আমার ছোটবেলা:: তখন এখন - যশোধরা রায়চৌধুরী


তখন এখন
যশোধরা রায়চৌধুরী

আমাদের শৈশবে আর কৈশোরে পৃথিবীর আকাশের রঙ একেবারে ঝকঝকে নীল ছিল, তা আমি মোটেই বলছি না৷ এমনও দাবি করব না যে আমাদের ছোটবেলায় ঘাসের রং পান্নার মত ছিল, এখন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আসলে ছোটদের চোখে সবকিছুই নতুন বলে, বড় হবার পর ছোটবেলায় দেখা শোনা সবই বড় ঝকঝকে লাগে৷ স্মৃতির কদর বর্তমানের চেয়ে বেশি সর্বদাই৷ কাজেই বলা বাহুল্য, আমরা, যাদের জন্ম এই ধরুন ৬০ থেকে ৭০ দশকের মধ্যে, তাদের আপাত চালশে লাগা চশমার ভেতর দিয়ে এই পৃথিবীর উপনিবেশটিকে এখন আর তত ভালো না লাগলে পরে, মনের ভেতরে অনেক বেশি তাজা থেকে যেতে পারে সেই কবেকার জল-হাওয়া-মাটি - মেলা-সার্কাস - অ্যানুয়াল পরীক্ষা - পুজোর ছুটি - দোল বিশ্বকর্মা পুজো - ঝুলনের দিনগুলি৷

ইদানীং নানান কাগজ পত্রে এই সময়টাকে ধরে রেখে দেওয়ার একটা চেষ্টা দেখব আমরা৷ খুব জরুরি এই হারিয়ে যাওয়া সময়ের খোঁজ৷ বলে কিনা ফরাসি সাহিত্যিক প্রুস্ত সায়েব তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম রেখে গেলেন এক বৃহৎ গ্রন্থাবলীতে, যার নামহারানো সময়ের খোঁজে’ ( লা রশের্শ দ্য তঁ পেরদ্যু)

প্রতি মুহূর্তে পাল্টে চলা এই দিনকালের ভেতরে দাঁড়িয়ে জন্ম-নস্টালজিক বাঙালির আবার নতুন করে অভিভূত স্মৃতিভারাতুর হবার পালা৷ হারিয়ে গেছে ক্যারম খেলা, হারিয়ে গেছে সরস্বতী পুজোর রাত জেগে পাড়ার ফাংশন দেখা৷ হারিয়ে গেছে রাশিয়ার রূপকথা পড়ে বড় হওয়া, হারিয়ে গেছে ইস্কুলের বাইরে চূরন-ওয়ালাহারিয়ে গেছে লাট্টু, লেত্তি, মার্বেল, ডান্ডাগুলি, তিনতাস, গাধাপেটাপেটিশব্দগুলিই যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের কথোপকথনের বৃত্ত থেকেএখনকার শিশুদের জীবন টিউশন, -মেল, টিভি, কার্টুন, একজ্যাম, ফাস্ট ফুড, ক্রিকেট ইত্যাকার শব্দের এক পিন্ড৷ মায়ের বকুনি, বাবার চোখ রাঙানি, রিয়ালিটি শো, কমপিটিশন, ভালো করা, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, রোজগার করা, নাম করা, ফার্স্ট হওয়া, এসবের তলায় তলিয়ে গেছে দাদু দিদা ঠাকুমা পিসিমা কাকিমা জ্যেঠিমার আদর বা বুনসুটি, হারিয়ে যাচ্ছে সাপলুডো, কালীপটকা৷ সার্কাস দেখার আনন্দও এখন থেকে বাদ, সরকারি আইনের ফলে, যদিও তার বহু আগে থেকেই অ্যানিমাল প্ল্যানেটের কল্যাণে শিশুরা খুইয়েছে তাদের নিজস্ব আগ্রহ, পশুপাখির নাচনকোঁদন দেখবার৷
সুতরাং যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে থাকবার ব্যর্থতা জেনেই, তা নিয়ে অল্পবিস্তর চর্চা করলে ক্ষতি কী? আমার লেখার ভেতর দিয়ে আমি ছোটবেলার সেই ভালো আর মন্দগুলোকেই আর একবার তুলে ধরবার চেষ্টা করছিজানি কারুর না কারুর সাথে সেই সব অনুভূতি ঠিক ভাগ হয়ে যাবে

