সঙ্গীতা
দাশগুপ্ত রায়
ছোটোমামি
যে নেহাত শুধু ছোটোমামি নয় সেটা গেনু, মনু, বিলু, নুটুদের মাথায় প্রথমে মোটেই ঢোকেনি। সবে
মাসখানেক হল ছোটোমামুর বিয়ে হয়েছে। এদ্দিন বাড়ির বড়োরাই কেবল নতুন বউ নতুন বউদি
বলে ছোটোমামিকে ঘিরে রেখেছিল। এখন যা হোক বিয়েবাড়ির মোচ্ছব শেষ আর ওদিকে ইস্কুলেও
গরমের ছুটি। সব মিলিয়ে গেনু মনু নুটু বুলি আর ষষ্টির হাতের নাগালে এসেছে
ছোট্টখাট্ট ছোটোমামি, কল্যাণী।
এখন, বোশেখের বেলা দশটায় বাড়ির সবাই যখন এক থালা ভাত, সুক্তো, আলু পোস্ত, বিউলির ডাল
আর মাছের ঝাল খেয়ে অফিস-টফিস যায়, মা দিদিমা বড়োমামি সেজমাসির
দল দুপুরে আয়েস করে ওপরের ঘরে গল্পের বইটা কি সেলাইটা হাতে নিয়ে টেলিভিশনের সামনে
বসে ঘুমিয়ে নেয় এক ফাঁকে, বড়দি আর রাঙ্গাদি নিজেদের মোবাইল
ফোন নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে, সেই সময় গেনু মনুরা আবিষ্কার করে ওদের নতুন ছোটোমামি
নিচের একটেরে ঘরে একগাদা কী সব যন্ত্রপাতি নিয়ে খুটখুট করে, এটা জোড়ে সেটা গাঁথে ওটা
সাজায় সেটা বাদ দেয়...
দু-চারদিন ওরা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছে।
তাতে ছোটোমামির মনোযোগে একচুল চিড় ধরেনি। শেষে আর কৌতূহল চাপতে না পেরে একদিন গেনু
আচমকা ঘরে ঢুকে চমকে দিয়ে বলে ওঠে, “কী কর তুমি ওই সব জিনিসপত্তর দিয়ে?”
ছোটোমামি একটা ছোট্ট আয়না লাগানো গেলাসের
মতো জিনিস ডান চোখটায় আটকে একটা চিমটে দিয়ে ছোট্ট একটা চকচকে পাথর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে
দেখছিল। গেনুর কথা শুনে জিনিসটা চোখ থেকে খুলে হাতের পাথরটা নামিয়ে রেখে হেসে বলে,
“এই যে, কাজ-টাজ করি।”
“কী কাজ?” এবার নুটুও এগিয়ে আসে। এমনিতে ছোটোমামি
একদম গম্ভীর না। ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। তবু কাজের সময় কাউকে ডিস্টার্ব করতে নেই, এ
কথা ওকে ক’দিন আগেই বাবা কানে মোচড় দিয়ে ভালো করে শিখিয়েছে। সেই জন্যেই আজ ও
গেনুকেই নেতৃত্ব দিতে জমি ছাড়ল।
ছোটোমামি আঁচলটা কোমর থেকে খুলে টেবিলে
রাখা পাথরগুলো একটা সরু ভেলভেটের বাক্সে পর পর সাজিয়ে রাখে। তারপর ওই কাচ লাগানো
গ্লাস আর চিমটে-টিমটেগুলো আর একটা ভেলভেটের পাউচে ভরে সরিয়ে রেখে বিছানায় গিয়ে
বসে। তখনও দরজায় মনু বুলি আর ষষ্টি দাঁড়িয়ে। ছোটোমামি হাত নেড়ে সব্বাইকে ভেতরে
ডাকে। তারপর খাটের পিছনের তাক থেকে একটা কাচের বয়াম নামিয়ে এনে সবার হাতে গুলি
গুলি ইমলি লজেন্স দিয়ে বসিয়ে দেয়।
“বললে না তো কী কাজ?” নুটু এতক্ষণে বুঝেছে ছোটোমামিকে ওরা
ডিস্টার্ব করছে না মোটেই।
“পাথর যাচাইয়ের কাজ,” ছোটোমামি হাসিমুখে
বলে।
“পাথর যাচাই? সেটা কেমন কাজ? কী
করে করো?” বুলি শুরু থেকেই মামিদের ন্যাওটা। ফ্রকের ঘেরটা তুলে
ভালো করে বিছানায় বসে এবার প্রশ্ন ছোড়ে।
“এই যে, কোন পাথরটা দামি কোনটা শুধুই চকচকে
কিন্তু দামি নয়, এইসব যাচাই করি আর কী।”
ওরা পাঁচজনে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এরকমও
কাজ হয় নাকি? আর এসব পাথর তুমি পাও কোথা থেকে?
ছোটোমামি এবার আসনপিঁড়ি হয়ে বসে ষষ্টিকে কোলের
কাছে টেনে নেয়। তারপর বলে পাথর তো কত জায়গা থেকেই পাওয়া যায়। সেই যেমন আমি একবার
পাহাড়ের চুড়ো থেকে...
এটুকু শুনেই ওরা হই হই করে ওঠে – “তুমি
পাহাড়ের চুড়ো দেখেছ? ছবির বইয়ের মতো?”
গেনু আর নুটু যখন খুব ছোট্ট তখন মা-বাবার
সঙ্গে দার্জিলিং গিয়েছিল। সে সব কিছুই মনে নেই, শুধু ছবিগুলো ওরা দেখে মাঝে মাঝে।
নুটু বলল, “পাহাড়ের চুড়ো তো মেঘে ঢাকা ছোটোমামি। তুমি সেখানে কী করে যাবে?”
