গল্প:: অভিমান - প্রতীক কুমার মুখার্জি


অভিমান
প্রতীক কুমার মুখার্জি

পুপুলের মনটা বড়োই খারাপ হয়ে রয়েছে গতকাল স্কুলের লাস্ট পিরিয়ড থেকেএকেবারে মুখ কালো করাবা চোখ কোটরে বসে যাওয়াধরনের মনখারাপশান্ত স্বভাবের ছেলেটার মুখের কথাও যেন তার চোখমুখের মতোই মুখেই শুকিয়ে গেছে সেই থেকেওর মা-ও সেটা লক্ষ করে তাকে কারণ জিজ্ঞেস করতে, সে কাঁপা কাঁপা হাতে রিপোর্ট কার্ডটা তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলমা আড়চোখে দেখলেন ছেলের চোখের কোলে তিরতির করছে অব্যক্ত কষ্টের অশ্রুকণা
এমনিতে পুপুল যে আহামরি ছাত্র নয় সেটা তার বাবা ও মা দুজনেই জানেনরিপোর্ট কার্ডটা দুরুদুরু বুকে হাতে তুলে নিতে নিতে, তিনি ভেবেছিলেন হয়তো অন্যবারের থেকে হাফ ইয়ারলির রেজাল্টটা অপেক্ষাকৃত খারাপ হয়েছে - তাই ছেলের এহেন দশাকিন্তু সেটায় চোখ বোলাতে গিয়েই একটা মোটা লাল দাগ তাঁর নজর কেড়ে নিলঅঙ্কের নম্বরটাতেরো! একশোতে মাত্র তেরো! ছেলে পড়াশোনায় সাদামাটা ঠিক কথা, কিন্তু ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত তার রিপোর্ট কার্ডে কখন লাল দাগ দেখেননি তাঁরা ঝাপসা হয়ে আসা চোখে প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে বাকি বিষয়ের নম্বরগুলি দেখতে থাকলেন তিনিনাঃ, অন্যান্য বিষয়ের নম্বরগুলি অন্যবারের মতো বজায় রয়েছে, আর সেটাই বাঁচোয়া
তখনই তাঁর একটা কথা মনে পড়ে খটকাটা লাগল - কী করে হয়? এইবার, বিশেষ করে এইবার বাপ ছেলে মিলে অঙ্কের পিছনে অনেক খাটাখাটনি করেছিল - এমনকি পরীক্ষা দেওয়ার পরে পুরো পেপারের সমস্ত অঙ্ক আরেকবার কষে নিয়ে উত্তর মিলে যেতে দুজনে ভীষণ খুশি হয়েছিল - পুপুল নাকি পঁচাশির উপর নম্বর পাবে! সেখানে এটা কী করে হয়? তখনই চোখে পড়ল রিপোর্ট কার্ডের নিচের দিকে ক্লাস টিচারের পেনের খোঁচা - পেরেন্ট কল করেছেন তিনিআর সেটাই যে চিন্তার আসল কারণ
অফিসের কাজে এই গোটা সপ্তাহটা পুপুলের বাবা কলকাতায় ছিলেন আজ তিনি বাড়ি ফিরে আসছেন ছেলের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার রেজাল্ট কেমন হয়েছে ইতিমধ্যে ফোনে জানতে চেয়েছেন তিনি অন্যবারের মতোই রেজাল্ট হয়েছে বলতে তিনিও একটা দীর্ধশ্বাস ফেলে ফোন কেটে দিয়েছিলেন সেখানেই পুপুলের আসল খারাপ লাগার জায়গাটাবাবা নিজের জগতে যথেষ্ট রাশভারী হলেও, একমাত্র ছেলের সঙ্গে একেবারে বন্ধুর মতো করে মেশেনএই যে মাঝে মাঝে পুপুল দুঃখ করে সে পড়াশোনায় এত সাধারণ, খেলাধুলোতেও সেভাবে নজর কাড়তে পারে না, কথা বলতে গেলে আত্মবিশ্বাসের অভাবে তোতলাতে থাকে প্রায়শই - বাবাই তখন তাকে কাছে টেনে নিয়ে পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে প্রতিবার একটাই প্রশ্ন করেন – আর মূকাভিনয়টা? ওটা যে তোর বন্ধুদের মধ্যে কেউ পারে না, সে বেলায় কী? ওটাই তোকে সবার থেকে আলাদা করে রাখে রে পার্টনার!
