বাঘের কাছাকাছি
প্রদীপ
কুমার
বিশ্বাস
বেস ক্যাম্প
স্টোর
থেকে
পেছনে
কানায়-কানায়
ভর্তি ট্রেলার
নিয়ে, সামনে
পেছনে হুডখোলা
পুরোনো মডেলের
উইলিজ
জিপ, দুপুর
একটার
জায়গায়
বিকেল
চারটের
পরে, বেস
ক্যাম্প
মেন
গেট
পার
হয়ে, লোহা-পাহাড়ের
রাস্তা
ধরল।
নিয়মিত ড্রাইভারের
জায়গায়
স্টিয়ারিং
হুইলে
বসে
লোহা-পাহাড়
ড্রিলিং
ক্যাম্প-ইন-চার্জ
নায়ার-স্যার
অনেক কারণেই ভেতরে-ভেতরে
রাগে
ফুটছিলেন।
ওনার
পাশে
বসে
আমি
সেই
রাগের
আঁচটা
টের
পাচ্ছিলাম।
দফায়-দফায়
লম্বা
মিটিং, স্টোরের
অলস
সহকর্মী, গ্যারেজের
মেকানিক
এরা
সবাই
মিলে
দেরি করিয়েছে।
এমনকি
তাঁর
সঙ্গে
আসা নিজের
অধস্তন
সহকর্মীরাও
টিফিনের
নামে
আরও
ঘণ্টাখানেক দেরি
করে
সদলবলে যখন
এল, দূর
থেকেই
ওদের
দিকে
একবার
দৃষ্টি
বুলিয়েই
জিপের
পেছনের
সিটে
বসবার
ইশারা
করলেন।
নায়ার-স্যার আমার
দিকে
তাকিয়ে
বললেন, “অন-ডিউটিতে
এসব
বদ
নেশার জন্য
একদিন
এদের
চাকরি
যাবেই।
আমার
ড্রাইভারটা
এসব
ছাইপাঁশ
গেলে
না, আজ
দেখছি
এও
ওদের
সঙ্গে
আছে।”
চার দিক উঁচু
পাহাড়ে
ঘেরা জায়গাতে
সন্ধে
নামার
অনেক
আগে
আলো
অনেক
কমে
যায়। আঁকা-বাঁকা
সরু
পাহাড়ি
রাস্তা,
তার
ওপর
চড়াই
রাস্তা, দিনের
আলো
চলে
গেলে, হেডলাইটের
ভরসায় গাড়ি চালানো বিপদজনক হতে পারে।
শুধু যে গাড়ি
চালানোই
বিপদজনক
তাই
নয়,
আরও
একটি
বিপদও
যে
পাহাড়ি
জঙ্গলে
ঝোপের
আড়ালে
অপেক্ষা
করে
আছে
তার
আশঙ্কাও
ছিল
নায়ারবাবুর
মনে।
এই আশঙ্কা
আর
উদ্বেগই
যে
তাঁর
রাগের
আসল
কারণ আমি
সেটা বুঝলাম
আর
একটু
পরেই।
এই
জিপে
তখন
দলবলসমেত
আমরা পাহাড়ি
রাস্তায় খানিকটা
এগিয়ে
গেছি
লোহা-পাহাড়ের
রাস্তায়।
ছত্রিশগড় রাজ্যের
দন্তেওয়ারার
কাছে, ঘন
জঙ্গলে ঘেরা, মাইলের
পর
মাইল
জুড়ে পৃথিবী-বিখ্যাত
আকরিক
লোহা
পাথরের বিশাল
উঁচু
চড়াই
পাহাড়ের
সারি অনেক
দূর
থেকে
দেখা
যায়।
সে সময়টায়
আকরিক
লোহার
ভূতাত্ত্বিক
অনুসন্ধান
চলছে পুরো
পাহাড়
জুড়ে।
কোথাও
প্রাথমিক
সমীক্ষা
চলছে তো
কোথাও
একদম
চূড়ান্ত
স্তরে
পাথর
ভেদ
করে
নমুনা
আনার
জন্য
ড্রিলিং
চলছে।
এই সব ক্যাম্পগুলোর
মূল
নিয়ন্ত্রণ
হয়
লোহা-পাহাড়ের
কোলে, পাহাড়ি
নদীর
ওপারে, বেস
ক্যাম্প
থেকে।
বেস
ক্যাম্পের
অফিসে
বসেন
মুখ্য
ভূতত্ত্ববিদ
আর
অনান্য
প্রবীণ
প্রযুক্তিবিদেরা।
কলেজ থেকে
সদ্য
পাশ
করে
তখন
মাত্র
মাস-খানেক
হল
এই
প্রতিষ্ঠানে
শিক্ষানবিশ
ভূতত্ত্ববিদ
হয়ে
যোগদান
করেছি
বেস
ক্যাম্পে
আর
কাজের
খুঁটিনাটি
বিষয়
শিখছি।
এরপর
আমাদের
একে
একে
পাঠানো
হবে
লোহা-পাহাড়ের
বিভিন্ন
ক্যাম্পে।
প্রতিটি
ক্যাম্পই
লোহা-পাহাড়ের
গভীর
অরণ্যের
মধ্যে।
তাতে
নাকি
বাঘ, ভালুক, সাপ
সবই
আছে।
ব্যাপারটা শুনেই
ভয়ে
আমার
হাত-পা
পেটের
মধ্যে
সেঁধিয়ে
এল।
ঘটনাচক্রে
লোহা-পাহাড়ের
ক্যাম্পে
যাবার
সবচাইতে
আগে
ডাক
এল
আমারই।
আমি যে মহা ভীতু
সেটা
সিনিয়র
জিওলজিস্টের
কানে
গেছে।
আমাকে
অভয়
দিয়ে
তিনি
বললেন
যে
সবচাইতে
ভালো
আর
নিরাপদ
সাইট
লোহা-পাহাড়
ড্রিলিং
ক্যাম্প
আর
কাজ
শিখবার
সব
চাইতে
ভালো
গুরু
নায়ার-স্যার।
প্রতি বুধবার
উনি
লোহা-পাহাড়
থেকে
বেস
ক্যাম্পে
আসেন
সাপ্তাহিক
মিটিং-এর
জন্য।
ঠিক
হল, ফেরার
সময়
নায়ার-স্যার
তার
জিপে
আমাকে
লোহা-পাহাড়
নিয়ে
যাবেন।
আগেই
শুনেছিলাম
উনি
বেশ
নিয়মনিষ্ঠ
কড়া
লোক, তবে
রেগে
না
গেলে
খুব
ভালো
মানুষ।
কপাল দোষে, বুধবার
সকালে
ওনার
