সোনার পালক
সুমন মিশ্র
এক
পিয়ালপুরের শাল বনে তখন সন্ধে সবে নামবে নামবে করছে। বিকেলের
আলো মরে এসেছে প্রায়। আকাশের
বুকে লালচে আভা। চারদিকে ঘরফেরতা পাখিদের গুঞ্জন। শুকনো হাওয়া বইছে শনশন করে। তাপমাত্রা কমছে দ্রুত। শীতটা
কয়েকদিন হল বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। সন্ধে নামলেই ঘন কুয়াশা এসে চাক বাঁধবে চারপাশে।
শালের ঘন বনের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে হাতির বৃংহণ।
কদাচিৎ কানে আসছে হরিণের ডাক। দশরথ তার ঝরঝরে বাড়ির উঠোনে বসে উনুন জ্বালানোর
চেষ্টা করছিল। গায়ে এক বিবর্ণ সোয়েটার, মাথা গলা পেঁচিয়ে একটা ফ্যাকাশে মাফলার। তাড়াতাড়ি
আজ তাকে রাতের খাবার তৈরি করতে হবে, আজ তার
নৈশপ্রহরীর দায়িত্ব।
দশরথ হল পিয়ালপুর জঙ্গলের বনরক্ষী। সেই কোন কালে কাকার সঙ্গে এসেছিল
এখানে, তখন সে সদ্য কিশোর। তারপর থেকে এখানেই থেকে গেছে। কম তো নয়, আজ পনেরো বছর হয়ে গেল। বয়স বেড়েছে, অভিজ্ঞতা বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে মায়া। কখন যে দশরথ থেকে সকলের দাশুদা
হয়ে গেছে, সে মনে করতে পারে না। বিয়ে-থা করেছে বটে, কিন্তু সংসার তাকে বিশেষ টানে না। বছরে দু’বার দেশের বাড়ি যায়। দু’দিন
থাকতে না থাকতেই কাজের জায়গায় ফেরার জন্য মন হাঁসফাঁস করে। এই শালের জঙ্গল, পাখির ডাক, প্রকৃতির স্নেহ এসব ছেড়ে সে আর থাকতে
পারে না। কাজ না থাকলেও মাঝে মাঝে জঙ্গলে সে একা ঘুরে বেড়ায়। সহকর্মীরা বলে পিয়ালপুরের
জঙ্গলকে দশরথ তার হাতের তালুর মতোই চেনে।
নিজের দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠাবান বলে দশরথ আগের ফরেস্ট
অফিসার অজয় সেনগুপ্তের স্নেহভাজন ছিল। অজয় সেনগুপ্ত ছিলেন ডাকসাইটে অফিসার। কোনোরকম বেনিয়ম
তিনি বরদাস্ত করতেন না। তাঁর সময়ে কোনোরকম দুর্নীতি পিয়ালপুরকে স্পর্শ করতে
পারেনি। কম কথা বলা রাশভারী প্রকৃতির মানুষটিকে বাকি সবাই ভয় পেত, কিন্তু দশরথকে
তিনি নিজের অনুজের মতোই দেখতেন। অবসর সময়ে অজয়বাবুর বাংলোর বারান্দায় বসে দশরথ এই
শালবনের গল্প করত, তার এত বছরের কত শত অভিজ্ঞতার গল্প উজাড় করে দিত। অজয়বাবু বলতেন
– দশরথ, এই পিয়ালপুরের জঙ্গল তোমার সঙ্গে কথা বলে, এখানকার পশুপাখি তোমার বৃহত্তর
পরিবারের অংশ হয়ে গেছে। যারা নিজের কাজকে সত্যিই ভালোবাসে তুমি তাঁদের দলে অন্তর্ভুক্ত। দেখ, নিজের মনটাকে কখনোই পরিবর্তিত
হতে দিও না।
ভবিষ্যতের কথা বিধাতাই জানেন, তবে দশরথের মনে হয় তার
মনের পরিবর্তন এ জীবনে আর সম্ভব নয়।
মাস ছয়েক হল পিয়ালপুরে নতুন ফরেস্ট অফিসার এসেছেন, মেঘনাদ দাশগুপ্ত। চারিত্রিক দিক থেকে তিনি অজয় সেনগুপ্তের বিপরীত মেরুর। হাসিখুশি,
সকলের সঙ্গে তাড়াতাড়ি মিশে যেতে পারেন। বনকর্মীদের মধ্যে ইতিমধ্যেই তিনি বেশ
জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।
গত ছয় মাসে দশরথ মেঘনাদবাবুরও যথেষ্ট স্নেহভাজন হয়ে উঠেছে। কিন্তু অজয়বাবুর
সঙ্গে যে আত্মিক টানটা সে অনুভব করত, সেটা মেঘনাদ দাশগুপ্তর ক্ষেত্রে সে অনুভব করে
না। তবে তাতে নিজের দায়িত্ব পালনে তার কোনও অসুবিধা হয় না। যা খবর সে সংগ্রহ করতে পারে
প্রথমেই এসে জানায় মেঘনাদ দাশগুপ্তকে।
আবার হাতির ডাক ভেসে এল, দূর থেকে।
দশরথ আপন মনে মাথা নাড়ল। গতকাল রাত তখন গভীর, চারদিকে ঝিঁঝিঁ
পোকার ডাক
আর বন্য জন্তুদের আওয়াজ মিশে গা ছমছমে পরিবেশ। তখন হঠাৎ জঙ্গলের উত্তরপ্রান্ত থেকে
ভেসে এসেছিল গুলির আওয়াজ। একবার। দুবার। তিনবার। সঙ্গে ভেসে এসেছিল হাতির আর্ত
চিৎকার। তখনই দশরথ বুঝে গিয়েছিল অনর্থ হয়ে গেছে।
সকালে অফিসার সাহেবের গাড়িতে গিয়ে জায়গাটা খুঁজে বের
করতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছিল। জঙ্গলের গভীরে শেষ অবধি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল সেই
নিরীহ প্রাণীটির নিথর দেহ। দাঁত দুটো কেটে নেওয়া হয়েছে।
সেই থেকে দশরথের মন মেজাজ খারাপ। মানুষ এত লোভী কেন?
