পরদিন সকাল আটটা নাগাদ আমার আর সঞ্জুর ঘুম ভাঙল। দেখি অমলকাকু চেয়ারে বসে একটা সাদা কাগজে কীসব আঁক কষছেন। আর গোমস ওঁর দিকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে আছে। সঞ্জু তা দেখে বলল, “কী গো ছোটকা, তুমি কখন থেকে এসব করছ? রাতে ঘুমিয়েছিলে তো?”
“আরে ঘুমবো না কেন? তবে ভোরবেলাই চোখটা খুলে গেল। জানিসই তো, কোনও অঙ্ক যদি মেলাতে না পারি তাহলে...”
“তা কোনও কিছু বুঝতে পারলে?”
“না, এখনও অব্দি তেমন কিছু নয়। চ, ব্রেকফাস্ট সেরে একটু বেড়িয়ে আসি। তাতে যদি মাথাটা একটু খোলে।”
গোমসের সাথে কথা বলে আমরা ঠিক করলাম, পায়ে হেঁটেই আমরা এখন মানিকচৌরির উত্তর দিকটায় যাব। ওদিকে নাকি একটা সুন্দর ঝর্ণা আছে। সেইমতো ন’টা নাগাদ টিফিন খেয়ে একটা স্যাকে কিছু শুকনো খাবার, জল আর গামছা নিয়ে আমরা রওনা হলাম। ইচ্ছা স্নানটা ঝর্ণার জলেই সারব।
মানিকচৌরি জায়গাটা সত্যিই সুন্দর। চারদিকটা পাহাড় দিয়ে ঘেরা। আমরা হাঁটছিলাম একটা হালকা বনের পথ ধরে। মাঝে মাঝেই প্রকৃতির শোভা দেখে আমাদের দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছিল। অমলকাকুর ডিজিটাল ক্যামেরাটা নিয়ে সঞ্জু এন্তার ছবি তুলে যাচ্ছিল। শুধু প্রকৃতির নয়, সঙ্গে আমাদেরও। একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম, ছবি তোলার ব্যাপারে গোমসের দারুণ অনীহা। সে কিছুতেই ফটোবন্দি হতে চাইছিল না। যাই হোক, তাই ঝর্ণার কাছে পৌঁছতে আমাদের প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেল। এমন সুন্দর জায়গায় কেন যে টুরিস্ট তেমন আসে না কে জানে!
আমরা দু’জন প্রকৃতির শোভা প্রাণভরে উপভোগ করলেও অমলকাকুকে কেমন যেন আনমনা লাগছিল। সঞ্জু কাকুকে বলল, “এত সুন্দর একটা ঝর্ণার সামনে দাঁড়িয়েও তুমি মুখ ব্যাজার করে আছ কেন ছোটকা? চল, সকলে মিলে চান করি। দারুণ মজা হবে!”
অমলকাকু আসলে এতক্ষণ ঐ ধাঁধাটার মধ্যেই ডুবে ছিলেন। উনি বললেন, “দ্যাখ সঞ্জু, পশ্চিমে মেপে তিন গজে চেপে বলতে ঐ তিনটে পাথরের হাতি যেখানে বসান আছে সেখান থেকে পশ্চিম দিকে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এর ঠিক পরের লাইনেই আছে সাত গুণে যাই। এর মানে কী?”
“আমার মনে হচ্ছে, কোনও কিছুকে সাত দিয়ে গুণ করতে হবে,” সঞ্জু জবাবে বলল।
“আমারও সেরকমই মনে হচ্ছে। কিন্তু গুণটা কাকে করতে হবে সেটা কিছুতেই ধরতে পারছি না।”
“আচ্ছা ছোটকা, গজ মানে যেমন হাতি, তেমনি তো আবার তিন ফুট দূরত্বকেও বোঝায়। সেক্ষেত্রে তিন গজ মানে তো নয় ফুট দাঁড়াল।”
“এক্সিলেন্ট! তুই একদম ঠিক ধরেছিস। বংশের ধারা যাবে কোথায়! তাহলে নয় ফুটকে সাত দিয়ে গুণ করে দাঁড়াল তেষট্টি ফুট। এবার পরের লাইন, গুণ করে পাই। কিন্তু তেষট্টিকে গুণটা করব কী দিয়ে?”