সঙ্গে
দেখা
হবার
পর
থেকেই
যা
সব
ঘটনা
একের
পর
এক
ঘটে
চলল, তাতে
মনে
হচ্ছে
এখনও
উনি
বেশ
রেগেই
আছেন।
পাহাড়ি নদীর
ওপর
পাকা
সেতুর
আগে
বাম্পের
ওপর
নায়ার-স্যারের
মতো
পাকা
ড্রাইভার
বোধ
হয়
ইচ্ছে
করেই
ব্রেক
প্যাডালে
একটু
কম
চাপ
দিলেন।
মনে
হল
গাড়িতে
হালকা
ঝাঁকুনি
দিয়ে
পেছনের
আরোহীদের
নেশাগ্রস্ত
ভাব
কাটিয়ে
দেবার
সঙ্গে
সঙ্গে
তাদের
এ
কাজটা
যে
উনি
কতটা
অপছন্দ
করেছেন
তার
একটা
বার্তা
দিলেন।
ব্রিজের পর লোহা-পাহাড়
যাবার
একুশ
কিলোমিটার
পিচ
রাস্তা, কালো
সাপের
মতো
পাহাড়কে
পেঁচিয়ে
পেঁচিয়ে
একদম
ওপরে
উঠে
গেছে।
নভেম্বর
মাসের
মাঝামাঝিও
পেরিয়ে
গেছে।
বিকেলের
হালকা
রোদ, সন্ধের
আঁধারকে
হাতছানি
দিয়ে
ডাকছে
আর
নিজে
উঁচু
পাহাড়ের
বনের
গাছের
মাথা
দিয়ে
লাফিয়ে
লাফিয়ে
হারিয়ে
যাচ্ছে।
পাহাড়ের কোলে
খুব
ঘন
জঙ্গল, কালো
পিচ
রাস্তা
তাকে
মাঝ
বরাবর
চিরে
এগিয়ে
গেছে।
এই
রাস্তায়
আসতেই
নায়ারবাবু
হেডলাইট
অন
করে
অভ্যাসমতো
কপালে
হাত
ঠেকিয়েই
একটা
বাঁক
দেখে
স্টিয়ারিং
হুইল
আর
গিয়ার
লিভারে
হাত
ঠেকালেন।
জোসেফ এ গাড়ির
নিয়মিত
ড্রাইভার, সে
মালয়ালিতে
নায়ার-স্যারকে
কিছু
একটা
বলল।
স্যার
গম্ভীর
গলায়
জোরে
মাথা
নেড়ে
একবার “ক্যাট!” বলেই
আমার
দিকে
চেয়ে
বাকি
কথা
না
বলে
চুপ
করে
গেলেন।
কিন্তু
জিপের
পেছনে
বসা
বাকি
লোকরা
বোধহয়
সেই
বিষয়েই
আলোচনা
শুরু
করে
দিল।
ভাগ্যিস এদের
কথাগুলো
মাতৃভাষা
মালয়ালিতে
হচ্ছিল।
একটু
হিন্দি
মিশিয়ে
বললেই
সামনে
পেছনে
হুড
খোলা
এই
জিপে
বোধ
হয়
প্যান্টেই
কিছু
একটা
করে
বসতাম।
পাহাড়ি রাস্তায়
প্রথম
বাঁক
শুরু
হবার
আগে, নায়ার-স্যার
ক্লাচে
পা
দিয়ে
গিয়ার
বদলাবার
সঙ্গে
সঙ্গে
মনে
হয়
সেই
আগে
শোনা “ক্যাট” নিয়ে
আলোচনা
বন্ধ
করার
জন্য
সবাইকে
এমন
ধমকানি
দিলেন
যে
চড়াই
পথে
জিপের
ইঞ্জিনের
গর্জন
ছাড়া
আর
কিছুই
শোনা
যাচ্ছিল
না।
কিন্তু বাঁকটা
পর
হবার
মিনিটখানেক
পরে
ঘন
পাতা
ঝোপের
আড়ালে
যাকে
দেখা
গেল, জোসেফ
আর
বাকিরা
কি
তাকেই “ক্যাট” বলছিল?
প্রথম বাঁকটা
পার
হবার
পর
বেশ
অনেকটা
রাস্তা
সমতলের
মতো, চড়াই-উতরাই
নেই।
জিপের
ড্রাইভিং
সিটের
দিকে
মানে
নায়ার-স্যারের
দিকে, মানুষ-সমান
উঁচু
ঝোপ
আর
আমার
দিকটায়
ঢালু
উপত্যকা।
দূরে
সমতলে
বেস
ক্যাম্পের
আলোর
সারি
দেখা
যাচ্ছে।
হঠাৎ কিছু
একটা
দেখে
স্যার
জোরে
ব্রেক
দিয়ে
জিপ
থামিয়ে
দিলেন।
জিপের
পেছন
দিক
থেকেও
সবাই
সমস্বরে
কিন্তু
চাপা
আওয়াজে
কিছু
বলে
উঠল।
সবাই, এমন
কিছু
কী
দেখল
আর
আমি
সামনের
আসনে
নায়ার-স্যারের
পাশে
বসে
তা
টেরই
পেলাম
না?
ম্যাথিয়াস, মানে
আমি
আসার
আগে
নায়ার-স্যারের
পর
ক্যাম্পের
সেকেন্ড
ইন
কমান্ড,
আমার
পেছনেই
বসে
ছিল।
আজ
সকালে
নায়ার-স্যার
ওর
সঙ্গে
আলাপ
করিয়ে
দেবার
পর
মনে
হচ্ছিল
ড্রিলিং
ক্যাম্পে
আমার
যাওয়াটা
ওর
অপছন্দ।
স্যারের
পরেই
ওর
জায়গাটা
আর
থাকবে
না
বলে?
সেই ম্যাথিয়াস, তার
এক
হাত
দিয়ে
আমার
মুখটা
চেপে
ধরে
বললে, “একদম
চেঁচাবে
না।
আমরা
যা
করতে
বলব
তাই
করবে।” অন্য
হাতের
আঙুল
তুলে
আমাকে
আবার
বললে, “দেখতে
পাচ্ছ? একদম
তোমার
সামনেই।”
আমি এতক্ষণ
যেদিকে
তাকিয়ে
ছিলুম
সেই
ঢালু
উপত্যকার
দিকেই
তো
ও
আঙুল
উঁচিয়ে
কী
বলতে
চাইছে? আমাকে
জিপ
থেকে
ওইদিকে
ঠেলে
ফেলে
দেবে? নায়ার-স্যারও
এখন
কেমন
চুপ
করে
আছেন।
এরা
সবাই
মিলে
এখন
একজোট
হয়েছে
তাহলে? কী
করি
আমি
তাহলে
এখন?
