গল্পের ম্যাজিক:: জেনেটিক কোড - গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

জেনেটিক কোড
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

আমতের কথা

গাছটাকে সাবধানে রেখো
কেন বললেন সাবধানে রাখতে? স্যার কি বুঝতে পারেননি কেন আমি এসেছি? একটা সাধারণ ফুলগাছ - আমি কি এটার জন্য জীবন বাজি রেখে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম?

       “আমার নাম আমতে আমি ডক্টর হারাইনের প্রাক্তন ছাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই
       “ডক্টর হারাইন ভীষণ ব্যস্ত কারোর সঙ্গে দেখা করার সময় নেই তাঁর এটা তাঁরই কথাতাঁর অনুরোধেই আমরা তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছি আমরা তাঁর নির্দেশ মেনেই চলি।”
       “অন্যদের ডক্টর হারাইন সময় না দিতে পারেন, আমার সঙ্গে নিশ্চয় দেখা করবেন আমি দশবছর তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি আমি স্যারকে মেল করেছিলাম, তার উত্তরে তিনি আমায় আসতে বলেছেন এই দেখুন সেই মেল আমি আপনাদের আগেই এই মেলের কপি পাঠিয়েছিলাম
       “দুঃখিত, কিন্তু আমরা তো আপনাকে লিখেছিলাম দেখা হবে না
       “স্যার নিজে আমাকে আসতে বলেছিলেনআপনারা বলছেন স্যারের কথামতো আপনারা চলেন তাহলে দেখা করতে দেবেন না কেন?
       ঠিক নাটকের সংলাপের মতো কথাবার্তাআমি কী বলব ওরা জানত, ওদের উত্তরও আমার জানা আমার মেল স্যার দেখার আগেই নিশ্চয় ওরা দেখেছে স্যারের উত্তরও ওদের জানা, হয়তো ওদেরই কারও লেখা। আমাকে দেখা করতে ওদের দিতেই হবে কারণ, ডক্টর হারাইন যে স্বেচ্ছায় ওদের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন সেটা গোটা ক্ষত্রপ গ্রহের মানুষের কাছে প্রমাণ করার দায়িত্ব ওদেরই
       আরও কিছুক্ষণ কথার পরে অনুমতি মিলল দেখা করার সময় মাত্র আধঘন্টা আমার দেহতল্লাসি করে নিশ্চিত হতে হল যে আমার কাছে কোনও অস্ত্র নেই
       ডক্টর হারাইনকে ছেড়ে গিয়েছিলাম একবছর আগে স্যারের শরীরটা এই সময়ের মধ্যেই বেশ ভেঙে পড়েছে মুখের হাসিটা বোধ করি কষ্ট করেই আনতে হয়েছে
“এসো আমতে তুমি কেমন আছ?
       “আমি ভালো আছি আপনি কেমন আছেন স্যার?
       “ভালোই আছি আমার কোনোকিছুরই অভাব এখানে নেই সারাক্ষণ আমার সমস্ত প্রয়োজনের দিকে নজর থাকে
নজর কথাটার ওপর কি সামান্য বেশি জোর দিলেন? নাকি আমি, আমার মন, স্যারের কথাকে নিজের মতো ব্যাখ্যা করে নিচ্ছে? কিছু আসে যায় না, আমি বেফাঁস কথা বলার জন্য আসিনি আমি ভালোই জানি, যতগুলো গোপন ক্যামেরা আমাদের উপর এই মুহূর্তে তাক করে আছে, ফুটবল মাঠেও ততগুলো থাকে নাকিন্তু আমি সত্যি সত্যি কেন এসেছি? আমি তো জানতাম কিছুতেই স্যারের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারব নানজরদারি থাকবেই কেন স্যার এই কাজ করছেন? কেন? কেন?

কাকানের কথা

“পৃথিবী কত দূরে, কাকান?”
“সে তো অনেকদূর, দিদিভাই
       মাথার উপরে আধখানা ফোবোস
দূরে ডিমোস পাহাড়ের পেছনে ঢাকা পড়েছে। সামনে নৈঃশব্দের চাদর মুড়ে ঘুমিয়ে সিলভান
       “অনেএএএক দূর? ফোবোস ডিমোসের থেকেও দূর?” সুর করে হাত নাড়ে সিনা।
       “আরও দূরে।”
“সূয্যির থেকেও বেশি দূরে?”
       “আরও অনেক অনেক দূরে
       সিনা আর হিসেব রাখতে পারে না বোধহয়, সে দূর ঠিক কেমন দূর। কোলে উঠে পড়ে আমার।
       “পৃথিবী কেমন জায়গা কাকান?”
       কী বলব ছোট্টো সিনাকে? পৃথিবী নীল, কিন্তু আমি তো নিজের চোখে দেখিনিপাহাড়ের মাথায় আপনি আপনি বরফ জমে, কিন্তু সে বরফের উপরে আমি হাঁটিনি। আমার জ্ঞান তো বুকফিল্মের থেকে পাওয়াক্ষত্রপে প্রথম যারা এসেছিল তারা তো পৃথিবী ছেড়েই এসেছিল। সেই সুন্দর পৃথিবী যেখানে আকাশ নীল, যেখানে রাত্রে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকে, যেখানে আকাশে মাত্র একটা চাঁদ।