এক একটা আনন্দের আর ভালো জিনিসের সাথে আবার এক একটা দুঃখ বা বেদনার জিনিসও কেমন যেন একত্র হয়ে আসে, গলা জড়াজড়ি করে থাকে নানা রকম অনুভূতি৷ একটা টানলেই আর একটা এসে পড়ে৷ একজনকে ছাড়া আর একজনকে মনে করাই যায় নাকেমন সুতোর মত জুড়ে রাখে জীবন সেইসব স্মৃতিকে৷

* * *

অ্যানুয়াল পরীক্ষা - পুজোর ছুটি

তখন বার্ষিক পরীক্ষা হত নভেম্বর মাসে, ঠিক পুজোর ছুটি শেষ হবার সাথে সাথেই, মা দুর্গা - মা লক্ষ্মী - কালীমায়ের পূজা সারা হতে না হতেই, ভাইফোঁটার দিব্য মজা শেষ হতে না হতেই, দুয়ারে প্রস্তুত পরীক্ষাগাড়ির ঘন্টা নাড়ত পরীক্ষার অপদেবতাতাই, কেমন করে যেন, পুজোর ছুটির মজার সাথে একটা বিষাদের সুর, আমার সব ছোটবেলার স্মৃতিতে মাখামাখি৷ পুজো আসছে পুজো আসছে এই আনন্দে বেশ কটা দিন কেটে যেত৷ মা নানারকমের ছিটের কাপড় আর লেস কিনে আনত, শেলাই কলের ঘরঘর আওয়াজে পূর্ণ হয়ে উঠত বাড়ি, মাঝে মাঝেই গিয়ে গিয়ে মাপ দিয়ে আসছি মায়ের কাছে, আধখানা সেলাই হওয়া জামার। তারপর তো একদিন পুজো এসে গেলপঞ্চমী বা ষষ্ঠীর দিন সন্ধেতে মা হাজরা পার্ক, রমেশ মিত্র, সঙ্ঘশ্রী, সঙ্ঘমিত্র, হরিশ পার্ক, ২৩ পল্লীর পুজো দেখিয়ে আনত, ফুচকা খাওয়ার ঢালাও ছাড় সেদিনই পাওয়া যেত৷ দক্ষিণের পুজোতে বেশির ভাগ নয়া কারসাজি সাজগোজের বিস্ময় লেগে থাকত৷ আলো আর আওয়াজের অভিনবত্বে, সচরাচর-এর পুজোটা অত্যন্ত চমকপ্রদ তখন৷ অডিও ভিশুয়াল-এর রমরমা তো ৭৫ সালে কলকাতা দূরদর্শন আসবার আগে আমাদের জীবনকে স্পর্শ করেনি, পাহাড়ের উপর থেকে মা দুর্গার শরক্ষেপণের ওই আলোকদৃশ্য, তাই দেখতে মানুষের ভিড়ে ঢল নামত৷

তারপর সপ্তমীর দিন চলে যেতাম দিদার বাড়িতে, উত্তর কলকাতায়৷ সেই রাজাবাজার, মির্জাপুর, কলেজ স্ট্রিট, আমহার্স্ট স্ট্রিট, এমনকি মহাম্মদ আলি পার্ক-এর পুজো অব্দি ঘুরে আসার হাতছানিসহ৷ অসংখ্য পুরোনো বাড়ির পুরোনো পুজো, চন্ডীমন্ডপে একচালার রাংতা-ডাকের-শোলার-সাজপরা সপরিবার দুর্গামূর্তি দেখার সৌভাগ্য ঘটত তখন৷ ওই তিন চারটে দিন টানা দিদার বাড়িতে থাকতে পারি, ওই কটা দিন পড়াশুনোর কথা মুখে আনা বারণ, যদিও দেখেছি মা বইগুলো বৃথাই ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছে, ওই কটা দিন কেবল খাওয়া, কেবল ঘুরঘুর৷ সারা রাত জেগে হেঁটে হেঁটে উত্তর কলকাতা চষে মামা আর আর মামাতো ভায়েদের সাথে গুণে গুণে ঠাকুর দেখা, কোনও কোনও বাড়িতে আবার আলাদা আকর্ষণ ছিল খাঁচার ময়ূর বা একঝাঁক চন্দনা-দোয়েল, পুরনো কলকেতার বনেদি বাড়িতে এমনকি হরিণ পর্যন্ত দেখেছিঅনেক রাতে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়া, পাড়ার প্যান্ডেলের সন্ধিপুজোর ঢাকঢোলের আওয়াজে আবার জেগে ওঠা৷

