে তবু ঘন্টাখানেক কম লাগে।”
       “জঙ্গলের রাস্তাতেই তো এলাম।”
       ভদ্রলোক এবার বই-টই বন্ধ করে কিছুক্ষণ গুম মেরে বসে রইলেন, আমাদের দিকে তাকিয়ে। তারপর আমাদের বসতে বললেন। বসলাম। সংক্ষেপে আমাদের অভিজ্ঞতা বললাম। শুনে ভদ্রলোক দশ মিনিট ধরে উপদেশ দিয়ে গেলেন।
       “খুব খারাপ কাজ করেছেন। এভাবে কেউ ঝুঁকি নেয়? মাত্র দু’দিন আগে বৈশাখী পূর্ণিমা গেল। সেদিন এখানে বিশাল শিকার উৎসব হয়। এই যে ইউথ হোস্টেল আজ একেবারে ফাঁকা দেখছেন, আপনারা ছাড়া কেউ নেই আজ, দু’রাত আগেও বারান্দায় শুতে দিতে হয়েছে ট্যুরিস্টদের। এত ভিড়! দূর দূর গ্রাম থেকে দলে দলে সাঁওতালরা আসে শিকার উৎসবে। তারা অবশ্য হোস্টেলে থাকে না, মাঠেঘাটে দল বেঁধে তাঁবু খাটিয়ে থাকে। শিকার উৎসবের পূর্ণিমা রাত্রে মহুয়ার রসে মাতাল হয়ে বর্শা, বল্লম, দা, কাস্তে যা আছে সব নিয়ে হৈ হৈ করে জঙ্গলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জানোয়ার মারার চেয়ে জখম করে বেশি। আর সেই জখম জানোয়ারই আমাদের চিন্তা। পরের দু’মাস কত লোক যে তাদের হাতে ঘায়েল হয়! এবারই তো একটা বিশাল দাঁতাল শুয়োর, দৈত্যের মতো চেহারা, জখম হয়ে চারজনকে ঢুঁসিয়েছে। দু’জনের পেট ফেঁসে গেছে, স্পটডেড। বাকি দু’জন হাসপাতালে। শেষে অবশ্য শুয়োরটা মারা পড়েছে। এখানে নিয়ে এসেছিল দেখাতে। শুধু কী শুয়োর? নেই নেই করেও জানোয়ার কম নেই এ জঙ্গলে। হাতি আছে দল কে দল। ভাল্লুক। চিতাও আছে শুনি। আপনারা যে ঝরনায় জল খেয়েছেন ওর নাম ‘বামনি’ওখানে একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে, কাঠের। দিনের বেলা গেলে দেখতে পাবেন। এই গরমে খুব বেশি ঝরনায় জল থাকে না। বামনিতে থাকে। ওদিকের জঙ্গলশুদ্ধু জানোয়ার ঝেঁটিয়ে জল খেতে যায় বামনিতে। ওয়াচ টাওয়ারে রাত কাটায় অনেকে, দেখার জন্য। কী ভাগ্যিস ও রাস্তায় আপনাদের রাত কাটাতে হয়নি আজ। হলে কী হত কিছুই বলা যায় না। আর জঙ্গলের পথে আসতে হলে স্থানীয় লোক সঙ্গে নিতে হয়। কত ছোট ছোট রাস্তা এদিকওদিক চলে গেছে! সঙ্গে আছাড়ি পটকা, চকলেট বোম রাখতে হয় নিদেনপক্ষে।”
       আমার আর উপদেশ শুনতে ভালো লাগছিল না। খিদে পেয়েছে খুব। ভাবলাম ভদ্রলোককে বলি আমাদের সঙ্গে শঙ্করের প্রাকৃতিক আলো আর ভাস্করের সিক্সথ সেন্স ছিল। আর ছিল গান – আছাড়ি পটকার চেয়ে ঢের জোরালো। উশখুশ করছি দেখে ভদ্রলোকই থামলেন, “নিন, ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করে নিন। সামনেই হোটেল আছে।”
       “কোন ঘরে ঢুকব?”
       “যেখানে খুশি ঢুকে যান। সবই খোলা, সবই খালি। তালাচাবির ঝামেলা নেই এখানে। চুরি নেই, তাই তালাও নেই।”
       “রেজিস্ট্রেশন?”
       “ওসব হবে কালকে, চলুন।”



