চাঁদের গায়ে
অনসূয়া চন্দ্র
বিকেলটা আজ কাটতেই
চাইছে না
ঝিলমিলের।
কাচের
জানলায়
হাত
রেখে
সে
আকাশে
চোখ
রেখেছে। আজ মেঘলা,
একটু হাওয়া হাওয়া দিচ্ছে। দূরে
পাইন
গাছগুলো
গুটিয়ে
আছে। পাহাড়টাকেও
স্পষ্ট
দেখা
যাচ্ছে না। কেমন
ধোঁয়া
ধোঁয়া
চারপাশ।
মা পার্কে
যেতে
দিল না। দু’দিন
ধরে
অবশ্য
তার
জ্বরও
ছিল। এমনিতে
পর্দা
সরিয়ে
আকাশ
দেখতে,
প্লেন গুনতে ঝিলের ভালোই
লাগে।
পাহাড়ের
ওই
মাথা
থেকে
এই
জানলা
যদি
একটা
রোপওয়ে
থাকত কী
যে
মজা
হত! বাবাকে
বলতেই
বাবা
শুধু খ্যা
খ্যা করে হাসে।
কিন্তু দশ মিনিটও
হয়নি
সে
দাঁড়িয়েছে, সবে
একটা
প্লেন
গেল। এর মধ্যেই
আবার
সেই
বিরক্তিকর,
ভয়মাখানো কান্নার আওয়াজটা!! কাচের
জানলা
ভেদ
করে
তার
কানে
পৌঁছালো।
ঝিলমিল জানে
কে
কাঁদে
এইসময়, সে
এও
জানে
কেন
কাঁদে। তবুও
এমন
সজাগ
চিৎকারে
তার
ভয়
করে,
খুব ভয় করে। কান্না
কান্না
দলা
পাকিয়ে
আসে। সে একছুট্টে
‘মা’ ‘মা’
করে বাইরের ঘরে চলে এল।
তিন তলার
ব্যালকনি
থেকে
ছেলেটার
ঘর
স্পষ্ট
দেখা
যায়। বয়সে
ঝিলমিলের
থেকে
দুই-তিন
বছরের বড়ো বলেই মনে হয়। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুলগুলো
রাবার
ব্যান্ড দিয়ে টাইট করে আটকানো, গায়ের
রং
বেশ
কালো,
নাক টিকালো, চোখ দুটো
বড়ো
বড়ো
আর
হাসিটা
খুব
বন্ধু
বন্ধু।
ঝিলমিলদের উলটোদিকের
দোতলার
ঘরে
ওরা
থাকে। ঝুঁটি
দাদার
ব্যালকনিতে
কোনো
গাছ
নেই,
একটা জামা-কাপড় শোকানোর
র্যাক,
দুটো সাদা প্লাস্টিকের চেয়ার,
একটা কার্পেট পাতা। দিনরাত
দাদাটা
একবার
ঘরে
একবার
বাইরে
দাপিয়ে
বেড়ায়। আর আ আ করে কী যে বলে চলে,
ঝিল কিছুই বুঝতে পারে না।
ওর খুব ইচ্ছে
করে
দাদাটার
সঙ্গে
খেলতে, গল্প
করতে। কখনও
ওরা
দু’জনেই যে
যার
ব্যালকনিতে
নেচে
বেড়াচ্ছে
উলুক
পুলুক
করে,
এ
ওকে
দেখছে;
কিন্তু কথা হয় না কোনোদিন।
মা বলেছে
ওরাও
ইন্ডিয়ান। তবে
দেশের
সাউথে
থাকত
বলে
ওরা
সাউথ
ইন্ডিয়ান। আমাদের
দেশ
এক
হলেও
খাওয়াদাওয়া,
ভাষা, জামাকাপড় সব নাকি
আলাদা। কী অদ্ভুত
লাগে
না!
ঝিলমিলরা এখন যে দেশে
থাকে, মানে
আমেরিকাতে
এরকমটা
প্রায়
দেখা
যায়
না। এদের
দেশীয়
লোকেরা
বেশিরভাগ
ইংরেজি,
কেউ কেউ স্প্যানিশ বলে।
মা’র
সঙ্গে
ওদের
কোনো
আলাপ
নেই। তবুও
ওদের
ভাষা
শুনেই
মা
বলে
দিল
ওটা
তামিল
বা
তেলুগু
হবে। মাকে
ঝিল
বলেছিল,
“আমাকে একটু তামিল বা তেলুগু
শিখিয়ে
দেবে?”
মা
হেসে
বলেছিল,
“ধুর্ পাগলি, সে আমি জানি
নাকি!!
এই ইংরেজ দেশে আগে নিজের
মাতৃভাষাটা
টিকিয়ে
রাখ।”
বড়ো গোলমেলে
লাগে
ঝিলের। স্কুলে
সবাই
ইংরেজিতে
কথা
বলে। ঘরে
বাবা-মা
বাংলায়। পার্কেও
বন্ধুরা
মানে
বাঙালি-অবাঙালি-আমেরিকান-মেক্সিকান
সবাই
ইংরেজিতে
কথা
বলে, বেশিরভাগ
আন্টি-আঙ্কেল
নিজেদের
মধ্যে
কী
ভাষা
বলে
ও
জানে না। শাসা
ওর
মায়ের
সঙ্গে
স্প্যানিশে
কথা
বলে; ঝিলকে
বলেছে। এদিকে
সে
স্প্যানিশটাও
জানে না। আর এই যে ঝুঁটি
দাদাটা
‘আ’
‘আ’
করে
চিল্লিয়ে
তামিল-তেলুগু
বলে
নাকি! কে
জানে!
আধঘণ্টা পর চিৎকারটা
থামল। ততক্ষণ
মাকে
কোথাও
নড়তে
দেয়নি
ঝিল।
মা রোজ একই কথা বলে,
“অত
ভয়
পাওয়ার
কী
আছে!”
ঝিল বলে,
“ও
ওরকম
চেঁচামেচি
করে
কেন
মা!”
“দাদাটাকে ওর
পেরেন্টস
পার্কে
যেতে
দেয় না,
তাই
ও
বিকেল
হলেই
চেঁচাতে
শুরু
করে।”
প্রায় এক কথা শুনতে
শুনতে
ঝিল
আজ
বিরক্ত
হয়ে
গেল।
শরীরটাও
ভালো
নেই, মনটাও
কেমন
যেন
গলে
যাওয়া
চকলেটের
মতো
ভ্যাদভেদে
হয়ে
ছিল। তাই মায়ের
ওপর
একটু
রেগে
গিয়ে
সে
বলল, “আমিও
তো আজ
পার্কে
যাইনি,
তুমি
বারণ
করলে;
আমি
কি
ওর
মতো
চেঁচিয়ে
কাঁদছি?”
মা পুরো
ব্যাপারটা
ঝিলের
ওপর
ছেড়ে
দিয়েছিল। কথা বলতে
না
পারা
আর
পাঁচজনের
মতো
স্বাভাবিক
জীবন
যাপন
করতে
না
পারা
যে
কতটা
কষ্টের, যন্ত্রণার
তা
বলে
বোঝানোর
থেকে
অনুভব
করা
প্রয়োজন। ‘বোবা’ বলে
বাকিদের
মতো
সিমপ্যাথি
না
দেখিয়ে
বরং
এমপ্যাথি
দিয়ে
যদি
কষ্টটা
ঝিল
অনুভব
করে
ওর
মনখারাপ
হয়;
তবেই
ও
বুঝতে
শিখবে।
মায়ের মনের
এত
কথা
ঝিলের
জানার
কথা
নয়,
উপরন্তু
সে
আজ
নাছোড়বান্দা।
মা
প্রথমবার
বাধ্য
হয়ে
বলল, “ওই
দাদাটার
ভাষা
আমাদের
সবার
থেকে
আলাদা,
ও
সাইন
ল্যাঙ্গোয়েজ
বোঝে।”
বাবা-মা ব্যস্ত
ছিল
সেই
রবিবার। বাবার ফোনটা
নিয়ে
ঝিলমিল
সোজা
বেডরুমে
চলে
এল। এই ফোনটা
ও
আনলক
করতে
পারে। স্কুলে ও শুনেছে
ইউ.এস.এ-তে
ইংরেজি, স্প্যানিশ
ভাষার
পরেই
সাইন
ল্যাঙ্গোয়েজ
শেখানো
হয়।
গুগল সার্চ
করলে কী
না
পাওয়া
যায়! ঝিল
‘সাইন
ল্যাঙ্গোয়েজ’
সার্চ
করতেই
জানল
বিশ্বের
সাত কোটি
মানুষ
এ
ভাষায়
কথা
বলে। ঝাঁকে ঝাঁকে
ইউটিউবের
ভিডিও
লিঙ্ক
আসতে
থাকল। ‘হাউ
টু
লার্ন
সাইন
ল্যাঙ্গোয়েজ’।
একমনে ঝিলমিল
হাতের
তালুকে
কখনও
কপালে
ঠেকাচ্ছে ‘হেলো’
বোঝাতে,
আবার
কখনও
দুটো
হাত
মুঠো
করে
কেবল
মধ্যমা
ও
তর্জনী
বের
করে
ওপর
নিচে
ওঠানামা
করছে
‘হারি’
বোঝাতে,
কখনও একহাতের তালুর ওপর আরেক
হাতের
বুড়ো
আঙুল
চাপিয়ে
দিচ্ছে। মা বলছে,
“এটা
কী
রে?”
ও
বলছে,
“হেল্প,
হেল্প।”
----------
ছবি - সুজাতা চ্যাটার্জী
ম্যাজিক ল্যাম্প
No comments:
Post a Comment