দিদার বাড়িতে পুজোটা নিজের আনন্দ নিয়ে আসত, ঘটে আম্রপল্লব আর সশীষ ডাব প্রতিষ্ঠা করে চন্ডীপাঠের চল ছিল, দাদু করতেন পাঠআমাদের কাজ ছিল পটের দুর্গা-মাকে চন্দন পরানো, আর পাড়ার বারোয়ারি শিউলি গাছের ফুল তুলে এনে কে কত লম্বা মালা বানাতে পারি তার প্রতিযোগিতা দেওয়া৷

লক্ষ্মীপুজোর পরদিন আবার ম্লানমুখে বাড়ি ফিরে আসা৷ দিদা বলতেন, পুজো পুজো পুজো, হয়ে গেল পুজো৷ পরের পুজোয় আর থাকি কি থাকি না দ্যাখএমনি করে বছরের পর বছর ঘুরে যেত, প্রতি বছরই পরের বছর না থাকার হুমকি দিয়েও, ঠিক দিদা পরের বছর আবার ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় ঘর ধুইয়ে, পুরোনো বেনারসি শাড়ির পর্দা টাঙিয়ে, কাগজের মালা আর পাখা সাজিয়ে, সেই বরিশালের ছাপা ছবির পটখানা বেঁটে কাঠের চৌকির উপরে স্থাপন করতেনদিদা ৯৭ বছর বয়সে দেহ রেখেছিলেন

ওই খারাপ সময়টা আর যেন কাটতেই চায় না৷ ওরই মধ্যে শেষ করতে হয় গাদাগুচ্ছের পড়া৷ অঙ্কের চ্যাপ্টারের পর চ্যাপ্টার কষে ফেলো রে, ইংরিজির কালিঝুলিমাখা কয়েকটা লেসন-এর প্রশ্ন-উত্তর মুখস্থ করো, বাংলায় কিশলয়ের কয়েকটা পাঠের পড়াও তথৈবচ৷ রবি ঠাকুরের পদ্য দেখলে জ্বর আসে, ভাব সম্প্রসারণে কান্না পায়৷ তাছাড়া ভয়াবহ ভূগোল আর বীভৎস ইতিহাস তো আছেই৷ ইতিহাসের সন-তারিখ আর ভূগোলের জায়গার নাম, দুটোতেই আমার বরাবরের অনাসক্তি, আর মা সেগুলোকেই লিখে লিখে পড়তে বলেহঠাৎ হঠাৎ এসে বানান লিখতে দেয়, আর নামতা ধরেআর আছে কত লিটারে এক কিলোলিটার, কয় সেন্টিমিটারে এক মিটার, আর এক কিলোগ্ৰামে কত হেক্টোগ্ৰাম তার চুলচেরা হিসেব৷ গোটা অত্যাচারটাই চলে মূলত পুজোর ছুটির ওই পনেরোটি দিনের মধ্যে, যখন অত্যাচার করার অগাধ সুযোগ মায়ের হাতে৷ জানি যে তার ঠিক পর পরই দিওয়ালি আসছে আলোর উৎসব, কিন্তু সেই দিকে তাকিয়ে থাকা, ঠিক যেন তৃষিত নয়নে, দূর থেকে যেমন দারুচিনি দ্বীপের দিকে তাকায় মাঝসমুদ্রে দিগভ্রষ্ট নাবিক, তেমনি করে৷

