সত্যদৃষ্টি
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
‘স্বপ্নপুরী, স্বপ্নপুরী...’
একটু থমকে দাঁড়াল টুবলু। মা
বার বার করে বলে দিয়েছিল, ‘বাস
থেকে নেমে দেখবি স্ট্যান্ডের পাশেই গরুর
গাড়ি পাওয়া যায়। বলবি স্বপনপুর যাব।’ গরুর গাড়ি তো একটাই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে তো...
‘দাদা, স্বপনপুর যাওয়ার গাড়ি
কোথায় পাব?’ দাদাই বলল টুবলু, ছেলেটার বয়স কুড়ির বেশি নয়।
‘কেন এই যে এতক্ষণ ধরে বলছি
শুনতে পাচ্ছ না?’
‘তুমি তো স্বপ্নপুরী বলছ, সে
আবার কোথায়?’
‘আরে ঐ একই হল, স্বপনপুর আর স্বপ্নপুরী
কি আলাদা নাকি? নাও উঠে পড়ো, তোমার জন্য কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি।’
‘আমার জন্য মানে? তুমি জানতে
আমি আসব?’
‘তোমার জন্য নয় তো কী? বাস
থেকে আর কে নেমেছে?’
সেটা অবশ্য ঠিক, বাসটা থেকে
টুবলু ছাড়া কেউ নামেনি। আশেপাশেও অন্য কেউ নেই। মাসি জানে টুবলু আজ আসবে, বলেছিল লোক পাঠানোর চেষ্টা
করবে। ‘তোমাকে কি
মাসি পাঠিয়েছে?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ঘুমপাড়ানি মাসিপিসি
সবাই মিলে তোমার জন্য
পাঠিয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে অত কথা বললে বেলা গড়িয়ে যাবে। উঠে পড় আমার রথে।
দূরের রাস্তা, সময় লাগবে অনেক। সব প্রশ্নের উত্তর পরে পেয়ে যাবে।’
টুবলু হেসে ফেলে। দাদাটা মজা
করতে পারে বটে। ভাঙাচোরা লজঝরে এই গরুর গাড়ি, এ নাকি রথ! যা হোক, এখানে তো আর অন্য
কোনো গাড়ি নেই।
স্বপনপুর যেতে হলে এই ভরসা। উঠে বসল টুবলু। সঙ্গে জিনিস
বলতে পিঠের একটা ব্যাগ। গরুগুলো এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জাবর কাটছিল, সারথি মুখে
একটা আওয়াজ করতেই গাড়ি টানতে শুরু করল। মা একটা মোবাইল ফোন দিয়েছিল। সেটা বার করল
টুবলু। মাকে খবর দিতে হবে।
‘আমাদের দেশে ও যন্ত্র চলবে
না গো।’
সত্যিই সিগন্যাল নেই। মা
অবশ্য বলেছিল যে রাস্তায় অনেক জায়গায় এমন হবে।
‘তোমার বাড়ি কি স্বপনপুর?’
‘হ্যাঁ গো, আমি স্বপ্নেই
থাকি। কখনও কখনও তোমার মতো কাউকে কাউকে সেই দেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসি।’
সোজা কথার সোজা উত্তর দেয় না
কেন? ছেলেটা নিজের নাম বলল সারথি। সেই জন্যেই বোধহয় ও গরুর গাড়ির নাম দিয়েছে রথ।
বাসের রাস্তা ধরে একটু এগিয়েই ডানদিকে বনের
পথ ধরল।
এই প্রথম টুবলু একা একা কোথাও
বেরিয়েছে। টুবলুর ছোটোমাসি থাকে স্বপনপুরে। মেসোর হঠাৎ করে খুব শরীর খারাপ হয়ে
পড়েছে। মাসি ফোন করেছিল মাকে, কলকাতা থেকে একটা ওষুধ পৌঁছে দিতে হবে। স্বপনপুর
জঙ্গলের মধ্যে ছোট্ট গ্রাম, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে না। মাসিও মেসোকে ছেড়ে আসতে পারছে
না।
‘কিন্তু আমার এদিকেও তো
সমস্যা। খুকুটার জ্বর, তাকে ছেড়ে যাই কেমন করে,’ মা চিন্তিত মুখে ফোনে মাসিকে বলে।
টুবলুর বাবাকে কাজের সূত্রে
ঘুরে বেড়াতে হয়। এখন গেছে মধ্যপ্রদেশ, এক সপ্তাহ পরে ফিরবে।
‘আমি যাব মা? ওষুধটা দিয়ে
আসব।’
‘তুই? তুই কি চিনে চিনে যেতে
পারবি নাকি? তোর তো কোনও খেয়ালই থাকে না। কোথায় বলতে কোথায় নেমে যাবি।’
সে কথা অবশ্য ঠিক। টুবলু সারাক্ষণই
আনমনা, যেন এক অন্য জগতে বাস করে। সেখানে আকাশে কালো মেঘের আড়াল থেকে রাক্ষসেরা
উঁকি দেয়, রাত্তিরবেলা ঘুমের পরি জোনাকির আলো নিয়ে খুঁজতে বেরোয় কে কে জেগে আছে,
চাঁদের বুড়ি রাতের আকাশের তারা ধরে ধরে চাঁদকে থালার মতো বড়ো করে।
কিন্তু উপায় ছিল না। ওষুধটা
নিয়ে যাওয়া খুব দরকার। বাবাও ফোনে শুনে এক কথায় রাজি হয়ে গেল। তাছাড়া টুবলুর বাবা-মা
কেউই ছেলে-মেয়েকে সারাক্ষণ আগলে রাখা পছন্দ করে না। টুবলু ক্লাস এইটে উঠেছে, আর
ছোটো নয়।
সারথি গুনগুন করে গান গাইছিল।
ছোটোবেলার ঘুমপাড়ানি গানের মতো ভারি মিষ্টি
সুর। সেই
কোন সকালে উঠেছে, টুবলুর চোখ জুড়ে এল। বসে
বসেই ঢুলতে শুরু করল।
‘ওঠো, ওঠো। আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছি।’
চোখ খুলল টুবলু। প্রথমেই চোখ
পড়ল সামনে গরুগুলোর দিকে।
গরু
কোথায়? এ তো দুটো সাদা ধবধবে ঘোড়া! তারা খুর দিয়ে মাটি ঠুকছে, যেন দৌড়ানোর জন্য
তৈরি। টুবলু ভালো করে চোখ কচলে তাকাল। কখন যেন তাকে গরুর গাড়ি থেকে একটা
সত্যিকারের রথে তুলে নিয়েছে সারথি। ঠিক যেমন রথ ও ছবিতে দেখেছে। সারথিরও পোশাক পালটে
গেছে। আগে ছিল একটা হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, আর গায়ে একটা গেঞ্জি। এখন পরে আছে
চোগা-চাপকান, সূর্যের আলোতে ঝকমক করছে। বিস্ময়ে কথা সরে না টুবলুর।
‘বিলম্ব
নয়, রথ থেকে অবতরণ করো,’ সারথি তাড়া লাগায়।
‘এ
কী করে হল? কোথায় এলাম আমি?’