গোমস বেশ উদ্বেগের সাথে বলল, “বাই চান্স শচীনবাবু ধাঁধাটা বানাবার সময় ওখানে সংখ্যাটা লিখতে ভুলে জাননি তো! তাহলে তো আর কোনওদিনই ওটা সলভ করা যাবে না।”
অমলকাকু বললেন, “সেটার সম্ভাবনা নেই। যে ভদ্রলোক এতো খেটেখুটে রীতিমত ছন্দ মিলিয়ে ধাঁধাটা বানিয়েছেন তিনি ওরকম একটা সিলি মিসটেক করবেন, মনে হয় না। আমরাই বোধহয় রহস্যটা ঠিক ধরতে পারছি না।”
আমারও সেটাই মনে হচ্ছিল। আমি সঞ্জুকে বললাম, “চ, ঝর্ণার জলে চান করি। তাতে মাথাটা যদি খোলে।”
অনেকক্ষণ সেদিন ঝর্ণার জলে আমরা চান করলাম। এত আরাম লাগছিল, কী বলব! গোমস অবশ্য জলে নামেনি। ও নিজের খেয়ালে একটা বড়ো পাথরের ওপর আঁক কাটছিল। কাছে গিয়ে দেখি চারটে বড়ো বড়ো গোল্লা এঁকেছে। সঞ্জু জিজ্ঞাসা করল, “এসব কী এঁকেছ গোমস?”
গোমস মলিন হেসে জবাব দিল, “চারজন মানুষের মাথা। একটা ছোট্ট রহস্য নিয়ে এই চারটে মাথা ভেবে চলেছে অথচ সমাধান বেরোচ্ছে না। কী অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না!”
কথাগুলো শুনে আমরা সকলেই বুঝতে পারলাম, ধাঁধাটার সমাধান করা যাচ্ছে না দেখে গোমস খুব ভেঙে পড়েছে। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। আংটিটা না পেলে যে ওর মুমূর্ষ মায়ের চিকিৎসা আটকে যাবে। এদিকে গোমসের আঁকা ঐ গোল্লাগুলো দেখে আমার মাথায় হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সেটা ঝর্ণার জলে মাথা ভিজানোর প্রভাব কি না জানি না। আমি অমলকাকুকে বললাম, “কাকু, বৃত্তের ক্ষেত্রফল পাই আর স্কয়ার আর পরিধি টু পাই আর। তাই আমার মন বলছে ধাঁধার ঐ পাইটা বোধহয় ত্রিকোণমিতির পাই অর্থাৎ টুয়েন্টি টু
বাই সেভেন।”
আমার কথা শেষ হতে না হতেই অমলকাকু আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “ব্রাভো! আমার বিশ্বাস তুই বড়ো হয়ে একজন বিজ্ঞানী-টিজ্ঞানী হবি। তাহলে আগের তেষট্টিকে সাত ভাগের
বাইশ দিয়ে গুণ করলে পাওয়া যাচ্ছে একশো
আটানব্বই। এরপরের লাইনে কোনও ঝামেলা নেই - ভাগ করি তাই, একাদশটাই। অর্থাৎ,
একশো আটানব্বইকে
ভাগ করতে হবে এগারো দিয়ে। ভাগফল দাঁড়াচ্ছে আঠারো।”
সঞ্জু এবার বলল, “এবার ধাঁধায় আছে ভাগফল শেষে, যেখানেই মেশে। তার মানে ঐ হাতি তিনটে যেখানে রাখা আছে সেখান থেকে পশ্চিম দিকে আমাদের
আঠারো ফুট যেতে হবে।”
অমলকাকু বললেন, “ঠিক তাই। চ, আমরা তাড়াতাড়ি বাংলোয় ফিরে যাই। আঠারো ফুট পশ্চিমের ঠিক কোন জায়গাটাকে নির্দেশ করা হচ্ছে তা না বুঝতে পারলে ধাঁধার পরের অংশটা সমাধান করা যাবে না।”
।। ছয়।।
অমলকাকুর তাড়ায় সেদিন বেশিক্ষণ আর আমাদের ঝর্ণায় চান করা হল না। বাংলোতে ফিরেই কাকু ফিতে নিয়ে মাপামাপি শুরু করে দিলেন। গোমস হল ওঁর সহকারী। যেখানে পাথরে খোদাই করা হাতি তিনটে ছিল সেখান থেকে সোজা পশ্চিমে গিয়ে দেখা গেল বাংলোয় ঢোকার মুখেই যে ফোয়ারাটা আছে ঠিক তার কেন্দ্রবিন্দুতে আঠারো ফুট হচ্ছে। অমলকাকু এবার লাফিয়ে উঠে বললেন, “আমরা ধাঁধার প্রথম অংশটা ঠিকঠাকই সমাধান করেছি বলে মনে হচ্ছে। এবার পরের পার্টটায় যেতে হবে।”
