গল্পের ম্যাজিক:: মিথ্যে তুমি দশ পিপীলিকা - তন্ময় বিশ্বাস


মিথ্যে তুমি দশ পিপীলিকা
তন্ময় বিশ্বাস

একটা ছোটখাটো ওয়াচ টাওয়ার। সূর্যদেব তার স্নেহ দিয়ে জড়িয়ে রেখেছেন তাকে। সোনালী আলো গিয়ে উঁকি মারছে টাওয়ারের ওপর। সেখানে গোমড়া মুখ করে বসে আছে বিল্টু। কালার বক্সের লাল রং শেষ। একদম শেষ! সামনে খোলা খাতা। বিল্টুর ক্যানভাসমনের ক্যানভাস। বিশাল মাঠ। পিল পিল করছে লোক। সবুজ রং করা জামা, প্যান্ট, টুপি। হাতে বন্দুক। যুদ্ধ। মিলিটারি। সবার সামনে যে আছে তার হাতে বন্দুক নেই। নেই মিলিটারি পোষাক। তার বদলে অপটু হাতে আঁকা পাজামা পাঞ্জাবি, যেন শান্তির দূত। হাতে একটা তেরঙা ফ্ল্যাগ। এটা বিল্টুর বাবা! ছবিটার অনেক জায়গা সাদা পড়ে আছে। ওখানে বিল্টু লাল রং করতলাল রক্ত।
এই ওয়াচ টাওয়ারটা কবেকার তা বিল্টু জানে না। বাবা বলে, একবার নাকি পৃথিবী জুড়ে ভীষণ যুদ্ধ হয়েছিল। এটা নাকি তখনকার। বিল্টুর বাবাও যুদ্ধ করে। লেফটেন্যান্ট। ওয়াচ টাওয়ারের ওপরটা বাবারও খুব প্রিয়। এখানে বসে বসে বিল্টুকে পড়াত। বলত, “লেফটেন্যান্ট বানান লেখ তো।”
বিল্টু মাথা চুলকে, কাটা নখগুলো আবার খেয়ে কোনওরকমে লিখত Leftnant বা Latent বাবা কোনওদিন বকে না। শুধু হাসে। হাসার সময় বাবাকে ভারি সুন্দর দেখায়। হাসলে সবাইকে ভালো লাগে না। বাবাকে লাগে। হাসার সময় যখন বাবার গোঁফদুটো ফিঙের লেজের মতো নাচে, তখন বিল্টুর বেশ মজা লাগে। বাবা বলে, “আচ্ছা, এবার লেখ মিথ্যে তুমি দশ পিপীলিকা। লিখে তার নিচে ওই শব্দের ইংরেজিগুলো লেখ lie-u-ten-ant তাহলে কী দাঁড়াল? Lieutenant ব্যস, হয়ে গেল
বিল্টু অবাক, “ওমা, কী সোজা!”
বাবা আবার হাসে। মন ভরানো সেই হাসি।