স্যার আমার
দিকে
একবার
তাকিয়ে
বুঝলেন
আমি
এখনও
দেখিনি
কিছুই।
উনি
ফিসফিস
করে
বললেন, “আমার
আঙুল
বরাবর
ঝোপের
দিকে
তাকাও, ঠিক
ওইখানটায়
যেখানে
ঝোপ
একটু
নড়ছে
বলে
মনে
হচ্ছে
দেখতে
থাকো
আর
ম্যাথিয়াস
যা
বলছে
তাই
করো, নইলে
তোমার
জন্যে
সবার
বিপদ
হতে
পারে।” ও
হরি! আমি
তো
এতক্ষণ
তাকিয়ে
ছিলাম
উপত্যকার
দিকে।
নায়ার-স্যারের
কথামতো
ঝোপের
দিকে
চাইতেই, বড়োজোর
পঞ্চাশ
মিটার
দূরে, একজোড়া
জলন্ত
আগুনের
ভাঁটার
মতো
কী
একটা
দেখলাম।
মুহূর্তখানিক
সেদিকে
তাকাতেই
বেশ
বড়োসড়ো
একটা
ডোরাকাটা
মাথা
দেখা
দিয়েই
মিলিয়ে
গেল।
আমার
মনে
হচ্ছিল
কেউ
আমার
হৃৎপিণ্ডটা
উপড়ে
এনে
আমার
হাতে
রেখে
হাতটা
কানের
কাছে
নিয়ে
এল।
ঠিক এই সময়, যাত্রাতে
রাজা
যখন
স্টেজে
ঢোকে
ঠিক
সেই
চালে, জঙ্গলের
রাজা
এবার
ঝোপের
আড়াল
থেকে
বেরিয়ে
এল।
পালা
এবার
শুরু
হবে
আর
আমি
যেন
সবচাইতে
দামি
আসনে
একদম
সামনে
বসে
সেই
পালা
দেখছি।
জিপের জ্বলন্ত
হেডলাইটের
দিকে
একবার
তাচ্ছিল্যভরে
তাকিয়েই, মুজরার
আসরে
রাজামশাই
যেভাবে
বসেন, তেমনভাবে
সরু
কালো
পিচ
রাস্তাটার
ওপর
আধশোয়া
হয়ে, ঘাড়টা
একবার
আমাদের
দিকে
ঘুরিয়ে
তাচ্ছিল্য
ভরা
দৃষ্টি
হেনেই
মাথাটা
উলটো
দিকে
সরিয়ে
নিলে।
অবাক কথা, সামনে
পেছনে
হুডখোলা
জিপের
সামনের
আসনে
বসে
পঞ্চাশ
মিটারের
কম
দূরে
জঙ্গলের
বাঘকে
দেখে
আমার
মতো
মহাভীতুও
যেন
ভয়
পেতেই
ভুলে
গেল।
এই ঘটনার
পর
টানা
তিন
বছর
গভীর
জঙ্গলেই
কাটিয়েছি, বাঘ, পাইথন, ভল্লুক
এই
সব
হাড়হিম
করে
দেওয়া
জন্তুজানোয়ারদের
সামনা-সামনি
পড়েছিও
বেশ
কয়েকবার,
কিন্তু
ভয়
আর
পাইনি।
নায়ার-স্যারের
মতো
পোড়খাওয়া
লোক
আমার
দিকে
তাকিয়ে
এটা
বুঝতে
পেরে, ম্যাথিয়াসকে
আমার
মুখ
থেকে
হাত
সরিয়ে
নিতে
বললেন।
লক্ষ
করলাম
নায়ার-স্যার
তাঁর
দুটো
পা
ব্রেক
আর
ক্লাচ
প্যাডে
রেডি
রেখেছেন
যাতে
গাড়ি
যে
কোনো
সময়ে
দৌড়োতে
পারে।
এরকম একটা
বিপদের
সামনে
পড়ে
নায়ার-স্যার
বা
সদ্য
নেশা
করে
আসা
তার
সহচরদের
কাউকেই
নার্ভ
হারাতে
দেখিনি, কাউকে
একটা
টুঁ
শব্দ
করতে
শুনলাম
না
এবং
আমিও
তাই
করলাম।
অবচেতন মনে এই শিক্ষণীয়
ব্যাপারটা
যে
অনেক
গভীরে
রেখাপাত
করে
গেল
সেটা
অনেকদিন
পরে
এইরকমই
বেশ
কিছু
ঘটনার
সামনে
আসবার
পরে
বুঝেছিলাম।
গাড়ির আলো আর ইঞ্জিনের
শব্দ
কীরকম
যেন
ঠেকছিল।
স্যার
ফিসফিস
করে
জোসেফকে
বললেন, “বেস
ক্যাম্প
গ্যারেজের
মেকানিককে
ফ্যান
বেল্ট
আর
ডায়নামো
বদলাতে
বলেছিলে?”
“জী
সাব।”
“ফুয়েল
ইঞ্জেকশানটা
আর
টিউনিং?”
“ঠিক
করে
দেবে
বলেছিল
সাব।”
“ফাঁকি
মেরেছে
সে
আর
তুমি
তো
বন্ধুদের
সঙ্গে
চায়ের
না
অন্য
কিছুর
দোকানে
ব্যস্ত
ছিলে।
নিজের
চোখেই
দেখ, ডায়নামো
ব্যাটারিকে
চার্জ
করছে
না, টিউনিংও
ঠিক
করেনি, এয়ার
নিচ্ছে
এঞ্জিন।”
ম্যাথিয়াস বলল, “জী
সাব, হেড
লাইট
তো
হলুদ
হয়ে
আসছে, আর
ইঞ্জিনের
চাল
এখন
ভালো
না।”
নায়ার-স্যার ফিসফিসিয়েই
হুকুমের
স্বরে
বললেন, “বাজে
কথা
একদম
বন্ধ
করো
সবাই।
সিটের
তলা
থেকে
হাতিয়ার
বের
করে
তৈরি
রাখো।
যে
কোনো
সময়
দরকার
হতে
পারে।”
এতক্ষণে আমি আশ্বস্ত
হলাম।
চোরাগোপ্তা
বেআইনি
হলেও
প্রাণরক্ষার
জন্য
বন্দুক-টন্দুক
আছে
তাহলে।
নয়তো
এই
অবস্থায়
ব্যাটারি
জবাব
দিলেই
অন্ধকার
নেমে
আসবে।
এই
সঙ্গে
এয়ার
নিয়ে
ইঞ্জিন
বন্ধ
হয়ে
গেলেই
আর
দেখতে
হবে
না।
শব্দ
আর
আলো
দুটোই
নেই
দেখলেই, বাঘরাজা
বিনা
দ্বিধায়
হুড
খোলা
জিপে
সঙ্গে
সঙ্গে
ঝাঁপিয়ে
পড়বে।
পেছন থেকে
ডিজেলের
গন্ধ
নাকে
আসতেই
ঘাড়
ঘুরিয়ে
দেখি
ম্যাথিয়াস
আর
তার
সঙ্গীসাথিরা,
সিটের
তলা
থেকে,
একপ্রান্তে
অনেকটা
মোটা
কাপড়
বাঁধা
বেশ
কয়েকখানা
কাঠের
লাঠি
বের
করছে।
স্যার তাড়া
দিচ্ছেন, “নিকাল
লিয়া
হাতিয়ার
সব? ম্যান্টল
টাইট
করে
নিয়ে
ডিজেলে
চুবিয়ে
তৈরি
রাখো।”
তাহলে
এই
হল
হাতিয়ার! এ
দিয়ে
রাস্তার
নেড়ি
কুকুরও
তেমন
ভয়
পাবে
না।
লাঠির আগাতে
যে
মোটা
কাপড়
বেঁধে
রেখেছে,
ম্যান্টল
না
কী
জানি
বলছে,
এ
দিয়ে
কী
করবে? বাঘের
পিঠে
হাত
বুলিয়ে
তাকে
যেতে
বলবে? চিড়িয়াখানাতে
পিঁজরাতে
রাখা
বাঘের
সঙ্গে
এ
রকম
রসিকতা
চলতে
পারে, তাই
বলে
যে
জঙ্গলি
বাঘ
মাত্র
পঞ্চাশ
মিটার
দূরে
রাস্তায়
আধশোয়া
হয়ে
নরম
নোনতা
নরমাংসের
অপেক্ষা
করছে
তার
সঙ্গে
কীভাবে
চলবে?