ঠিক অমোঘ সময়ের নিয়ম নীতি মেনে শেষ হয় সেই কটা দিনকালীপুজো আসে, সারারাত জেগে থাকার প্রতিশ্রুতি নিয়ে৷ মামার বাড়ির ছাতে আমরা সব মামাতো ভাইবোন মিলে, সারাসন্ধে বাজি পোড়াব ভেবেও, কেমন করে জানি বাজিগুলো খুব তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেলে অন্য বাড়ির ধূমধাড়াক্কাময় বাজিণ্ডলোর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিই বা করার থাকে? অন্তাক্ষরী খেলি আমরা, অধিকাংশ সময়েই গানগুলোর কথা বা সুর আমরা নিজেরাই বসাই৷ পাড়ার কালীপুজো দেখতে ভিড় করে নামি, পিছনের সারিতে বসে পুজো দেখতে দেখতে মেয়েদের গসিপ চলে খুব১০৮ প্রদীপ সাজানোর দায়িত্ব পাই কখনও বা, প্রতিটিতে সমান তেল ঢালার বা সলতে ঠিকঠাক বার করে দেবার কাজ করি মন দিয়েদিনে যেমন পানিফল কেটেছি বা দূর্বা বেছেছিআমার কিন্তু সবচেয়ে ভাল লাগে রক্তচন্দন বাটতে, শ্বেতচন্দনের চেয়ে ঢের বেশি দ্রুত বাটা যায়, আসলে নিজের কাজের ফল ফলতে দেখতে পাই যে পাটার উপরে তার গাঢ় লাল রঙে!

প্রতিপদের সকালে, হঠাৎ কোনও সময়ে ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়ার পর, জেগে উঠি বাসি লুচির স্বাদে, মাংস আর লুচি৷ তারপর আবার আড্ডা৷ সন্ধেতে বাঙালদের নিয়মমত ভাইফোঁটার আয়োজন শুরু হয়১৭ টি মামাতো পিশতুতো ভাইবোন আমরা, ফোঁটা দেওয়ার ঘটা অনেক৷ ভায়েরা বোনদের ছোট ছোট প্যাকেটে করে নানা রকম উপহার দেয়৷ বোনেরাও ভায়েদের৷ উপহার পাওয়ার একটা অদ্ভুত পারমুটেশন কমবিনেশন চলতে থাকে৷ কটা ভাই আর কটা বোন, তার হিসেব মেলে না কখনোই৷ কখনো বা কোনও দাদার বন্ধুও নেহাৎ অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভাইফোঁটার লাইনে বসে যেতে বাধ্য হয়৷ হয়ত তাকে বাধ্য করা হয়!

আমার স্মৃতিতে, নানারকমের ফিতে, ক্লিপ, বাহারি চুড়ি, বাহারি ব্যাগ, সাবান তোয়ালে বা গায়ে মাখার শৌখিন দ্রব্য, আমার পাওয়া শুরু ওই ভাইফোঁটার উপহার হিসেবেইআমাদের দেওয়ার নিয়ম ছিল ভায়েদের, হয় হালকাফুলকা রুমাল বা তোয়ালে, অথবা শার্ট।

সে সন্ধের খাওয়াদাওয়া তো বোনেদেরই স্পনসর করতে হয়তাই থালায় থালায় ফল আর মিষ্টি সাজানো, আর তার পাশাপাশি বেশ মুখরোচক কিছু, ফিশ ফ্রাই অথবা চপ কাটলেট গোছের, আমরা সাজাতামআর রাতের সুখাদ্যটি রাঁধত দিদার বাড়ির খাসরাঁধুনি গোবিন্দদা৷ মনে হয় ফ্রাইড রাইস আর মাংসটাই ছিল মূল মেনু৷

ভাইফোঁটা শেষ হয়ে গেলেই বিষণ্ণ কয়েকটা দিন, তারপরই স্কুল খুলে যাবে৷ হেমন্তের নিবে আসা সন্ধের সেই বিষাদ আজও মনে পড়ে৷ জীবনানন্দীয় বিষাদের চেয়ে তা কিছু কম ছিল না৷

এখন পুজোর সাথে অ্যানুয়াল পরীক্ষার কোনও অনুষঙ্গ নেই শিশুদের৷ অ্যানুয়ালটা হয় মার্চ নাগাদ৷ হয়ত বা কোনও কোনও স্কুলে হাফ ইয়ারলি ওই সময়টায় হয়আর দ্বিতীয় কথা হল, এখন ছোটদের সারাটা বছরই সেই রকম চাপ চলে, আমাদের যেটা পরীক্ষার ঠিক আগের কটা দিনে চলত৷ সারা বছর ফাঁকি দিতাম বিস্তরএখনকার বাচ্চারা সে সুযোগ পায় না৷

