উপন্যাস:: মানিকচৌরির ভূত-বাংলোঃ ৩য় অংশ - কৃষ্ণেন্দু দেব

মানিকচৌরির ভূত-বাংলোঃ কৃষ্ণেন্দু দেব
৩য় অংশ

।। নয়।।

আমাদের ফেরার ট্রেন হাওড়া পৌঁছানোর কথা ছিল সকাল সাতটা নাগাদ কিন্তু ট্রেনটা প্রায় দু’ঘন্টা লেট করল স্টেশন থেকে বেরিয়ে আমরা একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম রাতে ট্রেনে কারোরই ভাল ঘুম হয়নি তাই ভাবছিলাম কতক্ষণে বাড়ি পৌঁছে স্নান-খাওয়া সেরে লম্বা একটা ঘুম দেব কিন্তু সঞ্জু আমার ইচ্ছায় বাধ সাধল ড্রাইভারকে বলল, “শ্যামবাজার
অমলকাকু বললেন, “শ্যামবাজার মানে! আমরা এখন বাড়ি যাব না?”
সঞ্জু সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, “না
তোকে এখনই গোমসের বাড়ি যেতে হবে? বাড়ি ফিরে খানিকক্ষণ রেস্ট নিয়ে বিকালবেলা গেলে চলত না?” আমি বেশ বিরক্তির সঙ্গেই কথাগুলো বললাম
সঞ্জু এবার মৃদু হেসে বলল, “অরুন্ধতী গোমস তাঁর দাদার মহামূল্যবান আংটিটা আদৌ পেলেন কি না সেটা জানার খুব ইচ্ছা হচ্ছে
ওঁর ছেলে মানে অনিরুদ্ধর তো গতকালই ফিরে আসার কথা তুই কি ভাবছিস অনিরুদ্ধ এখনও শ্যামবাজারে ফিরতে পারেনি? আমি ওকে এক্ষুনি ফোন করছি,এই বলে কাকু ওকে ফোনে ট্রাই করলেন একবার নয়, বেশ কয়েকবার তারপর বললেন, “কী ব্যাপার বল তো? বার বার বলছে দিস টেলিফোন নাম্বার ডাজ নট একজিস্ট
আমি এরকম একটা কিছুই আশা করছিলাম যাই হোক, লোকটা আংটি নিয়ে ফিরেছে কি ফেরেনি সেটা ওর বাড়ি গেলেই বোঝা যাবে
কী হেঁয়ালি করছিস সঞ্জু? একটু ঝেড়ে কাশ না,অমলকাকু একটু রাগের সুরেই কথাটা বললেন
আমি এখন কিছুই খোলসা করে বলতে পারব না আমি একটা কিছু অনুমান করেছি মাত্র সেটা সঠিক নাও হতে পারে আগে আমরা শ্যামবাজার পৌঁছোই গোমসের বাড়ি যাই তারপর তোমাদের সব বলব
পরের আধঘন্টা সঞ্জুর মুখ থেকে আর একটা কথাও বের করতে পারলাম না দশটা নাগাদ আমরা শ্যামবাজার পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্য পাঁচ-এ, সুবল ঘোষ লেন কিন্তু ঠিকানায় কোনও গোমস পরিবারের খোঁজ পাওয়া গেল না একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দরজা খুলেছিলেন তিনি আমাদের জানালেন, শুধু পাঁচ-এ কেন, ঐ গোটা সুবল ঘোষ লেনেই কোনওদিন কোনও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি ছিল বলে তিনি জানেন না আমরা তখন বেশ বুঝতে পারলাম গোমস আমাদের ইচ্ছা করেই ভুল ঠিকানা দিয়েছে কিন্তু কেন?
উত্তরটা সঞ্জুই দিল বলল, “লোকটা আসলে ফ্রড, বুঝলি! কখনোই অনিরুদ্ধ গোমস নয় তবে গোমসদের ভাল করেই চেনে আর যেভাবেই হোক গোমসদের কাছ থেকেই ধাঁধাটা জোগাড় করেছে তবে বাস্তবে ঠিক কী ঘটেছে তা গোমস ফ্যামিলির কোনও একজনের সাথে দেখা না হলে জানা যাবে না
আমি তখন বললাম, “তোর কথামতো লোকটা যদি সত্যিই ফ্রড হয় তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে গেছে আমাদের বোকা বানিয়ে অত দামী একটা আংটি বাগিয়ে নিয়েছে
সঞ্জু আমার কথার কোনও জবাব না দিয়ে অমলকাকুকে বলল, “ছোটকা, বো ব্যারাকে তোমার এক বন্ধু থাকতেন না? জয় ডিকোস্টা না কী যেন একটা নাম?”