‘তোমাকে
তো বলেছিলাম স্বপ্নপুরীই আমাদের অভীষ্ট। এর মধ্যে বিস্মৃত হলে?’
স্বপ্নপুরী?
নাকি স্বপনপুর? মাথা তোলে টুবলু। সামনে একটা বিশাল প্রাসাদ। মাসি কিছুতেই এই রকম
বাড়িতে থাকে না। তাছাড়া স্বপনপুর তো গণ্ডগ্রাম, সেখানে এই রকম রাজপ্রাসাদ আসবে
কোথা থেকে?
‘আমি
কী স্বপ্ন দেখছি নাকি? তোমার গরুগুলো কোথায় গেল? ঘোড়া এল কোথা থেকে?’ টুবলু নিজেই বুঝতে
পারছে ওর কথাগুলো বোকা বোকা শোনাচ্ছে।
‘উত্তম
রূপে অবলোকন করো, আমাকে বলো কী দেখলে,’ সারথি হাসতে হাসতে বলল বটে, কিন্তু যেন
একটু চাপা উত্তেজনা তার গলায়।
টুবলু
ভালো করে তাকায়। ছটফটে ঘোড়াগুলো আছে, কিন্তু ভালো করে দেখলে যেন শান্তভাবে
জাবরকাটা গরুগুলোকেও মুহূর্তের জন্য দেখতে পেল টুবলু। গরুর গাড়িটাও যেন রথের সঙ্গে
মিশে আছে। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে পুরানো গরুর গাড়িটাই ফিরে এল। কিন্তু একটু
অন্যমনস্ক হতেই আবার সেই রথ!
‘কী
দেখতে পাচ্ছ?’ সারথি তাড়া লাগায়।
সারথির
দিকে তাকাল টুবলু। কিছুই বুঝতে পারছে না, তবু বলল কী দেখছে। সারথি একটা দীর্ঘনিশ্বাস
ফেলল, যেন একটা ভার তার উপর থেকে নেমে গেল। বলল, ‘চলো, রানিমা তোমার জন্য অপেক্ষা
করছেন।’
বিশাল
প্রাসাদ। টুবলু অনেক সময় কল্পনা করত রূপকথার রাজপ্রাসাদের, তার
সঙ্গে কী মিল! কিন্তু জনশূন্য। দু’জনের পায়ের আওয়াজ ছাড়া একটুও শব্দ নেই। টুবলু
খেয়াল করে সারথির পায়ে শুঁড়তোলা নাগরা, তার মতোই শব্দ করছে ওর নিজের জুতো। তাকাল
নিজের পায়ের দিকে, অবাক হয়ে দেখল ওর জুতোও একই রকম। এতক্ষণে
নিজের গায়ের দিকে চোখ পড়ল, ওর জামাও পালটে গেছে। সারথির মতো পোশাক পড়ে আছে। একটু ভালো
করে দেখলে যেন ফেডেড জিন্স আর টি শার্টটাও মুহূর্তের জন্য এসেই মিলিয়ে যাচ্ছে।
অবাক
হতেও ভুলে গেছে টুবলু। নাকি এটাই স্বাভাবিক? ওর মনে হচ্ছে এই প্রাসাদের ভিতর দিয়ে
হেঁটে রানির সঙ্গে দেখা করার জন্যই ও সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল।
প্রায়
চার মানুষ উঁচু এক দরজার সামনে দাঁড়াল সারথি। দরজায় জোরে টোকা দিল।
ভিতর
থেকে নারীকণ্ঠ ভেসে এল, ‘এসো সারথি।’
দরজা
ঠেলতেই নিঃশব্দে খুলে গেল। বিশাল দরবার ঘর। উপর থেকে ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে, দু’পাশে সারি
সারি আসন। কিন্তু জনপ্রাণী চোখে পড়ছে না। ঘরের একেবারে প্রান্তে একটা মঞ্চ,
মেঝে থেকে অনেকটা উঁচুতে ধাপে ধাপে উঠে গেছে। তার উপরে সিংহাসনে এক মূর্তি,
অবগুণ্ঠিতা নারী।
সারথি
সোজা সিংহাসনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘প্রণাম রানিমা।’
এতক্ষণ
টুবলু যাকে মূর্তি ভাবছিল, তার দেহে সামান্য সাড়া দেখা দিল। ‘সফল হয়েছ সারথি?’
‘হ্যাঁ
রানিমা। এই সত্যকল্প।’ সত্যকল্প হল টুবলুর ভালো নাম। কিন্তু সারথি সেটা জানল কী
করে?
রানি
বললেন, ‘নিকটে এসো সত্যকল্প।’
একটা
ঘোরের মধ্যে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল টুবলু। রানির মুখ ঘোমটাতে ঢাকা, তবু টুবলুর মনে হল
যেন এক তীক্ষ্ণদৃষ্টি তাকে জরিপ করে নিল। ভারি মিষ্টি একটা গন্ধ পেল টুবলু, জুঁইফুলের গন্ধ।
‘এ
তো একেবারেই শিশু!’ হতাশ গলায় বললেন রানি। ‘একে অনুরোধ করাও অন্যায় হবে। তুমি নিশ্চয় ভুল করেছ সারথি।’
‘না,
রানিমা। আপনি জানেন গত এক পক্ষকাল নানা জায়গায় বৃথা অন্বেষণ করেছি। কিন্তু আজ সকাল
থেকে আমাকে কেউ যেন স্বপ্নপুরীর নৈর্ঋত কোণের দিকে আকর্ষণ করছিল। দেখা মাত্র আমি
বুঝতে পেরেছি, এই আমাদের অন্বিষ্ট সত্যকল্প। সাধারণ কেউ এই স্বপ্নপুরীতে প্রবেশ করতে পারত না, স্বপ্নপুরীর
কুহকের আবরণ ছিন্ন করতেও পারত না। সত্যকল্পকেই প্রশ্ন করুন।’ সারথির শুধু কথাতে নয়,
গলার স্বরেও একটা পরিবর্তন এসেছে।
‘সত্যকল্প,
সারথির দিকে তাকাও। কী পরিধান দেখছ?’