ছোটোমামি টিপি টিপি হাসে। তারপর পাঁচ
ভাইবোনকে যে গল্প বলে তা তোমরা বাপু তার মুখ থেকেই শোনো -
আমি তখন সবে কলেজ পাস করে শিক্ষানবিশি
করছি। আমার সুপারভাইজার ছিলেন ডঃ সিদ্ধান্ত। ভারি কড়া মানুষ। সারাদিন চুরুট খান আর
কফির মগ হাতে নিয়ে মাপজোক করেন। শুরুতেই আমাকে বলেছিলেন, ‘দেখ মেয়ে, আমাদের সঙ্গে পাহাড়ে গিয়ে খনিজ সম্পদ
খুঁজতে চাও সে ভালো কথা, কিন্তু মেয়ে বলে তোমাকে কম ভারী কাজ দেব তা ভেবো না।
দিনের পর দিন মোট বইতে হতে পারে। টিনের খাবার আর মাপা জল খেয়ে থাকতে হতে পারে আর বাথরুম-টাথরুম যে পাবেই এমন কোনও কথা
নেই। নদীর ধার, ঝরনার আড়াল কি জংলি ঝোপের মধ্যে গিয়ে কাজ সারতে হতে পারে। সে সব
যদি পার তো সঙ্গে চল। নয়তো আমার পিছু নিও না মোটে।’
তা আমি ওই বাথরুম-টাথরুম শুনে একটু দমে
গেলেও ভাবলাম, দেখাই যাক না। মোট বইতে আপত্তি
নেই আর খাবার খাওয়ার বায়নাক্কাও নেই আমার। বাথরুমের ব্যাপারটা খুব অসুবিধার হলে না হয় পাহাড় থেকে নেমে আসতে হবে, এই তো! ক’দিনের মধ্যে রুকস্যাকে স্লিপিং ব্যাগ, ফুঁ দিয়ে ফোলানো বালিশ আর ক’টা মাত্র জামা-প্যান্ট
নিয়ে প্রস্তুত হলাম আমি। মা সঙ্গে দিল একটা দু’মুখো ফ্লাস্ক যাতে একদিকে জল আর
একদিকে চা কফি নেওয়া যায়, কিছু শুকনো খাবার মায় ক’টা শুকনো মালপো অবধি। ঠাকুমা এনে দিল একটা মুশকিল আসান ফকিরের মাদুলি। পথে বিপথে মাদুলিই আমাকে রক্ষা করবে। সব শেষে বাবা দিল একটা ছোট্ট এল-ই-ডি বাল্বের সাদা আলোর টর্চ।
রাতে খাটের নিচে সে টর্চ জ্বালতেই গোটা তিন চার সরু মোটা মাকড়শা খচমচ করে নিজের বোনা জাল বেয়ে এদিক থেকে
ওদিক হাঁটা দিল। আমার ছোটো ভাই গোপুর একটা রঙিন সুগন্ধী ইরেজার হারিয়েছিল অনেকদিন আগে। টর্চের আলোয় সেটাও দেখতে পাওয়া গেল এক্কেবারে কোনার দিকে। বুঝলাম এক্সপিডিশনের জন্য
এক্কেবারে ষোলো আনা প্রস্তুত আমি।
ট্রেনে উঠে ডঃ সিদ্ধান্ত বলে দিয়েছিলেন তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। গন্তব্যে পৌঁছনো অবধিই আমাদের বিশ্রামের সময়। একবার পৌঁছে গেলে আর শুয়ে বসে থাকার
সময় নেই।
মোটামুটি ত্রিশ ঘন্টা আমাদের খেয়ে আর ঘুমিয়েই কাটল। দলের মধ্যে একটি ছেলে, শ্যামল, সে আদতে নেপালি কিন্তু কখনও নেপাল যায়নি। আমাদেরই মতো কলকাতায় মানুষ, বাংলায় কথা বলে, ভাত
ডাল এঁচোড়ের ডালনা খায়। এমনকি পাহাড়ের অভিজ্ঞতাও তার নেই। পাহাড় চেনার শখও তেমন আছে মনে হয় না। তার সঙ্গে একখানা খাতা। তাতে গুটি গুটি
অক্ষরে মজার সব রেসিপি লেখা আছে। পাহাড়ের গাছপালা, ছোটো বুনো খরগোশ পাখি এসব কী করে রান্না করতে হয় তাইই লিখে নিয়ে চলেছে।
দেড়দিন পরে আমরা যখন গিয়ে পৌঁছলাম সেই গ্রামে তখন সন্ধে হয় হয়। ছোট্ট সাজানো গ্রামে সব বাড়িগুলোই উঁচু মাচার ওপর। বাড়ির গায়ে গায়ে সাদা আলপনা আঁকা। লক্ষ করে দেখলাম প্রায় প্রত্যেকটা বাড়ির গায়ের ছবি আলাদা আলাদা। অনেকটা ওরলি আর্ট ধরণের। তবে একটু মোটা মোটা আঁকাগুলো। ডঃ সিদ্ধান্ত বললেন, এই যে দেয়ালের আঁকা, এর থেকেই বোঝা যায় একটা
বাড়িতে কতজন সদস্য। নতুন শিশু জন্মালে ওরা একটা শিশু
এঁকে দেয়, কেউ মারা গেলে একজন
মানুষ মুছে ফেলে মাটি লেপে।
“ওরলি আর্ট কি ছোটোমামি?”