কিন্তু তখন আমার আর সঞ্জুর পেটে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে। আমি অমলকাকুকে বললাম, “অনেক বেলা হয়েছে। চলুন, হোটেলে খেতে খেতে বাকিটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে।”
কিন্তু গোমস তাতে আপত্তি জানাল। বলল, “আপনারা পাবলিকলি ধাঁধাটা নিয়ে আলোচনা করবেন না, প্লিজ। ব্যাপারটা পাঁচকান হয়ে গেলে ঐ আংটিটা হাতাবার জন্য আরও অনেকে হামলে পড়তে পারে। তখন খুব মুশকিল হয়ে যাবে। আংটিটা না পেলে আমি মায়ের ট্রিটমেন্ট করাতে পারব না।”
কথাটা গোমস মোটেই খারাপ বলেনি। সঞ্জু বলল, “তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। আংটির ব্যাপারটা আমাদের তিনজনের বাইরে কেউ
ঘুণাক্ষরেও জানতে পারবে না।”
হোটেল থেকে খেয়ে বের হওয়ার সময় একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হল। কোথা থেকে রামদয়াল এসে সোজা অমলকাকুর পা দু’টো জড়িয়ে ধরল। বক্তব্য, আমাদের মিথ্যা ভূতের ভয় দেখিয়ে সে খুব অপরাধ করেছে। তার সংসারের অবস্থা খুব খারাপ। নুন আনতে রোজ পান্তা ফুরোয়। তাই গোমসের অতগুলো টাকার অফার সে ফেরাতে পারেনি। এখন তার মালিক মানে সাত্যকিকাকু যদি জানতে পারেন যে টাকার লোভে সে একটা লোককে ঐ বাংলোয় থাকতে দিয়েছে এবং সেজন্য আমাদের মিথ্যা ভূতের গল্প শুনিয়ে ভাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তাহলে সাত্যকিকাকু ওকে কেয়ারটেকারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেবেন। সেক্ষেত্রে ওর সারাবছরের একটা বাঁধা ইনকাম বন্ধ হয়ে যাবে। বৌ-বাচ্চা নিয়ে ওর দুর্গতির শেষ থাকবে না। যাই হোক, অমলকাকু অনেক কষ্টে রামদয়ালকে বোঝাতে সক্ষম হলেন যে ওর চিন্তার কোনও কারণ নেই। আমরা সাত্যকিকাকুকে এ ব্যাপারে কিছুই জানাব না।
হোটেলে খাওয়াদাওয়া শেষ করতে প্রায় তিনটে বেজে গেল। গোমস বিশেষ কিছু খেল না। বুঝতে পারছিলাম ধাঁধাটার সমাধান হবে কি না তা নিয়ে ও খুব টেনশনে আছে। খাওয়া সেরে আমরা যখন আবার বাংলোয় পৌঁছলাম তখন প্রায় বিকেল। ফোয়ারাটার সামনে যেতে না যেতেই গোমস বলল, “এবার তাহলে ধাঁধাটার পরের অংশটায় যাওয়া যাক।” বেচারির আর তর সইছে না।
আগেই বলেছি, ফোয়ারাটা দেখতে অনেকটা প্লেটের মতো, যার ঠিক মাঝখানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা নকশাদার মোটা লোহার নল। অমলকাকু বললেন, “ধাঁধায় আছে ভাগফল শেষে, যেখানেই মেশে / এক মহাকবি পাই।”
আমি বললাম, “এতক্ষণ তো বেশ অঙ্ক চলছিল। হঠাৎ মহাকবি কোথা থেকে হাজির হলেন?”
সঞ্জু বলল, “আচ্ছা, কালিদাসকে তো মহাকবি বলা হয়। আর বাল্মিকীও তো...”