পুজোটা তো অনেকটাই বদলে গেছে৷ শুধু কেনাকাটির উৎসব হয়ে দাঁড়িয়েছে পুজো এখনসে কেনাকাটিতে টাকাপয়সার দ্যাখনদারি বেশি, হয়ত রেডিমেডের চমকগুলোও বেশিমায়েদের সেলাইকলের শব্দমুখরিত পুজোর আগের কটা দিন তো হারিয়ে গেছেই, সঙ্গে গেছে পুজোর গানের রেকর্ড-এর জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থাকাতখন প্রতিটি প্যান্ডেল থেকে ছুটে আসা অমায়িক চিৎকারে তো সেই কিশোর কুমার-লতা-আশা-মান্না-আরতি-সন্ধ্যা-হেমন্তের মণিমুক্তাগুলোই বাজত, বাবা-মায়েরা যতই ভুরু কুঁচকোন না কেনএখনো আশা ভোঁসলেরচুরা লিয়া হ্যায়’ অথবালক্ষ্মীটি দোহাই তোমার’ শুনলে আমার পুজোর প্যান্ডেলই মনে পড়ে৷ নিষিদ্ধ সব চটুল গান অকাতরে ইশকুল পডুয়া আমাদের কানের ভেতর ঢেলে দিয়ে মরম পর্যন্ত রসসিক্ত করে তুলত সেইসব গান৷ এখনকার কানে-আইপড-গোঁজা অঙ্ক করতে করতে ফিউশান গান শোনা ছেলেপিলেদের সাথে কোনদিন কমপিটিশনে বসতে পারতাম না আমরা

সাদাকালো ছবি - শনিবারের ছবি - লোডশেডিং

তখন আমাদের ছোটবেলাটা ছিল মূলত সাদাকালোর৷ মানে, ফোটোতেও সাদাকালো দেখা দিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের দেখাদেখির ইতিহাসমা-বাবার বিয়ের ফোটো, বা ঠাকুরদা ঠাকুরমা, পিতৃপুরুষদের ছবিগুলিতে সাদাকালো অথবা ঝাপসা সিপিয়ার মায়ামোহ, যা আজও কাটল না৷ অন্যদিকে আবার সিনেমার সাদাকালো৷ রমরমিয়ে চলা গুপী গাইন বাঘা বাইনের অথবা মর্জিনা আবদাল্লার শেষ দৃশ্যে রঙিনের ছোঁয়াকে যাদুর মতো বিস্ময়কর বলে মনে হওয়া৷ তারপর কলকাতা দূরদর্শন, সেও তো সাদা কালোতেই মাৎ করল আমাদেরমামার বাড়িতে, পাশের বাড়িতে টিভি এল প্রথমেআমাদের বাড়িতে এল না৷ এই থাকা না থাকাও তো একরকমের সাদাকালো৷

তা ছাড়াও ছিল দিন আর রাতের মতই স্বাভাবিক আর সাধারণ, কারেন্ট থাকা আর লোডশেডিং হয়ে যাওয়াগুলোপ্রায় সব পরীক্ষার আগের সন্ধেতেই, টিমটিমে হ্যারিকেনের আলোতে ঝুঁকে পড়েছি বইয়ের উপরে, এরকমই স্মৃতি৷ মা সারাদিন ধরে হ্যারিকেনের কাচ পরিস্কার করছেন৷ কেরোসিনের শিশিশুলি সযত্নে রক্ষা করছেনতারপর বিকেলের মুখেই জ্বেলে জ্বেলে সেইসব হ্যারিকেন ঘরের দুয়ারে রাখা হচ্ছে, শিখাটা যথাসম্ভব নামিয়ে, যাতে একবার লোডশেডিং হয়ে গেলে আবার দেশলাই খুঁজতে হয়রান না হতে হয়৷

এর পর পর আসবে আবার নতুন সব প্রযুক্তির এমারজেন্সি লাইট৷ পুরো ফ্লপ কেস৷ চার্জ দিয়ে রাখতে হয়, তথাপি ভালো জ্বলে না৷ দ্রুত খারাপ হয়৷ সারানো যায় না সহজে৷ চিনে জিনিস যে! যে- যেত শিলিগুড়ি, নিয়ে আসত হংকং মার্কেট থেকে।