ওয়াচ টাওয়ারের লম্বা ছায়া পড়ছে ওদের বাড়িটার ওপর। সেখান থেকে মা ডাকে, “বিল্টু এবার নীচে আয়পড়তে বস।”
বিল্টু নেমে আসে। ছদ্ম অভিমান দেখিয়ে বলে, “আমি কি পড়তে বসি না?
মা হেসে বিল্টুর নাকটা টিপে দিয়ে বলে, “না, আমার বিল্টুবাবু তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে
মায়ের দাঁতগুলো দিয়ে ঝরে পড়ে একরাশ মুক্তোস্নেহ, মমতামাখা একটা মুখ। চিকচিকে দুটো চোখ। চুলে হালকা রুপোলি রেখা। পৃথিবীর যা কিছু শুভ, সব যেন এসে জমা হয়ে আছে ওই মুখে। বিল্টুদের আশেপাশে কোনও বাড়ি নেই। ওদের প্রতিবেশী বলতে সবুজে মোড়া গাছ, কিচিরমিচির করা পাখি। আর ওই ওয়াচ টাওয়ার। বিল্টুর বাবা খুব নিরিবিলি পছন্দ করে। বলে, “যুদ্ধের সময় তো কান পাতা দায় হয়ে যায়। নাক দিয়ে যেন বিষ টানি। অন্তত বাড়িতে যখন আসব তখন তো একটু প্রাণ খুলে বাঁচি!”
পড়তে পড়তে বিল্টুর চোখ চলে যায় জানালার দিকে। কাঁচে হিম জমেছে। বিল্টু আঙুল দিয়ে কাঁচের ওপর ধারা কাটে। বাইরে পরিষ্কার আকাশ। মিটি মিটি তারা। আর ফুটফুটে একটা চাঁদ। যেন মেরি-বিস্কুট। সবেমাত্র রুপোয় ডুবিয়ে তুলে আনা হয়েছে। এখনও তা থেকে রুপো ঝরছে। একসময় চাঁদটাও গলে গলে পড়বে ঠিক মেরি-বিস্কুটের মতো! বিল্টুর বাবা বিল্টুকে নিয়ে সন্ধেবেলায় উঠে পড়ত ওয়াচ টাওয়ারে।
“ওই দ্যাখ কালপুরুষ। দেখেছিস কেমন তির-ধনুক উঁচিয়ে যুদ্ধ করছে!”
বিল্টু বলতো, “বাবা, আমিও যুদ্ধ করবতোমার মতো।”
তখন বাবা বলত, “দূর বোকা। যুদ্ধ বড়ো বাজে জিনিসতুই যুদ্ধ করবি না ওই দ্যাখ সপ্তর্ষিমণ্ডল। দেখেছিস ওরা কেমন জিজ্ঞাসাচিহ্ন বাগিয়ে বসে আছে! ওদের অনেক কৌতূহল। সবসময় প্রশ্ন করছে। এটা কী? ওটা কেন? ওরকম হতে হবে বুঝলি? জানার কোনও শেষ নেই।”
বিল্টু বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে।
বিল্টু উঠে পড়লমা পাশের ঘরে। ঘরে কোনও আলো নেই। জানালা দিয়ে জ্যোৎস্না এসে খেলা করছে মায়ের কোলে। জানালার পাশে ফুলদানি। তাতে বাগানে ফোটা দুটো রজনীগন্ধার স্টিক। জানালা দিয়ে তিরতির করে হাওয়া এসে সারা ঘর ভরিয়ে তুলছে রজনীগন্ধার মিষ্টি গন্ধে। মা জ্যোৎস্না কোলে নিয়ে একমনে পিয়ানোর রিড টানছে। করুণ একটা সুর। বিল্টুর মনটা হঠাৎ করে খুব খারাপ হয়ে গেল। বাবাকে কতদিন দেখে না। সেই শেষবার যখন গেল, হাতে পাশবালিশের মতো মস্ত একখানা ব্যাগইচ্ছে করলে বিল্টু তাতে ঢুকে পড়তে পারে। চুল ঘেঁটে দিয়ে বাবা বলেছিল, “তাহলে বিল্টুবাবু, ভালোভাবে থাকবে কিন্তু। একদম দুষ্টুমি করবে না।”
তারপর বিল্টুর মুখের কাছে মুখটা নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলেছিল, “তুমি এখন থেকে এখানকার কী বলো তো?
বিল্টু বাবার মুখে ছোট্ট একটা থাবা দিয়ে বলেছিল, “মিথ্যে তুমি দশ পিপীলিকা।”
বাবা হো হো করে হেসেছিল। মা একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল দুই অসমবয়সী শিশুর কীর্তি।
বাবা চলে গেল। বিল্টু ওয়াচ টাওয়ারে উঠে শেষপর্যন্ত দেখেছিল। যতক্ষণ না বাবা মিলিয়ে যাচ্ছে সূর্যের দেশে। সূর্য যেখানে ঘুমোতে যায় বিল্টু ছুটে গিয়ে মাথা গুঁজল মায়ের কোলে। জ্যোৎস্না কোল থেকে লাফিয়ে উঠে পড়ল বিল্টুর মাথায়যেন বিল্টু তার ছোটভাই
“এই, দেখি দেখি। কী হয়েছে আমার বিল্টুবাবুর?
“বাবা কবে আসবে?
“ও, বাবার জন্য মন খারাপ! বাবা তো ভারী দুষ্টু। আচ্ছা এবার বাবাকে আসতে দাও। দুজনে মিলে বলবকেমন?
মা হাত বুলিয়ে দেয় বিল্টুর পিঠে। তারও মনখারাপ। অনেকদিন হয়ে গেল বিল্টুর বাবার কোনও চিঠিপত্র আসেনি মানুষটা কেমন আছে কে জানে! হয়তো এই একই আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে বসে আছে বারুদমাখা মানুষটা! ভাবছে বিল্টুর কথা।

