গল্প:: সুপ্ত মৈনাক - রম্যাণী গোস্বামী


সুপ্ত মৈনাক
রম্যাণী গোস্বামী

এ পাড়ায় মল্লিকদের ওই খালি অ্যাপার্টমেন্টের দোতলায় নতুন ভাড়া এসেছেন সদানন্দবাবুগুছিয়ে বসার দিনকতকের মধ্যেই পাড়ার দুধওয়ালাটা অবধি খেয়াল করেছে যে বেচারা মানুষটি বিশ্ব সংসারে একা হলে কী হবে, উনি সদাই আনন্দে থাকেন। মুখে তাঁর বাঁধাধরা হাসিটি লেগেই আছেবাজার আগুন হলেও তিনি হাসছেন, আবার শেয়ারের দর কমলেও। পেট্রোলের দাম আচমকা বাড়লে কি বাড়িতে কাজের লোকটি বিনা বলে কয়ে সাত দিনের জন্য ডুব মারলেও তাঁর মুখের হাসিটির দৈর্ঘ্য বা প্রস্থের কোনো হেরফের ঘটছে না পাড়া প্রতিবেশী সকলেই অবাক হয়ে যায় সদানন্দবাবুর এই আশ্চর্য ঐশী ক্ষমতায়। ওঁর ঠিক উলটো দিকের একতলা বাড়িটাতেই থাকেন বিকাশবাবু। তাঁর আবার সামান্য কারণেই বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে যায়। কখনও গিন্নির সঙ্গে, কখনও বা পাড়ার কুকুরগুলোর সঙ্গে, ঘরে বাইরে রাতদিন খিটিমিটি লেগেই আছে। খুব বেশি রাগ হলে ভুরুর সঙ্গে আবার বোঁচা নাকটাও কুঁচকে গিয়ে সে এক অদ্ভুত লাগে দেখতে আর সামান্য রাগের ব্যাপার তো দিনে রাতে বাড়ি বা অফিসে যখন তখন ঘটতে পারে। সুতরাং বিকাশবাবুর ভুরুদুটো সর্বক্ষণই কুঁচকে থাকে
বয়সের বেশ খানিকটা ব্যবধান থাকলেও দু’জনের দিব্যি একটা বন্ধুত্ব গোছের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল রোজ বিকেলে ঢাকুরিয়া লেকের ধারে বেড়াতে যান দুই নতুন বন্ধু। লেকের চারদিকে এক চক্কর লাগিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট কাঠের বেঞ্চে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে কিছুক্ষণ গল্পগাছা করে বাড়ির পথ ধরেন দু’জনে। বিকাশবাবু কোনোদিন হয়তো তেড়েফুঁড়ে বললেন, “আরে, আজ সকালে খবরের কাগজটা খুলেই তো মাথাটা গেল গরম হয়ে, কী অবস্থা হয়েছে দেশটার। চারিদিকে শুধু করাপশন। সব ব্যাটাই দেখছি ঘুষ খায়। আপনি দেখেছেন তো দাদা আজকের ফ্রন্ট পেজটা? এসব কি মেনে নেওয়া যায় বলুন তো?”
সদানন্দবাবু ওসব খবরের কাগজ-টাগজের কোনো গরম গরম হেডলাইনের ধারপাশও না ঘেঁষে মৃদু হেসে বলেন, “আহা, আহা, এই ফুরফুরে বিকেলে খামোখা মাথা গরম করছ কেন ভায়া? চলো, ওঠা যাক। ফেরার পথে বিলটুর দোকানে ভাঁড়ের স্পেশাল মালাই চা খাই। মনটা তাজা লাগবে হ্যাঁ? ঠিক আছে?”