শেষটা আমরা মোমবাতিরই শরণাপন্ন হই। আর পাশের বাড়ির লোক ইনভার্টার কেনে! সবসময়েই পাশের বাড়ির লোকেরা একটু বেশি পায়। সাদাকালো থেকে নতুন রঙিন টিভিতে প্রোমোশনও পাশের বাড়িই পায়৷
শনিবারের হিন্দি ছবি, রবিবারের বাংলা ছবি, ছিল সাদাকালোর জমানায়। রঙিনের জমানায় এসে পড়ে অনেকগুলো চ্যানেল, সিরিয়াল। এসে পড়ে রামায়ণের পর মহাভারত। রবিবার সকালে রাস্তাঘাট শুনশান হয়ে যায়। মহাভারত দেখতে সক্কলেই হয় নিজের বাড়িতে নয় পাশের বাড়িতে টিভির সামনে বসে পড়েছে৷
তখনকার ভিলেনরাও কেমন কালো, আর হিরোরা সাদা৷ হিরোদের চরিত্র যতটাই নিষ্কলুষ, ততটাই হিরোইনদের মন অপাপবিদ্ধ৷ তখনকার খারাপ লোকরা কৈকেয়ী থেকে শকুনি, পাড়ার কুচুটে কাকিমা থেকে দজ্জাল শাশুড়ি। দুটো দিক-কে একসাথে দেখার অভ্যাস তখনো হয়নি আমাদের।

এখন সাদাকালো মানে নস্টালজিয়া। তাছাড়া আর কিসসু না। এখন সাদাকালো মানে, অতীতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছাটুকু। পুরনো অ্যালবাম ঘাঁটা। এখন সাদাকালো মানে উত্তমসুচিত্রার রোম্যান্স, সৌমিত্র-অপর্ণার রোমান্স। এখন সাদাকালো মানে, সেই ভালো আর মন্দের স্পষ্টতা, যা আগে ছিল, কিন্তু এখন হারিয়ে গেছে আমাদের জীবন থেকেই। এখন সবটাই হয় রঙিনের বাড়াবাড়ি৷ নয়ত গ্রে-টোন। ভালো আর মন্দের ভেদরেখাটা মুছে গেছে কবেই। এখন নায়িকারাও ভ্যাম্পের মত জামাকাপড় পরে, ওইরকমই নাচে। আর নায়করাও ভিলেনদের কবেই ছুটি দিয়ে নিজেরাই মেয়েবাজি করছে। একাগ্র একনিষ্ঠ প্রেমও তো সাদাকালো ফোটোর মতই ঝাপসা, ধোঁয়া ধোঁয়া৷ এই নতুন সময়ে সবচেয়ে ভালো যা, তা হল, রঙিনের অসংখ্য রঙের ভেতর থেকে আবার ফ্লুরোসেন্ট রঙটা আলাদা হয়ে উঠে আসে৷ প্রতিদিন টিভিতে শতাধিক চ্যানেল পাওয়া যায়, তাতে অ্যাত্তো অ্যাত্তো ছবি দেখায়। সবকিছু একসাথে বেছে নেওয়ার দেদার আয়োজনে এখন কোনও শনিবারের ছবি, রবিবারের ছবি দেখার বাধ্যতা নেই। তাই সেই শিরশিরে সুখও নেই।

৩। শীতের ছুটি - পিকনিক কমলালেবু - ভীষণ ঠান্ডা

তখন আমাদের ছোটবেলায় শীতটা একটু বেশি বেশি পড়ত৷ শুনে হাসবেন না কাঁদবেন ভাবছেন? এ তো সেই বুড়োমানুষদের মত কথা, যাঁরা বলেন, সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনে...৷ না, আপাতত ২০০৯ সালের গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর নমুনা দেখেই বলছি। বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে আমাদের ছোটবেলায় কলকাতা শহরের দূষণের মাত্রাটি এখনকার চেয়ে ঢের কম ছিল। পুকুর বা জলা জায়গার পরিমাণও অনেক বেশি ছিল৷ গ্রীষ্মের সন্ধেতে যে হাওয়াটা দিত সেটা যেমন উধাও হয়েছে তেমনি শীতের সকালের কুয়াশা আর হাড়হিম হাওয়াটাও৷ কমলালেবুর মত রোদটা এখনও আছে। কতদিন থাকবে বলা যায় না৷