কিন্তু এসব তো পুরোনো কথাতখন রেজাল্ট অতি সাধারণ হলেও, সেটাতে লাল দাগের আত্মপ্রকাশ ঘটেনিতার উপর আর একটা ব্যাপার - পুপুল অঙ্কতে বড্ড দুর্বল বলে এই বছরটা বাবা সারাদিনের কাজের শেষে নিজে বসে অঙ্ক করাচ্ছেন রোজকোনো বকাবকি নয়, ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেলেও কোনো চড়চাপড় নয় - পরম স্নেহে, অত্যন্ত যত্ন নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে দুজনে অঙ্ক কষে গেছেসেখানেই পুপুলের কষ্টটা মনের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠছেদিন আগেই, একটা অঙ্ক যেদিন কিছুতেই পুপুলের মাথায় ঢুকছিল না, বাবা অঙ্ক থামিয়ে একটা মজার গল্প বলেছিলেন পুরোনো একটা শারদীয়া আনন্দমেলা খুঁজে পেতে এনেগল্পটার নাম - গোঁসাইবাগানের ভূতসেখানেও গল্পের নায়ক ছোট্ট বুরুন অঙ্কে তেরোই পেয়েছিল! হাবু ডাকাত, গদাই দারোগা, একটা বিশাল কেঁদো বাঘ, করালীস্যার আর নানারকমের মজার ভূতের কাণ্ডকারখানা নিয়ে পুরো গল্পটা শোনার পর মন ভালো হয়ে গিয়েছিল পুপুলেরম্যাজিকের মতো শক্ত, ঘোরানো পেঁচানো আটকে যাওয়া অঙ্কটা জলের মতো সহজ হয়ে গিয়েছিল নিমেষে!
আর সে কিনা গুনে গুনে সেই তেরোই পেল অঙ্কে! নিজের ঘরের মধ্যেই ডুকরে কেঁদে ফেলল ক্লাস ফাইভের ছাত্র পুপুল সে জানে, বাবা রেজাল্ট দেখার পরে তাকে একটা কথাও বলবেন নাশুধু কথা বলা বন্ধ করে দেবেনচুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে পড়বেন অন্তত আগেরবার অবধি এরকম হতে দেখেছে পুপুলএইবার কী হবে ভাবতে পারছে না - বা ভাবার চেষ্টাও করছে না সেলাল দাগটা দেখে বাবা কতটা কষ্ট পাবেন, আর কীভাবে মাথা নিচু করে স্কুলে যাবেন টিচারে মুখোমুখি হতে, সেটা ভাবলে পুপুলের মাথাটা স্রেফ ঘুরে উঠছেসব তার জন্য - সমস্ত দোষ তারই
পুপুলদের ঘরে চাপা অশান্তিটা সরিয়ে রেখে চলো আমরা ওর সম্পর্কে বাকিটা জেনে ফেলিপুপুলের পড়াশোনা, খেলাধুলোর সম্পর্কে তো তোমরা কিছুটা জেনেই ফেলেছকিন্তু মূকাভিনয়ের ব্যাপারটা? সেটা তো কেউ জানো না! পুপুলকে ছোটোবেলায় তার বাবা স্পীচ থেরাপিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী আবৃত্তির ক্লাসে ভর্তি করে দিয়েছিলেনআবৃত্তি শেখানোর জন্য নয় - উদ্দেশ্য ছিল তার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা, এবং তোতলামির একটা ব্যবস্থা করা, ঠিক যেমনটি ডাক্তার বলেছিলেনকিন্তু আবৃত্তি করানো যায়নি তাকেতোতলামি একভাবেই থেকে গিয়েছিলকিন্তু প্রকাশ পেয়েছিল এক অসাধারণ প্রতিভা - মূকাভিনয়ের ক্ষমতা!
