বরাভয়
শরণ্যা মুখোপাধ্যায়
।। ১।।
আজ অনেকগুলো ফলপাকুড় জুটেছে। কাছের বাড়িগুলোয় যারা থাকে, আগে ওরাই দিত। এখন তো সব বন্ধ। তবে আজ কিনা মঙ্গলবার, তাই আজ আমার কিছু খাবারদাবার জোটে এখনও। ওরা আমাকে খুব ভালোবাসে তো! কেউ কেউ আবার ফুলও দেয়! ওই হলুদ-হলুদ ফুলগুলো দেয়। আমার ফুল ভালোই লাগে। বিনুটা এদিক ওদিক দৌড়োদৌড়ি করে, ফুল গাছ ছেঁড়ে, আমি জানি। আমার ভালো লাগে না। ওকে বলেওছি অনেকবার, এসব না করতে। কিন্তু ওর বয়েসটা কম। তাই, একবার শুনে সুবোধ বালকের মতো ঘাড় নাড়ে, তারপরই ভুলে যায়। হয়তো এই বসে পাঠগান শুনছে লক্ষ্মীছেলের মতো; একটু বাদেই মন্দিরের ওপাশে পুরুতমশায়ের ঘরের সামনে যে ছোট্ট বাগানখানা আছে সেখানে গিয়ে পুটুং পুটুং করে দু’খানা নতুন গাছের চারা ছিঁড়ে দাঁতে কাটবে। এইজন্যই ওকে একা দেখলে বাকিরা তাড়া করে। তবে কিনা ওর বয়স কম। তাই আমি বেশি কিছু বলি না। কিন্তু
আমার জাতভাইরা তো অত কথা শুনবে না। তাছাড়া ও নিজের একটা দলও বানিয়েছে এর মধ্যেই। পঞ্চু, লম্বু, পুলু, সব ক’টা দামাল একজায়গায় হয়েছে। তাই একসঙ্গে থাকলে ওদেরকে এরা কেউ কিছু বলে না। আমিও ভাবি এই-ই ভালো। দল বেঁধে থাক। একা থাকলে তো…
মন্দিরের এই চাতালটা আমার বড়ো প্রিয়। জানি না কবে এসেছিলাম এখানে। গুণতে জানি না তো। তাই বছর বলতে পারব না। তবে একথা বেশ মনে আছে যে সেটা ছিল চৈত্রমাসের ঝড়জলের রাত। চারদিক ঘুরঘট্টি করে মেঘ করেছিল। আমরা আগে যেখানে থাকতাম সেই জায়গার বিশাল আমবাগানের গাছগুলো হুলুস্থুলুস করে মাথা নাড়ছিল। ওদিনই কালুবিলুর দলের সঙ্গে আমাদের খুব ঝামেলা হয়েছিল। বাবাকে ওরা খুব মেরেছিল। ঠেলে ফেলে দিয়েছিল রানাজেঠুদের পাঁচিলের ওপারে। বাবার মাথা ফেটে গিয়েছিল। হুলহুল করে রক্ত বার হচ্ছিল। মা আর পুনুমাসি বুঝতে পেরেছিল ওদের সঙ্গে পারবে না। আমাদের ও জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। ওরা দলে ভারী ছিল।
সে রাতে আমাদের বাকি সবাই কোথায় না কোথায় ছড়িয়ে পড়েছিল। মা আমাকে বুকে করে নিয়ে জোর দৌড়েছিল। মা বলত আমি নাকি তখন এক্কেবারে দুধের বাছা, আমরা যতই দূরে যাচ্ছিলাম ততই কালুবিলুর দলের ছোঁড়া ঢিলগুলো ফসকাচ্ছিল। দূর থেকে ভেসে আসা ওদের খিচখিচে হাসিটা আমার আজও মনে আছে। সেই রাতেই মা আমায় নিয়ে এই মন্দিরে এসেছিল। তখন প্রায় ভোররাত। কারও থাকার কথাই নয় তখন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল সেদিন সেই সময়েও দু-তিনজন ছিল মন্দিরে। মন্দির সাজানো হচ্ছিল। ওই হলুদ ফুলগুলোও ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে মায়ের তখন ঝুপ্পুস অবস্থা। ঠান্ডা হাওয়ায়