সুন্দর এই প্রাণীগুলোকে শুধু কিছু লাভের আশায় এরা হত্যা করে কীভাবে? এই নিয়ে গত
চার মাসে দুইবার হল। চোরাশিকারির উপদ্রব ধীরে ধীরে আবার বাড়ছে। অজয়বাবুর কড়া
দৃষ্টি ছিল এইসব ব্যাপারে। হয়তো নতুন দায়িত্ব হস্তান্তরের ফলেই মেঘনাদবাবুর সময়
লাগছে এই ব্যাপারটা সামলাতে। হয়তো তিনিও কড়া পদক্ষেপ নেবেন এই ব্যাপারে। কিন্তু এই
দুর্বল সন্ধিক্ষণের সময়টাকে কাজে লাগিয়ে চোরাশিকারিরা যে আর কত ক্ষতি করবে কে
জানে।
দুই
বনরক্ষীদের পাঁচ জনের
দলটা এগিয়ে চলেছে অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। আজ অমাবস্যা। চারদিকের মসিকৃষ্ণ
অন্ধকারকে চিরে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের হাতের জোরালো টর্চের আলো। হাতে অস্ত্র বলতেও
সামান্য একটা মোটা লাঠি। যদিও এই জঙ্গলে হিংস্র জন্তু তেমন নেই, তবে এই ঘন জঙ্গলে
নিজের আত্মরক্ষার পক্ষে এই লাঠিটা কিছুই না। ভয় জন্তুদের থেকে নয়। ভয় যারা পশুর
অধম, যারা নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নিরীহ প্রাণীদের হত্যা করে তাদের।
সেইসব চোরা শিকারিদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে বনরক্ষী বাহিনীর কোনও প্রতিরোধই টিকবে
না।
অফিসার সাহেবের হুকুম ছিল
গতকাল যেখানে চোরাশিকারের ঘটনাটা ঘটেছে তার আশেপাশে আজ যেন বন কর্মীদের এই দল
টহলদারি করে। আর কোনও অনভিপ্রেত ঘটনা এড়ানোর জন্যই এই ব্যাবস্থা। যদিও দশরথ জানে
এইসবে কোনও কাজ হবে না, চোরাশিকারিরা এত বোকা নয় যে একই জায়গায় রোজ হানা দেবে। সে
কথা সবার সামনে দশরথ বলেও ছিল। কিন্তু অফিসার সাহেব এই ব্যাপারে কর্ণপাত করেননি।
জঙ্গলের অনেকটা গভীরেই
তারা এসে পৌঁছেছে। টহলদারি গাড়ির এদিকে আসার উপায় নেই। পায়ে হাঁটা পথই একমাত্র
ভরসা। টর্চের আলো অন্ধকারকে ফালাফালা করে দিচ্ছে। এই জঙ্গলকে দশরথ নিজের গ্রামের
পথঘাটের থেকেও ভালো চেনে, তা সে দিন হোক বা রাত। এখান থেকে উত্তর পূর্বে দেড়
কিলোমিটার গেলেই একটা ওয়াচ টাওয়ার। গতকালের ঘটনাটা ঘটেছিল সেই ওয়াচ টাওয়ার থেকে
আরও এক কিলোমিটার পূবে।
হঠাৎ পাতায় ঢাকা ছোটোখাটো
একটা গর্তে পা পড়তেই পা মচকে পড়ে গেল দশরথ। অসহ্য যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল সে। নিজে
উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। দলের বাকিরা ধরাধরি করে তাকে তুলে বসাল।
কিন্তু কিছুতেই পা ফেলতে পারছে না সে। ভীষণ যন্ত্রণা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পা
ফুলে ঢোল হয়ে গেল। সে আর হাঁটতে পারছে না। সঙ্গে একটা ছোটো ফার্স্ট এড বক্স থাকেই,
তবে তাতে সরঞ্জাম যৎসামান্যই উপস্থিত। নিতাই তাড়াতাড়ি দশরথের পায়ে পট্টি
বেঁধে দিল। দলের সবাই ঠিক করল দশরথকে নিয়ে সেখানেই অপেক্ষা করবে। কিন্তু দশরথ
নাছোড়বান্দা, তার জন্য বাকিদের ডিউটিতে দেরি হয়ে যাবে, তাই বাকিরা যেন ওয়াচ
টাওয়ারে পৌঁছে তার জন্য অপেক্ষা করে। সে এই চোটটা নিয়ে একটু ধাতস্থ হলে আস্তে
আস্তে না হয় এগিয়ে গিয়ে ওয়াচ টাওয়ারে দেখা করবে।
বলা বাহুল্য এ কথায় কারও
সায় ছিল না। অবশেষে ঠিক হল সবাই এগোলেও নিতাই থাকবে দশরথের সঙ্গে। দশরথ কিছুটা ধাতস্থ হলে তাকে নিয়ে
সে যাবে বাকিদের কাছে।
এরপর আরও ঘন্টাখানেক
সেখানেই কাটাতে হল। পায়ের ব্যথা আগের থেকে কমলেও এতটা পথ যাওয়ার অবস্থা ছিল না। বড়ো
জোর লাঠিতে ভর দিয়ে দশরথ দাঁড়াতে পারছে, কিন্তু হাঁটতে গেলেই সমস্যা।
নিতাই পাশেই বসেছিল।
একবার চোটের জায়গাটা সে পরীক্ষা করে বলল, “নাঃ। বুঝলে দাশুদা, পা ভাঙেনি এই তোমার
অনেক ভাগ্যি। তবে যা ফুলে আছে তাতে ভোগাবে মনে হয়।”
দশরথও কিছু একটা বলতে
যাচ্ছিল। কিন্তু এমন সময় একটা কাণ্ড হল। দশরথের কানে ভেসে এল ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি। খুব
ক্ষীণ, কিন্তু দশরথের বুঝতে ভুল হল না।
“এই নিতাই, শুনতে পেলি?”