মনু কথার মাঝে ফুট কাটে।
“মুম্বাইয়ের আশেপাশে যে আদিবাসীরা থাকে তাঁদের মধ্যে একরকম আঁকার চল আছে, তাকেই বলে ওরলি
আর্ট। মানুষ রোজদিন যা করে, রান্না খাওয়া, নাচ
গান এসব বিষয় নিয়েই আঁকা, সরু সরু হাত পা, গোল একটা মাথা... ওদের
সব ছবিতেই এমন মানুষ থাকে। তবে হিমালয়ের বুকের ওই গ্রামটিতে যে আঁকা দেখেছিলাম তাতে মানুষের শরীর অনেক বেশি ভরভরন্ত।”
“মোটাসোটা?” বুলি ফিক করে হাসে।
“হ্যাঁ, একদম তোমার মতো,” মামি বুলির গাল টিপে গল্পে ফেরে -
গ্রামের সর্দার যোগিয়া হাঁটু গেড়ে বসে আমাদের পাঁচজনকে আপ্যায়ন করল নতুন ছোটো হাতমোছার
গামছা আর ছোটো ছোটো আয়না দিয়ে। ওদের নাকি ওরকম নিয়ম।
জঙ্গলে হঠাৎ করে রাত নামে জানিস তো? তো ওই কষকষে জংলি গ্রামে এমনিতেই প্রত্যেকটা বাড়ি ঘিরে বেশ কিছু বড়ো গাছ। সেই গাছ বেয়ে যখন অন্ধকার নামল, যেন এক্কেবারে ঘুটঘুটিয়ে। যোগিয়ার বউ, তাঁকে গাঁয়ের সবাই মা বলে ডাকে, সে
আমাদের হাত পা ধোয়ার জল দিল, তারপর আমাকে নিচু গলায় জিজ্ঞেস
করল, ‘বাথরুম যাবে কি? গেলে এখনই চল। রাত হলে যেতে পারবে না।’ ওর
হাতের নির্দেশে দেখলাম দূরে মাচার ওপর বাথরুম করার জন্য
একটা ঘেরা জায়গা। এরা খুব পরিষ্কার। কিন্তু বাড়ির মধ্যে বাথরুমের ব্যবস্থা রাখে
না। পাশাপাশি চার-পাঁচটা মাচা আছে। গোটা গাঁয়ের লোক
সেগুলোই ব্যবহার করে।
রাতে আমরা খেলাম রুটি আর ভুট্টার সঙ্গে
মোটা লঙ্কার সবজি। ভীষণ ঝাল সে সবজি মুখে তুলেই আমি তো লাফিয়ে উঠি প্রায়। শ্যামল
বলল, ‘দিদি আমার কাছে গুড় আছে, খাবে?’
ডঃ সিদ্ধান্ত বাংলায় বললেন, ‘সেটা করলে
এদের অপমান করা হবে না তো?’
এদিকে আমার মুখ-চোখ দেখে ‘মা’ মানে
সর্দারের বউ বুঝতেই পেরেছে যে ভীষণ ঝাল লাগছে। এক মুখ হেসে সে শিকে থেকে একটা
হাঁড়ি নামিয়ে আনল। কালচে আঠা আঠা জমাট মধুতে ভর্তি হাঁড়িটা। আমি আয়েস করে মধু আর
রুটি খেয়ে শুতে গেলাম সেদিন।
পরদিন ভোর ছ’টা বাজতেই ডঃ সিদ্ধান্ত
তৈরি। অতএব আমরাও। আকাশ সেদিন খুব মেঘলা। চারদিক কেমন
অন্ধকার আর ঠান্ডা। তার মধ্যেই আমরা গরম চা আর ছাতুর রুটি খেয়ে বেরোলাম। আমাদের
গ্রুপে আর একটি ছেলে ছিল, বরুণ। যেমন তার স্বাস্থ্য তেমনই তার গলার
আওয়াজ। দেখলেই মনে হয় একে মিলিটারিতে ভর্তি করিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু কাজের সময় দেখা গেল সে একটি ভিতুর ডিম। কী করে তা বুঝলাম সেটা পরে
বলছি।
আমরা তো জঙ্গলে পাহাড়ে গিয়েছি পাথর থেকে খনিজ খুঁজতে। মাটির বুকের মধ্যে লুকোনো
থাকে রঙিন সুন্দর পাথরের স্তর। হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবী ঝড় বৃষ্টি ভূমিকম্প
সহ্য করে, সহ্য করে আগ্নেয়গিরির তাপ। কখনও জলের ধাক্কায় পাশ
ফেরে মাটি, কখনও ভয়ংকর উত্তাপে নিজেকে পোড়ায়। এভাবেই নিজেকে ভেঙ্গে গড়ে কষ্ট পেয়ে
অনেক দুর্যোগ সহ্য করে প্রকৃতি আমাদের চোখ ধাঁধানো রঙিন পাথর উপহার দেয়।
“আচ্ছা, তারপর কী হল বল? বরুণ
কীসে ভয় পেল?” নুটু, গেনুদের পাথরের
বিবরণে আগ্রহ নেই।
ছোটোমামি এক ঢোঁক জল খায়, তারপর আবার গল্প শুরু করে -
পাহাড়ের গায়ে কোথাও ভালো পাথর আছে কিনা
দেখতে পাহাড়কে ফাটাতে হয়। এক্সপ্লোসিভ পাহাড়ের গায়ে সেট করে তাতে আগুন লাগিয়ে
পাহাড় ফাটিয়ে দেখা যায় অনেক অনেক গভীরে কী আছে। কিন্তু আমরা তো বড়ো মাইনিং করতে
যাইনি। গিয়েছি কলেজের পড়া সেরে হাতে কলমে
সামান্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে। তাই অল্প এক্সপ্লোসিভ আর কিছু যন্ত্রপাতি
নিয়ে গেছি।
বরুণ যেহেতু সবচেয়ে শক্তপোক্ত তাই বরুণের
পিঠে ছিল সেই যন্ত্রপাতির বোঝা। হাঁটতে হাঁটতে আমরা যখন গ্রাম থেকে অনেক দূরে চলে
এসেছি তখন ডঃ সিদ্ধান্ত আমাদের দেখালেন একটা ঘন শালগাছে ঘেরা জায়গা। শ’খানেক
শালগাছ ঘিরে রেখেছে শক্ত পাথুরে একটা চাতালকে। কালচে কুমিরের পিঠের মতো রং
চাতালটার। রোদ্দুর ঢোকে না ওখানে খুব বেশি। দেখে মনে হচ্ছে শালের ছাওয়ায় মসৃণ চাতালটা যেন উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু
আমরা তাকে ঘুমোতে দিলে তো!
