উপন্যাস:: মিশরের চিঠি - সত্যজিৎ দাশগুপ্ত


মিশরের চিঠি
সত্যজিৎ দাশগুপ্ত


“সময়টা ১৬৮০ জায়গাটা লন্ডন উইলিয়াম ডকওয়ারা নামে এক ব্যবসায়ী আর ওনার পার্টনার রবার্ট মারে এক নতুন প্রথা চালু করেন মাত্র এক পেনির বিনিময়ে চিঠিপত্র বা অন্যান্য ছোটোখাটো জিনিস ওনারা পৌঁছে দিতে শুরু করেন লন্ডনের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ধীরে ধীরে বিষয়টা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে সারা লন্ডনে দেখতে দেখতে এর নাম হয়ে যায়লন্ডন পেনি পোস্ট সে সময় যার নামে চিঠি পাঠানো হত তাকেই সেটার দাম দিয়ে চিঠি নিতে হত প্রায় দেড়শো বছর পরে ১৮৪০ সালের পয়লা মেতে ইউনাইটেড কিংডমে পৃথিবীর প্রথম ডাক টিকিট ছাড়া হয় যার নাম ছিল পেনি ব্ল্যাক এর ঠিক দুদিন পর দু’পেনির ব্লু বাজারে ছাড়া হয় এই দুটো টিকিটেই ছিল রানি ভিক্টোরিয়ার ছবি বলাই বাহুল্য, পৃথিবীতে অনেক জনপ্রিয় খেলা থেকে শুরু করে বহু জিনিসের মতোই এই ডাক টিকিটের জনকও হল ইংরেজরা আর সেই কারণে বিলেতিদের নাক উঁচু হওয়াটা খুব একটা অন্যায় নয় তবে বিজয়ীর মুকুটটা ইংরেজরা জিতে নিলেও ফার্স্ট রানার আপের ট্রফিটা ভাগাভাগি করে নেয় সুইটজারল্যান্ড আর ব্রাজিল ১৮৪৬ সালে তারা তাদের দেশে প্রথম ডাক টিকিট ছাপায় আর দেখতে দেখতে ১৮৬০ এর মধ্যে সারা পৃথিবীতে প্রায় নব্বইটা দেশে পোস্টাল স্ট্যাম্প সিস্টেম চালু হয়ে যায়!
“আর আমাদের দেশে? অনিদার মুখে ডাক টিকিটের ইতিহাসটা হাঁ করে গেলার পর একটা সুযোগ পেয়ে প্রশ্নটা করলাম এতক্ষণ একটানা কথা বলার পর এবার একটু দম নিয়ে অনিদা বলল, “১৮৫৪-এর অক্টোবরে অবশ্য কেউ কেউ বলেন সালটা ১৮৫২ যদিও স্বাধীন ভারতের প্রথম স্ট্যাম্প ছাড়া হয়েছিল ১৯৪৭ এর ২১ শে নভেম্বর
অনিদা এতক্ষণ খবরের কাগজে চোখ রেখে কথা বলছিল এবার একটা পাতা উলটে বলল, “আধ আনা, এক আনা, দুআনা আর চার আনা দামের চারটে টিকিট বাজারে ছেড়েছিল ভারত সরকার
“এবার আসল ব্যাপারটা খোলসা করি আজ কাগজে একটা মজার বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে ভারত সরকার এক বিশেষ ধরনের ডাক টিকিট বাজার থেকে তুলে নিতে চায় স্বাধীনতার বেশ কিছুদিন পরে একটা টিকিট বাজারে ছাড়া হয়েছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ছবি দেওয়া এই টিকিটের দাম ছিল আট আনা সব মিলিয়ে মোট দশটা টিকিট বাজারে ছাড়া হয়েছিল এখনও পর্যন্ত টা টিকিট ফেরত পাওয়া গেছে বাকি রয়েছে আর একটা মজা অবশ্য অন্য জায়গায় বিজ্ঞাপনটাতে বলা আছে, প্রকাশিত সেই টিকিটগুলো বিক্রি হবে নিলামে বলার অপেক্ষা রাখে না যে সেগুলোর দাম আকাশ ছোঁবে আর বিক্রির কুড়ি শতাংশ টাকা পুরস্কার মূল্য হিসেবে দেওয়া হবে সেই টিকিটের সংগ্রহকারীকে আর বাকি আশি শতাংশ যাবে পাবলিক ওয়েলফেয়ার ফান্ডে মানে জনগণের সেবায়
“এ তো দারুণ খবর! নড়েচড়ে বসলাম আমি
“দারুণ তো নিশ্চয়ই, অভিনবও বটে,” কাগজে খবরটা পড়তে পড়তে বলল অনিদা আর তার পর পরই একথা সেকথা থেকে উঠে এল ডাক টিকিটের ইতিহাস এ ব্যাপারেও যে অনিদার এতটা পড়াশুনা, কথা না উঠলে সেটা জানতেই পারতাম না! কথায় কথায় কত কিছু জানা গেল যেমন জানতে পারলাম আমাদের দেশে প্রকাশিত প্রথম ডাক টিকিটেও ছিল রানি ভিক্টোরিয়ার ছবি তেমন এও জানা গেল যে পোস্টাল সিস্টেমের চল রোমের সম্রাট সাইরাস আর পারস্য সম্রাট দারায়ুসের সময়তেও ছিল অবশ্য চাণক্যের অর্থশাস্ত্রেও এই প্রথার উল্লেখ আছে আর আরেকটা মজার জিনিস হল, পৃথিবীর সব থেকে উঁচু পোস্ট অফিস কিন্তু আমাদের দেশে হিমাচলের সিমলাতে সেবার সিমলায় গিয়ে অনিদা এটা আমাকে দেখিয়েছিল!
সত্যিই আমরা কত কম জানি!
আমি লালমোহনবাবুর কথা ধার করে একটু ভাব আনার চেষ্টা করতে অনিদা হীরক রাজাকে নকল করে একটা একপেশে হাসি হেসে বলল
“যত পড়বি তত জানবি যত জানবি তত শিখবি আর যত শিখবি তত ভুলবি আর যত ভুলবি তত টেনশন বাড়বে আর তখন হীরক রাজের কথা মনে করবি
জানার কোনো শেষ নাই
জানার চেষ্টা বৃথা তাই।।
ঠিক কিনা?
আমিও তক্ষুনি মাথা নেড়ে বললাম“ঠিক ঠিক
সঙ্গে সঙ্গে হো হো করে হেসে উঠল অনিদা ওর সঙ্গে গলা মেলালাম আমিও

*                   *                   *

আজ রবিবার সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পরের মাসেই পুজো অবশ্য তার আগে বিশ্বকর্মা পুজো আছে আমার আর অনিদার আবার ঘুড়ি ওড়ানোর নেশা পাগলের মতো বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন আমাদের মধ্যে কেমন যেন একটা চনমনে ভাব চলে আসে মনে হয় পরের দিন যেন ওয়ার্ল্ড কাপ খেলতে নামব অবশ্য দক্ষিণ কলকাতায় ঘুড়ির চল খুব একটা নেই তাই আমরা চলে যাই উত্তরে শিয়ালদার বি আর সিং হাসপাতালে ওখানে রেলের কোয়ার্টার আছে অনিদার এক ডাক্তার বন্ধু থাকে ওখানে ওদের ফ্ল্যাটের ছাদে উঠেই আমাদের ঘুড়ি ওড়ানো চলে
এখন লুচি আর আলুর চচ্চড়ি খেতে খেতে অনিদার ঘরে বসে আড্ডা মারছি দিন কয়েক আগেই অনিদা কেরালার মুন্নারে একটা কেস সলভ করে ফিরেছে সেখানে আমিও ওর সঙ্গী ছিলাম তাতে ওর নামডাকও বেড়েছে আজকাল ডাকও পড়ছে এদিক সেদিক থেকে তবে হরির লুঠের মতো সব কেসই নিয়ে নিচ্ছে না বেশ ভেবেচিন্তে বেছে বেছে কাজ করছে আর ওর সঙ্গে সঙ্গে লোকজন আমাকেও চিনতে শুরু করেছে
অনিদার চোখ এখন কাগজের সাপ্লিমেন্টারির ওপর আমি খেলার পাতায় আরজেন্টিনার সুপারস্টার মেসির বন্দনা পড়ছি ঠিক এমন সময় অনিদার মোবাইলটা বেজে উঠল ফোনটা হাতে নিয়ে কপাল কুঁচকে যেতেই আমি বুঝলাম তাতে ভেসে ওঠা নম্বরটা অচেনা এবার ফোনটা ধরে কানে দিয়েই সোফায় হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসল অনিদা টুকরো টাকরা উত্তরে কথা সারতে থাকল
“হ্যাঁ বলছি, বলুন
-
“আই অ্যাম সো অনারড আপনার মতো একজন মানুষ আমাকে ফোন করেছেন!
-
“আপনার বাড়ি?
-
“ওকে”বলে আমার দিকে তাকাতে আমি আমার ফোনটা তুলে নিলাম ওপাশ থেকে মানুষটা যে ঠিকানাটা বলল, সেটা এই ২সি হীমাদ্রি এপার্টমেন্ট ফ্ল্যাট নং ৩এ রাজডাঙ্গানব পল্লী কলকাতা৭০০০৭৮
-
“ওকে, আজ তাহলে সন্ধে সাতটা
অনিদা ফোন কাটতে কাটতে আমি ঠিকানাটা ওকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিলাম এতে আমাদের সুবিধে হয় দু’জনের কাছেই ইনফরমেশন থেকে যায়
বুঝলাম নতুন মক্কেল তবে সে যে বেশ হাই প্রোফাইল, সেটা ওর সোজা হয়ে বসা থেকেই বুঝতে পেরেছি তবে কে, কী বা কেনতার কিছুই আন্দাজ করতে পারলাম না শুধু বুঝলাম জায়গাটা কসবায় আর টা বেজে পঞ্চান্ন মিনিটেই আমাদের সেখানে পৌঁছোতে হবে কারণ এই একটু আগে পৌঁছোনোটা অনিদা সাধারণত সব জায়গায় এইভাবে বজায় রাখে জিজ্ঞাসা করতে এবার বলল আমরা নাকি বিখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক দেবাশিস রায়ের বাড়ি যাব


কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে আমাদের গাড়ি হাজরা রোড ধরল অনিদা নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করে ওর পাশের সিটটা থাকে আমার আমার গাড়ি চালানো শেখার বয়স হয়ে গেছে ওর কাছেই শিখছি আমার মতে আর কিছুদিনের মধ্যেই আমি গাড়ি নিয়ে বড়ো রাস্তায় বেরোতে পারব অবশ্য অনিদা বলেছে সেটা আমার দ্বারা সম্ভব না কারণ আমি নাকি ভিতুর ডিম
সকালের ফোনটা আসার পর থেকেই অনিদা খুব উত্তেজিত এত বড়ো একজন মানুষ অনিদাকে ফোন করে ডেকেছেন! ওনার সঙ্গে পরিচয় করতে পারবে! জিনিসটা ভেবেই নাকি গায়ে কাঁটা দিচ্ছে ওর! ভদ্রলোক কী একটা সমস্যায় পরে অনিদার সাহায্য চেয়েছেন
“এবারের কেসটা কী? চুরি? খুন? না ব্ল্যাক মেইল? অনিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম
“উনি বলছিলেন গত কাল রাতে ওনার ফ্ল্যাটে চোর এসেছিল,” বলল অনিদা
“কিছু চুরি গেছে?
“বললেন না শুধু বললেন আমার সাহায্য দরকার
“কিন্তু চোর এলে তো মানুষ প্রথমে থানায় রিপোর্ট করে! উনি তোমাকে ডাকলেন?
আমার প্রশ্ন শুনে নিচের ঠোঁট উলটে অনিদা বলল, “তা তো বলতে পারব না!
“সামান্য একটা চুরির কেস তুমি নিয়ে নিলে! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম
তাতে আড়চোখে একবার আমাকে দেখে নিয়ে অনিদা বলল, “এখানে কেসের থেকেও বেশি ইম্পরট্যান্ট দেবাশিস রায় মানুষটা কলকাতায় আজকের দিনে ইতিহাসের যে ক’জন কেউকেটা লোক আছেন, উনি তাঁদের মধ্যে এক নম্বরে ওনার লেখা অনেক বই বেশ জনপ্রিয় যদিও সব হায়ার স্টাডিজের জন্য প্রায় সাতাশ বছর ধরে ভদ্রলোক ইতিহাস নিয়ে অধ্যাপনা করছেন
কথা বলতে বলতে আমাদের গাড়ি গড়িয়াহাট ছাড়িয়ে কসবার নব পল্লী পৌঁছে গেল হীমাদ্রি অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেলাম না বিল্ডিং-এর সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সোজা উঠে গেলাম তিন তলায় লিফট খারাপ তাই এগারো নম্বরের সাহায্যই নিতে হল হাত উলটে ঘড়ি দেখলাম সাতটা বাজতে তিন কলিং বেলের দিকে হাত বাড়াল অনিদা
বেল বাজার প্রায় কুড়ি সেকেন্ড পর কানে এল ছিটকিনি খোলার শব্দ এবার দরজাটা এক বিঘত ফাঁক হতে তার মাঝ থেকে সাদা ধবধবে এক মাথা পাকা চুলওয়ালা একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের মুখ উঁকি মারল ঠোঁট জোড়ার ওপরে মোটা সাদা গোঁফটা ঠোঁটের দু’পাশে ঝুলে পড়ে ভদ্রলোকের গাম্ভীর্যকে বাড়িয়ে তুলেছে মোটা কালো ফ্রেমের চশমার কাচের পেছনের চোখজোড়া আমাদের দু’জনকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল আন্দাজ করলাম ইনিই অধ্যাপক দেবাশিস রায় এবার একটা গুরুগম্ভীর গলায় আমাদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন উনি“ইয়েস?
অনিদা তখন ভীষণ বিনয় করে বলল, “গুড ইভিনিং স্যার আমি অনিরুদ্ধ সেন আজ সকালেই
অনিদার নাম শুনেই ভোল বদলে গেল ভদ্রলোকের অনিদাকে কথা শেষ করতে হল না তার আগেই দরজা খুলে আমাদের ভেতরে ঢোকার জন্য অনুরোধ করলেন তারপর আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালে পর অনিদাই ওনার না করা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল
“ও জয় রণজয় বোস আমার ভাইও বলতে পারেন আবার সহকারীও বলতে পারেন
তাতে একবার আমাকে দেখে নিয়ে উনিহুমবলে ভেতরে ঢুকে গেলেন পেছন পেছন আমরাও