হ্যাঁ, জয় ডিকোস্টাই তো তাকে দিয়ে কী হবে?”
ওঁর ফোন নাম্বার তোমার কাছে আছে? থাকলে ভদ্রলোককে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখ তো উনি অরুন্ধতী বা অনিরুদ্ধ গোমস বলে কাউকে চেনেন কি না আসলে কলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কমিউনিটিতে একজন আরেকজনের ভালোই খবরাখবর রাখেন বলে শুনেছি আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ফ্রড লোকটা নিজের সম্পর্কে মিথ্যা বললেও গোমসদের সম্পর্কে যা যা বলেছে সেগুলো সবই সত্যি
অমলকাকু সঙ্গে সঙ্গে জয় ডিকোস্টাকে ফোন করলেন উনি এল.আই.সি.তে বেশ উঁচু পদে চাকরি করেন কলকাতাতেই পোস্টেড ফোনে ভদ্রলোকের সাথে একটুখানি কথা বলেই অমলকাকু ফোন ছেড়ে দিলেন বললেন, “জয় এখন হাতিবাগানের অফিসে আছে আমাদের ওখানেই যেতে বলল
অতঃপর আমরা আর একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে আবার একটা ট্যাক্সি ধরে হাতিবাগানের দিকে রওনা হলাম বলা বাহুল্য, এল.আই.সি. অফিস খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধা হল না জয় ডিকোস্টা আমাদের বেশ আদর করে তাঁর চেম্বারে বসালেন তারপর আমাদের কাছ থেকে সব শুনে যা বললেন তার সারমর্ম হল -

বছর পনের আগে একটা নিউ ইয়ার পার্টিতে ওঁর সাথে অ্যান্টনি গোমসের আলাপ হয়েছিল গোমসের বৌ বাঙালি একটা বাচ্চা ছেলেও ছিল অ্যান্টনি গোমস তখন সপরিবারে বাগবাজারে থাকতেন এরপর আরও দু’একবার অ্যান্টনি গোমসের সাথে ডিকোস্টা আঙ্কলের দেখা হয়েছে আলাপের বছর দুয়েক বাদে হঠাৎই একদিন অ্যান্টনি গোমসের মৃত্যু সংবাদ আঙ্কলের কানে আসে তখন তিনি বাগবাজারে গোমসদের বাড়িতে গিয়েছিলেন মিসেস অরুন্ধতী গোমসকে সমবেদনা জানাতে তারপর মাঝে মধ্যে কয়েকবার ভদ্রমহিলার সাথে ওঁর দেখা হয়েছে অনিরুদ্ধ যে ইংল্যান্ডে যাচ্ছে পড়াশোনা করতে, সে খবরও ডিকোস্টা আঙ্কল অরুন্ধতী গোমসের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন কিন্তু তারপর আর ভদ্রমহিলার সাথে দেখা হয়নি অনিরুদ্ধ যে ইংল্যান্ডে মারা গেছে বা অরুন্ধতী গোমস যে ক্যানসারে আক্রান্ত, সেরকম কোনও খবর আঙ্কলের কাছে নেই
ডিকোস্টা আঙ্কলের কাছে সবটা শুনে সঞ্জু বলল, “আঙ্কল, আমাদের এক্ষুনি একবার বাগবাজারে গোমসদের বাড়িতে যেতে হবে খুব দরকার আপনি কি আমাদের সাথে একটু...”