বড়ো একটা গজাল চাতালের একদিকে ঠুকতে
বসলেন ডঃ সিদ্ধান্ত। হাতুড়ির ঠোকায় পেরেকের চারপাশ ঘিরে বড়ো চিড় ধরতে পারে শক্ত
পাথর হলে, আবার খুব নরম পাথর হলে চারপাশে চিড় না
ধরিয়েও গজালের মুখটা সরাসরি ভেতরে অল্প ঢুকে যেতে পারে। যাইই হবে, আমি লিখে নেব ডায়েরিতে। এসবই আমাদের রিপোর্টে যাবে। ডঃ সিদ্ধান্ত সবে
হাঁটু গেড়ে বসে গজালটা ঠুকেছেন ঠুক ঠুক আওয়াজে। আমিও খাতা কলম বাগিয়ে তাকিয়ে আছি
সেদিকে। শ্যামল বোধহয় ছবি তুলবে বলে ক্যামেরা বার করছে। ডকুমেন্ট হিসেবে ছবি লাগবে
তো! হঠাৎ মনে হলে কেউ যেন ঝুমুর পরে ঝুম ঝুম শব্দে এদিকে আসছে। তখনও আমরা ওদিকে
সেভাবে মন দিইনি। জঙ্গলে অনেক রকম অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়। তাছাড়া একটু সময়ের মধ্যেই
ব্যাপারটা কেমন ছন্দে বাঁধা হয়ে গেল। গজালের ঠুক ঠুক আর সেই ঝুম ঝুম মিলে - ঠুক
ঝুম ঝুম, ঠুক ঝুম ঝুম - একটা আওয়াজ শান্ত জঙ্গলের মধ্যে দিব্যি মানিয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু হঠাৎ দেখি বরুণ পিঠে সেই এক্সপ্লোসিভ
স্টিকের বোঁচকা নিয়ে বিকট ভারী গলায় ‘ওরে বাবা গো-ও, বাঁচাও বাঁচাও, হেল্প হেল্প’ করে
চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড়চ্ছে। আমরা যে যার কাজ থামিয়ে অবাক হয়ে দেখছি এদিক ওদিক। কেন
হেল্প? কীসের থেকে বাঁচাব? ডঃ
সিদ্ধান্তও ঘাবড়ে গিয়ে ‘স্টপ বরুণ, স্টপ রাইট নাও, হোয়াটস্ রং বরুণ’ বলে লাফালাফি শুরু করেছেন আর এদিকে আমি আর শ্যামল হেসে
কুটিপাটি যাচ্ছি দু’জনকে দেখে। হয়েছে কী, একটা বেশ বড়ো চেহারার সজারু, তার পিঠে বোধহয় বড়ো একখানা কাঁচা শালপাতা পড়ে কাঁটায় আটকে গেছে... সেইই ওই
আধো অন্ধকারে বেড়াতে বেরিয়ে চাতালে আমাদের দেখে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। সবুজ পাতা
ঢাকা গাবলুগুবলু একটা সজারুকে দেখে এত্ত লম্বাচওড়া একটা মানুষ যে ওরকম ভয় পেতে
পারে তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
যাক, সেদিন আমরা অল্প কিছু পরীক্ষামূলক তথ্য জোগাড় করে সন্ধে নামার
আগে গাঁয়ে ফিরলাম। ফিরে কিন্তু মনে হল চারদিক কেমন থমথমে।
পাহাড়ি গ্রামের লোকজন খুব হুল্লোড়ে হয়।
ওদের জীবনে আনন্দ বলতে ভালো খাওয়া আর নাচ গান। কখনও কখনও ছোরা ছুরি দিয়ে বুনো
জন্তু শিকারের প্রতিযোগিতা। শিকার যা হয় তা ওরা আগুন জ্বালিয়ে সেঁকে পাথুরে নুন, তেল আর লঙ্কা মাখিয়ে খায় আর মদ খেয়ে
নাচানাচি করে ঘুমোতে যায়।
যোগিয়া বলেছিল, আমাদের জন্য ওরা রাতে
বনভোজন করবে। বড়ো হাঁড়িতে মাংস রান্না হবে সব্বার জন্য। শালপাতায় করে মাংস আর জাউ
খাবে সবাই। আমরা জাউ খেতে পারব না, তাই আমাদের জন্য পাহাড়ি চালের ভাত করে দেবে ‘মা’। কিন্তু গ্রামে ঢুকে মনে হল তেমন কিছু হচ্ছে না। কেমন যেন
ফাঁকা ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই। যোগিয়া আর ওর বউ আমাদেরকে দাওয়ায় নিয়ে গিয়ে বসাল। তারপর
একটা ছোটো ছেলেকে ডেকে বলল, সব ঘরে ঘরে বলে আসতে সবাই যেন সজাগ থাকে। দরকারে খবর
দিতে যেন ভুল না করে।
আমাদের কেমন গা ছমছম করছিল। কীসের খবর, কেন কোনও জনমানুষ দেখছি না কোথাও...