“কী দাশুদা?” নিতাই খেয়াল
করেনি।
“আরে ওই যে...” দশরথ কথা
শেষ করতে পারল না। কোথা থেকে যেন একরাশ কুয়াশা এসে জড়ো হল চারপাশে। তবে সাধারণ
কুয়াশা নয়। বেশ ঘন আর নীলচে। কুয়াশা না বলে ধোঁয়া বলাই উপযুক্ত হবে। সেই ধোঁয়া
চোখে গেলে জ্বালা ধরাচ্ছে অল্প। চারপাশটা আবছা নীল আভায় ছেয়ে গেছে। বাতাসে একটা ঘোর লাগানো সুবাস।
দশরথের কেমন ঝিম ধরে যাচ্ছে। সে দেখল নিতাই কেমন নেতিয়ে পড়েছে। ঘুমোচ্ছে সে।
তাড়াতাড়ি দশরথ তার মাথার মাফলার খুলে নাক পেঁচিয়ে বাঁধল। এই ধোঁয়া নাকে বেশিক্ষণ
গেলে সেও হয়তো ঘুমিয়ে পড়বে।
এসব কী! তার এই পনেরো
বছরের কর্মজীবনে এমন কিছু তো সে আগে কখনও দেখেনি। আবার ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি ভেসে এল
কানে। আগের
থেকে অনেক পরিষ্কার, আর একাধিক। এই জঙ্গলে সে কোনোদিন বুনো ঘোড়া আছে বলে শোনেনি।
ব্যাপারটা তাকে দেখতেই হবে।
আওয়াজটা আসছে পায়ে চলা
পথের ডানদিক থেকে। লাঠিতে ভর দিয়ে সে কোনোমতে এগোনোর চেষ্টা করল। ব্যাপারটা তার
পক্ষে এই মুহূর্তে বেশ কষ্টকর, তবুও তাকে দেখতেই হবে। নীলচে আভায় চারপাশের অন্ধকার
অনেকটাই তরল হয়ে গেছে। ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে কিছুটা এগিয়ে গেল সে, তারপরেই নজরে এল সেই
দৃশ্য। ঘন ঝোপের ওই পারে একটা ছোটো সমতল জমি। চারপাশে ঘন শালের জঙ্গল, অথচ মাঝখানে
এই জায়গাটায় কোনও গাছ নেই, আছে শুধু সবুজ ঘাসের গালিচা। আর সেখানেই ওই নীলাভ আলোটা
বেশি জোরালো। মাটির কাছাকাছি সেই নীলচে কুয়াশা ঘন হয়ে জমে আছে। সেখানেই চরে
বেড়াচ্ছে নয়টা ঘোড়া। সাধারণ ঘোড়া নয়, দুধসাদা তাদের গায়ের রঙ, শ্বেতশুভ্র কেশর
গ্রীবা হয়ে প্রায় পিঠ অবধি বিস্তৃত। ঘন লেজেও শুধুই শুভ্রতা। কী রাজকীয় শোভা
তাদের, কী মোহময় রূপ। আর সবচেয়ে অভাবিত জিনিসটা হল তাদের দুই পাশে রয়েছে বিস্তৃত
দুটো বিশালাকার ডানা।
দশরথের গায়ে কাঁটা দিয়ে
উঠল, অস্ফুটে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, “পক্ষীরাজ ঘোড়া!!”
নাঃ, নাঃ, তা কী করে
সম্ভব। সেই সব তো রূপকথার গল্প, ছোটো বেলায় মা, ঠাকুমার মুখে কত শুনেছে। কিন্তু
এসব বাস্তবে তার সামনে কী করে আসতে পারে। গল্প কী করে সত্যি হতে পারে! তাহলে কি সে
সব গল্প বাস্তব থেকেই নেওয়া? তাহলে কি রূপকথার কোনও চরিত্রই অবাস্তব নয়? নাকি সবটাই
তার দৃষ্টিভ্রম!
দশরথ বেশ কিছুক্ষণ চিত্রার্পিতের
মতো দাঁড়িয়ে থাকার পর নিজের চোখ কচলাল, গায়ে চিমটি কাটল। না, সে সম্পূর্ণ
স্বজ্ঞানে আছে। এসব অবাস্তব স্বপ্নের মায়াজাল নয়।
দশরথ ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে এগিয়ে
গেল আরও কাছে। সে এখন ঘাস জমিতে নেমে পড়েছে। সে ঘোড়াগুলোর আরও, আরও কাছে এগিয়ে
গেল। সেগুলো ডানা ঝাপটাচ্ছে, নিজের মনে ঘাস খেয়ে বেড়াচ্ছে।
বুকে
সাহস নিয়ে কাঁপা হাতে সে স্পর্শ করল একটা ঘোড়াকে। নাঃ, সেটা শান্তভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। দশরথ এবার বুকে কিছুটা বল পেল। ঘোড়াটার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে
লাগল। ঘোড়াটাও
তার ভালো লাগা প্রকাশ করার জন্য ডানা ঝাপটাতে আরম্ভ করল। মুখ দিয়ে হ্রেষাধ্বনি করতে লাগল। বাকি পক্ষীরাজ ঘোড়ারাও দশরথের দিকে
ধীরগতিতে এগিয়ে এল। তাদের
নিজেদের ভালো লাগা প্রকাশ করতে বার বার ডানা ঝাপটাতে থাকল।
পুরো ব্যাপারটায় দশরথ এতটাই
রোমাঞ্চিত হয়েছে যে তার চারপাশে পক্ষীরাজ ছাড়া আর কী আছে তা তার খেয়ালই নেই। খেয়াল থাকলে সে বুঝত যে এই বারংবার
ডানা ঝাপটানোর সঙ্গে সঙ্গেই সেই নীল কুয়াশা আরও আরও ঘন হয়ে চারপাশ ঢেকে দিচ্ছে। এখন আর দশরথের নাক পেঁচিয়ে বাঁধা মাফলার
তাকে বিপদমুক্ত করতে পারছে না। মাফলারের ফাঁক গলে সেই কুয়াশা, আর তার সঙ্গে সেই মিষ্টি মোহজড়ানো
সুবাস প্রবেশ করছে তার নাকে। অবশ করছে তার স্নায়ুকে। ঘুম, গভীর ঘুমের ভারে চোখের পাতা বুজে এল
দশরথের।
তিন
পরের দিন সকালে বাকি সঙ্গীরা
যখন দশরথ আর নিতাইকে কাছাকাছি দুটো আলাদা জায়গায় খুঁজে পেল তখন সকাল প্রায় ছয়টা। তখনও দু’জনে গভীর নিদ্রারত। সঙ্গীদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গার পর
দশরথ বেশ অবাক হল। কোথায়
কালকের সেই রূপকথার জগৎ, কোথায় সেই স্বপ্নিল পরিবেশ। আর পাঁচটা দিনের মতোই সাদামাটা এক
সকাল। হতভম্ব
ভাবটা কাটিয়ে উঠতে তার বেশ কিছুটা সময় লাগল। নিতাই যদিও গত রাতের কিছুই মনে করতে
পারল না,
দশরথের কিন্তু
সব মনে আছে। প্রত্যেকটা
ঘটনা, প্রত্যেকটা মুহূর্ত তার স্মৃতিতে
চিরদিনের মতো গেঁথে গেছে। তবে সে সব কথা সে নিজের মধ্যেই রাখল, কারণ পাঁচ কান হলে তারই বেশি
হেনস্থা হবে। সবাই
ভাববে বয়েসের সঙ্গে দশরথের মানসিক বিকার দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ হয়তো ঠাট্টা করেই বলবে – কী দাশুভাইয়া, আজকাল সন্ধেবেলায় আফিমের নেশা-টেশা করছ নাকি?
