সিনেমা সমালোচনা - রাজকুমারী মনোনোকের কাহিনি
সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
জাপানের ইতিহাসে ১৩৩৬
থেকে ১৫৭৩ খ্রীষ্টাব্দ মুরোমাচি সোগুনের রাজত্বকাল হিসেবে ধরা হয়। মধ্যযুগের এই অধ্যায়টা
জাপানের প্রাচীন সাহিত্য আর শিল্পকলায় এক অনন্য স্থান নিয়ে আছে। নানা অদ্ভুত
লৌকিক-অলৌকিক বিশ্বাস আর দেশীয় আচারের পরিচয় পাওয়া যায় এই সময়কার কৃষ্টিতে। এই
সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে একটা অসামান্য অ্যানিমে (অ্যানিমেশন) ছায়াছবি ‘প্রিন্সেস
মনোনোকে’ [জাপানী ভাষায় ‘মনোনোকে হিমে’] যার পরিচালক
অ্যানিমের জাদুকর হায়াও মিয়াজাকি আর নির্মাতা ঘিবলি (জাপানী ভাষাতে
ঝিবড়ি) স্টুডিও।
গল্পের শুরুতে বিরাট এক
বন্য শুকরের বেশে একটা দৈত্য আক্রমণ করে এক এমিসি গ্রামে। এই এমিসিরা ছিল একরকম
আদিম জনগোষ্ঠী যারা হোনসু দ্বীপের উত্তর পূর্বে তোহোকু অঞ্চলে বাস করত। এরা ছিল মূলতঃ অরণ্যের
অধিবাসী, স্বাধীন। বহুবার জাপানের মূল সাম্রাজ্যের বিরাট সৈন্যবাহিনী এদের সঙ্গে
যুদ্ধ করেও পেরে ওঠেনি। প্রায় গেরিলা পদ্ধতিতে ছোট ছোট দলে ভেঙে অতর্কিতে আক্রমণ
করত এমিসিরা। যাই হোক, গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ার আগেই এমিসিদের শেষ রাজপুত্র
আসিতাকা ওই দৈত্যকে মেরে ফেলেন। কিন্তু পরে জানা যায় যে ওই দৈত্য আসলে ছিল শুকরদের
এক দেবতা যার নাম নাগো। জাপানের প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী সমস্ত বন্যপ্রাণীদেরই
একজন করে দেবতা ছিলেন। গ্রামের থেকে এই গুজব শোনা যায় যে এই দেবতা তার শরীরে একটা
লোহার বল ধারণ করে অভিশপ্ত দানবে পরিণত হয়েছিলেন। ওই দানবকে যে হাত দিয়ে হত্যা
করেছিলেন রাজপুত্র আসিতাকা তার সেই ডানহাত শাপভ্রষ্ট হয়ে যায়। এই অভিশাপের ফলে
অদ্ভুৎভাবে তার ওই হাতে কিছুদিনের জন্য এক অতিমানবিক শক্তি এসে যায় কিন্তু ধীরে
ধীরে অনিবার্য মৃত্যুর দিকে তিনি এগোতে থাকেন। তখন গ্রামের এক বয়স্কা জ্ঞানী মহিলা
রাজকুমারকে পরামর্শ দেন পশ্চিমদিক বরাবর এগিয়ে যেতে যে অঞ্চল থেকে নাগো দৈত্য
এসেছিল। হয়তো এই অভিশাপের প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে সেখান থেকে।
রাজকুমার আসিতাকা
ওই পথেই আসিতাকার দেখা
হয়ে যায় সন্ন্যাসী জিকো-বো’র সাথে যিনি তখন সারা জাপান পরিভ্রমণ করছিলেন। এই অত্যন্ত
ক্ষমতাশালী সন্ন্যাসী কুমার আসিতাকাকে পরামর্শ দেন কাছের জঙ্গলেই ঘুরে বেড়ানো বনের
প্রাচীন আত্মার সাথে দেখা করার জন্য যিনি দিনেরবেলা ‘কিরিন’ (চীন ও জাপানের
প্রাচীন পুরান আর উপকথায় বর্ণিত জীব) আর রাতের বেলা এক ভয়ংকর দানবের রূপে থাকেন।
একমাত্র এই প্রানীই পারে এই অভিশাপকে ঠেকাতে। রূপকথার ওই প্রানীর সন্ধান করতে গিয়ে
কুমার আসিতাকা পৌঁছে যান এক লোহার তৈরি শহরের মধ্যে। এই শহর নাকি তৈরি করার
জন্য এক প্রাচীন অরণ্যের অনেকটা অংশ কেটে ফেলা হয়েছিল। এর ফলে ওই অরণ্যের দেবতাদের সাথে ভয়ংকর
সংঘাতে জড়িয়ে পরে এই শহরের মানুষ বিশেষ করে তাদের রাণী এবোসি। তার পর থেকেই এই
শহরে অনেকে এসে জোটে এমনকী তাদের মধ্যে রয়েছে সমাজ পরিত্যক্ত গুন্ডা বদমাইশের দল।
এদের দিয়েই রাণী এবোসি নানা রকম আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করাতে থাকেন যেগুলো ওই দেবতাদের