আসলে একজন এজেন্ট একটু বাদেই আমার কাছে একটা জরুরি দরকারে আসবে ঠিক আছে, আমি ফোন করে ওকে বলে দিচ্ছি ঘন্টাখানেক বাদে আসতে কিন্তু অরুন্ধতী গোমসের সাথে তোমাদের এক্ষুনি কী দরকার সেটাই তো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না
আমরাও পারছি নাঅমলকাকু ঠোঁট বেঁকিয়ে মন্তব্যটা করলেন
সঙ্গে সঙ্গে সঞ্জু ঝাঁঝিয়ে উঠল, “তোমায় বললাম না ছোটকা, একটা ব্যাপার আমি অনুমান করেছি মাত্র এখন সেটা কিছুটা পরিষ্কারও হয়েছে তবে অরুন্ধতী গোমসের সাথে দেখা না হলে স্পষ্ট করে কিছুই বলা যাবে না তাই ভদ্রমহিলার সাথে তাড়াতাড়ি দেখা হওয়াটা খুব জরুরি
অতঃপর ডিকোস্টা আঙ্কল বা অমলকাকু কেউই আর বাক্যব্যয় করলেন না আমরা চারজন বাগবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম অবশ্য এবার ট্যাক্সিতে নয়, ডিকোস্টা আঙ্কলের নিজের গাড়িতে

।। দশ।।

বাগবাজারে আমরা চারজন যে বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম সেটা বেশ পুরনো আমলের ডিকোস্টা আঙ্কল দরজা নক্করলেন সামান্য বাদেই একটা কমবয়সী ছেলে দরজা খুলে দিল তারপর আঙ্কল নিজের পরিচয় দিতেই সে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেল একটা খাটের ওপর বসে ছিলেন অরূন্ধতী গোমস, পরনে একটা গাউন সামনের টেবিলে একগাদা ওষুধপত্র আর পাশে একটা হুইল চেয়ারে একজন বছর পঁচিশের তরুণ যে অনিরুদ্ধ তা আমাদের কারোরই বুঝতে বাকি রইল না ডিকোস্টা আঙ্কল এভাবে আমাদের নিয়ে হঠাৎ ওখানে উপস্থিত হওয়াতে মা-ছেলে দুজনেই যে বেশ অবাক হয়েছেন, তা বিলক্ষণ বোঝা গেল প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর আঙ্কল আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন দুই গোমসের সাথে
এরপর ওঁদের দুজনের সাথেই বেশ কিছুক্ষণ আমাদের কথা হল বুঝতে পারলাম শচীনবাবুর ধাঁধার ইতিহাস, অনিরুদ্ধর লন্ডনে পড়তে গিয়ে মায়ের ফোন থেকে সেকথা জানতে পারা এবং দেশে ফেরার আগে তার কার অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনা - সবই সত্যি ঘটনা কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টে অনিরুদ্ধর হাত কাটা যায়নি সে মারাত্মক চোট পেয়েছে কোমরে যার দরুণ হুইল চেয়ার এখন তার নিত্যসঙ্গী তাহলে মানিকচৌরিতে নকল অনিরুদ্ধ সেজে কে হাজির হয়েছিল? ধাঁধাটাই বা সে পেয়েছিল কীভাবে? আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর অনিরুদ্ধই দিল সে যা বলল, তা সংক্ষেপে এইরকম -
যে ছেলেটিকে মানিকচৌরিতে আমরা দেখেছি, তার নাম রাজীব বসাক ওরফে রাজু অনিরুদ্ধের স্কুলের বন্ধু আগে থাকত হাতিবাগানে এখন বোধহয় মানিকতলার কোথাও একটা থাকে ওরা দুজনে সেই ক্লাস ফাইভ থেকে সেন্ট পলস্স্কুলে পড়ত রাজু প্রায়ই আসত গোমসের বাড়িতে মাধ্যমিক অব্দি ওরা একসঙ্গেই পড়াশোনা করেছে কিন্তু তারপরেই ওদের স্ট্রিম আলাদা হয়ে যায় রাজুর কোনওদিনই পড়াশোনায় বিশেষ মন ছিল না বাড়িতেও নানারকম সমস্যা ছিল এর ওপর শিয়ালদার একটা কলেজে ঢুকে রাজু কিছু বদবন্ধুর পাল্লায় পড়ে একেবারে বখে যায়  নেশাভাঙ শুরু করে তবে অনিরুদ্ধর কাছে মাঝেমধ্যেই আসত এইসময় অনিরুদ্ধ ওকে শোধরানোর অনেক চেষ্টা করেও সফল হয়নি