কাউকে কথাগুলো না বললেও দশরথ
জানত সেই রাতে দেখা প্রত্যেকটা ঘটনা সত্য। তাই দশরথ তারপরও বেশ কয়েকবার কর্মবিরতির
দিনে সেই স্থানে গেল। সন্ধে গড়িয়ে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করল শুধুমাত্র সেই অলৌকিককে
প্রত্যক্ষ করার জন্য। কিন্তু কোথায় কী। সেই অদ্ভুত ঘটনাবলির আর পুনরাবৃত্তি
ঘটল না। বেশ
কয়েকবার এইভাবে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফেরায় তার নিজেরও ধীরে ধীরে মনের মাঝে সন্দেহ দানা
বাঁধতে থাকল যে সেদিন সে আদৌ পক্ষীরাজ ঘোড়া দেখেছিল তো? নাকি সবই ছিল মায়াজড়ানো বিভ্রম?
গল্পটা এখানে শেষ হতেই পারত, কিন্তু নিয়তির লিখন কিছুটা
অন্যরকমই ছিল।
দিন পাঁচেক এইভাবে পক্ষীরাজ
ঘোড়ার সন্ধানে যাওয়ার পর দশরথ মোটামুটি হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের কাজে আবার মন লাগাল।
সেইদিনটা ছিল ঠিক পরের অমাবস্যা। একটা কাজে দশরথকে মেঘনাদবাবুর বাংলোয়
অনেকক্ষণ থাকতে হল। সন্ধে
গড়িয়ে রাত হল,
রাত আরও গভীর
হল। কাজ
যখন শেষ হল তখন বাংলোর বারান্দার টিমটিমে সাহেবি আমলের আলো ছাড়া আশেপাশে কোনোরকম আলোর
চিহ্ন নেই। সেই
আলো গড়িয়ে এসে সামনের লনের অন্ধকারকে সামান্য তরল করলেও তারপর থেকে শুধুই অন্ধকারের
সমুদ্র।
ফরেস্ট অফিসারের বাংলোটা
মোটামুটি একটা উঁচু টিলার উপর। এখান থেকে পিয়ালপুর জঙ্গলের অনেকটাই পরিষ্কার চোখে
পড়ে। ব্রিটিশ আমলে তৈরি বাংলো। সারা বাড়িটা জুড়ে একটা প্রাচীন
গন্ধ, যেন ইতিহাসের ভার বয়ে নিজেই এক জীবন্ত ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলো থেকে
একটা পায়ে হাঁটা পথ নেমে এসেছে নীচের দিকে। বাঁধানো সুন্দর রাস্তা নয়, উঁচু নিচু
পাথুরে রাস্তা। সেই পথ ধরে নিচে নামা বেশ শ্রমসাধ্য। দশরথ সেই পথ ধরেই এগোচ্ছিল। শীতের
দাপট সামাল দিতে সে গায়ের চাদরটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিল। সঙ্গী বলতে হাতের জোরালো
আলোর টর্চ। তাতে অবশ্য খুব কম পরিসরের অন্ধকারই দূর হচ্ছে। অন্ধকারে চোখ সয়ে
যাওয়ায় সামনে পিয়ালপুরের জঙ্গল এখন আবছাভাবে বোঝা যাচ্ছে। যেন কুয়াশা ঢাকা এক
রহস্যপুরী। মেঘনাদবাবু বার বার দশরথকে বলেছিলেন আজকের মতো তার বাংলোয় থেকে যেতে।
দশরথ রাজি হয়নি। তার নাকি বাড়িতে অনেক কাজ পড়ে আছে। টিলার নিচে যেখানে এই
পায়ে চলা পথ শেষ হয়েছে সেখানেই বনরক্ষীদের ছোটো ছোটো বাড়ি। আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে
পাতা জড়ো করে আগুন জ্বালানো হয়েছে সেখানে। ভেসে আসছে হালকা অস্পষ্ট পাহাড়ি গানের
সুর। দশরথের বাড়ি অবশ্য সেখান থেকেও আরও একশো দুইশো মিটার দূরে।
দশরথ আপন মনে হনুমান চাল্লিশা
গুনগুন করতে করতে নামছিল রাস্তা দিয়ে, এমন সময় একটা দৃশ্য দেখে তার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে
গেল। জঙ্গলের উত্তর দিকের সেই অংশ, যেখানে সে পক্ষীরাজ ঘোড়া দেখেছিল, ঠিক সেখানেই জঙ্গলের
ভিতর থেকে আকাশের দিকে এক আবছা নীলচে আভা ছড়িয়ে পড়েছে। তাহলে কি আজ আবার...!
