দেশবিদেশের গল্প:: কুড়ি বছর পরে - ও. হেনরি :: ভাষান্তরঃ ঈশানী রায়চৌধুরী


কুড়ি বছর পরে
মূল গল্পঃ . হেনরি
ভাষান্তরঃ ঈশানী রায়চৌধুরী

পুলিশটি হেঁটে যাচ্ছিল রাস্তা দিয়ে দৃঢ়, বলিষ্ঠ, আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে এটাই অবশ্য লোকটির চলাফেরার ধরন এইমুহূর্তে তাকে কেমন দেখাচ্ছে, তা নিয়ে মাথাই ঘামাচ্ছিল না সে পথেঘাটে ক’টা মানুষই বা নজর করবে তাকে? সবেমাত্র রাত দশটা, কিন্তু জাঁকিয়ে শীত পড়েছে আজ বাতাস বইছে, সেই সঙ্গে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি
পথে যেতে যেতে যত বাড়ির সদর দরজা পড়ছে সামনে, সবক’টা ঠেলেঠুলে দেখে নিচ্ছে বন্ধ আছে কি না রাত হয়েছে তো! সাবধানের মার নেই মাঝেমধ্যেই ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক সেদিক নজর করছে, তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নিচ্ছে পথের এ প্রান্ত থেকে প্রান্ত দিব্যি সুদর্শন চেহারার পুলিশ, সতর্ক সাবধানী শান্তিরক্ষক
শহরের এই অঞ্চলে লোকজন বাড়ি  ফিরে যায় অপেক্ষাকৃত তাড়াতাড়ি এদিক ওদিক একটা দুটো বিজলিবাতি আলোর বিন্দু হয়ে ফুটে আছে হয়তো কোনও দোকান বা ছোটোখাটো রেস্তোরাঁ বেশিরভাগ দরজাই কোনও না কোনও দোকান বা অফিসবাড়ির, যা বেশ কয়েকঘন্টা আগেই ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে
আচমকা চলার গতি মন্থর হল তার একটা অন্ধকার দোকানের দরজার কাছে একজন কেউ যেন দাঁড়িয়ে পুলিশটিকে এগিয়ে আসতে দেখে অপেক্ষারত মানুষটি তড়িঘড়ি বলে উঠল, “অফিসার, আমি আসলে এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি বিশ বছর আগে আমরা পরস্পরকে কথা দিয়েছিলাম, আজকের দিনে এইখানে ঠিক এই সময়ে দেখা করব আপনার শুনে খুব অবাক লাগছে, তাই না? যদি আপনার সন্দেহ হয়ে থাকে, তাহলে আপনাকে নিশ্চিন্ত করার জন্য পুরো ব্যাপারটাই বুঝিয়ে বলব বিশ বছর আগে এই যে এই দোকানটা, এখানে একটা রেস্তোরাঁ ছিল বিগ জো ব্র্যাডির রেস্তোরাঁ
পুলিশটি বলল, “মাত্র পাঁচবছর আগেও তো ছিল
দরজা ঘেঁষে দাঁড়ানো লোকটির মুখের গড়ন চৌকোমতো, রং ফ্যাকাশে, একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ আর ডান চোখের পাশে একটা ছোট্ট সাদাটে দাগ টাইতে বসানো চকচকে পাথর লোকটি বলল, “বিশ বছর আগে ঠিক এই দিনটিতে আমি এখানে রাতের খাবার খেয়েছিলাম জিমি ওয়েলসের সঙ্গে আর আমি ছিলাম হরিহর আত্মা জিমির মতো ভালো মানুষ সারা দুনিয়ায় আর নেই আমরা ঠিক দুই ভাইয়ের মতো বড়ো হয়েছি নিউ ইয়র্ক শহরে আমার বয়স তখন আঠেরো, জিমির কুড়ি পরেরদিন সকালে আমায় চলে যেতে হবে পশ্চিমে চাকরি খুঁজব, জীবনে সফল হতে হবে আমাকে কিন্তু জিমি? নড়বেই না নিউ ইয়র্ক থেকে ওর সেই এক গোঁ, নিউ ইয়র্কই দুনিয়ার একমাত্র জায়গা!
