আবার রূপকথা
জয়তী রায় মুনিয়া
মনের মধ্যে রূপকথা চুপ করে
ঘুমিয়ে থাকে। এই সব আজোরবাজোর চৌকিচাবর দিনগুলি থেকে বেরিয়ে গিয়ে পৌঁছে যাওয়া
যায় রূপকথার দুনিয়ায়।
ধূর্ত চোখ নাচিয়ে তোম্বা
মুখে মিচকে হেসে বলবে,
আরে, এমন আবার হয় নাকি! পশু পাখি ভাষা বোঝে? দূর! গাছ সাড়া দেয়?
দূর! নদীর কুলুকুলু জলধারার মধ্যে বেজে চলে গানের সুর? দূর!
দুইটি চক্ষুর মালিক এর বেশি
আর দেখবে কী যে জানবে?
তাদের কাছে সবটাই কেবল দূর আর দূরচ্ছাই, নয়তো বা, অলীক কল্পনা মিথ্যে বানানো গপ্পো। তাদের কাছে জীবন
ঐ এক দুই তিন পা মেপে হেঁটে ফেলেই, ব্যস, কম্মো শেষ।
এই দেখো না, বৃষ্টির পরে আকাশ জুড়ে যখন জেগে ওঠে রামধনু, সাত রঙের আলো
ঝিলমিল ঝিলমিল করে ছড়িয়ে পড়ে, তখন কি বিজ্ঞজনের ব্যাখ্যা মনে
থাকে? মন উধাও হয়ে যায় কি না রামধনুর কল্পনায়!
শুদ্ধু দুইখান চোখ লাগিয়ে
দেখা নয় গো বাপু,
মন লাগিয়ে দেখো। বলি কী, একবার
ভুবনডাঙায় ঘুরেই এসো না হয়, জিমজিম ঠাণ্ডা রোদ্দুর, মাটির
দাওয়া, শীতল পাটি,
পা গুটিয়ে খাও দেখি নতুন গুড়ের পায়েস। উঁচু মুখি লাল পিঁপড়ে সামনের পা দুটি তুলে চাইবে ছিটেফোঁটা, আলিস্য ভরে বিড়াল তাকাবে মিউ মিউ, অতিথির কাছে চাইতে নেই বলে ভলু কুকুর
থাবায় মুখ ঢাকবে... আরও এমন কত কী! ওখানে জীবজগৎ জিন-জগৎ আর মানুষের
জগৎ মিলে মিশে চলে,
কেউ কোনো কিছুতেই অবাক হয় না, মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেয় না, বরং হেসে হেসে বলবে, ভুবনডাঙায় এমন হতেই পারে। কী হতে পারে? লম্বা লিস্টি আছে তার। অত ব্যাখ্যায় না গিয়ে বরং ঘুরেই এসো ভুবনডাঙা।
* * *
ছোট্ট সেই তোতনকুমার, যার গল্প তোমরা কেউ জানো কেউ জানো না। অনেক লড়াই করে অনেক অপমানের পরে হারানো
রাজ্য ফিরে পেয়ে তোতনকুমার এখন কুড়ি বছরের যুবক। টুলটুল চোখের সরল কিশোর এখন বীর
যুবক। টান টান চেহারা,
কার্তিক ঠাকুরের মতো ফরসা সুন্দর, লাঠি খেলে তরবারি চালায় কুস্তি
লড়ে, গ্রামের ছেলেদের মেয়েদের শরীরচর্চা করতে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে উৎসাহ দেয় আর
বলে - মনে পড়ে? ছোটোবেলায় ডাকাত দল তছনছ করে দিয়েছিল আমাদের? তখনই বুঝেছি,
শরীর শক্ত মন শক্ত তো জগৎ হাতের মুঠোয়।
লোকে বলবে - ও তোতন, এখন আর ভয় কীসের বাপ! সে ডাকাত তো কবে পালিয়েছে। দেশ
জুড়ে কত্ত সুখ।
তোতন বলে - কিচ্ছু পালায় না
কাকা। ঘাপটি মেরে থাকে। ফাঁক খুঁজবে সুযোগ খুঁজবে, যেই
দেখবে মুঠি আলগা দুম করে লাফিয়ে পড়বে ঘাড়ে।
গাঁয়ের লোক সরসর করে বলে
ওঠে - কী যে বলো তোতনকুমার। বলি, সেই কত্ত বছর
আগের ঘটনা, ধরে বসে থাকলে চলবে? এখন দেখো, ভাণ্ডার উপচে
ফসল, দুধ দই মাখন থইথই,
বিনা বেতনের ইস্কুল কলেজ, ছেলেমেয়েগুলো গটমট গটমট ইংরাজি
বলে, বলি ও তোতনকুমার,
তোমার রাজত্বে আছি মহা সুখে।
লোকগুলোর সরল মুখের হাসির
আলোয় তোতনের বুকের ভিতর জমে থাকা এক কুচি অন্ধকার নাড়া খায়। সত্যি তো, কবেকার কথা, চুকে বুকে গেছে - এমন ভেবে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায় - সেদিনের সেই ডাকাত মেসো
পঞ্চানন খুনে মাসি - সব পগার পার, খুনে পঞ্চার ছেলে সাধন এখন তার ডান
হাত। দাদার একটি কথায় প্রাণ দিয়ে দেবে সাধন। বাপ-মায়ের নাম
ভুলেও করে না। তবে? কীসের এত চিন্তা?