শীতের ছোট্ট দশদিনের ছুটিটা চলত বেশ নিষ্পাপ। নতুন ক্লাসে ওঠার আর দেরি নেই, রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে৷ বই কেনা হচ্ছে, তাতে ব্রাউন পেপারের মলাট লাগানো চলছে। আর সারা শীতের ছুটি আবদার হচ্ছে, চিড়িয়াখানায় নিয়ে চলো, তারামন্ডলে যাব; বড়দিনের দিন পিকনিকের ছক তৈরি হচ্ছে।
শীত ভাবলেই তাই সোয়েটার, মায়ের সোয়েটার বোনাবুনি, আর বলের ছোটাছুটি৷ শীত মানেই পাড়ার দোকানে ফুলকপির সিঙাড়া ভাজার গন্ধ, নলেন গুড়ের পায়েসের গন্ধ৷ শীত ভাবলেই ইডেনের খেলার ধারাবিবরণী রেডিওতে। শীত ভাবলেই তাই বোটানিকাল গার্ডেন, যাদুঘর৷ শীত ভাবলেই তাই অনেক কমলালেবু ছাড়ানোর স্মৃতি। আর হ্যাঁ, শোবার ঘরের জানালায় রোদের আসার পথটা কেমন কোণাকুণি ঘুরে যায়৷ মা বোঝান দক্ষিণায়নের তত্ত্ব। আমি দেখি প্রতি শীতেই রোদের রঙ পাল্টে যায়৷ পাড়ায় নতুন নতুন সব আওয়াজ শুনি৷ গলিতে নেট টাঙিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলা হয় রাত অব্দি, আলো জ্বেলে। খেলতে খেলতে প্রেম গড়ে, প্রেম ভাঙে৷ ক্রিকেট বল গায়ে এসে লাগে। নতুন নতুন গল্প তৈরি হয়।

এখন কি আর গল্প তৈরি হয় না? এখনও হয়৷ তবে কেকের দোকানের রমরমা, আর সেন্ট পল গির্জেতে মহাষ্টমীর ভিড় দেখলে মনে হয় আমরা কত বেশি হুজুগে হয়ে গিয়েছি৷ অত কেক বিক্রি হয়, কেক-ওয়ালাদের পক্ষে সুখের খবর বটে৷ কিন্তু নলেন গুড়ের পাটালি আর জলভরা তালশাঁসগুলো কেমন যেন মিইয়ে যাচ্ছে তাদের পাশে৷ ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা বলে মিষ্টি খাই না, শুধু পেস্ট্রি ছাড়া আর চকোলেট ছাড়া৷ দেশি মিষ্টি মানেই নাক শিঁটকোনো৷

যেমন ক্রিকেটও তো আর শুধু শীতের নয়, সারাবছরের৷ রেডিওর ধারাবিববরণী? কানের কাছে লাগিয়ে রাখা ছোট্ট রেডিওর বদলে এখন মোবাইল৷ সবারই আছে, তাই কেউ কারুর কাছে স্কোর জানতে চায় না - দাদা, কত হল? ক’টা উইকেট পড়ল? কেউ বলবে না৷

মায়েরা আর সোয়েটার বানান না। সময় নেই কারুর৷ রেডিমেড সেন্টারের সব জিনিসে কত ভালো ফিনিশ৷ তা ছাড়া প্রতি শীতে কেনা নতুন নতুন গরম জামায় আমাদের আলমারি ফেটে পড়ে, কিন্তু শীতই পড়ে না তেমন, তাই সবকিছু নামিয়ে আমাদের পরা হয় না আর। পরা মানে তো লোকদেখানো শুধু, কার কটা আছে জানান দেওয়া৷ সেইসব উল জমে যাওয়া সোয়েটার ছুড়ে ফেলেছি আমরা, মা বা দিদিমার হাতে তৈরি ছোট হয়ে আসা সোয়েটারে উল জুড়ে জুড়ে বাড়িয়ে নিতেও চেষ্টা নেই আর। কাচার পর ছাতে শুকোনোর সময়ে সোয়েটারের নিচে আধলা ইট বেঁধে টাঙিয়ে দৈর্ঘ্য বাড়ানো যায় যে সোয়েটারের, এই রহস্যও এখন আর জানা জরুরি নয় আমাদের কাছে৷

শীতের পাখি দেখতে চিড়িয়াখানায় যাবে কে? সারাবছর ধরে ট্র্যাভেল অ্যান্ড লিভিং চ্যানেল আছে কী করতে তবে?