“না না, বাল্মিকীর পরিচিতি আদিকবি হিসাবে; আর রবীন্দ্রনাথ হলেন বিশ্বকবি,” অমলকাকু মন্তব্য করলেন।
গোমস বলল, “আচ্ছা, এই লোহার নলটার গায়ে কোনও বিখ্যাত কবির ছবি-টবি খোদাই করা নেই তো? সেই জায়গা থেকেই হয়তো ধাঁধাটার পরবর্তী অংশটা বোঝা যাবে।”
গোমসের কথামতো আমরা সকলেই লোহার নলটা ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলাম। কিন্তু লতা-পাতা-ফুল-ফলের নকশা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। এবার অমলকাকু বললেন, “আমাদের ভাবনা-চিন্তায় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। ঐ মহাকবির সঙ্গে আমি নিশ্চিত গণিতের একটা সম্পর্ক আছে। কারণ, ধাঁধাটার পরের অংশটাতেও প্রচুর অঙ্কের খেলা। সামনে অঙ্ক, পিছনে অঙ্ক, শুধু মাঝখানে একজন মহাকবি। ব্যাপারটা ঠিক যেন খাপ খাচ্ছে না।”
অমলকাকুর কথায় যে যুক্তি আছে সেটা আমরা সকলেই মেনে নিলাম। তারপর মহাকবির গভীরে লুকনো অঙ্কটা অনুসন্ধানের চেষ্টা শুরু করলাম। কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনও আশার আলো মিলল না। চারজনই বসে রইলাম মনমরা হয়ে। সঞ্জু আমাকে বলল, “চ, সামনের দোকান থেকে একটু মুড়ি-তেলেভাজা কিনে নিয়ে আসি। অল্প অল্প খিদে পাচ্ছে।”
।। সাত।।
এখানকার মুড়িগুলো একটু অন্য ধরনের আর খেতেও বেশ ভালো। ওদিকে তেলেভাজা বলতে সামোসা আর বড়ো বড়ো লঙ্কাভাজা। তবে লঙ্কাগুলো কিন্তু মোটেই ঝাল নয়, বরং একটু টক টক গোছের। আমরা চারজনে বাংলোর সামনের বিশাল বারান্দাটায় বসে মুড়ি চিবোচ্ছিলাম। হঠাৎ কেন জানি আমার অমলকাকুর ঠোঙাটার দিকে চোখ গেল। ঠোঙায় একটা গণেশঠাকুরের ছবি। তাই দেখে আমার ঐ গণেশের মন্দিরটার কথা মনে পড়ে গেল। আমরা ঝর্ণা দেখতে যাওয়ার পথে আজ সকালে দেখেছিলাম মন্দিরটা। আমি অমলকাকুকে বললাম, “মুম্বাইতে গণেশের খুব পুজো-আচ্চা হয় জানি। তবে ছত্তিশগড়ে যে গণপতিবাপ্পা এত জনপ্রিয়, জানতাম না।”
আমার কথা শেষ হতে না হতেই সঞ্জু বলল, “ঠিক বলেছিস। আমি খাবার হোটেলটাতেও একটা গণেশের ফটো দেখেছি। আর সঙ্গে ইঁদুরও। সেটা অবশ্য জ্যান্তই ছিল।”
“জানিস, গণেশের কত প্রতিভা! ঐ দেবতাটি না থাকলে মহাভারত লেখাই হত না। বেদব্যাস তো নিজের হাতে মহাভারত লেখেননি। উনি কেবল মুখে বলে গেছেন আর গণেশ তা...” এ পর্যন্ত বলেই অমলকাকু হঠাৎ চুপ করে গেলেন।
আমি বললাম, “কী হল অমলকাকু, হঠাৎ কী ভাবছেন?”
এই সময়ে কাকু হঠাৎ মেঝেতে একটা থাপ্পড় মেরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ইউরেকা! মহাকবির মানে ধরতে পেরেছি।”
একথা শুনে আমরা বাকি তিনজনও বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লাম। প্রায় সমস্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী মানে?”
কাকু এককথায় জবাবটা দিলেন না। বেশ ফেলুদাসুলভ ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলেন, “ভাগ্যিস এখন তোরা গণেশের প্রসঙ্গ তুললি। না হলে শচীনবাবুর মহাকবির ছদ্মবেশ উন্মোচন করা সম্ভবই হত না। আমরা সবাই জানি মহাভারতের রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস, সংক্ষেপে ব্যাসদেব। মহাভারতের কবি বলে ওঁকে মহাকবিও বলা হয়। এবার ব্যাসদেবকে আরও সংক্ষিপ্ত করলে দেখ ব্যাস পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে ফোয়ারার বেসমেন্টে ঐ বিরাট পাথরের চাকতিটার মহাকবি থুড়ি ব্যাসের কথা ধাঁধায় বলা হয়েছে।”
কাকুর ব্যাখ্যা শুনে আমাদের আনন্দ আর ধরে না। গোমস তো “জয়, গণেশ বাবার জয়” বলে চেঁচিয়েই উঠল। দুপুর থেকে আমাদের মধ্যে যে মনমরা ভাবটা ছিল তা উধাও হল এক নিমেষে। আমরা লাফিয়ে হাজির হলাম ফোয়ারাটার সামনে। অমলকাকু ফিতে দিয়ে মেপে দেখলেন ঐ পাথরের চাকতিটার ব্যাস দাঁড়াচ্ছে ছয় ফুট। আমি বললাম, “এরপর ছড়ায় আছে অর্ধে মোদের ঠাঁই / সাথে পাঁচ-পা যুক্ত, হাতখানা অতিরিক্ত।”
গোমস বলল, “ছয় ফুটের অর্ধেক তো হল গিয়ে তিন ফুট। তাহলে....”
অমলকাকু ওকে বাহবা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “কে বলে তুমি অঙ্কে কাঁচা! এই তো দিব্যি ছয়কে দুই দিয়ে ভাগ করতে পারলে।”
একথা শুনে আমি আর সঞ্জু দু’জনেই হেসে ফেললাম। আর গোমস সেই যে চুপ করল, রাত্রে খাওয়ার আগে পর্যন্ত তার মুখ দিয়ে আর কোনও বাক্যি বের হল না। যাই হোক, আমরা আবার ধাঁধায় ফিরে এলাম। মাত্র তিন ফুটে মোদের ঠাঁই! এর মানেটা কী? পরের লাইনে আবার পাঁচখানা পা-যুক্ত হাতের কথা বলা আছে। সেটাই বা কী বস্তু! অমলকাকু আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, “আচ্ছা, হাতের ক’টা প্রতিশব্দ বল দেখি।”
আমি বললাম, “হস্ত, কর, পাণি, ভুজ....”
“ভেরি গুড। ঐ অতিরিক্ত হাত মানে খুব সম্ভবত অতিরিক্ত ভুজ অর্থাৎ অতিভুজ।”
সঞ্জু বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, “ছোটকা, তুমি একদম ঠিক ধরেছ। ওটা অতিভুজই। কিন্তু একটা অতিভুজ তো সরলরেখা। ওটা পাঁচ-পাযুক্ত হবে কীভাবে?”
আমি বললাম, “একজন মানুষ পাঁচ-পা হাঁটলে কতটা দূরত্ব যায় সেটা মাপলে হয় না?”
আমার প্রস্তাবটা অমলকাকুর পছন্দ হল না। উনি বললেন, “এই ডিসট্যান্সটা কখনই ফিক্সড নয়। ম্যান টু ম্যান ভ্যারি করবে। তাই শচীনবাবুর মতো একজন অঙ্কপ্রিয় মানুষ এমন একটা কাঁচা ক্লু দেবেন, সেটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়।”
“তাহলে?”
“আচ্ছা, এখানে পা মানে তো সত্যিকারের পা নাও হতে পারে,” সঞ্জু মন্তব্য করল।
“তার মানে, তুই কী বলতে চাইছিস?” আমি জানতে চাইলাম।
“যেমন ধর, ফুটবল নামকরণটা কেন হয়েছে? ঐ বলটা পা দিয়ে খেলা হয় বলেই তো? তাই এক্ষেত্রে হয়ত পা মানে ফুট। অর্থাৎ পাঁচ-পা মানে পাঁচ ফুট।”
অমলকাকু এই ব্যাখ্যা শুনে সঞ্জুকে প্রায় জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “সাবাস, আমার মনে হয় তুইও তোর বাবার মতোই অধ্যাপক হবি। তাহলে অতিভুজের দৈর্ঘ্য যে পাঁচ ফুট তা বেরিয়ে গেল। কিন্তু আগের লাইনটার অর্থ তো উদ্ধার হল না।”
সত্যি, ঐ তিন ফুটে মোদের ঠাঁই হবে কীভাবে তা ভেবে আমরা নাজেহাল হয়ে গেলাম। মোদের ঠাঁই বলতে তো আমাদের থাকার জায়গা বোঝায়। আর আমরা সকলেই যে যার বাড়িতে থাকি। নিজেদের বাড়িতে কোনও অঙ্কের সূত্র লুকিয়ে থাকতে পারে বলে মনে হয় না। এই সময় আবার সঞ্জুই আশার আলো দেখাল। বলল, “সব মানুষই যে কোনও বাড়িতে থাকে, এমনটা নয়। অনেকে তো মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরেও বাধ্য হয়ে দিন কাটায়। তাই মোদের ঠাঁই বলতে একটা কমন কিছু বোঝাবে, যা সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।”
গোমস বলল, “তার মানে কি এখানে মোদের ঠাঁই বোঝাতে গোটা পৃথিবীটাকেই মিন করছে?”