কে জানে, কীসের চিন্তায় মন মাঝে মাঝে ভারি হয়ে ওঠে, কেন যেন মনে হয়, আছে, কেউ আছে, সর্বদা নজর রাখছে ভুবনডাঙার উপর। মন খারাপ হলেই সে পালিয়ে যায় জঙ্গলের গভীরে, ওইটে প্রিয় জায়গা যে, সেই ছোট্ট থেকে বনভূমি দাপিয়ে
বেড়ায়, সেখানে আছে নিজের লোক।
* * *
পান্তাবুড়ি আছে, আছে কানা গাই,
বুড়ো বটতলা,
গভীর জঙ্গলে ভাঙ্গা দেউলে পুজো হয়, আছে পেঁচা, গঙ্গারাম ভূত, সাদা ধুতি পৈতা নিয়ে জ্ঞানী ব্রহ্মদত্যি। তোতন কুমার রাজা হয়েছে কাজ বেড়ে
গেছে তব্বু সে যাবেই জঙ্গলে। মা হারা তোতনকে আদর আর মায়ায় ভরিয়ে রাখে প্রাচীন বৃক্ষসকল।
বিশাল বিশাল গুঁড়ির উপর ঝরা পাতার বিছানায় শুয়ে ঘুমায় তোতনকুমার। গাছের ডাল
দুলে দুলে বাতাস করে,
গান শোনায়, ফুলের গন্ধে ভরিয়ে দিতে দিতে টুপ করে ফেলে দেয় রসালো ফল।
গাছ গান করে? কথা বলে? পাহারা দেয়?
বিশ্বাস করা বা না করা তোমাদের হাতে, তবে কী জানো? ওই যে বললাম,
মনের চোখ? সেই চোখ যদি জেগে থাকে, দেখবে, ভাষা কেবল
মানুষের মুখে নেই,
প্রকৃতি শব্দময়,
কিছু না কিছু বলছেই। আমরা শুনতে চাই না বলে শুনি না। প্রকৃতিকে দূরে সরিয়ে
রাখলে সে কাছে আসবে কী করে? তোতনকুমার প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে চলে। অরণ্য নদী পাহাড় ঘিরে ঘিরে চলে তার প্রতিদিনের কাজ। বিশেষ
করে অরণ্য। যেন ঠিক মায়ের মতো। তাদের একটি পাতা
অকারণ নষ্ট হলে বুকে বাজে, একটি পশুর অকারণ হত্যার কঠিন
শাস্তি দিতে দ্বিধা করে না, অবসরে এখনও ঝরা পাতায় শুয়ে
ঘুমিয়ে পড়ে আরামে,
হলুদ ডোরা বাঘ,
ফোঁসফোঁস সাপ,
বিদঘুটে বিছে,
তারাও গুটিগুটি রাজার পায়ের কাছে কানের কাছে মাথার কাছে শুয়ে বসে থাকে।
পাখিরা কিচিরমিচির বন্ধ করে, ল্যাজ তুলে দুষ্টু বাঁদর ফল এনে
সাজিয়ে রাখে পাশে। ঘুম থেকে উঠে খাবে রাজা। বড্ড মায়া ছড়ানো চারিদিকে, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে লুকোচুরি খেলে আলো, হঠাৎ করে
ঝাঁপিয়ে পড়ে বৃষ্টি,
আকাশ জুড়ে খিলখিল হেসে জেগে ওঠে রামধনু... অকারণ কিচ্ছু
নয় কিন্তু, সব কিছুর মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রাণ, প্রাণে ভরপুর এনার্জি। প্রকৃতির