যোগিয়া খাটিয়ায় বসে আমাদের বলল, ‘গ্রামের
থেকে দশ বারো মাইল দূরে একটা বড়ো গুহা আছে। জংলা বুনো কাঁটা গাছের মাঝে ওই বিরাট
গুহাতে কেউ কখনও যায় না। কথিত আছে ওই গুহায় বড়ো দানো থাকে। কারও কোনও ক্ষতি অবশ্য
সে কখনও করেনি। বরং কারও ঘরে কোনও বিপদ হলে তারা দানোর কাছে প্রার্থনা করে সে বিপদ
গিলে ফেলতে। প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে দানোর জন্য কাঁচা দুধ, ফল, পিঠে এসব রেখে
আসে ওই কাঁটাগাছের সামনে। পিছন ফিরে দেখা মানা আছে। দেখলেই চোখে ওই কাঁটাগাছের
কাঁটা এসে বিঁধবে। তবে দু’দিন পরে গিয়ে যদি দেখে খাবার যেমন কে তেমন আছে তো জানবে
দানো বিপদে সাহায্য করবে না। যদি দেখ ফেলাছড়া করে খাওয়া তো জানবে দানো চেষ্টা করবে,
বিপদ কাটতেও পারে, নাও পারে। আর যদি দেখ
খাবারদাবার কিছু নেই তো জানবে বিপদ কাটবেই।’
এতদূর বলে মামিমা আবার হাত বাড়ায় জলের
বোতলের দিকে। বাইরে একটু সন্ধে হয়ে আসছে।
“ঘরের আলোটা জ্বেলে দিই ছোটোমামি?” ষষ্টি বেচারা ভারী ভিতু। গল্পের মধ্যে
দানো ঢুকে থেকে তার গা ছম ছম করছে।
ছোটোমামিমা হেসে বলে, “দূর বোকা, ভয় পাচ্ছিস নাকি? আমি
আছি না!”
নুটু, গেনু, বুলি আর মনু হাসিমুখে ষষ্টির দিকে
তাকায়। বেচারা বড্ড ছোটো কিনা! তারপর নিজেরা আর একটু ঘেঁষে ঘেঁষে বসে তাড়া দেয়... “থামছ
কেন? বলো তারপর!”
“এই তো বলছি,” ছোটোমামি গল্পে ফেরে -
যোগিয়া গুমগুমে আওয়াজে নিচু গলায় আমাদের
বলতে থাকে... ‘ক’দিন আগে জুনান নামে গাঁয়ের একটি মেয়ে গিয়েছিল দানোর পুজো দিতে।
তার দাদা আজ দু’মাসের বেশি ঘর ছাড়া। শিকারে গিয়ে আর ফেরেনি। সেই জন্যেই গিয়েছিল।
খাবারটাবার দিয়ে মেয়েটা চলেই এসেছিল। তারপর দু’দিন পরে গিয়ে কি দেখেছে কে জানে।
সেদিন থেকেই বাড়ি এসে চুপ করে বসে থাকে। গাঁয়ের বদ্যি তখনই বলেছিল দানো ভর করেছে।
ঝাড়ফুঁকের জল দিয়েছিল মাথায় ছিটিয়ে ঘুম পাড়ানোর জন্য। কিন্তু সে জলে কাজ হয়নি।
গতকাল কোনও এক সময় মেয়েটা আবার দানোর গুহায় গিয়েছিল। কেউ টের পায়নি। সকাল
থেকে গাঁয়ের আশেপাশের জঙ্গলে খুঁজেছে সবাই। শেষে বিকেলের আগে দেখা গেছে মেয়েটা
দানোগুহার দিক থেকে ফিরছে। জঙ্গলের কাঠুরেরা দেখেছে ও কাঁটাঝোপ সরিয়ে গুহা থেকে
বেরিয়ে আসছে। মেয়েটার সারা গা চকচক করছিল দূর থেকে। কাছে আসতে দেখা গেছে ওর গায়ের
রং নীলচে হয়ে গেছে একদম। সারা শরীর ওর ভিজে। মাথার চুল থেকে জল ঝরছে আর মাথায় যেন
চকমকে মুকুট বসিয়ে দিয়েছে কেউ। এসে থেকে একটাও কথা বলেনি। ওদের দাওয়ায় মাথা নিচু
করে বসে থেকেছে। সেই সময় জুনানের মা খাওয়াতে গেলেও খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে
দাওয়ায়। বদ্যিকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু বদ্যি বলছে এ জড়িবুটি দাওয়াইয়ের কাজ
নয়। দানোর নজর পড়েছে ওর ওপর। হয়তো আজ রাতেও ও আবার গুহায় যাবে। জানি না কী হতে
চলেছে।’
ডঃ সিদ্ধান্ত আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘খুবই
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার মনে হচ্ছে। হয়তো যা খুঁজতে এসেছি তার থেকেও ভালো কিছু পেতে
পারি। চল, মেয়েটিকে দেখে আসি।’
বরুণ দেখলাম ব্যাজার মুখে ঘাড় থেকে বোঁচকা নামিয়ে বলল, ‘আমার শরীরটা ঠিক লাগছে না। বাথরুম যেতে হবে। আপনারা যান।’
বরুণ দেখলাম ব্যাজার মুখে ঘাড় থেকে বোঁচকা নামিয়ে বলল, ‘আমার শরীরটা ঠিক লাগছে না। বাথরুম যেতে হবে। আপনারা যান।’
ডঃ সিদ্ধান্ত জোর করলেন না। আমি, শ্যামল আর ডক্টর মিলে যোগিয়াকে নিয়ে
মেয়েটার বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। যোগিয়ার বউ পিছন থেকে ডেকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি ফিরো।
আমি ওদের জন্য আটা আর গুড়ের পিঠে বানাচ্ছি।’
গ্রামের মধ্যে সত্যিই যেন কিছু ভর করেছে।
বাচ্চাগুলো কাল গাছগুলোকে ঘিরে ঘিরে খেলছিল, আজ কোত্থাও নেই। খালি নজর করলাম সব বাড়ির দরজার পাশে একটা করে
ছোট্ট ঢোলকের মতো কিছু রাখা আছে। কাল ছিল কিনা দেখিনি খেয়াল করে।
জুনানের বাবা দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা
গুঁজে বসেছিল। জুনান বোধহয় ঘরে। ওর মা শুকনো কাঠপাতা গোছা করে উঠোনের উনুনের পেটে
ঠেসে ঢোকাচ্ছিল। আমাদের দেখে সব ফেলে এসে দাঁড়াল। যোগিয়ার হাত দুটো ধরে কেঁদে উঠল
জুনানের বাবা, ‘ছেলেটা দু’মাস হল হারিয়ে গেছে সর্দার, এবার মেয়েটাকেও দানোয় ডাকছে...’