*                   *                   *

দুটো শোবার ঘরের সামনে একটা বসার ঘর তার মাঝে বড়ো গদিওয়ালা একটা সোফা সেটার সামনে একটা দারুণ কারুকার্য করা সেন্টার টেবিল তার ওপর বাহারি ফুলে ভর্তি একটা ফুলদানি উলটো দিকের দেয়াল জুড়ে রয়েছে বিশাল একটা এল ডি টিভি ওয়াশিং মেশিন থেকে শুরু করে মাইক্রোওয়েভ, ফ্রিজ, কী নেই ঘরটাতে! তিন কামরার এই ফ্ল্যাটে লক্ষ করার মতো জিনিস হল ঘর বোঝাই শুধু বই আর বই ইতিহাসের মানুষের ঘরে ইতিহাসের বই থাকবে তাতে আর আশ্চর্যের কী? কিন্তু অন্যান্য বিষয়ের ওপরও এত বইয়ের কালেকশান ভদ্রলোকের, যা চোখ কপালে তোলে বই-কি? তবে একটা কাকতালীয় ব্যাপার মানতে হবে অনিদার কপালে যে যে মক্কেল জোটে তাঁদের বেশির ভাগেরই বইয়ের নেশা থাকে!
আমরা ততক্ষণে লম্বা সোফাটা দখল করে নিয়েছি পাশের সিঙ্গল সোফাতে এবার বসতে বসতে দেবাশিস রায় বললেন, “একা মানুষ রান্নার লোক আসবে আটটার পর তাই তার আগে চা-টা দিতে পারলাম না
কথাটা শুনে আমি ভাবলাম, এমন চাঁচাছোলা কথা এই রকম মানুষের মুখেই মানায় বটে
অনিদা জিনিসটা খুব হালকাভাবে নিয়ে হাসিমুখে বলল, “আপনি অত ব্যস্ত হবেন না স্যার
তাতে বেশ বাজখাঁই গলায় উনি বলে উঠলেন, “ডোন্ট কল মি স্যার কল মি প্রফঃ রায় বাট নট রে বাংলায় একজনই রে সত্যজিৎ রে! বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন ভদ্রলোক বুঝলাম প্রথম দেখায় যতটা ভারিক্কি লেগেছিল, ততটা উনি নন ভদ্রলোক এবার সরাসরি প্রসঙ্গে এলেন বললেন, “এবার বলি, আপনাকে কেন আমি এখানে ডেকেছি
অনিদা তখন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না প্লিজ
তাতে এক প্রস্থ হেসে নিয়ে প্রফঃ রায় বললেন, “ওকে আচ্ছা আমার কাজ সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে?
সেকেন্ড তিনেক ভেবে নিয়ে অনিদা বলল, “আপনি একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক রিসার্চের কাজে আপনার ধারেকাছে সারা ভারতে খুব কম মানুষই আছেন আপনার লেখা বই সব ছাত্রছাত্রীদের কাছে খুব প্রিয় অনেক সম্মানীয় পুরস্কার আপনার ঝুলিতে আর ইতিহাস নিয়ে আপনার কাছে মুখ খোলা মানে তেন্ডুলকরকে ক্রিকেট শেখানো! কথাগুলো এক দমে বলে গেল অনিদা
তাতে প্রফঃ দেবাশিস রায় হো হো করে হেসে উঠে বললেন, “এতটাও বড়ো করে করে বোলো না ভায়া আচ্ছা, আমার বর্তমান কাজ সম্পর্কে কোনো আইডিয়া আছে তোমার?
অনিদা তখন এতটুকু না ভেবে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়ল
“হুম...” এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে প্রফঃ রায় বললেন, “প্রাচীন মিশর সম্পর্কে তুমি কী জান?
এবার আমি ঢোঁক গিলতে বাধ্য হলাম আবার কেমন বেয়াড়া প্রশ্ন! ভদ্রলোক কি ইতিহাসের ক্লাস শুরু করলেন নাকি! অনিদা অবশ্য এতটুকু টাল খেল না একবার মাটির দিকে চেয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল
“মিশরের ইতিহাস প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর পুরোনো সেখানকার ফেরো সম্রাটরা আজও অমর গ্রীকরা প্রাচীন মিশর থেকেই তাদের সংস্কৃতি গ্রহণ করে মিশরের বিখ্যাত পিরামিড থেকে শুরু করে ফিনিক্স, সুরমা মন্দির, সবই তৈরই ফেরো রাজাদের আমলে মোট কতজন রাজা মিশরে রাজত্ব করেছিলেন, তা নিয়ে ভিন্ন মত আছে
“হুম, অনিদার কথা শুনে প্রফঃ রায় মাথা নেড়ে বললেন, “খারাপ জানো তা বলব না তবে সাধারণের থেকে বেশি হলেও আহামরি কিছু না
কথাটা শুনে অনিদা আড়চোখে একবার আমার দিকে চেয়ে নিল বুঝলাম পাশ করে গেছে প্রফঃ দেবাশিস রায় এবার বললেন, “বুঝতেই পারছ, নিয়ে বিস্তর পড়াশুনা করতে হয় আমাকে তার সঙ্গে লেখালেখিও কারণ বর্তমানে আমার কাজ এই মিশর নিয়েই তাই এই বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জোগাড় করতে হয়েছে আমাকে এর মধ্যে কিছু কিছু আবার বিদেশ থেকেও এসেছে কুরিয়ারে যদিও আজকালকার দিনে ই-মেইলেই সব আসে তবু কিছু জিনিসের প্রিন্ট আউটও আছে এর সমস্ত জিনিস ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এক কথায় লক্ষ লক্ষ টাকা দিলেও এগুলো পাওয়া যাবে না
প্রফঃ রায়ের কথা মন দিয়ে শুনছিল অনিদা লক্ষ করলাম খুব সময় নিয়ে ওর চোখের পাতা পড়ছে
“আমার আরও একটা নেশা আছে,” বললেন প্রফঃ রায়
“কী? প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে কপালটা সামান্য কোঁচকাল অনিদার
“পোস্টাল স্টাম্প কালেকশান
“আচ্ছা! নড়েচড়ে বসল অনিদা ওর ঠোঁটের কোণে একটা হালকা হাসি চোখে পড়ল কথাটা শুনে
“হ্যাঁ, মাথা নেড়ে প্রফঃ রায় বললেন, “নয় নয় করে প্রায় সাতশো খানেক খুব প্রেসাস স্টাম্প রয়েছে আমার কাছে এশিয়া, ইউরোপ, সব জায়গার
অনিদা কোনো কথা না বলে আরও একটু জাঁকিয়ে বসল স্টাম্পের কথা শুনে এর মধ্যে আমার ভেতরটাও চনমনাতে শুরু করেছে
“এবার বল তো দেখি, প্রথমেই আমি কেন এই দুটো জিনিসের কথা বললাম? কথায় হেঁয়ালি আর মুখে মুচকি হাসি দেখেই বুঝলাম ভদ্রলোক অনিদাকে পরীক্ষা করছেন অবশ্য অনিদাও এত সহজে ব্যাক ফুটে যাবার পাত্র নয় উত্তরে অনিদাও মুচকি হেসে বলল, “কারণ গতকাল আপনার বাড়িতে চোর এসেছিল টাকাপয়সা চুরি গেলেও এগুলোর কোনোটাই চুরি যায়নি কিন্তু ঘটনাতে আপনি যথেষ্ট ভয় পেয়েছেন যদি এবার এগুলোর ওপর চোরের হাত পড়ে!
অনিদার উত্তর শুনে ভদ্রলোকের চোখ দুটো চিক চিক করে উঠল উনি চোখ কপালে তুলে বললেন, “যা শুনেছিলাম, তুমি তো দেখছি তার থেকেও এক কাঠি ওপরে এবার কয়েক মুহূর্ত অনিদার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, “আশ্চর্যের কথা কী জান? টাকাপয়সাও কিছু চুরি যায়নি!
“সে কী! জিনিসটা অবাক করল অনিদাকে আর এর একটাই মানে হতে পারে বুঝতে অসুবিধে হল না যে চোরের উদ্দেশ্য ছিল ওই মূল্যবান জিনিসগুলোই! তাই প্রফঃ রায়ের কথা শুনে আমার বুকও ঢিপ ঢিপ করতে শুরু করল
প্রফঃ রায় তখন বললেন, “হ্যাঁ, টাকাপয়সা হলে না হয় এতটা চিন্তিত হতাম না, জান!
“আপনার কী মনে হয়? এই প্রথম গোয়েন্দাদের মতো প্রশ্ন করল অনিদা
“আজকের কাগজের বিজ্ঞাপনটা দেখেছ?
“পোস্টাল স্ট্যাম্পের কথা বলছেন তো?
“হ্যাঁ
“আপনার কাছে কি ওই স্ট্যাম্পটা আছে বা ছিল?
“না
“তাহলে আপনার বিজ্ঞাপন নিয়ে টেনশনের কারণ কী?
“আরে ভাই ওই স্ট্যাম্প আমার কাছে নেই সেটা আমি জানি চোর কি জানে?
“তা অবশ্য ঠিক
“তাহলে? ওই স্ট্যাম্প আমার কাছে আছে ভেবে যদি চোর আমার সব ফাইল নিয়ে চম্পট দেয় তাহলে তো আমার গেল!
“হুম, মাথা নেড়ে অনিদা বলল, “ব্যাপারটা চিন্তার বটে
“চিন্তার মানে! অনিদার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে চোখ কপালে তুলে প্রফঃ রায় বললেন, “ভীষণ চিন্তার! কিন্তু এখন প্রশ্ন হল, আমার ফ্ল্যাটে কার আবির্ভাব ঘটল? তাও আবার মাঝরাতে?
“চোর কে সেটা আমার পক্ষে এই মুহূর্তে বলা না গেলেও এতটুকু বলতে পারি সে আপনার পরিচিতদের মধ্যেই কেউ
“সে কী! অনিদার কথা শুনে চোখ গোল গোল হয়ে গেল প্রফঃ রায়ের বললেন, “কে হতে পারে বলে তোমার মনে হয়?
অনিদা প্রশ্নের উত্তরে বলল, “দেখুন আপনার পরিচিতদের আমি কাউকেই চিনি না তাই তার আগে আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই
“প্রশ্ন? নাক কুঁচকে প্রফঃ রায় বললেন, “মানে জেরা?
তাতে মুচকি হেসে অনিদা মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে বলল, “হ্যাঁ
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রফঃ রায় বললেন, “অগত্যা! এমনিতে কিন্তু আমি বেশি প্রশ্ন করা পছন্দ করি না
প্রফঃ রায়ের কথা তেমন একটা আমল না দিয়ে অনিদা ওর প্রথম প্রশ্নটা করল
“কাল রাতে যখন চোর আসে, তখন আপনি কী করছিলেন? মানে বুঝলেন কী করে যে চোর এসেছে?
“সবেমাত্র লেখাপড়ার কাজ শেষ করে শুয়েছি চোখটা লেগে এসেছিল রাত তখন ক’টা হবে, এই ধরো দুটো এমন সময় ব্যালকনির গ্রিলের কাছ থেকে খুট করে একটা শব্দ কানে এল প্রথমটা গা করিনি, কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার একটা শব্দ শুনে চোখটা যেই খুললাম, দেখলাম পাশের ঘরে একটা ছায়ামূর্তি ঘুরঘুর করছে সঙ্গে সঙ্গে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম এবার কে কে বলে চেঁচিয়ে উঠতেই রাতের সেই গেস্ট ব্যালকনি টপকে চম্পট দিল
“তিন তলার ওই ব্যালকনিটা! গলা শুনেই বুঝলাম জিনিসটা অবাক করেছে অনিদাকে
“হ্যাঁ ওটাই বসার ঘরের ডান দিকের লাগোয়া ব্যালকনিটার দিকে ইশারা করলেন প্রফঃ রায় বললেন, “আসলে এই বসার ঘরটাই আমার লাইব্রেরি কাম এন্টারটেইনমেন্ট রুম
“আর আপনার শোবার ঘর কোনটা?
“ওটা প্রফঃ রায়ের ইশারামতো আমরা যেখানে বসে ছিলাম তার ডান দিকে নজর দিতে চোখে পড়ল আরও একটা বই বোঝাই ঘর তার মাঝে একটা বক্স খাট পাতা
“কিন্তু তিন তলার ব্যালকনি বেয়ে চোর উঠল কী করে! থাকতে না পেরে প্রশ্ন করে বসলাম আমি
তাতে একপেশে একটা হাসি হেসে প্রফঃ রায় বললেন, “সেটা চোরকে জিজ্ঞাসা করলেই উত্তরটা পাওয়া যাবে ভাই!
আমি চুপ মেরে গেলাম বুঝলাম বোকার মতো প্রশ্ন হয়ে গেছে
অনিদা এবার উঠে ব্যালকনিতে গেল পেছন পেছন আমিও ব্যালকনির রেলিং কোমর পর্যন্ত ওপরটা খোলা রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে পড়ে নিচটা দেখছিল একবার মাথা তুলে ছাদের দিকেও তাকাল বুঝলাম অনিদাও বোঝার চেষ্টা করছে যে চোর এ পথে ফ্ল্যাটে ঢুকল কী করে? আর পালালই বা কী করে! তাও আবার চোখের নিমেষে! আমিও একবার ব্যালকনিটা থেকে নিচটা দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু এত উঁচু থেকে বাদুড়ের মতো নামছি ভেবেই মাথা ঘুরতে শুরু করল মনে হল ব্যাপারটা ভোজবাজি ছাড়া আর কিছু না
অনিদা এবার ফিরে এসে সোফায় বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার বাড়িতে ঘন ঘন যাতায়াত আছে, এমন কে কে আছেন?
“খুব বেশি কেউ নয় একটা ঠিকা কাজের লোক আসে আর সে ছাড়া ওই ওপরের ফ্ল্যাটের গাঙ্গুলীবাবুর যাতায়াত আছে তবে মাঝে মাঝে আসলে আমার আবার একটু দাবার নেশা আছে
“আপনার কাজের ব্যাপারে ওনার কোনো ধারণা আছে?
“তা আছে অবশ্যই আমার সব লেখার ব্যাপারে ওনাকে বলেছি এমনকি আমার স্টাম্প কালেকশানও ওনাকে দেখিয়েছি
“ওনার এসব ব্যাপারে কোনো ইন্টারেস্ট আছে?
“তেমন আছে বলে তো মনে হয় না আসলে উনি জিনিসগুলোর গুরুত্ব বোঝেন না বলেই আমার ধারণা থেকে থেকেই বলেন স্টাম্পগুলো বেচে দিতে বলেন অনেক টাকা কামানো যাবে কিন্তু এগুলো কি বেচার জিনিস বলুন?
অনিদার অনুরোধে উনি এবার ওনার স্টাম্পের খাতাটা নিয়ে এলেন একেকটা পাতা ওলটাচ্ছি আর অবাক হচ্ছি ফ্রান্স থেকে রাশিয়া, কত দেশের স্টাম্প রয়েছে ওনার কাছে!
প্রায় ঘণ্টাদুয়েক প্রফঃ রায়ের ফ্ল্যাটে কাটানোর পর অনিদা এবার উঠে দাঁড়াল বলল, “আমার মনে হয় না এতে তেমন কিছু ভয়ের ব্যাপার রয়েছে
“বলছ? গলা শুনে মনে হল অনিদার কথায় খুব একটা ভরসা পেলেন না প্রফঃ রায়
“পরিস্থিতি তো তাই বলছে,” বলল অনিদা তারপর বলল, “আপনার সঙ্গে পরিচয় করতে পেরে খুব ভালো লাগল
প্রফঃ রায় তখন মোটা গোঁফের পেছন থেকে মুচকি হাসি হেসে বললেন, “একটা সত্যি কথা বলব?
উনি কী বলতে চাইছেন বোঝার জন্য আমি কপাল কোঁচকালাম মুখে হাসি রেখে অনিদা জিজ্ঞাসা করল, “কী?
প্রফঃ রায় তখন অনিদার দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে গলাটা নামিয়ে বললেন, “তোমাকেও আমার বেশ লেগেছে ভায়া
“ধন্যবাদ! মুচকি হেসে উত্তর দিল অনিদা
ফেরার সময় আমি ভাবছিলাম কেসটা ঠিক জমল না আমার মনের কথা অনিদা সহজেই বুঝতে পারে রাসবিহারী মোড়ে আমাদের গাড়িটা সিগন্যাল খেতে অনিদা আমাকে বলল, “আরও বেশি কিছু আশা করেছিলি, তাই না? আমি কোনো উত্তর না করায় বলল, “এত বড়ো একজন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হল, এই বা কম কীসের? অনিদার কথা শুনে মনের খচখচানিটা নিমেষের মধ্যে উধাও হয়ে গেল