ভারসাম্য রক্ষা করতে গেলে পৃথিবী বাঁচিয়ে রাখতে গেলে এই এনার্জি ধরে রাখতে হবে বই-কি।
রাজাকেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। শাসক কখনও ঘাতক
নয়। শাসক হলেন সাধক। কুঁড়ি থেকে ফুটে ওঠা ফুল, টুপটুপ ঝরে পড়া
বৃষ্টির ফোঁটা, পৃথিবী তছনছ তুমুল ঝড়, ঠকঠক ঠান্ডা, খরখর গরম... সকলের মধ্যে প্রাণ দিয়েছেন ঈশ্বর, সেই প্রাণ রক্ষা
করেন রাজা।
* * *
ভুবনডাঙা পাঁচটা জায়গার মতো
সাধারণ নয়, এইখানের নদীর জলে গাছের বাতাসে মাটির ভিতরে ম্যাজিক আছে। অজানা কঠিন অসুখ, বাঁচার আশা নেই,
এই গেল ত সেই গেল...
পান্তাবুড়ি হেঁকে বলবে - গেলেই হল আর কী! চল দেখি জঙ্গলে, অমুক শিকড় খেয়ে নে, দ্যাখ, তারপর!
শুধু পান্তাবুড়ি কেন? ভুবনডাঙার কচি বাচ্চা ছেলে পর্যন্ত জানে জঙ্গলের ভিতর কোন ছোট্ট বেগুনি ফুলের
রস খেলে চট করে কমে যাবে পেটের বেদনা, কানের ফোঁড়া গলে যাবে পাতা
চিবিয়ে কয়েক ফোঁটায়, আমাশা হলে ছুট্টে চলে যাবে জঙ্গলে
আর হাতে করে নিয়ে আসবে মেন্দা গাছের পাতা, হাড় ভাঙলেই বা
পরোয়া কীসের, ওই মেন্দা গাছের ছাল নিয়ে প্লাস্টারের কাজ করে দেবে।
ঠান্ডা লাগলেই খাইয়ে দেবে
বাসক পাতা, রোজ খায় শতমূলি,
এতে আছে ভরপুর ভিটামিন, জঙ্গল জুড়ে আছে, আমলকী হরীতকী বহেড়া গাছ, অর্জুন গাছ, জারুল তমাল ডুমুর। যত গাছ তত উপকারী ওষুধ। এই তো সেদিন হারু কামারের ছেলেকে
সাপে কামড়াল, বুড়ো বদ্যি নরেন দত্ত লাগিয়ে দিল মাকাল ফলের বীজের তেল। শ্বাসকষ্ট কমে গেল, ছেলে একেবারে চাঙ্গা। হলুদ নিম থানকুনির কথা বলার কিছু নেই। ভুবনডাঙার ঘরে ঘরে
চলে এইগুলি খাওয়া। ফলে, জ্বর-জারি করোনা-মরোনা কিচ্ছু ঘেঁষে
না কাছে।
* * *
ভুবনডাঙার বনভূমি জুড়ে
গাছগুলির ওষধি গুণের কথা জানে না হেন কেউ নেই। তোতনকুমার বলে - বৃক্ষের আশ্রয় ভগবানের মতো। সাহায্য নাও
কিন্তু যতন করো।
এলাকায় যারা অতি বৃদ্ধ আছে, পাকা চুল ভরা মাথা নেড়ে বলবে - ওরে বাবা, এই অরণ্য অনেক
পুরোনো। কত হাজার বছর আগে এখানে বাস করত রাবণের পরিবারের লোক। যাঁদের আমরা রাক্ষস
বলি আসলে তাঁরাই ছিল দেশের প্রাচীন জনজাতি। কত্ত জড়িবুটির খবর রাখত, মরা মানুষ বাঁচিয়ে তুলতে পারত।
- সে কী গো? আছে না কি এমন গাছ ভুবনডাঙার জঙ্গলে?
- আছে বই-কি, ওই যে দেখো, সারি দিয়ে আছে শ্বেতচন্দনের গাছ, তাদের আশেপাশে লুকিয়ে আছে সেই লতা, বিশল্যকরণী। পাতাগুলি গাঢ় সবুজ, মাঝ বরাবর মধ্যশিরা লালচে বর্ণের, প্রতিটি পাতার গোড়ায় একটি করে কাঁটা। বুঝলে কিছু? রামায়ণের গল্প
শোনোনি? রাম রাবণের যুদ্ধ হল, লক্ষণ শক্তিশেলের ঘা খেয়ে
মূর্চ্ছা গেল গো,
বাঁচবে কিনা আশা নেই, তখন এই পাতার রস লাগিয়ে ফিরে পেল
জেবন।
চোখ গোল গোল করে শোনে সকলে, বিশল্যকরণীর পাতার রস খেলে মহামারি ঠেকানো যায়!
- যায় বই-কি।
- আর কী গাছ আছে গো?
- কৈলাস গাছ আছে। ছোটো ছোটো পাতার গাছ,
কত রকমের রং। সেগুলো বড়ো গাছের নিচে জমে জমে
জন্ম নেয়। এই পাতার রস খেলে বুকের ব্যারাম সারে গো, রক্তচাপ কমে
যায়।
শুনে-টুনে গালে হাত দিয়ে অবাক লোক বলে - এত কিছু আছে আমাদের ভুবনডাঙায়?
- তব্বে! আরও শোনো, সেরার সেরা হল শ্বেত চন্দনের গাছ। পুরনো ভাঙা দেউল ঘিরে বেড়ে উঠেছে। ইয়া মোটা
মোটা চন্দন গাছ। কত বছরের পুরোনো কে জানে!
- শ্বেত চন্দন গাছ!
ভুবনডাঙার জঙ্গলে?
- ওই সেই রাবণ রাজার বংশধরেরা লাগিয়েছিল বোধহয়। শরীরের অনেক অসুখ সারিয়ে দেয়
চন্দন। চন্দন লাগিয়ে রাখত সারা গায়ে, কত যে এর উপকার, বলে শেষ করা যাবে না।
গল্পের মাঝে কে যেন বীভৎস
হাসি হেসে ওঠে। সকলে চমকে ওঠে, এমন হাসি শেষবার
শোনা গিয়েছিল পনেরো বছর আগে, যখন সেই ডাকাত পঞ্চানন এসে দখল
করেছিল ভুবনডাঙা। এখন শান্তির আনন্দের সুখের মাঝে এমন করাল হাসি হাসে কে? আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে বুক। অরণ্য ভরে আছে দুষ্প্রাপ্য দুর্মূল্য বৃক্ষ। একটি শ্বেত
চন্দন গাছ কেটে নিয়ে বিক্রি করলেই হয়ে যাবে কোটিপতি। কেউ খবর পেল? বাইরের দুনিয়া?
* * *
মধুমতী নদীর
ধার ঘেঁষে চলে গেছে প্রশস্ত রাস্তা। মাটির হলেও চকচক শক্ত। গাড়ি কেন বাস ট্রাক সব
যেতে পারে। পালাপার্বণে লোকজন যাতায়াত করে, বর্ষাকালে অসুবিধা হতে পারে ভেবে, পথঘাট নতুন করে বাঁধিয়ে দিয়েছে তোতনকুমার। মাটির সঙ্গে
মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল এমন সব উপকরণ, জলে ভেসে গেলেও রাস্তায় কাদা হয় না, শুকিয়ে যায়।
শীতের এক
সকালে সেই রাস্তা ধরে সার বেঁধে আসতে দেখা গেল মোটর গাড়ি। এক দুই তিন মোট পাঁচটা।
নদীর বাঁধানো ঘাট পেরিয়ে কড়াই খেত পাশে ফেলে গাড়ি গড়গড় করতে করতে এসে দাঁড়াল
রাজমহলের বিশাল উঠোনের সামনে। এমন আরামসে এল, যেন জানাই আছে, কোথায় বাঁক খেলে কোথায় মুখ ঘোরালে গাড়ি একেবারেই এসে যাবে মহলের সামনে।
ভুবনডাঙায় মোটর গাড়ি? তাও শীতের সাতসকালে? কাণ্ড অবাক হওয়ার মতো বটে। তোতনকুমার এখনও
ভিতর মহলে। ছোটো রাজকুমার সাধন আছে, সে এগিয়ে এল, ব্যাপার কী দেখার
জন্য। এগিয়ে এসে বলল - কী ব্যাপার?
চমকের পর
চমক। গাড়ি থেকে নেমে এল তার বাবা, সেই ডাকাত দলের সর্দার। এখন বুড়ো হলেও বেশ শক্তপোক্ত চেহারা। এক মুখ হাসি।
সাধন চিনতে পারেনি। পঞ্চানন এগিয়ে এসে বলল - কী রে, নিজের বাবাকে চিনিস না? এই যে এনারা সব এয়েছেন, বিরাট বড়োলোক, মহলের দরজা খুলে দিতে বল, ভিতরে বসবে।
সাধন দেখল, লোকগুলো নেমে আসছে গাড়ি থেকে। বেঁটে মোটা ফরসা ধূর্ত
চেহারার লোকগুলোর মুখ চকচক কামানো, চুল আঁচড়ানো, পরনে সিল্কের ধুতি পাঞ্জাবি, পায়ে পালিশ করা পাম্প-সু, ধুতির কোঁচা একহাতে ধরা, অন্য হাতে রুপো বাঁধানো লাঠি, বয়স সকলেরই পঞ্চাশের কোঠায়... পঞ্চানন এমন ভাব করছে, যেন বাড়িতে নিয়ে এসেছে, হাঁক ডাক দিয়ে বলছে - নিজের বাপকে চিনতে পারছিস না? তোর দোষ কী? ব্যাটারা আমাকে তাড়িয়ে তোকে অনাথ করে দিল।
সাধন গম্ভীর
গলায় বলে - কী চাই?
- কী চাই মানে? খেঁকিয়ে উঠল পঞ্চানন - দেখছিস গণ্যমান্য লোক নিয়ে
এসেছি, ওই তোতনকে ডাক, সেই তো এখন কাগজে কলমে মালিক নাকি?
- এখন দেখা হবে না। তিনি এখন
প্রার্থনা ঘরে। জগতের জন্য গাছপালার জন্য পশুপাখির জন্য প্রার্থনা করছেন।
- অ্যাঁ! ভুবনডাঙা কাঁপিয়ে রাক্ষসের মতো হেসে উঠল পঞ্চানন -
গাছের জন্য প্রার্থনা?
- কেন নয়? গাছ আমাদের পরিবারের সদস্য, দেশের সদস্য।
এই কথা শুনে
আটজন লোক আর পঞ্চানন এইসা হাসতে লাগল যেন দুনিয়ার সবচেয়ে আজব কথা বলল সাধন। গাছ
হল পরিবার? হি হি হিঃ হি হি হু হূ হি হি।
- শোন রে তোতনের চামচা, ভুবনডাঙার জঙ্গলে তিনশো রকম ওষুধের গাছ আছে আর আছে দেশের
সেরা সম্পদ শ্বেতচন্দনের গাছ। একটা গাছ এক কোটি টাকা। পালটে যাবে ভুবনডাঙা, চকচক শহর হবে, বিদেশি দোকান হবে, গাড়ি চলবে, হোটেল রেস্তরাঁ পানশালা... জঙ্গল ইজারা নিয়ে গাছ কেটে চালান দেব।
সাধনের মনে হল নেকড়ে বাঘের মতো লাফ দিয়ে পড়ে টুঁটি চেপে
ধরে লোকটার। ডাকাত পঞ্চানন! কোনোমতে দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল - পরিবারের সদস্যের গলা কাটব টাকার জন্য? গোটা ভুবনডাঙার সকলে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকি আমরা। এটাই
নিয়ম, সে নিয়ম ভঙ্গ করতে যদি কেউ আসে, তার কপালে আছে অনেক দুঃখ।
পঞ্চানন
অবাক। তার ছেলে সাধন এত বোকা! আরে, এই গাঁয়ে আছেটা কী? হ্যাঁ, ওই গাছগুলো আছে, সাতরাজার ধন মানিক।
ওগুলো থেকে ওষুধ তৈরি হবে, কারখানা হবে। পয়সায় লাল হয়ে যাবে। বোকা ছেলে এসব কী
বলে? সে খেপে গিয়ে বলে - ডাক তোতনকুমারকে। ডাক।
- চুপ করো। সাধন আর তোতন আলাদা নয়। গোটা গাছ তো দূরের কথা, একটা পাতা ছেঁড়ার কথা চিন্তা করলে সব কটা লাশ ভেসে যাবে!
কখন এসে
দাঁড়িয়েছে তোতনকুমার। সকালের আলো পড়ে অপরূপ দেখাচ্ছে তাকে। যেন গোটা গ্রাম জয়
জয় করে উঠল। বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে পঞ্চানন বলল - গাছ দেবে না?
- না। টাকার বদলে ঘরের লোক বেচব না, তুমি ফিরে যাও।
গাড়ির দিকে
যেতে যেতে পঞ্চানন বলল - না দিলে ছিনিয়ে নেব। দেখি, আটকাও কী করে?
* * *
পৌষ সংক্রান্তি এসে গেছে।
ভুবনডাঙার ঘরে ঘরে নতুন গুড়ের সুবাস, নতুন চালের পায়েস পিঠে, চারিদিকে উৎসবের আমেজ। গোবর লেপানো তকতকে মাটির উঠোন ভরে চালের গুঁড়ো গুলে
সাদা আলপনা, খড়ের চালের উপর কচি নধর লাউডগা, পৌষ লক্ষ্মীর
গান গাইছে সবাই, খেতে উপচে পড়ছে সোনালি ধান, গাই গরুর দুধের ফেনায় ভরে উঠছে
পিতলের বাসন।
কে কোথায় কবে এক সকালে এসে
চেঁচিয়ে গাছ কাটার কথা বলেছিল, ভুলেই মেরেছে লোক। সরল মানুষের এই
তো সমস্যা, তারা বড্ড তাড়াতাড়ি খারাপ সময় ভুলে যায়। আজ সকাল থেকে বড়ো কাঁসার থালায়
পিঠে সাজিয়ে জাম বাটিতে পায়েস দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জঙ্গলের দেউলে। সেখানে
আছে পান্তাবুড়ি,
আছে গঙ্গাভূত,
আর আছে বুড়ো বট। তাদের আগে দেওয়া হবে পিঠে, তারপর খাবে
গাঁয়ের লোক। সেজেগুজে লম্বা মিছিল করে যাচ্ছে গাঁয়ের মেয়েপুরুষ, মিছিলের সামনে আছে তোতন সাধন দুই ভাই। আজ তাদের পরনে লাল রঙের ধুতি, সবুজ
কামিজ, কোমরে নতুন গামছা কষে বাঁধা, খালি পায়ে ঘাসের শিশিরের আদর মেখে
চলেছে সব্বাই। আহা,
কী আনন্দ চারিদিকে। কী শোভা, কী মায়া।
হঠাৎ সমস্ত পরিবেশ ছিন্ন করে
বেজে উঠল পান্তাবুড়ির হাহাকার - ওরে কে কোথায়
আছিস, ছুটে আয় রে ছুটে আয়, সব্বনাশ হয়ে গেছে রে, ছুটে আয়।
তোতনকুমার ছুট লাগাল তিরবেগে, সাধন একটু পিছনে,
জঙ্গলের গভীর থেকে ডাক এসেছে। হায় হায়, পান্তাবুড়ির
কোমরের হাড় ভাঙল নাকি?
* * *
দৌড় দৌড়
দৌড়, চল চল চল।
হাঁফাতে
হাঁফাতে সকলে গিয়ে পড়ল যেখান থেকে চিল চেঁচান দিয়েছিল পান্তাবুড়ি।
পৌঁছে থেকে
চুপ করে আছে সকলে। হাতের গরম পিঠে ঠান্ডা পাথর, চোখ ফেটে দরদর অশ্রু, হাজার পাখির কিচির মিচির নেই, লাফানো হরিণের দুষ্টুমি নেই, কালো বাঘের তর্জন নেই, গাছেদের সরসর ঝরঝর নেই। হল কী?
তোতনকুমারের
মুখ দেখে মনে হচ্ছে মাথার উপর ভেঙে পড়েছে গোটা আকাশ। চাপা গলায় বলল - কে করতে পারে এমন কাজ?
সাধনের চোখ
ছলছল। প্রাচীন দুটো শ্বেতচন্দনের গাছের গুঁড়ি থেকে পুরো গাছ কেউ কেটে নিয়েছে
নিখুঁত করে। গুঁড়ি দুটো পড়ে আছে অনাথের মতো। সাধনের চোখ জ্বলছে। হিংস্র গলায় বলল - আমার বাবা আর তার দলবল।
- গঙ্গাভূত কিছু টের পেল না? সাপ বাঘ কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারল না? পান্তাবুড়ি, তুমি তো জেগেই থাকো, এতবড়ো কাণ্ড হল, কী করছিলে তুমি তখন?
হাহাকার
বেজে ওঠে গাঁয়ের লোকের গলায়।
সত্যি তো! কেউ টের কেন পেল না? তবে কি নিদালি ওষুধ ছড়িয়ে দিয়েছিল বাতাসে?
- তাই হবে দাদা। শহরে এমন হয় গো।
ঘুমের ওষুধ ছড়িয়ে দিয়ে ডাকাতি করে, কেউ জানতে পারে না।
নিদালি ওষুধ? তাই যদি হয়, তবে তো গাছের পর গাছ কেটে ফাঁকা করে দেবে, কেউ জানতে পারবে না।
হায় হায়
হায় হায়
হায় হায়
অরণ্য জুড়ে
বিষাদের সুর ছড়িয়ে পরে নবান্নের দিনে। মনে পড়ে যায়, পঞ্চাননের রক্তচক্ষু...
- এত গাছ গাছ করছ, টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে দেব ওদের। ক্ষমতা থাকে রক্ষা
করো।
তোতনকুমার
চোখ তোলে, প্রিয় গাছগুলো মাথা ঝুঁকিয়ে
আছে, অসহায়। এরা নিজেরাই জানে না, কত দামি এরা, কত ওষুধ ধারণ করে আছে, এদের মাংস হাড় কাজে লাগবে মানুষের স্বার্থে। হায় হায়।
কেউ ঘুমোবে
না আজ থেকে। সর্ষের তেল চোখে লাগাও।
বলে ওঠে
তোতনকুমার।
সাধন চালাক
ছেলে। সে বোঝায়, এ ঘুম তোমার আমার
ইচ্ছেয় হবে না। বাতাসে ছড়িয়ে দেবে ঘুমের ওষুধ। শ্বাসের মধ্যে দিয়ে মাথায় ঢুকে
যাবে।
পান্তাবুড়ি
বলে গঙ্গাভূতের ঘুম নেই। ও জেগে পাহারা দিক। নাকে গামছা বেঁধে নাও সকলে।
ঠিক ঠিক।
নাকের গামছা খুলবে না কেউ। বিষ ঢুকবে না তবে।
* * *
সন্ধ্যা নামছে। থমথম। বাচ্চা বুড়ো ঘুম দিচ্ছে। যুবকদের সকলের নাকে গামছা
বেঁধে রাখা। ছোটো ছোটো দল দিচ্ছে পাহারা। হাতে লাঠি। আসুক দেখি কে আসবে, কারা আসবে। হিম
পড়ছে রূপসার জলের উপর। মিহি সরের মতো কুয়াশা নামছে। ঘরে ঘরে কুপির আগুন জ্বলছে। সারা শরীরে আলো জ্বালিয়ে গঙ্গা ভূত উড়ে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। আসুক ব্যাটা গাছচোর। প্রাণ নিয়ে ফিরতে হবে না। তোতনকুমারের
মনে হল, গাছগুলি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গায়ে গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অরণ্য
অন্ধকার হয়ে আসছে অথচ একটিও শব্দ নেই। পাতায় বাতাস বেজে উঠছে না। গতরাতে হত্যা
করা হয়েছে দুটি নিরীহ প্রাণকে, কেউ যেন ভুলতে পারছে না সেই আতঙ্ক।
এত পাহারা এত প্রস্তুতি এত
কিছু করেও ভোর রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল গোটা গ্রাম। সেই সময় চুপিচুপি এল চোরের দল। শ্বেত চন্দন! পৃথিবী সেরা গাছ
হাতের মুঠোয় পেয়ে জিভ লকলক চোখ চকচক। চাই আরও চাই। গোটা অরণ্য চাই। দরকার হলে, বোম দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হবে ভুবনডাঙা। গাছ চাই। যে করেই হোক।
* * *
ঘুমন্ত
গ্রাম। মানুষরূপী লোভ এগিয়ে আসছে... জিভ দিয়ে জল পড়ছে টপটপ টপটপ। শব্দহীন হিংস্রতায় এগিয়ে চলে, সঙ্গে আছে ধারালো দাঁতের করাত।
কেউ জেগে
উঠছে না? ওরা যে এসে পড়ল অরণ্যের
সীমানায়? ভেজা ভেজা মাটিতে পড়ছে পায়ের
ছাপ, এগিয়ে এসেছে, এইবার ঢুকে যাবে, সো-ও-জা চলে যাবে ভাঙা দেউলের পাশে, শ্বেতচন্দন বৃক্ষের কাছে। কী হবে এইবার?
কুয়াশার
চাদরের আড়াল থেকে চুঁইয়ে পড়ছে চতুর্দশী চাঁদের আলো। অলৌকিক রাত গভীর থেকে
গভীরতর। অরক্ষিত বনভূমির সীমানা ঘিরে মহাবৃক্ষের গম্ভীর প্রহরা।
অদ্ভুতভাবে
শরীরে শরীর সংযুক্ত তাদের। যেন কঠিন কঠোর প্রাচীর। বলিষ্ঠ শিকড় শাখা প্রশাখা একে
অপরকে আঁকড়ে ধরে আছে। হতভম্ব লোভীর দল এদিকে দৌড়ে যাচ্ছে ওদিকে দৌড়ে যাচ্ছে, মোটা মোটা পাতার ঝুরি ভেদ করার ক্ষমতা হচ্ছে না ধারালো
করাতের। সামান্য কেটে ফেলেছিল যেই, সাংঘাতিক
জোরে নেমে এল পাতার ঢল ওই ফাঁক পূরণ করতে।
ফিসফিস করে
লোকগুলো বলল - জোর করে ঢুকে পড়ো ভিতরে। পঞ্চানন, করাত চালিয়ে যাও তুমি।
- আমি!
আমতা আমতা
করে বলে পঞ্চানন - আমি একলা?
- তুমিই যাবে, কত টাকা দিয়েছি, মনে নেই? যাও। তোমার পিছনে আছি আমরা।
করাত সামনে
রেখে পাতার ঘন আস্তরণ ভেদ করে ঢুকতে গিয়ে আর্তনাদ করে উঠল পঞ্চানন। ঝুর ঝুর করে
নেমে এসেছে সরু সরু লতা, পেঁচিয়ে নিয়ে নিমেষে তুলে নিল তাকে, মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল ডাকাত পঞ্চার পুরো শরীর।
কী কাণ্ড! থর থর করে কাঁপতে লাগল বাকি লোকগুলো। মনে হতে লাগল, লম্বা ডাল ধেয়ে আসছে গলা টিপে দেওয়ার জন্য।
ভৌতিক কাণ্ড। এখানে থাকা নিরাপদ
নয়।
পালাও সবাই।
গ্রামবাসী জেগে উঠলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে।
করাত
গুটিয়ে পিছু হটে গেল চোরের দল।
* * *
সূর্যের
রাঙা আলো বুকে নিয়ে জেগে উঠল সারা গ্রাম। গতরাত মরণ ঘুমে ধরেছিল সবাইকে। অভিশাপ
ঘিরে ধরেছিল - আজ আর লজ্জায় মুখ তুলতে ইচ্ছে
করছে না। তোতনকুমার
ভাঙা গলায় বলল - সাধন, আমি হেরে গেলাম।
সাধন অবাক
গলায় বলল - দাদা, লুঠেরা কোথায়? ঐ দেখ, আমাদের জঙ্গল কেমন আগের মতো
আনন্দে হাসছে, সব তো আগের মতো।
সক্কলে হৈ
হৈ করে উঠল, ঝাঁপিয়ে এল পশুপাখি, মানুষজন, ঢম ঢম বেজে উঠল ঢোলক, গরম গরম পিঠে ভাজা হতে লাগল।
কেবল, তোতনকুমার গম্ভীর হয়ে রইল, রহস্য একটা রয়ে গেল বটে। তবে, ভুবনডাঙায় অনেক কিছু ঘটে। মনের চোখে দেখলে সমস্ত পরিষ্কার
বোঝা যায়। তাই না? তোমরা কী বলো?
----------
ছবি - শ্রীময়ী
ম্যাজিক ল্যাম্প
অসাধারণ
ReplyDelete