যাই হোক, কিছুকাল বাদেই অনিরুদ্ধ ইংল্যান্ডে চলে যায় এদিকে রাজু এক নেতার ছত্রছায়ায় গুন্ডাবাজি শুরু করে একদিন বিপক্ষদলের ছোঁড়া বোমায় ওর বাঁ হাতটা কনুইয়ের নিচ থেকে উড়ে যায় এরপর রাজু মস্তানি ছেড়ে দেয় ওর বাড়ির লোকেরা ইতিমধ্যে হাতিবাগান ছেড়ে মালদার দেশের বাড়িতে চলে গিয়েছিল রাজু বাড়ির লোকের সাথে যায়নি মানিকতলায় উঠে গিয়ে সেখানে একটা ছোটোখাটো দোকান চালাতে শুরু করে তবে এই সময়েও ইন্টারনেটের মাধ্যমে রাজুর সাথে অনিরুদ্ধর যোগাযোগ ভালই ছিল ব্যাপারটা অরুন্ধতী গোমসের একদম পছন্দ ছিল না তিনি ফোনে ছেলেকে রাজুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে মানাই করতেন কিন্তু অনিরুদ্ধের বক্তব্য ছিল তার বন্ধু এখন ভাল হয়ে গেছে সে- নিজে তৎপর হয়ে ইংল্যান্ড থেকে রাজুর জন্য আর্টিফিশিয়াল লিম্বের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল শুধু তাই নয়, মায়ের কাছে ফোনে শচীনবাবুর ধাঁধার বিষয়টা জানতে পেরে অনিরুদ্ধ তা রাজুকে বলেও দিয়েছিল ইচ্ছা ছিল দেশে ফিরে বন্ধুকে নিয়েই মানিকচৌরি যাবে কিন্তু গাড়ি দুর্ঘটনার জন্য সে ইচ্ছা আর অনিরুদ্ধর পূরণ হয়নি
অনিরুদ্ধ বাড়ি ফিরে আসার পরদিনই রাজু বাগবাজারের এই বাড়িতে এসে হাজির হয় একাই মানিকচৌরি গিয়ে আংটিটা নিয়ে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করে অনিরুদ্ধ রাজি হলেও মিসেস গোমস প্রস্তাবটা মেনে নেননি আসলে উনি রাজুকে একদম পছন্দ করতেন না তখন ঠিক হয়, অনিরুদ্ধ যেদিন ঠিকঠাক হাঁটাচলা করতে পারবে সেদিন সে নিজেই মানিকচৌরি যাবে কথাটা শুনে রাজু বিশেষ উচ্চবাচ্য করেনি শুধু অরুন্ধতী গোমসের আড়ালে একবার তার বন্ধুর কাছে ধাঁধাটা শুনতে চেয়েছিল আর অনিরুদ্ধও বোকার মত রাজুকে তা শুনিয়ে দিয়েছিল এটা মাসখানেক আগেকার কথা সেদিন থেকে রাজুর আর কোনও পাত্তা নেই
অনিরুদ্ধের মুখে সবটা শুনে আমি বললাম, “অতো বড়ো ছড়াটা রাজু একবার শুনেই হুবহু মনে রাখল কীভাবে সেটাই ভেবে পাচ্ছি না! এমন অসাধারণ স্মৃতিশক্তি খুব একটা...”
শোন দীপু, আজকাল প্রায় সমস্ত সেলফোনেই সাউন্ড রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা থাকে অনিরুদ্ধদা যখন ধাঁধাটা পড়েছে, তখন রাজু সেটা হয়তো গোপনে রেকর্ড করে নিয়েছে তারপর ধাঁধাটা কাগজে লিখে পৌঁছে গেছে মানিকচৌরি তাই নিয়ে অতো অবাক হওয়ার কিছু নেই
সঞ্জুর এই বক্তব্যের পর আর কোনও কথা চলে না আমি তাই চুপ করে গেলাম ওদিকে রাজু সেই মহামূল্যবান আংটিটা নিয়ে গায়েব হয়ে গেছে শুনে গোমস আর তার মা ভীষণ ভেঙে পড়লেন ওই অসুস্থ শরীরেও মিসেস গোমস ছেলের বোকামির জন্য তাকে ভর্ৎসনা করতে লাগলেন অনিরুদ্ধ প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল শুধু বলল, “রাজু এরকম বেইমানি করল! এখন আমার আর মায়ের ট্রিটমেন্টের জন্য এই বাড়িটা বোধহয় আমাদের বেচে দিতে হবে
ডিকোস্টা আঙ্কল ওদের দুজনকেই সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন উনি মিসেস গোমসকে বললেন, “কলকাতা পুলিশের এক ডি.আই.জি. আমার বন্ধু ওর সাহায্য নিয়ে আমি রাজুকে ঠিক খুঁজে বের করব আর তারপর আংটিটা আমি আপনার হাতে তুলে দেব
সেটা আপনি পারবেন না ডিকোস্টা আঙ্কল কারণ, আংটিটা রাজুর কাছে নেই,সঞ্জু বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে কথাগুলো বলল
আমরা তখন প্রায় সমস্বরে বলে উঠলাম, “নেই মানে! তাহলে আংটিটা কোথায়?”