তার মধ্যে এই অভূতপূর্ব প্রতিভার বিকাশ ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই দুটো জিনিস হল একটা ভালো আর একটা অবশ্যই খারাপপ্রতি বছরের স্কুল ফাংশানে নিয়মিতভাবে নিজের জায়গা পাকা করে ফেলল পুপুলসারা স্কুলে আর একজন ছাত্র নেই যে মূকাভিনয় বা প্যান্টোমাইমে পুপুলের মহড়া নিতে পারে - এই ক্ষমতা তার একচেটিয়াপড়াশোনায় বা খেলাধূলাতে কিছু করতে না পারলেও, স্রেফ তার মূকাভিনয়ের জোরে সারা স্কুল তাকে এক ডাকে চিনে ফেলতে শুরু করেতার মূকাভিনয়ের মান আস্তে আস্তে এমন উন্নত হতে থাকে, যে এদিক ওদিক থেকে নানান অনুষ্ঠানে তার ডাক আসতে শুরু করলবিভিন্ন পুজো প্যান্ডেলে, পাড়ার ফাংশানে, ঘরোয়া অনুষ্ঠানে পুপুলের একক পারফর্মেন্সের কদর বেড়েই চলতে লাগল
ছেলের এই উত্তরণে তার বাবা-মা যারপরনাই উল্লসিত ও গর্বিত - আরে, গতানুগতিক পড়াশোনা, চাকরি-বাকরি তো শয়ে শয়ে মানুষ করে, কিন্তু নাম, যশ বা প্রতিপত্তি? সেটার জন্য লাগে বিশেষ প্রতিভা, ভাগ্যের আনুকূল্য ও প্রচারপুপুলের বাবা ইতিমধ্যেই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কলকাতার এক কিংবদন্তি মূকাভিনয় শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে রেখেছেন - ছেলে ক্লাস সিক্সে উঠলেই সে তাঁর কাছে নাড়া বাঁধবে, সে কথা আগেই হয়ে রয়েছে
এবার খারাপ দিকটা বলেই ফেলি? পুপুলের মতো অতি সাধারণ এক ছাত্র, যার উপস্থিতি ক্লাসের সঙ্গে সঙ্গে খেলার মাঠেও কোনো দাগ ফেলে না - এক শান্ত, আপাত দুর্বল মানুষ যদি অবলীলায় নিজের দিকে সমস্ত লাইমলাইট টেনে নেয়, বাকি বন্ধুদের মেজাজও নিশ্চয় ফুরফুরে থাকে না! তাই, সাতে-পাঁচে না থাকা নিরীহ পুপুলের দিকে উড়ে আসতে থেকেছে নানাধরনের বিদ্রূপ - নানা টিটকিরিস্কুলে তার বিভিন্ন নামকরণ হয়েছে - সেই সমস্ত মশলাদার, টক ঝাল নাম দিয়ে নিজেদের র্ষা, হিংসার নিষ্ফল আক্রোশ মেটাতে থাকে তার বন্ধুরা - ডাম্বো, জিরাফ, মিউটি বিউটি, স্পীড ব্রেকার, ই এম আই ইত্যাদি ইত্যাদি যেমন শহরতলির ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের ডেঁপো ছাত্রদের কাছ থেকে আশা করা যায় - ঠিক সেইরকমতবে এই বিদ্রূপটুকুই সার - কারণ সে এখন রীতিমতো সেলিব্রিটি, তাই পিছনে লাগাটা দৈহিক অত্যাচারের পর্যায়ে যায়নি, সেটাই আশার কথা
ডিং ডং! ডিং ডং!দুবার পর পর তাদের কলিং বেলটা বেজে উঠতে চমকে উঠল পুপুল - শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল শরীরের নিচের দিকেনিজের ঘরে খাটের এক কোণে কাঠের পুতুলের মতো বসে ছিল পুপুল এতক্ষণ! বেলের শব্দে ছিটকে উঠে দাঁড়িয়েই আবার বসে পড়ল সেবাবার চোখে কীভাবে চোখ তুলে তাকাবে সে?