সে রাতে আমরা ঠিক করেছিলাম, বিশ বছর পরে আবার এখানেই এসে মিলব দুজনে ভেবেছিলাম, মাঝের এই এতগুলো বছর প্রমাণ করে দেবে আমরা কে কোথায় পৌঁছতে পেরেছি আর কোন ভবিষ্যৎই বা অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য
পুলিশটি মন্তব্য করল, “ভারী অদ্ভুত তো! তবে কুড়িটা বছর কিন্তু অনেকই দীর্ঘ সময় মানে, আমার তো তেমনটাই মনে হয় তা এই যে আপনি পশ্চিমে চলে গিয়েছিলেন, বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না?
লোকটি জবাব দিল, “কিছুদিন চিঠিচাপাটি চালাচালি হয়েছিল কিন্তু দু’একবছর পরে সেটা বন্ধ হয়ে যায় পশ্চিমের দেশ বিশাল আমি প্রচুর ঘোরাঘুরি করেছি কোনও জায়গাতেই বেশিদিনের জন্য থিতু হইনি কিন্তু জানি, জিমি পারলে আজ এখানে নিশ্চয়ই আসবে এমন মানুষ, যে কথা দিলে কথা রাখে কিছুতেই ভুলে যাবে না হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এখানে আজ হাজির হয়েছি আমার পুরনো বন্ধু এলে আমার আনন্দ ষোলো আনা পূরণ হয়
অপেক্ষারত লোকটি পকেট থেকে একটি মহার্ঘ ঘড়ি বের করে সময় পরখ করল ঘড়িতে খুদে খুদে রত্ন বসানো
“রাত দশটা বাজতে আর মিনিট তিনেক বাকি সে রাতে রেস্তোরাঁর দরজা থেকে আমরা যখন দুজন দুজনের কাছ থেকে বিদায় নিই, তখন ঠিক দশটাই বেজেছিল
পুলিশটি বলল, “আপনি নিশ্চয়ই পশ্চিমে গিয়ে সাফল্যের স্বাদ পেয়েছেন?
“সে আর বলতে! আশা করি জিমিও আমার মতো না হলেও অন্তত অর্ধেক সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে ওর আবার একটু ঢিমে তেতালায় এগোনো স্বভাব আমাকে অনেক লড়াই করে তবেই জায়গায় পৌঁছতে হয়েছে নিউ ইয়র্কেই দেখি লোকজন তেমন বদলায় না পশ্চিমে মানুষ টিকে থাকার জন্য আপনা থেকেই লড়াই করতে শিখে যায় নিজের পায়ের নীচের জমি নিজেকেই শক্ত করে নিতে জানতে হয়
পুলিশটি এক দু’পা এগোল তারপর বলল, “আমি এবার চলি আশা করি আপনার বন্ধুটি ঠিক পৌঁছে যাবেন দশটার মধ্যে উনি না এলে কি আপনি ফিরে যাবেন?
লোকটি জবাব দিল, “না না, অন্তত আধঘন্টা অপেক্ষা করব ওর জন্য জিমি যদি বেঁচে থাকে, তবে ওই সময়ের মধ্যে আসবেই আসবে শুভ রাত্রি, অফিসার!”
“শুভ রাত্রি
পুলিশটি এগিয়ে গেল পরপর দরজা পরখ করতে করতে