সব কথার শেষে এই – ‘হ্যাঁ? ঠিক আছে?’ বলাটা হল সদানন্দবাবুর মুদ্রাদোষ। প্রথম প্রথম একটু বিরক্ত লাগলেও এখন সয়ে গেছে বিকাশবাবুর।
এই তো কিছুদিন আগে দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা বাড়ি বাড়ি এসে যাকে বলে একপ্রকার জুলুম চালিয়ে গেল। ছেলেগুলোর আস্পর্ধা দেখে বিকাশবাবুর নাক কুঁচকে গিয়েছে। রাগে উনি থরথর করে কাঁপছেন। ছেলেগুলোকে তিনি প্রথমে ধমক-ধামক, তারপর গালিগালাজ করলেন, মায় পুলিশে ফোন করার হুমকিও দিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফল কী হল? গিন্নির ভীত চোখের করুণ আবেদনকে অগ্রাহ্য করতে পারলেন কি বিকাশবাবু? নাহ্‌, পারলেন না। কী আর করবেন, এই পাড়াতেই বসবাস তো করতে হবে সপরিবারে। শেষমেশ আধঘণ্টার বচসার পর সেই হাজার এক টাকাই পকেটে পুরে নিল ওরা। তারপর ওঁর দিকে একটা অনুকম্পার দৃষ্টি ফেলে ওরা দাঁত ক্যালাতে ক্যালাতে চলে গেল।
একটা ব্যাপারে কিন্তু হেবি কৌতূহল জাগল বিকাশবাবুর রাস্তা টপকে একরকম দৌড়েই সদানন্দবাবুর বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলেন তিনি। স্মিত মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ওঁকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন গৃহকর্তা
“দাদা, ওই বদ ছেলেগুলো চাঁদা চাইতে আসেনি আপনার কাছে?” এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন বিকাশবাবু।
“হ্যাঁ, এসেছিল তো
“ইয়ে, তা কত চাইল?”
“এ পাড়ায় নতুন এসেছি বলে আবার বেশি চেয়েছে ভেব না যেন ভায়া। তোমার কাছে যা চেয়েছে, সেম হিয়ার,” দু’হাতের দশটা আঙুল প্রসারিত করে দেখালেন সদানন্দবাবু। মুখে সেই টিপিকাল গদগদ হাসি।
“বাহ্‌! আর আপনিও দিয়ে দিলেন এক কথায়?”
“দেব না তো কি তোমার মতো আধঘণ্টা ধরে নিজের আয়ুক্ষয় করব? একটু চা খাও। হ্যাঁ? ঠিক আছে?” একগাল হেসে বললেন উনি।
মুখ গোঁজ করে বসে পড়লেন বিকাশবাবু। ছি ছি ছি... তিনিই কিনা শুধু শুধু... যা বাছাই করা কিছু মুখখিস্তি করেছেন ছেলেগুলোকে! আজকের ঘটনার পর ক্লাবের সামনে দিয়ে মাথা তুলে হেঁটে যেতে পারবেন? ছোকরাগুলো তো দিনভর ওখানে দাঁড়িয়েই ক্যারাম পেটায়। উফ্‌! এই ভদ্রলোকের কি কখনও রাগ হয় না? মনে মনে রাগে চিড়বিড়িয়ে উঠলেন উনি।
দু’দিন পরে লেক থেকে ফেরার সময় একটা ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘটল। দুলকি চালে চওড়া রাস্তার বাঁ দিক ঘেঁষে সাবধানেই হাঁটছিলেন দুই বুড়ো। এমন সময় কোথা থেকে এক ছোকরা ঊর্ধ্বশ্বাসে বাইক চালাতে চালাতে রাস্তার অনেকটা বাঁ দিকে চেপে এল। ভয়ের চোটে বিকাশবাবু লাফিয়ে পড়লেন সদানন্দবাবুর ঘাড়ের উপর টাল সামলাতে না পেরে সদানন্দবাবু ছিটকে পড়ে গেলেন মাটিতে। আর একটু হলে হাইড্রেনেই ঢুকে যাচ্ছিলেনখুব অল্পের উপর দিয়ে বাঁচলেন। তবে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছেন যথেষ্ট
“স্কাউন্ড্রেল! একবার সামনে আয়, তোর বাইকবাজি ভুলিয়ে দেব আমি,” দুই ভুরু কপালে তুলে হাত মুঠি পাকিয়ে বাইকওলার উদ্দেশে চিৎকার করে উঠলেন বিকাশবাবু, কিন্তু ছোকরা ততক্ষণে পগার পার।