যোগিয়া অসহায় মুখে সান্ত্বনা দিল, ‘ভেবো
না। দানো ভাগাবার চেষ্টা করব। গুণিনকে খবর পাঠিয়েছি। বদ্যি তো আছেই।’
ডঃ সিদ্ধান্ত গলায় একটু কাশির আওয়াজ
করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘জুনানকে একবার দেখতে পারি?’
পায়ে পায়ে আমরা ওদের ঘরের দরজায় গিয়ে
দাঁড়ালাম। শিকে থেকে ঝুলছে বিছানা। দোলনার মতো। শিকেটায় গাঁট আছে শেকলের। বোধহয়
দরকার মতো খাটের নিচে জিনিস রাখার জন্য খাট উঁচু নিচু করা যায়। জুনান শুয়ে আছে চুপ
করে। ঘরে বাতি নেই কোনও। আমি আমার পকেটের সেই টর্চটা বার করে জ্বালালাম। প্রায়
ঘুটঘুটে ঘরের মধ্যে ওই দুধ সাদা আলোয় জুনানের গোটা শরীরে কালো কালো কালসিটে। আর হাতের
পাতা কেমন নীলচে। আরও একটা জিনিস দেখলাম, জুনানের চুলের মাঝে মাঝে কিছু যেন চিকমিক
করছে। ইচ্ছে করছিল ওকে ছুঁয়ে দেখি, কিন্তু সেটা বোধহয় উচিত হবে না। তবে বুঝলাম,
শুধু হাতের পাতাই নীল, যা লোকের মুখে মুখে সারা শরীর নীল হয়ে ছড়িয়েছে। চুলের
মুকুটের গল্পও তাইই।
ফেরার পথে ডঃ সিদ্ধান্ত একটাও কথা বলেননি।
যোগিয়া আমাকে জিজ্ঞেস করছিল আমার আরও ভাই বোন আছে কিনা। শ্যামল ফিসফিস করে বলল, ‘সর্দার
বোধহয় ভাবছে তোকে এমন ভয়ঙ্কর পাহাড়ে একা ছেড়ে দিয়েছে মা বাবা, মানে তুই মরে গেলেও
ওদের আরও ছেলেমেয়ে থাকবে, কষ্ট হবে না।’
রাতে আমরা দালিয়ার খিচুড়ি খেলাম, সঙ্গে আচার দিয়ে মাখা মিষ্টি আলু পোড়া। আর
ছিল গুড় দিয়ে আটা মেখে বানানো পিঠে। দিব্যি খেতে। দেখলাম ওরা রান্নাতেও খনিজ নুন
ব্যবহার করে, গোলাপি রঙের। আমাদের মতো সাদা আয়োডাইজড নুন না।
খেয়েদেয়ে আমি শুয়েছি খাটিয়ায়। সবাই একটা
ঘরে তিন চারটে খাটিয়ায় ভাগাভাগি করে শুই আমরা। আর যোগিয়া শোয় ঘরের বাইরে মাটি দিয়ে
বানানো ডিভানের মতো বড়ো রোয়াকে।
আমার সঙ্গে স্লিপিং ব্যাগ ছিল। ঠান্ডায়
স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে ভীষণ আরাম। আমিও কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানি না। ঘুম ভাঙল যখন, তখন বোধহয় ভোর রাত। দ্রিমি দ্রিমি গুমগুম একটা আওয়াজ
হচ্ছে একটানা। তবে সে আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গেনি আমার। ঘুম ভেঙ্গেছে কারণ ডঃ সিদ্ধান্ত
আমার মুখে ঠান্ডা জলের ছিটে দিয়ে ডাকছে, ‘কল্যাণী! কল্যাণী! ওঠো শিগগির।’
আমি ভাবলাম, এ কী! আমি কি অজ্ঞান হয়ে
গেছিলাম? জলের ছিটে দিচ্ছে কেন?
তাড়াতাড়ি উঠে চোখ কচলে বুঝলাম ডক্টর শ্যামলকেও ওভাবেই জলের ছিটে
দিচ্ছেন। ঘুম ভাঙ্গাতে ঠান্ডায় এর চেয়ে ভালো দাওয়াই আর হয় না। ঘোর কাটতে শুনলাম
ডক্টর বলছেন শিগগির চলো। জুনান আবার বেরিয়ে পড়েছে বাড়ি থেকে। শুনছ না গ্রামের
লোকেরা ঢাকের আওয়াজে খবর দিচ্ছে?