তখনই তার কাছে ব্যাপারটা
পরিষ্কার হয়ে গেল। অমাবস্যার দিনই তার মানে পক্ষীরাজ ঘোড়ার দল ওই সমতল জমিতে চরতে
আসে।
কিছুক্ষণ মুগ্ধ বিস্ময়ে
দশরথ তাকিয়ে রইল সেই দিকে। তারপর আবার সাবধানী পায়ে নেমে চলল সেই পথ ধরে।
চার
এবারও দশরথ কাউকে কিচ্ছু
বলল না। শুধু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকল পরবর্তী অমাবস্যার।
পরের অমাবস্যায় বিকেল
বিকেল দশরথ পৌঁছে গেল যথাস্থানে। তারপর চুপচাপ একটা ঝোপের ধারে লুকিয়ে অপেক্ষা
করতে লাগল সেই অভিপ্রেত মুহূর্তের। ঘন জঙ্গলে দুপুরের পরেই দিনের আলো আর পৌঁছয় না,
সন্ধেও নামল ঝুপ করে। রাত বাড়ল, বাড়ল জন্তু জানোয়ারের ডাক। আরও বাড়ল ঝিঁঝিঁ পোকার
ডাক।
রাত তখন ক’টা জানা নেই,
দশরথ দেখল সামনের সমতল জমির মাঝখান থেকে হঠাৎ সেই নীল ধোঁয়া বেরোতে লাগল। প্রথমে
অল্প অল্প। তারপর গলগল করে। ধীরে ধীরে চারপাশটা ছেয়ে যেতে লাগল সেই নীল ধোঁয়ায়। দশরথও
তাড়াতাড়ি তার নাক মুখ ভালো করে বেঁধে নিল। ধীরে ধীরে একটা দুটো করে পক্ষীরাজ
ঘোড়াগুলো দৃশ্যমান হতে শুরু করল। আগের দিনের মতোই তারা শান্তভাবে ঘাস খাচ্ছে। দশরথও
এগিয়ে গেল তাদের দিকে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর কারতে লাগল। তারাও আগের দিনের মতোই
ডানা ঝাপটিয়ে আনন্দ প্রকাশ করতে শুরু করল।
তবে আজ হিসেবের বাইরে আর
একটা ঘটনাও হল। হঠাৎ জমিটার ঠিক মাঝখানের অংশটা একটা তীব্র সোনালি আলোয় ছেয়ে গেল। চোখ ধাঁধানো সেই আলোটা একটু সয়ে
আসতেই দশরথ দেখতে পেল একটা কুচকুচে কালো রঙের ঘোড়া জমির ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।
আকারে সেটা বাকিদের তুলনায় অনেক বড়ো। গায়ের রঙ কালো বটে তবে তার
উজ্জ্বলতা চোখে পড়ার মতো। আর দু’পাশে বিস্তৃত ডানা বাকিদের তুলনায় প্রায় দেড়গুণ।
তার উপর সেই ডানার পালকগুলো আবার সাদা নয়। সোনালি!! যেন পালকগুলো সব সোনার তৈরি।
সেই ঘোড়াটা তার বিশাল
ডানা দু’দিকে বিস্তৃত করে জমিটার মধ্যে চরে বেড়াতে লাগল। তার ভঙ্গিতে স্পষ্ট যে সে
বাকি দলের গতিবিধির উপর নজর রাখছে। মাথা তার সগর্বে উঁচু, চালচলনে রাজকীয় ভঙ্গী। বোঝাই
যাচ্ছে যে সে হল এই অপূর্ব জীবগুলোর দলপতি।
দশরথ খুব ধীর পায়ে
সাবধানে এগিয়ে চলল পক্ষীরাজ দলপতির দিকে। দলপতির মেজাজ কেমন তা তো সে জানে না। সাবধান তো হতেই হবে।
দশরথ গুটি
গুটি পায়ে এগিয়ে চলল সেই বিশালাকার ঘোড়াটির দিকে। দশরথ
যেই না ঘোড়াটার নাগালের মধ্যে পৌঁছল সঙ্গে সঙ্গেই দলপতি তার বিরক্তি প্রকাশ করল। প্রথমে
সে তার বিশালাকার ডানা তীব্র গতিতে কয়েকবার ঝাপটাল।
হাওয়ায় দাপট এতটাই, দশরথের মনে হল যেন এক টুকরো ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার চারপাশে।
তারপর
দলপতি নিজের পিছনের পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠে সামনের দু’পা দিয়ে সজোরে মাটিতে আঘাত
করল। একবার নয়,
বেশ
কয়েকবার। এইসব আসলে আগন্তুককে ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা।
সত্যি
বলতে দশরথ বেশ ভয়ই পেয়েছিল। প্রথমে সে দুই তিন পা পিছিয়েও গেল। কিন্তু তারপরেই
কেমন যেন একটা জেদ চেপে গেল তার। মনের সমস্ত জোর একত্রিত করে সে
এগিয়ে চলল। সে তার ডান হাতটা ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে দিল ঘোড়াটিকে
স্পর্শ করার জন্য।
দশরথ
যখন ঘোড়াটার একদম সামনে পৌঁছে গেল তখন সেই দলপতি পক্ষীরাজ
হঠাৎ একদম চুপ করে গেল। তার মধ্যে সেই আগের অসন্তোষ আর নেই। সেই অস্থিরতাও বিলীন
হয়েছে। সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দশরথের দিকে।
দশরথ
দলপতির মাথায় হাত রাখল। তারপর ধীরে ধীরে গায়ে, মাথায় হাত বোলাতে লাগল। আগের দিনের
ঘোড়াটির মতোই এটিও দেখা গেল তাতে বেশ খুশি হয়েছে। আনন্দে সে মৃদু ডানা ঝাপটাতে লাগল।
এই ডানা ঝাপটানোর মধ্যে আগের সেই অসন্তোষ আর নেই।
এমন
সময় ঘোড়াটির ডান দিকের ডানা থেকে একটা সোনালি পালক খসে পড়ল। ঘোড়াটা মাথা নামিয়ে
সেই পালকটার কাছে জোরে শ্বাস ত্যাগ করল। ফলে পালকটা স্থানচ্যুত হয়ে দশরথের পায়ের
কাছে এসে পড়ল। দশরথের বুঝতে বাকি রইল না যে দলপতি তাকে এই উপহারটা দিতে চায়।
পালকটা
হাতে নিয়ে দশরথের যেন বিস্ময় আর কাটে না। এ পালক সোনালি নয়, এ যে সোনার তৈরি।
আশ্চর্য জিনিস, পালকের মতোই হালকা, অথচ সোনার তৈরি। সে গরিব মানুষ, এ উপহার যে তার
কল্পনার অতীত। এই পালক হাতে নিয়ে তার একদিকে যেমন রোমাঞ্চ হচ্ছে তেমনই আর একদিকে
এক অজানা ভয় তাকে ঘিরে ধরছে। এক গরিব মানুষের কাছে এত দামি জিনিস কি সত্যিই মানায়?