ঠকঠক করে কাঁপছিল মা। তবুও আমাকে বুকের মধ্যে এমন জড়িয়ে রেখেছিল যে আমার একটুও শীত করেনি। শীত করল তখন, যখন মা আমাকে নামিয়ে রাখল আমাদের মন্দিরের ছোটো পুরুতমশায়ের পায়ে। পিছন থেকে তখন বড়ো পুরুতমশাই একটা একটা করে প্রদীপ জ্বালাচ্ছিলেন। ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় দুলদুল করে সেই প্রদীপের নরম শিখাগুলো দুলছিল আর মন্দিরের কোণে কোণে থাকা আঁধারগুলোও এদিক-ওদিক ছুটে পালাচ্ছিল। পুরুত ঠাকুরের দিকে চেয়ে মা অনেক কিছু বলতে চেষ্টা করেছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু বলতে পারেনি। তাঁর পায়ের কাছে শুয়ে আমি দেখছিলাম মায়ের চোখ দুটো। কেমন টলটলে কালো দুটো কাঁচের গুলির মতো চোখ! হাত দুটো বুকের কাছে জড়ো করে মা তাকিয়েছিল পুরুতঠাকুরের দিকে।
ঠাকুরমশাই খুব ভালোমানুষ। আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন এখানে। কিন্তু মাকে আর কখনও দেখতে পাইনি।
পরে ওদের কথা শুনে বুঝেছিলাম সেদিন আমাদের গুরুঠাকুরের জন্মজয়ন্তী ছিল।
।। ২।।
এতদিনে অনেককিছুই দেখলাম। আমার আসার পর আরও কত লোক এল। বড়ো ঠাকুর আর ছোটো ঠাকুর অবশ্য ছিলেন টানাই। প্রথম প্রথম মায়ের কথা খুব মনে পড়ত। আমার একটা দাদা ছিল। তার কথাও খুব ভাবতাম। আর সেইসব ভাবতে ভাবতে চুপ করে বসে থাকতাম ঠাকুরের মূর্তি যে ঘরটায় থাকে, তার পিছনের সরুমতো জায়গাটায়। ওখানে চট করে কেউ যায় না। কেউ কিছু দিলে খেতাম, না দিলে শুয়েই কাটিয়ে দিতাম সারাবেলা।
এই করতে করতে বেশ ক’টা দিন কেটে গিয়েছিল। খাবার-দাবার তেমন না পেয়ে খুব রোগাভোগাও হয়ে যাচ্ছিলাম। একদিন খুব রোদে ঝিম মেরে বসেছিলাম। গা পুড়ে যাচ্ছিল, তাও বসেই ছিলাম। ছোটোঠাকুর এসে আমার মাথায় হাত রেখেছিলেন। তারপর ডেকে নিয়ে গিয়ে খিচুড়ি খাইয়েছিলেন। তারপর থেকে রোজ আমাকে নিজে হাতে খাওয়াতেন ছোটোঠাকুর। শুধু ছোটোঠাকুরই নয়। এখানে আরও একজন আসত। ছোটোঠাকুর তাকে ডাকত বৈদেহী মা বলে। বৈদেহী মা আমাকে সলতে দিয়ে দুধ খাওয়াত। “আমার ছোট্ট লালা” বলে কোলে নিয়ে দোল খাওয়াত মা। খুব দুর্বল হয়ে গেছিলাম তখন। মায়ের দুটো বাচ্চা ছিল। আমার থেকে একটু বড়োই। ওদের নিয়েই মা আসত রোজ। আমার দেখভাল করত। ছোট্ট ভাইদুটোর সঙ্গে খেলতুম তখন।
এইভাবেই আস্তে আস্তে মানিয়ে নিলাম। সকালে পুজো হত, দুপুরে ভোগ, আর বিকেলে নামগান। এখানেই বসে থাকতাম। ভালোই লাগত। তারপর আগের পুজোর সময় বিনু এল। ও-ও খুব বাচ্চা অবস্থায় এসেছিল। এখন একটু বড়ো হয়েছে। আরও কেউ কেউ ওর সঙ্গে জুটে গেল। এখন বড়ো দল করেছে ওরা। আমি এখানেই থাকি নিজের মতো। ওদের সঙ্গে অত হাঁকডাক পোষায় না আমার। কিন্তু ছোট্ট থেকে বিনুকে দেখেছি তো! ও তাই আমাকে ছাড়ে না।
আমার ভালো লাগে না এখন। ওদের দেখে আমার খুব ভয় হয়। ওই কালুবিলুর দলের মতো দিন দিন ওরা কেমন যেন রাগী হয়ে যাচ্ছে। দিনকাল খুব খারাপ। এরকম সময়ে ভয় পেতে হয়, ভয় পেয়ে থাকতে হয়। বেশি চেঁচামেচি করতে নেই, উঁচু গলায় কথা বলতে নেই। আমি খুব ভীতু। ভীতুই। তবু বিনুর টানটা কাটাতে পারি না। ওরা যাই করুক, আমার নিজের লোক বলেই শেষপর্যন্ত সঙ্গে থাকি।
আগে তবু খাওয়াটা নিয়মিত ছিল। কিন্তু শেষ ক’টা দিনে আমাদের জাতভাইদের যা সব হচ্ছে। চারদিক শুনশান হয়ে গেছে। ওই সামনের রাস্তা দিয়ে আগে কত বড়ো বড়ো বাসগাড়ি, মোটর, তারপর আরও কীসব গাড়ি যেত। লোকজন হুলহুল করে যেত। ক’দিন সব বন্ধ। কী নাকি রোগ এসেছে। কেউ কাউকে ছুঁলেই নাকি বিপদ। আমাদের জাতভাইরা তাই সবাই গাছে গাছে ঢুকে গেছে। কে কোথায় আছে, কেউ জানে না। বনজঙ্গলও তেমন নেই কিছু। ওদের কাজের জায়গা-টায়গা সব বন্ধ। আগে বাইরে বার হলে দু-চারটে কলা-টলা এমনিই পেতুম। মন্দিরে এসেও লোকে দিত। এখন সবই বন্ধ। ছোটো পুরুতমশায়ের সেই রোগটা হবার পর থেকেই।
খাওয়ার খুব অসুবিধে হয়েছে। আমি তবু বড়ো হয়েছি। বুঝি। খিদের জ্বালা সহ্য করি। কিন্তু বিনুরা তো ছোটো, ওরা পারে না। এর বাগানে গাছ ছেঁড়ে, ওর বাগানে ফল চুরি করে। আমাকেও এনে দেয়। মন্দিরে পুজো-টুজো কবে থেকেই হয় না। ভোগ হবে কোথা থেকে। তাই আমি খাই, ওরা যা এনে দেয়। আর মাঝে মাঝে যাই ওই দূরে কোণের বাড়িটায়। ওটা বৈদেহী মায়ের বাড়ি। এখন ওতে শুধু মা আর ভাইয়েরা থাকে। আগে অনেকে ছিল। মা এখনও আমাকে দেখলে চালটা-মুলোটা দেয়। তবে কতদিন দেবে? মায়ের অবস্থা আর আগের মতো নেই। আমি জানি আমাদের জাতভাইয়েরা ওদের গরিব বলে। আমাদের তো গরিব–বড়োলোক বলে কিছু হয় না! শুধু পেট ভরলেই খুশি। তারপর নামগান শুনি, হাততালি দিই! ব্যস! কিন্তু আমার মা’কে বলতে শুনেছিলাম। ওদের অনেক নিয়ম। অনেক শব্দ আছে ওদের। তার অনেক অনেক মানে। উঁচু-নিচু, আমি-তুমি, গরিব-বড়োলোক… আমি অত শব্দও জানি না, ওগুলোর মানেও না। কিন্তু সব সময় কি শব্দই জানতে হয়? বড়ো বড়ো মানুষগুলো যেন কেমন! মনে মনে কি বোঝা যায় না কিছু?
আমি তো জানি বৈদেহী মায়ের হাতেও কাজ নেই। আর কাজ না থাকলে ওরা মোটে খেতে পায় না। মা এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে ঘুরে কীসব কাজ করত আগে। এই পোড়া রোগ আসার পর সেটাও বন্ধ। মায়ের কাছে কেউ আসেও না। ভাই দুটোও এখন পড়াশোনা শিখতে যায় না। ওরা নিজেরাই খেতে পায় না, তো আমাকে কী দেবে! তাও আমি গেলে দেয় কিছু কিছু। কিন্তু আমিই যাই না। লজ্জায়। তাছাড়া ও পাড়ায় আমাকে দেখলে এখন লোক তাড়া করে। তার কারণটা অবশ্য বিনু। আমি যে ওদের বাগানের ফল চুরি করি না সে আর বোঝাব কী করে! ওরা আমাদের ভাষাও বোঝে না! কিন্তু আজ একবার যাবার ইচ্ছে আছে। ক’দিন যাইনি যে! না না, শুধু খাবার জন্য না। আসলে মাকে দেখতে ইচ্ছে করে!
।। ৩।।
ভাগ্যিস গিয়েছিলাম আজ। মা খুব খুশি হয়েছিল। ওরা কী কেস না কী জিতেছে। কী সব মামলা না কী যেন হয়েছিল। মানুষদের কত্ত কাজ! কত্ত বড়ো বড়ো ব্যাপার! মায়ের সব কিছু নাকি অন্য লোকে নিয়ে নিচ্ছিল। তার জন্য মা-ও লড়ে গিয়েছিল। নিজের জন্য না। আমি জানি। ভাই দুটোর জন্যই। মা আজ আমাকে দেখে খুব খুশি হয়েছিল। পাড়ার হারাণদাদু যদিও লাঠি বাগিয়ে তেড়ে এসেছিল।
“মুখপোড়া হনুমান, আবার এসেছিস!”
আরেকটু হলেই আমার মাথায় পড়ত! মা বাঁচাল! সঙ্গে সঙ্গে যদি বার হয়ে না আসত! আচ্ছা, আমাদের জাতভাইগুলো এত রাগি হয় কেন? আমি তো কিছুই করিনি। দাদুকে আমি কী আজ চিনি! সেই ছোট্টবেলা থেকে দাদুও মন্দিরে যায়! শুনলুম একদিন আগে নাকি বিনু ওর দলবল নিয়ে দাদুর বাগানে হামলা করেছে! খুব দুঃখ পেলুম। কিন্তু, আমি কী করব! আমার যে বিনুকে আটকাবার ক্ষমতাই নেই। আমি তো চুপচাপ থাকতেই চাই। কী জানি, বিনুও তাহলে কালুবিলুর মতোই… কিন্তু সে সব ভুলেই গেলুম মা যখন গরম ভাত, আলুসেদ্ধ আর ডাল খাওয়াল। ওফ! কতদিন বাদে ভাত খেলুম। কী যে ভালো লাগল! মা মাথায় হাত বুলিয়ে কত্ত কথা বলল। তারা নাকি টাকাপয়সা পেয়েছে। সে দিয়ে নাকি সব কিছু পাওয়া যাবে। খাওয়া যাবে। ভাই দুটোও এল। ওরা অবশ্য বড়ো হয়ে গিয়ে আমার সঙ্গে অতটা আর মেশে না।
আচ্ছা, তোমরা বড়ো হয়ে গেলেই অন্যরকম হয়ে যাও কেন বলো দেখি? আমি তো আর বদলালাম না! এসবই ভাবছি এখন মন্দিরে বসে! সন্ধে হয়ে এসেছে। আজও ঝড় হবে মনে হচ্ছে। আগের মতো পাঠ-গান কিছুই হয় না, কেউ আসেও না। বড়ো পুরুতমশায়ের বয়স হয়েছে, উনিও শুধু একবারই আসেন, সকালবেলাটায়, পুজো দিয়ে নমো নমো করে চলে যান। তবে আজ আমার আর তেমন কিছু চাই না। এখন একবার খেলেই হয়! বেশি খেতে ইচ্ছেও হয় না। বিনুটাও আজ আর এল না। আস্তে আস্তে রাস্তার ওপাশের বাড়িগুলোর সাদা সাদা আলোগুলোও নিভে আসছে দেখে ভাবলুম যাই, এবার শুয়ে পড়ি!
আহ! চাতালটা সকাল-সন্ধে ধুয়ে দিয়ে যায় ও পাড়ার চায়ের দোকানের বিশু। ওর আর কোনো কাজ নেই এখন। দোকান বন্ধ! পুরুতমশাই-ই ওকে রেখেছেন। কী চমৎকার ঠান্ডা! আজ কী গরমটাই না গেছে! এবার মনে হয় বৃষ্টি হবে। ঘুম আসবে মনে হয়! চোখটা বুজেছি কি বুজিনি, বিনু আর ওর দলের চারটে দামাল এসে হাজির। ওদের দেখলেই আমার এখন কেমন যেন ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। বিনু অবশ্য কেবল কিছু ফলমূল দিতেই এসেছিল। তখনই দেখলুম!
আরে! এ তো বৈদেহী মায়ের বাড়ির পেয়ারা! এ আমি খুব চিনি! মাথায় রক্ত উঠে গেল! ফলটা ছুঁড়ে ফেলে ওকে এক ধমক দিলুম! কিন্তু বিনু তাতে যা বলল, শুনে আমার হাত-পা সব ঠান্ডা হবার জোগাড়! ও নাকি মায়ের গাছ থেকে কিছুই নেয়নি! গাছটা কাটা অবস্থায় পড়ে ছিল রাস্তায়! কী হল ব্যাপারটা! ঘুম মাথায় উঠল। সঙ্গে সঙ্গেই বার হলুম! ব্যাপার বুঝে বিনু আর ওর সাঙ্গোপাঙ্গরাও সঙ্গে এল! আমাকে ভরসা নেই আসলে! রাতবিরেতে!
যাই হোক! পৌঁছোলুম যখন তখন দেখি মায়ের বাড়িতে তুলকালাম চলছে! ষণ্ডামার্কা বেশ ক’টা লোক মায়ের ঘর থেকে সব জিনিসপত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে। দু’জন চেঁচাচ্ছে! টাকার ব্যাগ কোথায় আছে সেটা জানতে চাইছে! বলছে মামলা জিতলে কী হবে! মাকে ওরা এখানে থাকতে দেবে না! বড়ো কোর্টে নাকি আবার মামলা করবে! মা বার বার বলছে মায়ের কাছে আর কিচ্ছু নেই! কিন্তু ওরা সে সব শুনলে তো! মা আর ভায়েরা এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে! পাড়ার বাকি সব বাড়িগুলো চুপচাপ, শুনশান। কেউ যেন কোত্থাও নেই। আরে এরা সবাই এত্ত ঘুমোচ্ছে! এত চিৎকারেও সাড়া দিচ্ছে না কেউ!
হঠাৎ শুনি ছোটো ভাইটা বলছে, “হনু ঠিক আসবে! আমাদের বাঁচাতে!”
শুনেই আমার শান্ত মাথাটা বোঁ করে ঘুলিয়ে গেল! কী যেন হয়ে গেল! ও তো চিরকাল আমাকে
হনু বলেই ডাকত! ওরা কত্ত খেলা করেছে আমার সঙ্গে! ওরা আমাকে আমাদের গুরুঠাকুরের মতো ফুল দিয়েছে! আমায় কত্ত ভালোবাসে! ঝড়টা ভালোই উঠেছে! ঠিক সেই রাতের মতো! যেদিন আমাদের কালুবিলুর দল… ভাবতে ভাবতেই কখন যেন রাস্তা থেকে ঢিল তুলে নিয়েছি! আমার দেখাদেখি বিনুরাও যে যা হাতের কাছে পেয়েছে, তুলেছে! ব্যস! তারপর আর কী! বিনুগুলো দামাল, আগেই বলেছি। ঝড়ের সঙ্গে বাজ আর বিনুর দল! এলোপাথাড়ি ঢিলগুলো কোথা থেকে আসছিল ওরা বুঝতেই পারেনি শুরুতে! আর ভাঙা পেয়ারা গাছের ডালটাও কাজে এল! বিনুর দলের আঁচড়ে কামড়ে ততক্ষণ ওরা অস্থির হয়ে পালাতে আরম্ভ করেছে! বীরবিক্রমে কীভাবে বিনুরা মোকাবিলা করল গুণ্ডাগুলোর! আমি দু’চোখ ভরে দেখছিলুম! কিছুক্ষণের মধ্যেই সাফ হয়ে গেল ওরা!
আস্তে আস্তে বৈদেহী মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম আমি! অনেক কিছুই বলতে চাইছিলুম! বলতে চাইছিলুম মা, তোমার কোনো ভয় নেই! আমার মা আমায় বলেছিল, মানুষরা নাকি আমাদেরই কীরকম জানি জাতভাই! সেই কোন বিদেশি সাহেব নাকি বলে গেছে! আমি তা মানি! মানুষগুলো যেন কেমন! ওরা মনে হয়, মানে না সাহেবের কথা! আমি কিন্তু মানি আমার মায়ের কথা!
“…আমি আছি মা! আমি দেখব তোমায়! যেমন আজ দু’চোখ ভরে দেখলুম বিনুকে! কেমন ওরা দুষ্টুগুলোকে তাড়াল। আমার আর বিনুকে দেখে ভয় করছে না মা। ওরা কালুবিলুদের মতো হয়নি! ওরা ভালো হয়েছে! ওরা শক্তিশালী হয়েছে। শক্তির খুব দরকার! ওরা ভীতু হয়নি! ওদের সাহস দেখে আমিও সাহসী হয়ে গেছি মা!...”
অনেক করে মা’কে কথাগুলো বোঝাবার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু মা যে কিছুই বুঝতে পারল না! তোমরা মানুষরা আমাদের কথা বোঝ না কেন বল তো? আমরা তোমাদের কথা দিব্যি বুঝি! ঠিক তখনই দেখলাম মা তাকিয়ে আছে আমার মাথার দিকে! কী ব্যাপার! বোঝার চেষ্টা করতে গিয়েই টের পেলুম! ও হরি! কেউ একটা বাড়ি মেরেছে আমার মাথায়! কখন মারল রে বাবা! খেয়ালই হয়নি! হাত দিয়ে দেখলুম বেশ রক্ত বার হচ্ছে! মায়ের চোখ ছলছল করছে! মা সামনেই পড়ে থাকা নিজের একটা কাপড় তুলে আমার মাথাটা চেপে ধরল! আমি আস্তে আস্তে বসে পড়েছি! না, শুয়ে পড়েছি! মায়ের কোলে আমার মাথা! ঠিক সেই রাতটার মতো! নিচে থেকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি মায়ের টলটলে চোখের তারা। আমি এইবার বুঝতে পারছি, মা আমার সব কথা বুঝতে পেরেছে! আমাকে ঘিরে রয়েছে বিনুর দলবলেরা!
চোখ বুজলাম। আমি জানি আমি খুব তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাব। আর গরম নেই। বৃষ্টি নেমেছে।
----------
ছবি – লাবণি চ্যাটার্জী
ম্যাজিক ল্যাম্প
No comments:
Post a Comment