আজ সকালের যোগাসনের পর হাতে আমার তেমন কিছু কাজ নেই পড়াতেও মন বসছে না ব্যাপারে আমি আবার অনিদার মতো বলে মন না চাইলে সে পড়া শুধুই পড়া হয় আত্মস্থ হয় না বরং মেজাজ আরও খিঁচড়ে যায় কথাটা সত্যি হলেও পরীক্ষার সময় সেটা অবশ্য ভুলে থাকতে হয়! না হলে কী হতে পারে সেই ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না
এখন সকাল সাতটা অনিদার ঘরে বসে কফির মগে সরর করে চুমুক মারতে মারতে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছি এমন সময় অনিদা পেছন থেকে এসে খবরের কাগজ দিয়ে ঝপাং করে মাথায় একটা ঝাপটা মেরে বলল, “খবরটা দেখেছিস?
আচমকা আক্রমণটা সামলে নিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কোন খবরটা?
আমার হাতে ছিল ইংরিজি কাগজ ওর হাতে বাংলাটা সেটার আট নম্বর পাতাটা খুলে আমার দিকে সেটা এগিয়ে দিয়ে খবরটার ওপর আঙুল রেখে আমাকে দেখিয়ে দিল চোখে পড়ল স্টাম্পের খবরটা বেরিয়েছে উত্তর দিনাজপুরের মিঃ সুবীর কর্মকার সেই ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ছবি দেওয়া দশ নম্বর স্টাম্পটা কালেকশন সেলে গত কালই জমা করে দিয়েছে
খবরটা পড়ে কাগজটা ওকে ফেরত দিয়ে বললাম, “ব্যস, তাহলে তো হয়েই গেল যে লোকগুলো স্টাম্প জমা করেছে, তারা তো বেশ লাভবান হয়েছে বলে মনে হয়!
আমার প্রশ্নের উত্তর একটা একগাল হাসিতে দিল অনিদা এবার সামনের সোফাতে বসে খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে লাগল ঘড়ি ধরে পাক্কা আধ ঘণ্টা কেটেছে, “ঠিক সেই সময় ওর মোবাইলটা বেজে উঠল
ফোনটা হাতে নিতেই অনিদার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল নিজে নিজেই বলে উঠল, ‘এ কী, এর মধ্যেই! তারপর ফোনটা ধরে বলল, “হ্যাঁ প্রফঃ রায়, বলুন?
প্রফঃ দেবাশিস রায় ফোনে কী বলছিলেন তা স্বাভাবিকভাবেই আমার কানে আসছিল না কিন্তু খবরটা যে খুব একটা খুশির নয় তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না কারণ কয়েক সেকেন্ড কথা বলার পরই অনিদা সোফায় হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসল আর ততক্ষণে ওর কপালে গোটা তিনেক ভাঁজ পড়ে গেছে! শেষে বলল, “ওকে, আজ বিকেলেই আমরা আসছি
আমি উৎসুক হয়ে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে চেয়ে ছিলাম এবার ফোনটা কাটতে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী হয়েছে অনিদা?
তাতে অনিদা যা বলল সেটা শুনে আমার গলার কাছটা শুকোতে শুরু করল জানাল যে কাল রাতে প্রফঃ দেবাশিস রায়ের বাড়িতে আবার চোর এসেছিল আর এবারে ওনার মিশরের গবেষণার সব কাগজপত্র গেছে
আমি আমার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ভাবটা কোনোরকমে সামলে নিয়ে একটা ঢোঁক গিলে ওকে বললাম, “স্ট্যাম্পের খাতাটা?
“ওটাও গেছে! ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে দু’হাত জড়ো করে দুই জোড়া তর্জনীর ওপর থুতনি রেখে কোনো এক গভীর চিন্তায় ডুবে গেল অনিদা
স্ট্যাম্পের খাতা চুরি গেছে শুনে মন বেজায় খারাপ হয়ে গেছিল আমার তবে বেশ বুঝতে পারছিলাম ম্যাড়মেড়ে হয়ে থাকা খেলাটা এবার আচমকা জমে উঠেছে! অনিদার সামনে এবার বড়ো চ্যালেঞ্জ!
বিকেল হতে না হতেই আমরা এবার ছুটলাম প্রফঃ দেবাশিস রায়ের বাড়ি ভদ্রলোক খুব ভেঙে পড়েছেন বললেন, স্ট্যাম্পের খাতার থেকেও কাগজপত্রগুলোর চুরি যাওয়াটা নাকি ওনার বেশি ক্ষতি করেছে বললেন, “ওগুলো আমার গবেষণার কাগজ তোমাকে তো ভাই আগেই বলেছি যে বিদেশ থেকে বেশ কিছু চিঠিপত্র আর জার্নাল এসেছিল আর তার সবগুলোই এসেছিল এনভেলপে আমার গবেষণা এখন মিশর নিয়ে আর তাতে সেই সম্পর্কিত জিনিসপত্রই ছিল!
কথাটা শুনে অনিদা বলল, “তার মানে সেগুলোতেও দামি পোস্টাল স্ট্যাম্প ছিল!
“হুঁ, তা তো স্বাভাবিক,” মাথা নাড়লেন প্রফঃ রায়
অনিদার কথা শুনে মনে হল স্ট্যাম্প চুরিটাকেই এই মুহূর্তে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “চোরের আসল টার্গেট কী ছিল? চিঠি নাকি স্ট্যাম্প?
“যা কিছু হতে পারে,” ঠোঁট উলটে বলল, “অন্য কিছুও হতে পারে
“অন্য কিছু মানে? অনিদা কী বলতে চাইল ধরতে পারলাম না
“যে লোকের ডাক টিকিট বা গবেষণার কাগজ দরকার সে যে ছিঁচকে চোর হবে না, তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না?
“তার মানে?
“তার মানে হল, প্রফঃ রায়ের কথা অনুযায়ী আগের দিন চোর ব্যালকনি টপকে ভেতরে ঢোকে, আর তাই বলা যায় এভাবে পাঁচিল-টাচিল টপকানোর ব্যাপারে সে বেশ সিদ্ধহস্ত! আর অন্যদিক থেকে বলা যায়, যে এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস চুরি করবে সে কোনোমতেই সাধারণ লোক হতে পারে না তাই এটুকু বলা যায়, হয়তো চোরটা ভাড়াটে যে কিনা শুধুমাত্র টাকার জন্য চুরিটা করেছে
প্রফঃ রায় অনিদার কথা শুনে বলল, “কিন্তু আমার ঘর থেকে চুরিটা করল কে? কার ওইসব কাগজপত্রের দরকার হয়ে পড়ল?
“আক্রমণটা বিদেশি নয় এতটুকু বলতে পারি যদিও এটা শুধুমাত্র আন্দাজ
অনিদার কথাটা যে প্রফঃ রায়ের কাছে একটা হেঁয়ালি ছিল সেটা ওনার মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম তবে আমি মনে মনে ওকে সমর্থনই করছিলাম এ কাজ অচেনা কোনো লোকের নয় কিন্তু কার এতে হাত থাকতে পারে তা জানতে হলে আমাদের জানতে হবে কে কে এই জিনিসগুলোর কথা জানত আর কার কার এই বাড়িতে যাতায়াত ছিল অবশ্য এদের মধ্যে একজনের ব্যাপারে তো আমরা আগেই জেনেছি ওপরের তলার মিঃ গাঙ্গুলী যিনি কিনা প্রফঃ রায়ের সঙ্গে দাবা খেলতে আসেন
আমি এইসব সাতপাঁচ ভাবছি, ঠিক তখন অনিদা প্রফঃ রায়কে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার দাবা পার্টনার মিঃ গাঙ্গুলীর এখানে কতদিন যাতায়াত?
“কে? , মানে মিঃ গাঙ্গুলী? একটু ভেবে প্রফঃ রায় বললেন, “তা হ্যাঁ, উনি এখানে ফ্ল্যাট কিনেছেন তা বছর দুই হয়ে গেল প্রায় তখন থেকেই ওনার আমার এখানে যাতায়াত
“হুম,” অনিদা ছোট্ট করে উত্তর করল
“তুমি কি ওনার সঙ্গে কথা বলতে চাও? জিজ্ঞাসা করলেন প্রফঃ রায়
অনিদা কিছু উত্তর করার আগেই আচমকা এসে হাজির হলেন গাঙ্গুলী ভদ্রলোক কথা বলে জানা গেল উনি জানতেনই না যে প্রফঃ রায়ের বাড়িতে চুরি হয়েছে! চুরির কথাটা শুনে চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, “সে কী মশাই, এ তো সাপের গর্তে হাত ঢুকিয়ে সাপের বাচ্চা বের করে আনার মতো অবস্থা! তারপর আমাকে আর অনিদাকে একবার দেখে নিয়ে বললেন, “এনারা? এবার প্রফঃ রায়ের কাছে আমাদের পরিচয় পেয়ে হুঁহ করে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, “এরা আর কী করবে? বাচ্চা ছেলে! যা গেছে তা গেছে নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই
অনিদা কিন্তু ওনার বাউন্সারটা হুক করে বাউন্ডারিতে পাঠাল একটা কড়া দৃষ্টি দিয়ে বলল, “তদন্তটা না হলে মনে হয় আপনার সুবিধে হয়?
এবার হড়কালেন মিঃ গাঙ্গুলী আমতা আমতা করে বললেন, “ইয়ে তা কেন? আমি কি তাই বলেছি নাকি?
অনিদার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ভদ্রলোকের এই বাড়তি স্মার্টনেসটা ভালোভাবে নেয়নি অবশ্য এবার গলা নরম করে বলল, “একটা চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?
“তা বটে ক্ষতি তো নেই,” মাথা নেড়ে বললেন মিঃ গাঙ্গুলী
“শুনেছি আপনি নাকি দারুণ দাবা খেলেন? কেন জানি না প্রসঙ্গ বদল করল অনিদা
তবে নিজের প্রশংসা শুনে বেশ গদগদ হয়ে উনি বললেন, “ওই আর কী ওই খেলাটার ওপর আমার দুর্বলতা বরাবরের
“আপনি এমনিতে কী করেন? এবার বুঝলাম অনিদার আচমকা প্রসঙ্গ বদলের কারণ আসলে ওটা ছিল ওর জেরা শুরুর একটা ভূমিকা
“করতাম এখন কিছু করি না
“রিটায়ার্ড?
“হ্যাঁ গত ডিসেম্বর থেকে বেকারত্ব গ্রহণ করেছি
“কোথায় চাকরি করতেন?
“ব্যাঙ্কে
“পেনশন পান?
“হ্যাঁ
“তাতে চলে যায়?
“ওই আর কী,” এবারে যেন একটা কেঠো হাসি হাসলেন ভদ্রলোক আর সেটা বেশ সন্দেহজনক
“আপনার ইতিহাসে কোনো ইন্টারেস্ট নেই?
“না ভাই ভীষণ বোরিং! কে কবে রাজা হয়েছিল, কে যুদ্ধে জিতেছিল, কী হবে জেনে বলুন তো?
কথাটা শুনে একবার প্রফঃ রায়ের দিকে তাকালাম ওনার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ছাত্র হলে মিঃ গাঙ্গুলীকে এখনই এক চোট দিয়ে দিতেন!
“কাল আপনি প্রফঃ রায়ের ফ্ল্যাটে এসেছিলেন?
“হ্যাঁ কাল রাত টা নাগাদ”বলেই মিঃ গাঙ্গুলী চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, “কেন বলুন তো? আপনি কি আমাকে
অনিদা ওনার কথাটাকে পাত্তা না দিয়ে প্রফঃ রায়ের দিকে তাকাল উনি তাতে মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, উনি এসেছিলেন কাল পরশুর ইংরিজি কাগজটা নিতে অবশ্য মিনিট তিনেকের বেশি এখানে দাঁড়াননি
প্রফঃ রায় ওনার পক্ষ নিয়ে কথা বলায় মনে হল বেচারা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন মিঃ গাঙ্গুলী!
এবার বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল চোখ সরু করে মাটির দিকে চেয়ে থেকে কী যেন ভাবল অনিদা তারপর প্রফঃ দেবাশিস রায়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, আপনার এই নতুন গবেষণার কাজ শুরু হওয়ার পর আর কেউ আছেন যিনি ঘন ঘন আপনার বাড়ি যাতায়াত করতেন?
“না ভাই, মাথা নেড়ে প্রফঃ রায় বললেন, “আমি একা মানুষ গাঙ্গুলীবাবু ছাড়া আমার ফ্ল্যাটে আর কারও যাতায়াত নেই তাও বিকাশবাবু চাকরি ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে
“বিকাশবাবু কে? লিস্টে নতুন নাম জুড়তে নড়েচড়ে বসল অনিদা
“আমার সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করতেন মাসখানেক আগে চাকরি ছেড়ে দেন
“কেন? অনিদার কপালে এখন গোটা চারেক ভাঁজ
“ওনার নাকি টাকায় পোষাচ্ছিল না কথা বলতে বলতে এবার আচমকা রেগে উঠলেন প্রফঃ রায় চোখ পাকিয়ে বললেন, “দেখুন, আমি ধনকুবের নই যে মাসে বিশ হাজার টাকা দিয়ে সেক্রেটারি রাখব!
“ওনাকে কত দিতেন?
“মাসে চার দিচ্ছিলাম কথা ছিল সামনের পুজো থেকে পাঁচ করে দেব পোষাল না আর সারাদিন তো আসতে হত না বিকেল থেকে রাত অবধি টাকার দরকার তো বাকি সময়টা অন্য কাজ করতে পারত! এখানে আর তেমন কী কাজ? বসে বসেই টাকা পেত এবার একটু দম নিয়ে প্রফঃ রায় বললেন, “এখন বেটা বেকার!
প্রফঃ দেবাশিস রায় জানালেন এই বিকাশ রায় ভদ্রলোককে উনি ওনার এই মিশরের প্রজেক্টটার জন্যই নিয়েছিলেন কাজ বেশ কিছুটা এগোনোর পর উনি চাকরি ছাড়েন ভদ্রলোক আগে একটা চাকরি করতেন আর্থিক অবস্থা বিশেষ ভালো না কলেজ স্ট্রিটে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকেন ছেলেপুলে কেউ নেই এই প্রজেক্টের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ওনার কাছে ছিল
“আপনার গবেষণার কাজগুলোর দাম কতটা সেটার ব্যাপারে নিশ্চয়ই একটা ধারণা ছিল ওনার? প্রশ্ন করল অনিদা
“তা তো থাকবেই,” জোরে মাথা কাত করে বললেন প্রফঃ রায়
“হুম, আর আপনার স্ট্যাম্প কালেকশানের ব্যাপারটা? উনি জানতেন?
“হ্যাঁ,” মাথা নেড়ে প্রফঃ রায় বললেন, “তবে তাতে ওর কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না
“ওনার কাজটা ঠিক কী ছিল?
“এই ধরুন টাইপ করে দেওয়া, কলেজ স্ট্রিট থেকে বা লাইব্রেরি থেকে বই এনে দেওয়া, এইসব আর কি অবশ্য আজকাল যদিও বেশিরভাগ ইনফরমেশন ইন্টারনেটেই পাওয়া যায় দরকার হলে সেগুলো নেটে সার্চ-টার্চও করে দিতেন নোট করে দিতেন
মিঃ গাঙ্গুলী এতক্ষণ মৌনব্রত পালন করে রয়েছেন মন দিয়ে অনিদা আর প্রফঃ রায়ের কথা শুনছেন তবে কেন জানি না থেকে থেকে ওনার কপাল ঘেমে যাচ্ছে আর রুমাল ব্যবহার করছেন জিনিসটা অনিদার চোখ এড়ায়নি সেটা জানি একবার মিঃ গাঙ্গুলীর দিকে চেয়ে নিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিল এদিকে আমিও চুপচাপ এই সমস্ত সিরিয়াস সময়ে আমি মুখ খুলি না অবশ্য এর মধ্যে আমি আমার কাজ করে চলেছি চার দেয়ালের মধ্যে হয়ে চলা সব কথাবার্তা আমি আমার মোবাইলে গোপনে রেকর্ড করে চলেছি এটা আমাদের তদন্তের একটা বিশেষ কৌশল সব তথ্য হাতের কাছে থাকলে পরে সুবিধে হয়
অনিদার জেরা পর্ব চলছে এমন সময় প্রফঃ রায় একেবারে চমকে দেবার মতো আশ্চর্য একটা তথ্য দিলেন বললেন, গত শনিবার এক ভদ্রলোক নাকি হঠাৎ ওনার কাছে এসে আবদার শুরু করেন যে প্রফঃ রায় যেন ওনার ছেলেকে প্রাইভেট টিউশন দেন! আরও মজার ব্যাপার, ওনার ছেলে পড়ে মাত্র ক্লাস এইটে! ভদ্রলোক নিজেকে কসবা পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার বলে পরিচয় দিয়েছিলেন
কথাটা শুনে নড়েচড়ে বসল অনিদা জিজ্ঞাসা করল, “ওনার বয়স কত?
তাতে কিছুটা চিন্তা করে নিয়ে প্রফঃ রায় বললেন, “এই ধরুন না পঞ্চান্ন থেকে ষাট হবে
পঞ্চান্ন থেকে ষাট! বুঝলাম বয়সটা হজম হল না অনিদার কিন্তু সেটা কেন, তা জানি না! এবার জিজ্ঞাসা করল, “ওনাকে দেখতে কেমন মনে আছে?
তাতে মাথা নেড়ে প্রফঃ রায় বললেন, “মনে আছে একটু একটু কিন্তু তার ডেসক্রিপশন আপনাকে কী করে দিই বলুন তো? এবার তড়াক করে সোজা হয়ে বসে ডান হাতে একটা তুড়ি মেরে বললেন, “তবে হ্যাঁ, ভদ্রলোককে এক ঝলকে দেখলে বিকাশ রায় বলে মনে হতে পারে!
“বিকাশ রায়! অনিদার কপালে ভাঁজ পড়ল তারপর জিজ্ঞাসা করল, “চেহারার আর কিছু মনে আছে? এই যেমন ধরুন হাইট, গায়ের রং
“বেশি লম্বা না মাঝারি হাইটের তবে স্বাস্থ্য ভালো মাথায় কাঁচাপাকা চুল
“উনি আপনার কথা জানলেন কী করে?
“বললেন তো যে উনি কসবা পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার
“কী নাম বলেছিলেন?
তাতে একটু চিন্তা করে প্রফঃ রায় বললেন, “কী সাম গুহ যেন
“আর বিশেষ কোনো মনে রাখার মতো জিনিস?
এবার কয়েক সেকেন্ড আবার চিন্তা করে প্রফঃ রায় বললেন, “একটা জিনিসে আমি অবাক হয়েছিলাম
“কী? কিছু একটা নতুন তথ্যের আশায় নড়েচড়ে বসল অনিদা আমার বুকও সঙ্গে সঙ্গে ঢিপ ঢিপ করতে শুরু করল
প্রফঃ রায় তখন বললেন, “দেখ, আমাদের লিফটটা অনেক দিন খারাপ হয়ে পড়ে আছে উনি এই বয়সে তিন তলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলেন অথচ দেখলাম এতটুকু হাঁপাননি!
“হুম,” এবার আবার কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে অনিদা বলল, “আপনার কাছে যে চিঠিগুলো এসেছিল, সেগুলো কার কাছ থেকে এসেছিল?
“উইলিয়াম হার্ড নামে এক ইংরেজের সঙ্গে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতা আছে ওনারও সাবজেক্ট হিস্ট্রি উনিই আমাকে চিঠি আর জার্নালগুলো পাঠাচ্ছিলেন
“ওগুলো কি বাজারে বিক্রি করা যেতে পারে? আর তার দাম কত হতে পারে?
অনিদার প্রশ্নে হেসে প্রফঃ রায় বললেন, “সবজি বাজারে তো আর ওগুলো বিক্রি হবে না ভাই তার জন্য বুঝদার লোক চাই আর যোগ্য লোকের হাতে পড়লে সে অনেক টাকা দিতে পারে
প্রফঃ দেবাশিস রায়ের ফ্ল্যাটে আমরা আর বেশি সময় খরচ করলাম না তার আগে অনিদা অবশ্য বিকাশ রায়ের ঠিকানাটা নিতে ভুলল না বেরোনোর সময় আমাদের পরিচয় হল লোকাল থানার ওসি তাপস মিত্রর সঙ্গে তাপস মিত্রকে লোক না বলে ছেলে বলাই ভালো উনি নাকি অনিদার ব্যাপারে অনেক শুনেছেন আরও একটা ব্যাপার উনি আমার নামও জানেন!