আইনস্টাইন ইন্টারস্টেলার ড্রাইভের সে সবে প্রথম যুগকে ছিল আইনস্টাইন? পৃথিবীর কোনও শাসকের নাম? ইতিহাস সে কথা মনে রাখেনি, মনে রাখার প্রয়োজনও হয়নিআলোর চেয়ে জোরে যাচ্ছে মহাকাশযান, গোটা ছায়াপথটাই আসবে মানুষের হাতের মুঠোয়। একের পর এক যান ছাড়া হচ্ছে অ্যারিজোনা, বাংলাদেশ, উরাল, আটলান্টিস এবং আরও সব বিচিত্র দেশ থেকে, যেগুলো ক্ষত্রপের অধিবাসীর কাছে এখন শুধু কতকগুলো শব্দমানুষকে নিয়ে যাচ্ছে ঘরের উঠান থেকে মহাবিশ্বে। আইনস্টাইন ড্রাইভ কোথায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে প্রথমে ঠিক করা যাচ্ছিল না। কিন্তু ড্রাইভের উন্নতির জন্য অপেক্ষা করতে মানুষ আর রাজি নয়। দেড় লক্ষ বছর শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে সে স্বপ্ন দেখেছে। আর নয়, সময় এসেছে, তারাদের মাঝে নিজের জায়গা করে নিতে হবে
       তেমনি এক যানে দু’শো জন মানুষ, না না, একশো জন আদম আর একশো জন ইভ, বেরিয়ে পড়েছিল। ক্ষত্রপের ইতিহাসে তাদের নাম লেখা সোনার জলে। তারাই খুঁজে পেয়েছিল এক নতুন গ্রহ। হোক পৃথিবীর থেকে অনেক গরম, হোক প্রায় মরুভূমি, কিন্তু সেখানে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ানো যায়, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। হোক পৃথিবী থেকে চল্লিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। একদিন আবার পৃথিবী তার সন্তানদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেবে। সে সময় নতুন গ্রহ যেন সেই হাত ধরার যোগ্য হতে পারে।
       অবশেষে একদিন পৃথিবী থেকে দূত এল। বলল, আইনস্টাইন ড্রাইভের নেভিগেশন সিস্টেম এখন অনেক নির্ভুল দ্বিতীয় প্রজন্মের কলোনিগুলো সব গড়ে উঠেছে পৃথিবীর কাছের তারাগুলোতে। ইচ্ছা করলে আমরা যে কেউ ফিরে যেতে পারি পৃথিবীতে, কিংবা পৃথিবীর কাছের কোনও কলোনিতে।  
       কিন্তু ক’জনই বা ফেরত গেল? কেনই বা যাবে? কী আছে আমাদের জন্য পৃথিবীতে? কতগুলো গল্প ছাড়া? আমাদের কাছে পৃথিবীর নাম ততদিনে হয়ে গেছে ক্ষত্রপ। শেষ যে দূত এসেছিল তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি, “পৃথিবী কেমন জায়গা?”
হেসে ফেলেছিল সে বলেছিল, “কেমন করে আপনাকে বলব? সে ভারী মজার জায়গা
       “পৃথিবী কেমন জায়গা, কাকান?” সিনা কোলে বসে পা দোলাচ্ছে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
       হেসে ফেলেছিলাম আমি।
“সে ভারী মজার জায়গা দিদিভাই

আমতের কথা

একবছর আগের কথা আমি ল্যাবরেটরি থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলাম একদিন সকালে খবরটা দেখে চমকে উঠলাম ডক্টর হারাইন এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন তিনি দীর্ঘদিন ধরে সম্রাট জাবাজের গুণগ্রাহী ও তাঁর নীতির সমর্থক অনেক বিবেচনা করে তিনি সিদ্ধান্ত করেছেন আমাদের গ্রহ ক্ষত্রপের সমস্ত মানুষের উন্নয়ন একমাত্র জাবাজের শাসনেই সম্ভব তাই তিনি তাঁর গবেষণাগার বেদাস সাম্রাজ্যের রাজধানী অ্যাক্রোপোলিসে স্থানান্তর করছেন এখন থেকে তিনি জাবাজের কল্যাণকর শাসনের উন্নতিকল্পে তাঁর গবেষণা পরিচালনা করবেন
       ডক্টর হারাইন! খবরটা বিশ্বাস করতে পারিনি স্যারকে ফোন করলাম একই কথা স্যার আমাকেও বললেন ভাগ্যিস আমাকে ওনার সঙ্গে কাজ করতে ডাকেননি তাহলে জীবনে প্রথমবার স্যারের আদেশ বা অনুরোধ অমান্য করতে হত

