ম্যাজিক ল্যাম্প:: এপ্রিল ২০২২

সপ্তম বর্ষ।। দ্বিতীয় সংখ্যা।। এপ্রিল ২০২২
বিশেষ রজত জয়ন্তী সংখ্যা
--------------------------
----------
প্রচ্ছদঃ সপ্তর্ষি দে
ম্যাজিক ল্যাম্প 

সম্পাদকীয়:: এপ্রিল ২০২২


ম্যাজিক ল্যাম্পের প্রিয় বন্ধুরা,
 
ভালো আছ তো সবাই? এখন তো ভালো থাকারই কথা আবার আগের মতো স্কুলে যেতে পারছ সবাই বন্ধুদের সঙ্গে আগের মতোই মজা, খুনসুটি, খেলাধুলোতাই না? দেখেছ, আমি বলেছিলাম, একদিন সব আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে খুব খারাপ অন্ধকার সময়টা আমরা মনে হয় পেরিয়ে এসেছি নতুন বছরের নতুন সূর্য সব কালো মুছে দিক এটাই আমাদের প্রার্থনা
তোমাদের সবাইকে জানাই শুভ নববর্ষের প্রাণভরা ভালোবাসা আর তার সঙ্গে একটা নয়, দুটো ভালো খবর ম্যাজিক ল্যাম্প পা দিল তার পঁচিশতম সংখ্যায় আর সেই সঙ্গে আমাদের পাঠক সংখ্যা ছাড়িয়ে গেল এক লক্ষেরও বেশি
এই পঁচিশতম সংখ্যা তাই আমাদের কাছে খুব স্পেশাল
শুরু থেকেই তোমাদের সবার কাছে এত এত ভালোবাসা পেয়েছি আমরা, আজ যখন ভাবতে বসি অবাক হই কত সহজে তোমরা আমাদের আপন করে নিয়েছ
লেখক, পাঠক, শিল্পী সবাইকে নিয়েই গড়ে উঠেছে আমাদের ম্যাজিক ল্যাম্প পরিবার শুরু থেকেই আমরা জোর দিয়েছি পত্রিকার গুণমানে ম্যাজিক ল্যাম্পের হাত ধরেই উঠে এসেছেন কত নতুন লেখক, শিল্পী
বড়ো আনন্দের বিষয় জিনির তাই ইচ্ছে হচ্ছে আনন্দের ডানা মেলে ম্যাজিক দুনিয়া থেকে যত দামি দামি উপহার আছে তোমাদের দিয়ে দিতে তবে এই মুহূর্তে যেটুকু সম্ভব তা হল এবারের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধের সম্ভার পড়ে মতামত দিও কিন্তু বন্ধুরা
এই সংখ্যার প্রচ্ছদটি এঁকেছেন শিল্পী সপ্তর্ষি দে এই সংখ্যাটি সাজিয়ে গুছিয়ে তোমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন শ্রী তাপস মৌলিক
ভালো থেকো, ভালোবাসা নিও সবাই
ইতি,
জিনি
----------
ছবি - সপ্তর্ষি দে
ম্যাজিক ল্যাম্প 

গল্প:: নাম অয়স্কান্ত বক্সি - চিত্ত ঘোষাল


নাম অয়স্কান্ত বক্সি
চিত্ত ঘোষাল

আমাদের আশুর ভালো নাম অয়স্কান্ত বক্সি। নিজের এই নামটা মোটে পছন্দ নয় আশুর। বলতে কষ্ট, লিখতে কষ্ট – যেমন বাংলায়, তেমনি ইংরেজিতে। অনেকেই বলে, কী ভজকট নাম রে বাবা। যাদের নতুন নতুন জিনিস পছন্দ এমন দু’এক জন শুধু বলে – দারুণ, দারুণ, বেশ নাম তো! আশু মনে মনে বলে, হত যদি নিজের তখন বুঝতে কেমন দারুণ।
আশুর যত সমস্যা তার ভালো নামটা নিয়ে। ডাকনাম আশু নিয়ে তার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু অয়স্কান্তর ডাকনাম আশু হয় কী করে? ডাকনাম হওয়ার সাধারণ একটা নিয়ম আছে। বেশিরভাগ সময় ভালো নাম থেকেই ডাকনামটা আসে। যেমন ভালো নাম যার সঞ্জয় তার ডাকনাম আপসেই হয়ে যায় সঞ্জু, বিনয়ের হতে হবে বিনে বা বিনু। যেখানে এটা হওয়ার উপায় নেই সেখানে অন্যরকম কিছু হয়। যেমন, উজু বা উজা এত বিচ্ছিরি যে ওগুলো উজ্জ্বলের ডাকনাম হতে পারে না। তখন হয়তো তার ডাকনাম হয়ে যায় বাবলু। অয়স্কান্তের বেলায় হল কী, ভালো নাম থেকে ডাকনাম হতে পারে অয়স বা অসু। চলেই না ওরকম ডাকনাম। তাই কাছাকাছি আশুরই চল হয়ে গেল। নইলে ডাকনাম নিয়েও সমস্যা হত অয়স্কান্তর।
কিন্তু যে ভালো নাম অয়স্কান্ত নিয়ে এত কথা সেটা হল কী করে? তার একটা ইতিহাস আছে। আশুর ঠাকুরদার বাবা ছেলের নাম রেখেছিলেন কৃতান্তকরাল বক্সি। নিজের নাম থেকে অনুপ্রাণিত মানে উৎসাহিত হয়েই ঠাকুরদা একজন নামজাদা নাম-দাতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। নাম-দাতা মানে যিনি নামকরণ করে দেন। অনেকে এসে তাদের ছেলেমেয়েদের নাম দিয়ে দেবার জন্য ঠাকুরদাকে ধরত। তিনি তাদের ভালো ভালো সব নাম দিয়ে দিতেন। অবশ্য আশুর বাবার নাম তিনি দিতে পারেননি। সেটা দিয়েছিলেন ঠাকুমা। নিতান্ত সহজ সরল একটি নাম – লালমোহন বক্সি।
দুই নাতির নাম কিন্তু দিয়েছিলেন ঠাকুরদা নিজে। আশুর দাদা পুলুর ভালো নাম পুলস্ত্যপুলক বক্সি। তা থেকে ডাকনাম পুলু। পুলু একটু গম্ভীর স্বভাবেরনাম নিয়ে তার কোনো আপত্তি আছে কি না জানা যায় না। থাকলেও সেটা নিয়ে হইচই করে সে নিজের নাম খারাপ করেনি। কিন্তু আশুর মনে নাম নিয়ে মহা অশান্তি। লোকের কাছে শুনেছে নাম নাকি পালটানো যায়। ঠাকুরদা বেঁচে থাকতে তাঁর দেওয়া নাম নিয়ে আপত্তি করতে সাহস করেনি আশু। বছরখানেক হল ঠাকুরদা মারা গেছেন। তারপর থেকে আশু সুযোগের অপেক্ষায় আছে। সুযোগ পেলেই সে নাম পালটানোর দাবি তুলবে।
সুযোগ একটা এসেও গেল।
ইস্কুলে অঙ্কের একজন নতুন মাস্টারমশাই এসেছেন। অঙ্ক শেখাতে শেখাতে তিনি মুখে মুখে ছড়া বানান। ছেলেরা চাইলে সেইসব ছড়া বোর্ডে লিখেও দেন।
সেদিন হয়েছে কী, ক্লাসে তিনি একটা অঙ্ক কষতে দিয়েছেন। অঙ্কটা সোজাই। বেশিরভাগ ছেলেই ঠিকঠাক কষতে পারল। দু’জন শুধু পারল না, তাদের একজন অয়স্কান্ত। বিচ্ছিরিভাবে অঙ্কটা ভুল করেছে সে। মাস্টারমশাই তার খাতাটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে ছড়া বাঁধলেন মুখে মুখে –
অয়স্কান্ত বক্সিমশাই
কক্সবাজার গিয়ে
নকশিকাঁথা আনেন কিনে
পাঁচশো টাকা দিয়ে।
নকশা নিয়ে বক্সিবাবু
মকশো করেন যত
অঙ্কগুলো মাথার থেকে
পালিয়ে যাচ্ছে তত।
অঙ্কটা তো ভুলে ভুলাক্কার করেছ অয়স্কান্ত, তার ওপর অঙ্কের খাতায় এত নকশা এঁকেছ কেন? এটা কি ড্রয়িং খাতা?
দিব্যেশ বলে উঠল – ছড়াটা ভারী জম্পেশ হয়েছে স্যার, বোর্ডে লিখে দিন-না, আমরা টুকে নেব।
হইহই করে দিব্যেশের আবদারে সায় দিল অনেক ছেলে।
- না, লিখে দেব না, মাস্টারমশাই বললেন, তোমরা ওই ছড়াটা বলে অয়স্কান্তকে বিরক্ত করবে, তা হবে না।
ওদিকে আশুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেছে। সে বলল – দিন-না স্যার, ওরা যখন চাইছে। সবাই আমার বন্ধু, কেউ আমার পেছনে লাগবে না।
একটু ভেবে মাস্টারমশাই বললেন – অত আমি বোর্ডে লিখতে পারব না। আস্তে আস্তে বলে যাচ্ছি, তোমরা লিখে নাও।
অনেক ছেলে লিখে নিল। অয়স্কান্তও লিখে রাখল খাতায়। এটাই হবে তার নাম বদলের অস্ত্র।

বাবা অফিস থেকে ফিরে মুখহাত ধুয়ে আরাম করে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে, আশু গিয়ে হাজির হল, হাতে ইস্কুলের খাতা বাবাকে নাম পালটে দেবার কথা বলার এই সুযোগ
আশু গিয়ে পাশে বসতে বাবা বলল – কী রে, কিছু বলতে চাস মনে হচ্ছে
- বলছিলাম কী বাবা, আমার নামটা তুমি পালটে দাও
বাবা তো আকাশ থেকে পড়ল - বলিস কী তুই, এত সুন্দর নাম, তার ওপর তোর ঠাকুরদার দেওয়া, পালটাতে বলছিস কেন? কী সুন্দর ছন্দ নামটায়।
- দ্যাখো বাবা, উচ্চারণ করা শক্ত, বানান করা আরও শক্ত। ইংরেজি বানানটা তো মারাত্মকতার ওপর ওই যে তুমি বললে না ছন্দ, তারই জন্যে অঙ্কস্যার অত সহজে ছড়াটা বানিয়ে ফেলল না বাবা, আমার নাম তুমি পালটে দাও
- অঙ্কস্যার ছড়া বানালেন! মানে? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না
- এই দ্যাখো, বলে খাতাখানা বাবার সামনে খুলে ধরে আশু বলল, পড়ো, অঙ্কস্যার আমাকে নিয়ে ছড়া বানিয়েছে
পড়তে পড়তে বাবার মুখে হাসি – বাঃ, তোদের অঙ্কস্যার ছড়াও বানান বুঝি! তা, ক্লাসে বসে ছড়াটা বানালেন?
- হ্যাঁ, খাতা দেখতে দেখতে মুখে মুখে বানিয়ে ফেললেন
- বাঃ! কিন্তু আশু, তোকে নিয়ে ছড়াটা কেন বানালেন স্যার তাও যেন আছে ছড়াটায়। ব্যাপারখানা কী?
কী আর করে আশু। অঙ্ক না-পারার কথাটা বলতেই হল বাবাকে
শুনে বাবা বলল – ও, এই ব্যাপার তা মন দিয়ে অঙ্ক কর, তাহলে উনি আর তোর নামে ছড়া বানাবেন না নাম পালটে কী হবে, উনি ছড়া বানাতে যে রকম ওস্তাদ তাতে অঙ্ক না পারলে সেই নামেও তিনি ছড়া ছাড়বেন
- সে যা হয় হবে, নামটা তুমি পালটে দাও এমনিতেও ওটা আমার একেবারে ভালো লাগে না
- নাম পালটানোর কত ঝামেলা জানিস? পালটে দাও বললেই পালটানো যায় না
এই সময় ঠাম্মা ঠাকুরঘর থেকে এল এ ঘরে। হাতে জপের মালা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কুড়ি ঘণ্টাই ঠাম্মা থাকে ঠাকুরঘরে শ্যামসুন্দরের মূর্তি আছে সেখানে শ্যামসুন্দরের ভক্তিতে ঠাম্মা টুবু টুবু
- কি পালটাপালটির কথা হচ্ছিল যেন বাপব্যাটায়? ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ঠাম্মা বলল
- আর বল কেন মা, আশু বায়না ধরেছে ওর অমন ভালো অয়স্কান্ত বক্সি নামটা পালটে দিতে হবে
ঠাম্মা অবাক - কেন রে দাদাভাই, তোর ঠাকুরদার দেওয়া চমৎকার নামখানা পালটাতে চাইছিস কেন? এতদিন তো কিছু বলিসনি।
কী উত্তর দেবে আশু? সে মুখ নিচু করে চুপ থাকে
ঠাম্মা বুঝতে পারে আশু উত্তর দিতে চাইছে না দুই নাতির মধ্যে আশুই বেশি ন্যাওটা তার, তাই ঠাম্মা আর প্রশ্ন করে না, আশুর আবদারেই সায় দেয়। - তা লালু, বলছে যখন দে না পালটে। নামটা যখন ওর পছন্দ নয় পালটে দেওয়াই তো ভালো দাদাভাই চাইলে আমি না হয় ওর পছন্দমতো একটা নাম ঠিক করে দেব
ঠাম্মার সমর্থন পেয়ে আহ্লাদে আটখানা আশু বলল – ঠাম্মা, মনে থাকে যেন, নাম তোমাকেই ঠিক করে দিতে হবে সোজা, সরল, জিভে আটকায় না এমন একখানা ফ্যান্টাবুলাস নাম
ঠাম্মা মিষ্টি হেসে বলল – দেব রে দাদাভাই, দেব। তারপর বাবাকে - লালু, নাম পালটাতে গেলে কী কী যেন করতে হয় তুই বরদা উকিলের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিস
মাতৃ-আজ্ঞা বলে কথা বাবাকে যেতেই হল পাড়ার বরদা উকিলের কাছে তার নাম বরদা ঘোড়ুই। লোকে বলে বরদা ঘোড়েল। তার মাথায় নাকি শুধু প্যাঁচ আর প্যাঁচ। মক্কেলের পকেট থেকে পয়সাগুলোকে নিজের পকেটে নিয়ে আসতে তার প্যাঁচের শেষ নেই
আশুর বাবা তার বৈঠকখানায় ঢুকতে বরদা উকিল বলল – আসুন, আসুন, বসুন লালমোহনবাবু তা, কী মনে করে? প্রথমে একটা কথা বলে রাখি, আমি এখন পারতপক্ষে পাড়ার লোকের কেস নিই না
- কেন?
- হেরে গেলেই বদনাম দেয় আমি নাকি অন্যপক্ষের টাকা খেয়ে কেস হারিয়ে দিয়েছি আরে বাবা, কেসে যদি জেতার মতো মাল না থাকে আমি কি ঘাড়ে ধরে জজসাহেবকে দিয়ে তোমার পক্ষে রায় লিখিয়ে নেব? এমনও বলে আমি নাকি মিথ্যে মিথ্যে টাকা বেশি নিই তাই খুব ধরে না পড়লে পাড়ার লোকের কেস আর নিচ্ছিই না
- বরদাবাবু, আমি কিন্তু আপনার কাছে কোনো মামলা নিয়ে আসিনি একটা ব্যাপারে আপনার পরামর্শ চাইতে এসেছি
- পরামর্শ? বরদা উকিলের মুখ যেন একটু ব্যাজার, আইনের ব্যাপার না হলে আমি আর কী পরামর্শ দেব?
- শুনুন তো আগে আমার ছোটোছেলে বায়না ধরেছে তার নামটা পালটে দিতে হবে কী করতে হয় এজন্য?
বরদা উকিলের মুখের হালকা ব্যাজার ভাবটা কেটে গেল- ও, এই ব্যাপার দেখুন লালমোহনবাবু, মামলা না হলেও বিষয়টা কিন্তু আইনঘটিত। আমরা, মানে উকিলরা, পরামর্শ দেবার জন্য টাকা নিয়ে থাকি, যাকে বলে কনসালটেশন চার্জ তবে আপনার কাছ থেকে সেটা আমি নেব না আপনি অতি সজ্জন, আমার প্রতিবেশী এবার পরামর্শের দিকটায় আসি আমার প্রথম পরামর্শ হচ্ছে, নাম পালটানোর দরকার কী? ওতে কিন্তু বেশ হ্যাপা কোর্টের দিকটা না হয় আমি সামলে দেব আপনাকেও কিন্তু অনেক ঝামেলা পোয়াতে হবেসব জেনেও যদি নাম পালটাতে চান ছেলের নতুন নাম ঠিক করে চলে আসবেন আমার কাছে আর যা যা তথ্য দরকার আপনার কাছ থেকে জেনে শুধু খরচটুকু নিয়ে কাজটা আমি করে দেব এবার আমাকে উঠতে হচ্ছে আজ আবার একটা কঠিন মামলা আছে একটা কথা লালমোহনবাবু, এই যে আপনাকে এতটা উকিলি পরামর্শ দিলাম তার জন্য কি আপনার কাছে টাকা চেয়েছি? চাইনি তো? বলবেন, পাড়ার লোককে বলবেন আমার বদান্যতার কথা
- বলব, নিশ্চয় বলব, বলতে বলতে বাবা পকেট থেকে একখানা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করল, বরদাবাবু, বদান্যতাকে এত লাই দেবেন না আপনার প্রতিভা আর পরিশ্রমের একটা মূল্য আছে না? নিন, ধরুন।
বরদা উকিলের ডান হাতখানা সেকেন্ড পাঁচেক একটু পেছোয় একটু এগোয় করতে করতে নোটখানা নিল - না দিয়ে যখন ছাড়বেন না দিন দরকার হলেই চলে আসবেন, মুশকিল আসান আমি তো আছি
- নিশ্চয় চলি এখন বলে বেরিয়ে এল আশুর বাবা
বিকেলে বাড়ির সবাইকে নিয়ে সে বসল আশুর নতুন নামের আলোচনায় প্রথমে বরদা উকিল যা যা বলেছে সব সে জানাল তারপর বলল - এবার তোমরা বলো কার কী মত।
পুলু তার স্বাভাবিক গম্ভীর ভাবে বলল - গোলাপের নাম যদি ফ্যাকাচু হত তাহলেও সুন্দর গন্ধ আর রংয়ের জন্য ফ্যাকাচু নামটাও লোকের ভালো লাগত আশা করি আমার বক্তব্য তোমরা বুঝতে পেরেছ তার পরেও যদি নাম পালটাতে চাও, যে নাম তোমরা দেবে তাতেই আমার মত আছে আচ্ছা, আমি এখন যাচ্ছি, আমার ট্রিগোনোমেট্রি পড়া শেষ হয়নি
পুলু চলে গেল
মায়ের ভালোলাগা শুধু রান্না করে সবাইকে খাওয়ানোয়। আলোচনা আর-একটু এগোবার পরে মা বলল - আমি যাচ্ছি মাংসের শিঙাড়ার পুরটা আদ্দেক হয়ে আছে।
এরপরে মাকে আর আটকানো যায় না বাবা বেশ খুশি-খুশি ভাবে বলল – হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাও নামটাম আমরা ঠিক করে নেব তা, শিঙাড়াটা কখন আশা করা যায়?
- ঘন্টাখানেক পরে মুচকি হেসে মাও উঠে পড়ল
বাবা ঠাম্মাকে বলল – মা, সব তো শুনলে, তুমি বলো আশুর নাম কি পালটানো হবে?
ঠাম্মা চট করে একবার আশুর দিকে তাকিয়ে বলল - ছোটো ছেলে... চাইছে যখন দে-না পালটে।
- বেশ, বাবা বলল, তাহলে নতুন নামটা ঠিক করতে হয়
আশুর থমথমে মুখটা খুশিতে ঝলমল করে উঠল - ঠাম্মা, তুমি কথা দিয়েছ আমার নতুন নাম তুমি ঠিক করে দেবে বলো কী নাম হবে আমার।
- বলছি, বলে ঠাম্মা চোখ বুজে জপের মালা ঘোরাতে লাগল
খানিক বাদে চোখ মেলে বলল – পেয়েছি। শ্যামসুন্দর পাইয়ে দিলেন দাদাভাই, তোর নতুন নাম হবে নবজলধরঘনশ্যামসম বক্সি। সম-টা না রাখলেও চলে
ঠাম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে হাঁ-মুখ আশু, কথা ফুটতে সময় লাগল – এ যে রেলগাড়ি ঠাম্মা!
- তুই তো সহজ সরল সুন্দর নাম চেয়েছিলি। রেলগাড়ির সঙ্গে তুলনা করছিস? রেলগাড়ি সুন্দর না? আর কী সহজভাবে সোজা লাইন ধরে গড় গড় করে চলে এ নামটাও তেমনি না?
- বড্ড বড়ো যে। আশু অসহায়ভাবে বলে
- বেশ দিচ্ছি ছোটো করে। জলধর বক্সি হোক তোর নাম।
- না ঠাম্মা, এটা কেমন বোকা বোকাআশুর গলার স্বর করুণ।
ঠাম্মা একটু ভেবে বলল - তাহলে ঘনশ্যাম বক্সি-টা নে
- এটা আরও ম্যানতামারা, বিচ্ছিরি। আশু যেন কান্না মিশিয়ে বলে
এতক্ষণ বাবা একটাও কথা বলেনি, এবার সে মুখ খুলল - কী জানিস আশু, বাবার দেওয়া অয়স্কান্ত বক্সি নামটার মধ্যে যে চমক যে ছন্দ সেটা তোর মনেও গেঁথে আছে অন্য নাম পছন্দ হওয়া তোর পক্ষে শক্ত
ঠাম্মা বলল - দ্যাখ দাদাভাই, তোর ঠাকুরদাকে লোকে এমনি এমনি নামদাতা বলত না এমন এমন সব নাম দিতেন যে লোকে অবাক হয়ে যেত এখন ভেবে দ্যাখ কী করবি
আশুকে চুপ করে থাকতে দেখে ঠাম্মাই আবার বলল – শ্যাম বক্সি-টা ভেবে দেখতে পারিস আর আমার মাথায় কিছু আসছে না
- না, এটাও ভালো লাগছে না, ভীষণ মিইয়ে গিয়ে আশু বলল, একদম ন্যাড়া-ন্যাড়া
সবাই চুপ করে থাকে ঠাম্মা মালা জপছে বাবা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে আর আশু নিজে একটা নাম খুঁজতে খুঁজতে হেদিয়ে যাচ্ছে
এমন সময় পুলু এ ঘরে এল তার গম্ভীর মুখের ওপর অল্প অল্প হাসি, বলল - মাংসের শিঙাড়া ভাজা হচ্ছে মা তোমাদের খাবারঘরে ডাকছে ভালো কথা, আশুর নতুন নাম ঠিক হল?
- কই আর হল, বাবা বলল, এখন চলো সবাই খাবারঘরে মাংসের শিঙাড়া ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার মতো অপরাধ আমরা করতে পারি না
সবার সঙ্গে আশুও উঠে দাঁড়াল। - হ্যাঁ, চলো। নাম নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে
আশুর কাঁধে হাত রেখে পুলু বলল – না ভাবলেও চলবে। দ্যাখ আশু, মাংসের শিঙাড়ার নাম যদি ঘুঁটে হত তখন ওই নামটাই তোর ভালো লাগত, আবদার করতিস না মা’র কাছে, আর-একটা ঘুঁটে দাও-না মা? আসল কথা কী জানিস, যে নামই হোক কোনো জিনিসের বা লোকের, গুণ থাকলে সেই নামটাই মানুষের ভালো লাগে
- চল তো দাদা, আর পণ্ডিতি ফলাতে হবে না, শিঙাড়া বোধহয় কড়াই থেকে নেমে গেছে ওসব নামটাম নিয়ে আমি আর ভাবছি না
হো হো করে হেসে উঠল বাবামালা জপতে জপতে ঠাম্মার হাসিটা মুচকি মুচকি।
----------
ছবি – অতনু দেব
ম্যাজিক ল্যাম্প 

গল্প:: দুখু - শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য


দুখু
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য

আমি যেখানে থাকি সে জায়গাটা ভারী ভালো পাহাড়ের ওপর চারদিকে পাথরের স্তূপ, ঝোপঝাড় আর মস্ত বড়ো বড়ো কত রকমের গাছে ভর্তি সেখানে কত যে পাখি, কাঠবেড়ালি আর বাঁদর বাসা বেঁধে আছে বলবার নয় অনেক উঁচু থেকে ঝুরঝুর করে ফুল, পাপড়ি ঝরে পড়ে তলাকার পাথর, ঝোপ আর তার ফাঁকে ফাঁকে লাল রক্তরঙা মাটি ঢাকা পড়ে যায় গন্ধে মাতাল হয়ে থাকে বাতাস ভনভন শব্দে মৌমাছিরা উড়ে বেড়ায়
এখানে আমার আপনার লোক কেউ না থাকলেও মোটেই একা নই আমি আশেপাশে কত চেনাজানা লোকেরা থাকে আমি ছোটো বলে সবাই ভালোবাসে তাই একটুও একা লাগে না আমার
ছোট্ট মেয়ে করুণাকে বোন বলে ডাকি ও আমার চেয়ে দু’মাসের ছোটো। থাকে এই পাহাড়টার চুড়োর ওপর মন্দিরে ওখানে রোজই যাই আমি সবচাইতে উঁচু পাথরটার চূড়ায় বসে কত গল্প করি দু’জনে ও-ও আসে এখানে আমাকে দেখলে নাকি ওর নিজের দাদার কথা মনে পড়ে, তাই আসেওরও এখানে আপনজন কেউ নেই নেই তো নেই, কী করা যাবে? সবার সবকিছু থাকতে হবে নাকি! তাছাড়া এইটুকু বয়েসে আবার অত মন খারাপ কীসের! মুখে ওকে এসব বলি বটে, কিন্তু আমারও তো মায়ের মুখটা মনে পড়ে মাঝে মাঝেই। চুপ করে থাকি কাউকে জানতে দিই না মনে হয় যেন কতদূর থেকে মা চেয়ে আছে আমার দিকে!
করুণা আমাকে দাদা বলে ডাকে বাকিরা বলে ছটু। আসলে তো আমার নাম দুখীরাম, মা বলত দুখু। করুণা ছাড়া কেউ জানে না, ও বলে দুখুদাদা
আজ সকালে আলো ফুটে ওঠার পর করুণা এসে ঝরনার ধারে যাবার আবদার করল বলে এসে বসেছি ঝরনার পাশে পাথরটার ওপর। টুকরো টুকরো রোদ এসে পড়েছে, গায়ে জলের ছিটে লাগলে কী আরাম! দূরে ভাঙা মন্দিরটার ভেতর গণেশ ঠাকুরের পুজো হচ্ছে এখান থেকে পুরুত মশাইয়ের মন্ত্র আর ঘণ্টার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি ধূপের গন্ধ নাকে আসছে চুপচাপ বসে আছি, হঠাৎ হলদে মতো গোল কী একটা জিনিস গড়াতে গড়াতে পাথরটার তলায় ঢুকে যেতে দেখলাম তারপর দুটো ছেলে ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে এসে হাজির। আমাদের দেখতে পেয়ে কাছে এসে দাঁড়ালছেলে দুটোর আমার মতোই বয়েস মিষ্টি গলার আওয়াজ
-      একটা বল এখানে এসে পড়েছে দেখেছিস?
-      হলদে রঙের গোলাটা তো?
-      গোলা আবার কী? হলদে রঙের বল তো।
-      দেখলাম ঐখানে বড়ো পাথরটার তলায় ঢুকেছে
ছেলেদুটো খুঁজে না পেয়ে আবার ফিরে এল
-      পাচ্ছি না, তুই একটু খুঁজে দিবি?
আমি দিব্যি দেখতে পাচ্ছি গোলাটাকে। চার-পাঁচ হাত গভীর পাথরের খাঁজে আটকে আছে ওদের আড়াল করে তুলে দিলাম গোলাটাকে। আমি যে জাদু জানি ওদের জানাতে চাইনি বলে আড়াল করতে হলদেখতে পেলে চমকে ভয় পেয়ে পালাত। পালালে ভালো লাগত না আমার বেশ ভালো লেগে গেছে ওদেরকরুণাও খুব খুশি ওদের দেখে
ওরা চলে যাবার পর মনে মনে বলতে লাগলাম, আমাদের ডাক তোরা তোদের সঙ্গে খেলতে খেলতে ডাক, খেলতে ডাক! কী অদ্ভুত জাদু আমাদের, যা চাই তাই হয়ে যায় মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই নিজেরাইছেলেদুটো আবার ফিরে এসে দাঁড়িয়েছে
-      খেলতে যাবি আমাদের সঙ্গে?
মাথা নেড়ে চললাম দু’জনেই পাথরের ঢালু সিঁড়িটা দিয়ে খানিকটা নেমে যেতেই দেখি ছোটো মাঠটাতে বসে আছে ওরা ছোটো-বড়ো মিলিয়ে দশ-বারোজন ছ-সাত বছরের ছেলেদুটোর মতো আরও দুটো মেয়ে, একটা আরও ছোটো ছেলে বাকিরা বড়ো। কী ভালো যে লাগল দেখে! বোধ হয় বনভোজন করতে এসেছে আরও অনেকটা নিচে পাহাড়ের গোড়ায় একটা গাড়িও দেখলাম, বোধহয় ওদেরই গাড়ি।
আমি তো ধুতি পরি, করুণা শাড়ি ওরা কেমন অবাক চোখে দেখল আমাদের, তারপর হাত নেড়ে কাছে ডাকল আমার মায়ের বয়সি একজন কাছে গিয়ে দাঁড়াবার পর হাসলেন
-      কোথায় থাকিস রে তোরা?
আঙুল বাড়িয়ে পাহাড়ের ওপরটা দেখালাম
-      শীত করে না? খালি গায়ে, আবার ধুতি পরেছে দেখো!
করুণাকে কাছে টেনে নিয়ে একগাল হাসি
-      তোকে শাড়ি পরিয়ে দিল কে রে, মিষ্টি মেয়ে? নাম কী তোর?
কতদিন কেউ আদর করেনি ওকে করুণা মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমিই জবাব দিলাম
-      ওর নাম করুণা আর আমার নাম দুখীরাম ও পাহাড়ের চূড়ার কাছে থাকে
শুনে একটু মিষ্টি হেসে গাল টিপে দিলেন আমার করুণাকে কোলে বসিয়ে কী আদর!
-      যাবার সময় খেয়ে যাবি আমাদের সঙ্গে খেল গে যা এখন


খুব খেলা হল একটা লম্বা কাঠের টুকরোকে ওরা বলছিল ব্যাট আর সেই হলদে গোলাকে বলে বলএই দিয়ে খেলা ব্যাট দিয়ে গোলাটাকে দূরে পাঠিয়ে ছুট। ভারি মজা! আমার হাতে গোলাটা দিয়ে ছুড়তে বলায় হল এক কাণ্ড! গোলা এত জোরে ছুড়েছি ওরা দেখতেই পায়নি! তারপর থেকে আস্তে আস্তে ছুড়তে লাগলাম, খেলা জমে গেল আমার পালা এলে ব্যাট নিয়ে দাঁড়ালাম গোলা ছুড়তেই দুম করে মেরেছি আর বল চলে গেছে পাহাড় পেরিয়ে মনে মনে বলটাকে ডাকতেই আবার ফিরে এসেছে ওদের হাতে এত অবাক বোধহয় ওরা আগে হয়নি! তারপর অবশ্য ভুলেও গেল অবাক হওয়াটা। ছোটোদের আবার অত মনে থাকে নাকি!
খাওয়ার সময় হঠাৎ আমার চোখ গেল পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মস্ত বড়ো বটগাছটার দিকে তার একদম মগডালে পা ঝুলিয়ে বসে ওদের দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে চেয়ে আছে বনের মধ্যে বাস করা ছায়া ছায়া ক’জন। ওরা মোটেই ভালো নয় মানুষকে ভয় দেখানো আর ক্ষতি করাই কাজ ওদের আমরা দু’জন ছাড়া আর কেউ বোধহয় দেখতেই পাবে না ওদের আমাকে আর করুণাকে এদের মধ্যে বসে থাকতে দেখে কী দাঁত বার করে হাসি! খুব রাগ হয়ে গেল আমার ওরা বেঁচে থাকতেও ভালো মানুষ ছিল না, এখন আর ভালো হবে কী করে? দীনুদাদার নজরে পড়লে বেশ হয়। মজা করা বার করে দেবে! দীনুদাদা বুড়ো হলেও গায়ের জোরে ওর ধারেকাছে আর কেউ নেই ও থাকে পাহাড়ের সবচাইতে বুড়ো বেলগাছটার মাথায়আমাদের খুব ভালোবাসে ও এখন গেছে ওপরের বড়ো মন্দিরের মায়ের কাছে মায়ের সন্ধিপুজো হয়ে যাবার পর এখানে আসবে আমাদের গল্প শোনাতে
এরা এবার চলে যাবে মনে হচ্ছে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বাসন সতরঞ্চি গোটানো চলছে এতক্ষণ এরা এই পাহাড় মন্দির এসব নিয়ে কত কথা বলছিল এখানে কোন তান্ত্রিক নাকি সিদ্ধযোগী তাঁর কাছে মায়ের নামে পুজো দিতে আসবে কাল। কান পেতে ছিলাম, তান্ত্রিকের নাম শুনে চমকে উঠলাম মনটা খারাপ হয়ে গেল রাঘব তন্ত্রাচার্য মোটেই ভালো লোক নয় ডাকাতের মতো মস্ত চেহারা সিদ্ধযোগী না ছাই, ও একটা জন্তু! কত মানুষকে মেরে ফেলেছে ও! এখন লোক ঠকিয়ে বেড়ায় কপালে তেল সিঁদুরের ফোঁটা আর মাথায় নকল জটা চাপিয়ে গায়ে ছাই মেখে অং বং চং কত লোকদেখানো ভড়ং। অথচ মা ওকে দেখতে পারে না! বটগাছের ওপরে থাকা নোংরা ভূতগুলো ওর সঙ্গে সঙ্গে থাকে সব সময় মা তো সবার তার পুজো মনে মনে করলেই হয় আবার তান্ত্রিকের কাছে যাবার দরকার কী?
চলে যাবার আগে আমাদের কাছে ডেকে মায়ের মতো মহিলাটি আবার আদর করে কালকে আবার আসতে বলে গেলেন আমরা মাথা নেড়ে বললাম আসব মনে মনে বললাম, আসতেই হবে। নইলে ঠকে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারব না তোমাদের তান্ত্রিকটাকে তাড়াতেও হবে তো দীনুদাদা ঠিক কিছু একটা করবে, আমরা তো আছিই।

পাহাড় চূড়ার মন্দিরের পাশে খাদের ওপর ঝুলে থাকা মস্ত অশ্বত্থ গাছটার গোড়ায় বসে আছি করুণা আছে মন্দিরে সন্ধের আরতির সময় ওকে ওখানে বসে থাকতে হয় যারা পুজো করে তারা ওকে দেখতে পায় না বলে বুঝতেই পারে না আরতি করছে ওরা করুণাকেই ভারি মজা! অনেক নিচের শহরটা অন্ধকারে বিন্দু বিন্দু আলোয় সাজানো মাথার ওপর আকাশটাও কালো অন্ধকারের ওপর বিন্দু বিন্দু তারার আলো আর গ্রহ নিয়ে চমৎকার দেখাচ্ছে নদীর উপর দু-একটা নৌকোতেও টিমটিম করে বাতি জ্বলছে অনেক দূরে নদীর মাঝে দ্বীপের ওপর ভৈরব মন্দিরে আরতি হচ্ছে ঘণ্টা বাজছে শুনতে পাচ্ছি ঢং ঢং। দীনুদাদা কালো আকাশে আবছা আলোর রেখা টেনে মায়ের মন্দিরে যাবার সময় হাত নেড়ে বসতে বলে গেল কিছুক্ষণ বাদে করুণা এসে বসল পাশে মন্দিরে আরতি সেরে পুরুত মশাই চলে গেছেন বাড়ি ধারে কাছে আর কেউ নেই
বসে আছি চুপচাপ হু হু হাওয়া দিচ্ছে, অশ্বত্থ গাছের পাতা কাঁপছে ঝিরঝির করে এই সময়ে আমার মনটা বড়ো খারাপ হয়ে যায় আগামীকাল অমাবস্যা আবার মনে পড়ছে কতকাল আগে ফেলে আসা মায়ের কথা। অমাবস্যায় আরও বেশি করে মনে পড়ে খড়ের চালে ঢাকা মাটির বাড়ি, ভালোমানুষ বাবা আর আমার মায়ের কথা করুণাও ওর ছোট্ট হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছছে ও মুখে কিছু না বললেও ওরও মনে সেই ওর নিজের মায়ের কথা হাজার বছর আগে আমার মতো ওকেও তো কেড়ে এনেছিল কাপালিকের লোকজন ওর মায়ের কোল থেকে তারপর কী ভীষণ যন্ত্রণা! এতদিন পরেও ভুলতে পারিনি হাঁড়িকাঠে বাঁধার আগে অবধি বুঝতেই পারিনি ওরা আমাকে নিয়ে কী করতে চায় হাঁড়িকাঠে বেঁধে যখন শান দেওয়া খড়্গটা হাতে নিল তখন বুঝলাম! সেদিনটাও তো ছিল অমাবস্যা! সেই থেকে তান্ত্রিক কাপালিকদের ওপর রাগ আমাদের!
ধুপ করে শব্দ হল মায়ের মন্দিরের চুড়ো থেকে উড়ে এসে পাশে বসেছে দীনুদাদা

পরদিন যা হল বলি এবার দীনুদাদা যেমন যেমন ঠিক করেছে সবাই সেভাবে তৈরি হয়ে আছে আমি আর করুণা ছোটো বলে শুধু রাঘব বাবাজির আখড়ার পাশে বসে মজা দেখব অদৃশ্য হয়ে থাকব বলে কেউ দেখতে পাবে না আমাদের সকাল থেকেই তাই বসেছিলাম ওখানে পাঁচটা মুণ্ডু ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে ওকে বলে পঞ্চমুণ্ডির আসন বাবাজি তার পাশে বাঘের চামড়ার আসনে বসেছে টানটান করে কপালে তেলসিঁদুরের লম্বা ফোঁটা কেটে গাঁজার ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার বাবাজির সঙ্গে আরও দু’জন লোক বসে আছে তাদেরও গুন্ডার মতো দেখতে মাথায় নকল জটা, দাড়ি গোঁফ, কপালে লাল সিঁদুরের টিপ। দেখলে ভয় হয়
সারাদিন পরে বিকেলের দিকে কালকের বনভোজনের দলটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে দেখা গেলমেয়েরা কেউ নেই সঙ্গে, ছোটোরাও আসেনি ভালোই হল, ওরা ভয় পেয়ে যেত মায়ের মতো দেখতে মানুষটিও আসেননি
ধুনি জ্বেলে যজ্ঞের কাঠ সাজাতে সাজাতে সন্ধে হয়ে গেল অমাবস্যার অন্ধকারে থম থম করছে বনকোথাও কোনো শব্দ নেই সবকিছু যেন কোনো কিছুর জন্য চুপচাপ অপেক্ষায় আছে কাঠগুলো ধরে উঠেছে। খড়ের আগুন ঘিরে বসেছে সবাই হাতায় করে আগুনে ঘি ঢালতে ঢালতে গম্ভীর গলায় মন্ত্র পড়া চলছেঅন্ধকারে একটা তক্ষকের ডাক শোনা গেল ঐ ডাক শুনলে বুক কেঁপে ওঠে
লকলকে আগুনের আলো কাঁপছে বাইরের বড়ো গাছগুলোর গায়ে এমন সময় হঠাৎ একটা জোরালো বাতাস এসে আখড়ার মাথার চালাটা উড়িয়ে নিয়ে গেল তান্ত্রিক মশাইয়ের মাথা থেকে নকল জটাটাও খসে পড়ল যজ্ঞের আগুনে যজ্ঞের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠে আকাশ ছুঁতে চাইছে কারা যেন ভয়ঙ্করভাবে পাহাড় কাঁপিয়ে হেসে উঠল আগুনটা আরও বেড়ে গেছে আগুন তো নয়, যেন অজস্র আগুনরঙা হাত লকলক করে তান্ত্রিককে ছুঁতে চাইছে চার দেয়ালের ওপর দিয়ে কতগুলো ভয়ঙ্কর মুখ উঁকি দিয়ে চেয়ে আছে ওর দিকে তাদের বড়ো বড়ো দাঁত আর রাগি চোখ দেখলে ভয় হয় পচা মাংসের গন্ধে বাতাস ভার হয়ে এল এবার মস্ত বড়ো শরীর নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে দীনুদাদা।
ভয় পেয়ে রাঘবের সঙ্গী দু’জন কখন পালিয়েছে কে জানে! যাঁরা পুজো দিতে এসেছিলেন তাঁরাও দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পালিয়েছেন তান্ত্রিক এখন একা এবার পঞ্চমুণ্ডির আসনের মাথাগুলো লাফিয়ে উঠতেই ভীষণ ভয় পেয়ে লোকটা আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠে ঝোপঝাড় ভেঙে ছুট লাগাল পাঁচটা কঙ্কাল ছুটেছে ওকে তাড়া করে ওদের চিৎকার কাঁপিয়ে দিচ্ছে পাহাড়-জঙ্গল - আর আসবি এখানে? আর যেন না দেখি তোকে! এবারকার মতো করুণামায়ের দয়ায় বেঁচে গেলি!
আবার বন পাহাড় অমাবস্যার আঁধারে চুপচাপ হয়ে গেছে কুঁড়েঘর, পঞ্চমুণ্ডির আসনের কোনো চিহ্ন নেই! আগুন নিভে গেছে কখন এতক্ষণে শান্তি আমরা ফিরে চললাম যে যার জায়গায় খারাপ লোকটাকে আর কখনও বোধহয় এখানে আসতে দেখা যাবে না!
----------
ছবি - লেখক
ম্যাজিক ল্যাম্প