গল্প:: জাম্ববান আর গুন্ডা - রোহন রায়


জাম্ববান আর গুন্ডা
রোহন রায়

এক

রাতে খাবার টেবিলে রুবি কথাটা তুলল “জামগাছটার এবার একটা ব্যবস্থা করো। ঝাঁকড়া হয়ে গেছে। মশা হচ্ছে।”
“ঠিক বলেছ,” রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে পার্থ বলল, “পরশু ছুটি। নন্দুকে ডাকব, এসে ছেঁটে দিয়ে যাবে।”
রুবি বলল, “ছাঁটলে হবে না। একেবারে কেটে দাও। অত বড়ো গাছ বাড়িতে রাখা যায় না। বড্ড নোংরা হয়। মশা হয়। সাপখোপও তো হতে পারে।”
“বাবার নিজের হাতে লাগানো গাছ, কেটে দেব?” পার্থ মুখ কুঁচকে একটু ভাবল, “তাছাড়া এত বড়ো হয়ে গেছে গাছটা।”
“বুঝতে পারছি। কিন্তু অসুবিধে হচ্ছে এটা তো সত্যি। যখন অসুবিধে হয়নি তখন হয়নি। কিন্তু এখন তো হচ্ছে।”
“ছেঁটে দিলে কী অসুবিধে?”
“কতবার ছাঁটবে? এই তো দু’মাস আগে একবার ছাঁটা হল। এর মধ্যেই দ্যাখো আবার কেমন ঝাঁকড়া হয়ে গেছে। তার চেয়ে একেবারে ঝামেলা মিটিয়ে দেওয়াই ভালো না?”
বিয়ের পর থেকে সহজেই রণে ভঙ্গ দেওয়াটা পার্থর অভ্যেস হয়ে গেছে। রুবির সঙ্গে কথা বাড়িয়ে কোনোদিনই বিশেষ লাভ হয় না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পার্থ বলল, “ঠিক আছে। নাসিমকে খবর দেব তাহলে।”
গুন্ডা খাওয়া থামিয়ে চুপ করে বসে মা-বাবার কথা শুনছিল। গাছ কাটার এইসব শলাপরামর্শ ওর মোটেই পছন্দ হচ্ছিল না। গুন্ডা জানে গাছ কাটা খারাপ। গাছের প্রাণ আছে এটা তো সেই নার্সারি ক্লাস থেকেই জানে। এখন ক্লাস থ্রি-তে উঠে ওদের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বলে নতুন একটা সাবজেক্ট পড়তে হচ্ছে। যদিও এটার নম্বর টোটাল মার্কসের সঙ্গে যোগ হবে না, শুধু পাশ করতে হবে। তাই ক্লাসের বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই এই সাবজেক্টটা তেমন গা লাগিয়ে পড়ে না। আর টিচাররাও তেমন ইম্পরট্যান্স দিয়ে পড়ান না। কিন্তু গুন্ডার কেন কে জানে এটা খুব পছন্দ হয়ে গেছে। হিস্ট্রির চেয়েও বেশি ভালো লাগছে। এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বইয়ের প্রথম চ্যাপটারটাই গাছ নিয়েসেখানে লেখা আছে গোটা পৃথিবী জুড়ে এত গাছ কাটা হয়েছে বলে পৃথিবী আজ নানারকম সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। হাওয়া-মাটি-জল সব বিষিয়ে যাচ্ছেবৃষ্টি কমে যাচ্ছে। তাপমাত্রা চলে যাচ্ছে আয়ত্বের বাইরে। খাবার জলের অভাবে ভুগছে কত মানুষ। রোগ-ভোগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ুর পরিবর্তন সবকিছু এই গাছ কমে যাবার জন্য। বইতে লেখা আছে, গাছ কাটা তো একদমই উচিত না, বরং সবার উচিত যতটা সম্ভব বেশি বেশি করে গাছ লাগানো। গুন্ডা তো সেই বই পড়েই মায়ের কাছে বাগানে আরও গাছ লাগানোর বায়না করেছে।
এটা গুন্ডার খুব ভালো লাগে যে ওদের বাড়িতে একটা বাগান আছে। খুব বড়ো না হলেও, আস্ত একটা বাগান তো বটে। ওর বন্ধুদের কারও বাড়িতেই এরকম বাগান নেই। বাগান তো দূরের কথা, নিজেদের বাড়িই বা ক’জনের আছে এখন? গুন্ডার বন্ধুদের বেশিরভাগেরই তো ফ্ল্যাটবাড়ি। নিজেদের বাড়ি, নিজেদের বাগান নিয়ে গুন্ডামনে বেশ গর্ব। বাগানটা দাদুর হাতেই তৈরি। গুন্ডার বায়নায় ইদানীং ওর মা-ও কিছু কিছু গাছ লাগিয়েছে। কিন্তু এখন মা-বাবার পরিকল্পনা শুনে গুন্ডার মনটা খারাপ হয়ে গেল। জামগাছটা দাদুর লাগানো। বছর দশ-বারো আগে। চার বছর হল দাদু মারা গেছেন। গাছটা এর মধ্যে অনেকটা বড়ো হয়েছে। এত বড়ো একটা গাছ মা কেটে ফেলতে চাইছে শুধু মশা হয় বলে?
গুন্ডা খাওয়া থামিয়ে মুখ গোঁজ করে বসে আছে দেখে রুবি তাড়া লাগাল, “কী হল গুন্ডা, খাচ্ছ না কেন? ঝাল লাগছে?”
“না
“তাহলে?”
“তোমরা জামগাছটা কাটবে কেন?”
“কত বড়ো হয়ে গেছে গাছটা। ঘরে মশা হচ্ছে। চারদিকে ডেঙ্গু হচ্ছে দেখছ না?”
“জানলায় নেট লাগাও গাছ কেন কাটবে?”
রুবি পার্থর দিকে তাকাল। পার্থ হাসল। রুবিও।
গুন্ডার এলোমেলো চুলটা বাঁ হাত দিয়ে একটু ঠিক করে দিয়ে রুবি নরম গলায় বলল, “মশার বাসা যদি নষ্ট না করা যায়, তাহলে কি নেট লাগিয়ে কিছু হবে বলো? বাগানে তো নেট থাকবে না। বাগানে গিয়ে মশার কামড় খেলে কী হবে?”
পার্থ সায় দিল, “আর তাছাড়া একটা গাছ কাটলে কী এমন হবে? মা তো তোমার কথামতো বাগানে গাছ লাগাচ্ছেই।”
“একটা গাছ কাটলে কী হবে মানে?” গুন্ডা রেগে গেল, “তোমরা এত বড়ো হয়ে জানো না গাছ কাটার জন্য আমাদের কত ক্ষতি হচ্ছে? এখন আমাদের বেশি বেশি করে গাছ লাগাতে হবে। আর তোমরা গাছ কাটবে বলছ?”
গুন্ডার রাগ দেখে পার্থ আর রুবি বিশেষ ঘাবড়াল না। ছোটো থেকেই গুন্ডা প্রচণ্ড দুরন্ত। যেমন হাতে-পায়ে, তেমনই কথাবার্তায়। সেইজন্যই রুবির জ্যাঠামশাই আদর করে নাম রেখেছিলেন গুন্ডা। সে সব দুরন্তপনা সামলাতে সামলাতে পার্থ আর রুবি এখন চোস্ত হয়ে গেছে। ওরা জানে, গুন্ডার কোনো বেয়াড়া খেয়াল চাপলে বকেঝকে তার সমাধান হবে না। বকলে বরং আরও জেদ চেপে যাবে ওর। এসব ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবাদ না করে একটু সময় দিতে হয়। কিছুক্ষণ পর গুন্ডা নিজেই ভুলে যায়। স্বভাবচঞ্চল বলেই গুন্ডার কোনো খেয়াল দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
পার্থ বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। ওর যখন ইচ্ছা না, তখন গাছটা না হয় না-ই কাটলাম।”
“ঠিক আছে,” রুবি মাথা নাড়ল, “কাটার দরকার নেই। নন্দুকে তাহলে বোলো একটু ছেঁটে দিতে।”
গুন্ডা খুশি হয়ে খাওয়ায় মন দিল।

দুই

রোববার সকালে সাঁতার ক্লাস থেকে ফিরেই গুন্ডার চক্ষুস্থির।
জামগাছটা নেই।
নেই মানে, একেবারে মুড়িয়ে কেটে ফেলা হয়েছে। কাণ্ডের সামান্য একটু অংশ থেকে গেছে চিহ্ন হিসেবে। আর কিচ্ছু নেই।
গাছটা কেটে ফেলল? গুন্ডার চোখে জল এসে গেল। এতদিন ও গাছটার দিকে আলাদা করে নজর দেয়নি। কিন্তু মা-বাবার পরিকল্পনার পর থেকেই গাছটার প্রতি একটা আলাদা টান ও টের পেয়েছে। মাঝের এই একটা দিন গুন্ডা অনেকটা সময় কাটিয়েছে জামগাছটার সঙ্গে। কথা বলেছে। টের পেয়েছে গাছটার সত্যিই প্রাণ আছে। খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালে ঝুপসি পাতার শিরশিরানি শোনা যায়। শিকড়ের গায়ে কান রাখলে টের পাওয়া যায় বগবগ করে কীসের শব্দ। ব্যাপারটা ম্যাজিকের মতো। গুন্ডা এই একদিনেই ভালোবেসে ফেলেছিল গাছটাকে। গাছটার একটা নামও দিয়েছিল। আর ওরা ওকে কেটে ফেলল?
কাঁদতে কাঁদতে গুন্ডার মাথায় আচমকা আগুন জ্বলে উঠল। ওরা বলেছিল গাছটা কাটবে না। ওরা মিথ্যে বলেছিল। বড়োদের কথায় কক্ষনো বিশ্বাস করতে নেই। অত সুন্দর গাছটাকে কেটে ফেলল শুধু মশা হচ্ছে বলে? নোংরা হচ্ছে বলে? গুন্ডা ছোটো হয়ে যেটা বোঝে, মা-বাবা কি এত বড়ো হয়েও সেটা বোঝে না? ওরা এত বোকা? তাছাড়া ক্ষতির কথা যদি ছেড়েও দেওয়া যায়, গাছ তো একটা প্রাণ। এভাবে একটা প্রাণকে মেরে ফেলা যায় নাকি? গাছ কিছু বলতে পারে না, বাধা দিতে পারে না বলে ইচ্ছা করলেই তাকে মেরে ফেলা যায়? এত সহজ?
গুন্ডা নিমেষে ঠিক করে ফেলল কী করবে। তারপর এক ঝটকায় আয়ামাসির হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিল রাস্তার দিকে।
ভ্যাবাচ্যাকা ভাব কাটিয়ে ‘ও বৌদিমণি! ও দাদাবাবু!’ বলে আর্ত চিৎকার ছেড়ে আয়ামাসি যতক্ষণে গুন্ডার পিছু নিল, গুন্ডা ততক্ষণে গলি পেরিয়ে বড়ো রাস্তা নিয়ে বেলঘরিয়া থানার দিকে দৌড়োচ্ছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে থানায় ঢুকে গুন্ডা দেখল, চোখে চশমা পরা গুঁফো একজন লোক টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে একটা খাতায় কিছু লিখছেন। দেখে যদিও তাঁকে পুলিশ বলে মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে অঙ্কের স্যার।
গুন্ডা তাঁকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি পুলিশ?”
ইনস্পেকটর-ইন-চার্জ চোখ তুলে একটা সাত-আট বছরের বাচ্চা ছেলেকে একা দেখে অবাক হয়ে গেলেন।
গুন্ডা আবার জিজ্ঞেস করল, “বলো না, তুমি পুলিশ?”
ইনস্পেকটর এবার জবাব দিলেন, “হ্যাঁ আমি পুলিশ। তুমি কোথা থেকে এসেছ?
“এই তো কাছেই থাকি
“তোমার সঙ্গে বড়োরা কেউ আসেনি?
“না আমি একাই এসেছি
“সে কী!ইনস্পেকটর গুন্ডাকে আপাদমস্তক দেখে নিলেন একবার তারপর বললেন, হারিয়ে গেছ নাকি?”
গুন্ডা মাথা নেড়ে বলল, “হারিয়ে যাব কেন? আমি তো এখানেই থাকি। অরবিন্দ পার্কে।”
“তাহলে? এখানে কেন এসেছ?
“আমার জাম্ববানকে মেরে ফেলেছে।”
“অ্যাঁ! মেরে ফেলেছে!” ইনস্পেকটর চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন, “মার্ডার?”
“ইয়েসমার্ডার।”
“কোথায়?”
“আমাদের বাগানে।”
“চলো দেখি,” ইনস্পেকটর শশব্যস্ত হয়ে উঠে পড়লেন। মাথায় টুপি পরে নিয়ে একটা হাঁক ছাড়লেন, “সান্যাল, শিগগির চলো। একটা মার্ডার কেস।” তারপর গুন্ডার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, “খুনটা কে করেছে তুমি জানো?”
“আমার মা, বাবা আর নাসিমকাকু।”
“তুমি দেখেছ? তোমার সামনে হয়েছে?
“না আমি স্কুল থেকে এসে দেখলাম পুরোটা কেটে দিয়েছে মা-বাবা বলেছে আর নাসিমকাকু কেটেছে
কথাটা শুনে ইনস্পেকটর একটু থমকে গেলেন। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “খুন কে হয়েছে?”
“জাম্ববান।”
“জাম্ববান কে?”
“আমার গাছ।”
“গাছ?” ইনস্পেকটরের চোখ কপালে।
গুন্ডা বলল, “হ্যাঁ। আমার জামগাছ। ওরা কেটে দিয়েছে।”
ইনস্পেকটরের মাথায় হাত, “গাছ কেটেছে বলে তুমি থানায় এসেছ নালিশ করতে?”
গুন্ডা ঠিক বুঝতে পারল না পুলিশটা কী বলতে চাইছে। “কেন? গাছ কাটলে সেটা খুন হয় না?”
ইনস্পেকটর হেসে ফেললেন। কনস্টেবলরাও গুন্ডার কথা শুনেছে। তারাও মিটিমিটি হাসছে।
হাসতে হাসতে ইনস্পেকটর নিজের জায়গায় গিয়ে বসলেন। গুন্ডাকে ডাকলেন হাতছানি দিয়ে। গুন্ডা তাঁর টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল
ইনস্পেকটর হাসি সামলে একবার গলা খাঁকরে নিলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কী?”
“তথাগত। বাড়িতে সবাই গুন্ডা বলে ডাকে।”
ইনস্পেকটর নরম গলায় বললেন, “শোনো তথাগত, বাড়ির লোকে বাড়ির গাছ কাটলে কীসের দোষ? আর তাছাড়া গাছ কাটলে তো সেটাকে ঠিক খুন বলে না।”
পুলিশরা হাসছে দেখে গুন্ডার মোটেই ভালো লাগেনি। ওকে বাচ্চা দেখে পুলিশেরা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। তাই গুন্ডা একটু রাগি গলায় বলল, “কেন? গাছের তো প্রাণ আছে।”
“হ্যাঁ। সে তো মশারও প্রাণ আছে। তাহলে কেউ যখন গুড নাইট জ্বালিয়ে মশা মারে, তখন কি তুমি এসে থানায় নালিশ করবে যে মশাকে খুন করা হয়েছে?”
গুন্ডা একটু ভাবল। তারপর বলল, “তাহলে শুধু মানুষ মারলে সেটাই খুন?”
ইনস্পেকটর আতান্তরে পড়লেন। কী উত্তর দেবেন তিনি? এইসব সহজ প্রশ্নের উত্তর দেওয়াই তো সবচেয়ে কঠিন। তিনি আর কথা বাড়ালেন না। বললেন, “তথাগত, তোমার বাবা বা মায়ের ফোন নম্বর জানো তুমি?”
“হ্যাঁ
“বলো তো। ওদের ডাকি। তারপর দেখি কী শাস্তি দেওয়া যায়।”
“শাস্তি দেবে তো?”
“অবশ্যই। তোমার জাম্ববানকে খুন করেছে, এমনি এমনি ছেড়ে দেব নাকি?”
দশ মিনিট পর পার্থ আর রুবি যখন গুন্ডাকে নিয়ে থানা থেকে বেরোচ্ছে, তখন ইনস্পেকটর-ইন-চার্জ তাদের কিছুটা এগিয়ে দিতে এলেন। পার্থর কোলে গুন্ডা। গুন্ডার হাতে ইনস্পেকটরের দেওয়া চকলেট।
ইনস্পেকটর গুন্ডাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী? খুশি তো? মা-বাবা তোমার এই একটা জাম্ববানের জায়গায় দুটো জাম্ববান বসাবে। খুশি তো এবার?”
গুন্ডা ইতিবাচক মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “কিন্তু ওরা বড়ো হলে ওদেরও যদি কেটে দেয়?”
“তখন তো আমি আছিই,” ইনস্পেকটর হাসিমুখে জবাব দিলেন, “সোজা জেলে পুরে দেব।”
----------
ছবি – নচিকেতা মাহাত
ম্যাজিক ল্যাম্প 

No comments:

Post a Comment