সঙ্গে যুদ্ধে কাজে লাগে ভীষণভাবে। এরকম এক যুদ্ধেই নাগোর দেহে একটা লোহার গোলা
ঢুকে গিয়ে সে অভিশপ্ত দানবে পরিণত হয়ে গেছিল।
রাণী এবোসি
রাণী এবোসির এই
গুন্ডাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে জড়িত ছিল সান নামে এক কিশোরী মেয়ে। এই সান মানুষ
হয়েছিল নেকড়েদের মধ্যে তাই জঙ্গলের প্রাচীন আত্মার সঙ্গে সে ছিল একাত্ম হয়ে।
অরণ্যের বিরুদ্ধে মানুষের এই সংগ্রামে সে তীব্রভাবে ছিল মানুষের বিপক্ষে। নিজেই সে
মনোনোকে উপাধি নিয়েছিল। জাপানী ভাষায় এই শব্দের মানে আত্মা। এই কথাবার্তার মধ্যে
সান আক্রমণ করে বসে রাণী এবোসির শহরে। এই যুদ্ধে রাজকুমার আসিতাকাও জড়িয়ে পড়ে
বাঁচাতে চান রাণী এবোসিকে। কিন্তু মারাত্মক আঘাত পেয়ে সানের মতোই অজ্ঞান হয়ে যান
তিনিও। জ্ঞান ফিরে পাবার পর রাজকুমার আসিতাকা, সান বা মনোনোকের
সাথেই তার জঙ্গলে গিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের জীবনশৈলী জানতে পারেন। এই সুপ্রাচীন
অরণ্যের আত্মার সাথে তারা যে কতটা একাত্ম হয়ে আছেন সেটা জানতে পেরে আসিতাকার ভুল
ভাঙে। এই সব বিরাট পুরোন গাছেরা মৌন থেকেও যে অশ্রুত সুরে গান গেয়ে যায় সেই গানের
সুর আস্তে আস্তে ধরতে পারেন তিনি। বুঝতে পারেন যে যন্ত্র সভ্যতার দম্ভে আসলে
মানুষই এই মহান ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে যাচ্ছে। মনোনোকের জন্যই তার শাপ মুক্তি ঘটে
বনের এক আত্মার সাহায্যে।
সান ওরফে রাজকুমারী মনোনোকি
এরপর কি হবে? যন্ত্রের
গরবে মত্ত মানুষ না প্রকৃতির ছায়ায় বেড়ে ওঠা অরণ্যবাসীরা কে জিতবে এই যুদ্ধে। নাকি
দুজনেই এক সহজ সরল সহাবস্থানে আসতে পারবে? জানতে হলে অবশ্যই দেখতে হবে এই অনবদ্য
ছবিটা। এখন এ দেশেও যথেষ্ঠ সুলভ এর ডিভিডি।
সিরাতানি উনুসি’র ঘন জঙ্গল; যা এই ছবির অনেক গ্রাফিক ডিজাইনের প্রেরণা
এই ছবির গল্পে পৌরাণিক
এবং লৌকিক নানা প্রাণীর ছায়া আছে। লোক আঙ্গিকে গল্পের বয়ানের মধ্যে দিয়ে আসলে
পরিবেশ হত্যাকারী আধুনিক মানুষের সভ্যতার উদ্দ্যেশেই তীব্র শ্লেষ ছুঁড়ে দেওয়া
হয়েছে। এমনকি গল্পের আখ্যানের এই বিষয়বস্তুটা রজার এবার্টের মতো বিখ্যাত
সমালোচকেরও খুব পছন্দ হয়েছিল। ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন তিনি এই ছবির। মিয়াজাকির
নিজের কথায় এই অ্যানিমে ছায়াছবি ঠিক ভালো – খারাপের মোটা দাগের দ্বন্দ্ব নিয়ে নয়। এটা
আসলে একটা অন্বেষণ যে শিল্প বা যন্ত্র সভ্যতার উন্নতি আর অদিম অরণ্যের কোলে
মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনার মুক্তি এই দুইয়ের মধ্যে হয়তো খুব বিরোধ নেই। মানুষই
পারে এদের মধ্যে একটা সমন্বয় এনে আগামী পৃথিবীটা শিশুদের সত্যিই বাসযোগ্য করে
যেতে। আর ঠিক এই কারণেই এক মহান পরিচালক মিয়াজাকির এক অমর সৃষ্টি হয়ে রয়ে গেছে এই
বিখ্যাত চলচ্চিত্র।
জাপানী উপকথা অনুসারে প্রাচীন অরণ্যের এক আত্মা – এই ছবিতে দেখানো
_____
শেষের অংশে "দ্য লাষ্ট সামুরাই" সিনেমার কিছু ছায়া লক্ষ্য করা গেল। আসিতিকা যেমন যুদ্ধে অজ্ঞান এবং আহত হয়ে মনোনকের সাথে সেই অরন্যে যান - আর অরন্যের জীবনকে সম্যক উপলব্ধি করে তাঁর জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয় সেরকমই 2003 সালে তৈরী দ্য লাষ্ট সামুরাই তে ন্যাথান আহত এবং অবসৃত হয়ে কাটসুমোটোর সাথে গভীর অরন্যে তাদের বাসভুমিতে গিয়ে তাদের জীবনে জীবন যোগ করে।