“আহা আহা, করছ কী ভায়া? যা হওয়ার তা হয়েছে। ভুলে যাও। এত উত্তেজনা ভালো নয়। হ্যাঁ? ঠিক আছে?” পা খিমচে ধরে মাটি থেকে কোনোরকমে উঠতে উঠতে বললেন সদানন্দবাবু। হাঁটুর যন্ত্রণায় চোয়াল সামান্য বেঁকে গেলেও শো কেসে সাজানো বুদ্ধমূর্তির সৌম্য মুখাবয়বের চিরাচরিত স্মিত হাসির ঝিলিক এখনও যথারীতি ঝুলে রয়েছে তাঁর ঠোঁটের কোণে
“জানি না দাদা, আপনি কীভাবে পারেন এত শান্ত থাকতেআমার কিন্তু এসব বাঁদরামি মোটে সহ্য হয় না। ইস, এ যে রক্ত বেরোচ্ছেচলুন, চলুন, ওই চায়ের দোকানে গিয়ে একটু বসি। জায়গাটা ধুতে হবে,” বিকাশবাবু এগিয়ে গিয়ে সদানন্দবাবুর হাত ধরলেন। রাগে এখনও তাঁর গা কাঁপছে। বোঁচা নাকটা কুঁচকে রয়েছে প্রবলভাবে
একটু পরে দুটো স্পেশাল মালাই চা অর্ডার করে দু’জনে এসে বসলেন চায়ের দোকানের সামনে পেতে রাখা কাঠের বেঞ্চে।
“বুঝলেন দাদা, আমার বরাবরই এরকম রাগ। এজন্য অফিসে সবাই ভয় খায় আমাকে। সেদিন বাসের কনডাকটর খুচরো দেওয়া নিয়ে বিস্তর খিটখিট করছিল। এত রাগ হল। ইচ্ছে করছিল যে টেনে এক চড় কষাই। আর আজ ওই বাইকওয়ালাকে হাতের মুঠোয় পেলে দেখিয়ে দিতাম মজা। এই দেখুন আমার বাইসেপস, ট্রাইসেপস এখনও কী সলিড। উঁহু... উঁহু, ওভাবে নয়। টিপে দেখুন,” আস্তিন গুটিয়ে দেখালেন বিকাশবাবু।
সদানন্দবাবু সত্যিই আঙুল দিয়ে টিপেটুপে দেখলেন জায়গাটা তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে একেবারেই স্বভাববিরোধী বিচিত্র একটা কৌতুকের স্বরে ফিসফিস করে বললেন, “আর কিছু নয় বিকাশ? একটা মাত্র চড়? তাহলে এই হল গিয়ে তোমার প্রচণ্ড রাগের নমুনা? আরে ছো ছো... ছো ছো...” ওঁর গলার স্বর অনেকটা যেন দুয়ো দেওয়ার ভঙ্গিতে দুলে দুলে উঠল
কথাটা খুবই অদ্ভুত শোনালেও অতটা গা করলেন না বিকাশবাবু। মালাই চা এসে গিয়েছে টেবিলে। ওতেই মনোনিবেশ করলেনসদানন্দবাবু অন্যমনস্কভাবে তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে। চায়ের কাপে হাতও ছোঁয়াননি মানুষটাসেদিনের আড্ডা জমল না তেমন। বিকাশবাবুর জোরাজুরিতে পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে একটা ব্যথার মলম কিনে নিজের বাড়িতে গুটিগুটি ঢুকে গেলেন সদানন্দবাবু। যাওয়ার আগে অভ্যেসমতো বন্ধুর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন। যদিও বিকাশবাবুর বার বার মনে হচ্ছিল যে মানুষটার মুখের হাসিটা কোনো কারণে খোলতাই হল না আজ। একটু আগের ওই দুর্ঘটনায় পাওয়া হাঁটুর আঘাতের জন্যই কি? হুম। তা-ই হবে।
রাস্তা টপকে উলটোদিকে এগোতেই দেখলেন তাঁদের বাড়ির বারান্দা থেকে ঝট করে কেউ যেন ঘরের ভিতরে সেঁধিয়ে গেল। গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতেই শুনলেন ভিতরে কথাবার্তার আওয়াজ
“ওহ্‌, সুজন তুমি? অনেকদিন কোনো খোঁজখবর নেই। কেমন আছ সব? আরে বোসো বোসো তারপর? চা-টা খেয়েছ?” ঘরে ঢুকে আগন্তুকের উদ্দেশে হাসিমুখে বললেন বিকাশবাবু।
সোফায় বসতে গিয়েও লোকটি উঠে দাঁড়াল খুশিয়াল স্বরে বলল, “হ্যাঁ জামাইবাবু, একবার চা খাওয়া হয়ে গেল। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। বুলা’দির কাছে শুনলাম যে আপনি হাঁটতে বেরিয়েছেন। তা রিমলির বিয়েটা ঠিক করে ফেললাম, বুঝলেন? এই ডিসেম্বরে ছেলে হায়দ্রাবাদে থাকে। সেখানেই ইঞ্জিয়ারিং ফার্মে কাজ করে। রিমলিও ওখানে গিয়ে কোনো জব খুঁজতে চায়। আজকালকার মেয়েজানেনই তো শুধু ঘরসংসারে তাদের আবার মন ওঠে না