“গোটা পৃথিবী মানে তো জল-স্থল-আকাশ সবই। কিন্তু মানুষ তো আর সাধারণভাবে জলে বা আকাশে থাকে না, থাকে কেবল মাটিতে। কিন্তু মাটির সাথে তো অঙ্কের কোনও সম্পর্ক নেই।”
আমার এই কথা শুনেই অমলকাকুর চোখ চিকচিক করে উঠল। উনি বললেন, “মাটির সাথে অঙ্কের সম্পর্ক নেই বটে, ভূমির সাথে অবশ্যই আছে। আরে ঐ তিন ফুট হল সমকোণী ত্রিভুজের ভূমির দৈর্ঘ্য। অতিভুজ শব্দটা দেখে এটা আমাদের অনেক আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল। যাই হোক, বেটার লেট দ্যান নেভার।”
আমি এবার বেশ উৎফুল্ল হয়ে বললাম, “তাহলে দাঁড়াচ্ছে, ভূমি তিন ফুট আর অতিভুজ পাঁচ ফুট।”
এবার তাহলে ধাঁধার শেষ স্ট্যানজায় যাওয়া যাক।” অমলকাকু প্রস্তাবটা দিলেন।
কিন্তু সঞ্জু তাতে রাজি হল না। ও বলল, “ঘড়িটা দেখেছ? আটটা বেজে গেছে। এরপর আর হোটেলে খাবার পাবে ভেবেছ? তোমরা এক্ষুনি গিয়ে খাবারের অর্ডার দাও। আমি একবার টয়লেট থেকে ঘুরে যাচ্ছি।”
আমরা সকলেই বুঝতে পারছিলাম আর সামান্য কসরত করলেই ধাঁধাটা সলভ্ হয়ে যাবে। কিন্তু সঞ্জু হোটেলে যাবার জন্য এমন তাড়া লাগাতে শুরু করল যে আমাদের ওখান থেকে বেরিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না। আমরা তিনজন হোটেলে গিয়ে রুটি আর মাংস অর্ডার দিয়ে দিলাম। মিনিট পনের বাদে গরম গরম খাবারও চলে এল। কিন্তু সঞ্জুর পাত্তা নেই। আমরা ভেবেই পেলাম না, টয়লেটে এতক্ষণ ও কী করছে!
।। আট।।
প্রায় আধঘন্টা বাদে ও হোটেলে এল। বলল, পেটটা একটু খারাপ হয়েছে। ওষুধ অবশ্য ও সঙ্গে করে এনেছে। কিন্তু স্যাকের কোথায় রেখেছে তা ভুলে গিয়েছিল। ওটা খুঁজতেই এত দেরি হয়ে গেছে। সঞ্জু পেট খারাপের কথা বলল বটে, তবে রুটি-মাংস সবই চেটেপুটে উদরস্থ করল। একটু ঝোলও প্লেটে পড়ে রইল না। আমরা সকলেই ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি দেখে ও বলল, “ওষুধ তো খেয়েই নিয়েছি। তাই খাবারটা নষ্ট করার কোনও মানেই হয় না।”
আমরা ন’টা নাগাদ আবার বাংলোয় ফিরে এলাম। অমলকাকু বললেন, “এবার তাহলে পরের স্ট্যানজায় যাওয়া যাক - ওই দুটোর বর্গ, কষে দেয় দৈর্ঘ্য।”
“দৈর্ঘ্য মানে নিশ্চয়ই লম্বদৈর্ঘ্য,” আমি বেশ কনফিডেন্সের সঙ্গে বললাম। অমলকাকু তৎক্ষণাৎ আমার সঙ্গে সহমত হলেন। কিন্তু গোমস ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারল না। আমাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।
অমলকাকু এবার একটা ছোটো ইঁটের টুকরো নিয়ে বারান্দার মেঝেতে ছবি এঁকে ওকে বোঝাতে শুরু করলেন, “একটা ত্রিভুজের তিনটে বাহু আর তিনটে কোণ থাকে। ঐ তিনটে কোণের কোনও একটা কোণ যদি সমকোণ মানে নব্বই ডিগ্রি হয় তবে সেই ত্রিভুজটাকে সমকোণী ত্রিভুজ বলে। আর ওর বাহু তিনটেকে ভূমি, লম্ব আর অতিভুজ বলা হয়। ভূমি আর লম্ব একে অপরের সাথে নব্বই ডিগ্রি কোণ করে অবস্থান করে। অতিভুজ থাকে ঐ সমকোণের ঠিক বিপরীতে। পিথাগোরাস নামে একজন বিশ্ববিখ্যাত গণিতবিদ একটি সূত্র আবিষ্কার...”
সঞ্জু এসব দেখে আর চুপ থাকতে পারল না। বলল, “ছোটকা, এই রাত্রিবেলা হ্যাজাকের আলোয় তুমি ওকে পিথাগোরাস থিয়োরেম বোঝাবে নাকি?”
“না বুঝিয়ে আর উপায় কী বল? ও তো অঙ্কটা একদমই জানে না,” একথা বলে আবার গোমসকে বোঝাতে শুরু করলেন, “সমকোণী ত্রিভুজের ক্ষেত্রে পিথাগোরাসের সূত্রটি হল...”
“লম্ব স্কয়ার প্লাস ভূমি স্কয়ার ইজ ইকুয়াল টু অতিভূজ স্কয়ার,” গোমস মন্তব্য করল।
অমলকাকু সঙ্গে সঙ্গে ওর পিঠ চাপড়ে দিলেন। বললেন, “সাবাস! তুমি বিদেশে ম্যানেজমেন্ট পড়তে গিয়ে তোমার প্রতিভার প্রতি অবিচার করেছ। ওর বদলে তোমার ম্যাথমেটিক্স নিয়ে পড়া উচিত ছিল।”
আমার আর ওসব ছেলে ভোলানো কথা শুনতে ভাল লাগছিল না। আমি তাই কাকুকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “অতিভুজ পাঁচ ফুট আর ভূমি তিন ফুট তো জানাই আছে। এবার তো তাহলে লম্বদৈর্ঘটা বের করে ফেললেই হয়।”
“হ্যাঁ, তা তো বটেই,” একথা বলেই উনি আবার গোমসকে বোঝাতে শুরু করলেন, “এক্ষেত্রে লম্ব-দূরত্ব বের করার জন্য পিথাগোরাসের ঐ সূত্রটিকে আমরা একটু বদলে নেব - লম্ব স্কয়ার ইজ ইকুয়াল টু অতিভূজ স্কয়ার মাইনাস ভূমি স্কয়ার।”
একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে অত ভ্যানতারা আমার ভাল লাগছিল না। আমি বললাম, “অতিভুজ পাঁচ ফুট। পাঁচের বর্গ পঁচিশ। আর ভূমি তিন ফুট। তিনের বর্গ নয়।
পঁচিশ থেকে নয় বিয়োগ করলে দাঁড়াচ্ছে ষোলো। ওটাই লম্ব স্কয়ার। ষোলোর বর্গমূল চার। অতএব লম্বদৈর্ঘ দাঁড়াল চার ফুট।”
অমলকাকু বললেন, “ভেরি গুড। ধাঁধায় এবার আছে, সেখানেই আছে/ ফলখানা গাছে। এবার তাহলে লোহার নলটার গোড়া থেকে চার ফুট মেপে দেখা যাক, কোনও ফল পাওয়া যায় কি না।”
আগেই বলেছিলাম, ফোয়ারার ঐ মোটা নলটার গায়ে লতা-পাতার নকশা খোদাই করা ছিল। ফিতে দিয়ে মেপে দেখা গেল চার ফুট উচ্চতায় লতা-পাতার মধ্যে সত্যিই একটা আম ঝুলছে। আমরা তখন সবাই ভীষণ উত্তেজিত। ধাঁধার শেষ লাইনে আছে - ধরে তার বোঁটাটি, চাপ দিলেই আংটি। আমরা সকলেই দেখলাম, আমটার মাথা থেকে একটা ছোট্ট লোহার তার বোঁটার মত বের হয়ে আছে। তার মানে ওটাতে চাপ দিলেই শচীনবাবুর সেই মহামূল্যবান আংটিটা পাওয়া যাবে। টেনশনের চোটে আমি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। আমের বোঁটাটা চাপতে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু অমলকাকু আমাকে বাধা দিলেন। বললেন, ওটা গোমসের সম্পত্তি। তাই লোহার তারটাতে ও-ই চাপ দেবে।
গোমস তখন ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল ঐ নলটার দিকে। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে চাপ দিল ঐ আমের বোঁটায়। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিক! আমটার উল্টোদিকের একটা অংশ ঠিক ড্রয়ারের মতো বেরিয়ে এল। আর তার মধ্যে ঝকমক করতে লাগল লাল পাথর বসানো একটা আংটি। গোমস ওটা হাতে তুলে নিয়ে একদম মোহিত হয়ে গেল। তারপর কাকুর হাতে দিয়ে বলল, “এই পাথরটা কি খুব দামী? এটার নাম কী?”