       দু’সপ্তাহ আগের এক দিন আমি এখন যে ল্যাবরেটরিতে কাজ করি, তার ডিরেক্টর ডক্টর লিসা সকালবেলা আমাকে ডেকে বললেন, “আপনার সঙ্গে দেখা করতে এই দুই ভদ্রলোক এসেছেন তবে বিষয়টা গোপনীয় আপনাকে অনুরোধ, ওনাদের কথায় যদি আপনি রাজি নাও হন, তাহলেও অন্য কাউকে এ বিষয়ে কিছু বলবেন না
       স্বাভাবিকভাবেই আমার বেশ কৌতূহল হল ডিরেক্টরের অফিসে যে দু’জন ছিলেন তাঁদের কাউকেই আমি চিনি না তাঁরাও তাঁদের নাম বললেন না প্রথমজন বললেন, “ডক্টর আমতে, কিছু মনে করবেন না, কয়েকটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন আপনাকে করব ডক্টর হারাইনের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? একসঙ্গে কী কাজ করতেন আপনারা?
কী উত্তর দেব এই প্রশ্নের? স্যারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী, বাইরের লোককে দু’কথায় বোঝানো সম্ভব? আমাকে স্নেহ করতেন নিজের ছেলের মতো দেবতুল্য অমন মানুষের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল তাঁর যে জাবাজের অধীনে গবেষণা করার মতো অধঃপতন হতে পারে, তা ভাবতেই পারি না
       “আপনারা সবাই জানেন, ডক্টর হারাইন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে কাজ করতেন আমি তাঁর অধীনে মূলত জাঙ্ক ডি.এন.এ. নিয়ে গবেষণা করতাম ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলি জীবকোষের নিউক্লিয়াসে যে ডি.এন.এ. থাকে, তার মধ্যে থাকে প্রোটিন সংশ্লেষের কোড বা নির্দেশাবলী এটাকেই আমরা জেনেটিক কোড বলি কিন্তু ডি.এন.এ.-এর অনেকটাই প্রোটিন তৈরিতে কোনও কাজে লাগে না যেমন, মানুষের ডি.এন.এ.-এর আটানব্বই শতাংশই কোনও কাজে লাগে বলে মনে হয় না ডি.এন.এ.-এর এই অংশকে আমরা জাঙ্ক বা নন-কোডিং বলি
       “সত্যি কথা বলতে কী, আপনি ঠিক কী কাজ করেন, তার সঙ্গে আপনার সঙ্গে আমাদের দেখা করতে চাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই আমাদের সমস্যাটা আপনাকে বলি জাবাজকে নিয়ে আমরা খুবই চিন্তিত আমাদের ধারণা, শীগগিরি বেদাস আবার পাশের অঞ্চলগুলো অধিকার করার চেষ্টা করবে বেদাসের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার মুখে, তাকে ঠেকিয়ে রাখতে ও প্রজাদের ভুলিয়ে রাখতে এই পদ্ধতি ইতিহাসে বারবার একচ্ছত্র শাসকরা অনুসরণ করেছে,” প্রথমজন আবার বললেন
       “আমরা মানে কারা?” জানতে চাই আমি
       “দুঃখিত, এর উত্তর আমি আপনাকে দিতে পারব না ধরে নিন আমরা কিছু মানুষ যারা ক্ষত্রপের ভালো চাই এবং জাবাজের হাত থেকে মুক্তি চাই সহজবোধ্য কারণে আমাদের গোপনে কাজ করতে হয়, আমরাও অন্য সকলের নাম জানি না আমাদের যিনি মূলনেত্রী, তিনি হঠাৎ মারা গেছেন মৃত্যুটা খুবই আকস্মিক, আমরা একেবারেই তৈরি ছিলাম না মারা যাওয়ার আগে তিনি শেষ নির্দেশে ডক্টর হারাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলেছিলেন বিশেষ করে আপনাকে পাঠানোর কথাই বলেছিলেন কেন বলেছিলেন, আমরা কেউই জানি না
       “আমরা প্রথমে আপনাকে এর মধ্যে জড়াতে চাইনি দুর্ভাগ্যবশত ডক্টর হারাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করার আমাদের সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে সরকারি পদ্ধতিতে যোগাযোগ করলে গতে বাঁধা উত্তর এসেছে অন্য কোনোভাবে আমরা ওনার কাছে সরাসরি পৌঁছোতে পারিনি একমাত্র তাঁর ছাত্র হিসাবে আপনি যদি দেখা করতে চান, তাহলে হয়তো জাবাজ রাজি হতে পারেন কারণ, তা না হলে সকলের মনে হতে পারে যে ডক্টর হারাইনকে জোর করে ধরে রাখা হয়েছে
       “দেখা করে কী লাভ হবে? আপনাদের কি মনে হয় সত্যিই ওনাকে জোর করে ধরে রাখা হয়েছে?
       “জানি না কেন যোগাযোগ করতে বলেছিলেন আমাদের নেত্রী, আমাদের সে ব্যাপারে কোনও ধারণা নেই আপনাকে তাই অনুরোধ করতে এসেছি আমরা এতে অবশ্য একটু ঝুঁকি আছে, অন্তত বেদাসে যতক্ষণ থাকবেন মনে হয় না আপনাকে কেউ কিছু করতে সাহস পাবে তবুও, বলা তো যায় না
       “আমি যাব স্যারের কাছে আমায় জানতে হবে কেন ওঁর এই পরিবর্তন
       “না না, অমন কাজ করবেন না আপনি নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাবেন না যা বলার ওনাকেই বলতে দিন আমরা তো অন্ধের মতো পথ হাতড়াচ্ছি

       এই ঘটনার পর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ডক্টর হারাইনের সাক্ষাৎ পেয়েছি কিন্তু সাধারণ কথার বাইরে কীই বা বলব? আমার মাথায় সবচেয়ে আগে যে প্রশ্নটা ঘুরছে, সেটা স্যারকে কেমন করে জিজ্ঞাসা করব? যে কথাই হোক, যতই তুচ্ছ, তা পৌঁছে যাবে জাবাজের কাছে
       “এখন কী কাজ করছেন স্যার?
       “আমার কথা এখন থাক,” স্যার এড়িয়ে গেলেন, “তুমি বল তুমি কী কাজ করছ
       এইভাবে উদ্দেশ্যহীন কথাবার্তা চলতে থাকল তাতে আর যাই থাকুক, প্রাণ ছিল না যাওয়ার সময় হল হঠাৎ স্যার বললেন, “চলো, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই
ল্যাবরেটরির ঠিক বাইরে একটুখানি বাগান, তাতে কয়েকটা ফুলগাছ হয়ে আছে স্যার একটা গোলাপগাছের পাশে গিয়ে বললেন, “দেখেছ, আমি নিজের হাতে এই গাছটা বানিয়েছি গাছটার একটা কলম কেটে রেখেছি তোমার জন্য, নিয়ে যাও
পাশ থেকে একটা গাছের কলম তুলে আমার হাতে দিলেন মুহূর্তের জন্য হাতে একটু চাপ পড়ল বললেন, “গাছটাকে সাবধানে রেখো এই গাছের ফুল সমস্ত পরিবেশটাকে পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে
       বেরোবার সময় ল্যাবরেটরির দরজা পর্যন্ত এসেছিলেন স্যার। বললেন, “ভালোভাবে কাজ করো। নামে জাঙ্ক হলেও ডি.এন.এ.-এর সেই অংশের মধ্যেও যে সঙ্কেত আছে, তা খুঁজে বার করার দায়িত্ব তোমার