আজ সকাল থেকেই সূর্যের অভিমান। একনাগাড়ে জ্বলতে জ্বলতে মাঝে মাঝেই সূর্যের অভিমান হয়। মুখ কালো করে বসে থাকে। চোখ বেয়ে পড়ে অশ্রুনদী। আজ বোধহয় একটু বেশিই অভিমান। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি ভিজে ভিজে একটা লোক এলসবুজ রেনকোট থেকে টপ টপ করে জল পড়ছে। মুখটা কেমন জানি। ইয়া মোটা মোটা ঝুলপি। বিল্টুর কেন জানি তাকে দেখেই ভয় করতে লাগললোকটা কিন্তু মিষ্টি হেসে একটা ক্যাডবেরি গুঁজে দিল বিল্টুর হাতে। দাঁত বার করে বলল, “গুড মর্নিং, ইয়াং ম্যান!”
বিল্টু ছুট্টে ঘরে চলে গেল লোকটা রেনকোট ছেড়ে বিল্টুর মায়ের মুখোমুখি সোফায় বসলতারপর মায়ের উৎকণ্ঠা মেশানো মুখটার দিকে তাকিয়ে একটা গলাখাঁকারি দিয়ে বলতে লাগল, “ম্যাডাম, আমি মিলিটারি অফিস থেকে আসছি। ওয়ার-ফিল্ড থেকে কিছু খবর আছে মানে ইয়ে, এই নিউজ আছে যে.... মিঃ সেন বীরগতিপ্রাপ্ত হয়েছেন।”
কোনওরকমে কথাগুলো শেষ করে লোকটা তাকাল বিল্টুর মায়ের দিকে। সেখানে যেন সত্যিই বাজ পড়েছে। শুধু কোনওরকমে চোখ চুঁইয়ে একফোঁটা মুক্তো খসে পড়ল কোলের ওপর। লোকটিও ভীষণ অসহায় বোধ করল। এই সময়ে কী করতে হয়, তা সে সত্যিই জানে না। চাকরির দায়ে তাকে আজ মৃত্যু বয়ে আনতে হয়েছে। সে খুলে দিয়েছে এক মস্ত প্যান্ডোরাস বক্স। তা থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসছে কালো ধোঁয়া। কালো দুঃখ। সে আবার বলে, “মিসেস সেন, প্লিজ ভেঙে পড়বেন না। ইউ শুড ফিল প্রাউড অফ ইয়োর হাজব্যান্ড! উনি দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। উনি দেশের গর্ব!”
তার কথাগুলো যেন কোথায় হারিয়ে যায়। তলিয়ে যায় গভীরে।
বিল্টু জানালার কাছে বসে। মন খারাপ। টেবিলের ওপর আঁকাটা রেখেছিল। জানালা দিয়ে জল এসে ভিজিয়ে দিয়েছে। লাল রঙটা আর করা হল না। জানালার কাঁচে জমে আছে প্রকৃতির কান্না। বিল্টু তার ওপর ধারা কেটে লেখে ‘মিথ্যে তুমি দশ পিপীলিকা’! কিন্তু প্রকৃতি আজ বন্য। বন্য অভিমানে আছড়ে পড়ে জানালার ওপর। মুছে যায় ‘’মিথ্যে তুমি দশ পিপীলিকা!’
_____
ছবিঃ দ্বৈতা গোস্বামী

1 comment:

  1. খুব ভাল হয়েছে লেখাটা, একটা চোরা দু:খ মিশে আছে লেখাটার পরতে পরতে।

    ReplyDelete