       ইউথ হোস্টেলের দুটো ব্লক। প্রতিটায় দুটো করে বিশাল ডর্মিটরি। নিচের ব্লকটা যেখানে শেষ সেখান থেকে পাহাড় খাড়া নিচে নেমে গেছে, ঘন জঙ্গল সেদিকে। ওপরের ব্লকটার একদিকে রাস্তা, অন্যদিকে নিচের ব্লক। আরও দুটো ছোট ছোট ব্লক তৈরি হচ্ছে দেখলাম, পাথরের দেওয়াল, একটা করে ডাবল বেড রুম, বাথরুম আর সামনে-পেছনে বারান্দা। রেডি হয়ে গেলে দারুণ হবে।
       বলা বাহুল্য নিচের ব্লকটায় ঢুকলাম। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে কেয়ারটেকার ভদ্রলোকের সঙ্গে খেতে চললাম। ইউথ হোস্টেলের গেটের বাইরে একটু এগোলেই ঝুপড়ি হোটেল। দরমার বেড়ার দেওয়াল, বাঁশের কাঠামোয় খড়ের চাল। ভেতরে সেই ফুলবেঞ্চি আর হাফবেঞ্চি। গরম গরম ভাত, ডাল, তরকারি আর ঝিরিঝিরি করে কাটা আলুভাজা, সঙ্গে কাঁচালঙ্কা আর পেঁয়াজঅমৃত! সবই মনে হচ্ছে এক্ষুনি রান্না করা। জিগ্যেস করে জানলাম ঠিক তাই। হোটেলের মালিক খালি গা, বিশাল সাদা গোঁফ, উশকোখুশকো পাকা চুল, ভুঁড়ি, ময়লা ধুতি, খালি পা। নাম জানলাম যুগল সর্দার। বললাম, “এত তাড়াতাড়ি রাঁধলেন কী করে?”
“তাড়াতাড়ি কোথায়? আপনারা যখন ঢুকলেন গেট দিয়ে, তখনই ভাত চাপিয়ে দিয়েছি। আমার এখেনেই তো আসতে হবে, খাবেন আর কোথায়? দেরি দেখে বিজয়বাবুকে তো হাঁকও পাড়লুম। গেল হপ্তা খুব খাটুনি গেছে গো, আজ ভেবেছিলুম তাড়াতাড়ি বাতি বুজোব।”
খাওয়া হল। বিজয়বাবু গুডনাইট করে আগেই চলে গেছেন। বোধহয় ঘুমিয়েও পড়েছেন এতক্ষণে। খাবারের পয়সা দিতে গিয়ে প্রায় বিষম লাগে আর কী! আড়াই টাকা প্লেট। ভরপেট নিরামিষ খাবার। এরা যে এত গরিব তাতে আর আশ্চর্য কী? যা পায় তাতেই তো সন্তুষ্ট। বেশি কামানোর কোনও ধারনাই নেই।
বাইরে বেরিয়ে দেখি চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমা তো শুনলাম দু’দিন আগেই গেছে। প্রায় গোল চাঁদ। চারদিকের ঘুমন্ত বাড়িঘর, মাঠ, জঙ্গল জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। ঠান্ডা শিরশিরে হাওয়া। সামনে বিশাল একটা মাঠের একপাশে একদল সাঁওতাল আগুন জ্বালিয়েছে। কেউ কেউ শুয়ে আছে, অন্যরা আগুনের চারদিকে ছড়িয়েছিটিয়ে বসে। একটা মাদল মাঝে মাঝে অনিয়মিত দায়সারাভাবে কেউ বাজাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে এরা শিকার উৎসবে আসা কোনও দল, এখনও ফেরেনি। সবাই ক্লান্ত, নেশাতুর। শঙ্কর বলল, “চাঁদটা সন্ধেবেলায় উঠলে কার কী অসুবিধে হত বুঝি না।” ভাস্করকে তখন গানে পেয়েছে, গলায় দরদ উথলে উঠছে –
‘এমন চাঁদিনী রাতে
একা শুয়ে তেতলাতে
খালি খালি খিদে কেন পায় রে...’
______
ছবিঃ লেখক
(এরপর আগামী সংখ্যায়)

12 comments:

  1. Darun hoechee..Khub bhalo laglo.

    ReplyDelete
  2. Asadharan. Anek kotha ami nijei bhuley gechhilum.

    Sankar

    ReplyDelete
  3. এ সংখ্যার অন্যতম সেরা পাওনা। দেখলাম আর বুঝলামও যে দেবজ্যোতি তাপসবাবুর লেখার অযথা প্রশংসা করেন না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ। :-)

      Delete
  4. Byapok. Darun likhechis... Tobe Shanky Ar Bhaskar (who ?) nam gulo na dile Amra guess who? Khelte partam��

    ReplyDelete
  5. darun darum darun laglo..

    ReplyDelete
  6. অসাধারণ! দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা!

    ReplyDelete