খবরটা শুনেই মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল বিকাশবাবুর। দূর সম্পর্কের এই শ্যালকটির সঙ্গে খুব বেশি যোগাযোগ নেই তাঁর রিমলিকে এই অ্যাতটুকু দেখেছেন। খুব সম্ভব মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করার জন্য সুজন একবার একটা পার্টি দিয়েছিল নিজের বাড়িতে। সস্ত্রীক গিয়েছিলেন। সেই মেয়ের কিনা দু’দিন পরে বিয়ে! মৃদু হেসে বললেন তিনি, “বাহ, এ তো জবর খবর হে
সুজন হঠাৎ গলার স্বর খাদে নামিয়ে ফেলে ভুরু নাচিয়ে বলল, “একটা কথা বলুন তো জামাইবাবু, ওই সাঙ্ঘাতিক লোকটাকে আপনি জোটালেন কোথা থেকে?”
“কে? কোন লোক? কার কথা বলছ?” বেশ খানিকটা অবাক হয়েই সুজনের দিকে তাকালেন বিকাশবাবু।
“ওই যে দেখলাম আপনার পাশে পাশে অল্প খোঁড়াতে খোঁড়াতে হেঁটে আসছিল। তারপর উল্টোদিকের বাড়িতে ঢুকে গেল
সুজনের কথা বলার ধরনে তার উপর ফস করে রেগে উঠলেন বিকাশবাবু। কোনোরকমে রাগ চেপে রেখে ভুরু কুঁচকে বললেন, “ওহ, তুমি সদানন্দবাবুর কথা বলছ? উনি তো আমার প্রতিবেশী। এ পাড়ায় নতুন এসেছেন। জাস্ট কিছুদিনের আলাপ
“সদানন্দ! ফুঃ... বলুন যে ক্রোধান্ধ। এই নামেই তো চিনত ওকে আমাদের কর্পোরেশন অফিসের গোটা বিল্ডিং-এর লোক দিব্যি ভালোমানুষ। মিলেমিশে কাজ করছেন। সবার সঙ্গে হাসি ঠাট্টা ইয়ার্কি চালাচ্ছেন হঠাৎ দেখি কথা নেই বার্তা নেই তুচ্ছ কারণে লোকটা রাগে একেবারে পাগল হয়ে গেল! আর খেপলে যে একদম হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলা যায় এই জিনিসটা আমরা প্রথম ওর মধ্যেই দেখেছিলাম এরকম নমুনা তো আগে দেখার অভিজ্ঞতা হয়নি জামাইবাবু। তবে তারপর থেকে এমনটা একবার নয়, বহুবার ঘটেছে
“বলছ কী!” বিস্ময়ে একেবারে অভিভূত হয়ে পড়েন বিকাশবাবু। “তু... তুমি শিওর? অন্ধকারে চিনতে কোনো ভুল হয়নি তো তোমার সুজন? উনি যে ভারি অমায়িক এবং সজ্জন ভদ্রলোক। সবসময় মুখে হাসিটি লেগেই আছে
“হা হা হা... আপনি এখনও ওর পালটে যাওয়া রূপটা দেখেননি যে জামাইবাবু। প্রথম প্রথম সবার অমনি ভুল হয়। আরে, আমি ওকে চিনব না? আমাদের অফিসের বেয়ারা সুখনলাল একবার ওর সঙ্গে মুখে মুখে কী একটা তক্ক করেছিল বলে লোকটা সুখনলালের নাকে এমন ঘুষি হাঁকিয়েছিল যে সে উড়ে গিয়ে পড়ে চার হাত দূরে। তার মাথাটা গিয়ে লাগে টেবিলের কোনায়। সে এক যাচ্ছেতাই রক্তারক্তি কাণ্ড। ইউনিয়ন থেকে প্রচুর জলঘোলা হয়েছিল ঘটনাটা নিয়ে। থানা পুলিশ অবধি গড়ায় ব্যাপারটা। প্রায় খুনের দায় থেকে কোনোমতে বেঁচে গেছল লোকটা। আমিই তো দৌড়ঝাঁপ করে সব ঝামেলা মেটাই। ওই ঘটনার পরপরই ভদ্রলোক স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ায় অফিসসুদ্ধ আমরা সবাই সত্যি বলতে কি হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। কবেকার কথা বলি দাঁড়ান... হুঁউ, তা এই ধরুন গিয়ে বছর এগারো হবেহাহ্‌, এই মানুষের নাম কিনা সদানন্দ। অবশ্য নামটা যে রেখেছিল সে কি আর ভবিষ্যৎ পড়তে জানত?”
