সবুজের সন্ধানে, রণকপুর – কুম্ভলগড়
সুদীপ্ত ঘোষ
বারান্দার
সামনেই তিরতির করে বয়ে চলেছে সরু ফিতের মতো নদী। নাম জানি না। আদৌ আছে কিনা তাও
জানা নেই। নদীর গা ঘেঁষে উঠে গেছে উঁচুনিচু ঢেউ খেলানো পাহাড়। সারা গায়ে তার গাছ
পোশাক। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে আমলকী, বট, অশ্বত্থ, নিম, পলাশ, মহুয়া। একটু আগেই
এক পশলা ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে গেছে। গাছের পাতার ডগায় তখনও আলগোছে লেগে আছে বৃষ্টির
জল। আরাবল্লী শৈলশিরা ছুঁয়ে জমাট মেঘের উষ্ণীষ। একটা ফিঙে কাঁটাতারের বেড়ায় বসে
লেজ দোলাচ্ছে। দেবপ্রিয়া ততক্ষণে দেখে নিয়েছে একটা ‘কপারস্মিথ বারবেট’, আর একটা
‘ইন্ডিয়ান ইয়েলো টীট’। সবেমাত্র পৌঁছেছি। রণকপুর। পালি ডিস্ট্রিক্ট,
দক্ষিণ রাজস্থান। হোটেলের ঝুল বারান্দায় ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ হাতে প্রকৃতির
মুখোমুখি আমরা চার জন।
রাজস্থান
নামটা শুনলে বাঙালীদের মনে বোধহয় মরুভূমির কথাই আসে। অন্ততঃ আমার তো তাই আসত। রণকপুর সেই
অর্থে ভ্রমণপিপাসু বাঙালীদের কাছে তেমন জনপ্রিয় নয়। কিন্তু বর্ষায় দক্ষিণ রাজস্থান
অনবদ্য। পাহাড়, জঙ্গল, ইতিহাসের এক অপূর্ব মিশেল।
রণকপুরের জঙ্গল |
জয়পুর
থেকে বেরিয়েছি অনেক সকালে, তারপর আজমের, দেওগড়, দেসুরী হয়ে রণকপুর। প্রায় তিনশো
ষাট কিলোমিটার রাস্তা। পিচ ঢালা মসৃণ জাতীয় সড়ক। শীতের ধূসর ন্যাড়া
পাহাড় এখন বর্ষার মমত্বে গাঢ় সবুজ। অনুচ্চ টিলার পিছনের ব্যাকড্রপে
শ্লেট রঙা আকাশ। ‘ভীম’ পার হতেই রাস্তা অনন্য সুন্দর। আরাবল্লীর বুক চিরে উঁচুনিচু
রাস্তা... পার হয়ে যাচ্ছি কত প্রাচীন জনপদ। গাড়ি থামল। সাময়িক জলপান বিরতি।
গরমাগরম আলু পরোটা আর চা দিয়ে উদরপূর্তি করে আবার ছুটে চলা। দেসুরীর পর
থেকে রাস্তা আরও নির্জন, ছায়া ঘেরা। সাপের মতো এঁকে বেঁকে চলেছে বহুদূর,
কখনও একটু ঢেউ খেলানো...। আবার বিরতি। রণকপুরের বিখ্যাত ‘জৈন মন্দির’। অসাধারণ
শৈল্পিক নিদর্শন। মন্দির দর্শন সাঙ্গ করে আবার ছুটে চলা।
কিছুটা
চড়াই ভেঙে আমাদের আস্তানা, একেবারে জঙ্গলের মাঝে। রিজার্ভ ফরেস্ট। গাড়ি থেকে নেমেই
টের পেলাম চারিদিকে অদ্ভুত নৈঃশব্দ। নিস্তব্ধতা চিরে মাঝে মধ্যে ছুটে চলেছে গাড়ি। দিনের
বেলাতেই ঝিঁঝিঁর ডাক শোনা যাচ্ছে। চেক ইন করেই চেয়ার পেতে বসে পড়েছি ঝুল
বারান্দায়।
* * *
দুপুরে
লাঞ্চের পর হাঁটতে বেরোলাম নদীর ধার ধরে, বর্ষায় জঙ্গলের ভিতরে ঢোকা নিষেধ। ‘জঙ্গল
সাফারি’ বন্ধ থাকে এইসময়। বেশি পয়সা দিয়ে নিয়ম ভাঙতে ইচ্ছে করল না। ঝিম ধরা দুপুর।
পাতার খসখস শব্দে দুপুরের আলস্য মাখা। এক ঝাঁক ছাতারে পাখি পাশাপাশি বসে আছে। গুণে