হারাইনের কথা

জাবাজের খবরে, বেদাসের খবরে আমি বিশেষ পাত্তা দিইনিআমি কেন, কেউই প্রায় দেয়নি। আমি বিজ্ঞানী, ল্যাবে বসে কাজ করি, তার বাইরে আর কীই বা জানি? কাজের ভিড়ের মধ্যে খবর আসত। আমার সহকর্মীরা আলোচনা করত কখনও কখনও। কে জাবাজ? নাকি দস্যুকী করেছে সে? ক্ষত্রপের প্রায় জনশূন্য গোটা উত্তরমেরু দখল করে রাজ্যপাট বসিয়েছে নাকি, নিজেকে সম্রাট বলে ডাকছে, রাজ্যকে ডাকছে বেদাস। সম্রাট! হা হা, কেমন ছোটবেলার রূপকথার গল্পের মতো শোনায় না? আজকালকার দিনেও এসব চলে নাকি আর? আমাদের ক্ষত্রপের তো সৈন্যসামন্ত নেই, যুদ্ধ করবার ক্ষমতাও প্রায় নেই। পৃথিবীতে খবর পাঠাতে হবে নাকি? খবরটা তো কাউকে ইন্টারস্টেলার ড্রাইভের মারফত বয়ে নিয়ে যেতে হবে। মহাবিশ্বের অদ্ভুত নিয়মে রেডিও-বার্তা যেতে লাগবে চল্লিশ হাজার বছর
তারপরে আবার খবর এসেছেজাবাজ চকিত আক্রমণে ক্ষত্রপের একমাত্র স্পেসপোর্টটা দখল করে নিয়েছে। কিন্তু ক্ষত্রপ হার মানেনি। প্রাথমিক ধাক্কা সয়ে জাবাজকে চরমপত্র দিয়েছে অবিলম্বে সৈন্য পোর্ট থেকে সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু জাবাজের থেকেও এক চরমপত্র এল। তার আগে...
       সেদিন দরজায় দাঁড়িয়েছে কেউ একজন, “প্রোফেসর, জাবাজের স্পেস ডেস্ট্রয়ার কয়েকঘন্টা আগে সিলভানে...”
       তারপর? “আমাকে যেতে দিন। সিনা থাকে ওখানে...”
অফিসার পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। আমাকে যেতে দিল না। কী হয়েছে? কে করল এরকম, কে করতে পারে? জাবাজ? সত্যি জাবাজ নাকি অন্য কেউ? গুজব, কথা, অন্য কথা, চব্বিশ ঘন্টা এরকম, খবর ভুল খবর, অনেক কথা। অবশেষে জাবাজের বিবৃতি, সমস্ত টেলিস্ক্রিনে সরাসরি সম্প্রচার, বেদাস শান্তি চায়, কিন্তু কেউ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাকে ধ্বংস করতে চাইলে পরিণতি এই হবে এই তার চরমপত্র
       এক সপ্তাহ পরেও আমি পাগলের মতো খুঁজেছিযদি আর একবার শুনতে পাই, আধো আধো স্বরে কোথাও থেকে আওয়াজ ভেসে আসে, ‘পৃথিবী কেমন জায়গা কাকান?’ কী অন্যায় করেছিল সিনা? কী পাপ করেছিল সেই প্রাণগুলো যারা সেদিন দুপুর বারোটা আটচল্লিশ মিনিটে সিলভানের ঐ এক কিলোমিটার বৃত্তের মধ্যে ছিল, থাকার দুর্ভাগ্য করেছিল?

       “ডক্টর হারাইন, আপনি কিন্তু জেনেশুনে বাঘের গুহাতে ঢুকতে চাইছেন।”
       “ম্যাডাম, আমার আর কিছু করার নেই। নিজের কাছে কোনও উত্তর দিতে পারছি না। কিছু একটা করতে হবে। হয়তো, হয়তো আগে যদি কিছু করতাম, তাহলে কি সিনা আজকে...”
“আমি জানতাম না আপনার কোনও আত্মীয় সিলভানে আছে।”
       “আপনি কেন, কেউই প্রায় জানত না। কাজের বাইরে আমার কতটুকু সময় ছিল? যেটুকু ছিল, সেটা ছিল নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত, কাজকে সেখানে ঢুকতে দিতাম না। এখন আর...” পরপর দ্বিতীয়বার কথা শেষ করতে পারলাম না।
       “আমরা অনেকে আজ আপনার ঐ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি। যদি আমরা আগে জানতাম জাবাজের একটা স্পেস ডেস্ট্রয়ার আছে, যদি কিছু করতাম, তাহলে হয়তো শুধু আপনার সিনা নয়, আমার ছেলেটাও...”
       ক্ষণিকের নীরবতা। “ডক্টর হারাইন, আপনাকে লুকোব না। আপনার মতো কাউকে ক্ষত্রপের আজকে খুব দরকার। জাবাজ আসলে এক মহাকাশদস্যু যে পৃথিবীর কাছাকাছি মহাকাশে অনেক যানের উপর আক্রমণ করত। সেখানকার সুরক্ষা বাহিনির তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসে। তার ঠিক আগে সে একটা মহাকাশযান থেকে কয়েকজন বিজ্ঞানীকে ধরে ফেলেছিল। তাঁদের উপর জোর খাটিয়ে জোর করে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুদ্ধের নানা কাজে লাগাচ্ছে তাঁরা না থাকলে জাবাজের ক্ষমতা ছিল না গোটা ক্ষত্রপকে পরাজিত করার। অবশ্য ক্ষত্রপের মতো শান্তিপূর্ণ গ্রহ আর একটাও নেই, এখানে সুরক্ষা বাহিনি নেই বললেই চলে। সেই ব্যাপারটাও জাবাজের পক্ষে গেছে। আমাদের একমাত্র স্পেসপোর্ট এখন জাবাজের দখলে, কাজেই বাইরে থেকে সাহায্য চাওয়ার কোনও উপায় নেইজাবাজের কব্জায় ঐ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ যেকোনও মূল্যে আমাদের দরকার।
       “কিন্তু, তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম আপনি সফল হলেন, ঐ বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলেন, আমাদের যে খবরটা দরকার, সেটা ওনাদের থেকে জানতে পারলেন কিন্তু তারপর? আমাদের খবর পাঠাবেন কেমন করে? আপনাকে যতই বিশ্বাস করুক না কেন, আপনার প্রত্যেকটা মেল ওরা পড়বে, আপনার প্রত্যেকটা গতিবিধির ওপর নজর রাখবে। ফোন করার অনুমতি পাবেন না। ভালো করে ভাবুন। আপনাকে আমাদের এখানেও দরকার হতে পারে”  
       “যে কায়দায় আমি খবর পাঠাব, তা বোঝার ক্ষমতা জাবাজের অনুচরদের হবে না। আমাকে যদি কাজ করতে দেয়, তাহলেই আমি আপনাদের চিঠি পাঠাতে পারব। সেটা পড়ার জন্য শুধু দরকার হবে আমার ছাত্র আমতেকে। আপনাকেই বলছি কেমন করে খবর পাঠাব, প্রয়োজন না হলে কাউকে জানাবেন না। শুনুন...”