ঘোরের
মধ্যে সারথির দিকে তাকাল টুবলু। বলল, ‘একই সঙ্গে যেন দুই রকম পোশাক পরে আছে সারথিদা। রাজার মতো
ঝলমলে পোশাক, আবার খাটো ধুতি। কেমন করে হয়?’
সারথি
হেসে বলল, ‘এই যদি রাজপোশাক হয়, তাহলে রাজাকে যখন দেখবে তখন কী বলবে সত্যকল্প? রানিমা,
ও একই সঙ্গে দুই জগতকে দেখতে পাচ্ছে, ও সফল হবেই।’
রানিমা
ঘোমটা খুললেন। অপরূপা সুন্দরী। টুবলুর মনে হলে, এঁকে
দেখলেই মা বলে ডাকতে ইচ্ছা করে।
রানি
বললেন, ‘রাজাকে কি আর দেখার সুযোগ হবে ওর? শোনো সত্যকল্প, এই রাজপুরীতে তুমি কোনও মানুষকে
দেখতে পাচ্ছ না। স্বপ্নপুরী নগরীতেও আমাদের দুইজন ব্যতীত কাউকে খুঁজে পাবে না। এক দুষ্ট
ঐন্দ্রজালিকের অভিশাপ লেগেছে এই নগরীর উপর। দুই মাস পূর্বেও যদি তুমি আসতে, দেখতে
পেতে কোলাহলমুখর চিরচঞ্চল এক নগরীকে। কিন্তু ...’
এক
মুহূর্তের জন্য বিষাদের ছায়া ঘনিয়ে এল রানির মুখে। আবার শুরু করলেন, ‘দুই মাস
পূর্বে ভিন্ন দেশ থেকে এক মায়াবী ঐন্দ্রজালিক এল স্বপ্নপুরীতে। সে রাজার নিকট দশ
লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দাবি করেছিল। রাজা তাকে বলেন, রাজকোশে গচ্ছিত অর্থ প্রজাদের
সম্পত্তি। তাছাড়া রাজকোশে দশ লক্ষ দূরে থাক, দশ সহস্র স্বর্ণমুদ্রাও নাই।
ঐন্দ্রজালিক তখন এক মধ্যরাত্রে আমাদের নগরীকে অভিশাপ দেয়। এক মুহূর্তে স্বপ্নপুরীর
সমস্ত মানুষ নিদ্রাভিভূত হয়ে পড়ে। একমাত্র আমিই জাগরূক আছি, কিন্তু কারও
নিদ্রাভঙ্গ আমারও সাধ্যাতীত। ঐন্দ্রজালিক এখন আমাকে রাজকোশ শূন্য করে সমস্ত অর্থ
ওর হাতে তুলে দিতে বলছে। প্রজা ও রাজার মঙ্গলের জন্য আমি তাতে সম্মত, কিন্তু দশ
লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা আমি কোথায় পাব? আমি ঐন্দ্রজালিককে সেই কথা বলেছি, কিন্তু সে
আমাকে অবিশ্বাস করছে। তার ধারণা আমি অর্থ অন্যত্র লুক্কায়িত রেখেছি।’
‘কিন্তু
সারথিদা? তার তো কিছু হয়নি।’
‘ঐন্দ্রজালিকের
অভিশাপের সময় সারথি স্বপ্নপুরীতে অবস্থান করছিল না। তাই অভিশাপ ওকে স্পর্শ করেনি।
ও পরদিন প্রত্যাবর্তন করে।’
টুবলুর
মনে হল ও যেন গুপি গাইন বাঘা বাইন সিনেমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ‘আমাকে এখানে এনেছেন
কেন? আমি কি জাদুকরকে হারাতে পারব? আমার কি ম্যাজিক করার ক্ষমতা আছে?’
‘জাদুবিদ্যা
এই স্বপ্নপুরীর রক্তস্রোতের মধ্যে মিশে রয়েছে, কুহক ব্যতীত আমাদের কারও অস্তিত্বও
থাকবে না। ঐন্দ্রজালিক সেই কুহককেই ব্যবহার করেছে, আমার অথবা সারথির পক্ষে তার মায়াজাল
ছিন্ন করা অসম্ভব। যে একই সঙ্গে দুই জগতে অবস্থান করতে সক্ষম, একমাত্র সে-ই
ঐন্দ্রজালিককে পরাস্ত করতে পারে। আমাদের নগরীতে একটি প্রাচীন কথা প্রচলিত আছে,
সত্যকল্প নামের এক ব্যক্তি একই সঙ্গে দুই জগতে অবস্থান করতে পারে, নগরীর ঘোর বিপদে
সে উদ্ধারকর্তা হয়ে দেখা দেবে। কিন্তু তুমি কি ঐন্দ্রজালিককে পরাজিত করতে পারবে?’ রানিমার
গলায় একই সঙ্গে আশা ও সন্দেহ।
‘কিন্তু
সারথিদা তো স্বপ্নপুরী থেকে বেরোতে পারে, আমাকে বাসস্ট্যান্ড থেকে নিয়ে এল,’ টুবলু
বলে।
‘সারথি
স্বপ্নপুরীর অধিবাসীদের মধ্যে ব্যতিক্রম, ও তার সীমার বাইরে যেতে পারে। আমি সারথির
প্রতি কৃতজ্ঞ, ও ইচ্ছা করলেই স্বপ্নপুরী ত্যাগ করতে পারে, তৎসত্ত্বেও ও আমাকে পরিত্যাগ
করেনি। কিন্তু তোমার মতো একই সঙ্গে দুই জগতে অবস্থান ওরও সাধ্যাতীত। শৈশব থেকে
শুনে এসেছি একই সঙ্গে যে দুই পৃথিবীতে অবস্থান করতে পারে, সে যে কোনও
ঐন্দ্রজালিকের মায়াজাল ছিন্ন করতে পারে। কিন্তু এতদিন সেরূপ কোনও মনুষ্যের সঙ্গে
সাক্ষাৎ হয়নি।’
‘কিন্তু
আমাকে তো মেসোর জন্য ওষুধ নিয়ে যেতে হবে, তার শরীর খুব খারাপ। আমার ব্যাগটা কোথায়?