*                   *                   *

ফেরার সময় অনিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম কাউকে ওর সন্দেহ হয় কিনা
তাতে মাথাটা সামনের দিকে বার দুয়েক ঝুঁকিয়ে অনিদা বলল, “সব্বাইকে
“মানে? কী বলতে চাইল বুঝলাম না
তাতে অনিদা বলল, “প্রথমজন তো মিঃ গাঙ্গুলী কারণ উনি মনে হচ্ছে জোর করে এই চিঠিপত্রের ব্যাপারে অনীহা দেখাচ্ছেন!
“ও,” একটু সময় নিয়ে আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “আর কে?
“নিঃসন্দেহে বিকাশ রায় ভদ্রলোকের আর্থিক অবস্থা ভালো না অবশ্য কতটা খারাপ তা না দেখলে বোঝা যাবে না!
আমরা বিকাশ রায়কে এখনও দেখিনি মনে হয় অনিদা ওনার সঙ্গে দেখা করবে কথাটা ভাবছি, এমন সময় অনিদা বলল, “সব থেকে সন্দেহজনক বলে মনে হল মিঃ গুহকে
“লোকটা তো মিথ্যে কথা বলে এসেছিল
তাতে মুচকি হেসে অনিদা বলল, “সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই আর মনে হয় না লোকটার বয়স অত হবে
“তাহলে? আমার পিঠের শিরদাঁড়ায় একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল
“হতে পারে লোকটা ছদ্মবেশে এসেছিল হতে পারে অন্য কোনো অল্পবয়স্ক ছেলে নাহলে প্রায় ষাটের কাছাকাছি বয়স, অথচ সিঁড়ি দিয়ে তিন তলায় উঠে এসেও হাঁপাল না! যদি না তার ভীষণভাবে শরীরচর্চার অভ্যাস থাকে
অনিদার কথা শুনে নানা রকমের চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করল আমাদের সন্দেহের তালিকায় এখন লোকসংখ্যা তিন তাদের মধ্যে মিঃ গাঙ্গুলী ছাড়া আর কাউকে দেখিনি বিকাশ রায়ের দেখা পেয়ে যাব কিন্তু মিঃ গুহ যদি ফলস কোনো লোক হয়, তাহলে তার দেখা পাব কী করে! এবার আমাদের গাড়ি একটা গর্তে পড়তে আমি সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম ভাগ্যিস সিট বেল্ট লাগানো ছিল! আবিষ্কার করলাম আমরা হরীশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে ঢুকে পড়েছি সামনে রাস্তায় ইলেকট্রিকের কাজ চলছে


কলেজ স্ট্রিটের একটা এঁদো গলির ভেতর অত্যন্ত পুরোনো একটা বাড়ির একতলার ছোট্ট একটা ঘরে বসে কথা হচ্ছিল প্রফঃ রায়ের প্রাক্তন সেক্রেটারি বিকাশ রায়ের সঙ্গে কথাতেই বোঝা যাচ্ছিল প্রাক্তন মালিকের সম্পর্কে ওনার শ্রদ্ধা কতটা বললেন এমন মানুষ নাকি সচরাচর দেখা যায় না
“তাহলে কাজটা ছাড়লেন কেন? প্রশ্ন করল অনিদা
“টাকাটা বড্ড কম মিঃ সেন বললেন মিঃ রায়
“আপনি ওনার চিঠিগুলোর ব্যাপারে জানতেন?
“জানতেন কী বলছেন মশাই? চোখ বড়ো বড়ো করে মিঃ রায় বললেন, “ওগুলো সর্ট আউট করা থেকে শুরু করে কম্পুটারে এন্ট্রি করা, টাইপ করা, সব তো আমিই করতাম
“আপনি কোথায় চাকরি করতেন?
“কলকাতা করপোরেশনে চার বছর হল রিটায়ার করেছি
“সংসার চলে কী করে?
“চলে আর-কি? চালিয়ে নিতে হয় সামান্য কিছু পেনশন তাই তো ওই কাজটা ধরেছিলাম
ভদ্রলোকের কথা শুনে খারাপ লাগছিল আমার এর মধ্যে ওনার স্ত্রী মুড়ি-তেলেভাজা নিয়ে এসেছেন সঙ্গে চা অন্য কেউ হলে হয়তো ভদ্রতা করে বলত যে আবার এগুলো কেন? অনিদার অবশ্য সে সবের কোনো বালাই নেই মহানন্দে মুড়ি-তেলেভাজা মুখে পুরে চিবোতে শুরু করল ভদ্রমহিলা খুবই অমায়িক আদর আপ্যায়ন দেখে মনে হচ্ছিল আমরা ওনাদের অনেক দিনের পরিচিত কেউ
“চুরিটা কে করল বলে মনে হয় আপনার? খেতে খেতে প্রশ্ন করল অনিদা
“পরিচিতদের মধ্যেই কেউ করে থাকবে ওনার তো এই লাইনে অনেক পরিচিতি তাদের মধ্যেই হয়তো কেউ
“এভাবে অত রাতে তিন তলার ব্যালকনি টপকে!
“ভাড়াটে চোর হতে পারে
“হুম, কিছুক্ষণ চিন্তা করে অনিদা বলল, “আচ্ছা, চিঠিগুলো কি বাইরে বিক্রি করা যেতে পারে? মানে খরিদ্দার পাওয়া যাবে?
“যাবে মানে? নিশ্চয়ই যাবে!
“আপনি তেমন কাউকে চেনেন? মানে যারা ওগুলো কিনতে পারেন? মানে যাদের ও ব্যাপারে আগ্রহ ছিল?
“এই মুহূর্তে দু’জনের নাম করতে পারি
“তাদের ওনার ফ্ল্যাটে যাতায়াত ছিল?
“না, যাতায়াত ছিল না,” মাথা নেড়ে বললেন বিকাশ রায়
“ওকে,” আবার কিছুটা সময় নিল অনিদা তারপর জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, প্রফঃ রায়ের স্ট্যাম্পের কালেকশান ছিল, জানতেন?
“হ্যাঁ, খাতাটা দেখেছি দেশবিদেশের অনেক স্ট্যাম্প ছিল তাতে
“ওটাও কিন্তু চুরি গেছে
কথাটা শুনে মিঃ রায় চোখ কপালে তুলে বললেন, “সেকি ওগুলোও নিয়ে নিয়েছে!
“ওগুলোর বাজারদর কিন্তু কম না,” চায়ের কাপে চুমুক মেরে বলল অনিদা
“হ্যাঁ, একবার থেমে গিয়ে মুখ দিয়ে চুক করে একটা শব্দ করে বিকাশ রায় বললেন, “ভদ্রলোকের তো অনেক ক্ষতি হয়ে গেল
অনিদা এবার একটা অন্যরকম প্রশ্ন করল, “আপনার কাছে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
“দুটোই তবে কাগজপত্রগুলো বেশি দুর্লভ! মানে অনেক দরকারি তথ্য ছিল তো!
“আপনি কারও কাছে চিঠিগুলোর কথা বলেছিলেন?
“না মিঃ সেন,” মাথা নেড়ে মিঃ রায় বললেন, “কাজের কথা অন্য কাউকে বলব কেন? আর তাছাড়া মাত্র চার হাজার টাকার চাকরির কথা লোককে বলার মতো কী আছে বলুন তো? তবে হ্যাঁ, আমার স্ত্রী জানত
“হুম,” কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে অনিদা প্রসঙ্গ বদল করে জিজ্ঞাসা করল, “এ বাড়িতে আপনি আর আপনার স্ত্রী ছাড়া আর কে থাকে?
“আর কেউ থাকে না,” কথাটা বলেই কেন জানি না আচমকা গম্ভীর হয়ে গেলেন মিঃ রায়
অনিদা আবার প্রশ্ন করল, “আপনার ছেলে মেয়ে?
প্রশ্নটা শুনে কপালটা কুঁচকে গেল ভদ্রলোকের বললেন, “ছেলে ছিল মারা গেছে! কথাটা শুনে লক্ষ করলাম ওনার স্ত্রীর মুখটাও কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল গলাটাও এর মধ্যে গম্ভীর হয়ে এসেছে মিঃ রায়ের
উত্তরটায় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল অনিদা
বেরোনোর সময় বিকাশ রায়কে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল অনিদা জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা আপনার কোনো যমজ ভাই আছেন?
প্রশ্নটা শুনে মুখটা এবার কেন জানি না কালো হয়ে গেল ভদ্রলোকের বললেন, “কই না তো! কেন বলুন তো?
অনিদা তখন মুচকি হেসে বলল, “না এমনিই আপনার মতো কাউকে যেন কোথাও দেখেছি!
দরজা দিয়ে বেরোচ্ছি, ঠিক এমন সময় সামনের আয়নায় পরিষ্কার দেখতে পেলাম বিকাশ রায় আর তাঁর স্ত্রী-এর মধ্যে কোনো একটা তথ্য আদানপ্রদান হয়ে গেল!
জিনিসটা অনিদাও লক্ষ করেছিল ওকে সেটা বলতে বলল, ভদ্রলোক নাকি কিছু একটা লুকোচ্ছে কারণ জিজ্ঞাসা করতে বলল, ওনার ভাবটা অনেকটা এইরকম যে জানেন সব, কিন্তু সবই অজানা অনেকটা ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো

*                   *                   *

কলেজ স্ট্রিট থেকে আমাদের গাড়ি সোজা এগিয়ে চলল প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের দিকে কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কিছুই জানি না অনিদাও কিছু বলছে না বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তেজনাটা আর চাপতে না পেরে এবার জিজ্ঞাসা করলাম, “কে চোর হতে পারে, কিছু আন্দাজ করতে পারছ?
“কেসটাতে সবাইকে সন্দেহ করা যায়,” বলল অনিদা
“তবু মানে কেউ বেশি কেউ কম তো হতেই পারে
“যেই হোক সে অবশ্যই চেনাশোনা কেউ আর চেনাশোনা লোক বলতে যাদের ওনার বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল শুধুমাত্র সেই নকল পোস্টমাস্টার ছাড়া
“চোরের উদ্দেশ্য কী বলে মনে হয় তোমার? চিঠি, পোস্টাল স্ট্যাম্প নাকি অন্য কিছু? আবার জিজ্ঞাসা করলাম ওকে
“পাল্লাটা চিঠিপত্রর দিকেই বেশি ঝুঁকে আছে
“আচ্ছা, ওই পোস্টমাস্টার যে নকল সেটার ব্যাপারে এত সিওর হচ্ছ কী করে?
তাতে আমাকে অবাক করে দিয়ে অনিদা বলল, “কসবা পোস্ট অফিসে আমার এক পরিচিত স্টাফ আছেন খবর নিয়েছি ওই টাইটেলের কোনো লোকই ওই পোস্ট অফিসে নেই!
আমি ওর কথা শুনে হাঁ করে ওর দিকে চেয়ে আছি বলতে থাকল
“সবাই যা যা বলেছেন সেগুলো ভেবে দেখ বিকাশ রায় বলেছেন উনি স্ট্যাম্পের কথা তেমনভাবে জানতেন না তাছাড়া একই কথা প্রফঃ রায়ও বলেছেন এবার আসি মিঃ গাঙ্গুলীর কথায় উনি বলেছিলেন টিকিটগুলো বিক্রি করে অনেক টাকা পাওয়া যাবে এখানে একটা লোভের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে উলটো দিকে প্রফঃ রায় আবার বলছিলেন ইতিহাস নিয়ে মিঃ গাঙ্গুলীর ইন্টারেস্ট অনেক
এতটা বলে থামল অনিদা আবার কিছুক্ষণ পর বলতে শুরু করল
“শেষ জন অবশ্যই সেই পোস্টমাস্টার মানে নকল মাস্টার আর-কি! সে জানত দেবাশিস রায় ইতিহাসের লোক কিন্তু সেদিন লোকটা এল কেন? কী করতে এল? চিঠি চুরি? নাকি স্ট্যাম্প চুরি? নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য? কারণ ছেলের পড়ার ব্যাপারটা তো স্রেফ ভাঁওতা
“অন্য উদ্দেশ্য! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম
“হয়তো প্রাথমিকভাবে ঘরের মাপজোক নিয়ে গেছিল
অনিদার কথাগুলো ধন্দে ফেলে দিল আমাকে এর মধ্যে লক্ষ করলাম আমাদের গাড়িটা আনন্দবাজারের অফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আমরা এখানে কী করছি সেটা অনিদাকে জিজ্ঞাসা করতে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, “কাগজের অফিসে যাব
“কোনো ইনফরমেশন জোগাড় করবে নাকি? আমি জিজ্ঞাসা করলাম
তাতে আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, “একটা বিজ্ঞাপন দেব
“বিজ্ঞাপন! আমি আরও দু-একটা কথা জিজ্ঞাসা করতাম কিন্তু আমাকে সে সুযোগ না দিয়ে সোজা অফিসে ঢুকে গেল
আনন্দবাজারের পর আমরা টাইমস অফ ইন্ডিয়া থেকে শুরু করে বর্তমান সমেত বড়ো বড়ো সব খবরের কাগজের অফিসেই ঢুঁ মারলাম এর ফলও মিলল হাতেনাতে আসলে বিজ্ঞাপনের বিষয় ছিল মিশর সম্পর্কে তথ্যসংগ্রহ যে ব্যক্তি উপযুক্ত তথ্য দিতে পারবে সে অনেক টাকার পুরস্কার পাবে!
জিনিসটা শুনে আমি বললাম, “এ বিজ্ঞাপন দেখে তো লোকে হাসবে আজকাল তো ইন্টারনেটেই সব পেয়ে যাওয়া যায়!
আমার কথা শুনে অনিদা হেসে বলল, “এটাই তো গুগলি!
এই তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশ অফিসার মিঃ তাপস মিত্রও কিন্তু আমার সঙ্গে একমত উনি বললেন, “এ জিনিস আদৌ কেসে কোনো হেলপ করবে না কারণ পেপারে অ্যাড দেওয়াটা এখন ব্যাকডেটেড ব্যাপার
রাজা রায়ের বসার ঘরে বসে কথা বলছিলাম আমরা বলতে বাধা নেই, অনিদা ছাড়া ঘরে উপস্থিত সবাই মনে করছে অনিদার পাতা ফাঁদটা একেবারেই বেকার চোর তো আর চুরি করে নিজে থেকে এসে জিনিসটা পুলিশের হাতে তুলে দেবে না! আর এই ‘সবার’ মধ্যে কিন্তু আমিও একজন! যদিও মনে মনে অবশ্যই চাইছিলাম অনিদার ফিকিরটা যেন কাজে লাগে
অনিদার এই নতুন ফন্দির কথা শুনে তাপস মিত্র বললেন, “কে জেনেশুনে এই ফাঁদে পা দেবে বলুন তো? আর তাছাড়া যে চুরি করেছে সে নিজে আসবে এখানে বেচতে? পাগল নাকি?
“বোকামো না চালাকি, তা জানি না তবে একটা চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী? হেসে বলল অনিদা
তাপস মিত্র লোকটাকে আমার বেশ লেগেছে ফরসা, সুন্দর, স্মার্ট কথাবার্তাতেও বেশ চৌকশ কথা বলতে বলতে আবিষ্কার করলাম ওনার সাধারণ জ্ঞানও নজর কাড়ার মতো
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা অবাক করা কাণ্ড ঘটে গেল আমরা আলোচনায় ব্যস্ত ঠিক সেই সময় বেজে উঠল ফ্ল্যাটের কলিং বেলটা প্রফঃ দেবাশিস রায় উঠে গিয়ে দরজা খুললেন এবং তাঁর অতি পরিচিত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, “ইয়েস?
দরজার ওপারের মানুষটাকে এখনও দেখে উঠতে পারিনি তবে একটা পুরুষ কণ্ঠ কানে এল
“আমি কি অধ্যাপক দেবাশিস রায়ের সঙ্গে কথা বলছি?
উত্তরে প্রফঃ রায়ের গলা কানে এল “হ্যাঁ বলছেন আপনি?
“আমি প্রবাল গুপ্ত আজকের কাগজের বিজ্ঞাপনটা দেখে
ভদ্রলোককে আর কথা শেষ করতে দিলেন না প্রফঃ রায় আসুন আসুন বলে ওনাকে প্রায় কোলে তুলে ঘরে নিয়ে এলেন উনি বিজ্ঞাপনের কথা শুনে অনিদা আর তাপস মিত্র, দু’জনেই এর মধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে আমার মনেও একটা আশার আলো উঁকি মারতে শুরু করেছে আসলে অনিদা কিছু করছে আর সেটা ফেইল করছে, জিনিসটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না এতক্ষণ সবার কথা শুনে মনমরা হয়ে গেছিলাম এবার এই লোকটা আসায় মনে জোর ফিরে পেলাম মনে হল, যাক, অনিদা তাহলে ভুল কিছু করেনি!
ভদ্রলোকের চেহারা মনে রাখার মতো কিছু না তবে মুখে যা বললেন, তাতে কেসটা হয়তো একটা নতুন মোড় নিতে চলল
ভদ্রলোক সোফায় বসতে অনিদা ওনাকে জিজ্ঞাসা করল, “আজকের বিজ্ঞাপনটা আপনি দেখেছেন?
“হ্যাঁ,” মাথা নাড়লেন প্রবাল গুপ্ত
“আপনি কি এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারেন?
“আশা করি পারি,” মুচকি হেসে বললেন ভদ্রলোক
“কীভাবে? আপনি কি ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা করেছেন?
“না, মাথা নেড়ে ভদ্রলোক বললেন, “আমি ব্যবসায়ী
কথাটা শুনে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে প্রফঃ রায় বললেন, “তাতে আমার কী লাভ?
তাতে এতটুকু না দমে গিয়ে উনি বললেন, “আমি ব্যবসায়ী মানুষ আপনার লাভ করাতে হলে আমি এতদূর ছুটে আসতাম না নিশ্চয়ই?
“মানে?
“আমি এসেছি বিজ্ঞাপনে টাকার ব্যাপারটা দেখে এবার সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “যে জিনিস খুঁজছেন, সেটা পেলে আমার লাভের অংশ কত হবে?
প্রবাল গুপ্তর কথা শুনে মনে বেশ চটলেন প্রফঃ রায় বাজখাঁই গলায় বলে উঠলেন, “কী ইনফরমেশন আছে আপনার কাছে সেটা তো দেখি আগে!
তাতে এক মিনিট”, বলে ব্যাগ থেকে এবার একটা মোটা প্যাকেট বের করলেন প্রবাল গুপ্ত আমরা সবাই সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সেটার ওপর ঝুঁকে পড়লাম উনি এবার সেটা দেবাশিস রায়ের হাতে দিয়ে বললেন, “দেখুন তো, এটা আপনার কোনো কাজে লাগে কিনা?
একবার করে অনিদা আর তাপস মিত্রর দিকে চেয়ে নিয়ে দেবাশিস রায় ওনার হাত থেকে প্যাকেটটা নিলেন এবার খয়েরি মোড়কটা খুলে তার ভেতরের কাগজগুলো বার করে বারকয়েক নাড়াচাড়া করতেই ওনার চোখজোড়া চিকচিক করে উঠল তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে হুররে বলে চেঁচিয়ে উঠে বলে উঠলেন, “পেয়েছি, পেয়েছি তারপর আনন্দে প্রায় নাচতে নাচতে প্রবাল গুপ্তকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আপনি যে আমার কী উপকার করলেন তা বলে বোঝাতে পারব না
আমাদের অবশ্য তখন আর বুঝতে বাকি নেই যে চুরি যাওয়া সব চিঠিপত্র দেবাশিস রায়ের হাতে ফেরত চলে এসেছে আমি আশা করিনি উনি জিনিস আর কোনোদিন ফেরত পাবেন বলে! প্রবাল গুপ্ত কিন্তু ওনার পাওনাগন্ডা বুঝে নিতে তৎপর বললেন, “আমার পাওনা মিটিয়ে দিন তারপরেই জিনিস আপনাদের হবে
অনিদা তখন বলল, “সবই হবে কিন্তু যে জিনিস আপনি ওনাকে বিক্রি করতে এসেছেন, তার আসল মালিক কিন্তু উনিই দিনকয়েক আগে এগুলো ওনার ফ্ল্যাট থেকে চুরি গেছিল
“মানে? অনিদার কথা শুনে এবার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন প্রবাল গুপ্ত বললেন, “এর মানেটা কী? বিজ্ঞাপন দেখে আমি এলাম আর এখন টাকার কথা শুনে আপনারা সুর বদল করে ফেললেন!
আবহাওয়া আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝতে পেরে অনিদা বলল, “আপনার প্রাপ্য টাকা আপনি নিশ্চয়ই পাবেন মিঃ গুপ্ত কিন্তু তার আগে আপনি কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিন
তাতে উনি তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠলেন, “প্রশ্ন? কীসের প্রশ্ন?
“এ জিনিস আপনি কোথায় পেয়েছেন?
“এক পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের কাছ থেকে
“পাঞ্জাবি ভদ্রলোক! অনিদার কপাল কুঁচকে গেল বেশ বুঝতে পারলাম মঞ্চে আরও এক অভিনেতার আবির্ভাব হল
“হ্যাঁ, আমি ওনার থেকে এটা কিনেছিলাম
“কোথা থেকে? মানে কোথায় ওনার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল? আর কত টাকায় কিনেছিলেন?
“হোটেল সান ইন্টারন্যাশনালে তিন লাখ দিয়েছিলাম ফুল ক্যাশ
“হুম আপনি জানলেন কী করে ওনার কাছে এ জিনিস আছে? আর উনি আপনাকে বেচলেনই বা কেন?
“দেখুন, আমার অ্যান্টিক জিনিস কেনাবেচার ব্যাবসা সেদিন হোটেল সান ইন্টারন্যাশনালে আমি এক খদ্দেরের সঙ্গে দেখা করতে যাই সেখানকার লবিতে ওই পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় উনি আমাকে জিনিসটা অফার করেন আমি বুঝতে পারি ঠিক লোকের কাছে বেচতে পারলে মোটা টাকা কামানো যাবে তাই সেই সুযোগ নষ্ট করিনি
“উনি ওটা কোথা থেকে পেয়েছিলেন সেটা জিজ্ঞাসা করেছিলেন?
“না
“ভদ্রলোককে কেমন দেখতে ছিল বলতে পারবেন?
অনিদার প্রশ্নে মিঃ গুপ্ত হেসে বললেন, “দেখুন সব পাঞ্জাবিদের দেখতে আমার একইরকম মনে হয় মুখ ভর্তি দাড়ি আর গোঁফ সঙ্গে মাথায় পাগড়ি বাট হি ওয়াজ ওয়েল বিল্ট এবার তাপস মিত্রের দিকে ইশারা করে বললেন, “অনেকটা ওনার মতো
কথাটা শুনে বারদুয়েক গলা খাঁকারি মেরে পুলিশ অফিসার তাপস মিত্র বললেন, “পাঞ্জাবিদের স্বাস্থ্য সবসময় ভালোই হয়
এতক্ষণ চুপ করে কথা শুনছিলেন প্রফঃ দেবাশিস রায় এবার গলা সপ্তমে চড়িয়ে বললেন, “কিন্তু জিনিস তো আমার
তাতে মুখ খিঁচিয়ে মিঃ গুপ্ত বললেন, “যতক্ষণ না টাকা পাচ্ছি, জিনিসের আশা ছেড়ে দিন মশাই
দেবাশিস রায় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু অনিদা ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “নিশ্চয়ই মিঃ গুপ্ত, জিনিস আপনার তবে চিন্তা করবেন না ঠিক দাম দিয়েই আমরা জিনিস আপনার কাছ থেকে কিনব তবে হ্যাঁ, একটা কথা আপনাকে আমাদের দিতে হবে
“বলুন,” বলে প্যাকেটটা টেবিল থেকে তুলে নিলেন মিঃ গুপ্ত
“ওই পাঞ্জাবি না ধরা পড়া পর্যন্ত আপনি জিনিস কাউকে দেবেন না না হলে ইতিহাসের গবেষণার কাজে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে এবার উঠে দাঁড়িয়ে মিঃ গুপ্ত বললেন, “ওকে, তাই হবে তবে একটা টাকাও আমি লস করতে রাজি নই মনে থাকে যেন
তাতে মুচকি হেসে অনিদা বলল, “আচ্ছা মনে থাকবে
প্রবাল গুপ্ত চলে যেতে আমাদের আলোচনা ঘুরল ওই পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের দিকে প্রফঃ রায় অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না যে তেমন কাউকে উনি চেনেন কিনা তবে উনি এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত এই ভেবে যে ওনার সব কাগজপত্র এখনও অক্ষত!
বুঝতে পারলাম রহস্যের জট খুলতে আরও বেশ কিছুটা সময় লাগবে তবে সেই পাঞ্জাবি লোকটা যে একটা বিরাট সূত্র, তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই একবার শুধু তাকে হাতে পাওয়ার অপেক্ষা! ফেরার পথে কথাটা অনিদাকে বলতে বলল, “আরও একজন আছে
“সে আবার কে?
“সেই পোস্টমাস্টার লোকটা!
অনিদার কথা ফেলে দেবার মতো ছিল না বলল, “বিকাশ রায় বা মিঃ গাঙ্গুলীর কথাও ভুলে গেলে চলবে না
তার মানে কেস এখনও ঘোলাটে
আমার কথায় উত্তর না করে অনিদা হেসে গাড়ির গতি বাড়াল


আজ সকালবেলা আমরা জমায়েত হয়েছি প্রফঃ দেবাশিস রায়ের বাড়িতে অনিদা ওর এক স্কেচ আর্টিস্ট বন্ধুকে ডেকেছে উদ্দেশ্য প্রবাল গুপ্ত আর দেবাশিস রায়ের কথার ওপর ভিত্তি করে সেই অচেনা পোস্টমাস্টার আর পাঞ্জাবি লোকটার ছবি আঁকানো প্রবাল গুপ্তর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অফিসার তাপস মিত্রও এসেছেন আজ কোনো কেসে এই ছবি আঁকার পদ্ধতিটা এই প্রথমবার ব্যবহার করছে অনিদা তাই আমিও যারপরনাই উত্তেজিত! শুধুমাত্র মুখের বর্ণনা শুনে শিল্পি কোনো একটা মানুষের ছবি এঁকে ফেলবে! জিনিসটা আমার কাছে রহস্যজনক! টিভি বা সিনেমাতে দেখেছি কিন্তু চাক্ষুষ এই প্রথম দেখব হতে পারে এই ছবির সাহায্যেই ধরা পড়ে যাবে অপরাধী! ব্যাপারটা ভেবেই আমার গা শিউরে উঠছে কিন্তু আমার মনে এখন একটাই চিন্তা পোস্টমাস্টার বা ওই পাঞ্জাবি লোক, অপরাধী যেই হোক না কেন, তাকে ধরা হবে কী করে? কারণ এদের কাউকেই তো আমরা চিনি না! বা তারা তো আমাদের নাগালের বাইরে!
পেনসিলের একের পর এক টানে চোখের পলকে দুটো ছবি এঁকে ফেলল স্কেচ আর্টিস্ট আঁকাগুলো দারুণ হলেও তা আসল লোকগুলোর সঙ্গে একশো শতাংশ মিলে গেছে কিনা তা বলতে পারব না কারণ ওইটুকু সময়ের মধ্যে কারও পক্ষে একটা মানুষের মুখ মনে রেখে দেওয়া সম্ভব না
অনেক সময় আসামী নামি হলে পুলিশ তাদের দেখেই চিনে ফেলে আমি আশা করেছিলাম তাপস মিত্রও তেমন কিছু একটা করবেন কিন্তু সেইরকম কিছু হল না কারণ উনি এদের কাউকেই চিনতে পারলেন না যার থেকে বোঝা গেল লোকদুটো কোনো নামকরা অপরাধী নয় মানে অনিদার কাজ বাড়ল
ঘরে প্রফঃ রায়ের দাবাড়ু বন্ধু মিঃ গাঙ্গুলীও উপস্থিত ছিলেন ছবি দুটোকে অনেকক্ষণ উলটেপালটে দেখে উনি ছোট্ট করে বললেন, “হুম
“কি, চিনতে পারলেন? অনিদা জিজ্ঞাসা করলেন
“নাঃ আবার ছোট্ট কথায় উত্তর করে ছবিগুলো উনি ফেরত দিয়ে দিলেন অনিদাকে
ছবিগুলো আমাদের কোনোরকম আশার আলো দেখাতে পারল না অনিদা অবশ্য সেগুলো গুছিয়ে নিজের কাছে রেখে দিল আবার এমন একটা মানুষ যে কিনা কোনো খারাপ অবস্থাতেই আশাহত হয় না!
ওদিকে প্রফঃ রায়ের টেনশন আর আগের মতো নেই তবে একেবারে শান্ত হয়েছেন তাও বলা যাবে না অবশ্য চিঠিগুলো হাতে না পাওয়া পর্যন্ত ওনার ছটফটানি কিছুতেই কমবে না সেটা বুঝতে পারছি বার দুয়েক মুখ দিয়ে চুক করে শব্দ করে অনিদাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কবে আমার সম্পত্তি ফেরত পাব বল তো?
তাতে মুচকি হেসে অনিদা বলল, “পাবেন প্রফঃ রায় এক পা দুপা করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠাই ভালো এক ধাপে অনেকটা উঠতে গেলে হড়কে পড়ে যাবার ভয় থাকে, তাই না?
দেবাশিস রায়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সবেমাত্র গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে গজ দশেক এগিয়েছে, আর সঙ্গে সঙ্গে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল অনিদা
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “কী হল?
আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে হুড়মুড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে পেছনদিকে দৌড় লাগাল অনিদা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের কাচ দিয়ে দেখি দৌড়ে দেবাশিস রায়ের বিল্ডিং-এর গেটের সামনে গিয়ে কী যেন একটা কুড়িয়ে নিল অবশ্য সেটা কীসের সেটা বুঝতে না পারলেও মুখের ভাবই বলে দিচ্ছিল যে পাহাড়প্রমাণ কিছু একটা হাতে পেয়েছে জিনিসটা বুঝতে পেরে আমার মনের ভেতরটা চনমনিয়ে উঠল ফিরে এসে গাড়িতে এসে বসতে আমি ওর দিকে উৎসুক হয়ে ঝুঁকে পড়লাম
অনিদা তাতে মুচকি হেসে বলল, “পাঞ্জাবির পায়জামা
ওর হেঁয়ালি বোঝার ক্ষমতা আমার নেই তবে ওর কথায় একটা আশার আলো দেখতে পেলাম চোরকে কি তাহলে চিনতে পেরেছে? প্রশ্নটা করতে বলল, “আজ থার্সডে সামনের রবিবারের মধ্যে ঝামেলা মেটাব” ওর কথা শুনে মনটা খুশিতে নেচে উঠল ভেবে দেখলাম রহস্যের যবনিকা পতন হতে আর বাকি মাত্র তিন দিন অবশ্য এর বেশি আর আমাকে কিছু বলল না বুঝলাম দম চেপে রেখে আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেই!

*                   *                   *

রাত এখন পৌনে একটা আমি আর অনিদা এখন ওর পড়ার ঘরে টিভিতে একটা ডকুমেন্টারি চলছে কলকাতার ওপর জানতে পারলাম লেনিন সরণি এলাকার ধর্ম ঠাকুরের নাম থেকে নাম হয়েছিল আজকের ধর্মতলার আদি চিত্তেশ্বরী ঠাকুরের নাম থেকে নাম হয়েছে আজকের চিৎপুরের আরও জানতে পারলাম যে আমাদের বাড়ির ঠিক পেছনের আদি গঙ্গা একসময় বইত বালিগঞ্জ দিয়ে সেখানে ধীরে ধীরে বালি জমে জায়গাটা সমান হয়ে যায় পরে সেখানে গড়ে ওঠে একটা বাজার বা গঞ্জ আর সেই থেকেই ওই অঞ্চল হয়ে যায় বালিগঞ্জ সব থেকে মজা লাগল এই জেনে যে ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌল্লা কলকাতা আক্রমণ করেছিলেন তাঁর সৈন্যবাহিনীতে ছিল সেনা, কামান, অশ্বারোহী আর হাতির পাল সেই হাতির পালকে একটা বাগানে রাখা হয়েছিল আর সেই থেকেই ওই অঞ্চলের নাম হয়ে যায় হাতিবাগান সিরাজের ওই বাহিনীর নাম ছিল ‘চতুরঙ্গ’
আমার চোখ টিভিতে অনিদা সেই থেকে সেই পোস্টমাস্টার আর পাঞ্জাবির ছবি নিয়ে বসে আছে মজার ব্যাপার, দুটো ছবিরই বেশ কিছু জেরক্স করেছে ঠিক এমন সময় চেঁচিয়ে উঠল “হুররে!
কী হল? আচমকা এমন চিৎকারে পিলে চমকে গেছিল আমার তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে অনিদার কাছে গিয়ে দেখি পোস্টমাস্টার আর পাঞ্জাবিটার ছবি দুটো পাশাপাশি রেখে একদৃষ্টে সেগুলোর দিকে চেয়ে আছে আমি অপলকে বেশ কিছুক্ষণ ওই ছবিগুলোর দিকে চেয়ে রইলাম এবার ধীরে ধীরে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে গলা নামিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিছু পেলে অনিদা?
তাতে চাপা গলায় বলল, “কিছু দেখতে পাচ্ছিস?
অনিদার ইশারা কোন দিকে বুঝতে পারলাম না দেখলাম টেবিলে দু-চারটে পেনসিল আর জল রং আর তুলি পড়ে আছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সবেমাত্র সেগুলো ব্যবহার হয়েছে অনিদার ছবি আঁকার হাত যে বেশ ভালো তা অনেক নামী শিল্পীও স্বীকার করেছে জিজ্ঞাসা করলাম, “পোস্টমাস্টার আর পাঞ্জাবির ছবিগুলো পাশাপাশি রেখে কী বার করার চেষ্টা করছ অনিদা?
আমার কথায় মুচকি হেসে বলল, “পোস্টমাস্টার আর পাঞ্জাবি না পাঞ্জাবি আর পোস্টমাস্টার পেনসিল আর তুলির টানে এধারেরটা ওধারের হয়ে গেছে
“মানে? ওর কথাটা হেঁয়ালি লাগল আমার কাছে
অনিদা বলল, “পোস্টমাস্টারের গালে পেনসিল চালালাম, পাঞ্জাবি হয়ে গেল আর পাঞ্জাবির গালে সাদা রঙের পোঁচ দিয়ে তারপর একটু পেনসিল চালালাম, পোস্টমাস্টার হয়ে গেল
এতেও অনিদার কথার মারপ্যাঁচ ধরতে পারলাম না মনে হল বুঝেও বুঝতে পারছি না অনিদা একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে রইল বুঝলাম আমাকে সময় দিচ্ছে এবার আসল ব্যাপারটা আস্তে আস্তে আমার কাছে পরিষ্কার হতে শুরু করল আসলে পোস্টমাস্টার আর পাঞ্জাবি, দুটো লোকই এক! যেটা কিনা অনিদা পেনসিল আর তুলি দিয়ে প্রমাণ করে ফেলেছে
“আরে বাঃ! চোখের সামনে জটটা খুলে যেতে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলাম আমি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই গম্ভীর হয়ে গেলাম মনে হল এই পোস্টমাস্টার লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছি! কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কিছু মনে করতে পারলাম না ভেতরটা আনচান করতে শুরু করল অনিদাকে সে কথা বলতে মুচকি হাসল বুঝলাম অপরাধীকে চিনে ফেলেছে! কারণ ওই পাঞ্জাবি আর পোস্টমাস্টার, দু’জন যে একই লোক, সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই আর সেই লোকই হল গিয়ে চিঠি চোর! কিন্তু লোকটা যে আসলে কে সে কথা আমার কাছে খোলসা করছে না এবার ওর লালবাজারের বন্ধু রাজাদাকে ফোন করে বলল যে ওর আগামীকাল কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দরকার
“তাহলে সকালে পাওয়া পাঞ্জাবির পায়জামা?
আমার প্রশ্নের উত্তরে ব্যাগ থেকে একটা খাম বার করে আমাকে দিয়ে বলল, “প্রেরক ডঃ উইলিয়াম হার্ড
“মানে? আমি অবাক হয়ে বললাম
“যে খামগুলো করে দেবাশিস রায়ের গুরুত্বপূর্ণ চিঠিগুলো এসেছিল, এটা সেগুলোর মধ্যে একটা
“এটা তুমি কোথায় পেলে? আমার মুখ অজান্তেই হাঁ হয়ে গেল
তাতে অনিদা আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে বলল, “চোরের পকেট থেকে পড়ে গেছিল প্রফঃ রায়ের বাড়ির সামনের রাস্তায় লাকিলি ওটা আমার হাতে চলে আসে আর সব কিছু জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়!
অনিদার কথা শুনে আমি চনমনিয়ে উঠলাম উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “তাহলে চোরটা কে?
তাতে হেসে বলল, “সেই পাঞ্জাবি বা পোস্টমাস্টার!
“কিন্তু ওদের কাউকে তো আজ সকালে ওখানে দেখতে পাইনি!
আমার কথা শুনে একটা একপেশে হাসি হেসে বলল, “একটু চোখ খোলা রাখলেই দেখতে পেতিস
অনিদা এবার আমাকে প্রায় জোর করে ঘরে পাঠিয়ে দিল কারণ এবার শুতে হবে কাল সকালে উঠে আবার যোগাসন আছে ক্লাইম্যাক্সের একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে অপরাধী কে জানতে না পেরে ঘুমোনোর চেষ্টা করা যে কী চ্যালেঞ্জিং, তা বলে বোঝানো যাবে না মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল কতগুলো প্রশ্ন চোর কি তবে মিঃ গাঙ্গুলী? নাকি বিকাশ রায় নিজেই পাঞ্জাবি সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? নাকি প্রফঃ দেবাশিস রায়েরই এটা একটা চাল? কিন্তু সেটা হলেই বা তার কারণ কী? আকাশ পাতাল কতকিছুই মনে আসছিল আমার এমন সময় দেখি মিশরের তিন হাজার খ্রিষ্টপূর্বের ফারাওদের আমলে পৌঁছে গেছি আমরা মাথায় মুকুট, গায়ে বর্ম, হাতে তলোয়ার নিয়ে রাজার দরবারে লোকজন ঘোরাফেরা করছে আর তারই মাঝে জিন্স, টিশার্ট পরে পপ কর্ণ আর কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতে খেতে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি আর অনিদা! এখানে কেউ বাংলা, হিন্দি বা ইংরিজি জানে না তাই ইশারাতেই কাজ চালাতে হচ্ছিল আমাদের


আজ সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে ঘণ্টাখানেকের জন্য কোথায় যেন বেরিয়েছিল অনিদা বাড়ি ফিরতে দেখি ওর মেজাজ একেবারে তোফা!
“কোথায় গেছিলে অনিদা?
আমার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে আমাকে বলল, “জলদি রেডি হয়ে নে বেরোতে হবে
“কোথায় যাব? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম
“কলেজ স্ট্রিট বিকাশ রায়ের বাড়ি
“কেন? আমি আবার অবাক হলাম
প্রশ্নটা শুনে আমার ওপর কেমন যেন খ্যাঁক করে উঠল বলল, “সেটা তোকে জানতে হবে না
বকা খেয়ে আমি দমে গেলাম গাড়িতে উঠতে উঠতে আমাকে একটা ক্রেপ ব্যান্ডেজ দিয়ে বলল, “ডান পায়ের গোড়ালির ওপর বেঁধে নে খেলতে গিয়ে তোর পায়ে লেগেছে
এটা আবার অনিদার কী নতুন ফিকির কে জানে? তবে এতটুকু বুঝলাম যে এই নাটকে আমারও একটা ভূমিকা আছে সাতপাঁচ ভাবছি, তখন অনিদা আমাকে বলল, “বিকাশ রায়ের বাড়িতে ঢুকে বসার পর বলবি তুই একবার ওয়াশ রুমে যেতে চাস আর তুই সেখানে যেতে গিয়েই টাল খেয়ে পড়ে যাবি, কারণ তোর ব্যথা জায়গায় চাপ লাগবে আর তুই সেটা সহ্য করতে পারবি না ওকে?
বুঝেছি বুঝলাম বিকাশ রায়ের বাড়িতে নতুন কোনো একটা তথ্য জোগাড় করতে যাচ্ছে অনিদা
বিকাশ রায়ের বাড়ি পৌঁছোতে উনি প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন যে তদন্তের কোনো কিনারা হল কিনা
তাতে মুচকি হেসে অনিদা জানাল যে হয়ে এল বলে
তা শুনে খুশি হলেন মিঃ রায়
এর মধ্যে অনিদা আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করতে আমি বাথরুম কোনদিকে জানতে চাইলাম বিকাশ রায় আমাকে বাথরুমের রাস্তা দেখাতে উঠলে পর আমিও উঠে দাঁড়ালাম দুপা এগিয়েছি, এমন সময় কায়দা করে টাল খেয়ে পড়লাম আমার অবস্থা দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন বিকাশ রায় ছুটে এলেন আমার কাছে চেঁচিয়ে অনিদাকে ডাকতে লাগলেন প্রায় কুড়ি সেকেন্ড পর অনিদা ঘর থেকে বেরিয়ে এল ততক্ষণে মিসেস রায়ও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন
“আপনার ভাই পড়ে গেছেন! অনিদাকে দেখে ফ্যাকাশে গলায় বললেন মিঃ রায়
“ও কিছু না,” বলে ততক্ষণে উঠে বসেছি আমি এবার অনিদার ইশারা পেয়ে অভিনয় করতে করতে কষ্ট করে উঠে দাঁড়ালাম
“শরীর ঠিক আছে তো বাবা? ভয়ার্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলেন মিসেস রায়
“হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ঠিক আছি ওই খেলতে গিয়ে পায়ে একটু লেগেছিল” - বলে ব্যান্ডেজ বাঁধা গোড়ালিটা দেখালাম তারপর বললাম, “হাঁটতে গিয়ে ব্যথা জায়গায় চাপ লেগে গেছিল তাই টাল খেয়ে পড়ে গেছিলাম
“ইউ আর ওকে নাউ? একটা দুলকি চালে প্রশ্ন করল অনিদা
“হ্যাঁ,” মাথা নাড়লাম আমি আমার দিকে চেয়ে চোখ টিপল বুঝলাম আমি পাশ করে গেছি আর ওর কাজও মিটে গেছে
বিকাশ রায়ের বাড়ি থেকে আমরা এবার সোজা গিয়ে উঠলাম কলেজ স্ট্রিট বই পাড়ায় উদ্দেশ্য ‘সেরা সত্যজিৎ’ বইটা কিনব বই কেনা হলে পর আমরা এবার সোজা গেলাম ধর্মতলার আমিনিয়াতে বিরিয়ানির প্লেট থেকে এক চামচ বিরিয়ানি তুলে নিয়ে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে একটা পুরোনো বাংলা গানের সুর ভাঁজতে লাগল অনিদা ওর এই তুরীয় মেজাজের কারণটা অবশ্য আমার জানা অনিদা কেস সলভ করে ফেলেছে আমি অবশ্য যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই

*                   *                   *

আজ রবিবার নান্দিকারের একটা নতুন প্রোডাকশানের একাডেমিতে দুটো টিকিট কাটা আছে সকালটা অবশ্য বুক করা আছে প্রফঃ রায়ের জন্য
কথামতো সকাল দশটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম প্রফঃ দেবাশিস রায়ের বাড়ি অনিদা আর আমি ছাড়াও ঘরে আছেন প্রফঃ দেবাশিস রায়, ওনার দাবাড়ু বন্ধু মিঃ গাঙ্গুলী, ব্যবসায়ী প্রবাল গুপ্ত, দেবাশিস রায়ের প্রাক্তন সহকারী বিকাশ রায় এছাড়াও আছেন লোকাল থানার ওসি তাপস মিত্র আর অনিদার বন্ধু লালবাজারের ওসি রাজাদা এছাড়াও অনিদার অনুরোধে এসেছেন কলকাতার এসিপি প্রদ্যুৎ দাশগুপ্ত রাজাদা ঠিক আছে কিন্তু এসিপি দাশগুপ্ত কেন, আন্দাজ করতে পারলাম না
“চোরের সন্ধান কি পাওয়া গেছে? প্রশ্ন করলেন প্রফঃ রায়
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনিদা মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “হ্যাঁ তারপর এক অজ্ঞাত কারণে রাজাদার দিকে তাকিয়ে হাসল উত্তরে দেখলাম রাজাদাও মুচকি হাসল জিনিসটা আমার কাছে একটা হেঁয়ালি! যদিও বুঝে গেলাম অনিদার মতো রাজাদাও জেনে গেছে চোরের পরিচয় এতে আমার একটু রাগ হল আমি কিনা অনিদার ছায়াসঙ্গী! আর ভেতরের খবর আমার আগে জেনে গেল রাজাদা! যাই হোক, রাগ চেপে প্রশ্ন করলাম, “চোর তো সেই পাঞ্জাবি লোকটা?
“নিঃসন্দেহে,” বলল অনিদা এবার এসিপি দাশগুপ্তকে কেসের পুরো গল্পটা সংক্ষেপে বলতে উনি নিচের ঠোঁট উলটে বললেন স্ট্রেঞ্জ!
অনিদা তাতে হেসে বলল, “এমন কেস আমি খুব কমই দেখেছি প্রদ্যুৎদা
“তাহলে পাঞ্জাবি লোকটা এখন কোথায়? জিজ্ঞাসা করলেন পুলিশ অফিসার তাপস মিত্র
“খেলোয়াড়কে পেশ করার আগে তার খেলার ধারাবিবরণীটা একবার দিয়ে নিই,” মুচকি হেসে বলল অনিদা তারপর প্রফঃ রায়ের উদ্দেশে বলল, “একটা কথা বলে রাখা ভালো, চোরের টার্গেট কিন্তু ছিল ওই চিঠিগুলো, স্ট্যাম্পগুলো নয়
তাতে প্রফঃ রায় গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, “চোর কে?
“আমাদের সন্দেহের তালিকার প্রথম নামটা হল মিঃ গাঙ্গুলী
অনিদার কথা শুনে খুক খুক করে বারদুয়েক কেশে নিয়ে তিরিক্ষি গলায় মিঃ গাঙ্গুলী বললেন, “আর ইউ জোকিং মিঃ সেন? দিজ ইজ ইনসাল্টিং!
“এ তুমি কী বলছ ভাই? আমতা আমতা করে প্রফঃ রায় বললেন, “উনি তো সজ্জন ব্যাক্তি!
অনিদা তাতে হেসে বলল, “আমি তো বলেছি আমার ওনাকে সন্দেহ হয়েছিল চোর তো বলিনি সন্দেহ করা তো আমাদের কাজ তবে প্রথমে সন্দেহ হলেও পরে নানান তথ্য থেকে বোঝা যায় উনি চিঠি চুরি করেননি
কথাটা শুনে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন মিঃ গাঙ্গুলী তারপর আবার গলা খাঁকারি মেরে বললেন, “তাহলে চোরটা কে?
“পোস্টমাস্টার লোকটাকে দেখেছেন প্রফঃ রায় আর পাঞ্জাবিকে দেখেছেন মিঃ প্রবাল গুপ্ত দুটো লোকেরই স্কেচ আমাদের কাছে রয়েছে প্রফঃ রায় আর প্রবাল গুপ্তর কথা অনুযায়ী ওই পোস্টমাস্টার আর পাঞ্জাবি, দু’জনেরই শারীরিক গঠন ছিল দারুণ এতটা বলে থামল অনিদা তারপর বলল, “আমার সন্দেহের তালিকায় দ্বিতীয় আর তৃতীয়জন হলেন বিকাশ রায় আর প্রবাল গুপ্ত
অনিদার কথা শুনে মাথা নামিয়ে নিলেন বিকাশ রায় তারপর ধীরে ধীরে মাথা তুলে বললেন, “আমি চোর নই
ওদিকে প্রবাল গুপ্ত বেজায় চটে গিয়ে বললেন, “আমি কিনা জিনিসটা আগ বাড়িয়ে নিয়ে এলাম আর আমাকেই চোর বানানো হচ্ছে!
তাতে অনিদা ওনাকে বেশ কড়া গলায় বলল, “আপনি যে পাঞ্জাবি লোকটার থেকেই চিঠিগুলো নিয়েছিলেন তা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কোনো কারণ আছে কি? হতেও তো পারে ওই পাঞ্জাবি লোকটা আপনার হয়েই কাজ করছিল!
তাতে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন মিঃ গুপ্ত বললেন, “আপনি আমাকে ফালতু এই সবের মধ্যে জড়াচ্ছেন কিন্তু আর আমি এই প্রফেসার ভদ্রলোককে চিনতামই না! তো ওনার কাছে চিঠি আছে না কী কাগজ আছে তা আমি জানব কী করে! আপনি এই বুদ্ধি নিয়ে গোয়েন্দা হলেন কী করে মশাই!
উত্তরে অনিদা প্রবাল গুপ্তর চোখে চোখ রেখে বলল, “পোস্টমাস্টার আর পাঞ্জাবি ভদ্রলোক যে সেম লোক তা আমি জানি আবার পাঞ্জাবি লোকটার আদৌ কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা তার কোনো সিওরিটিও নেই কিন্তু কেউ একটা পোস্টমাস্টার সেজে এসেছিল, সেটা সিওর
“তার মানে সেই লোকটাই আসলে প্রবাল গুপ্ত! চোখ কপালে তুলে বললেন প্রফঃ রায়
তাতে আবার চেঁচিয়ে উঠে প্রবাল গুপ্ত বললেন, “আপনাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
অনিদা তখন মুচকি হেসে বলল, “এর উত্তর আমি পরে দেব তারপর বিকাশ রায়ের দিকে চেয়ে বলল, চিঠিগুলো পেলে আপনার সুবিধে হত তাই না?
অনিদার কথা শুনে বিকাশ রায় করুণ মুখ করে বললেন, “আপনি আমাকে খামোখা অপরাধী সাজাচ্ছেন মিঃ সেন
তাতে অনিদা বলল, “আপনি অপরাধী নন? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে দেখুন তো?
অনিদার কথা শুনে আবার মাথা নিচু করে নিলেন বিকাশ রায়
“তাহলে কি চোর
আমাকে থামিয়ে দিয়ে অনিদা বলল, “একে একে সবাইকেই আমার সন্দেহ হয়েছিল জটের প্রথম প্যাঁচটা আমি খুলি যখন আমি বুঝতে পারি ওই পোস্টমাস্টার আর পাঞ্জাবি, একই লোক দুজন প্রত্যক্ষদর্শীর থেকে জানা যায় সে একজন শক্তসমর্থ মানুষ যদিও পোস্টমাস্টার লোকটা বেশ বয়স্ক মানে তাহলে বলতে হয় সে মেকআপে এসেছিল আর শেষে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমার হাতে আসে
“সেটা কী? প্রশ্ন করলেন প্রফঃ রায়
“একটা খাম বলল অনিদা
“কীসের খাম?
অনিদা তখন উইলিয়াম হার্ডের কাছ থেকে আসা খামটা প্রফঃ রায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলল, “চিনতে পারছেন?
“এ কী! এটা তুমি কোথায় পেলে? খামটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে গেলেন প্রফঃ রায়
“চোরের পকেট থেকে এটা পড়ে গেছিল আর ঘটনাচক্রে সেটা চলে এসেছিল আমার হাতে আর তাতেই তার আসল রূপটা আমার কাছে ধরা পড়ে গেছিল তাতেই আমি বুঝে যাই তার সমস্ত ছক কোনো এক সূত্র থেকে অপরাধী জানতে পেরেছিল যে প্রফঃ রায়ের কাছে রয়েছে দুর্মূল্য কিছু কাগজপত্র তখন থেকেই তার মাথায় এই সব চারা দিয়ে ওঠে সমানে সে ফন্দি আঁটতে থাকে যে কী করে ওই জিনিসগুলো হাতানো যায় সে জানতে পারে দেবাশিস রায়ের পড়ার ঘরেই রয়েছে সেই জিনিসগুলো কিন্তু সেগুলো সে পাবে কী করে? শেষে সে একটা স্টেপ নেয় বয়স্ক পোস্টমাস্টার সেজে সে সোজা চলে যায় প্রফঃ রায়ের ফ্ল্যাটে তবে সেদিন সে খুব একটা সুবিধে করে উঠতে পারেনি, কিন্তু অল্প সময়ের জন্য হলেও ঘরের সমস্ত খুঁটিনাটি সে দেখে নেয় সেদিন এরপর পর পর দু’বার সে চোর সেজে হানা সেয় প্রথম দিন বিফল হলেও দ্বিতীয় দিন সে সফল হয় এক্ষেত্রে একটা কথা না বলে পারা যায় না চুরির জন্য তিন তলার কার্নিশ বেয়ে উঠে জীবনের একটা বিশাল ঝুঁকি নিয়েছিল সে সন্ধে থেকেই সে লুকিয়ে থাকে এই বিল্ডিং-এর ছাদে তারপর রাত বাড়তে থাকলে সে ছাদ থেকে নেমে আসে কার্নিশ বেয়ে এসে ঢুকে পরে প্রফঃ রায়ের ঘরে!
কথাটা বলে অনিদা একবার আমার দিকে তাকাল বলল, “আলাদা কিছু করতে হলে উলটো দিক থেকে চিন্তা করতে হয় আমরা নিচ থেকে ওপরে ওঠার কথা ভাবছিলাম আর সে ওপর থেকে নিচে নেমেছিল! ওর কথা শুনে আমি মুচকি হাসলাম বলতে থাকল -
“আবার থেকে এও বোঝা যায়, এই সমস্ত বিষয়ে চোর বিশেষ ভাবে ট্রেইন্ড! যাই হোক চিঠিগুলো নিয়ে এবার সে হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকে বিক্রির জন্য কারণ জিনিস যাকে তাকে যেমন দেওয়া যাবে না, আবার সবার কাছে নিয়ে যাওয়াও যাবে না কারণ তাতে ধরা পড়ে যাবার চান্স থেকে যায় শেষে প্রবাল গুপ্তর সঙ্গে পরিচয় হয় সেই পাঞ্জাবির মানে চোরের তখন সে ছদ্মবেশে এই বিক্রিবাট্টার জন্য তখন সে বেশিরভাগ সময়েই ছদ্মবেশ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যাতে ধরা না পড়ে যায় সব ঠিকমতোই চলছিল দারুণ এগিয়েছিল সে, কিন্তু বিধি বাম শেষে পকেট থেকে খামটা পড়ে যেতে সব শেষ হয়ে গেল বেচারার!
এতক্ষণ একটানা কথা বলে একটু দম নিয়ে এক চুমুক জল খেল অনিদা ঘরের সবাই এতক্ষণ হাঁ করে ওর কথা গিলছিল আমি বললাম, “চোর তাহলে আশেপাশেরই কেউ?
“অফ কোর্স! ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের চেটোতে একটা ঘুসি মেরে বলল অনিদা তারপর আস্তে আস্তে মাথা ঘুরিয়ে বিকাশ রায়ের দিকে চেয়ে বলল, “উনি মিঃ রায়ের একজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ
“সে কী! চোখ কপালে তুলে বললেন প্রফঃ রায় অনিদার কথা শুনে ঘরে যেন তখন একটা বাজ পড়েছে! হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসলেন মিঃ গাঙ্গুলী! প্রবাল গুপ্ত একবার ডাইনে বাঁয়ে চেয়ে নিলেন তাপস মিত্র দেখলাম একদৃষ্টে চেয়ে অনিদার দিকে রাজাদা বা এসিপি মিঃ দাশগুপ্ত অবশ্য নির্বিকার আর আমার অবস্থা আলাদা করে কী বলব? পা দুটো শিরশির করছিল
“কে সে? আবার প্রশ্ন করলেন প্রফঃ রায় ওনার দৃষ্টি তখন অনিদার ওপর স্থির
এবার বেশ কিছুটা সময় নিল অনিদা তারপর ধীরে ধীরে বলল, “চোর হল বিকাশ রায়ের একমাত্র ছেলে
অনিদার কথা শুনে আমি বললাম, “কিন্তু উনি তো বলেছিলেন ওনার ছেলে মারা গেছে!
“মারা যায়নি উনি ওনার ছেলেকে ত্যাজ্য করেছিলেন বলল অনিদা
সে কথা শুনে ঘরের মধ্যে একটা ফিসফাস শুরু হয়ে গেল অনিদা বলতে থাকল
“প্রায় বছরখানেক আগের কথা ঘটনাচক্রে একটা খারাপ সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল বিকাশ রায়ের ছেলে উদ্দেশ্য অল্প সময়ে বড়োলোক হওয়া, কিন্তু বাদ সাধেন বিকাশ রায় ছেলের এই অধঃপতন উনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না প্রবল অশান্তি শুরু হয় ঘরের মধ্যে কিন্তু ছেলেকে বাগে আনা যায় না একের পর এক খারাপ কাজ করতে শুরু করে সে নিজের ছেলেকে আর নিজেই চিনতে পারেন না বিকাশ রায় এদিকে উনি তখন প্রফঃ রায়ের কাছে কাজ করতে শুরু করেছেন কথায় কথায় উনি ওনার স্ত্রীকে বলেন ওই চিঠিপত্রের কথা আর ওনার স্ত্রী-এর থেকেই সেগুলোর কথা জানতে পারে ওনার ছেলে ব্যস, শুরু হয়ে যায় ফিকির তৈরি করা কী করে হাতানো যায় ওগুলো? কারণ সে তখন জেনে গেছে ওই চিঠিগুলো থেকে কামানো যেতে পারে লাখ লাখ টাকা! কিন্তু সেটা হবে কী ভাবে? এক্ষেত্রে একটা কথা বলে রাখা দরকার, বিকাশ রায়ের ছেলে কিন্তু আজ সমাজের এক অত্যন্ত সম্মানীয় জায়গায় রয়েছেন!
সম্মানীয় জায়গা! অনিদার এই তথ্যটা আবার হতবাক করল সবাইকে ওর কথা শুনে আমিও ! অনিদা বলতে থাকল
“ওই পজিশনে থেকে এই সব চুরিচামারি ওর পক্ষে সম্ভব ছিল না তাই জোর দিতে থাকে বাবাকে চুরির জন্য রাগে ফেটে পরেন বিকাশ রায় সারাজীবন সততার সঙ্গে জীবন কাটানোর পর ছেলের এই আচরণ কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না উনি এদিকে ক্রমশ বেড়ে চলে ছেলের উৎশৃঙ্খলতা রেসের মাঠ, হোটেল-বার, মদ্যপান, কিছুই বাদ রাখে না সে আর সহ্য করতে পারেন না বিকাশ রায় শেষে একদিন ঘরে প্রবল বাগবিতণ্ডার মধ্যে বাবার গায়ে হাতও তুলে ফেলে ছেলে আর দেরি করেন না বিকাশ রায় ত্যাজ্য করেন ছেলেকে
সারা ঘরে এখন পিন পড়া নিস্তব্ধতা বেচারা বিকাশ রায়ের মুখের দিকে চেয়ে খুব মায়া হচ্ছিল অনিদার কথা শুনে মিঃ গাঙ্গুলী জিজ্ঞাসা করলেন, “উনি কি জানেন ওনার ছেলের এই কুকীর্তির কথা?
অনিদা তাতে মাথাটা বারদুয়েক সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ জানেন
প্রফঃ রায় তখন ভীষণভাবে উশখুশ করে চলেছেন বললেন, “এবার ভাই বলো, অপরাধী কে?
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল অনিদা এটা ওর একটা কায়দা সাসপেন্সটা বাড়িয়ে তোলার কে হতে পারে অপরাধী? একেক জনের দিকে তাকাচ্ছি, আর একেক জনকে সন্দেহ হচ্ছে মাঝে তো ওর বন্ধু রাজাদা আর এসিপি দাশগুপ্তকেও সন্দেহ করে ফেললাম তারপর প্রফঃ রায়ের দিকে তাকাতে ওনাকেও তালিকায় নিয়ে নিয়ে নিয়েছিলাম! ঘরের অন্যদের দিকে চেয়ে দেখলাম সবার অবস্থা আমার মতোই
বেশ কিছুক্ষণ পর মুখ খুলল অনিদা সবার দিকে একবার করে চেয়ে নিয়ে ওর ব্যাগ থেকে একটা কিছু বার করল সেকেন্ড দুয়েক পর বুঝলাম সেটা একটা ছবির ফ্রেম অনিদা প্রথমেই সেটা এসিপি প্রদ্যুৎ দাশগুপ্তর হাতে দিল
ছবিটা হাতে নিয়ে উনি তখন সোজা হয়ে বসেছেন
ওনার হাত থেকে ছবিটা রাজাদার হাত ঘুরে এবার প্রফঃ রায়ের হাতে যেতে উনি চেঁচিয়ে উঠলেন, “এটা কী করে সম্ভব!
এবার সেটা মিঃ গাঙ্গুলীর হাতে যেতে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন উনি “অবিশ্বাস্য! বলে উনি ছবিটা বিকাশ রায়ের দিকে এগিয়ে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ রায়ের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল
সবার হাত ঘুরে এবার ছবিটা আমার হাতে এল হাতে নিতেই আমার হাত থেকে সেটা পড়ে যাচ্ছিল মুখ হাঁ হয়ে গেল আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আমার হাতে এদের ছবি একবার অনিদার দিকে তাকালাম দেখলাম আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসছে এবার আবার তাকালাম ছবির দিকে প্রথমে আমার চোখের সামনেটা ঘোলাটে লাগছিল এবার আস্তে আস্তে দৃষ্টিটা পরিষ্কার হয়ে যেতে দেখলাম ছবিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বিকাশ রায় আর পুলিশ অফিসার তাপস মিত্র!
“কিন্তু ওনার নাম তো তাপস মিত্র! আঁতকে উঠলেন প্রফঃ রায়
“হ্যাঁ, কিন্তু উনি ওনার টাইটেল চেঞ্জ করে নিয়েছেন বলল অনিদা
ওদিকে তাপস মিত্র ওরফে তাপস রায় একেবারে মুখে তালা লাগিয়েছেন বুঝলাম উনি ওনার দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন মাথা নিচু করে বসে ছিলেন বলে রাখি ছবিটা একবার ওনার হাতেও গেছিল উনি তখন চুপ ছিলেন
অনিদা যে এমন একটা জিনিস আমাদের সামনে তুলে ধরবে, কেউ সেটা কল্পনাও করতে পারেনি বেশ কিছুক্ষণ আবার নিস্তব্ধতার মধ্যে কাটল এবার প্রবাল গুপ্ত চেঁচিয়ে উঠলেন, “আমার টাকা না পেলে কিন্তু আমি ওই চিঠিগুলো হাতছাড়া করবো না!
“আমার এত বড়ো ক্ষতি করবেন না মিঃ গুপ্ত,” অনুনয় করে উঠলেন প্রফঃ রায়
এবার কথা বললেন এসিপি প্রদ্যুৎ দাশগুপ্ত বললেন, “আপনাদের কারও কোনো ক্ষতি হবে না আমি কথা দিচ্ছি তাপস প্রবালবাবুর সব টাকা ফেরত দেবে আর প্রবালবাবু প্রফঃ রায়ের সব কাগজপত্র ফেরত দেবেন
প্রফঃ রায় তখন আহ্লাদে গদগদ হয়ে অনিদাকে বললেন, “তোমাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব, জানি না এবার হঠাৎ চুপ মেরে গিয়ে বললেন, “কিন্তু আমার স্ট্যাম্পের খাতাটা?
কথাটা শুনে অনিদা বাঁ হাতটা গালে ঘষতে লাগল কপালে দেখলাম হালকা দুটো ভাঁজ ভাবলাম এর মানেটা কী? চিঠিপত্র তো উদ্ধার হল কিন্তু স্ট্যাম্পগুলো? ঠিক এই সময় তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন মিঃ গাঙ্গুলী
তা দেখে অবাক হয়ে দেবাশিস রায় বললেন, “কী হল মশাই? আপনার আবার কী হল?
তখন উনি এক মিনিটবলে ঝড়ের গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন ওনার কাণ্ড দেখে আমরা সবাই কেউ কিছু বুঝতে পারলাম না বিকাশ রায় আর তাপস মিত্র শুধু মাথা নিচু করে বসে বাকিরা সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন এমনকি অনিদার চোখেও অবাক হওয়ার চিহ্ন
ঠিক পাঁচ মিনিট কেটেছে ঠিক একইভাবে ঝড়ের গতিতে এসে ঘরে ঢুকলেন মিঃ গাঙ্গুলী বাঁ হাতটা পেছন দিকে আড়াল করা মনে হচ্ছিল কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছেন এবার আস্তে আস্তে প্রফঃ রায়ের কাছে এসে ডান হাতে ডান কানটা ধরে জিভ কেটে বললেন, “আমাকে মাফ করবেন প্রফঃ রায়
“মানে? ওনার হেঁয়ালি আমরা তো বটেই, প্রফঃ রায়ও ধরতে পারলেন না তবে অনিদার কী মনে হচ্ছিল বলতে পারব না, আমার মনে কিন্তু একটা সন্দেহ দানা বেঁধেছিল আর সেটা সত্যি বলে প্রমাণিত হল যখন উনি বাঁ হাতটা পেছন থেকে বার করে আনলেন আর দেখলাম তাতে ধরা রয়েছে একটা খাতা
“এ কী! সেটা দেখে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন প্রফঃ রায় “এই খাতা আপনার কাছে কী করে এল!
সেদিন যখন আমরা প্রথমবার প্রফঃ রায়ের ফ্ল্যাটে এসেছিলাম, উনি আমাদের এই খাতাটা দেখিয়েছিলেন তাই আমি এক ঝলকেই স্ট্যাম্পের খাতাটা চিনতে পারলাম!
জিনিসটা দেখে অনিদার চোখও কপালে তো বলেই ফেলল, “এটা নিয়ে আপনি কী করছেন মিঃ গাঙ্গুলী?
“ওটা আপনার কাছে ছিল? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন প্রফঃ রায়
তাতে আমতা আমতা করে মিঃ গাঙ্গুলী বললেন, “দেখুন প্রফঃ রায়, চুরির উদ্দেশ্য আমার ছিল না বিশ্বাস করুন আসলে আমার নাতি সেদিন এসেছিল আমার বাড়ি ওরও এই সব স্ট্যাম্প কালেকশানের খুব শখ তো আমি ওকে আপনার এই খাতার কথা বলতে তো নাছোড়বান্দা যে ওকে এই খাতাটা দেখাতেই হবে তো আপনি তো যাকে তাকে এ খাতা দেখান না! তাই আমি ভাবলাম কী করা যায়? তারপর মনে হল আমি চুপটি করে এক বেলার জন্য খাতাটা নিয়ে যাই আর পরের দিন এসে দিয়ে যাব কাল রাতে যখন ন’টা নাগাদ আমি এলাম, আপনি আমাকে পরশুর কাগজটা দেবার জন্য শোবার ঘরে ঢুকলেন ঠিক তখনই আমি, মানে আপনার খাতাটাকিন্তু নেবার পরই সব গণ্ডগোল হয়ে গেল মশাই যেই রাতে নিলাম, সেই রাতেই আপনার সব চিঠিপত্র চুরি হয়ে গেল ব্যস, আমার আর খাতা ফেরত দেবার সাহস হচ্ছিল না কারণ আপনি তো আমাকেই চোর ভেবে বসবেন, বলুন? কিন্তু বিশ্বাস করুণ, আমার চুরির কোনো উদ্দেশ্য ছিল না” এতটা বলে থামলেন মিঃ গাঙ্গুলী এবার অনিদার দিকে এগিয়ে বললেন, “গোয়েন্দা ভাই, ওনাকে একটু বোঝান না, আমার চুরির উদ্দেশ্য থাকলে আমি কি আর জিনিসটা ফেরত দিতে আসতাম?
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটল এবার প্রফঃ রায় মিঃ গাঙ্গুলীর হাত থেকে স্ট্যাম্পের খাতাটা ছোঁ মেরে নিয়ে বললেন, “খুব অন্যায় কাজ করেছেন আপনি মিঃ গাঙ্গুলী!
“হ্যাঁ, ঠিক বলে মাথা নাড়লেন মিঃ গাঙ্গুলী
“মানে! আবার খেঁকিয়ে উঠলেন প্রফঃ রায়
“আর কোনোদিন হবে না, বিশ্বাস করুন বলে কান ধরলেন মিঃ গাঙ্গুলী
“আপনি আমাকে একবার বলে দেখতে পারতেন এভাবে খাতা নিয়ে যাবার কোনো অর্থ হয়? আশ্চর্য!
“খুব ভুল হয়ে গেছে মশাই!
উত্তরে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন প্রফঃ রায় মিঃ গাঙ্গুলী তখন ধীরে ধীরে ওনার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, “আমি তাহলে আপনার সঙ্গে দাবা খেলতে আসতে পারি তো প্রফঃ রায়?
প্রফঃ রায় তখন ওনার দিকে চেয়ে খুব গম্ভীর গলায় বললেন, “এমন সব ছেলেমানুষি কেন করেন মিঃ গাঙ্গুলী?

*                   *                   *

ফেরার সময় আমি অনিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি এই রকম ক্লাইম্যাক্স আশা করেছিলে?
“কখনও না,” হেসে উত্তর দিল অনিদা
“তুমি কাকে প্রথমে সন্দেহ করেছিলে? আবার প্রশ্ন করলাম আমি
“বিকাশ রায়কে
“আর ওনার বাড়ি থেকে সেদিন কী সরিয়েছিলে?
“তাপস রায় আর বিকাশ রায়ের ছবিটা! এখনও বুঝতে পারলি না গবেট! হেসে বলল অনিদা
ওদের সেই ছবিটা তখন আমার হাতে আমি সেটা দেখতে দেখতে আবিষ্কার করলাম, দু’জনের থুতনির কাছটা অনেকটা একরকম! বুঝলাম এই কারণেই প্রফঃ রায় বলেছিলেন যে পোস্টমাস্টারের মুখের গড়নটা অনেকটা বিকাশ রায়ের মতো!
আমি এবার ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি ফিজ নিলে না?
তখন আমাকে ওর মোবাইলের একটা এস.এম.এস দেখিয়ে বলল, “অ্যাকাউন্ট ট্রান্সফার করেছেন ভদ্রলোক
আমি সেটা দেখে চোখ দুটো বড়ো বড়ো করলাম বললাম, “এত টাকা!
উত্তরে অনিদা শুধু হাসল টাকার অঙ্কটা অবশ্য আর খোলসা করছি না!
----------
ম্যাজিক ল্যাম্প 

No comments:

Post a Comment