আমতের কথা

অ্যাক্রোপোলিস থেকে আমার শহর প্লেনে ঘন্টাখানেক লাগে আমি গাছের কলমটা হাতে নিয়ে বসেছিলাম বেরোনোর সময় সিকিউরিটিতে সেটা নিয়ে নিতে চেয়েছিল আমি অনুরোধ করলাম, “আমার স্যার নিজে আমায় এটা দিয়েছেন, আমাকে রাখতে দিন” গার্ড কমিউনিকেটরে কারও সঙ্গে কথা বলল আমি শুধু একপাশের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম
       “ডক্টর হারাইন একটা গোলাপগাছের কলম দিয়েছেন, সেটা নিয়ে যেতে চাইছে
       “না না, অন্যকিছু দেননি, আমরা নিশ্চিত কাগজ তো নয়ই
       …
       “ঠিক আছে” কমিউনিকেটর বন্ধ করে আমাকে হাত নেড়ে চলে যেতে বলা হল
       এয়ারপোর্টে নামার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে পাশেই একটা ঘরে যেতে হল সেই দু’জন, যাঁরা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, তাঁরা ছিলেন স্যারের সঙ্গে আমার কথার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে হল দু’জনে স্পষ্টতই হতাশতাঁরা বোধহয় অনেককিছু আশা করেছিলেন
       “কোনওকিছু দেননি আপনাকে? আলাদা করে কিছু বলেননি?
       “বললাম তো আপনাদের এই গোলাপগাছের কলমটা ছাড়া কিছুই দেননি এটাকে সাবধানে রাখতে বলেছেন - কেন জানি না

হারাইনের কথা

আস্তে আস্তে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। খুব ভয় হচ্ছে ভেতরেএকটা ক্যালকুলেটেড ঝুঁকি। আমতের প্লেন নিশ্চয় এতক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে নিশ্চয় কেউ বুঝতে পারেনি কী বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ও। তা না হলে আমারও এতক্ষণে জায়গা হত জাবাজের কয়েদখানায়।
       বুঝতে কেউ পারলে আমতেই পারে কিন্তু ধরা যাক, আমতে বুঝল না ভাবল, স্যারের মতিভ্রম তাহলে? শয়তানটাকে কি তাহলে কেউ কখনও সরাতে পারবে না? মুখটা যথাসম্ভব নির্বিকার রাখলাম। ক্যামেরার তাক সর্বত্র সত্যিই ওরা কাউকে বিশ্বাস করে না। আমতেকেও আবার দেখা করতে দেবে বলে মনে হয় না। বাইরে অ্যাক্রোপোলিসে সন্ধে নামছে। বাগানে গোলাপের পাতা নড়ছে মৃদু হাওয়ায়। সিলভানে এখন নিশ্চয় রাত্রি, মাথার উপরে আধখানা ফোবোস।

আমতের কথা

সে রাতে অনেকক্ষণ ঘুম এল না। উশখুশ করলাম অনেকক্ষণ, উঠে জল খেলাম, গোটা দিনের কাণ্ডকারখানা, স্যারের কথাগুলো এপাশ ওপাশ উলটে অনেক ভাবলাম। শেষে কখন জানি না, ভোররাতের দিকেই হবে বোধহয়, অস্বস্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভারী অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলাম। সবকথা মনে নেই আর। কিন্তু বেশ মনে আছে সে স্বপ্নে ডক্টর হারাইন একটা বিশাল ঘোড়ায় চেপে (যেরকম পুরনো পৃথিবীর ছবিতে দেখেছি) শহরের দিকে আসছেন, আর আমি পাঁচিলের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। এমন সময় সামনে পড়ল একটা রক্ষী ডেস্ট্রয়ার ঘোড়াটাকে তাক করে কামান মারতে যাবে, এমন সময় ঘোড়া হয়ে গেল একটা গোলাপফুল। আর ডক্টর হারাইন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, ‘আমি নিজের হাতে এই গাছটা বানিয়েছি। গাছটাকে সাবধানে রেখো।’ কিন্তু ঘোড়া তো আর নেই। ডেস্ট্রয়ার বেকুব বনে ফিরে গেল। আমি পাঁচিলের উপরে দাঁড়িয়ে বেশ লাফিয়ে হাততালি দিয়ে উঠলাম, আর ঘুমটাও ভেঙে গেল। খানিকক্ষণ শুয়ে রইলাম, আরও একবার কালকের কথাগুলো মনের মধ্যে আওড়ালাম। আস্তে আস্তে নিশ্চিত হলাম। হ্যাঁ, যা বলার স্যার আমাকে গতকালই সব বলে দিয়েছেন।