আমার কাছে,সঞ্জু খুব শান্তস্বরে জবাবটা দিল
সত্যি বলছি, আমরা তখন কেউই মুখে ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না সঞ্জু সম্ভবত আমাদের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারল তাই নিজেই বলতে শুরু করল, “ রাজুকে দেখে আমার প্রথম থেকেই সন্দেহ হয়েছিল প্রথম সন্দেহটা হয় ওর ছবি তোলার অনীহা দেখে আমার শুধু মনে হচ্ছিল চাইছে না যে ওর কোনও ছবি আমাদের কাছে থাকুক সঙ্গে এটাও মনে হল লোকটা আসল গোমস মানে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান নয়, আমাদের মতই একজন সাধারণ ভেতো বাঙালি তোমরা হয়তো কেউই লক্ষ করোনি, ওর গলায় একটা রূপোর হার ছিল হারটায় যে ছোট্ট লকেটটা ঝুলছিল তাতে ছিল মাকালীর ছবি তাছাড়া যখন চপের ঠোঙায় গণেশঠাকুরের ছবি দেখে মহাকবির ব্যাপারটা সলভ্হয়, তখন আনন্দে বলে উঠেছিল ‘জয়, বাবা গণেশের জয়’ একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ক্রিশ্চানের মুখে এমন উক্তি ঠিক খাপ খায় না তাছাড়া যে ছেলে ম্যানেজমেন্ট পড়তে লন্ডনে গেছে সে প্রায় মাসখানেক চেষ্টা করেও ধাঁধাটার একটা অংশও সলভ্করতে পারেনি এটাও ঠিক মেনে নিতে পারছিলাম না তাই আমি মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছিলাম যে আংটিটা ওর হাতে পড়তে দেব না আগে নিজে গোমসের বাড়ি যাব নিজের চোখে সব দেখে তবেই জিনিসটা হস্তান্তরিত করব
কিন্তু আংটিটা তো গোমস আমাদের সামনেই নিজের হাতে নিল তাহলে ওটা তুই আবার পেলি কোথা থেকে? জিনিসটা তুই ওর কাছ থেকে চুরি করেছিস নাকি? তোকে বাপু কিচ্ছু বিশ্বাস নেই!” অমলকাকু বেশ উদ্বেগের সাথেই কথাগুলো বললেন
সঞ্জু সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, “তুমি কী যে বল ছোটকা! একটা চোরের কাছ থেকে আংটি চুরি করা কি মুখের কথা? আসলে তোমরা ফোয়ারার নলটার ভিতরে যে আংটিটা দেখেছিলে, সেটার দাম মাত্র দশ টাকা ওটা আমি অভনপুর স্টেশনের পাশে যে ছোট্ট মেলাটা হচ্ছিল সেখান থেকে কিনেছিলাম
তার মানে? তোর আংটিটা ওখানে গেল কীভাবে?” আমি অবাক হয়ে প্রশ্নটা করলাম
একটু ভেবে দ্যাখ, শচীনবাবুর ধাঁধার প্রথম দুটো স্ট্যানজা বেশ ঝামেলার হলেও শেষ স্ট্যানজাটা কিন্তু তুলনামূলকভাবে অনেক সোজা ছিল পিথাগোরাসের সূত্র প্রয়োগ করে লম্ব-দূরত্ব বের করাটা আমাদের কাছে তো কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার এরপর শুধু কাজ বাকি ছিল ফলখানা খুঁজে তার বোঁটায় চাপ দেওয়া সেটা রাজুর আড়ালে করব বলেই তোদের জোর করে সেদিন খেতে পাঠিয়েছিলাম
তার মানে আমরা হোটেলে চলে আসার পর তুই ফোয়ারার নল থেকে আসল আংটিটা বের করে নিয়েছিলি?”