“কি... কিন্তু...,” এখনও যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না বিকাশবাবু। সুজন কি সত্যি বলছে? গায়ে পড়ে শুধুমুধু মিথ্যেই বা বলবে কেন?
দিদির হাতের তৈরি আরও এক কাপ চা, এক প্লেট মাংসের ঘুঘনি, দুটো লাড্ডু আর ঝুরিভাজা খেয়ে বিদায় নেওয়ার আগে তাঁকে কতকটা উপদেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল সুজন, “তা, ওর সঙ্গে মিশছেন, মিশুন। কিন্তু খুব সাবধান! বেশি কথা-টথা বলতে যাবেন না যেন। যা বলবেন যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করে মেপেজুপে বলবেন। কখন যে কোন তুচ্ছ কারণে লোকটা রেগে যাবে আর আগ্নেয়গিরির লাভার মতো ওর সেই রাগ বাইরে ফেটে পড়ে আপনাকে ভস্ম করে দেবে সেটা কিন্তু আপনি টেরও পাবেন নাওই হাসিমুখ দেখে ভুললে বিপদে পড়বেন কিন্তু। এই সাফ বলে দিলুমছেলেবেলায় ভূগোল বইতে পড়েননি সুপ্ত আগ্নেয়গিরির কথা? ওই লোকটা হল গিয়ে ঠিক তাই
সুজন চলে যাওয়ার পর গিন্নিকে আরও এক কাপ চায়ের কথা বলে একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন বিকাশবাবু। খোলা বাতাসে শ্বাস নিলেন জোরে জোরেমাথাটা খুব ভার ভার লাগছে। একবার মুখ তুলে চেয়ে দেখলেন। তাঁর প্রতিবেশীটি এখন নিদ্রিতউলটোদিকের অ্যাপার্টমেন্টের দোতলায় এখন কোনো আলো জ্বলছে না অন্ধকারে ডুবে থাকা জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেন যেন ভয়ে বুকটা ঢিবঢিব করে উঠল ওঁর। সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। হ্যাঁ, ছেলেবেলায় পড়েছিলেন বটে জাপানের বিখ্যাত মাউন্ট ফুজিয়ামা পর্বত। পাহাড় চূড়ায় পুরু বরফ জমে আছে কিন্তু কে খোঁজ রাখে অভ্যন্তরের ওই ফুটন্ত লাভার উপস্থিতির?
হঠাৎ তাঁর মনে পড়ে গেল যে গতকালই নিউজপেপারে তিনি একটা অদ্ভুত খবর পড়েছেন। প্রায় কুড়ি বছর পরে নাকি আফ্রিকার কঙ্গোর কোনো এক হ্রদের মাঝে একটি ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি কোনো আগাম সতর্কবার্তা ছাড়াই আচমকা জেগে উঠেছে। কী যেন একটা খটোমটো নাম হ্যাঁ, মনে পড়েছে। মাউন্ট নিরাগঙ্গো! তার উগড়ে দেওয়া জ্বলন্ত লাভায় নাকি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে গেছে আশেপাশের বেশ কয়েকখানা গ্রাম। উফ্‌, কী সাঙ্ঘাতিক! ভয়ে চোখ বুজে ফেললেন বিকাশবাবু।
ঠিক এই কারণেই কি সদানন্দবাবুর সামনে বিতর্কিত কোনো বিষয় তুললেই উনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে থামিয়ে দিতেন? যাতে সেই কথার সূত্র ধরে বড়োসড়ো একটা বিস্ফোরণ না ঘটে যায়? হ্যাঁ। ঠিক। ঠিক ভেবেছেন। নিশ্চয়ই তাই। এতদিনে আসল কারণটা বোঝা গেল। কাল বিকেলেই অফিস থেকে ফিরে এসে আবার একসঙ্গে দু’জনের লেকের ধারে হাঁটতে যাওয়ার কথা রয়েছে। সেটা ভাবতেই যেন শিউরে উঠলেন বিকাশবাবু। কাতর আর্তনাদ করে উঠল ওঁর অন্তরাত্মা, না, না, নেভার। ওই লোকের সঙ্গে আর নয়। আর্তনাদটা কাশির দমকে বাইরে বেরিয়ে এল। খুক খুক করে বারকতক কাশলেন বিকাশবাবু। শীত আসছে দাঁত নখ মেলে লেকের ধারের জোলো হাওয়াটা সেজন্যই মনে হয় নিতে পারছে না শরীর। নাহ্‌, এখন থেকে বিকেলে বেরোনোটা একেবারে বন্ধ না করলেই নয়।
কিন্তু তাঁর সঙ্গীটিকে তো জানাতে হবে সেটা? বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? কাল সকালে নিজেই একবার চলে যাবেন সদানন্দবাবুর কাছে? গিয়ে বলে আসবেন যে বৈকালিক ভ্রমণটা না হয় আপাতত কিছুদিন বন্ধ থাক? নাহ, বরং বিকেলবেলায় ভদ্রলোক এলে তাঁকে তখনই জানিয়ে দেবেন। উঁহু, এটাও ঠিক মনঃপূত হচ্ছে না বিকাশবাবুর। ভাবতে ভাবতেই সিগারেট ফেলে দিয়ে ঘরে ঢুকে সোজা বেডরুমে গিয়ে কাঁথামুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন উনি। বড্ড ম্যাজম্যাজ করছে শরীরটা। জ্বর জ্বরও লাগছেহ্যাঁ, আগামীকাল এটাই করবেন। নিজে বিছানায় কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে থেকে বরং গিন্নি মারফত সদানন্দবাবুকে জানিয়ে দেবেন তাঁর জ্বর আসার এবং সেজন্যই কিছুদিন হাঁটাহাঁটি বন্ধ করে বিশ্রাম নেওয়ার কথা। আগামী কয়েকটা দিন অন্তত ওই ভয়ঙ্কর লোকটার মুখোমুখি হওয়ার বিন্দুমাত্র বাসনা নেই তাঁর।
গিন্নি যখন বাইরের ঘর বারান্দা ইত্যাদি জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে চায়ের কাপ হাতে বেডরুমে এলেন তখন বিকাশবাবুর মুখটা সত্যিই ফ্যাকাসে তাঁর নিদ্রিত শুকনো মুখে গভীর ভয়ের ছাপ। সেদিকে দু’পলক তাকিয়ে মুচকি হাসলেন গিন্নি। কথায় কথায় রেগে ওঠা মানুষটাকে দেখ এখন? কেমন অসহায় শিশুর মতো লাগছে।
উফ্‌, সুজন’টা পারেও বটে! কলেজ জীবনে থিয়েটারের শখ ছিল একটু-আধটুকিন্তু সে তো অনেকেরই থাকে। তাই বলে এখনও যে এত ভালো অ্যাকটিং করে দেখাবে ভাইটা, তিনি তা ধারণাও করেননি। দ্যাখো তো কাণ্ডখানা, অতীতে কোনো এক গেট টুগেদারে সামান্য কোনো ঠাট্টায় খাপ্পা হয়ে উঠে উনি কী সমস্ত আজেবাজে কথা বলেছিলেন শালাবাবুকে, সুজন এতদিন ধরে সেই রাগ মনের মধ্যে পুষে রেখে দিয়েছিল? তা রেখেছিস, রাখ। কিন্তু এতগুলো বছর পরে এমনি করে বানিয়ে বানিয়ে কতগুলো মিথ্যে কথা বলে খামোখা মানুষটাকে ভয় খাইয়ে কি তার শোধ নিতে আছে?
হাতে ধরে থাকা চায়ের কাপে নিজেই চুমুক দিতে দিতে এবার খুকখুক করে হাসতে থাকেন বিকাশবাবুর গিন্নি
----------
ছবি – শুভশ্রী দাস
ম্যাজিক ল্যাম্প 

No comments:

Post a Comment