দশরথের
চিন্তাজাল ছিন্ন করে এবার দলপতি ডানা ঝাপটিয়ে শূন্যে লাফ দিল। মাটি থেকে প্রায় বিশ
ফুট উপরে উঠে সে স্থির হয়ে উড়তে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে বাকি পক্ষীরাজ ঘোড়াগুলোও তাকে
ঘিরে গোল হয়ে উড়তে শুরু করল।
দশরথ
দেখল ক্রমশ নীলচে কুয়াশা আবার ঘন হচ্ছে। আগের দিন এরপরই সে সংজ্ঞা হারিয়েছিল। নাঃ
আজ আর তার পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া চলবে না। সে দ্রুত ছুটতে শুরু করল। যতক্ষণে সে
ঘাস জমিটার প্রান্তভাগে পৌঁছল কুয়াশা ঘন হয়ে এক হাত দূরের জিনিসও দৃশ্যমান হচ্ছে
না। ঘাসজমি থেকে উঠে সে যখন হাঁপাতে হাঁপাতে পিছনে ফিরে দেখল তখন সেখানে শুধুই নীল
কুয়াশা, পক্ষীরাজ ঘোড়ার দলকে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। নীলচে আলোটা বাড়তে বাড়তে এখন
চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে, তারপর হঠাৎ ঝুপ করে চারপাশে অন্ধকার নামল। কোথায় নীল কুয়াশা,
কোথায় পক্ষীরাজের দল, চারপাশে অসীম নিস্তব্ধতা আর ঘন রহস্যময় অন্ধকার।
দশরথ
কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে সোনার পালকটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর হরিণ পায়ে বাড়ির
পথ ধরল।
পাঁচ
পরের
সারাটা দিন দশরথ আনমনা হয়েই কাটাল। মনের মাঝে তার ঝড় চলছে। এতদিন মেঘনাদবাবুর থেকে
সে লুকিয়ে রেখেছিল সব কথা, কিন্তু এভাবে কথাগুলো সে আর চেপে রাখতে পারছে না। সোনার
পালকটার কথা মনে পড়লেই একটা অপরাধবোধ তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। সারাদিন এমনই
মানসিক টানাপোড়েনে কাটল। বিকেল হতে হতে পরিস্থিতি এমনই হল যে দশরথ ঠিক করল আজই সে
অফিসার সাহেবকে সব খুলে বলবে।
সন্ধে
তখন সাতটা। একটা কনকনে হাওয়া বয়ে চলেছে। কাঁপুনি ধরাচ্ছে সারা শরীরে। বাংলোর
বারান্দায় বসে আছেন মেঘনাদ দাশগুপ্ত। গায়ে কারুকাজ করা শৌখিন চাদর। আরাম কেদারায়
বসে তিনি গম্ভীর মুখে চুরুট খাচ্ছিলেন। সামনের টেবিলে তার সন্ধের জলখাবার
রাখা আছে।
সামনে
হাত পাঁচেক দূরে মাটিতে বসে আছে দশরথ। দশরথের কথা শেষ হয়েছে। তার যা যা বলার ছিল
সব বলে সে এখন বেশ হালকা বোধ করছে। মেঘনাদ দাশগুপ্ত যদিও দশরথের কথা শুনে মিচকি
মিচকি হাসছিলেন শুরুতে, কিন্তু দশরথ সোনার পালকটা বার করে মেঘনাদবাবুর হাতে দিতেই
তার মুখের ভাবে আমূল পরিবর্তন হয়। বিস্ফারিত চোখে কিছুক্ষণ জিনিসটা
দেখার পর কাঁপা কাঁপা হাতে তিনি তা ফেরত দিলেন দশরথকে। তারপর বেশ কিছুক্ষণ শুধুই নীরবতা।
“এই
পালকের কথা... আর যা যা তুমি বললে, সে সব কথা আমাকে ছাড়া আর কাকে কাকে জানিয়েছ?” এতক্ষণের
নীরবতা কাটিয়ে গমগমে গলায় বলে উঠলেন মেঘনাদ দাশগুপ্ত।
“বিশ্বাস
করুন স্যার, আর কেউ জানে না,” দশরথ হাতজোড় করে বলল।
“একদিকে
ভালোই করেছ আমাকে জানিয়ে। দেখ, তোমার কথায় আমার প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না। সবটাই
গাঁজাখুরি গল্প হিসাবে আমি শুনছিলাম, কিন্তু হিসাবে গণ্ডগোল করে দিয়েছে এই পালকটা।
এটা সত্যিই সোনার পালক কিনা সেটা প্রমাণ সাপেক্ষ। তবে এমন পালক আমি সত্যিই আগে দেখিনি।
সোনা যদি নাও হয়, তাহলেও এই পালক যে প্রাণীর তাকে আমাদের বিশেষ ভাবে সংরক্ষণ করা
উচিত, এই পিয়ালপুরের পর্যটন মানচিত্রে সেটা হবে নতুন এক মাইলস্টোন। যদি তর্কের
খাতিরে ধরেও নিই যে তুমি সব ঠিকঠাক দেখেছ, মানে প্রাণীগুলো সত্যিই পক্ষীরাজ ঘোড়া,
তাহলে তো আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। তোমার কথা অনুযায়ী যেখানে চোরা শিকারিদের হাতে
শেষ হাতিটা মারা গিয়েছিল, জায়গাটা তার কাছাকাছি। তাহলে তো প্রাণীগুলোর স্বার্থেই
আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত করতে হবে। ধর চোরা শিকারিরা এই প্রাণীগুলোর খোঁজ কোনোভাবে
পেয়ে গেল, তখন ওদের মৃত্যুর জন্য কি নিজেদের ক্ষমা করতে পারব আমরা?”
দশরথ
কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। চুপ করে বসে থাকল।
“আচ্ছা
অত চিন্তার কিছু নেই। অমাবস্যার দিন বললে, না? আমরা পরের অমাবস্যায় ওখানে যাব। আমি
নিজের চোখে ব্যাপারটা দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ স্থির করব।”
এর
পরের এক মাস দশরথের এক অদ্ভুত উৎকণ্ঠার মধ্যেই কাটল। অফিসার সাহেবও ফাঁকা
পেলেই তাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে পরের অমাবস্যায় তারা যাচ্ছেন সেখানে, ভুল করেও সে
যেন কথাটা পাঁচকান না করে। দশরথও শুধু মাথা হেলিয়ে জানিয়েছে
যে সে মরে গেলেও তৃতীয় কোনও ব্যাক্তিকে কথাগুলো জানাবে না।
অবশেষে
সেই দিনটা উপস্থিত হল। মেঘনাদবাবু দশরথকে সেদিন কাজ থেকে ছুটি দিয়েছিলেন। সেদিনকার
মতো রাত পাহারাও স্থগিত করে দিয়েছিলেন। বিকেলের দিকে তৈরি হয়ে নিজে চলে এলেন
দশরথের বাড়ি।
দশরথের
বাড়ি বাকি বনকর্মীদের বাড়ির থেকে কিছুটা তফাতে। যাত্রাকালে তাই বাকিদের নজর এড়িয়েই
যাওয়া যাবে। ঠিক হল সরকারি জিপ তারা ব্যবহার করবে না। পায়ে হেঁটেই তারা যাবে। বিকেল
বিকেল বেরোলে ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যাবে।
বিকেলের
আলো থাকতেই দু’জনে বেরিয়ে পড়ল। দেড় কিলোমিটার চলার পর একটা ছোটো জলার ধারে তারা
পৌঁছতেই মেঘনাদ দাশগুপ্ত বললেন, “এক মিনিট দাঁড়াও দশরথ, আরও দুইজন আমাদের সঙ্গে
যাবে।”
“আমাদের
সঙ্গে?” দশরথ বিস্মিত হয়ে বলল।
“হুম,
এসব কাজে সঙ্গে বিশেষজ্ঞ থাকলে সুবিধা হয়...”