সাতদিন পরে ডক্টর লিসার ঘরে সেই দুই ভদ্রলোক আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন প্রথমজনই সমস্ত কথাবার্তা চালান তিনিই প্রশ্ন করলেন, “আপনি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন?
       “হ্যাঁ স্যার একটা বার্তা আপনাদের জন্য পাঠিয়েছিলেন, আমি সেটা আপনাদের দিতে চাই
       “আপনি যে বলেছিলেন ডক্টর হারাইন আপনাকে কিছুই বলেননি!”
       “মুখে বলেননি বার্তাটা লিখে হাতে দিয়েছিলেন কিন্তু আমি সেটা পড়তে পারিনি আপনারা পারবেন বলেই আমার বিশ্বাস
       দু’জনেরই মুখ দেখে বুঝলাম ওনারা কিছুই বোঝেননি
“জিন সম্পর্কে আপনাদের কোনও ধারণা আছে?
       প্রথমজন একটু অধৈর্য হয়েই বললেন, “না নেই, কিন্তু আমাদের সময়ের দাম আছে আপনাকে আগেই বলেছিলাম, আমরা একটা খুব সঙ্কটের সামনে এসে পড়েছি এখন জেনেটিক্স শেখার সময় আমাদের নেই
       এতক্ষণ পরে অন্য ভদ্রলোক কথা বললেন, “শোনোই না আগে আমাদের জন্য উনি এতটা করেছেন সময়ের দাম ওনারও আছে আমাদের এমনি এমনি ডাকেননি নিশ্চয় আপনি বলুন আপনার কথা
       “ধন্যবাদ। আপনাদের আগেই বলেছি আমি জাঙ্ক বা নন-কোডিং ডি.এন.এ. নিয়ে কাজ করি। চলে আসার সময় স্যার আমাকে বলেছিলেন জাঙ্ক ডি.এন.এ.-এর মধ্যে সঙ্কেত খোঁজার দায়িত্ব আমার। স্যারের কাছ থেকে যেদিন ফিরলাম, তার পরেরদিন ভোরেই বুঝেছিলাম স্যার আমাকে কী বলতে চেয়েছিলেন। গাছটাকে সাবধানে রাখতে বলেছিলেন স্যার। বলেছিলেন যে গাছের কলমটা আমাকে দিয়েছিলেন, সেই গাছটা ওনার বানানো। শব্দটা খেয়াল রাখবেন, বানানো। হঠাৎ বুঝলাম স্যার ওই গাছের ডি.এন.এ. পালটে দিয়েছেন, তার জাঙ্ক অংশের মধ্যে সঙ্কেত ভরে দিয়েছেন।
       “জীবের জিন থাকে ডি.এন.এ.-তে। ডি.এন.এ., পুরো কথাটা হল ডি-অক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড। অনেকগুলো নিউক্লিওটাইড দিয়ে তৈরি হয় একটা ডি.এন.এ. তন্তুপ্রত্যেকটা নিউক্লিওটাইডে থাকে একটা নিউক্লিওবেস। চাররকম বেস হয় – অ্যাডেনিন, থাইমিন, সাইটোসিন আর গুয়ানিন, সংক্ষেপে এ, টি, সি আর জি। জেনেটিক্সের বিবরণ দিয়ে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাব না। শুধু বলি এই নিউক্লিওবেসগুলো কেমনভাবে সাজানো থাকে ডি.এন.এ.-তে, তাই সমস্ত জীবের জন্ম, বৃদ্ধি, জনন ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। সেটাকেই বলে জেনেটিক কোড। কিন্তু জাঙ্ক অংশের এরকম কোনও কাজ নেই। সেখানে সঙ্কেত ভরে দিলে গাছটার কোনও পরিবর্তন হবে না, কিন্তু তার প্রত্যেকটা কোষের ডি.এন.এ.-তে সেই সঙ্কেতটা থেকে যাবে। আমাদের সেটা পড়ে নিতে হবে। আমি পড়েছি। কিন্তু সেই বার্তার কোড ভাঙার ক্ষমতা আমার নেই। যতদূর বুঝেছি, সেই কাজটা আপনাদের পক্ষে খুব সহজ। তাই বার্তাটা আপনাদের দিয়ে দিতে চাই।”
       “আরও একটু স্পষ্ট করে না বললে আমরাও কিছু করতে পারব না। ডক্টর হারাইন ডি.এন.এ. পাল্টাতে পারেন আমরা জানি। কিন্তু ডি.এন.এ.-এর মধ্যে বার্তা কেমন করে থাকে বুঝতে পারছি না,” প্রথমজন বললেন।