হেড লাইট
মাঝে
মধ্যে
দপ
দপ
করছে
আর
বেশ
হলুদ
হয়ে
আসছে, ইঞ্জিন
একটু
বেচাল
হলেই
এক্সেলেটর
দাবিয়ে
নায়ার-স্যার
তাকে
উসকে
দিচ্ছেন।
এমন সময় বাঘ মহারাজ
আলো
অথবা
মাঝেমধ্যে
এঞ্জিনের
ব্যাকফায়ারের
ফাটা
আওয়াজে
বিরক্ত
হয়ে, এবার
ঘাড়
ঘুরিয়ে
আমাদের
দিকে
একবার
তাকিয়ে
বিশাল
মুখ
খুলে
সব
কটা
দাঁত
দেখিয়ে
একটা
হাই
তুলল।
হেড
লাইটের
হলুদ
ম্লান
আলোতেও
তার
চোখ
দুটো
আর
দাঁত
যেন
ঝলসে
উঠল। বাঘমামা
এটা
একটা
ওয়ার্নিং
দিল
বলে
মনে
হচ্ছে।
আমার
আন্দাজ
যে ভুল নয় তা কয়েক
সেকেন্ড
পরেই
বুঝলাম।
নায়ার-স্যার আমার
কাঁধে
টোকা
দিতেই
চমকে
উঠলাম।
ওনার
হাতে
ধরা
সেই
মাথার
দিকে
কাপড়
বাঁধা
লাঠি
আর
একটা
গ্যাস
লাইটার
আমার
হাতে
ধরিয়ে
দিলেন।
আমি
কাপড়
বাঁধা
দিকটা
হাতে
ধরেছি
দেখে
আমাকে
ঠিক
করে
ধরিয়ে
দিয়ে
ফিসফিস
করে
বললেন, “এটা
মশাল।
কাপড়
বাঁধা
দিকটাতে
লাইটার
জ্বালালেই
জ্বলে
উঠবে।
মশাল
আর
লাইটার
হাতে
তৈরি
রাখো
আর
আমাদের
ইশারার
জন্য
তৈরি
থাকো।
বিপদ
আঁচ
করতে
পারা
মাত্র
আমি
বা
ম্যাথিয়াস
তোমার
কাঁধে
হালকা
টোকা
দেব।”
আমি ভয়ার্ত
স্বরে
খুব
ফিসফিসিয়ে
বললাম, “তারপর?”
স্যার মনে হল খুবই
বিরক্ত
হলেন
আমার
কথা
শুনে, “তারপর
আর
কী! আমরা
সবাই
জিপ
থেকে
ঝাঁপিয়ে
নেমে
পড়ব
আর
মুহূর্তের
মধ্যে
যে
যার
মশাল
জ্বেলে
নেব।
কিন্তু
আমাদের
ইশারার
অপেক্ষা
না
করে
নিজে
কিছু
করলেই
আমরা
সবাই
বিপদে
পড়ব।”
নায়ার-স্যারের
কথাটা
শেষ
হয়েছে
কি
হয়নি, ঠিক
সেই
সময়
জিপের
অসুস্থ
ইঞ্জিন
দু-তিনবার
কাশতে
কাশতে
চুপ
করে
গেল।
তার
একটু
পরেই
গাড়ির
হেডলাইটের
আলোও
নিভে
গেল। আকাশে চাঁদের
আলো
আছে
কিন্তু
সেটা
পূর্ণিমার
অর্ধেকের
অর্ধেক।
কালো
মেঘের
দ্রুত
আনাগোনাতে, কাস্তের
ফালি
চাঁদ
মাঝে
মধ্যেই
গায়েব
হয়ে
যাচ্ছে।
সেই হালকা
আলোতে, রবারঘষা
পেনসিল
স্কেচের
মতো
বসে
থাকা
বাঘের
আবছা
অবয়ব, বেশ
কষ্টের
সঙ্গে
ঠাহর
করা
যাচ্ছে।
ইঞ্জিন
বন্ধ
হবার
পর
নিস্তব্ধতা
ঘিরে
এল।
শুধু
মাঝে
মাঝে
হাওয়াতে
ভেসে
আসছে
কাছের
একটা
পাহাড়ি
ঝরনার
জলনূপুর।
তার
সঙ্গে
তাল
ঠুকে, বাঘের
কপালে, ঝরনার
জলের
সঙ্গে, তোফা
জলযোগ
নেচে
চলেছে।
নায়ার-স্যার ফিসফিস
করে
বললেন, “কেউ
নড়বে
না, অপেক্ষা
কর
একটুক্ষণ।” একটু
পরে
কিন্তু
অবস্থাটা
আরও
বিগড়াল।
মেঘগর্জনকে
লজ্জা
দিয়ে
এবার
বাঘের
ডাক
শোনা
গেল, কিন্তু
আওয়াজটা
শেষ
হবার
আগে
বোঝা
গেল
এটা
নিচে
খাদের
দিক
থেকে।
তাহলে
আরও
একটা
বাঘ
মানুষের
গন্ধ
পেয়ে
গেছে,
তারও
আসার
দেরি
নেই
আর।
চীৎকার-চেঁচামেচির
তো
প্রশ্নই
ওঠে
না,
কিন্তু
দেখলাম
আমার
সারা
শরীর
কেঁপে
কেঁপে
উঠছে, দুই
পা
থেকে
একের
পর
এক
ঠাণ্ডা
স্রোত
আছড়ে
পড়তে
চাইছে।
তাহলে
কি
এখানের
কুখ্যাত
ম্যালেরিয়া
আমাকে
ধরে
ফেলল? বাড়ির
সকলের
মুখগুলো
একবার
ভেসে
উঠল।
একটু জল হাতের
কাছে
থাকলে
বড়ো
ভালো
হত, গলা
আর ঠোঁট
শুকিয়ে
কাঠ
হয়ে
আসছে।
পেছনে
দুটো
বড়ো
বোতলে
জল
আছে, ঘাড়
ঘুরিয়ে
আনতে
গিয়ে
সবার
নির্লিপ্ত
মুখভাব
দেখে
খুব
অবাক
হলাম।
বোতলে হাত লাগাতে
যাবার
আগেই
আবার
খাদের
ধার
থেকে
বাঘের
ডাক
শোনা