তার মধ্যে ওষুধটা ছিল।’
‘তোমার
পেটিকা রথেই সুরক্ষিত আছে, তুমি যখন ইচ্ছা নিয়ে নিও,’ সারথিদা বলল।
‘তোমার
বিলম্বের কোনও আশঙ্কা নেই,’ রানি বললেন, ‘তোমাদের জগতের তুলনায় এই স্বপ্নপুরীতে
সময় অতি ধীরগতিতে চলে। এখানে তুমি এক দিবস অবস্থান করলে ফিরে গিয়ে দেখবে এক ঘটিকাও
অতিবাহিত হয়নি। সত্যকল্প, একবার কি চেষ্টা করবে না? এতগুলি মনুষ্যের জীবন তোমার
উপর নির্ভর করছে। জানি তুমি নিতান্তই বালক, আমাদের অন্য উপায় থাকলে তোমাকে অনুরোধ
করতাম না।’
টুবলু
বুঝতে পারে না ও কী উত্তর দেবে। শেষ পর্যন্ত বলল, ‘আমি এখনই হ্যাঁ বলছি না, কিন্তু
রাজি হলে কী করতে হবে?’
‘ওই
ঐন্দ্রজালিকের ক্ষমতার উৎস কাচের আধারে রক্ষিত একটি জাদুদণ্ড। আধারটিকে চূর্ণ
করে দণ্ডটি দ্বিখণ্ডিত করতে পারলে তার সমস্ত মায়া তাকে পরিত্যাগ করবে। তখন আবার
আমাদের নগরী পুনরায় জাগ্রত হবে। কিন্তু সেই আধার ঐন্দ্রজালিকের বাসভবনে অতি
সুরক্ষিত আছে। ভবন পাহারা দেয় হিংস্র শ্বাপদকুল। অদ্যাবধি তাদের
কেউ অতিক্রম করতে সক্ষম হয় নাই। অভিশাপের পূর্বে স্বপ্নপুরীর কতিপয় বীর যুবক সেই
চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শার্দূলের আক্রমণে তারা পলায়নে বাধ্য হয়। তার পরে নিশ্চয় আরও
বিপদ অপেক্ষমান। শুধু তাই নয়, ঐ পামর ঐন্দ্রজালিকও প্রায় সর্বদাই নিজ বাসভবনে
অবস্থান করে।’
‘তাহলে
আমি কেমন করে করব?’
‘সত্যকল্প,
তোমার প্রশ্নের উত্তর আমার অজ্ঞাত, তোমাকেই তা সন্ধান করতে হবে। পূর্বেই বলেছি, আমাদের বহু প্রাচীন শ্রুতি যে সত্যকল্প একই সঙ্গে দুই
জগতে অবস্থান করতে পারে, কোনও কুহকই তার নিকট বাধা হতে পারে না। সত্যকল্প, একবার প্রয়াসও কি করবে না?’
টুবলু চোখ
তুলে রানির দিকে তাকাল। দেখল তাঁর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। ঠিক যেন ওর নিজের মা কাঁদছে। সেই
মুহূর্তে টুবলু মেসোমশায়ের অসুখ, বাড়ি ফেরার চিন্তা, জাদুকরের থেকে বিপদ, সব ভুলে
গেল। বলল, ‘সারথিদা, চলো জায়গাটা দেখাবে।’
‘তুমি
সত্য সত্য যাবে?’ সারথির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘দেখি
চেষ্টা করে,’ টুবলুর সংক্ষিপ্ত উত্তর।
রানি সিংহাসন থেকে নামার
উপক্রম করলেন, ‘আমিও যাব।’
সারথি ও
টুবলু একসঙ্গে না না করে উঠল। সারথি বলল, ‘ঐ ঐন্দ্রজালিক আপনার ক্ষতি করতে পারে রানিমা।’
‘অতিরিক্ত আর কোন ক্ষতি
করবে? আমার প্রজাগণ কালনিদ্রার গ্রাসে, আমার স্বামী মৃত্যুপথযাত্রী। অভিশাপের গ্রাসই
আমার নিকট শ্রেয়তর ছিল। না সারথি, তোমরা আমাকে নিষেধ কোরো না। তুমি ভাবলে কী করে যে এক নিতান্ত বালককে বিপদের গ্রাসে পাঠিয়ে
আমি নিশ্চেষ্ট বসে থাকব?’ রানিমা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
সারথি
বলল, ‘রানিমা, আমাদের
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। রাত্রি আগতপ্রায়, ভাগ্য সহায় হলে ঐন্দ্রজালিক নিদ্রাভিভূত হবে। সেই ক্ষণই গোপন অভিযানের শ্রেষ্ঠ সময়।’
রানি
সিংহাসন থেকে নেমে এলেন, এক সাধারণ আসনে গিয়ে
বসলেন। টুবলুকে ডেকে পাশে বসালেন। তারপর জিজ্ঞাসা করে করে টুবলুর কাছ থেকে ওর রোজকার জীবনের নানারকম
গল্প শুনলেন। স্কুলের গল্প, ফুটবল খেলার গল্প, পুরীর
সমুদ্র দেখার গল্প। ইতিমধ্যে সারথি একবার উঠে
কয়েকটা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিল। আর একবার তিন থালা ফল নিয়ে
এসেছিল, টুবলু জীবনে কখনও এত সুস্বাদু ফল খায়নি।
বাইরের
আলো মিলিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে রানি উঠে দাঁড়ালেন। একটা প্রদীপ হাতে নিয়ে বললেন, ‘একবার শুধু রাজাকে দেখে আসি। তোমরা ইচ্ছা করলে আমার অনুবর্তন
করতে পার।’ টুবলু ও সারথি তাঁর সঙ্গী হল। দরবার ঘরের থেকে বেরিয়ে রানি যেদিকে গেলেন, টুবলু বুঝল সেটা অন্তঃপুর। আগে খেয়াল করেনি, এখন দেখল দু-এক জায়গায় আসনে বসে কয়েকজন ঘুমোচ্ছে,
মনে হয় তারা রাজপুরীর কর্মচারী। রানি পর্দা সরিয়ে একটা ঘরে ঢুকলেন। টুবলু ও সারথি দরজায় দাঁড়াল।
বোঝাই
যাচ্ছে শোয়ার ঘর, তার প্রধান আসবাব হল
একটা বিশাল খাট। তার উপরে ঘুমোচ্ছেন একজন
মানুষ। রাজা বলতে টুবলু যেমন ভাবতে
অভ্যস্ত, তেমন নয়। নেহাতই মামুলি দেখতে একজন, সাধারণ পোশাক পরে শুয়ে আছেন। অবশ্য জাদুকরের অভিশাপ লেগেছিল
মাঝরাতে, ঘুমানোর সময় রাজারানিরাও নিশ্চয় জমকালো
রাজপোশাক পরেন না। গায়ের রঙ অতিরিক্ত ফ্যাকাসে – বোঝা যাচ্ছে গুরুতর কোনও অসুস্থতা বা দুর্বলতা
আছে।
রানি
কাছে গিয়ে অপলক দৃষ্টিতে রাজার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলেন। টুবলু দেখল আবার তাঁর চোখের কোণে জল টলটল করছে। তারপর হাত বাড়িয়ে রাজার হাত স্পর্শ করলেন। সারথি টুবলুর হাত ধরে টেনে সরিয়ে আনল।
একটু
পরেই রানি বেরিয়ে এলেন। প্রদীপ
দরজার ধারে একটা কুলুঙ্গিতে রেখে বললেন, ‘আমি প্রস্তুত।’
‘তলোয়ার নেব না? বা তীর ধনুক?’ টুবলু
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে?