       “একটু ধৈর্য ধরে শুনতে হবে,” আমি বললাম, “আমার আরও একটু সুবিধা আছে। স্যার জানতেন আমি শখ করে একদম প্রথম যুগের কম্পিউটার নিয়ে কিছুদিন পড়াশোনা করেছিলাম। তখন দু’শো ছাপান্নটা ক্যারেক্টার দিয়ে ইংরাজির সমস্ত অক্ষর, শূন্য থেকে নয় পর্যন্ত সমস্ত সংখ্যা, আর দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলোনের মতো চিহ্ন এসব দেখানো হত। কম্পিউটার বাইনারি পদ্ধতিতে কাজ করে আপনারা জানেন। একটা বিট হয় শূন্য না হয় এক – এই দু’টো জিনিসকে বোঝায়। দু’টো বিট দিয়ে তাহলে লিখতে পারি ০০, ০১, ১০ আর ১১ এভাবে দুই দুগুণে চার - চারটে ক্যারেক্টার বোঝানো যায়। তিনটে বিট দিয়ে আট, চারটে দিয়ে ষোল – এরকমভাবে আটটা বিট দিয়ে দু’শো ছাপান্নটা ক্যারেক্টার দেখানো যেত। তাই আটটা বিটকে একসঙ্গে বলা হত বাইট। ধরুন ০১০০০০০১ তার মানে ছিল A, ০১০০০০১০ মানে B, এইরকম
       “এবার নিউক্লিওবেসের কথা ভাবুন। আমরা এখন সহজেই কোষের ডি.এন.এ. তন্তুর মধ্যে নিউক্লিওবেসদের সাজাতে পারি। স্যার জাঙ্ক ডি.এন.এ.-এর মধ্যে সেইরকমভাবে সাজিয়ে আমাদের কাছে খবর পাঠিয়েছেন। সেইজন্যই স্যার বলেছিলেন গাছটা ওনার বানানো। জাঙ্ক ডি.এন.এ. পাল্টালে গাছটার বাইরে কোনও পরিবর্তন হবে না। আগে থেকে জানা না থাকলে কে আর ডি.এন.এ.-এর মধ্যে চিঠি খুঁজতে যাবে? কাজেই এভাবে সঙ্কেত পাঠানো সম্পূর্ণ নিরাপদ। সেজন্যই স্যার আমাকে চেয়েছিলেন। আমাকে পরিষ্কার বললেন জাঙ্ক ডি.এন.এ. থেকে সঙ্কেত বার করতে, কিন্তু যারা শুনল তারা কিছুই বুঝতে পারল না। আপনারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। কিন্তু স্যার ভেবেছিলেন যে আমি এই নিয়ে গবেষণা করি, আমি সহজেই ওনার কথাটা ধরতে পারব। স্যার আমাকে বেশি চালাক ভেবেছিলেনকিন্তু আসলে বোকাই আমি। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারিনি। সময় লেগেছিল।”
       দ্বিতীয় ভদ্রলোক বললেন, “নিজেকে বোকা বলেছেন, কিন্তু আমি তাহলে আরও বোকা। এখনও আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। ডি.এন.এ.-এর মধ্যে নিউক্লিওবেসদের সাজিয়ে কেমন করে লেখা যায়?”
       “চারটে নিউক্লিওবেস দিয়ে যদি একটা অক্ষর বা বাইট কল্পনা করি, তাহলে তা দিয়ে চার গুণ চার গুণ চার গুণ চার, মোট দু’শো ছাপান্নটা ক্যারেক্টার লেখা সম্ভব। তার মানে প্রথম যুগের কম্পিউটারে যেভাবে সবকিছু লেখা যেত, সবই নিউক্লিওবেস ব্যবহার করে লেখা যাবে। ধরুন পরপর চারটে অ্যাডেনিন অর্থাৎ এএএএ সাজিয়ে দিলাম। এই সঙ্কেতটাকে বললাম A তিনটে অ্যাডেনিন একটা গুয়ানিন মানে এএএজি, এটাকে বলাম B, এইরকম এভাবে সমস্ত কিছু লেখা সম্ভব।
       “যখন বুঝতে পারলাম, সঙ্গে সঙ্গে গাছটার জেনেটিক বিশ্লেষণ শুরু করলাম। দেখলাম, সত্যিই একটা ডি.এন.এ.-এর বিরাট অংশ পরিষ্কারভাবে একেবারে অন্যরকম, কৃত্রিম। সেই অংশটাকে বিশ্লেষণ করে আমি একটা ফাইলে লিখে রেখেছি। সেটা আপনারা নিয়ে গিয়ে বিশ্লেষণ করুন তার থেকে স্যার কী লিখেছেন পড়তে পারবেন।”