গেল, এটা
কিন্তু
আগের
থেকে
আরও
জোরে
আর
স্পষ্ট
শোনা
গেল।
জিপের
বাকি
সবাই
কপালে
জোড়হাত
ঠেকিয়ে
সমস্বরে
হিন্দিতে
বলে
উঠল, “জয়
বজরঙবলি, বাঁচা
গেল।”
এরা সবাই
কি
তাহলে
বাঘের
পেটে
যাবার
ভয়েতে
পাগল
হয়ে
গেল? শিয়রে
জোড়া
শমন
আর
এরা
বলছে
‘বাঁচা
গেল’? কিন্তু
দেখি
নায়ার-স্যারও
একগাল
হেসে
বললেন, “হ্যাঁ,
মনে
হচ্ছে
রাস্তা
এবার
জলদি
সাফ
হয়ে
যাবে।” আমি
মনে
মনে
বললাম, “হ্যাঁ,
তা
আর
বলতে, আমরা
এখন
নিজেরাই
সাফ
হয়ে
যাব
বাঘের
পেটে
গিয়ে।”
আমার ভাবা
শেষ
হতে
না
হতেই
দেখি
এতক্ষণ
আধশোয়া
হয়ে
থাকা
বাঘ
এবার
উঠে
দাঁড়িয়েছে
আর
দাঁড়িয়ে
উঠেই
আমাদের
দিকেই
চেয়ে
একবার
হুংকার
দিল।
এত
কাছ
থেকে
বাঘের
পিলে
চমকানো
আওয়াজ, আগে
কখনও
শুনিনি।
মনে
হল
যেন
একসঙ্গে
অনেক
মেঘ
গর্জে
উঠছে।
বাঘ
আর
কয়েক
সেকেন্ডের
মধ্যে
হুডখোলা
এই
জিপের
মধ্যে
লাফিয়ে
পড়বে
আর
বোধহয়
সবার
আগে
আমারই
গলাটা
কামড়ে
ধরে
টানতে
টানতে
নিয়ে
যাবে।
একটা জোর ঝাঁকুনিতে
আমার
জ্ঞান
ফিরে
এল।
এই
ঝাঁকুনিটা
ডিজেল
জিপের
ইঞ্জিন
চালু
হবার।
বাঘরাজা
খাদের
ঢালের
আড়ালে
অদৃশ্য
হতেই, আমার
অসমসাহসি
সহচরেরা
বিদ্যুৎগতিতে
জিপ
থেকে
নেমে
জোর
ঠেলা
লাগিয়ে
আবার
উঠে
পড়েছে।
স্টিয়ারিং
হুইলে
নায়ারবাবু
শ্যেন
দৃষ্টি
রেখেছিলেন
খাদের
দিকে।
আমি সে সময়টা
অজ্ঞান
হয়ে
যাবার
জন্য
এইসবের
যেমন
কিছুই
টের
পাইনি,
ঠিক
সেইভাবে
আমার
এক-আধ
মিনিটের
জন্য
জ্ঞান
হারানো
এবং
আবার
ফিরে
আসা, ওনার
এবং
পুরো
দলটার
নজর
এড়িয়ে
গেল, নইলে
পরে
সবার
হাসির
খোরাক
হতাম।
নায়ার-স্যার কুশলী
হাতে
স্টিয়ারিং
সামলে
কমজোরি
হেডলাইটেও
একের
পর
এক
চুলের
কাঁটার
মতো
পাহাড়ি
পাকদণ্ডি
রাস্তা
অনায়াসে
পার
করছিলেন।
লোহা-পাহাড়
হিলটপে
পৌঁছোবার
অর্ধেকের
বেশি
রাস্তা
পার
হয়ে
এসেছি। কিন্তু
এখনও
খাদের
বাঘের
পর
পর
দুটো
ডাক
নিয়ে
আলোচনা
চলছেই।
ডাকটা
বাঘের
না
বাঘিনির
এই
নিয়ে
জোরালো
তর্ক
চলছে।
মনে হচ্ছে
বাঘ
নয়, কোনো
সদ্য
সমাপ্ত
টি-২০
ম্যাচ
খেলে
ফিরছি
আমরা
আর
নায়ার-স্যার
কুশলী
পোড়খাওয়া
অধিনায়কের
মতো
ঠান্ডা
মাথায়
ম্যাচটা
সবাইকে
দিয়ে
জিতিয়ে
আনালেন।
জোসেফ আমাকে
দলে
টানবার
জন্যে
বললে, “সাহেব, এটা
বাঘিনির
ডাক
বলেই
আমাদের
সামনে
রাস্তা
জুড়ে
বসে
থাকা
বাঘটা
আর
বিলম্ব
করতে
সাহস
পেল
না, নয়তো
আমাদের
ছাড়া
পেতে
আরও
সময়
লাগত।”
জোসেফের পাশে
যে
বসেছিল
সে
মানতে
রাজি
নয়, “কিন্তু
বাঘিনির
আওয়াজ
এত
জোরে
পিলে
চমকানো
হয়?”
জোসেফের বন্ধু
মাধবন
বলে, “কেন
তুই
কি
ভেবেছিলি
বাঘিনি
বলে
তার
গলা
দিয়ে
বাঁশির
সুর
বেরোবে? এই
তো
সবে
দু’মাস
হল
এসেছিস,
আরও
শোন
তবে
না
বুঝবি।”
ম্যাথিয়াস আমাকে
বললে, “সাহেব, বাঘ
আদতে
বাউণ্ডুলে
প্রকৃতির,
কিন্তু
বছরকার
এই
কয়েকটা
মাস
সে ফ্যামিলি
ম্যান
হয়ে
যায়
আর
বাধ্য
স্বামীর
মতো
বউয়ের
ফাইফরমাস
খাটে।
আমরা
যখন
খাদের
ধার
থেকে
বাঘিনির
ডাক
শুনতে
পাই
তখনই
বুঝে
নিয়েছিলাম
রাস্তা
জুড়ে
বসে
থাকা
এই
বাঘ
আর
বেশিক্ষণ
বসে
থাকতে
পারে
না।”
আমি বলি, “কিন্তু
বাঘ
আর
বাঘিনির
আওয়াজ
আলাদা
হয়
নাকি?”