“পাথরটার নাম আমি বলতে পারব না। তবে এতকাল এই লোহার নলটার ভিতর পড়ে থেকেও ওটা যেভাবে চকচক করছে তাতে সহজেই অনুমান করা যায় জিনিসটা খুবই হাই কোয়ালিটির। আর শচীনবাবু নিশ্চয়ই কোনও সাধারণ পাথর এখানে রেখে তা খুঁজে বের করার জন্য এত কঠিন একটা ধাঁধা তৈরি করবেন না! তবে এই পাথরটার নাম আর বর্তমান মূল্য তুমি কোনও জুয়েলারি শপে গেলেই জানতে পারবে। তবে কোনও বিশ্বস্ত চেনা লোকের কাছেই যেয়ো, না হলে ঠকে যেতে পার।”
“আমার ধারণা, পাথরটার দাম কয়েক লক্ষ টাকা। এটা বেচলে যা টাকা পাবে তা দিয়ে দেখবে অনায়াসে তুমি মায়ের চিকিৎসা করাতে পারবে,” সঞ্জু মন্তব্যটা করল।
একথা শুনে গোমস দারুণ খুশি। ও আমাদের সকলকে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বলল যে পরেরদিন ভোরের ট্রেনেই ও অভনপুর চলে যাবে। তারপর সেখান থেকে যেভাবেই হোক রায়পুর হয়ে কলকাতায় পৌঁছবে। আমরা ওকে একটা দিন মানিকচৌরি থেকে পরেরদিন আমাদের সাথেই ফিরে যেতে প্রস্তাব দিলাম। কারণ, আমরা অভনপুর যাব পরশু সকালে। রায়পুর থেকে পরশু বিকালের একটা ট্রেনে আমাদের রিজারভেশন আছে। কাল দুপুরে রায়পুর পৌঁছে তো আর গোমস কোনও ট্রেনের রিজার্ভড টিকিট পাবে না। ওকে জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠতে হবে। তার চেয়ে আমাদের সঙ্গে গেলে ওর সুবিধাই হবে। টিটিকে বলে যদি একটা স্লিপার বার্থ জোগাড় যায় তো ভাল, না হলেও অসুবিধা নেই। আমাদের কারোর সাথে কোনওভাবে ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে।
কিন্তু আমাদের প্রস্তাবে গোমস কিছুতেই রাজি হল না। পরদিন ভোরেই বেরিয়ে গেল। বোধহয় অসুস্থ মায়ের কাছে পৌঁছনোর জন্য ওর মনটা খুবই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। ঐ ধাঁধার চক্করে পড়ে গতকাল আমাদের মানিকচৌরি বেড়ানোটা ঠিকঠাক হয়নি। তাই সেদিন ভোরবেলা গোমসকে বিদায় জানিয়ে আমরা গোটা এলাকাটা সারাদিন খুব ঘুরলাম। গোমস যাওয়ার সময়ও আমাদের তিনজনকে আরও একবার ওকে আংটিটা খুঁজে বের করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাল। সঙ্গে দিয়ে গেল ওর ফোন নম্বর আর বাড়ির ঠিকানাটাও। বারবার অনুরোধ করল, কলকাতায় ফিরে আমরা যেন অবশ্যই ওর বাড়ি যাই, ওর অসুস্থ মাকে একবার দেখে আসি। আমরা ওর বাড়ি অবশ্যই যাব বলে কথা দিলাম।
_____
ছবিঃ পুষ্পেন মন্ডল
No comments:
Post a Comment