প্রথমজন এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন। এবার আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী লিখেছেন ডক্টর হারাইন? আপনি তো পড়েছেন
       “বললাম তো, আমি পড়তে পারিনি। সঙ্কেতটা পাওয়ার পরেও আরও একটা বিষয় রয়ে গেছে। আমি যেভাবে বললাম, এএএএ মানে A, স্যার যে সেটাই নিয়েছেন তার সম্ভাবনা খুব কমস্যার হয়তো সেটাকে নিয়েছেন দাঁড়ি বা কমাতবে এসব ব্যাপারে কোড ভাঙার বিশেষজ্ঞ আছেন, তাঁদের কাছে এটা খুব সহজ কাজ। কোডটার মধ্যে নতুনত্ব নেই, কিন্তু স্যার যে জিনিয়াস তা খবর পাঠাবার কায়দা থেকে বোঝা যায়
একটু থেমে বললাম, “স্যারের কাজে লাগতে পেরেছি বলে ভালো লাগছে। ওনার সম্পর্কে আমি শেষ একটা বছর কত কীই না ভেবেছি। আমার সেই ধারণাগুলো যে ভুল, সেটা বুঝতে পেরেই কিন্তু আরও ভালো লাগছে



       একমাস পর ডিরেক্টরের অফিসে এসেছি ডক্টর লিসার ডাকেতিনি আমার হাতে একটা সিল করা খাম দিয়ে বললেন, “এই চিঠিটা আপনার জন্য। ভেতরে কী আছে আমি জানি নাআমাকে বলা হয়েছে, এটা আপনাকে এখানে বসেই পড়তে হবে, বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না, কপি করা যাবে না
       খামটা খুলতে বেরোল একটা কাগজ ও আরও একটা মুখবন্ধ খাম। কাগজটাতেই প্রথমে চোখ বোলালাম। নিচে কোনও সই নেই। লেখা আছে, ‘সঙ্গের খামে আপনার উদ্দেশ্যে একটা চিঠি আছে। আপনি জানেন আমরা কোথা থেকে এই কথাগুলো পেয়েছি। লেখক আপনাকে এটা দিতে বলেছেন। খাম খোলার পাঁচ মিনিট পরে কাগজগুলো ছাই হয়ে যাবে। দয়া করে কোনও কপি করবেন না। আপনার মেশিন থেকেও বার্তার কপিটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মুছে দিন। ক্ষত্রপের মুক্তির জন্য আপনার অবদান অন্য কাউকে এই মুহূর্তে জানাতে না পারলেও আমরা ভুলে যাব না।’
ভেতরের খামটা খুললাম, তার মধ্য থেকেও বেরোল একটা কাগজছাপার অক্ষরে আমার উদ্দেশ্যে লেখা একটা চিঠি। পড়ার আগে এক মুহূর্ত সময় নিলাম। ডক্টর লিসার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, “কী লেখা আছে বা কার কাছ থেকে এসেছে, আমাকে বলবেন না। আমি জানতে চাই না। আমার দায়িত্ব শুধু আপনাকে এটা পৌঁছে দেওয়া।”
       আমি হাতের কাগজটার দিকে চোখ নামালাম। এইরকম কাগজের কথা আমি শুনেছি। একটা বিশেষ রাসয়ানিক কাগজে লাগানো থাকে, হাওয়ার সংস্পর্শে এলে কিছুক্ষণ পরে কাগজটা পুড়ে যায়।
‘এই চিঠিটা পড়ছ মানে আমার পরিকল্পনার প্রথম অংশ অন্তত সফল হয়েছে। অবশ্য এই ভাগটা যে সফল হবে তা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। সব ঠিকঠাক চললে আজ থেকে দু’তিনমাস পরে তুমি আমার এই চিঠিটা পড়বে
       প্রথমেই তোমাকে কিছুটা হলেও বিপদে ফেলার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিই। আগে তোমার এখানে আসার কোনও প্রয়োজন ছিল না - শুধু জিন সিকোয়েন্সিং-এর কাজটা তোমার করার কথা। জাবাজ যে কাজ করছে, তোমাকে তো চিনি, তুমি তার সর্বতোভাবে বিরোধী। অ্যাক্রোপোলিসে তোমার কথায়-বার্তায় যদি সেটা ফুটে উঠত, তাহলে তোমার বিপদ হতে পারততা সত্ত্বেও পরিস্থিতি এমন হল যে তুমি ছাড়া আমার কোনও গত্যন্তর ছিল না আমার উপর সারাক্ষণ নজর রাখা হয়। তুমি আমার ছাত্র, আমার সঙ্গে দেখা করতে চাও, এ কথা বললে অনুমতি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। জাবাজকেও তো গোটা ক্ষত্রপের সামনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো কথা হল যে একমাত্র তুমিই আমার ইঙ্গিত বুঝতে পারবে, বুঝবে কেমনভাবে আমি সঙ্কেত পাঠাচ্ছি। অন্য কাউকে দিয়ে সে কাজ হবে না। তুমি এই চিঠি পড়ছ মানে তোমার মাধ্যমেই আমার পাঠানো খবরগুলো প্রয়োজনীয় জায়গায় পৌঁছে গেছে। সেই সঙ্গে তোমার জন্য পাঠাচ্ছি এই চিঠিটা।
       এতদিনে বুঝতেই পেরেছ আমি কেন বেদাসে এসেছি, জাবাজের হয়ে কাজ করছিতোমাকে আগে বলিনি, তার কারণ এই কথাটা যত কম লোক জানে, ততই মঙ্গল। শুধু তো আমি নই, আরও কয়েকজন লোক এর মধ্যে জড়িত, তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টাও আছে।
       আমি বিজ্ঞানী, আমি কেন এই সমস্ত ব্যাপারে জড়ালাম? সিলভানে থাকত আমার একমাত্র ভাইতার একটা ছোট্ট মেয়ে ছিল, সিনা। জাবাজ যেদিন সিলভান আক্রমণ করেছিল সেদিন তারা দু’জনেই মারা যায়। সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এই দানবের শাসনকে শেষ করাই হবে আমার জীবনের ব্রত।
       কিন্তু কীভাবে? কেমন করে আমি একা একটা মানুষ জাবাজের বিরোধিতা করতে পারি? সুযোগ খুঁজছিলাম, সুযোগ এসেও গেল। কেমন করে, সেকথা তোমাকে এখন বলতে চাই না। শুধু বলতে পারি যে তোমার সহায়তায় আমি সেই কাজটাই করলাম।
       জানি তুমি আমাকে একসময় ভুল বুঝেছিলে। আশা করি এখন বুঝতে পেরেছ কোন তাগিদ থেকে আমি এই রাস্তা বেছে নিয়েছি। তুমি ভালো থেকো। প্রথম পর্বের কাজ শেষ হয়েছে – এবার দ্বিতীয় অঙ্কের অপেক্ষা। আমার পাঠানো খবর যদি ঠিক হয়, তবে হয়তো আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই জাবাজের পতন ঘটবে। ক্ষত্রপের পুনর্জন্ম ঘটবে।’
       আমি কাগজটা সামনের একটা ট্রের উপর নামিয়ে রাখলাম। আমার চোখের সামনে সেটা নিজে থেকেই পুড়ে ছাই হয়ে গেল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। স্যারের পাঠানো গোলাপগাছটা ল্যাবরেটরির সামনের বাগানে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। তাতে অনেকগুলো কুঁড়ি ধরেছে। কয়েকদিনের মধ্যেই গাছটা লাল গোলাপে ভরে যাবে।
_______
ছবিঃ অদ্রিজা ঘোষ

2 comments:

  1. interesting গল্প, আমি আগেও ম্যাজিক ল্যাম্পে পড়েছি, এবারের টা বেশ লাগল, পরের অংশের জন্য অপেক্ষায় আছি।

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ। শেষ অংশ লেখার চেষ্টা করছি। দেখা যাক কেমন দাঁড়ায়।

    ReplyDelete