বৃষ্টি বেড়েছে, সেই সঙ্গে বাতাসের গতিও রাস্তায় যে গুটিকয় লোক এখন, তারাও পা চালিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে ব্যস্ত জোরে হাঁটলে শীতবোধ একটু কম হয় আর ওই দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সেই লোকটি, যে কুড়ি বছর পরে পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে হাজার মাইল পথ পেরিয়ে
এই প্রতীক্ষা ফলপ্রসূ হবে কি না নিশ্চিত করে বলাও যায় না তবুও লোকটি অপেক্ষা করছে
প্রায় কুড়ি মিনিট অপেক্ষার পর লম্বা ঝুলের কোট পরা একজন দীর্ঘকায় মানুষকে দূর থেকে আসতে দেখা গেল দ্রুত পায়ে সে সোজা এসে দাঁড়াল অপেক্ষমান লোকটির সামনে সামান্য দ্বিধা জড়ানো গলায় জানতে চাইল, “বব নাকি?
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি উত্তেজনায় অধীর
“তুমি জিমি ওয়েলস?
নতুন আগন্তুক অন্য লোকটির হাত চেপে ধরল
“বব! হ্যাঁ, ববই তো! আমি জানতাম তুমি বেঁচে থাকলে তোমাকে আজকের তারিখে এখানেই পাওয়া যাবে কুড়ি বছর অনেক দীর্ঘ সময়, বব পুরনো রেস্তোরাঁটা আর নেই থাকলে কিন্তু বেশ হত, তাই না? আমরা আবার একবার বসে খেতাম! পশ্চিমে কেমন কাটল তোমার?
“যা যা চেয়েছি, সব দু’হাত ভরে পেয়েছি তবে তুমি কিন্তু বদলে গেছ, জিমি তুমি যে এতটা লম্বা... কী জানি, কেমন অবাক লাগছে!
“ওহ্‌, কুড়ি বছর বয়সের পর ঝপ করে মাথায় খানিক বেড়ে গেলাম
“নিউ ইয়র্কে কাজকর্ম কেমন চলছে জিমি?
“ভালোই শহরটার ভালোর জন্য কাজ করি চল বব, আমার চেনা একটা জায়গায় যাওয়া যাক অনেক সব পুরনো কথা বলা যাবে
দুজন হাতে হাত রেখে পা বাড়াল পশ্চিম থেকে আসা লোকটি শুরু করল নিজের জীবনের গল্পকথা অন্য জন কোটের কলার কান পর্যন্ত তুলে শুনতে লাগল গভীর মনোযোগে
মোড় ঘুরতেই একটা দোকান তীব্র উজ্জ্বল বিজলিবাতি তার কাছাকাছি এসেই একে অন্যের মুখের দিকে তাকাল পশ্চিম থেকে আসা লোকটি এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিল নিজের হাত
“তুমি তো জিমি ওয়েলস নও! কুড়িটা বছর যদিও অনেকটাই সময়, তবুও তাতে মানুষের নাকের গড়ন এভাবে পাল্টে যেতে পারে না!
লম্বা  লোকটি বলল, “এই কুড়িটা বছর কখনও কখনও একজন ভালো মানুষকে কিন্তু মন্দ করে দিতে পারে দশ মিনিট হল তোমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বব শিকাগো পুলিশের কাছে খবর ছিল, তুমি নিউ ইয়র্কে আসতে পার তারা সেইমতো এখানে আমাদের সতর্ক থাকতে বলেছিল আমার সঙ্গে চুপচাপ আসবে তো, বব? এই তো, লক্ষ্মীছেলে! কিন্তু এক মিনিট, তোমার জন্য একটা কাগজ আছে আমাকে বলা হয়েছে সেটা তোমাকে দিতে এই জানালা দিয়ে আসা বাতির আলোয় বরং পড়ে নাও ওয়েলস নামের আমার এক সহকর্মী পুলিশ এটা তোমাকে পাঠিয়েছে
পশ্চিম প্রান্ত থেকে আসা লোকটি চিরকুটটা খুলল পড়তে পড়তে তার হাতটা কাঁপছিল থরথর করে

“বব,
আমি ঠিক সময়েই ঠিক জায়গায় আজ পৌঁছে গিয়েছিলামচোখে পড়ল সেই মুখ, যাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে শিকাগো পুলিশ আমি পারিনি, কিছুতেই পারিনি নিজের হাতে তোমায় হাতকড়া পরাতে তাই ফিরে গিয়ে আমার সহকর্মীকে পাঠালাম বাকি কাজটুকু করার জন্য 
জিমি’’
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল

4 comments:

  1. ভীষণ ভালো লাগল

    ReplyDelete
  2. Bhison Bhalo , Golpoti amar aage pora chilo , ICSE deyar somoy amader ekta golper boi chilo Selected Stories bole tate chilo golpota - After Twenty Years , seta 94 er byapar , kintu golpota mone rekha ketechilo ; ajke apni etake sobar samne bangla te tule dhorechen dekhe aro i bhalo laglo . Khub Sundor apnar ei proyas. Asgha rakhi apnar kach theke aro onek bhalo bhalo lekha pabo. Hoyto ektu besh bola galo nostalgic hoye giye.

    ReplyDelete
  3. সুন্দর অনুবাদ।নতুন করে আবার ভালো লাগলো।

    ReplyDelete