এক লাফে খাটিয়া থেকে নেমে জ্যাকেট চড়িয়ে
বেরিয়ে এলাম। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। আর তার থেকে বেশি অদ্ভুত ঘোর লাগানো আওয়াজ।
একভাবে এক তালে দ্রিমিদাম দ্রিমিদাম করে ঢাক বাজছে, কিন্তু যেন খুব নিচু স্কেলে।
গাছপালার ঘেরে এক অদ্ভুত ইকো তৈরি করেছে আওয়াজটা। আশেপাশের বাড়িগুলোর লোকজন দাওয়ায়
এসে দাঁড়িয়েছে। শুধু একটা মশালের আলো এগিয়ে যাচ্ছে বোধহয় দানো গুহার দিকেই। দরজার
ধার থেকে একটা জন্তু গাঁথার বল্লম টেনে নিল যোগিয়া। ডঃ সিদ্ধান্ত আমাদের দিকে
তাকিয়ে বললেন, ‘চলো, কুইক।’
শুকনো পাতা মাড়িয়ে কিছুটা দৌড়ে কিছুটা
হেঁটে আমরা এগোচ্ছিলাম। দু’পাশে শাল আর সেগুনের জঙ্গল। অন্ধকারে বড়ো গাছের ফুলে
ওঠা শিকড় বাঁচিয়ে এগোতে গিয়ে বার বার হোঁচট খাচ্ছি। যোগিয়া বরং অনেক দ্রুত
এগোচ্ছে। এসব রাস্তায় ও অভ্যস্ত।
জানি না কতক্ষণ ওভাবেই হেঁটেছি আমরা।
হঠাৎই দেখি সকালের সেই চাতালের মতোই আর একটা চাতাল। কিন্তু আকারে সেটার প্রায়
তিনগুণ। চাতালের ওপাশ দিয়ে একটা ছোটো ঝোরা তিরতির করে বইছে। আর তার কুড়ি পঁচিশ
ফিটের ওপারে অনেক উঁচু পাথরের একটা গুহা, যেন বিশাল এক দৈত্য মাথায় কম্বল মুড়ি দিয়ে একটু সামনে ঝুঁকে
দাঁড়িয়ে আছে।
ঝোরাটা অগভীর। পা দিলে প্রায় হাঁটু জল
হবে। টর্চের আলো এখানে ম্যাড়ম্যাড়ে আর বড্ড বেমানান। বরং হালকা চাঁদের আলোয়
হাঁটুজলের ওই ঝোরার নিচে বড়ো বড়ো সাদা আর তামাটে পাথর স্পষ্ট দেখা যায়। জলের সামনে
দাঁড়িয়ে যোগিয়া নিচু হয়ে জল হাতে তুলে মাথায় ছিটায়। দেখাদেখি আমরাও জলে হাত দিই।
পাহাড়ি ঝোরার জল সাধারণতঃ বেশ ঠান্ডা হয়। বিশেষ করে রাতের দিকে। এই জল কিন্তু তা
নয়। বরং ঠান্ডার দিনে যে উষ্ণ গরম জলে চান করি আমরা, প্রায় সেরকম।
ডক্টর আস্তে করে জিজ্ঞেস করেন এতক্ষণে, ‘মশাল হাতে লোকটা কে ছিল যোগিয়া?’
যোগিয়া এদিক ওদিক তাকিয়ে উত্তর দেয়, ‘জুনানের
বাপ। কিন্তু সে গেল কোথায়?’
যা শুনলাম, জুনান এমনিতেই ভোর রাতে ঘুম থেকে ওঠে।
কিন্তু আজ মাঝরাতেই উঠে পড়েছে। তারপর কোনোদিকে না তাকিয়ে চুপচাপ বাড়ি থেকে বেরিয়ে
হাঁটছিল গ্রামের পথে। ওর মা বাবার ডাকে সাড়াও দেয়নি। হয়তো দানোগুহাতেই যাচ্ছে,
দানোর ডাক শুনতে পাচ্ছে হয়তো ও, এই ভেবে ওর
বাপ মশাল জ্বালিয়ে মেয়ের পিছু নেয় আর মা ঢাক বাজিয়ে গাঁয়ের লোককে ডেকে তোলে।
নিচু গলায় কথা বলতে বলতে আমাদের চোখ সয়ে
আসে আধো অন্ধকারে। দেখি মশালটা নেভা। একটু দূরে গুহার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে
কোলকুঁজো একটা লোক, জুনানের বাপ। যোগিয়া তার কাছে যেতেই হু হু করে কেঁদে উঠে সে বলল, ‘জুনানকে
দানো ডেকেছে আবার। জুনান চলে গেছে গুহার মধ্যে।’
ডঃ সিদ্ধান্ত যেন মুহূর্তের মধ্যে ঠিক
করে নেন কী করতে হবে। আমাকে বলেন, ‘কল্যাণী, তোমার টর্চটা দাও। আর তোমরা কেউ না চাইলে এসো না আমার সঙ্গে।
জানি না কতটা রিস্ক আছে ভেতরে, তবে আমার মন বলছে ভেতরে ভয়ের কিছু নেই। থাকলে জুনান
সেখান থেকে ফিরে এসে আবার যেত না।’
আমি আর শ্যামল কোনও কথা না বলে ঝোরার জলে
পা ডুবিয়ে পার হলাম। যোগিয়াও। জুনানের বাবাও আমাদের পিছু পিছু আসবে ভাবছিল বোধহয়।
কিন্তু দু’পা এগিয়েই দাঁড়িয়ে গেল। আর দাঁড়িয়ে রইল বরুণ। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা গুহামুখে