ReplyDeleteহয়ত জাপানের গল্পগুলি এরকমই। যন্ত্রসভ্যতা যেমন একদিকে জাপানকে দুহাত ভরে দিয়েছে, সেরকমই সেই সভ্যতার মধ্যে থাকা কিছু সংবেদশীল মানুষ "দাও ফিরে সে অরন্য" ধ্বনি তুলেছেন অতি সংগত ভাবে। পুরানের কাহিনী উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে অ্যানিমকে কেবল শিশুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে গভীর বার্তা বহনের যে মাধ্যম হিসাবে সমাজের সর্বস্তরে তুলে ধরেছেন পরিচালক তাতে এসব সিনেমা হল অফ ফেমে অবশ্যই স্থান পেতে পারে। আর এর সন্ধান দিয়ে সন্দীপনবাবু আমাদের ধন্যবাদার্হ হলেন।
এই পয়েন্টটা যথার্থ বলেছেন। মিয়াজাকির ছবিতে এক ঘোর জাদুবাস্তবের আলো ছায়াতে প্রাচীন সভ্যতায় প্রকৃতির সাথে ক্লেদহীন নিবিড় যোগ আর আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার সমন্বয় নিয়ে এক অনবদ্য রূপক উপস্থাপিত হয়েছে বারবার। আলোচ্য ছবিটা এরই এক উজ্জ্বল নিদর্শন।
Deleteশেষের অংশে "দ্য লাষ্ট সামুরাই" সিনেমার কিছু ছায়া লক্ষ্য করা গেল। আসিতিকা যেমন যুদ্ধে অজ্ঞান এবং আহত হয়ে মনোনকের সাথে সেই অরন্যে যান - আর অরন্যের জীবনকে সম্যক উপলব্ধি করে তাঁর জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয় সেরকমই 2003 সালে তৈরী দ্য লাষ্ট সামুরাই তে ন্যাথান আহত এবং অবসৃত হয়ে কাটসুমোটোর সাথে গভীর অরন্যে তাদের বাসভুমিতে গিয়ে তাদের জীবনে জীবন যোগ করে।
ReplyDeleteহয়ত জাপানের গল্পগুলি এরকমই। যন্ত্রসভ্যতা যেমন একদিকে জাপানকে দুহাত ভরে দিয়েছে, সেরকমই সেই সভ্যতার মধ্যে থাকা কিছু সংবেদশীল মানুষ "দাও ফিরে সে অরন্য" ধ্বনি তুলেছেন অতি সংগত ভাবে। পুরানের কাহিনী উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে অ্যানিমকে কেবল শিশুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে গভীর বার্তা বহনের যে মাধ্যম হিসাবে সমাজের সর্বস্তরে তুলে ধরেছেন পরিচালক তাতে এসব সিনেমা হল অফ ফেমে অবশ্যই স্থান পেতে পারে। আর এর সন্ধান দিয়ে সন্দীপনবাবু আমাদের ধন্যবাদার্হ হলেন।
শেষের অংশে "দ্য লাষ্ট সামুরাই" সিনেমার কিছু ছায়া লক্ষ্য করা গেল। আসিতিকা যেমন যুদ্ধে অজ্ঞান এবং আহত হয়ে মনোনকের সাথে সেই অরন্যে যান - আর অরন্যের জীবনকে সম্যক উপলব্ধি করে তাঁর জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয় সেরকমই 2003 সালে তৈরী দ্য লাষ্ট সামুরাই তে ন্যাথান আহত এবং অবসৃত হয়ে কাটসুমোটোর সাথে গভীর অরন্যে তাদের বাসভুমিতে গিয়ে তাদের জীবনে জীবন যোগ করে।
ReplyDeleteহয়ত জাপানের গল্পগুলি এরকমই। যন্ত্রসভ্যতা যেমন একদিকে জাপানকে দুহাত ভরে দিয়েছে, সেরকমই সেই সভ্যতার মধ্যে থাকা কিছু সংবেদশীল মানুষ "দাও ফিরে সে অরন্য" ধ্বনি তুলেছেন অতি সংগত ভাবে। পুরানের কাহিনী উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে অ্যানিমকে কেবল শিশুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে গভীর বার্তা বহনের যে মাধ্যম হিসাবে সমাজের সর্বস্তরে তুলে ধরেছেন পরিচালক তাতে এসব সিনেমা হল অফ ফেমে অবশ্যই স্থান পেতে পারে। আর এর সন্ধান দিয়ে সন্দীপনবাবু আমাদের ধন্যবাদার্হ হলেন।