“কীসের
বিশেষজ্ঞ?” দশরথের কন্ঠ থেকে জিজ্ঞাসা যাচ্ছে না।
“দেখতেই
পাবে...” বলেই মেঘনাদ দাশগুপ্ত পাখির মতো শিস দিয়ে উঠলেন। তার কয়েক মুহূর্তের
মধ্যেই দু’জন লোক কাছের ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। দু’জনেরই গায়ের রঙ চাপা। একজন
অনুমান ছয় ফিট হবে, আর এক জন পাঁচ আটের আশেপাশে। লম্বা লোকটার মাথায় ঝাঁকড়া
কোঁকড়ানো চুল, আর অপরজনের মাথায় টুপি। তবে সবচেয়ে যেটা নজর কাড়ছে, দু’জনের কাঁধেই
ঝুলছে অত্যাধুনিক দূরপাল্লার বন্দুক। কী ধরণের বিশেষজ্ঞ এরা!!
“বন্দুক
কেন?” দশরথ এবার গলায় জোর এনে প্রশ্ন করল।
মেঘনাদ
দাশগুপ্ত বরফ শীতল স্বরে বললেন, “যদি চোরাশিকারিদের সামনে পড়ি তখন? আর এত প্রশ্ন
কেন করছ দশরথ, প্রশ্নে প্রশ্নে আমাদের কত সময় নষ্ট হচ্ছে সে খেয়াল আছে?”
দশরথ
আর প্রশ্ন করতে পারল না, তবে তার মন সমানে কু গাইতে লাগল।
চার
জনে যখন সেই স্থানে পৌঁছল তখন চারদিকে অন্ধকার ঘন হয়েছে। টর্চ নিভিয়ে তারা ঝোপের
ধারে বসে পড়ল। শুরু হল প্রতীক্ষা।
ছয়
একসময়
ঘড়ির ডায়ালে রেডিয়ামের আলোয় সময়টা দেখে নিলেন মেঘনাদ দাশগুপ্ত। রাত ন’টা
পঁয়তাল্লিশ।
“তোমার
গল্পের চরিত্ররা কখন আসবে দশরথ? আমাকে ভুল জায়গায় নিয়ে আসনি তো?” মেঘনাদ দাশগুপ্ত শীতল
স্বরে বললেন।
“নাঃ
স্যার, এটাই সেই জায়গা, আর হিসাব মতো আজকেই তো তাদের আসার কথা। আমি তো
শুধু
সম্ভাবনার কথাটুকু বলতে পারি। আসা না আসা তো আর আমার হাতে নেই,” দশরথ নিঃস্পৃহ
গলায় বলল। তার মেঘনাদ দাশগুপ্তর ভাবগতিক সুবিধের লাগছে না।
“হুম,
এলেই ভালো। আমি আবার চালাকি জিনিসটা ঠিক পছন্দ করি না।”
এই
মেঘনাদ দাশগুপ্তকে দশরথ কিছুতেই যেন চিনতে পারছে না। অফিসার সাহেব আজ যেন এক অচেনা
মানুষ।
দশরথ আরও কিছু বলতে
যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই সামনের ঘাসজমির মাঝ বরাবর নীল ধোঁয়া উঠতে শুরু করল। একে
একে আগের দিনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির পর তাদের সামনে পক্ষীরাজের দল দৃশ্যমান হল।
মেঘনাদ দাশগুপ্ত
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছেন। উত্তেজনায় চেপে ধরেছেন দশরথের হাত।
“স্প্লেনডিড।
অবিশ্বাস্য!” মেঘনাদ দাশগুপ্তর উত্তেজনায় গলা বুজে আসছে।
“চলুন স্যার, সামনে যাওয়া
যাক। এরা
শান্ত জীব, কোনও ক্ষতি করবে না।”
মেঘনাদ দাশগুপ্ত দশরথের
হাত আরও জোরে চেপে ধরলেন, “চুপ। এদের ডানার পালক তো দেখছি সাদা, সোনার পালক কই?”
“সে তো দলপতির ডানায় আছে
শুধু। সে বাকিদের থেকে কিছুক্ষণ বাদে আসে।”
“তাহলে আমাদেরও আর একটু
অপেক্ষা করতে হবে দশরথ।”
এমন সময় সেই সোনালি আভা
ছড়িয়ে সামনে এল পক্ষীরাজদের দলপতি।
দশরথ দেখল সেই অবর্ণনীয়
মায়াময় সৌন্দর্য দেখে বিস্ময়ে বাকিরা কাঠের পুতুলের মতোই স্তব্ধ হয়ে আছে।
কোঁকড়া চুলের লোকটা ফিসফিসিয়ে
বলল, “স্যার, কালোটাকে মারলেই আর
চিন্তা করতে হবে না। কম সে কম লাখ ছয়েক পাওয়া যাবে।”
দশরথ চমকে তাকাল, এসব কী শুনছে! দেখল কোঁকড়া
চুলের লোকটা বন্দুক তাক করেছে পক্ষীরাজের দলটার দিকে।
“হুম, ঠিকই বলেছ রফিকুল। এবার
কাজ শুরু করতে হবে, কুইক। রফিকুল, তুমি দলপতির ব্যবস্থা কর। রমেশ তুমি বাকিগুলোর মধ্যে যে কোনও
একটাকে টার্গেট কর। দলপতি
যেন প্রাণে মরে,
অপরটাকে শুধু
আহত করবে। মরা
হাতি যদি লাখটাকা হতে পারে, তবে জীবন্ত পক্ষীরাজ ঘোড়া আমাদের কোটিপতিও করতে পারে,” মেঘনাদ দাশগুপ্ত চাপা স্বরে
বললেন।
দশরথ তীব্র প্রতিবাদ করে উঠল, “এসব কী হচ্ছে! ওঃ তাহলে আপনিই
এই চোরাশিকারিদের মাথা?” বলতে বলতে সে কলার চেপে ধরল মেঘনাদ দাশগুপ্তর। সঙ্গে সঙ্গেই তার পিঠে চোরাশিকারিদের
মধ্যে একজন বন্দুকের বাট দিয়ে জোরে আঘাত করল। তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে দশরথ
মাটিতে পড়ে গেল। তার
সেই আর্তনাদে পক্ষীরাজের দলটির মধ্যেও একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল যা মেঘনাদ
দাশগুপ্তর নজর এড়াল না।
মেঘনাদ দাশগুপ্ত পকেট থেকে
পিস্তল বার করে দশরথের মাথায় ঠেকালেন।
“তুমি আমাদের কাজটা অনেক সহজ
করে দিয়েছ দশরথ। হাতি কি আর ঘন ঘন শিকার করা যায়? এমন দুর্লভ শিকার খুঁজে
দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু দুঃখিত, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তোমায় বাঁচতে দিতে পারছি না। আগে এই কাজটা শেষ হোক তারপর তোমার
ব্যবস্থা করব।” তারপর শিকারিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী হল? নিশানা লাগাও জলদি।”
এমন সময় তাদের ঠিক পিছন
থেকে ঘোড়ার ডাকের আওয়াজ ভেসে এল। কখন যেন দুটো পক্ষীরাজ ঘোড়া সকলের অগোচরে তাদের
পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সেই দুটো ঘোড়া প্রায় একই সঙ্গে পিছনের পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে
উঠল। তারপর সামনের দুটো পা দিয়ে সজোরে একটা ঘোড়া আঘাত করল মেঘনাদ দাশগুপ্তর বুকে, আর
একটা আঘাত করল রফিকুলের বুকে।
হঠাৎ আঘাতে মেঘনাদ
দাশগুপ্ত ছিটকে পড়লেন ঘাস জমির মধ্যে, হাত থেকে ছিটকে গেল পিস্তল। রফিকুলও ছিটকে পড়ল
একটু দূরে, তারপর কাতরাতে কাতরাতে গড়িয়ে নেমে গেল ঘাস জমির মধ্যে।
রমেশ প্রাণভয়ে দৌড়ে পালাল
ঘাসজমির দিকে। সঙ্গে সঙ্গেই দুটো ঘোড়াও তার পিছু নিল। বাকি পক্ষীরাজ ঘোড়াগুলোও এসে
ঘিরে ফেলল তিন জনকে।
মেঘনাদ দাশগুপ্ত আঘাত সয়ে
উঠতে পারেননি তখনও। একই
জায়গায় পড়ে ছিলেন। পক্ষীরাজের দল বারংবার আঘাত করতে লাগল রফিকুল আর রমেশকে। এখন
তাদের শুধু রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে আছে ঘাসের উপর।
দলপতি পক্ষীরাজ তার
রাজকীয় চালে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল মেঘনাদ দাশগুপ্তর দিকে। মেঘনাদ দাশগুপ্ত হয়তো
প্রবল আঘাতে ক্ষণিকের জন্য সংজ্ঞাহীন হয়েছিলেন। এখন জ্ঞান ফিরতেই চার পাশ হাতড়ে
পিস্তলটা হাতে তুলে নিলেন। তারপর সেটা দিয়ে দুর্বল হাতে নিশানা লাগানোর চেষ্টা করলেন
পক্ষীরাজ দলপতির দিকে। কিন্তু সেই সুযোগ তিনি পেলেন না। দলপতি তীব্র গতিতে লাফিয়ে
উঠে সামনের পা দিয়ে আঘাত করল মেঘনাদ দাশগুপ্ত মাথায়। ফরেস্ট অফিসারের রক্তাক্ত
দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
দশরথ তার সমস্ত ব্যাথা
যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। ততক্ষণে অবশ্য সেই আগের দিনের
মতো দলপতি ডানা ঝাপটিয়ে শূন্যে লাফ দিয়েছে। মাটি থেকে অনেক উপরে উঠে সে স্থির হয়ে
উড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে বাকি পক্ষীরাজ ঘোড়াগুলোও তাকে ঘিরে গোল হয়ে উড়ছে। ক্রমশ নীল কুয়াশা ঘনীভূত হল এবং
আগের দিনের মতোই হঠাৎ ঝুপ করে অন্ধকার হল চার পাশ। সবকিছু মিলিয়ে গেছে। না আছে
পক্ষীরাজের দল, না আছে তিন চোরা শিকারির মৃতদেহ।
সাত
পরের দিন সকালে দশরথ
সোনার পালকটা তার বাড়ির উঠোনে মাটিতে পুঁতে ফেলল। কিছু
জিনিস গোপনীয় থাকাই হয়তো ভালো। নিরীহ জীবগুলোর অস্তিত্ব হয়তো মানব ইতিহাসের
যুগান্তকারী আবিষ্কার হতে পারত, কিন্তু যে লোভের ধিকিধিকি আগুনের উত্তাপ গত রাতে
দশরথ অনুভব করেছে তা অচিরেই প্রাণীগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারে।
ফরেস্ট অফিসার নিখোঁজ হয়ে
যাওয়ার খবরটা সকাল হতেই ছড়িয়ে পড়ল। পুলিশ এল, জিজ্ঞাসাবাদ হল। দশরথকেও জেরার মুখে
পড়তে হল। তবে পুলিশ তেমন কিছুই প্রমাণ পেল না। উপরন্তু এই জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন
ফরেস্ট অফিসারের বাংলো থেকে এমন কিছু নথি পাওয়া গেল যা তার চোরাশিকারিদের সঙ্গে
যোগাযোগ প্রমাণ করে। খবর ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতো। সত্য কখনও চাপা থাকে না।
দশরথ তার বাড়ির উঠোনে বসে
ছিল। সে একটা ছুটির আবেদন করেছে। অনেক দিন পর তার আবার নিজের পরিবারের সঙ্গে দেখা
করতে খুব ইচ্ছে করছে। একটা লম্বা ছুটি চাই। এতদিন যাদের অবহেলা করেছে আজ সেই
আপনজনের সান্নিধ্য সে চাইছে। আচ্ছা পক্ষীরাজের দল কি আবার ফিরে
আসবে? দশরথকে তারা মনে রাখবে? না রাখুক, আর কেউ যেন প্রাণীগুলোকে খুঁজে না পায়। দশরথ
পিয়ালপুরের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তারপর ধীর পায়ে বাড়ির ভিতর
ঢুকে গেল।
_____
ছবিঃ অতনু দেব
অপূর্ব লাগল।
ReplyDeleteধন্যবাদ। :)
Delete