জোসেফ বলে, “স্যার, শুনতে
শুনতে
আপনিও
আমাদের
মতো
বুঝতে
পেরে
যাবেন।”
তার মানে
এখানে
আরও
অনেকবার
তাহলে...।
আমার মুখের
দিকে
চেয়ে
নায়ার-স্যার
বললেন, “যে
বাঘ
দেখা
যায়, সে
অতটা
ভয়ংকর
নয়।
কিন্তু
সে
যখন
শিকারি
হয়
তখন
শিকার
তাকে
দেখে
একদম
শেষ
সময়ে।
আরও
জেনে
রাখুন
বাঘ
নরখাদক
না
হলে
মানুষকে
এড়িয়েই
চলে।”
আর একটা
বাঁক
পেরোলেই
লোহা-পাহাড়
চুড়ো।
ড্রিলিং
ক্যাম্প
সেই
চুড়োর
ঠিক
কোলে
অনেকটা
সমতল
জায়গা
জুড়ে।
ম্যাথিয়াস
সেদিকে
দেখিয়ে
আমাকে
বললে, “পুরো
ক্যাম্পটা
কাঁটাতারের
উঁচু
বেড়া
দিয়ে
ঘেরা
আর
পাহারাদারেরা
সবসময়
কড়া
নজর রাখে।
নায়ার-স্যার
পুরো
ক্যাম্পটা
দু’ভাগে
ভাগ
করেছেন
পাহাড়ধার
আর
খাদের
ধার।
আপনার
তাঁবু
কোনদিকে
খাটাব?”
জোসেফ বললে, “পাহাড়ধারে
একটু
গরম
বেশি,
তবে
আমরা
সবাই
এইখানেই
আছি।
ডিউটির
পর
সবাই
মিলে
তাস
পাশা, ক্যারম, টিটি
ভলিবল
খেলে
আর
গল্পগুজব
করে
কখন
যে
শোবার
সময়
এসে
যায়
বুঝতেও
পারবেন
না।”
“আর
খাদের
ধারে?”
“খুব
সুন্দর
ঠান্ডা
হাওয়া, রোদের
তেমন
জোর
নেই
তবে...”
“তবে
কী?”
জোসেফ বলে, “মাঝ
রাত
থেকে
একটু
ঘুমের
অসুবিধে
হতে
পারে।
খাদের
ধারে
নিচের
তরাইয়ের
জঙ্গল
থেকে
হায়েনা
আর
শেয়াল
প্রহরে
প্রহরে
ডেকে
যায়, এছাড়া
কখনও
কখনও
বাঘের
ডাকও
শোনা
যায়।”
নায়ার-স্যার এসব শুনে
বিরক্ত
হয়ে
বললেন, “আজ
রাতটা
উনি
আমার
তাঁবুর
পাশে
গেস্ট টেন্টে
কাটিয়ে
নিন।
কাল
সব
কিছু
দেখে
উনি
যেখানে
চাইবেন
সেইখানেই
ওনার
টেন্ট
লাগিয়ে
দেওয়া
হবে।”
আমি হিলটপে
আসছি
এই
খবর
পেয়ে
ড্রিলিং
ফোরম্যান
পাণ্ডেজি
তাঁর
তাঁবুর
পাশেই
আমার
থাকবার
টেন্ট
তৈরি
রেখেছিলেন। সকাল
হতেই
তিনি
আমাকে
নিয়ে
এলেন
সেখানে।
আসতে আসতে
উনি
জানালেন
তিনি
খাদের
ধারের
এলাকায়
থাকেন।
তবে
এই
টেন্ট
পছন্দ
না
হলে
ম্যাথিয়স
আমাকে
পাহাড়ধারে
তার
তাঁবুর
পাশেই
আমার
তাঁবু
তৈরি
রেখেছে।
আমি
সেখানেও
থাকতে
পারি।
আমার নিজের
মনে
হল
যে
ড্রিলিংয়ের
কাজ
শিখতে
হলে
আমার
পাণ্ডেজির
সঙ্গে
থাকা
অনেক
বেশি
দরকারি।
আমি
যে
ভুল
করিনি
তার
প্রমাণ
একটু
পরেই
পেলাম।
দু’দিকের
পাহাড়-চুড়ো
থেকে, দুটি
বড়ো
মাপের
জলপ্রপাত, ঝাঁপ
দিয়ে
এক
জায়গায়
মিলেছে
আর
তারপর
নিচের
উপত্যকাতে
এঁকেবেঁকে
বয়ে
যাওয়া
পাহাড়ি
নদীতে
পড়েছে। এই তাহলে
জোড়া
ঝরনা
যার
কথা
আমাকে
বেস ক্যাম্পের
সবাই
বলেছিলেন।
চারিদিকে
ঢেউখেলানো
পাহাড়ের
মাথাতে
ধোঁয়ার
মতো
দেখতে
সাদা
সাদা
মেঘ
আটকে
আছে।
কিছু
মেঘের
দল
উপত্যকার
ঘন
অরণ্য
থেকে
পাহাড়চুড়োর
দিকে
ভেসে
ভেসে
এগিয়ে
চলেছে।
সব
মিলিয়ে,
মনে
হচ্ছে
প্রকৃতির
এক
নয়নমনোহর
স্বর্গের
দোরগোড়ায়
চলে
এসেছি।
আমার তন্ময়
ঘোর
ভাঙিয়ে
পাণ্ডেজি
দেখিয়ে
দিলেন
আমার
টেন্ট।
টেন্টের
বাইরে
একটু
দূরে
আগুনের
একটা
কুণ্ড
মতো
দেখলাম।
তার
ওপর
দিয়ে
টাঙানো
লাঠিতে
একটা
কেটলি
ঝুলছে।
সেখান
থেকে
একটু
দূরে
পাথরের
লম্বা
স্ল্যাব
বিছিয়ে
রাখা
হয়েছে।
তার
পাশেই
একটা
বেশ
লম্বা
দোলনা।
পান্ডেজি
বললেন,
সারাদিনের
কাজের
পর
কয়েক
কাপ
চা
বানিয়ে
রাখলে
দোলা
কিংবা
স্ল্যাবে
বসে
তাতে
চুমুক
দিতে
দিতে
দূরের
পাহাড়ের
ঢালগুলো
দেখতে
দেখতে
দেখবেন
সাঞ্ঝাচুলা
থেকে
বাঁকে
করে
রাতের
ডিনার
পৌঁছে
গেছে।”
এই অরণ্যে
টিভির
ব্যবস্থাও
আছে
নাকি? আমি
এদিক
ওদিক
চাইছি
দেখে
এবার
পাণ্ডেজি
বললেন, “আপনার
টেন্টের
বাইরের
ওই
লম্বা
গাছটার
মগডালে
হ্যামক
আর
তার
সঙ্গে
লাগানো
দড়ির
সিঁড়ি
ঝুলছে।
আর
একটু
পরেই
সাঞ্ঝাচুলা
থেকে
ডিনার
এসে
যাবে।
সাঁঝবেলাতেই
ডিনার
সেরে, নাইট
ভিশন
বাইনোকুলার
নিয়ে
উঠে