দেখলাম ওরা পাঁচ জন। বয়স্ক বট গাছটাকে ঘিরে অজস্র ঝুরি নেমেছে। পাতার ফাঁকে লাফিয়ে
বেড়াচ্ছে বসন্তবৌরি। একটা নয়, অসংখ্য। খানিকটা এগোতেই চোখে পড়ল ‘ইন্ডিয়ান গ্রে
হর্ণবিল’। মেঘলা
আকাশ ঘন হতে শুরু করেছে। ফেরার পথ ধরলাম। পাশের ঘাসজমিতে বাঁশপাতির দল তখন
সান্ধ্যাহারে ব্যস্ত। ব্যালকনিতে চায়ের কাপ হাতে বসতে না বসতেই উলটোদিকের পাহাড়ের
গা বেয়ে নেমে এল বুনো শুয়োরের পাল। ক্যামেরা বের করার আগেই, ধাঁ। পাহাড়ের গা বেয়ে
মেঘের কুয়াশা নামতে শুরু করেছে। ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙের কোরাসে জমে উঠেছে সন্ধ্যার আগমনি। উপত্যকা
জুড়ে তখন শুধুই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। আর অন্ধকারের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে নিস্তব্ধতা।
কানে ভেসে আসছে শুধু প্রবহমান নদীর মূর্ছনা। এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। তাই
ঝঞ্ঝাট থেকে সাময়িক মুক্তি।
পাশাপাশি, একঝাঁক ছাতারে |
* * *
পরদিন
সকালে ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। সামনের খোলা ঘাসজমিতে অজস্র পাখি। কাকে ছেড়ে কাকে
দেখি! বুলবুলি, খঞ্জনা, মুনিয়া, মৌটুসি, শ্যামা, সোনা বৌ। আকাশ একইরকম মেঘলা।
ভোরের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে, বাতাসে হালকা শীতের ভাব। জঙ্গলের দিক থেকে ভেসে
এল ‘অ্যালার্ম কল’। হনুমানের দল তারস্বরে হৈ হল্লা জুড়েছে। এখানে বাঘ নেই। সামনের
নদীতে লেপার্ড জল খেতে আসে মাঝেমধ্যে। দূরবীন চোখে খোঁজাই সার... ঘন ঝোপের আড়ালে
কিছুই দেখা গেল না।
ব্রেকফাস্ট
করে চললাম ‘কুম্ভলগড় ফোর্ট’ দর্শনে। ‘কুম্ভলগড় ফোর্ট’ আয়তনে রাজস্থানের দ্বিতীয়
বৃহত্তম। পনেরশো শতকে ‘মেওয়ার’ বংশের ‘রাণা কুম্ভ’ এই দুর্গটি নির্মাণ শুরু করেন।
কুম্ভলগড় ফোর্ট |
সুদীর্ঘ
প্রাচীর বেষ্টিত এই ফোর্ট ‘ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের’ অন্তর্ভুক্ত। শুধু
দৈর্ঘ্যে নয়, প্রস্থেও প্রাচীরটি এতটাই চওড়া যে সাতটি ঘোড়া পাশাপাশি অনায়াসে চলতে
পারে।
বাদল মহল থেকে ফোর্টের প্রাচীর |
সাতটি
অতিকায় দরজা বা পোল অতিক্রম করে প্রবেশ করতে হয় এই দুর্গে। দুর্গের ভিতরেই ছড়িয়ে
ছিটিয়ে আছে অসংখ্য মন্দির। প্রাচীন স্থাপত্যরীতির অসাধারণ নিদর্শন। দুর্গের আনাচে
কানাচে জড়িয়ে আছে ইতিহাস।
ইতিহাসে
বিচরণ করতে করতে এসে পৌঁছালাম মূল রাজপ্রাসাদে। ‘বাদল মহল’। ‘কুম্ভলগড় ফোর্টের’
সর্বোচ্চ বিন্দু, যেখানে হাত বাড়ালেই মনে হয় মেঘ ছোঁয়া যায়...।।
দৈনন্দিন
জীবনের ক্ষণিকের বিরতি শেষে পরদিন আবার ফিরে চলা... সেই কংক্রিটের জঙ্গলে, যে
জঙ্গলের রংটা ধূসর।
বাদল মহল থেকে...। কুম্ভলগড় ফোর্ট |
_____
ছবিঃ লেখক
No comments:
Post a Comment