কই রে পার্টনার, কোথায় তুই?ড্রয়িংরুমে ভারী ব্যাকপ্যাক নামিয়ে রাখার শব্দ! পুপুল আবার খাটের কোণ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দুপা এগিয়ে আবার পর্দার পিছনে থমকে দাঁড়ালজ্যালজ্যালে পর্দার মধ্যে দিয়ে সে দেখল সোফায় বসেই বাবা, মায়ের উদ্দেশে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সেটা যে চায়ের কাপের জন্য নয়, পুপুলের রিপোর্ট কার্ডের উদ্দেশ্যে, তা বুঝতে তার একবিন্দু অসুবিধে হল না
রিপোর্ট কার্ডটা হাতে পেতেই বাবার চোখ সেটার বিশেষ একটি জায়গায় আটকে গেল, এবং পর্দার পিছন থেকেই পুপুল বুঝতে পারল বাবা আস্তে আস্তে শরীর ছেড়ে দিলেন সোফার উপরপুপুল মনের জোরে এই মুহূর্তে পর্দার পিছন থেকে বেরিয়ে এসে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল, কারণ বাবাই তাকে শিখিয়েছেন যে কোনো অবস্থাতেই লুকিয়ে থাকতে নেই - সমস্যার মোকাবিলা বুক ঠুকে করা উচিতপিঠ দেখিয়ে পালিয়ে যাওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়
বাবা তার দিকে চোখ তুলে তাকালেন না পর্যন্ত! শুধু গলা খাঁকরে কয়েকটা কথা বললেন – দিন দিন যেভাবে উন্নতি করছ তুমি, তাতে আমরা ভীষণ গর্বিত! কাল পাড়ার বিজয়া সম্মিলনীর ফাংশানে তোমার মূকাভিনয়ের আইটেম আছে - দেখো যদি সেখানেও আমাদের মুখ এভাবে উজ্জ্বল করে তুলতে পারো!পুপুলের বুকে যেন শেল বিঁধে গেল - তার মাথা বুকের উপর ঝুলে পড়ল, চোখ থেকে নিঃশব্দে টপ টপ করে ঝরে পড়তে লাগল নোনাজলের ফোঁটাপায়ে পায়ে নিজের ঘরের অন্ধকার আশ্রয়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল সে - অপমান ও অভিমানের প্রচণ্ড দমকটা যেন তার ছোট্ট বুকটা মুচড়ে কান্না হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে প্রাণপণে!
পরের দিন সকালে সে যখন ঘুম থেকে উঠল, ততক্ষণে বাবা অফিসে বেরিয়ে গেছেনব্রেকফাস্ট দিতে দিতে মা জানালেন যে বাবা তার রিপোর্ট কার্ডটা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন, একেবারে ক্লাস টিচারের সঙ্গে দেখা করে ফিরবেনসারাটা দিন পুপুল যে কীভাবে বুকে পাথর চাপিয়ে কাটাল তা শুধু সেই জানেমা নীরবে দেখলেন, মানসিক অশান্তিতে ছেলেটা ছটফট করছে, একদিনেই যেন তার বয়সটা অনেক বেড়ে গেছেআজ সন্ধেবেলায় পাড়ার ফাংশান, সেখানে কবিগুরুর দেবতার গ্রাসকবিতার উপর মূকাভিনয়ের একটা আইটেম করার কথা পুপুলেরশক্ত কবিতা, বেশ জটিল কাহিনি - বেশ কদিন ধরে যত্ন করে অনেকবার মহড়া চলেছেবাবা ও মায়ের সামনেও বার বার পারফর্ম করেছে পুপুল, কিন্তু আজ যেন সে সম্পূর্ণ উদাসীনতার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, আজকের ফাংশানের ব্যাপারটা যেন তার মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছে
দুপুর অবধি ছেলেকে অস্বস্তিতে ভুগতে দেখে শেষে মা বললেন, যা না, পাড়ায় ফাংশানের প্যান্ডেল করেছে দাদারা, একবার মঞ্চে উঠে দেখে তো আয় ব্যবস্থা কেমন হয়েছে! যা হবার তো হয়েছেই, ওটাকে তো বদলাতে পারা যাবে না! একবার মঞ্চে উঠলেই মনটা অন্যরকম হয়ে যাবে৷ বাবা তো স্কুলে যাবেই, দেখ না কী হয়? যা, ঘুরে আয় একবার!বলে প্রায় ঠেলেঠুলেই ছেলেকে বাড়ি থেকে বার করে দিলেন তিনি
ঠিক কুড়ি মিনিট পরেই কলিং বেলের মুহুর্মুহু শব্দে একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে দরজা খুললেন তিনিসামনে বিধ্বস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে পুপুলমুখ লাল হয়ে গেছে, জামার কলার ছিঁড়ে গেছে, আর দুহাতের তালু দিয়ে সমানে চোখ মুছতে মুছতে ফুলে ফুলে কাঁদছে সে! কী হয়েছে রে?অস্ফুটে বলে উঠলেন তিনি? পুপুল কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা তার ঘরে ঢুকে বিছানার উপর কুণ্ডলী মেরে শুয়ে পড়ে ফোঁপাতে লাগল
একটু পরে ধাতস্থ হতে সে জানাল মঞ্চের কাছে যেতেই পাড়ার পালবাবুর ছেলে সোহম তাকে টিটকিরি দিতে শুরু করেআজ আপনাদের সামনে পারফর্ম করছেন দেশের বিখ্যাত শিল্পী ডাম্বোবাবুউনি কথা বলেন ইন্সটলমেন্টে, তাই মানুষ তাঁর কথা বুঝতে পারে নাতাই তিনি আমাদের মিউটি বিউটি - তিনি জিরাফের মতোই বোবা! তারপর তিনি আবার অঙ্কে তেরো পেয়েছেন! আমাদের বিরল প্রতিভা - ডাম্বোবাবু!ইত্যাদি ইত্যাদিএক সেকশনে পড়ার দরুণ সোহম পুপুলের পড়াশোনার ব্যাপারে সবটাই জানেএই অবস্থায় মাথা ঠান্ডা রাখতে না পেরে সে সোহমকে একটা ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেয় সোহম অতটা আশা করেনি নিরীহ ছেলেটার কাছ থেকেকয়েক মুহূর্ত থমকে থেকে সে উঠে এসে দু-চার ঘা বসিয়ে দেয় পুপুলকেটানাটানি, ধাক্কাধাক্কিতে পুপুলের জামা ছিঁড়ে যায়তারপর সুযোগ বুঝে পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা রীতিমতো প্যারেড করে তাকে তেরো - হেরো! ডাম্বো তুমি অংকে তেরো!স্লোগান দিতে দিতে তাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেছে
মায়ের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, মাথাটা গরম হয়ে ওঠেতিনি তৎক্ষণাৎ তৈরি হতে থাকেন পালবাবুর বাড়ি গিয়ে এই ঘটনার একটা বিহিত করতেকিন্তু বেরোবার মুখে তাঁর আঁচল টেনে ধরে পুপুলসে বলে, মা, তুমি যেও নাও আমাকে ওসব বলেছে ঠিক কথা - কিন্তু আমিই তো ওকে ধাক্কা দিয়েছি প্রথমে!এই কথা শুনে মা পুপুলকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, দুজনের চোখের জল বাঁধ মানল না আর
একটু পরে, বিকেল নাগাদ পুপুল গোঁ ধরে বসল যে আজ সে পাড়ার ফাংশানে পারফর্ম করবে নাপাড়ার ব্যাপার, মা তাকে বোঝাতে থাকলেন ওরকম করতে নেই, সবাই কী মনে করবে ইত্যাদি ইত্যাদি, কিন্তু পুপুলকে নড়ানো গেল নাদুপুরে প্যান্ডেলে ঘটে যাওয়া ছোট্ট অশান্তিটার জের অনেক দূর যেতে পারে আন্দাজ করে, পাড়ার সিনিয়াররা শেষ বিকেলে হানা দিলেন পুপুলদের বাড়িতে তাঁরা ভালো করেই জানতেন, পুপুলের আইটেমটা ফাংশানের প্রাণভোমরা - কোনো কারণে সেটা না হলে অনুষ্ঠানের জেল্লা অনেকটাই ফিকে হয়ে যেতে পারেপুপুলের মা তাঁদের ভদ্রভাবে, কিন্তু সরাসরি বুঝিয়ে দিলেন তাঁরা থাকতে এরকম অপ্রিয় ঘটনা পাড়ার মধ্যে একেবারেই কাম্য নয়
অনেক বলাকওয়ার পরে সেই সিনিয়াররাই শেষ পর্যন্ত পুপুলের গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে পারফর্মেন্সে রাজি করালেন কোনোভাবে৷ তাঁরা কথা দিলেন, সোহম যাতে সবার সামনে তার কাছে ক্ষমা চায়, সেই ব্যবস্থা তাঁরা অবশ্যই করবেনঅগত্যা পুপুল আর কী করে? সে নিমরাজি হলকিন্তু তাঁদের সামনে একটা শর্ত রাখল সে - তার পারফর্মেন্স হবে সমস্ত আইটেমের শেষেসে জানত, বাবার মনে যত কষ্টই থাক, তিনি ঠিক মঞ্চের সামনে একবার এসে দাঁড়াবেন ছেলের পারফর্মেন্স দেখবার জন্য তাই সে এই ব্যবস্থা করে রাখল
ফাংশান শুরু হলনানারকম গান, আবৃত্তি, নাটক, শ্রুতিনাটকের সম্ভার মঞ্চের পাশ থেকে ভিড়ের উপর নজর রাখছিল পুপুল - তার চোখ খুঁজছিল সোহমকেতবে আসলে সে খুঁজে চলেছিল তার বাবাকেঅফিস ফেরত ও স্কুল ফেরত তার বাবার মুখটা দেখতে চাইছিল সে - মরিয়াভাবেদেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটা পেরিয়ে নটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকল, এবং পুপুলের আইটেমের সময় এগিয়ে আসতে লাগলকিন্তু বাবা কোথায়? পুপুলের এবং অডিয়েন্সের মধ্যে মায়ের মন অশান্তিতে ভরে উঠল
ঠিক রাত নটা দশে সিনিয়ার এক দাদা বললেন পুপুলকে – কী রে বাবু, এরপরেই তোর আইটেম, তুই মেকআপ করিসনি এখন? যা, হাতে আর পাঁচ মিনিট আছে তো! তাড়াতাড়ি মেকআপ সেরে ফেল রে! এক্ষুনি তোর নাম এনাউন্স করবে তো! পুপুল সেই দাদার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল - সে হাসি ম্লান হলেও, যথেষ্ট রহস্যজনক
ঠিক সেই মুহূর্তেই অডিয়েন্সের পিছনদিকে জমায়েতের মাঝে তার বাবার মুখটা দেখতে পেল পুপুলবাবার মুখ মোটেই কালো নয়, তাতে হতাশার কোনো লেশ নেই, বরং বড়ো বড়ো চোখে উত্তেজিতভাবে তিনি ছেলেকেই সম্ভবত খুঁজে চলেছেন ভিড়ের মধ্যে! এনাউন্সার সেই মুহূর্তেই ঘোষণা করলেন, আজ, আপনাদের সামনে আমরা নিয়ে আসছি বিস্ময়বালক অনিন্দ্য সেনের অবাক করা প্যান্টোমাইম - মূকাভিনয়আমাদের পাড়ার ছেলে, তাঁকে আপনারা সবাই পুপুল বলেই চেনেন...হঠাৎ ঘোষকের কথা শেষ হবার আগেই শেষ হয়ে গেল - তাঁর হাত থেকে মাইক কেড়ে নিয়েছে ছোট্ট পুপুল!
আমি আ-জ আপ-না-দের সামনে রং মে-মেখে মূকাভিনয় করব না - চে-চেষ্টা করব নতুন একটা জিনিস করে দেখাবার!উপস্থিত সবাইকে হতচকিত করে বলে উঠল পুপুলআমি আপনাদের আবৃত্তি করে শোনাব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা - বী-বীরপুরুষ!
অডিয়েন্সে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেলকেউ কেউ চেয়ার ছেড়ে ওঠার উপক্রম করল, মৃদু একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল ভিড়ের মধ্যে! ভেসে এল কিছু টুকরো টুকরো কথা, শেষ পর্যন্ত কবিতা?” “ও করবে আবৃত্তি?ইত্যাদি ইত্যাদিপুপুলের মুখে ছড়িয়ে পড়ল এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি - সে দেখল ভিড়ের মধ্যে থেকে প্রবলভাবে মাথা নেড়ে চলেছেন তার বাবা, তাঁর দুচোখে আতঙ্ক মিশ্রিত উৎকন্ঠা! পুপুল আর কোনোদিকে তাকাল না, দুচোখ বুজে শুরু করল - বীরপুরুষ!
একটানা আবৃত্তি শেষ করে যখন সে থামল, তখন তার মনে ঘনিয়ে এসেছে ভয় – কী হবে যদি চোখ খুলে দেখি অডিয়েন্সে কেউ নেই? শুধু মা আর বাবা বসে আছেন? চারিদিক নিস্তব্ধ - একটা ছুঁচ পড়ার শব্দও শোনা যাচ্ছে নাতারপরেই বোমা ফাটল যেন!