সারথি
হেসে ফেলে, বলে, ‘অশিক্ষিতের
হাতের অস্ত্র স্বপক্ষের নিকট অধিক ভয়ঙ্কর।’
রানি
বললেন, ‘সাধারণ অস্ত্র ঐন্দ্রজালিকের কোনও ক্ষতি
করতে পারবে না। তার একমাত্র দুর্বলতা ঐ জাদুদণ্ড।’
কোথাও
প্রদীপ জ্বলছে না। আকাশে পূর্ণিমা চাঁদ আলোর
বান ডাকিয়েছে। অথচ তারারা মিলিয়ে যায়নি, তারাও যেন প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছে। আজ পূর্ণিমা কেমন করে, এই তো কদিন আগে অমাবস্যা ছিল? সারথিকে সেই কথা জিজ্ঞাসা
করল টুবলু। সারথি উত্তর দিল, ‘আমাদের দুটি তিথি, পূর্ণিমা
ও অমাবস্যা। সময় এখানে তোমাদের জগতের
মতো চলে না।’
সারথি
সামনে, রাস্তাটা তারই চেনা। এত নিস্তব্ধতার মুখোমুখি টুবলু কখনও হয়নি। রানিমা টুবলুর পাশেই হেঁটে চলেছেন। অন্ধকার হতে পারে ভেবে টুবলু হাতে একটা লাঠি নিয়েছিল। তার দরকার হচ্ছিল না, তবু টুবলু সেটা হাতেই রেখেছে। আসলে তাকে একটু সাহসও দিচ্ছে সেটা।
শহরের
বাইরে একটা পাঁচিল, সারথি তার সামনে গিয়ে
দাঁড়াল। চাপা গলায় বলল, ‘এই প্রাচীরের পশ্চাতে ঐন্দ্রজালিকের আবাস। কিন্তু অতি সাবধান, হিংস্র শ্বাপদকুল প্রহরারত।’
কাছেই
একটা উঁচু গাছ ছিল, নিঃশব্দে সেটা বেয়ে
উঠে গেল সারথি, তারপর একটা ডাল বেয়ে এসে পাঁচিলের উপর নেমে পড়ল। দু’পাশে পা ঝুলিয়ে বসল। টুবলু লাঠিটা বাড়িয়ে দিল, সারথি সেটা ধরে নিল, তারপর নিচের দিকে হাত বাড়াল। প্রথমে টুবলু উঠল হাত ধরে, তার পরে রানি। তারপর তিনজনেই পাঁচিলের উলটো
দিকে লাফিয়ে নামলেন।
খুব চুপিসারে
সামনের দিকে রওনা হলেন তিনজনে। জায়গায় জায়গায় শুকনো পাতা
পড়ে আছে, তাই সাবধানে পা ফেলা। টুবলু ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, কোন হিংস্র জন্তু ছাড়া আছে কে জানে?
দূরে এক জায়গায় অন্ধকার যেন দলা পাকিয়ে আছে, টুবলুর
মনে হল ওটাই জাদুকরের বাড়ি।
হঠাৎ
একটু খড়মড় শব্দ, তিনজনেই দাঁড়িয়ে গেল
একসঙ্গে। ডানদিক থেকে আওয়াজটা আসছে, টুবলু তাকাল সেদিকে। একটা ঝোপের মতো রয়েছে, তার ভিতরে যেন দু’জোড়া চোখ, আগুনের
মতো জ্বলছে। আস্তে আস্তে চোখগুলো এগিয়ে
এল।
রানিমা
চাপা গলায় বললেন, ‘স্থির থাকো।’
চাইলেও
টুবলু নড়তে পারত না, পা দুটো জমে গেছে। হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠেছে গলার কাছে। চাঁদের আলোতে জন্তুগুলোর রঙ ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, তবু টুবলুর মনে হল যেন কালো চিতা। কিংবা বাঘিরা, জাঙ্গল বুকসের সেই ব্ল্যাক প্যান্থার।
সম্বল
একটা লাঠি, তা দিয়ে কি বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করা যায়?
রানিমার সাবধানবাণী ভুলে লাঠিটা শক্ত করে দু’হাতে
ধরতে গেল টুবলু, সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিল একটা বাঘ। সারথি টুবলুকে সরিয়ে দিতে গেল। বাঘের ধাক্কা বুকে না লেগে লাগল ওর কাঁধে। সামলাতে না পেরে পড়ে গেল টুবলু, লাঠিটা হাত থেকে ছিটকে পড়ল।
বাঘটা
মাত্র দু’ফুট দূরে, নিশ্চয়
এবার কামড়ে টুঁটি ছিঁড়ে নেবে। জীবনের আশা ছেড়ে দিল টুবলু, এমন সময় কে যেন হঠাৎ ওকে বলল, ‘ছিন্ন করো কুহকের জাল।’ কেমন করে? হঠাৎ মনে পড়ল
বিকেলের অভিজ্ঞতার কথা। ভালো করে বাঘটার দিকে তাকাল
টুবলু।
বাঘ কোথায়? এ তো একটা কালো বিড়াল। এ এতখানি লাফই বা দিল কেমন করে, আর তার ধাক্কায় টুবলুই বা পড়ে গেল কেন?
সে সব কথা পরে ভাবা যাবে, শুয়ে শুয়েই বিড়ালের দিকে
ফিরে এক লাথি। রোজ দু’ঘণ্টা ফুটবল পেটানোটা কাজে লেগে গেল,
ক্লাস এইটের সেন্টার ব্যাকের লাথিতে বিড়ালটা প্রায় দশ ফুট দূরে ছিটকে
পড়ল, তারপর ঝোপের আড়ালে গা ঢাকা দিল। হাত বাড়িয়ে লাঠিটা তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল টুবলু।
অন্য
জন্তুটা তখনও জায়গা থেকে নড়েনি। তার দিকে তাকাল টুবলু। দেখল সেটাও আসলে আর একটা বিড়াল। একবার নিশ্চিত হতেই সেটাকে আর বাঘ মনে হল না। লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে যেতেই সেও পালিয়ে গেল।
পিছন
ফিরে দেখল সারথি ও রানি তার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছে। সারথির প্রথম বাক্যস্ফূর্তি হল, ‘সত্যকল্প, তুমি কি ছদ্মবেশী
ভীম? ঐ হিংস্র ব্যাঘ্রকে পদাঘাতে দূরে নিক্ষেপ করলে?’
টুবলু
বলল, ‘ওগুলো বাঘ নয়, আসলে বিড়াল।’
রানি
জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মার্জার! কুহকের মায়া তবে মার্জারকে ব্যাঘ্রে রূপান্তরিত করেছিল। তুমি কীরূপে বুঝলে?’
টুবলু
ব্যাখ্যা করে বলে যে ভালো করে তাকাতেই ও দেখতে পায় সেগুলো বিড়াল, বাঘ নয়। নিজেকে জোর করে সেই কথা বিশ্বাস করানোর পরে তারা আর বাঘে পরিবর্তিত
হয়নি।
‘তোমার দৃষ্টিই তবে ইন্দ্রজাল ছিন্ন করে। অতি উত্তম। কিন্তু প্রশ্ন হল মায়াশার্দূলের
আক্রমণে কি মৃত্যু হতে পারে?’
তিনজনের
কারও কাছে এই প্রশ্নের উত্তর ছিল না। দাঁড়ানোরও সময় নেই, তাই আবার সামনের দিকে পা বাড়ালেন সকলে। টুবলু আশপাশের দিকে সাবধানে নজর রাখছিল, বিড়াল না হয়ে কুকুর হতে পারত। জাদু থাক বা না থাক, বড়ো কুকুরকে তো অত সহজে লাঠি দিয়ে তাড়ানো যাবে না। সামনে সারথি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। আর একটু হলে টুবলু তাকে ধাক্কা মারতে যাচ্ছিল, রানি পিছন থেকে ওকে টেনে ধরলেন।
সারথি
এক খাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তলা দেখা যাচ্ছে
না, টুবলু আন্দাজ করল চওড়াতে না হলেও একশো
ফুট হবে। রানি না ধরলে ওর ধাক্কায়
সারথি হয়তো খাদে পড়ে যেত।
টুবলু
পাথরের একটা বড়ো টুকরো নিয়ে খাদের মধ্যে ফেলে দিল। কত গভীর কে জানে - তলা থেকে কোনও শব্দ এল না। কোথাও ব্রিজের মতো কিছু দেখতে
পেল না। মনে হল খাদটা সামনের অন্ধকার
বাড়িটাকে ইতিহাস বইয়ের পাতার দুর্গের পরিখার মতো ঘিরে আছে।
রানি
বললেন, ‘তোমার সত্যদৃষ্টি উন্মোচন কর সত্যকল্প,
ছিন্ন কর কুহকের জাল।’
ঠিক, নিশ্চয় কোথাও সেতু আছে পরিখা পেরোনোর জন্য। জাদুবলে সেটাকে অদৃশ্য করে রাখা আছে। তিনজনে হেঁটে হেঁটে পরিখার পাশ দিয়ে ঘুরে এলেন, কিন্তু টুবলু কোথাও ব্রিজের মতো কিছু দেখতে
পেল না। হতাশ হয়ে সারথি বলল, ‘অতঃপর? কেমন করে এই গভীর
পরিখা অতিক্রম করব?’
টুবলুর
হঠাৎ কী মনে হল, এতক্ষণ সে খাদের দিকে
তাকায়নি, সেতুর চিহ্ন খুঁজছিল। এবার ভালো করে খাদের দিকে লক্ষ করল। তারপর একটা পাথরের টুকরো নিয়ে আবার ছুঁড়ল।
‘সারথিদা, রানিমা, এটা খাদ নয়,
জাদুর জন্য ওরকম মনে হচ্ছে। এ একেবারেই সমতল মাঠ।’
রানিমা
বললেন, ‘আশ্চর্য, এই প্রস্তরখণ্ডটি
ভাসমান অবস্থায় আছে। অথচ পূর্বে তুমি যেটি নিক্ষেপ
করেছিলে, সেটি অতলস্পর্শী পরিখাতে পতিত হয়েছিল। সত্যকল্প, তুমি কী
দেখছ?’
‘পাথরটা মাঠের মধ্যে পড়ে আছে।’ টুবলু এক পা বাড়াল। শক্ত জমি, পরিখার চিহ্নমাত্র
নেই। দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে।
‘চমৎকার,’ বলে সারথি পা বাড়াচ্ছিল, রানিমা তার হাত টেনে ধরলেন। আর একটা পাথর নিয়ে খাদের
মধ্যে ছুঁড়লেন। টুবলু অবাক হয়ে দেখল যে সেটা
জমিতে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
‘কুহকের রহস্য বুঝতে পেরেছ? আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছি,
কুহক ছিন্ন না করলে মায়াব্যাঘ্রও সত্যকারের ব্যাঘ্রের ন্যায় ভয়ঙ্কর। সত্যকল্প শ্বাপদের সহিত সংঘর্ষে ভূপতিত হয়েছিল, কারণ সেই মুহূর্তে মার্জারকে ব্যাঘ্র বলে তার
প্রতীতি হয়েছিল। অথচ যে মুহূর্তে সে কুহককে
ছিন্ন করল, সেই মুহূর্তে সে পদাঘাতে তাকে দূরে নিক্ষেপ
করতে পারল। সমতল ক্ষেত্রকে যতক্ষণ পরিখা
বলে সত্যকল্পের বিভ্রম হয়েছিল, তার নিক্ষিপ্ত
প্রস্তরখণ্ডটি তলদেশে পতিত হয়েছিল। কুহক ছিন্ন করার পশ্চাতে
তা হয় নাই। এক্ষণে তুমি ও আমি দেখছি
যে সত্যকল্প খাদের উপর শূন্যে ভাসমান। আমরা কুহক ছিন্ন করতে পারি
নাই, আমাদের কাছে তা পরিখাই।’
সারথি
সাবধানে এক পা বাড়িয়ে মাটি ছোঁয়ার চেষ্টা করল, টুবলু দেখল পা-টা মাটির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি করে পা সরিয়ে নিল। ‘তাহলে উপায়?’
রানি
কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর এগিয়ে এলেন। সাবধানে দাঁড়াতে দেখে টুবলু বুঝল যেখানটা আগে খাদের কিনারা মনে
করছিল সেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন। তারপর চোখ বুজে পা বাড়ালেন। এবার কিন্তু পা-টা আর মাটিতে ঢুকে গেল না। রানি এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন, বোধ হয় মনে জোর করে নিলেন। তারপর অন্য পাটা তুলে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ‘সারথি, তুমি কী দেখছ?’
অবাক
গলায় সারথি বলল, ‘আপনি সত্যকল্পের ন্যায়
শূন্যে ভাসমান।’
রানি
কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন। চোখ খুলে বললেন, ‘পরিখার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ না করলে কুহকের
প্রভাব আমার উপরে কাজ করছে না। আমরা যদি চক্ষু উন্মোচন না
করি, সত্যকল্প আমাদের হস্ত গ্রহণ করে নিরাপদে পরিখা অতিক্রম করাতে পারবে। প্রশ্ন হল যে মধ্যবর্তী স্থানে যদি চক্ষু খুলে যায় তা হলে কী
হবে? আমি অন্তত সেই পরীক্ষাতে আগ্রহী নই। সারথি, তোমার নিকট
কোনও বস্ত্রখণ্ড আছে?’
দু’জনে দুটো রুমাল বার করে শক্ত করে নিজেদের চোখ
বাঁধলেন। তারপর টুবলু দু’হাতে দু’জনের হাত ধরে মাঠ
পার করে নিয়ে গেল।
‘ঠিক আছে, এবার চোখ খুলতে পারেন। আমরা খাদ পেরিয়ে এসেছি।’
সামনে
একটা বড়ো বাড়ি। অন্ধকার। তিনজনে নিঃশব্দে এগিয়ে গেলেন। দরজা ঠেলতেই খুলে গেল। বোঝাই যাচ্ছে যে জাদুকর নিশ্চিত তার মায়া টপকে কেউ আসতে পারবে
না। ভিতরে ঢুকে সারথি চকমকি পাথর
ঠুকে একটা প্রদীপ জ্বালল।
‘জাদুদণ্ডটা কোথায় রাখা আছে?’ টুবলু ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা
করল।
‘অনুসন্ধান করতে হবে,’ সারথি একই রকম গলায় উত্তর দেয়।
রানি
চাপা গলায় বললেন, ‘ঐন্দ্রজালিক নিদ্রাভিভূত
আছে, এই উত্তম ক্ষণ।’ এতক্ষণে টুবলু খেয়াল
করল যে কারও নাক ডাকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
জাদুকর
যে ঘরে ঘুমোচ্ছে, সেটা বাদ দিয়ে বাকি
ঘরগুলো প্রদীপের আলোতে সাবধানে খোঁজা হল, কিন্তু জাদুদণ্ডের চিহ্ন
পাওয়া গেল না। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রানি বললেন, ‘প্রাণভ্রমরকে স্বীয় তত্ত্বাবধানে রাখবে দুষ্ট,
সেটাই স্বাভাবিক। গত্যন্তর নাই, ঐ কক্ষেই প্রবেশ করতে হবে।’
সারথি
বলল, ‘সকলের প্রবেশের প্রয়োজন নাই। আমি একাই যথেষ্ট।’
বাকি
দু’জন উদ্বিগ্নভাবে ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন,
সারথি প্রদীপ হাতে ভিতরে ঢুকল। খাটের উপর চাদর চাপা দিয়ে জাদুকর ঘুমোচ্ছে। খুঁজতে হল না, খাটের মাথার কাছে একটা তাক, তার উপরেই রাখা আছে একটা
কাচের ঘনক। প্রদীপের আলোতে ঝকমক করছে। সারথি আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে হাত বাড়াল, কিন্তু নাগাল পেল না। খাটের উপরে না উঠলে হাত পৌঁছবে না।
একটু
ইতস্তত করল সারথি, কিন্তু উপায় নেই। তারপর সাবধানে খাটের উপর উঠল। হাত বাড়িয়ে কাচের বাক্সটা যেই হাতে নিয়েছে, নাকের ডাক থেমে গেল। এক ঝটকায় জাদুকর উঠে বসল। সারথিকে চেপে ধরল, তার হাত থেকে কাচের বাক্সটা মাটিতে পড়ে চৌচির হয়ে গেল। রানি আর টুবলু একসঙ্গে ঘরের ভিতর ঢুকতে গেলেন। একটু হাতের ভঙ্গি করল জাদুকর, সঙ্গে সঙ্গে মাটি থেকে লোহার শিকল উঠে দু’জনকেই আষ্টেপৃষ্ঠে
বেঁধে ফেলল।
জাদুকরের
প্রকাণ্ড চেহারা, সারথিকে কাবু করা তার
কাছে কোনও ব্যাপার না। এক মুহূর্ত পরেই সে সারথিকে
মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। আর একটা শিকলে বাঁধা পড়ে
গেল সারথির হাত-পা। জাদুকর নিচু হয়ে জাদুদণ্ডটা তুলে নিল। প্রদীপটা মাটিতে পড়েও নেভেনি। সেটা তুলে নিয়ে ভালো করে তিনজনের মুখ দেখল।
‘রানি হয়ে চৌর্যবৃত্তি করতে লজ্জা করছে না?’
‘তস্কর কে? রাজকোশ লুণ্ঠন এবং রাজ্যবাসীদের মৃত্যুমুখে
প্রেরণের প্রয়াসের জন্য দায়ী যে ব্যক্তি, তার কাছে নীতিশাস্ত্রের
পাঠ নিতে হবে?’ রানিমা তেজের সঙ্গে উত্তর দিলেন।
‘অতঃপর কী হবে? কে আর প্রজাদের রক্ষা করবে? তাদের মহারানি স্বয়ং শৃঙ্খলাবদ্ধ,’ জাদুকর বিদ্রূপের
স্বরে বলল। রানির কাছে এল। ‘এই বালকটিকে কোথা থেকে
পেয়েছ? বুঝেছি, নিশ্চয় সারথির সঙ্গে পর্যটনে
বেরিয়েছিল। তাই আমার মায়া থেকে পরিত্রাণ
পেয়েছে। কিন্তু তা নিতান্তই সাময়িক। সারথি, তোমার যদি
কিঞ্চিৎ পরিমাণ বুদ্ধিও থাকত, তা হলে তুমি বালকটিকে নিয়ে স্বপ্নপুরী
থেকে পলায়ন করতে। কৃতকর্মের ফলভোগের জন্য প্রস্তুত
হও। প্রথমে এই বালকটিকে একটি
তুচ্ছাতিতুচ্ছ কীটে পরিবর্তিত করে পদতলে পিষ্ট করব। তোমরা দুইজনে দেখবে, তাই হবে তোমাদের প্রথম শাস্তি। তারপরেও যদি রানির মতের পরিবর্তন না হয়, সমস্ত অর্থ যদি আমার হস্তে সমর্পণ না করে,
তাহলে সারথির পালা। দেখি সারথির প্রাণ না অর্থ, রানির প্রিয়তর কোনটি?’
কথা বলতে
বলতে জাদুকর টুবলুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। জাদুদণ্ড বাড়িয়ে মন্ত্রোচ্চারণ
শুরু করল। টুবলু ভালো করে নিজের দিকে
তাকাল। শিকল মিলিয়ে গেল। জাদুকর কিছু বোঝার আগেই এক লাফে এগিয়ে গিয়ে জাদুদণ্ডটা তার হাত
থেকে এক ঝটকায় কেড়ে নিল টুবলু। সোজা ঊরুর উপর ধরে চাপ দিল, মট করে সেটা ভেঙে গেল।
ঘটনার
বিবরণ পড়তে যত সময় লাগল, ঘটতে লাগল তার অনেক
কম। জাদুকর অবাক হওয়ারও সময় পায়নি, একটা প্রচণ্ড আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই রানি ও সারথির গা থেকে শিকল মিলিয়ে গেল।
রানি
বললেন, ‘ধন্য সত্যকল্প, তুমি ধন্য। কেমন করে তুমি শৃঙ্খল ছিন্ন
করলে?’
‘আগের মতোই। আমি তো জানি শিকল মায়া ছাড়া
কিছু নয়। তাই ভালো করে নিজের দিকে
তাকাতেই তা মিলিয়ে গেল। তার মায়া যে এত সহজে ভেঙে
যাবে, তা জাদুকর ভাবতেও পারেনি। সেজন্যই অত সহজে জাদুদণ্ডটা কেড়ে নিতে পেরেছি।’
রানি
এসে নিজের হাত থেকে একটা রত্নখচিত আংটি খুলে টুবলুর হাতে দিলেন। বললেন, ‘জাদুদণ্ড
ভগ্ন হওয়ার মুহূর্তেই ঐন্দ্রজালিকের মায়া বিলুপ্ত হয়েছে। স্বপ্নপুরী নিশ্চয় পুনরায় নিজের প্রকৃত রূপ ফিরে পেয়েছে। যে উপকার তুমি করেছ, তার প্রতিদান দেওয়ার শক্তি আমার নাই। এই অঙ্গুরীয় গ্রহণ কর, এর জাদুবলে তুমি ইচ্ছামতো স্বপ্নপুরীতে প্রবেশ করতে পারবে। সারথি তোমাকে তোমার গন্তব্যে পৌঁছিয়ে দেবে।’ তারপর ঠিক মায়ের মতোই
জড়িয়ে ধরলেন টুবলুকে। জুঁইফুলের মিষ্টি গন্ধেই
যেন চোখ জুড়ে এল টুবলুর।
‘ওঠো, ওঠো, আর কতক্ষণ ঘুমোবে?
এসে গেছি।’
ধড়মড়
করে উঠল টুবলু। গরুর গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে
একটা বড়ো বাড়ির বাইরে। সারথি টুবলুকে গায়ে হাত দিয়ে
নাড়া দিচ্ছে।
‘কোথায় আমি?’
‘কোথায় আবার? স্বপনপুরে যাবে বলেছিলে, এসে গিয়েছি। তোমার মাসিকে ডেকেছি। ব্যাগ নামিয়ে দিয়েছি।’
টুবলু
বোকার মতো গাড়ি থেকে নামল। এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিল? কিন্তু স্বপ্ন এত স্পষ্ট হয়? সারথি মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ করতেই গরুগুলো গাড়ি ঘুরিয়ে টানতে শুরু করল। একটা বাড়ির আড়ালে চলে গেল গাড়িটা, তার আগে সারথি ফিরে টুবলুর দিকে হাত নাড়ল। আওয়াজ না করে ঠোঁট নাড়ল, টুবলুর মনে হল বলল, ‘আবার দেখা হবে।’ একটা গাছের ফাঁক দিয়ে
গাড়িটা একবার দেখা গেল, কিন্তু তাকে কি গরু টানছে, নাকি ঘোড়া? ঠিক বুঝতে পারল না টুবলু।
ঐ যাঃ, ভাড়া নিল না তো সারথিদা! বাড়ি থেকে মাসি বেরিয়ে এসেছে। জ্ঞান হওয়ার পরে টুবলু এই মাসিকে কখনও দেখেনি, কিন্তু মুখটা দেখে যেন মনে হল চেনা। আর যখন ওকে জড়িয়ে ধরল মাসি, তখন জুঁই ফুলের যে মিষ্টি গন্ধটা নাকে এল, সেটাও যেন
একটু আগে কোথাও পেয়েছে। প্যান্টের ডান পকেটে হাত
ঢোকাল টুবলু, হাতে ঠেকল একটা আংটি।
_____
ছবিঃ অতনু
দেব