পড়ুন
আপনার
হ্যামকে।
সঙ্গের
ওয়াকিটকিতে
হেডফোন
কানে
গুঁজে
রাখবেন।
আমি
পাশের
হ্যামকেই
থাকব।
এইধরনের
শো
আপনি
আগে
দেখেননি।
আজ
প্রথম
রাতে
আপনাকে
একটু
গাইড
করে
দেব।”
পরিষ্কার আকাশ
থেকে, নবমীর
চাঁদ
তার
মায়াবী
আলোয়, প্রকৃতির
এই
আরণ্যক
পরিবেশের
চারপাশ
ভরিয়ে
দিয়েছে।
রাতের
খাওয়া
সারবার
সঙ্গে-সঙ্গে, আমার
তাঁবুতে
বসে
শুনতে
পাচ্ছি, সামনের
জোড়া
জলপ্রপাতের
শব্দে
এবারে
যেন
প্রাণ
এসেছে।
তাদের
জলনূপুরে
যেন
মুজরোর
মন-মাতাল
করা
ছন্দ।
হ্যামকের সঙ্গে
লাগানো
নাইলনের
শক্ত
দড়ি
বেয়ে
গাছের
মগডালে
বাঁধা
হ্যামকে
পৌঁছে
একটু
থিতু
হয়ে
বসতেই
মনে
হল
যে
আমি
কোনো
শব্দ
এবং
আলোর
যুগলবন্দী
শো
দেখতে
এসেছি।
নাইট ভিশনে
ব্যাপারটা
আরও
পরিষ্কার
হল।
উপত্যকার অনেক
গাছের
ডালে
ডালে
ঘুমোচ্ছে
শিকারি
পেঁচাগুলো।
থেকে
থেকে
আকাশে
আলো
করে
আসছে
একের
পর
এক
ধূমকেতু।
জোড়া
ঝরনা
যেখানে
পাহাড়ি
নদীতে
মিশেছে
সেখানকার
এবং
পাহাড়ি
নদীর
দুই
পারে, প্রায়
প্রতিটি
গাছেই
জোনাকির
টুনি
বালব
জ্বলছে।
কানে
ওয়াকিটকির
হেডফোন
লাগানোই
ছিল, পান্ডেজির
চাপাস্বর
শুনতে
পেলাম, “গাছে
গাছে
যেখানে
জোনাকির
টুনি
বালব
জ্বলছে
নিভছে
ঐসব
জায়গাতে
লক্ষ
রাখুন।
ওই
আলো
দেখেই
জঙ্গলের
সব
প্রাণীরা
আসবে
নদী
আর
ঝরনার
জলে
সারাদিনের
তৃষ্ণা
মেটাতে।
একটু
পরেই
হয়তো
দেখতে
পাবেন
হরিণের
দল
আসছে
নেচে-নেচে। এছাড়া আরও অনেক
প্রাণীর
আওয়াজের
সঙ্গে
সঙ্গে
নাইট ভিশনে
তাদের
দেখতেও
পাবেন।”
একটা কিছু
আওয়াজ
শোনা
যাচ্ছে।
কান
পেতে
তা
শোনবার
চেষ্টা
করলাম।
মনে
হচ্ছে, কারা
কারা
যেন
আসছে।
হঠাৎ
ঝরনার
জল
পড়বার
আওয়াজও
পালটে
গেল।
আমার তাঁবুর
সামনের
গাছগুলোর
শাখাতে, হঠাৎ
দোলন-কাঁপন
দেখে
নাইট ভিশনে
দেখলাম
শাখামৃগেরা
গাছে
গাছে
ঝাঁপ
দিয়ে
দলে-দলে
চলেছে
ঝরনার
দিকে।
একটু
চারপাশে
ঘাড়
ঘোরাতেই, দেখলাম
শাখামৃগের
বন্ধুরাও, অর্থাৎ
চিতল
হরিণের
দলও
চলেছে
ঝরনার
দিকে।
নাহ! হরিণের
দল
একটা
নয়, পশ্চিম
পাহাড়ের
কোল
দিয়ে, একটা
শুঁড়িপথ
আছে
ঝরনার
কাছ
অবধি।
সেখান
দিয়েও
আসছে
আরও
হরিণের
পাল।
দেখে
মনে
হবে, যেন
ব্রিগেডের
কোনো
জনসভাতে
লোক
চলেছে
দলে
দলে।
হরিণের
পালের
আসা
শেষ
না
হতেই
চলে
এল
এক
পাল
বাইসন
ঝরনা
আর
নদীর
মিলন
স্থলে।
নদীর
অন্য
পারে
আওয়াজ
করতে
করতে
আসছে
হাতির
একটা
বড়োসড়ো
যৌথ
পরিবার।
নিশাচর
পাখিরাও
নামছে
এক
এক
করে
নদীর
দুটো
ধরে
ঠিক
যে
গাছগুলোতে
জোনাকির
আলোগুলো
জ্বলছে।
এই জ্যোৎস্না-ধোয়া
রাতে, ঝরনার
ধারে
আর
নদীর
দুই পাড়ে, সবরকমের
বন্যপ্রাণী
আর
নিশাচর
পাখিদের
যেন
মেলা
বসেছে।
তাদের
চেঁচামেচি
এত
দূরেও
স্পষ্ট
শোনা
যাচ্ছে।
গাছের
মগডালে
হ্যামকের
দুলুনিতে
কখন
যে
বেশ
আচ্ছন্ন
হয়ে
পড়েছি
জানতেও
পারলাম
না।
শেয়ালের দলের
হুক্কাহুয়া
আওয়াজে
ঘুমের
চটকা
কেটে
গেল।
মনে
হল
নিশ্চয়
মাঝরাত
হবে।
নাইট
ভিশনে
দেখলাম
সেই
মেলা
এখনো
চলছে।
হঠাৎ
শুনতে
পেলাম
জোড়া
ঝরনা
তার
জল
ফেলবার
তাল
বদলে
ফেলেছে।
অন্য
তালের
আওয়াজ, ঠিক
যেন
বিপদ
সংকেতের
মতো।
মনে
হল
সে
যেন
সতর্ক
করে
দিয়ে
বলছে, “আসছে, সে
আসছে।” বাঁদররা
সমানে
চিৎকার
করে
যাচ্ছে
মাঝে
মাঝে।
হঠাৎ
একটা
দলছুট
হরিণ, কর্কশ
অদ্ভুত
আওয়াজে, কিছুটা
কুকুরের
আওয়াজের
মতো, ডেকে
উঠল, পর
পর তিন-চারবার।
এই
ডাক
শোনামাত্র
একটা
হুড়ো-হুড়ি
পড়ে
গেল
পশুদের
সেই
মেলায়, ঠিক
যেন
শোলে
সিনেমায়
গব্বর
নিজে
হামলা
করেছে
আর
গ্রামবাসীরা
পালাচ্ছে।
পশুরা দিগ্বিদিক
জ্ঞানশূন্য
হয়ে
পালাতে
লাগল।
তাদের
কেউ কেউ তো
আমাদের
ক্যাম্পের
একদম
নিচে
এসে
চেঁচামেচি
শুরু
করল। ঠিক এই সময়, আমি
নাইট
ভিশনে
শুধু
একজোড়া
জ্বলন্ত
চোখ
দেখতে
পেলাম।
এরপর
আবছা
হলেও
বোঝা
গেল
এটা
একটা
বাঘ
আর
সেটা
একদম
আমাদের
ক্যাম্পের
কাছে।
নালা পার হবার
জন্য, ক্যাম্পের
কাছে, একটা
লোহার
দড়ির
সেতু
আছে। রাতের ঠান্ডা
জলে, জোরালো
স্রোত পার
হয়ে
আসার
কষ্ট
আর
জলের
ওপর
নিজের
পায়ের
আওয়াজ
বাঁচানোর
জন্য, চতুর
বাঘটা
ওই
লোহার
দড়ির
সেতু
দিয়ে
চুপিসাড়ে
পার
হয়েছে।
নাইট ভিশনে এইবারে
পরিষ্কার
দেখা
গেল, একটা
পূর্ণবয়স্ক
বাঘ
লোহার
সেতু
থেকে
নেমে
ঝরনার
দিকে
গুটি
গুটি
পায়ে
এগিয়ে
যাচ্ছে।
চোখের
পলক
ফেলবার
আগেই, একটা
চাপা
হুঙ্কার
আর
তারপর
ঝটাপটির
শব্দ
শোনা
গেল।
সেই
সঙ্গে, একটা
বুক-চেরা
আর্তনাদ
একবার
হয়েই
স্তব্ধ
হয়ে
গেল।
এই হঠাৎ
স্তব্ধ
হয়ে
আসা
আওয়াজটা, কোনো
অসতর্ক
দলছুট
মৃগশিশুর
শিকার
হয়ে
যাবার
পর
তার
মায়ের
বুকফাটা
আর্তনাদ।
সে
আর্তনাদ, বিলাপ
হয়ে
ছড়িয়ে
পড়ল
প্রথমে
বাঁদরদের
গলায়
তার
পর
সেখানে
উপস্থিত
বনের
বাকি
পশুদের
মাঝে।
জঙ্গলের হাওয়া
কিছুক্ষণ
শোকার্ত
হয়ে
স্তব্ধ
ছিল।
তারপর
সে
কেঁদে
উঠল, হু-হু-হু
করে। কোথা থেকে
উড়ে
এল
এক
বেশ
বড়োসড়ো
কালো
মেঘ, আর
এসেই
সে
পূর্ণিমার
চাঁদকে
গিলে
খেল
বাঘটার
মতো।
দমকা
হাওয়া
এবার
মাত্রা
বাড়িয়ে
ঝড়ের
রূপ
নিল। ওয়াকিটকিতে পাণ্ডেজি
সতর্ক
করে
দেবার
আগেই
আমি
টেন্টের
ভেতরে
চলে
এসেছিলাম।
সেই রাতে, একটু
পরেই, বেহালাতে
বেহাগ
রাগ
শুনতে
শুনতে
ঘুমিয়ে
পড়েছিলাম।
বেহালাতে
বন্দিশের
শিল্পিরা
ছিলেন
জোড়া
ঝরনা
আর
সঙ্গে
সঙ্গত
তাঁবুর
ওপরে
পড়া
বৃষ্টির
টাপুর
টুপুর।
ক্যাম্প থেকে
বেরোলেই
পাহাড়ি
নদীর
প্রথম
বাঁক, তার
ঠিক
উলটো
দিকে
লোহা-পাহাড়ের
প্রথম
চুড়ো।
এইভাবে
পাহাড়ি
নদীর
পর পর
ছয়টি
বাঁক
আর
সেই
সঙ্গে
লোহা-পাহাড়ের
ছয়টি
শৃঙ্গ।
এইভাবে
পান্ডেজি
আমাকে
কয়েকদিনের
মধ্যে
হিলটপ
আর
তার
পাহাড়তলির
অরণ্যের
প্রধান
প্রধান
জায়গাগুলো
চিনিয়ে
দিয়েছিলেন। আর
এই
চেনা
পরিচয়
করতে
গিয়ে
পুরো
আরণ্যক
প্রকৃতি
আমাকে
তার
মায়াজালে
বেঁধে
ফেললে।
প্রথম দিনে
আগের
রাতের
বেদনাভরা
স্মৃতি
মনের
মধ্যে
ঘোরাফেরা
করছিল।
আমার
মনের
অবস্থাটা
আন্দাজ
করে
পাণ্ডেজি
বললেন, “অরণ্যের
বন্য
প্রাণীদের
সবাই
নৃশংস
আর
সুযোগসন্ধানী
হয়
না।
তাদের
সঙ্গে
দোস্তি
রাখলে
অনেক
বিপদ
থেকেই
উদ্ধার
পাওয়া
যায়।” সেটা
যে
শুধু
কথার কথা
নয়
তা
বুঝতে
আমার
কিছুদিন
সময়
লেগেছিল।
দু’বছর ধরে সেই খাদের
ধারেই
আমার
তাঁবু
লাগানো
ছিল।
মাঝ
রাত
নয়, সন্ধে
হলেই
গাছে
গাছে
জোনাকিদের
আলোর
খেলা
দিয়ে
শুরু
হয়
দারুণ
একটা “লাইট
অ্যান্ড
সাউন্ড
শো”। সারা রাত ধরেই
জঙ্গলের
সব
অধিবাসীদের
শোরগোল
চলতেই
থাকে।
যে দিন জঙ্গলের
রাজা-রানির
আগমন
হয়, অনেক
আগে
থেকেই
জঙ্গলের
অধিবাসীদের
হাঁকডাক
শুরু
হয়ে
যায়।
তবে
রাজকীয়
আদব-কায়দাতেই
চলেন
তাঁরা, দু-তিন
বারের
বেশি
একসঙ্গে
তাঁদের
গুরুগম্ভীর
আওয়াজ
শোনা
যায়
না।
লৌহপাথর আর টাঙস্টেনের
অনুসন্ধানে
টানা
দশ বছর
গভীর
জঙ্গলেই
কাটিয়েছি।
সেই
কাজের
দরুন
বাঘ, পাইথন, ভল্লুক
এই
সব
হাড়হিম
করে
দেওয়া
জন্তুজানোয়ারদের
সামনা-সামনি
পড়েছিও
বেশ
কয়েকবার,
কিন্তু
ভয়
আর
পাইনি।
জঙ্গলের একটা
বহুলপ্রচলিত
মুখে
মুখে
ফেরা
কথা, এই
সব
বিপদে
বার বার
পরখ
করে
নিয়েছি, ‘প্রাণঘাতী
ভয়ঙ্কর
বিপদ
যখন
তোমার
চোখের
সামনে
আসবে
তখন
তুমি
ভয়
পেতে
ভুলে
যাবে।’
ভয় আর লাগে
না, প্রথমবার
বাঘের
কাছাকছি
এসে
সে
যে
কোথায়
নিরুদিষ্ট
হল
কে
জানে?
----------
ছবি – অতনু দেব
ম্যাজিক ল্যাম্প
No comments:
Post a Comment