পৌঁছলাম। ভীষণ কাঁটাঝোপে ভর্তি বেশিটাই, কিন্তু একটা ফাঁক আছে যেখান দিয়ে অনায়াসে
ভেতরে যাওয়া যায়। আর কী অদ্ভুত, সেই ফাঁক দিয়ে ভিতর থেকে একটা নীলচে আলোর আভা যেন বয়ে আনছে হাজার ধূলিকণা।
যোগিয়া কখন মশালটা তুলে নিয়েছিল দেখিনি।
এখন দেখলাম সে কোমর থেকে দেশলাই বার করে মশালটা জ্বালিয়ে নিল, তারপর এক হাতে বল্লম
আর এক হাতে মশাল নিয়ে সে আর ডক্টর সিদ্ধান্ত আমার আর শ্যামলের আগে ঢুকল গুহায়।
ভেতরে ঢুকেই আমি আর শ্যামল চিৎকার করে
উঠলাম। ভয়ে নয়, বিস্ময়ে। গুহাটা বাইরে থেকে যত বিশাল মনে হয় ভেতরে তেমন নয়। বরং ছাদ অনেক
নিচু, আকারেও বিরাট নয়। এরই মধ্যে উঁচু করে রাখা মশালের আলোয়
আমরা দেখলাম, জুনান দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা ভিতরে সরু তিরতিরে একটা ঝরনার সামনে। ঝরনার জল বোধহয় ফুটন্ত গরম, যাকে লোকে উষ্ণ প্রস্রবন বলে, সেই রকম। জল থেকে উঠে আসছে ধোঁয়া আর সেই ধোঁয়ার ওপাশে বিরাট এক নীলচে দেয়াল।
এবড়োখেবড়ো দেয়ালটা ঝরনার থেকে অনেকই চওড়া। ফলে যেখান দিয়ে জল যাচ্ছে সেখানের রংটা
যত স্পষ্ট, তার দু’পাশের শুকনো দেয়ালে অত স্পষ্ট নয়। চারদিকে
ভালো করে আলো ফেলে দেখা গেল নীলের বিভিন্ন শেডের পাথরে ভর্তি দেয়ালটা। আলো না
ফেললে নীল রং তেমন বোঝাই যেত না। শুধু যেখান দিয়ে জল নামছে সে জায়গাটায় তাকালে চোখ
ধাঁধিয়ে যায়।
কতক্ষণ যে অবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা
জানি না। ঘোর কাটতে দেয়ালে হাত রেখে রেখে তুলে নিচ্ছিলাম, সাদা আলোয় দেখছিলাম আমাদের হাতে নীলচে
ধুলো।
ভোরের আলো ফুটতে বাইরে পাখির ডাক শুনে বেরিয়ে
এলাম আমরা। জুনানের হাত ধরে বার করে আনলাম আমি।
ডক্টর সিদ্ধান্ত বললেন, জুনান সম্ভবতঃ
বিস্ময়ের ধাক্কা সহ্য করতে পারেনি। বলতেও পারেনি কাউকে বুঝিয়ে। এত বছরের দানোর
বিশ্বাস ভেঙ্গে ও ভেতরে কেন গিয়েছিল, কোন সাহসে গিয়েছিল - সে প্রশ্নের উত্তর কীই বা দিত? তবে হয়তো দানোর কাছে প্রার্থনা জানাতে বেশি এগিয়ে গিয়ে ও ওই আলো দেখে।
তারপর আলোর টানেই ভেতরে ঢুকে এসব দেখে। দেয়াল ধরে ধরে ঘুরেছিল হয়তো বা ভিতরে ওই
ঝরনায় পড়ে গিয়ে থাকতে পারে। বাইরের আলোতে দেখ, ওই ঝরনার জলে
অভ্র মেশানো আছে। সেই অভ্র শরীরে আটকে যায়।
“আমরা সেবার ওখান থেকে প্রচুর স্যাম্পেল
কালেক্ট করেছিলাম, জানিস? বহুবছর ধরে গুহার বাইরের পাথরের চাপ আর ভেতরের হাওয়ার প্রতিরোধ, তার সঙ্গে প্রাকৃতিক উষ্ণ ঝরনার জল মিলেমিশে গুহার দেয়ালে নীল কোয়ার্টজের
একটা আস্তরণ তৈরি করেছিল। ডাক্তার সিদ্ধান্ত পরে আরও অনেকবার ওখানে গিয়ে আরও অনেক
পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন জানি। সে সব গবেষণার নথিপত্র এখন কোনও লাইব্রেরিতে আছে
নিশ্চয়ই।”
“তুমি আর যাওনি ছোটোমামি?” বুলি ঘোর ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করে।
“না রে। তারপর আমার আর যাওয়া হয়নি। আমি
অন্য জিনিস নিয়ে পড়াশুনো করতে লাগলাম যে!”
ওপরের ঘর থেকে কেউ একজন হাঁক দিল, “কল্যাণী, ওপরে আয়, চা খাবি তো!”
ছোটোমামি সদ্যপ্রাপ্ত ফ্যানেদের মিছিল
নিয়ে ওপরতলায় উঠে যায় চা খেতে।
খুব ভালো লাগল
ReplyDeleteবেশ অন্যরকম
ReplyDeleteকি ভালো লাগলো। ছোটমামীকে নিয়ে আরো গল্প লিখো।।
ReplyDeleteবাহ্, আমিও ছোটো মামির ফ্যান হয়ে গেলুম।
ReplyDelete