হ্যাঁ, আর সেখানে রেখে দিয়েছিলাম আমার দশ টাকা দামী আংটিটা তবে ওটা প্রথমে স্যাকের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছিলাম না তাই হোটেলে পৌঁছতে আমার সেদিন কিছুটা দেরি হয়ে গিয়েছিল পাছে আমার দেরি দেখে রাজু সন্দেহ করে তাই পেট খারাপের গল্প ফেঁদেছিলাম
অমলকাকু পুরোটা শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন বললেন, “সত্যি সঞ্জু, তোর জবাব নেই! তা পুরো ব্যাপারটা দু’দিন ধরে আমাদের কাছে বেমালুম চেপে গেলি কেন? রাজু বাংলো ছেড়ে চলে যাবার পর আমাদের সব বলে দিতেই পারতিস
আসলে ছোটকা, আমি তোমাদের একটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম
সারপ্রাইজ তো ভালোই হল, এখন আসল আংটিটা দেখা চোখ সার্থক করি
সঞ্জু তখন ওর স্যাকের ভিতর থেকে আংটিটা বের করল আংটিটা সোনার আর তাতে বেশ বড়ো সাইজের সবুজ রঙের একটা পাথর বসানো আমরা এক এক করে সকলে ওটা হাতে নিয়ে দেখলাম ডিকোস্টা আঙ্কল বোধহয় পাথর-টাথর চেনেন উনি বললেন, “আমার মনে হচ্ছে এটা মরকত, জুয়েলারিতে নিয়ে গেলে কনর্ফাম হওয়া যাবে তবে আমার অনুমান যদি সত্যি হয় তাহলে এই পাথরটার বর্তমান বাজারদর মিনিমাম ফাইভ ল্যাক তো হবেই এছাড়া সোনাটাও তো বেশ ভালই আছে অনিরুদ্ধ, এটা বেচে তোমাদের দুর্দশা কিছুটা মিটবে আশা করা যায় ভাগ্যিস এই ছেলেটা বুদ্ধি করে আংটিটা সরিয়ে রেখেছিল না হলে এতক্ষণে জিনিসটা তোমার বেইমান বন্ধুর নেশা আর ফুর্তির খরচ জোগাত
একথা শুনে অনিরুদ্ধ আর তার মা দুজনেই সঞ্জু আর আমাদের তাঁদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালেন তারপর আমরা বারবার না করা সত্ত্বেও যে ছেলেটি ওঁদের দেখাশোনা করে তাকে দিয়ে আনালেন একগাদা মিষ্টি সেগুলোর সদ্ব্যবহার করার পর আমাদের রেহাই মিলল ডিকোস্টা আঙ্কলের ইচ্ছা ছিল পুলিশে খবর দিয়ে রাজুকে প্রতারণার দায়ে অ্যারেস্ট করাবেন কিন্তু অনিরুদ্ধ এবং তার মা দু’জনেরই বক্তব্য, ছেলেটা প্রায় একমাস মানিকচৌরি পড়ে থেকেও একদম খালি হাতে ঘরে ফিরেছে সেটাই ওর বড়ো শাস্তি তাই আর থানা-পুলিশে কাজ নেই
গোমসদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডিকোস্টা আঙ্কল তড়িঘড়ি নিজের অফিসে ফিরে গেলেন আর আমরা তিনজন আবার একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম এবার গন্তব্য ভবানীপুর মানে আমাদের বাড়ি ট্যাক্সিতে বসে আমি বললাম, “আচ্ছা অমলকাকু, রাজুর মতো একটা জালিয়াত দশ টাকার আংটিটা যে নকল সেটা ধরতে পারল না কেন বলুন তো?”
অমলকাকু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু সঞ্জু গম্ভীরস্বরে বলে উঠল, “ওটা অভনপুরের যাদু, বুঝলি! যেভাবে একজন সাদামাটা দেহাতি মানুষ ছোটকার কাছে ডাকাত হয়ে গিয়েছিল, সেভাবেই একটা সাধারণ পাথরও অভনপুরের হাওয়া লেগে রাজুর কাছে মরকত হয়ে গেছে
কথাটা শুনে অমলকাকু প্রথমটা খানিক গুম হয়ে রইলেন তারপর ট্যাক্সির জানলার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, “ছেলেটা আজকাল বড়ো ডেঁপো হয়ে গেছে
আমার তখন হাসি আর ঘুম দু’টোই একসঙ্গে পাচ্ছে তাই রুমালটা দিয়ে গোটা মুখটা ঢেকে মাথাটা এলিয়ে দিলাম সঞ্জুর কাঁধে
_____
সমাপ্ত
ছবিঃ পুষ্পেন মন্ডল

2 comments: