ম্যাজিক আড্ডায় অনিলিখা
ম্যাজিক ল্যাম্পের মুখোমুখি অভিজ্ঞান
রায়চৌধুরী সৃষ্ট জনপ্রিয়, বিখ্যাত
চরিত্র অনিলিখা
সাক্ষাৎকার: দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
১। অনিলিখা, তুমি তো এত দেশ ঘুরে বেরিয়েছ। সব থেকে
প্রিয় দেশ কোনটি এবং কেন?
অবশ্যই ভারত। শুধু জন্মভূমি বলে নয়, এ ভূখণ্ড বিভিন্ন
মানুষের মিলনভূমি। এখানে যেভাবে সহজে সব ধরনের মানুষের
সঙ্গে মেশা যায়, সবাইকে খুব সহজে আপনার করে নেওয়া যায়, সেটা অন্য কোনো দেশে হয় বলে
আমার মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছেন ভারত সম্বন্ধে।
‘কেহ নাহি
জানে কার আহ্বানে
কত মানুষের
ধারা
দুর্বার
স্রোতে এল কোথা হতে
সমুদ্রে হল
হারা।’
একই সঙ্গে যেভাবে এখানে পাশাপাশি
অতীত ও বর্তমান দুটোরই দেখা মেলে, যেভাবে হাজার হাজার বছর আগের মুনিঋষিদের
প্রজ্ঞা, ও আগামী দিনের বিজ্ঞান প্রযুক্তি সাহিত্য চিন্তাভাবনা এখানে মিশে যায়,
সেটাও খুব ভালো লাগে। এজন্য আমাদের অজান্তে অনেক আচার ব্যবহারে বা নিয়মিত খাবারে
মিশে আছে এই হাজার হাজার বছরের উপলব্ধ জ্ঞান, যার সন্ধান আগামী দিনে বিজ্ঞান পাবে।
ভারতের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত গেলে তার মধ্যেই এত বৈচিত্র্য যেন মনে হয়
সারা বিশ্বকে দেখতে পাওয়া যায়। ওই যে ‘উলূপী’ বা ‘পুতুল খেলার আড়ালে’-র মতো গল্পে
যে সব উপজাতির কথা লিখেছি, তাদের মতো কত ভিন্ন ভিন্ন জাতি উপজাতি মিশে আছে এই
ভারতে।
অন্যদিকে দেখ আমেরিকা,
ইংল্যান্ড, ইউরোপ এখন ‘ইনক্লুসিভিটি’, ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ এসব নিয়ে খুব হইচই শুরু
করেছে। ভারতকে দেখে তাদের শেখা উচিত কীভাবে আমরা সে কাজ
এত সহজে হাজার হাজার বছর ধরে করে চলেছি।
প্রকৃতি সব কিছু ভারতকে এত
দরাজ হাতে দিয়েছে, যে সেটাও আমাকে অবাক করে। যখন নরওয়ে, সুইডেনের মতো দেশে থেকেছি
তখন বুঝতে পেরেছি, আমরা কত ভাগ্যবান। এখানে প্রকৃতি যেন সবসময় আমাদের আগলে রেখেছে।
একটু হেসে একটু থেমে অনিলিখা
ফের বলে ওঠে –
এসব হল অবশ্য ভারী ভারী কথা।
শনিবারের আসর কী আর কোথাও আছে? সবার আড়ালে, সব ক্যামেরার বাইরে থেকে মিস্টার পাই-এর
মতো বিজ্ঞানী যেভাবে কাজ করে, সেরকম আর কোথাও হয় কি! অন্য কোনো দেশে রবীন্দ্রনাথ,
বিদ্যাসাগর-এর মতো মানুষ কখনও জন্মেছেন!
২। নিজের দেশের
প্রতি গভীর ভালোবাসার সূত্রপাত কীভাবে হল?
ছোটোবেলা থেকেই বিভিন্ন দেশে যেতে হয়েছে বাবার
সঙ্গে। কিন্তু যেখানেই থাকি না কেন, বাবার সঙ্গে কথা বললেই মনে হত যেন বাবার রক্তের
প্রত্যেকটা কোষে কেউ ভারতের প্রতি গভীর ভালোবাসা মিশিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া আমরা সবসময়
বাড়িতে বাংলায় কথা বলতাম, বাংলা বই পড়তাম। সেজন্যে বিদেশে অনেক সময় কাটলেও মনে হত সবসময়
যেন ভারতেই ছিলাম। সবসময় আমাকে ঘিরে ছিল ভারতের মাটি, বাতাস, আকাশ, ভারতের কথা,
বাংলার কথা।
একই সঙ্গে আমার দাদু ছিলেন
বাংলার শিক্ষক। ভারতে যখন থাকতাম তখন তাঁর কাছ থেকে দেশভাগের গল্প শুনতাম, সেই ১৯৪৮
সাল নাগাদ ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসার গল্প শুনতাম। আমার ঠাকুরদা স্বাধীনতা পূর্ব যুগে এক বিপ্লবী দলে যুক্ত ছিলেন। জেলেও
ছিলেন দু’বছর। আমার দিদার মুখে শুনতাম বিদ্যাসাগর, সুভাষ চন্দ্র বোস, মাস্টারদা
সূর্য সেনের গল্প। এরকম মানুষদের গল্প শুনলে কী আর দেশকে দূরে রাখা যায়। এভাবেই
হয়তো এই গভীর ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল। তবে একই সঙ্গে দেশকে মন দিয়ে ভালোবেসেছি, সে
দেশের সার্থক প্রতিনিধি হওয়ার কথা ভেবেছি বলেই হয়তো কখনও আমার দেশের প্রতি এই
ভালোবাসা অন্য কোনো দেশের মানুষকে ছোটো করতে শেখায়নি, বা অহেতুক তাদের সঙ্গে
দূরত্ব গড়তে দেয়নি।
৩। অনিলিখা তোমার
গল্প তো আমরা সবাই পড়েছি, তোমার কী ধরনের বই প্রিয়?
আমি নানা ধরনের বই পড়ি। কখনও বিজ্ঞান বা
প্রযুক্তির, কখনও ইতিহাস, কখনও বিভিন্ন লেখকের গল্পের বই, কখনও অর্থনীতি, কখনও বা কমিকস। দেশ
বিদেশের বিভিন্ন সময়ের। তবে সব থেকে প্রিয় কিশোরদের জন্য লেখা গল্প, কারণ তাতে
অভিনবত্ব, কল্পনা সবথেকে বেশি থাকে।
৪। কোনো বিপদে পড়লে
সব থেকে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে কাকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে?
মিস্টার পাই। উনি এক আশ্চর্য মানুষ। দেশ বিদেশে
অনেক বন্ধু আমার ছড়িয়ে আছে, সেজন্যে কী ধরনের বিপদ তার উপরেও অনেকটা নির্ভর করবে। তবে
বিপদের সময়ে নিজের বুদ্ধি বিবেচনার উপরেই সব থেকে বেশি ভরসা করতে হয়।
৫। এতগুলো উপন্যাসে
অনেকের সঙ্গেই তুমি বিদেশে ঘুরেছ। সব থেকে
উপভোগ্য কোন মানুষটির সঙ্গ?
শনিবারের আসরে যারা থাকে সেই প্রতীক, বিশ্বজিৎ, সাগ্নিক,
সহেলী - সবাই আমার খুব প্রিয়। মিস্টার পাইও আমার খুব প্রিয় মানুষ। তবে সবার আগে
অবশ্যই আমার মা। মায়ের সঙ্গে থাকা প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমি খুব উপভোগ করি।
বেড়াতে গেলে সঙ্গে অনর্থবাবুর
মতো মানুষ থাকলে সে বেড়ানোর আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায়। কীভাবে জানি ঠিক একের পর এক
অঘটন বাধিয়ে বসেন। সেবারে চিকলেট খেয়ে অন্যমনস্ক হয়ে ডাস্টবিন ভেবে লন্ডনের বিশেষ
একটা পোস্টবক্সে ফেলে যেভাবে ‘এম আই সিক্স’-এর অনুসন্ধানের কেন্দ্রীয় আকর্ষণ হয়ে
গিয়েছিলেন, সেটা আমি পরে জেনেছিলাম। এরকম ঘটনা উনি আকছার ঘটিয়ে থাকেন। এখন উনি ফেসবুকে
আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছেন। ওনার বিদঘুটে অর্থহীন কবিতাগুলোয় কীভাবে হাজার হাজার
লাইক পড়ে যায়, সেটা আমি আদৌ বুঝতে পারি না। সেটা ওনাকে বলতে উনিও বললেন - কবি
নিজেই যখন সে কবিতার অর্থ বোঝে না, তখন
সেটাই সেরা কবিতা হয়। আমি এখন সেজন্যে লেখার পরে শুধু শব্দগুলো এদিক ওদিক করে দিই।
তাতে নাকি তিন গুণ লাইক হয়।
৬। তোমাকে কেউ উপহার
দিতে চাইলে কী উপহার পেতে সব থেকে বেশি পছন্দ করবে?
বই। অবশ্যই বই।
৭। একা একটা দ্বীপে
গেলে প্রিয় কোন তিনটে জিনিস সঙ্গে নিয়ে যাবে?
বই, কলম আর কিছু সাদা পাতা। আশা করি জল ও কিছু
খাবার সেখানে পেয়েই যাব।
৮। তুমি যে শরীরে
ও মনে এত ফিট এর রহস্য কী?
আমি খুব পজিটিভ চিন্তায় বিশ্বাস করি। মনে করি সব
কিছুরই শেষে ভালো হবে। যত বড়ো সমস্যাই আসুক না কেন, ঠিক তার সমাধান সম্ভব। সবসময়
নতুন নতুন কিছু করতে ও জানতে চেষ্টা করি। সেজন্য এতটাই ব্যস্ত থাকি যে কখনও খারাপ কোনো
চিন্তার সময় পাই না।
আর শরীর? আমি বসে থাকতে একদম
ভালোবাসি না। পারলেই কিছু না কিছু করি। যোগ ব্যায়াম, সাঁতার - এর অভ্যেস ছোটোবেলা
থেকেই ছিল। পরে তাইকোয়ান্ডো শিখেছিলাম। এখনও নানা ধরনের খেলাধুলোর মধ্যে থাকি।
কলকাতার বাইরে অনেক সময় কাটিয়েছি বলে হয়তো এসবের সুযোগও যথেষ্ট পেয়েছিলাম ছোটোবেলার
থেকে। কোনোদিন শরীরচর্চা না করে থাকতেই পারি না। এভাবেই হয়তো ফিট থাকি।
৯। মিঃ পাই-এর সঙ্গে
প্রথম আলাপ নিয়ে কিছু বলো। ওঁকে
মানুষ হিসেবে কীরকম মনে হয় তোমার?
সে নিয়ে তো আমি আগেই লিখেছিলাম। একবার
কলেজস্ট্রীটে পুরোনো বই-এর খোঁজ করতে গিয়ে একটা বই হাতে আসে। এই
পৃথিবী একশো বছর পরে। বইটা প্রায় কুড়ি বছর আগে লেখা। পড়তে গিয়ে চমকে উঠি। লেখক
মিস্টার পাই। বিজ্ঞানপ্রযুক্তির অনেক সম্ভাবনা, কল্পনার কথা লিখেছেন, যা কুড়ি বছর
আগে ভাবা প্রায় অসম্ভব ছিল। বর্তমানে দাঁড়িয়ে অনেক ভবিষ্যৎবাণী মিলে গেছে। তখনই
অবাক হয়ে সে বই-এর প্রকাশকের কাছে গিয়ে লেখকের খোঁজ করি। জানতে
পারি যে সে বই প্রায় বিক্রি হয়নি। সেখানে
থেকেই লেখক মিস্টার পাই-এর ঠিকানা পাই। তারপরে একদিন সেই ঠিকানায় হানা দিয়ে
মিস্টার পাই-এর দেখা পাই। প্রথম আলাপেই বুঝি যে এক অসামান্য মানুষ। একদম প্রথম
সারির বিজ্ঞানী। তবে সম্পূর্ণ নিজের খেয়ালখুশি মতো গবেষণা করেন। নানান বিষয়ে
আগ্রহ। এখানেই উনি সবার থেকে আলাদা। এখনকার দিনে বিভিন্ন বিষয় জানে এরকম বিজ্ঞানী
প্রায় নেই। একদম স্বাধীনভাবে সব প্রচারের থেকে
দূরে থেকে কাজ করতে ভালোবাসেন। খুব খোলামেলা
সহজ সরল মানুষ। একই সঙ্গে বাংলা কিশোর সাহিত্যের
অত্যন্ত মনোযোগী পাঠক। এখানে এটা বিশেষ করে বললাম কারণ যারা কিশোর সাহিত্যের
নিয়মিত পাঠক, তাদের মন চিরনবীন হয়।
১০। তোমার গল্প উপন্যাসে
তুমি তো অনেকরকম শত্রুর সম্মুখীন হয়েছ। সব থেকে
সাংঘাতিক ভিলেন বা দুর্ধর্ষ দুশমন কাকে মনে হয়েছে?
মিস্টার গিল। আসলে খুব প্রতিভাবান বিজ্ঞানীরা যদি
তাদের বুদ্ধি খারাপ কাজে ব্যবহার করতে চায়, তাহলে তাদের ক্ষতি করার ক্ষমতা অনেক
বেশি হয়। ‘সংকেত রহস্য’, ‘রহস্য যখন সংকেতে’ – দু’বারেই সেটাই দেখেছি। কে বলতে
পারে, আবার সামনে কী বিপদ আছে। সেই যে নিখোঁজ হলেন, আর কোনো খোঁজ পাইনি। হয়তো
আগামীদিনে আবার দেখা হতে পারে।
১১। অনিলিখার পছন্দের
গান ও প্রিয় কবিতা কোনটা?
সবার আগে রবীন্দ্রসঙ্গীত। প্রত্যেকটা গানের কথাই
আমাকে খুব ভাবায়। সুর ও কথার রেশ সঙ্গে থেকে যায়। তাছাড়া আমি গজলও খুব পছন্দ করি।
পছন্দ করি ক্লাসিকাল গান। কবিতার মধ্যে ছন্দ আমার খুব ভালো লাগে। সেজন্য ছড়া পড়তে
আমার খুব ভালো লাগে। এছাড়া ভালো লাগে অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ। তবে এখনও
সুকুমার রায়ের ছড়া পেলে পড়তে বসে যাই।
কোনো একটা কবিতা প্রিয় বলা
খুব শক্ত। তবে এখনও যখন ওই ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটা শুনি, আমার দারুণ লাগে। ছোটোবেলায় যখন মা’র মুখে শুনতাম বারবার মনে হত, সত্যি যেন
সেরকম কোনো যুদ্ধ করে দস্যুদের হাত থেকে সবাইকে বাঁচিয়েছি। মা’র কাছে ফিরে এসে
বলছি - ‘আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে, বলছি এসে লড়াই গেছে থেমে।’ এখানে একটা কথা বলি।
আমার খুব জটিল ছন্দহীন কবিতা ভালো লাগে না। কবিতা এমন হবে যার শব্দগুলো হৃদয় দিয়ে
অনুভব করা যাবে।
১২। নিজেকে ঠিক কেমন
মানুষ হিসেবে বর্ণনা করবে তুমি?
সেটা অন্যদের মুখেই শোনা ভালো। তবে আমি হৃদয়কে
বুদ্ধির থেকে বেশি প্রশ্রয় দিই। আমি অন্যায় করি না। অন্যায় সহ্যও করতে পারি না, সে
প্রতিপক্ষ যতই শক্তিশালী হোক না কেন। দুর্বলের পাশে থাকতে ভালোবাসি। বাচ্চাদের
সঙ্গে সময় কাটাতে খুব ভালোবাসি। পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ-এর উপরে জোর দিই। সব সময় পজিটিভ
চিন্তা করি। কখনোই সহজে কিছু মাঝপথে ছেড়ে দিই না।
১৩। বুদ্ধি না আবেগ
– কোনো কঠিন কাজে কোনটা প্রাধান্য পাবে?
প্রাথমিকভাবে হয়তো আবেগ। তবে সে আবেগ কাটিয়ে পরক্ষণেই
যে কর্মপদ্ধতি ঠিক করি, সেটা অবশ্যই বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে।
১৪। তোমার প্রিয়
মহাপুরুষ বা মনীষী কে বা কারা?
বিদ্যাসাগর। ওরকম মানুষ সারা বিশ্বে খুব কমই
হয়েছে। কোন ক্ষেত্রে কাজ করেননি! সেরকম একটা সময়ে সবার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিধবা
বিবাহ, নারী শিক্ষা প্রসারের মতো বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেছেন, ভাবাই যায় না। একই
সঙ্গে আধুনিক বাংলা ভাষা তো ওঁর হাতেই শুরু বলা যায়। ওঁর কাছ থেকেই আমি সব সময়
নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে শিখেছি।
১৫। তোমার ছোটোবেলা
কোথায় এবং কীভাবে কেটেছে?
বেশিরভাগ সময়ে ভারতে থাকলেও মাঝে মধ্যে আমেরিকা ও
ইউরোপের কিছু দেশে যেতে হয়েছিল। সে জন্য আমি
এগারোটা ভাষা খুব ভালো করে জানি যার মধ্যে স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, সুইডিশও
পড়ে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন স্কুলে পড়ার
জন্যে সবার সঙ্গে খুব সহজে মিশতে শিখেছিলাম। পড়াশোনায় বরাবরই
ভালো ছিলাম, কিন্তু পড়ার বই-এর থেকে অন্য সব বই বেশি পড়তাম। অনেক খেলাধুলো করতাম। পরে
যখন দেশে ও বিদেশে নামী ইউনিভারসিটিতে পড়লাম, তখন মনে হল সে সব ইউনিভারসিটিতে যা
যা ডিগ্রি পেয়েছি, সবই লোক দেখানো। আসলে সে সব কিছুই কাজে লাগে না। উলটে অরিজিনাল
চিন্তাভাবনার ক্ষমতা খানিকটা নষ্ট করে দেয়।
ছোটোবেলা থেকেই মা’র সঙ্গে
সঙ্গে আমিও রান্না করতাম। ঘরের অনেক কাজ করতাম। কলকাতায় থাকার
সময়ে জয়েন্ট ফ্যামিলিতে বড়ো হয়েছি। সে জন্য কখনোই শুধু নিজের কথা ভাবতে শিখিনি। সবার
সঙ্গে সব কিছু ভাগ করে নিতে শিখেছি।
১৬। যে আড্ডার আসরে
তুমি প্রায়ই যাও তার সূত্রপাত কীভাবে হল?
সে বহু বছর আগের কথা। আসলে আমরা থাকি উত্তর
কলকাতার এক পুরোনো পাড়ায়। সেখানে পাড়ার মধ্যে কিছুটা হলেও সবাই সবাইকে চেনে। প্রথমে
আমার এক বন্ধুর মাধ্যমেই শুনি যে এরকম একটা আড্ডা হয় প্রতি শনিবারে। যেতে শুরু
করি। প্রথমদিকে আড্ডাটা হত একটু বেশি বয়সিদের মধ্যে সাহিত্য নিয়ে। সময়ের সঙ্গে
সঙ্গে নানান বিষয় নিয়ে আড্ডা আলোচনা শুরু হয়। আস্তে আস্তে সে আড্ডায় যোগ দেওয়ার পর
থেকে দেখি, যারা আসছে, তাদের বয়সও যেন কমছে। এখন সব কমবয়সিদের দল।
১৭। তোমার মায়ের
কথা কয়েকবার গল্প উপন্যাসে উল্লেখ থাকলেও বাবার কথা নেই। ওঁর
কথা কিছু বলো।
আমার বাবা ছিলেন আর্মিতে। মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স
অফিসার হিসেবে কাজ করতেন। সে জন্যেই বিভিন্ন দেশে ছোটোবেলা থেকে ঘুরতে হয়েছে। আমি
যখন ক্লাস নাইনে, তখন বাবা মারা যান। দেশের কাজেই। বাবার কথা কিছু বন্ধ ফাইলেই
থাকুক। বাবার কাছেই শিখেছি, সবার আগে দেশ। সেজন্য আমি চাই না তার আত্মত্যাগ সামনে
এসে দেশের জন্য কোনো সমস্যার সৃষ্টি হোক। সে জন্য বাবার কথা সামনে আনি না।
১৮। বিশ্বজিৎদা তোমাকে
খুব বাঁকা মন্তব্য করে অথচ তুমি মাথা গরম কর না। কখনও
কি সত্যিই রাগ হয় না?
না, না, এই মন্তব্য ও আসলে মজার জন্যেই করে। তা
ছাড়া পাঁচফোড়ন ছাড়া কী ভালো রান্না হয়।
১৯। তোমার মতে মানুষের
তিনটি প্রধান গুণ কী হতে পারে?
আদর্শ-মূল্যবোধ, আত্মবিশ্বাস, কোনো অন্যায়কে সহ্য
না করে দুর্বলের পাশে থাকা।
২০। দেশে বা রাজ্যে
কীভাবে সুশাসন আনা যায়? তোমার কী মনে হয়?
শিক্ষা। মানুষকে প্রকৃত শিক্ষা দিতে পারলেই সব সমস্যার
সমাধান হয়ে যাবে। বহু বছর আগেই চাণক্য এ ব্যাপারে যা যা
বলে গেছেন, তা এখনও একইভাবে প্রযোজ্য। তার মধ্যে
একটা প্রধান শর্ত হল মুক্ত সমাজে সবার জন্য সমান সুযোগ।
২১। তোমার প্রাণের
থেকেও দামি তোমার কাছে কী?
সামনের কোনো অসহায় মানুষ যাকে আমি সাহায্য করতে
পারি।
২২। বর্তমানের এই
কোভিড পরিস্থিতি আমাদের কী কী শেখাল বলে তোমার মনে হয়?
উন্নততম সভ্যতাও কত সহজে থমকে যেতে পারে। একই সঙ্গে
মানুষ চাইলে সব থেকে বড়ো বিপদেরও মোকাবিলা করতে পারে। সবার উপরে বিজ্ঞানের উপরে
ভরসা রাখতেই হবে। একই সঙ্গে সব দেশ সব জাতি মিলে কাজ না করলে, কিছু সমস্যার কখনোই
সমাধান সম্ভব হবে না।
২৩। আজ থেকে একশো
বছর পরে তোমাকে মানুষ কীসের জন্য মনে রাখবে বলে তুমি মনে করো?
তখন হয়তো আরও বেশি করে বুঝতে পারবে আমার এই রহস্য
কাহিনিগুলো। বুঝতে পারবে কতবার আমি বড়ো রকমের
বিপদ থেকে সবাইকে বাঁচিয়েছি। সবার শেষে বলবে অনিলিখা কখনও শেষ লক্ষ্যে না পৌঁছে
হাল ছাড়েনি।
২৪। ম্যাজিক ল্যাম্প
তোমার কেমন লাগে? আমাদের
কিশোর পাঠকদের জন্য কি তোমার কোনো বার্তা আছে?
দারুণ। সব গল্প পড়ার সময় অবশ্যই পাই না। কিন্তু
যখনই পড়েছি, মনে হয়েছে, এর মান প্রিন্টেড নামী পত্রপত্রিকাগুলোর থেকে কিছু কম নয়। কিশোরদের
জন্য সেরা ওয়েব ম্যাগাজিন।
কিশোর পাঠকদের বলব তোমরা সবাই
সবরকম বই পড়বে। অবশ্যই বাংলা বইও। সব ধরনের লেখা। ফিকশন। নন–ফিকশন। নানান বিষয়ের
উপরে পড়বে। বই হচ্ছে এমন একটা মাধ্যম যেখানে তোমরা পড়ার সময়ে তোমার মতো করে গল্প তৈরি
করো। শুধু যে লেখক পুরোটা লেখেন, সেটা নয়। অন্য কোনো মাধ্যমে এই চিন্তাভাবনার
অবকাশ সেভাবে থাকে না। যখন বই পড়বে না দেখবে আস্তে আস্তে এই কল্পনার জায়গাটাও যেন
হারিয়ে ফেলছ।
----------
ছবি - আন্তর্জাল
ম্যাজিক ল্যাম্প
No comments:
Post a Comment