8গোলাপি মিক্সচার ডাক্তারজ্যেঠু - কাঠের বেঞ্চি

শীত ভাবলেই শীত শেষ হবার কথাও মনে হয়৷ ইফ উইন্টার কামস, ক্যান স্প্রিং বি ইত্যাদি ইত্যাদি৷ তো, স্প্রিং মানেই তো হঠাৎ পড়া গরম, মন আনচান, আর অবধারিতভাবে সিজন চেঞ্জের সর্দি-কাশি-গলা ফোলা-জ্বরআর তারপর পাড়ার ডাক্তারজ্যেঠুর আগমন, গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে৷ চেঁচিয়ে কথা বলা, হরেক গল্প করাযার সবটাই খুব বিরক্তিকর আমার কাছে, কারণ জানি, ফিরে গিয়েই কমপাউন্ডারের হাতে উনি পাঠিয়ে দেবেন সেই উৎকট স্বাদের গোলাপি মিক্সচার৷

কোথায় গেল সে সব গোলাপি মিক্সচার, আর সেই কমপাউন্ডারবাবুরা? এখন অনেক এক্স ওয়াই জেড সহকারে একটা খটমট নামের অ্যান্টিবায়োটিক না দিলে, ডাক্তারের মানই তো থাকে নাডাক্তাররা জানেন, পেশেন্ট পার্টিকে খুশি করতে হলে, গোটা শ’দুই টাকার ওষুধ লিখে দিতেই হবে৷ পেশেন্ট যখন থেকে পার্টি হয়ে গেল তখন থেকেই এই বিপত্তি৷ ব্লাড টেস্টের জন্য অনেকগুলো প্যাথোলজিকাল ল্যাবরেটরি গজিয়ে ওঠাটাও একটা কারণ বটে, ডাক্তার কাকু ডাক্তার জ্যেঠুদের ধন্বন্তরী-জন্ম, নাড়ী-টেপা-জন্ম, দেবতা-জন্ম শেষ হয়ে, এক একটি কমিশন-খাটিয়ে যন্ত্র-মানব হয়ে ওঠার৷ ডাক্তার জ্যেঠুর সাথে সাথে তার চেম্বারের কাঠের বেঞ্চিগুলোও তো কেমন উধাও হয়ে গেল, সেই জায়গায় এসে পড়ল প্লাস্টিকের মোল্ডেড চেয়ার৷ একসাথে কেশো রুগি- পেটের পেশেন্ট আর হেঁপো জ্বোরো বাচ্চারা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসতে হয় নাএখন সব ডাক্তারখানাই চকচকে ক্লিনিক হয়ে উঠেছেডেটল সাজানো বেসিন থাকে ঘরের কোণে৷ তাতে মানুষের অসুখ বিসুখের সংখ্যা কিছু হ্রাস পেল কিনা তা জানা যায়নি অবশ্য৷

গলা টনটন করে ভাবলে, বসন্তকালের ওই সব অসুখগুলোর কথামনে পড়ে জ্বরের দিনগুলিতে পড়া পরশুরাম বা শরদিন্দুর বইয়ের কথা, গরম দুধে একটু কফি গুলে মা যখন দিতেনআর জানালা থেকে বয়ে আসা মলয়সমীরণে কোন অদেখা প্রিয়ের জন্য বুক ধড়ফড় শুরু হত যেই, অসুখের দিনের পড়াশুনোহীন অখন্ড অবসরটাও কত প্রিয় বলে মনে হতযখন কেউ বকে না, সবাই নানারকম খাবার এনে সামনে ধরে, আর বাকি সময়টা কেটে যায় সিলিঙের দিকে তাকিয়ে৷ একগাদা অ্যান্টিবায়োটিক খেলে জ্বরটা সারে বটে, শুধু জ্বরের ওই সুখটা বড্ড তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়

* * *

এই লেখা শেষ হবার নয়এই লেখা আমাদের সবার গল্পগেঁথে গেঁথে চলা ছাড়া আর কিই বা করা চলেএক সময়ে মনে হয়, আমাদের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিকে তো ধরে রাখার কোনও দায় নেই আমাদেরএক সময়ে সবই ধুলো হয়ে যাবেআজকের দিনটিও ভবিষ্যতের ধুলো৷ তবু যে সময়টুকু আমরা বেঁচে ছিলাম, সেই সময়টুকুর জন্য আমাদের জীবন তো ধন্য৷ তারই এক সেলিব্রেশন, উদযাপন গাঁথলাম। আর কিছু না
______

3 comments: