মিশরের চিঠি
সত্যজিৎ দাশগুপ্ত
১
“সময়টা ১৬৮০। জায়গাটা লন্ডন। উইলিয়াম ডকওয়ারা নামে এক ব্যবসায়ী আর ওনার পার্টনার রবার্ট মারে এক নতুন প্রথা চালু করেন। মাত্র এক পেনির বিনিময়ে চিঠিপত্র বা অন্যান্য ছোটোখাটো জিনিস ওনারা পৌঁছে দিতে শুরু করেন লন্ডনের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ধীরে ধীরে বিষয়টা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে সারা লন্ডনে। দেখতে দেখতে এর নাম হয়ে যায় “লন্ডন পেনি পোস্ট”। সে সময় যার নামে চিঠি পাঠানো হত তাকেই সেটার দাম দিয়ে চিঠি নিতে হত। প্রায় দেড়শো বছর পরে ১৮৪০ সালের পয়লা মে’তে ইউনাইটেড কিংডমে পৃথিবীর প্রথম ডাক টিকিট ছাড়া হয়। যার নাম ছিল “পেনি ব্ল্যাক”। এর ঠিক দু’দিন পর দু’পেনির ব্লু বাজারে ছাড়া হয়। এই দুটো টিকিটেই ছিল রানি ভিক্টোরিয়ার ছবি। বলাই বাহুল্য, পৃথিবীতে অনেক জনপ্রিয় খেলা থেকে শুরু করে বহু জিনিসের মতোই এই ডাক টিকিটের জনকও হল ইংরেজরা। আর সেই কারণে বিলেতিদের নাক উঁচু হওয়াটা খুব একটা অন্যায় নয়। তবে বিজয়ীর মুকুটটা ইংরেজরা জিতে নিলেও ফার্স্ট রানার আপের ট্রফিটা ভাগাভাগি করে নেয় সুইটজারল্যান্ড আর ব্রাজিল। ১৮৪৬ সালে তারা তাদের দেশে প্রথম ডাক টিকিট ছাপায়। আর দেখতে দেখতে ১৮৬০ এর মধ্যে সারা পৃথিবীতে প্রায় নব্বইটা দেশে পোস্টাল স্ট্যাম্প সিস্টেম চালু হয়ে যায়!”
“আর আমাদের দেশে?” অনিদার মুখে ডাক টিকিটের ইতিহাসটা হাঁ করে গেলার পর একটা সুযোগ পেয়ে প্রশ্নটা করলাম। এতক্ষণ একটানা কথা বলার পর এবার একটু দম নিয়ে অনিদা বলল, “১৮৫৪-এর অক্টোবরে। অবশ্য কেউ কেউ বলেন সালটা ১৮৫২। যদিও স্বাধীন ভারতের প্রথম স্ট্যাম্প ছাড়া হয়েছিল ১৯৪৭ এর ২১ শে নভেম্বর।”
অনিদা এতক্ষণ খবরের কাগজে চোখ রেখে কথা বলছিল। এবার একটা পাতা উলটে বলল, “আধ আনা, এক আনা, দু’আনা আর চার আনা দামের চারটে টিকিট বাজারে ছেড়েছিল ভারত সরকার।
“এবার আসল ব্যাপারটা খোলসা করি। আজ কাগজে একটা মজার বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। ভারত সরকার এক বিশেষ ধরনের ডাক টিকিট বাজার থেকে তুলে নিতে চায়। স্বাধীনতার বেশ কিছুদিন পরে একটা টিকিট বাজারে ছাড়া হয়েছিল। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ছবি দেওয়া এই টিকিটের দাম ছিল আট আনা। সব মিলিয়ে মোট দশটা টিকিট বাজারে ছাড়া হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত ন’টা টিকিট ফেরত পাওয়া গেছে। বাকি রয়েছে আর একটা। মজা অবশ্য অন্য জায়গায়। বিজ্ঞাপনটাতে বলা আছে, প্রকাশিত সেই টিকিটগুলো বিক্রি হবে নিলামে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে সেগুলোর দাম আকাশ ছোঁবে। আর বিক্রির কুড়ি শতাংশ টাকা পুরস্কার মূল্য হিসেবে দেওয়া হবে সেই টিকিটের সংগ্রহকারীকে। আর বাকি আশি শতাংশ যাবে পাবলিক ওয়েলফেয়ার ফান্ডে। মানে জনগণের সেবায়।”
“এ তো দারুণ খবর!” নড়েচড়ে বসলাম আমি।
“দারুণ তো নিশ্চয়ই, অভিনবও বটে,” কাগজে খবরটা পড়তে পড়তে বলল অনিদা। আর তার পর পরই একথা সেকথা থেকে উঠে এল ডাক টিকিটের ইতিহাস। এ ব্যাপারেও যে অনিদার এতটা পড়াশুনা, কথা না উঠলে সেটা জানতেই পারতাম না! কথায় কথায় কত কিছু জানা গেল। যেমন জানতে পারলাম আমাদের দেশে প্রকাশিত প্রথম ডাক টিকিটেও ছিল রানি ভিক্টোরিয়ার ছবি। তেমন এও জানা গেল যে পোস্টাল সিস্টেমের চল রোমের সম্রাট সাইরাস আর পারস্য সম্রাট দারায়ুসের সময়তেও ছিল। অবশ্য চাণক্যের অর্থশাস্ত্রেও এই প্রথার উল্লেখ আছে। আর আরেকটা মজার জিনিস হল, পৃথিবীর সব থেকে উঁচু পোস্ট অফিস কিন্তু আমাদের দেশে। হিমাচলের সিমলাতে। সেবার সিমলায় গিয়ে অনিদা এটা আমাকে দেখিয়েছিল!
সত্যিই আমরা কত কম জানি!
আমি লালমোহনবাবুর কথা ধার করে একটু ভাব আনার চেষ্টা করতে অনিদা হীরক রাজাকে নকল করে একটা একপেশে হাসি হেসে বলল –
“যত পড়বি তত জানবি। যত জানবি তত শিখবি। আর যত শিখবি তত ভুলবি। আর যত ভুলবি তত টেনশন বাড়বে। আর তখন হীরক রাজের কথা মনে করবি।
জানার কোনো শেষ নাই।
জানার চেষ্টা বৃথা তাই।।
ঠিক কিনা?”
আমিও তক্ষুনি মাথা নেড়ে বললাম – “ঠিক ঠিক।”
সঙ্গে সঙ্গে হো হো করে হেসে উঠল অনিদা। ওর সঙ্গে গলা মেলালাম আমিও।
* * *
আজ রবিবার। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ। পরের মাসেই পুজো। অবশ্য তার আগে বিশ্বকর্মা পুজো আছে। আমার আর অনিদার আবার ঘুড়ি ওড়ানোর নেশা পাগলের মতো। বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন আমাদের মধ্যে কেমন যেন একটা চনমনে ভাব চলে আসে। মনে হয় পরের দিন যেন ওয়ার্ল্ড কাপ খেলতে নামব। অবশ্য দক্ষিণ কলকাতায় ঘুড়ির চল খুব একটা নেই। তাই আমরা চলে যাই উত্তরে। শিয়ালদার বি আর সিং হাসপাতালে। ওখানে রেলের কোয়ার্টার আছে। অনিদার এক ডাক্তার বন্ধু থাকে ওখানে। ওদের ফ্ল্যাটের ছাদে উঠেই আমাদের ঘুড়ি ওড়ানো চলে।
এখন লুচি আর আলুর চচ্চড়ি খেতে খেতে অনিদার ঘরে বসে আড্ডা মারছি। দিন কয়েক আগেই অনিদা কেরালার মুন্নারে একটা কেস সলভ করে ফিরেছে। সেখানে আমিও ওর সঙ্গী ছিলাম। তাতে ওর নামডাকও বেড়েছে আজকাল। ডাকও পড়ছে এদিক সেদিক থেকে। তবে হরির লুঠের মতো সব কেসই ও নিয়ে নিচ্ছে না। বেশ ভেবেচিন্তে বেছে বেছে কাজ করছে। আর ওর সঙ্গে সঙ্গে লোকজন আমাকেও চিনতে শুরু করেছে।
অনিদার চোখ এখন কাগজের সাপ্লিমেন্টারির ওপর। আমি খেলার পাতায় আরজেন্টিনার সুপারস্টার মেসির বন্দনা পড়ছি। ঠিক এমন সময় অনিদার মোবাইলটা বেজে উঠল। ফোনটা হাতে নিয়ে কপাল কুঁচকে যেতেই আমি বুঝলাম তাতে ভেসে ওঠা নম্বরটা অচেনা। এবার ফোনটা ধরে কানে দিয়েই সোফায় হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসল অনিদা। টুকরো টাকরা উত্তরে কথা সারতে থাকল।
“হ্যাঁ বলছি, বলুন।”
-
“আই অ্যাম সো অনারড। আপনার মতো একজন মানুষ আমাকে ফোন করেছেন!”
-
“আপনার বাড়ি?”
-
“ওকে” – বলে আমার দিকে তাকাতে আমি আমার ফোনটা তুলে নিলাম। ওপাশ থেকে মানুষটা যে ঠিকানাটা বলল, সেটা এই – ২সি হীমাদ্রি এপার্টমেন্ট। ফ্ল্যাট নং ৩এ। রাজডাঙ্গা – নব পল্লী। কলকাতা – ৭০০০৭৮।
-
“ওকে, আজ তাহলে সন্ধে সাতটা।”
অনিদা ফোন কাটতে কাটতে আমি ঠিকানাটা ওকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিলাম। এতে আমাদের সুবিধে হয়। দু’জনের কাছেই ইনফরমেশন থেকে যায়।
বুঝলাম নতুন মক্কেল। তবে সে যে বেশ হাই প্রোফাইল, সেটা ওর সোজা হয়ে বসা থেকেই বুঝতে পেরেছি। তবে কে, কী বা কেন – তার কিছুই আন্দাজ করতে পারলাম না। শুধু বুঝলাম জায়গাটা কসবায় আর ছ’টা বেজে পঞ্চান্ন মিনিটেই আমাদের সেখানে পৌঁছোতে হবে। কারণ এই একটু আগে পৌঁছোনোটা অনিদা সাধারণত সব জায়গায় এইভাবে বজায় রাখে। জিজ্ঞাসা করতে এবার ও বলল আমরা নাকি বিখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক দেবাশিস রায়ের বাড়ি যাব।
২
কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে আমাদের গাড়ি হাজরা রোড ধরল। অনিদা নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করে। ওর পাশের সিটটা থাকে আমার। আমার গাড়ি চালানো শেখার বয়স হয়ে গেছে। ওর কাছেই শিখছি। আমার মতে আর কিছুদিনের মধ্যেই আমি গাড়ি নিয়ে বড়ো রাস্তায় বেরোতে পারব। অবশ্য অনিদা বলেছে সেটা আমার দ্বারা সম্ভব না। কারণ আমি নাকি ভিতুর ডিম।
সকালের ফোনটা আসার পর থেকেই অনিদা খুব উত্তেজিত। এত বড়ো একজন মানুষ অনিদাকে ফোন করে ডেকেছেন! ওনার সঙ্গে পরিচয় করতে পারবে! জিনিসটা ভেবেই নাকি গায়ে কাঁটা দিচ্ছে ওর! ভদ্রলোক কী একটা সমস্যায় পরে অনিদার সাহায্য চেয়েছেন।
“এবারের কেসটা কী? চুরি? খুন? না ব্ল্যাক মেইল?” অনিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম।
“উনি বলছিলেন গত কাল রাতে ওনার ফ্ল্যাটে চোর এসেছিল,” বলল অনিদা।
“কিছু চুরি গেছে?”
“বললেন না। শুধু বললেন আমার সাহায্য দরকার।”
“কিন্তু চোর এলে তো মানুষ প্রথমে থানায় রিপোর্ট করে! উনি তোমাকে ডাকলেন?”
আমার প্রশ্ন শুনে নিচের ঠোঁট উলটে অনিদা বলল, “তা তো বলতে পারব না!”
“সামান্য একটা চুরির কেস তুমি নিয়ে নিলে!” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
তাতে আড়চোখে একবার আমাকে দেখে নিয়ে অনিদা বলল, “এখানে কেসের থেকেও বেশি ইম্পরট্যান্ট দেবাশিস রায় মানুষটা। কলকাতায় আজকের দিনে ইতিহাসের যে ক’জন কেউকেটা লোক আছেন, উনি তাঁদের মধ্যে এক নম্বরে। ওনার লেখা অনেক বই বেশ জনপ্রিয়। যদিও সব হায়ার স্টাডিজের জন্য। প্রায় সাতাশ বছর ধরে ভদ্রলোক ইতিহাস নিয়ে অধ্যাপনা করছেন।”
কথা বলতে বলতে আমাদের গাড়ি গড়িয়াহাট ছাড়িয়ে কসবার নব পল্লী পৌঁছে গেল। হীমাদ্রি অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেলাম না। বিল্ডিং-এর সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সোজা উঠে গেলাম তিন তলায়। লিফট খারাপ। তাই এগারো নম্বরের সাহায্যই নিতে হল। হাত উলটে ঘড়ি দেখলাম। সাতটা বাজতে তিন। কলিং বেলের দিকে হাত বাড়াল অনিদা।
বেল বাজার প্রায় কুড়ি সেকেন্ড পর কানে এল ছিটকিনি খোলার শব্দ। এবার দরজাটা এক বিঘত ফাঁক হতে তার মাঝ থেকে সাদা ধবধবে এক মাথা পাকা চুলওয়ালা একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের মুখ উঁকি মারল। ঠোঁট জোড়ার ওপরে মোটা সাদা গোঁফটা ঠোঁটের দু’পাশে ঝুলে পড়ে ভদ্রলোকের গাম্ভীর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে। মোটা কালো ফ্রেমের চশমার কাচের পেছনের চোখজোড়া আমাদের দু’জনকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল। আন্দাজ করলাম ইনিই অধ্যাপক দেবাশিস রায়। এবার একটা গুরুগম্ভীর গলায় আমাদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন উনি – “ইয়েস?”
অনিদা তখন ভীষণ বিনয় করে বলল, “গুড ইভিনিং স্যার। আমি অনিরুদ্ধ সেন। আজ সকালেই –”
অনিদার নাম শুনেই ভোল বদলে গেল ভদ্রলোকের। অনিদাকে কথা শেষ করতে হল না। তার আগেই দরজা খুলে আমাদের ভেতরে ঢোকার জন্য অনুরোধ করলেন। তারপর আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালে পর অনিদাই ওনার না করা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল।
“ও জয়। রণজয় বোস। আমার ভাইও বলতে পারেন আবার সহকারীও বলতে পারেন।”
তাতে একবার আমাকে দেখে নিয়ে উনি “হুম” বলে ভেতরে ঢুকে গেলেন। পেছন পেছন আমরাও।
* * *
দুটো শোবার ঘরের সামনে একটা বসার ঘর। তার মাঝে বড়ো গদিওয়ালা একটা সোফা। সেটার সামনে একটা দারুণ কারুকার্য করা সেন্টার টেবিল। তার ওপর বাহারি ফুলে ভর্তি একটা ফুলদানি। উলটো দিকের দেয়াল জুড়ে রয়েছে বিশাল একটা এল ই ডি টিভি। ওয়াশিং মেশিন থেকে শুরু করে মাইক্রোওয়েভ, ফ্রিজ, কী নেই ঘরটাতে! তিন কামরার এই ফ্ল্যাটে লক্ষ করার মতো জিনিস হল ঘর বোঝাই শুধু বই আর বই। ইতিহাসের মানুষের ঘরে ইতিহাসের বই থাকবে তাতে আর আশ্চর্যের কী? কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের ওপরও এত বইয়ের কালেকশান ভদ্রলোকের, যা চোখ কপালে তোলে বই-কি? তবে একটা কাকতালীয় ব্যাপার মানতে হবে। অনিদার কপালে যে যে মক্কেল জোটে তাঁদের বেশির ভাগেরই বইয়ের নেশা থাকে!
আমরা ততক্ষণে লম্বা সোফাটা দখল করে নিয়েছি। পাশের সিঙ্গল সোফাতে এবার বসতে বসতে দেবাশিস রায় বললেন, “একা মানুষ। রান্নার লোক আসবে আটটার পর। তাই তার আগে চা-টা দিতে পারলাম না।”
কথাটা শুনে আমি ভাবলাম, এমন চাঁচাছোলা কথা এই রকম মানুষের মুখেই মানায় বটে।
অনিদা জিনিসটা খুব হালকাভাবে নিয়ে হাসিমুখে বলল, “আপনি অত ব্যস্ত হবেন না স্যার।”
তাতে বেশ বাজখাঁই গলায় উনি বলে উঠলেন, “ডোন্ট কল মি স্যার। কল মি প্রফঃ রায়। বাট নট রে। বাংলায় একজনই রে। সত্যজিৎ রে!” বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক। বুঝলাম প্রথম দেখায় যতটা ভারিক্কি লেগেছিল, ততটা উনি নন। ভদ্রলোক এবার সরাসরি প্রসঙ্গে এলেন। বললেন, “এবার বলি, আপনাকে কেন আমি এখানে ডেকেছি।”
অনিদা তখন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না প্লিজ।”
তাতে এক প্রস্থ হেসে নিয়ে প্রফঃ রায় বললেন, “ওকে। আচ্ছা আমার কাজ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে?”
সেকেন্ড তিনেক ভেবে নিয়ে অনিদা বলল, “আপনি একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক। রিসার্চের কাজে আপনার ধারেকাছে সারা ভারতে খুব কম মানুষই আছেন। আপনার লেখা বই সব ছাত্রছাত্রীদের কাছে খুব প্রিয়। অনেক সম্মানীয় পুরস্কার আপনার ঝুলিতে। আর ইতিহাস নিয়ে আপনার কাছে মুখ খোলা মানে তেন্ডুলকরকে ক্রিকেট শেখানো!” কথাগুলো এক দমে বলে গেল অনিদা।
তাতে প্রফঃ দেবাশিস রায় হো হো করে হেসে উঠে বললেন, “এতটাও বড়ো করে করে বোলো না ভায়া। আচ্ছা, আমার বর্তমান কাজ সম্পর্কে কোনো আইডিয়া আছে তোমার?”
অনিদা তখন এতটুকু না ভেবে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়ল।
“হুম...” এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে প্রফঃ রায় বললেন, “প্রাচীন মিশর সম্পর্কে তুমি কী জান?”
এবার আমি ঢোঁক গিলতে বাধ্য হলাম। এ আবার কেমন বেয়াড়া প্রশ্ন! ভদ্রলোক কি ইতিহাসের ক্লাস শুরু করলেন নাকি! অনিদা অবশ্য এতটুকু টাল খেল না। একবার মাটির দিকে চেয়ে নিয়ে ও বলতে শুরু করল –
“মিশরের ইতিহাস প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর পুরোনো। সেখানকার ফেরো সম্রাটরা আজও অমর। গ্রীকরা প্রাচীন মিশর থেকেই তাদের সংস্কৃতি গ্রহণ করে। মিশরের বিখ্যাত পিরামিড থেকে শুরু করে ফিনিক্স, সুরমা মন্দির, সবই তৈরই ফেরো রাজাদের আমলে। মোট কতজন রাজা মিশরে রাজত্ব করেছিলেন, তা নিয়ে ভিন্ন মত আছে।”
“হুম,” অনিদার কথা শুনে প্রফঃ রায় মাথা নেড়ে বললেন, “খারাপ জানো তা বলব না। তবে সাধারণের থেকে বেশি হলেও আহামরি কিছু না।”
কথাটা শুনে অনিদা আড়চোখে একবার আমার দিকে চেয়ে নিল। বুঝলাম ও পাশ করে গেছে। প্রফঃ দেবাশিস রায় এবার বললেন, “বুঝতেই পারছ, এ নিয়ে বিস্তর পড়াশুনা করতে হয় আমাকে। তার সঙ্গে লেখালেখিও। কারণ বর্তমানে আমার কাজ এই মিশর নিয়েই। তাই এই বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জোগাড় করতে হয়েছে আমাকে। এর মধ্যে কিছু কিছু আবার বিদেশ থেকেও এসেছে কুরিয়ারে। যদিও আজকালকার দিনে ই-মেইলেই সব আসে। তবু কিছু জিনিসের প্রিন্ট আউটও আছে। এর সমস্ত জিনিস ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এক কথায় লক্ষ লক্ষ টাকা দিলেও এগুলো পাওয়া যাবে না।”
প্রফঃ রায়ের কথা মন দিয়ে শুনছিল অনিদা। লক্ষ করলাম খুব সময় নিয়ে ওর চোখের পাতা পড়ছে।
“আমার আরও একটা নেশা আছে,” বললেন প্রফঃ রায়।
“কী?” প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে কপালটা সামান্য কোঁচকাল অনিদার।
“পোস্টাল স্টাম্প কালেকশান।”
“আচ্ছা!” নড়েচড়ে বসল অনিদা। ওর ঠোঁটের কোণে একটা হালকা হাসি চোখে পড়ল কথাটা শুনে।
“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে প্রফঃ রায় বললেন, “নয় নয় করে প্রায় সাতশো খানেক খুব প্রেসাস স্টাম্প রয়েছে আমার কাছে। এশিয়া, ইউরোপ, সব জায়গার।”
অনিদা কোনো কথা না বলে আরও একটু জাঁকিয়ে বসল। স্টাম্পের কথা শুনে এর মধ্যে আমার ভেতরটাও চনমনাতে শুরু করেছে।
“এবার বল তো দেখি, প্রথমেই আমি কেন এই দুটো জিনিসের কথা বললাম?” কথায় হেঁয়ালি আর মুখে মুচকি হাসি দেখেই বুঝলাম ভদ্রলোক অনিদাকে পরীক্ষা করছেন। অবশ্য অনিদাও এত সহজে ব্যাক ফুটে যাবার পাত্র নয়। উত্তরে অনিদাও মুচকি হেসে বলল, “কারণ গতকাল আপনার বাড়িতে চোর এসেছিল। টাকাপয়সা চুরি গেলেও এগুলোর কোনোটাই চুরি যায়নি। কিন্তু ঘটনাতে আপনি যথেষ্ট ভয় পেয়েছেন। যদি এবার এগুলোর ওপর চোরের হাত পড়ে!”
অনিদার উত্তর শুনে ভদ্রলোকের চোখ দুটো চিক চিক করে উঠল। উনি চোখ কপালে তুলে বললেন, “যা শুনেছিলাম, তুমি তো দেখছি তার থেকেও এক কাঠি ওপরে।” এবার কয়েক মুহূর্ত অনিদার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “আশ্চর্যের কথা কী জান? টাকাপয়সাও কিছু চুরি যায়নি!”
“সে
কী!” জিনিসটা অবাক করল অনিদাকে। আর এর একটাই মানে হতে পারে। বুঝতে অসুবিধে হল না যে চোরের উদ্দেশ্য ছিল ওই মূল্যবান জিনিসগুলোই! তাই প্রফঃ রায়ের কথা শুনে আমার বুকও ঢিপ ঢিপ করতে শুরু করল।
প্রফঃ রায় তখন বললেন, “হ্যাঁ, টাকাপয়সা হলে না হয় এতটা চিন্তিত হতাম না, জান!”
“আপনার কী মনে হয়?” এই প্রথম গোয়েন্দাদের মতো প্রশ্ন করল অনিদা।
“আজকের কাগজের বিজ্ঞাপনটা দেখেছ?”
“পোস্টাল স্ট্যাম্পের কথা বলছেন তো?”
“হ্যাঁ।”
“আপনার কাছে কি ওই স্ট্যাম্পটা আছে বা ছিল?”
“না।”
“তাহলে আপনার বিজ্ঞাপন নিয়ে টেনশনের কারণ কী?”
“আরে ভাই ওই স্ট্যাম্প আমার কাছে নেই। সেটা আমি জানি। চোর কি জানে?”
“তা অবশ্য ঠিক।”
“তাহলে? ওই স্ট্যাম্প আমার কাছে আছে ভেবে যদি চোর আমার সব ফাইল নিয়ে চম্পট দেয় তাহলে তো আমার গেল!”
“হুম,” মাথা নেড়ে অনিদা বলল, “ব্যাপারটা চিন্তার বটে।”
“চিন্তার মানে!” অনিদার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে চোখ কপালে তুলে প্রফঃ রায় বললেন, “ভীষণ চিন্তার! কিন্তু এখন প্রশ্ন হল, আমার ফ্ল্যাটে কার আবির্ভাব ঘটল? তাও আবার মাঝরাতে?”
“চোর কে সেটা আমার পক্ষে এই মুহূর্তে বলা না গেলেও এতটুকু বলতে পারি সে আপনার পরিচিতদের মধ্যেই কেউ।”
“সে
কী!” অনিদার কথা শুনে চোখ গোল গোল হয়ে গেল প্রফঃ রায়ের। বললেন, “কে হতে পারে বলে তোমার মনে হয়?”
অনিদা প্রশ্নের উত্তরে বলল, “দেখুন আপনার পরিচিতদের আমি কাউকেই চিনি না। তাই তার আগে আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।”
“প্রশ্ন?” নাক কুঁচকে প্রফঃ রায় বললেন, “মানে জেরা?”
তাতে মুচকি হেসে অনিদা মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে বলল, “হ্যাঁ।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রফঃ রায় বললেন, “অগত্যা! এমনিতে কিন্তু আমি বেশি প্রশ্ন করা পছন্দ করি না।”
প্রফঃ রায়ের কথা তেমন একটা আমল না দিয়ে অনিদা ওর প্রথম প্রশ্নটা করল।
“কাল রাতে যখন চোর আসে, তখন আপনি কী করছিলেন? মানে বুঝলেন কী করে যে চোর এসেছে?”
“সবেমাত্র লেখাপড়ার কাজ শেষ করে শুয়েছি। চোখটা লেগে এসেছিল। রাত তখন ক’টা হবে, এই ধরো দুটো। এমন সময় ব্যালকনির গ্রিলের কাছ থেকে খুট করে একটা শব্দ কানে এল। প্রথমটা গা করিনি, কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার একটা শব্দ শুনে চোখটা যেই খুললাম, দেখলাম পাশের ঘরে একটা ছায়ামূর্তি ঘুরঘুর করছে। সঙ্গে সঙ্গে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। এবার কে কে বলে চেঁচিয়ে উঠতেই রাতের সেই গেস্ট ব্যালকনি টপকে চম্পট দিল।”
“তিন তলার ওই ব্যালকনিটা!” গলা শুনেই বুঝলাম জিনিসটা অবাক করেছে অনিদাকে।
“হ্যাঁ ওটাই।” বসার ঘরের ডান দিকের লাগোয়া ব্যালকনিটার দিকে ইশারা করলেন প্রফঃ রায়। বললেন, “আসলে এই বসার ঘরটাই আমার লাইব্রেরি কাম এন্টারটেইনমেন্ট রুম।”
“আর আপনার শোবার ঘর কোনটা?”
“ওটা।” প্রফঃ রায়ের ইশারামতো আমরা যেখানে বসে ছিলাম তার ডান দিকে নজর দিতে চোখে পড়ল আরও একটা বই বোঝাই ঘর। তার মাঝে একটা বক্স খাট পাতা।
“কিন্তু তিন তলার ব্যালকনি বেয়ে চোর উঠল কী করে!” থাকতে না পেরে প্রশ্ন করে বসলাম আমি।
তাতে একপেশে একটা হাসি হেসে প্রফঃ রায় বললেন, “সেটা চোরকে জিজ্ঞাসা করলেই উত্তরটা পাওয়া যাবে ভাই!”
আমি চুপ মেরে গেলাম। বুঝলাম বোকার মতো প্রশ্ন হয়ে গেছে।
অনিদা এবার উঠে ব্যালকনিতে গেল। পেছন পেছন আমিও। ব্যালকনির রেলিং কোমর পর্যন্ত। ওপরটা খোলা। ও রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে পড়ে নিচটা দেখছিল। একবার মাথা তুলে ছাদের দিকেও তাকাল। বুঝলাম অনিদাও বোঝার চেষ্টা করছে যে চোর এ পথে ফ্ল্যাটে ঢুকল কী করে? আর পালালই বা কী করে! তাও আবার চোখের নিমেষে! আমিও একবার ব্যালকনিটা থেকে নিচটা দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু এত উঁচু থেকে বাদুড়ের মতো নামছি ভেবেই মাথা ঘুরতে শুরু করল। মনে হল ব্যাপারটা ভোজবাজি ছাড়া আর কিছু না।
অনিদা এবার ফিরে এসে সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার বাড়িতে ঘন ঘন যাতায়াত আছে, এমন কে কে আছেন?”
“খুব বেশি কেউ নয়। একটা ঠিকা কাজের লোক আসে। আর সে ছাড়া ওই ওপরের ফ্ল্যাটের গাঙ্গুলীবাবুর যাতায়াত আছে। তবে মাঝে মাঝে। আসলে আমার আবার একটু দাবার নেশা আছে।”
“আপনার কাজের ব্যাপারে ওনার কোনো ধারণা আছে?”
“তা আছে অবশ্যই। আমার সব লেখার ব্যাপারে ওনাকে বলেছি। এমনকি আমার স্টাম্প কালেকশানও ওনাকে দেখিয়েছি।”
“ওনার এসব ব্যাপারে কোনো ইন্টারেস্ট আছে?”
“তেমন আছে বলে তো মনে হয় না। আসলে উনি জিনিসগুলোর গুরুত্ব বোঝেন না বলেই আমার ধারণা। থেকে থেকেই বলেন স্টাম্পগুলো বেচে দিতে। বলেন অনেক টাকা কামানো যাবে। কিন্তু এগুলো কি বেচার জিনিস বলুন?”
অনিদার অনুরোধে উনি এবার ওনার স্টাম্পের খাতাটা নিয়ে এলেন। একেকটা পাতা ওলটাচ্ছি আর অবাক হচ্ছি। ফ্রান্স থেকে রাশিয়া, কত দেশের স্টাম্প রয়েছে ওনার কাছে!
প্রায় ঘণ্টাদুয়েক প্রফঃ রায়ের ফ্ল্যাটে কাটানোর পর অনিদা এবার উঠে দাঁড়াল। বলল, “আমার মনে হয় না এতে তেমন কিছু ভয়ের ব্যাপার রয়েছে।”
“বলছ?” গলা শুনে মনে হল অনিদার কথায় খুব একটা ভরসা পেলেন না প্রফঃ রায়।
“পরিস্থিতি তো তাই বলছে,” বলল অনিদা। তারপর বলল, “আপনার সঙ্গে পরিচয় করতে পেরে খুব ভালো লাগল।”
প্রফঃ রায় তখন মোটা গোঁফের পেছন থেকে মুচকি হাসি হেসে বললেন, “একটা সত্যি কথা বলব?”
উনি কী বলতে চাইছেন বোঝার জন্য আমি কপাল কোঁচকালাম। মুখে হাসি রেখে অনিদা জিজ্ঞাসা করল, “কী?”
প্রফঃ রায় তখন অনিদার দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে গলাটা নামিয়ে বললেন, “তোমাকেও আমার বেশ লেগেছে ভায়া।”
“ধন্যবাদ!” মুচকি হেসে উত্তর দিল অনিদা।
ফেরার সময় আমি ভাবছিলাম কেসটা ঠিক জমল না। আমার মনের কথা অনিদা সহজেই বুঝতে পারে। রাসবিহারী মোড়ে আমাদের গাড়িটা সিগন্যাল খেতে অনিদা আমাকে বলল, “আরও বেশি কিছু আশা করেছিলি, তাই না?” আমি কোনো উত্তর না করায় ও বলল, “এত বড়ো একজন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল, এই বা কম কীসের?” অনিদার কথা শুনে মনের খচখচানিটা নিমেষের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।
৩
আজ সকালের যোগাসনের পর হাতে আমার তেমন কিছু কাজ নেই। পড়াতেও মন বসছে না। এ ব্যাপারে আমি আবার অনিদার মতো। ও বলে মন না চাইলে সে পড়া শুধুই পড়া হয়। আত্মস্থ হয় না। বরং মেজাজ আরও খিঁচড়ে যায়। কথাটা সত্যি হলেও পরীক্ষার সময় সেটা অবশ্য ভুলে থাকতে হয়! না হলে কী হতে পারে সেই ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না।
এখন সকাল সাতটা। অনিদার ঘরে বসে কফির মগে সরর করে চুমুক মারতে মারতে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছি। এমন সময় অনিদা পেছন থেকে এসে খবরের কাগজ দিয়ে ঝপাং করে মাথায় একটা ঝাপটা মেরে বলল, “খবরটা দেখেছিস?”
আচমকা আক্রমণটা সামলে নিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কোন খবরটা?”
আমার হাতে ছিল ইংরিজি কাগজ। ওর হাতে বাংলাটা। ও সেটার আট নম্বর পাতাটা খুলে আমার দিকে সেটা এগিয়ে দিয়ে খবরটার ওপর আঙুল রেখে আমাকে দেখিয়ে দিল। চোখে পড়ল স্টাম্পের খবরটা বেরিয়েছে। উত্তর দিনাজপুরের মিঃ সুবীর কর্মকার সেই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ছবি দেওয়া দশ নম্বর স্টাম্পটা কালেকশন সেলে গত কালই জমা করে দিয়েছে।
খবরটা পড়ে কাগজটা ওকে ফেরত দিয়ে বললাম, “ব্যস, তাহলে তো হয়েই গেল। যে লোকগুলো স্টাম্প জমা করেছে, তারা তো বেশ লাভবান হয়েছে বলে মনে হয়!”
আমার প্রশ্নের উত্তর একটা একগাল হাসিতে দিল অনিদা। এবার সামনের সোফাতে বসে খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে লাগল। ঘড়ি ধরে পাক্কা আধ ঘণ্টা কেটেছে, “ঠিক সেই সময় ওর মোবাইলটা বেজে উঠল।”
ফোনটা হাতে নিতেই অনিদার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। নিজে নিজেই ও বলে উঠল, ‘এ কী, এর মধ্যেই!’ তারপর ফোনটা ধরে বলল, “হ্যাঁ প্রফঃ রায়, বলুন?”
প্রফঃ দেবাশিস রায় ফোনে কী বলছিলেন তা স্বাভাবিকভাবেই আমার কানে আসছিল না। কিন্তু খবরটা যে খুব একটা খুশির নয় তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না। কারণ কয়েক সেকেন্ড কথা বলার পরই অনিদা সোফায় হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসল। আর ততক্ষণে ওর কপালে গোটা তিনেক ভাঁজ পড়ে গেছে! শেষে বলল, “ওকে, আজ বিকেলেই আমরা আসছি।”
আমি উৎসুক হয়ে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে চেয়ে ছিলাম। এবার ফোনটা কাটতে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী হয়েছে অনিদা?”
তাতে অনিদা যা বলল সেটা শুনে আমার গলার কাছটা শুকোতে শুরু করল। ও জানাল যে কাল রাতে প্রফঃ দেবাশিস রায়ের বাড়িতে আবার চোর এসেছিল। আর এবারে ওনার মিশরের গবেষণার সব কাগজপত্র গেছে।
আমি আমার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ভাবটা কোনোরকমে সামলে নিয়ে একটা ঢোঁক গিলে ওকে বললাম, “স্ট্যাম্পের খাতাটা?”
“ওটাও গেছে!” ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে দু’হাত জড়ো করে দুই জোড়া তর্জনীর ওপর থুতনি রেখে কোনো এক গভীর চিন্তায় ডুবে গেল অনিদা।
স্ট্যাম্পের খাতা চুরি গেছে শুনে মন বেজায় খারাপ হয়ে গেছিল আমার। তবে বেশ বুঝতে পারছিলাম ম্যাড়মেড়ে হয়ে থাকা খেলাটা এবার আচমকা জমে উঠেছে! অনিদার সামনে এবার বড়ো চ্যালেঞ্জ!
বিকেল হতে না হতেই আমরা এবার ছুটলাম প্রফঃ দেবাশিস রায়ের বাড়ি। ভদ্রলোক খুব ভেঙে পড়েছেন। বললেন, স্ট্যাম্পের খাতার থেকেও কাগজপত্রগুলোর চুরি যাওয়াটা নাকি ওনার বেশি ক্ষতি করেছে। বললেন, “ওগুলো আমার গবেষণার কাগজ। তোমাকে তো ভাই আগেই বলেছি যে বিদেশ থেকে বেশ কিছু চিঠিপত্র আর জার্নাল এসেছিল। আর তার সবগুলোই এসেছিল এনভেলপে। আমার গবেষণা এখন মিশর নিয়ে। আর তাতে সেই সম্পর্কিত জিনিসপত্রই ছিল!”
কথাটা শুনে অনিদা বলল, “তার মানে সেগুলোতেও দামি পোস্টাল স্ট্যাম্প ছিল!”
“হুঁ, তা তো স্বাভাবিক,” মাথা নাড়লেন প্রফঃ রায়।
অনিদার কথা শুনে মনে হল ও স্ট্যাম্প চুরিটাকেই এই মুহূর্তে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “চোরের আসল টার্গেট কী ছিল? চিঠি নাকি স্ট্যাম্প?”
“যা কিছু হতে পারে,” ঠোঁট উলটে ও বলল, “অন্য কিছুও হতে পারে।”
“অন্য কিছু মানে?” অনিদা কী বলতে চাইল ধরতে পারলাম না।
“যে লোকের ডাক টিকিট বা গবেষণার কাগজ দরকার সে যে ছিঁচকে চোর হবে না, তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না?”
“তার মানে?”
“তার মানে হল, প্রফঃ রায়ের কথা অনুযায়ী আগের দিন চোর ব্যালকনি টপকে ভেতরে ঢোকে, আর তাই বলা যায় এভাবে পাঁচিল-টাচিল টপকানোর ব্যাপারে সে বেশ সিদ্ধহস্ত! আর অন্যদিক থেকে বলা যায়, যে এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস চুরি করবে সে কোনোমতেই সাধারণ লোক হতে পারে না। তাই এটুকু বলা যায়, হয়তো চোরটা ভাড়াটে। যে কিনা শুধুমাত্র টাকার জন্য চুরিটা করেছে।”
প্রফঃ রায় অনিদার কথা শুনে বলল, “কিন্তু আমার ঘর থেকে চুরিটা করল কে? কার ওইসব কাগজপত্রের দরকার হয়ে পড়ল?”
“আক্রমণটা বিদেশি নয় এতটুকু বলতে পারি। যদিও এটা শুধুমাত্র আন্দাজ।”
অনিদার কথাটা যে প্রফঃ রায়ের কাছে একটা হেঁয়ালি ছিল সেটা ওনার মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম। তবে আমি মনে মনে ওকে সমর্থনই করছিলাম। এ কাজ অচেনা কোনো লোকের নয়। কিন্তু কার এতে হাত থাকতে পারে তা জানতে হলে আমাদের জানতে হবে কে কে এই জিনিসগুলোর কথা জানত আর কার কার এই বাড়িতে যাতায়াত ছিল। অবশ্য এদের মধ্যে একজনের ব্যাপারে তো আমরা আগেই জেনেছি। ওপরের তলার মিঃ গাঙ্গুলী। যিনি কিনা প্রফঃ রায়ের সঙ্গে দাবা খেলতে আসেন।
আমি এইসব সাতপাঁচ ভাবছি, ঠিক তখন অনিদা প্রফঃ রায়কে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার দাবা পার্টনার মিঃ গাঙ্গুলীর এখানে কতদিন যাতায়াত?”
“কে? ও, মানে মিঃ গাঙ্গুলী?” একটু ভেবে প্রফঃ রায় বললেন, “তা হ্যাঁ, উনি এখানে ফ্ল্যাট কিনেছেন তা বছর দুই হয়ে গেল। প্রায় তখন থেকেই ওনার আমার এখানে যাতায়াত।”
“হুম,” অনিদা ছোট্ট করে উত্তর করল।
“তুমি কি ওনার সঙ্গে কথা বলতে চাও?” জিজ্ঞাসা করলেন প্রফঃ রায়।
অনিদা কিছু উত্তর করার আগেই আচমকা এসে হাজির হলেন গাঙ্গুলী ভদ্রলোক। কথা বলে জানা গেল উনি জানতেনই না যে প্রফঃ রায়ের বাড়িতে চুরি হয়েছে! চুরির কথাটা শুনে চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, “সে কী মশাই, এ তো সাপের গর্তে হাত ঢুকিয়ে সাপের বাচ্চা বের করে আনার মতো অবস্থা!” তারপর আমাকে আর অনিদাকে একবার দেখে নিয়ে বললেন, “এনারা?” এবার প্রফঃ রায়ের কাছে আমাদের পরিচয় পেয়ে হুঁহ করে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, “এরা আর কী করবে? বাচ্চা ছেলে! যা গেছে তা গেছে। ও নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই।”
অনিদা কিন্তু ওনার বাউন্সারটা হুক করে বাউন্ডারিতে পাঠাল। একটা কড়া দৃষ্টি দিয়ে বলল, “তদন্তটা না হলে মনে হয় আপনার সুবিধে হয়?”
এবার হড়কালেন মিঃ গাঙ্গুলী। আমতা আমতা করে বললেন, “ইয়ে তা কেন? আমি কি তাই বলেছি নাকি?”
অনিদার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ও ভদ্রলোকের এই বাড়তি স্মার্টনেসটা ভালোভাবে নেয়নি। অবশ্য এবার ও গলা নরম করে বলল, “একটা চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?”
“তা বটে। ক্ষতি তো নেই,” মাথা নেড়ে বললেন মিঃ গাঙ্গুলী।
“শুনেছি আপনি নাকি দারুণ দাবা খেলেন?” কেন জানি না প্রসঙ্গ বদল করল অনিদা।
তবে নিজের প্রশংসা শুনে বেশ গদগদ হয়ে উনি বললেন, “ওই আর কী। ওই খেলাটার ওপর আমার দুর্বলতা বরাবরের।”
“আপনি এমনিতে কী করেন?” এবার বুঝলাম অনিদার আচমকা প্রসঙ্গ বদলের কারণ। আসলে ওটা ছিল ওর জেরা শুরুর একটা ভূমিকা।
“করতাম। এখন কিছু করি না।”
“রিটায়ার্ড?”
“হ্যাঁ। গত ডিসেম্বর থেকে বেকারত্ব গ্রহণ করেছি।”
“কোথায় চাকরি করতেন?”
“ব্যাঙ্কে।”
“পেনশন পান?”
“হ্যাঁ।”
“তাতে চলে যায়?”
“ওই আর কী,” এবারে যেন একটা কেঠো হাসি হাসলেন ভদ্রলোক। আর সেটা বেশ সন্দেহজনক।
“আপনার ইতিহাসে কোনো ইন্টারেস্ট নেই?”
“না ভাই। ভীষণ বোরিং! কে কবে রাজা হয়েছিল, কে যুদ্ধে জিতেছিল, কী হবে জেনে বলুন তো?”
কথাটা শুনে একবার প্রফঃ রায়ের দিকে তাকালাম। ওনার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ছাত্র হলে মিঃ গাঙ্গুলীকে এখনই এক চোট দিয়ে দিতেন!
“কাল আপনি প্রফঃ রায়ের ফ্ল্যাটে এসেছিলেন?”
“হ্যাঁ। কাল রাত ন’টা নাগাদ” – বলেই মিঃ গাঙ্গুলী চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, “কেন বলুন তো? আপনি কি আমাকে –”
অনিদা ওনার কথাটাকে পাত্তা না দিয়ে প্রফঃ রায়ের দিকে তাকাল। উনি তাতে মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, উনি এসেছিলেন কাল। পরশুর ইংরিজি কাগজটা নিতে। অবশ্য মিনিট তিনেকের বেশি এখানে দাঁড়াননি।”
প্রফঃ রায় ওনার পক্ষ নিয়ে কথা বলায় মনে হল বেচারা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন মিঃ গাঙ্গুলী!
এবার বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল। চোখ সরু করে মাটির দিকে চেয়ে থেকে কী যেন ভাবল অনিদা। তারপর প্রফঃ দেবাশিস রায়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, আপনার এই নতুন গবেষণার কাজ শুরু হওয়ার পর আর কেউ আছেন যিনি ঘন ঘন আপনার বাড়ি যাতায়াত করতেন?”
“না ভাই,” মাথা নেড়ে প্রফঃ রায় বললেন, “আমি একা মানুষ। গাঙ্গুলীবাবু ছাড়া আমার ফ্ল্যাটে আর কারও যাতায়াত নেই। তাও বিকাশবাবু চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে –”
“বিকাশবাবু কে?” লিস্টে নতুন নাম জুড়তে নড়েচড়ে বসল অনিদা।
“আমার সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করতেন। মাসখানেক আগে চাকরি ছেড়ে দেন।”
“কেন?” অনিদার কপালে এখন গোটা চারেক ভাঁজ।
“ওনার নাকি টাকায় পোষাচ্ছিল না।” কথা বলতে বলতে এবার আচমকা রেগে উঠলেন প্রফঃ রায়। চোখ পাকিয়ে বললেন, “দেখুন, আমি ধনকুবের নই যে মাসে বিশ হাজার টাকা দিয়ে সেক্রেটারি রাখব!”
“ওনাকে কত দিতেন?”
“মাসে চার দিচ্ছিলাম। কথা ছিল সামনের পুজো থেকে পাঁচ করে দেব। পোষাল না। আর সারাদিন তো আসতে হত না। বিকেল থেকে রাত অবধি। টাকার দরকার তো বাকি সময়টা অন্য কাজ করতে পারত! এখানে আর তেমন কী কাজ? বসে বসেই টাকা পেত।” এবার একটু দম নিয়ে প্রফঃ রায় বললেন, “এখন বেটা বেকার!”
প্রফঃ দেবাশিস রায় জানালেন এই বিকাশ রায় ভদ্রলোককে উনি ওনার এই মিশরের প্রজেক্টটার জন্যই নিয়েছিলেন। কাজ বেশ কিছুটা এগোনোর পর উনি চাকরি ছাড়েন। ভদ্রলোক আগে একটা চাকরি করতেন। আর্থিক অবস্থা বিশেষ ভালো না। কলেজ স্ট্রিটে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকেন। ছেলেপুলে কেউ নেই। এই প্রজেক্টের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ওনার কাছে ছিল।
“আপনার গবেষণার কাজগুলোর দাম কতটা সেটার ব্যাপারে নিশ্চয়ই একটা ধারণা ছিল ওনার?” প্রশ্ন করল অনিদা।
“তা
তো থাকবেই,” জোরে মাথা কাত করে বললেন প্রফঃ রায়।
“হুম, আর আপনার স্ট্যাম্প কালেকশানের ব্যাপারটা? উনি জানতেন?”
“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে প্রফঃ রায় বললেন, “তবে তাতে ওর কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না।”
“ওনার কাজটা ঠিক কী ছিল?”
“এই ধরুন টাইপ করে দেওয়া, কলেজ স্ট্রিট থেকে বা লাইব্রেরি থেকে বই এনে দেওয়া, এইসব আর কি। অবশ্য আজকাল যদিও বেশিরভাগ ইনফরমেশন ইন্টারনেটেই পাওয়া যায়। দরকার হলে সেগুলো নেটে সার্চ-টার্চও করে দিতেন। নোট করে দিতেন।”
মিঃ গাঙ্গুলী এতক্ষণ মৌনব্রত পালন করে রয়েছেন। মন দিয়ে অনিদা আর প্রফঃ রায়ের কথা শুনছেন। তবে কেন জানি না থেকে থেকে ওনার কপাল ঘেমে যাচ্ছে। আর রুমাল ব্যবহার করছেন। জিনিসটা অনিদার চোখ এড়ায়নি সেটা জানি। ও একবার মিঃ গাঙ্গুলীর দিকে চেয়ে নিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিল। এদিকে আমিও চুপচাপ। এই সমস্ত সিরিয়াস সময়ে আমি মুখ খুলি না। অবশ্য এর মধ্যে আমি আমার কাজ করে চলেছি। চার দেয়ালের মধ্যে হয়ে চলা সব কথাবার্তা আমি আমার মোবাইলে গোপনে রেকর্ড করে চলেছি। এটা আমাদের তদন্তের একটা বিশেষ কৌশল। সব তথ্য হাতের কাছে থাকলে পরে সুবিধে হয়।
অনিদার জেরা পর্ব চলছে। এমন সময় প্রফঃ রায় একেবারে চমকে দেবার মতো আশ্চর্য একটা তথ্য দিলেন। বললেন, গত শনিবার এক ভদ্রলোক নাকি হঠাৎ ওনার কাছে এসে আবদার শুরু করেন যে প্রফঃ রায় যেন ওনার ছেলেকে প্রাইভেট টিউশন দেন! আরও মজার ব্যাপার, ওনার ছেলে পড়ে মাত্র ক্লাস এইটে! ভদ্রলোক নিজেকে কসবা পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার বলে পরিচয় দিয়েছিলেন।
কথাটা শুনে নড়েচড়ে বসল অনিদা। জিজ্ঞাসা করল, “ওনার বয়স কত?”
তাতে কিছুটা চিন্তা করে নিয়ে প্রফঃ রায় বললেন, “এই ধরুন না পঞ্চান্ন থেকে ষাট হবে।”
পঞ্চান্ন থেকে ষাট! বুঝলাম বয়সটা হজম হল না অনিদার। কিন্তু সেটা কেন, তা জানি না! এবার জিজ্ঞাসা করল, “ওনাকে দেখতে কেমন মনে আছে?”
তাতে মাথা নেড়ে প্রফঃ রায় বললেন, “মনে আছে একটু একটু। কিন্তু তার ডেসক্রিপশন আপনাকে কী করে দিই বলুন তো?” এবার তড়াক করে সোজা হয়ে বসে ডান হাতে একটা তুড়ি মেরে বললেন, “তবে হ্যাঁ, ভদ্রলোককে এক ঝলকে দেখলে বিকাশ রায় বলে মনে হতে পারে!”
“বিকাশ রায়!” অনিদার কপালে ভাঁজ পড়ল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “চেহারার আর কিছু মনে আছে? এই যেমন ধরুন হাইট, গায়ের রং –”
“বেশি লম্বা না। মাঝারি হাইটের। তবে স্বাস্থ্য ভালো। মাথায় কাঁচাপাকা চুল।”
“উনি আপনার কথা জানলেন কী করে?”
“বললেন তো যে উনি কসবা পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার।”
“কী নাম