হাততালির গর্জনে চারদিক ফেটে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কারা যেন তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল - সকলে মিলে জড়াজড়ি করে তাকে নিয়ে মঞ্চের উপর গড়াগড়ি করতে শুরু করেছেসেই ঝটপটানির মধ্যেই চোখ খুলে দেখল সে পাড়ার সমস্ত ছেলের হাতে বন্দি - তার বুক দুহাতে প্রাণপণে পেঁচিয়ে রেখেছে সোহম, তার মুখ পুপুলের বুকের মধ্যে গোঁজাপুপুল বুঝতে পারল, সামান্য একটা আবৃত্তি সঠিকভাবে করতে পারার পিছনে এতটা উচ্ছ্বাস সত্যিই বাড়াবাড়ি আসলে সিনিয়র দাদাদের ধাতানি খেয়ে ক্ষমা চাইবার বদলে সদলবলে সোহম তার অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্তটা এভাবেই সেরে ফেলতে চায়কিন্তু যখন সে নিজেকে সোহমের দুহাতের বন্ধন থেকে মুক্ত করতে পারল, তার চোখ ভরা জল দেখে বুঝল যে কিছুটা হলেও সোহম বিকেলের ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত - আর অন্য ছেলেরা যেটা করছে সেটা সম্পূর্ণ হুজুগ
তার চোখ চলে গেল দর্শকদের দিকেঅডিয়েন্সের একটা মানুষও বসে নেই - সকলে দাঁড়িয়ে উঠে হাততালি দিয়ে চলেছে, আর যেটা থামার নামও করছে নাবাবাকে ঘিরে ফেলেছে পাড়ার অনেক মানুষ - কিন্তু বাবার কী হয়েছে? ক্রমাগত হাতের তালু দিয়ে বাবা মুখ থেকে কী মুছে ফেলতে চাইছেন?
গল্প তো এখানেই শেষ হবার কথা, এবং সেটা হবেও - কিন্তু কয়েকটা কথা তোমাদের বলে না রাখলে তোমরা আমার উপর হয়তো রাগ করতে পারো, তাই বলি শোনো -
ক্লাস টিচার পুপুলের বাবাকে ডেকে প্রথমে জিজ্ঞেস করেছিলেন তাকে বাড়িতে অঙ্ক কে করান? কারণ, হিসেবমতো পুপুল গুনে গুনে পঁচাশি পেয়েছে, এবং তাতে কোনো ভুল নেইকিন্তু আই সি এস ই- নিয়মানুযায়ী অঙ্কের প্রসেসে ভুল আছেতাই উত্তর মিলে গেলেও, অঙ্ক ঠিক হয়নিএই জিনিস যাতে আবার না হয়, তাই এই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তাকেপুপুলের বাবা অকপটে নিজের ঘাড়ে সমস্ত দোষ চাপিয়ে নেন, ও প্রতিশ্রুতি দেন, এই ভুল আর হবে না
ফাইনালের রিপোর্ট কার্ডে আবার চমক - স্কুল থেকে হাফ ইয়ারলির অঙ্কের মার্কস তেরো থেকে বাড়িয়ে পঞ্চাশ করে দেওয়া হয়েছেস্কুলের তরফে কৈফিয়ত - ওই তেরোর রেশ পুপুলের মানসিক ভবিষ্য নষ্ট করে দিতে পারেফাইনালে পুপুল ঠিক প্রসেস অনুযায়ী অঙ্ক করে ছাপান্ন পেয়েছিলতবে তাতে তার স্টার স্ট্যাটাসে মরচে পড়েনি কখন
পরবর্তীকালে ছোট্ট পুপুল একযোগে এক দিকপাল মূকাভিনেতা ও আবৃত্তিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়সে এমন এক অনন্য শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়, যার দুটি ক্ষমতা একেবারে বিপরীতধর্মী - একটিতে শব্দ লালিত ভাবমাধুর্য, অন্যটিতে সম্পূর্ণ অভিব্যক্তিপূর্ণ নীরবতা!
----------
এই কাহিনির সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক, বাস্তবে যদি এর সঙ্গে কোনো ঘটনার মিল অথবা সামঞ্জস্য থেকে থাকে, তার জন্য কাহিনিকার কোনোভাবেই দায়ী থাকবেন না

----------
ছবি - লাবণি চ্যাটার্জী
ম্যাজিক ল্যাম্প 

2 comments:

  1. মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প

    ReplyDelete
  2. প্রতীক প্রতীকের মতই, দারুন লাগল

    ReplyDelete