সহেলী চট্টোপাধ্যায়
তখন আমার বয়স কুড়ি
বাইশ হবে। এখনকার মতো মোটা চশমা পরা ভারিক্কি গোছের দিদিমণি মোটেও ছিলাম না। গ্রাজুয়েশনের
ফাইনাল ইয়ার। এখনও মনে হয় এই তো ক’দিন আগের ঘটনা। ঘটনা
বলা যাবে কিনা জানি না, কিন্তু কিছু একটা তো ঘটেছিল।
আমার মর্নিং কলেজ ছিল। রোজ সকাল সকাল বেরিয়ে যেতাম। একদিন কলেজে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে
গেল। কোনও একজন স্টাফ মারা গেছিল। আমি ফিরছিলাম। আমার একটা বন্ধু
ছিল ইতি। একসঙ্গে যাতায়াত করতাম। কিন্তু ইতি সেদিন আসেনি। আমি একা টুকটুক করে
হাঁটছি। বাস ধরব বলে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল হঠাৎ। ছাতা খুলতে খুলতে বেশ খানিকটা
ভিজে গেলাম। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি যদি একটা মাথা গোঁজার আস্তানা পাওয়া যায়। সামনে
একটা বিউটি পার্লার দেখে ঢুকে পড়লাম।
পার্লারটা একদম নতুন
হয়েছে। ঢুকতেই মনটা অদ্ভুত একটা ভালোলাগায় ভরে উঠল। জানি না
কেন এরকম লাগছিল! মনে হচ্ছিল যেন কোথাও বেড়াতে এসেছি। বেশ সুন্দর ঝাঁ চকচকে
পার্লার। ভেতরে ঝকঝক করছে। ঝকঝকে আয়নায় নিজেকে কত সুন্দর লাগছে। কয়েকটা মিষ্টি
মেয়ে বসেছিল। আমাকে দেখে একজন হেসে বলল, কী করবে?
আমি বললাম, বাইরে বৃষ্টি দেখে
ঢুকে পড়লাম। আমি তো কিছু করাই না।
- তাহলে একটা ম্যাসাজ
হয়ে যাক।
- কিন্তু আমি কখনও এসব
করাই না। তাছাড়া আমার কাছে তেমন টাকাও নেই।
- আমরা টাকা নেব না।
-
না না, তা কী করে হয়!
- তুমি লাকি ফিফথ
কাস্টমার। তাই তুমি ফ্রিতে পাবে সব সার্ভিস।
আস্তে আস্তে আমি যেন
কেমন হয়ে যাচ্ছিলাম। ভেতরে একটা সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছিল। মনে হয় কোনও এসেন্স দিয়েছে বা
নতুন ধরনের কোনও রুম ফ্রেসনারস। আর একটা মিউজিকের টিউন ভেসে আসছে। সত্যি
মনে হচ্ছে আমি কোথাও বেড়াতে এসেছি। মনটা খুব হালকা লাগছে। খুব আনন্দ
হচ্ছে, মনে হচ্ছে আমি চিরশান্তির রাজ্যে চলে গেছি। আমি আমার কথা বলতে লাগলাম। আমাকে
যে ম্যাসেজ করছিল ওর নাম ইউনিস। এরকম অদ্ভুত নাম কেন আমি আর জিজ্ঞাসা করিনি। তার
হাতের ম্যাজিক ম্যাসাজ আমি আজও ভুলিনি। পার্লারের ভেতরটা খুব আরামদায়ক। দেয়ালে
একটা পাহাড়ি ঝরনার ছবি। ঝরনার জলধারা গড়িয়ে পড়ছে।
জলটা যে গড়িয়ে পড়ছে বোঝা যাচ্ছে। ছবির ঝরনাও কথা বলছে। নিশ্চয় এই ছবির পেছনে
বিজ্ঞান আছে। আর দেখা যাচ্ছে একটা ছোটো ঘর। পাহাড়ি জায়গায় যেমন বাংলো
টাইপের বাড়ি হয় ঠিক সেই রকম। মনে হল এই পার্লারেই থেকে যাই। এত শান্তি
এখানে। বাড়িতে সারাক্ষণ মায়ের খিট্মিট্ সহ্য করতে হয়। মা প্রচন্ড বাস্তববাদী, তাই আমার সঙ্গে বনে
না। তার চেয়ে এখানেই থেকে যাই। কিন্তু পার্লারে আমাকে রাখবেই বা কেন! ইউনিস বলছিল, তারা অন্য জায়গা থেকে
এসে এই পার্লার খুলেছে। তারপর আর কিছু মনে নেই। জানি না কেন।
পার্লার থেকে বেরুলাম
যখন তখন আর বৃষ্টি হচ্ছিল না। বেগুনি রঙের আকাশ। পাখির শিস শুনতে শুনতে
মনটা ভালোলাগায় ভরে যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে একটা
রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ল। আবার ঢুকে পড়লাম। রুমালি রুটি আর চিকেন তন্দুরি
দিয়ে লাঞ্চ করলাম। একা একা বেশ ভালো লাগছিল।
বাস ধরে বাড়ি এলাম। মা
অফিস, বাবা অফিস। তারপর কলেজের আবার ছুটি পড়ল।
একমাস পর আবার গেলাম। পার্লারের জায়গায় দেখলাম সেই পুরানো ভাঙাচোরা বাড়িটা দাঁড়িয়ে
আছে। মনে পড়ে গেল, এখানে বরাবর এই ভাঙা বাড়িটাই দেখে আসছি। এখানে কখনও
কোনও ঝাঁ চকচকে পার্লার কোনোদিনই ছিল না। পার্লার
কোথা থেকে আসবে? সেদিন কি দিনের বেলা আমি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখেছিলাম! কাছেপিঠে
রেস্টুরেন্টও নেই।
এই ছিল আমার গল্প।
তারপর কুড়িটা বছর কেটে গেছে। আমার চোখে চশমা উঠেছে। এখন পড়াই কোচিং সেন্টার করে।
মা আরও খিট্খিটে হয়েছে। প্রতিদিন বকা খাওয়াটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। একদিন কলেজের
ওদিকেই গেছি। সেই রাস্তা ধরেই হাঁটছি। অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আবার বৃষ্টি নামল।
হঠাৎ সেই ভাঙাচোরা বাড়িটার কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাড়ির জায়গায়
শোভা পাচ্ছে ঝাঁ চকচকে একটা পার্লার। ভেতরে ঢুকেই মনটা ভালো হয়ে গেল। দেখলাম
দেয়ালে সেই ঝরনার ছবি। জল গড়িয়ে পড়ছে। দু-তিনটে মেয়ে বসে গল্প
করছিল। তাদের মধ্যে একজন বলল, কী করাবেন?
ইউনিস এখনও একইরকম
আছে। বয়স শুধু আমারই বেড়েছে।
বললাম, আমি আসলে বৃষ্টি দেখে
ভেতরে ঢুকে পড়েছি। কখনও কিছু করাই না।
- তাহলে একটা ম্যাসাজ
হয়ে যাক। আপনার শরীর মন তরতাজা হয়ে উঠবে। সব স্ট্রেস কেটে যাবে।
-
কিন্তু আমার হাতে তো তেমন টাকা নেই।
-
আপনি আমাদের লাকি ফিফথ কাস্টমার। আপনি ফ্রিতে করাবেন।
ইউনিসের হাতের ম্যাসাজের পর আবার রেস্টুরেন্টে
গেলাম। সেই রুমালি রুটি আর চিকেন তন্দুরি। আজ একটা আইসক্রিম নিলাম। অবিকল
কুড়ি বছর আগের একটা দিনের মতোই সব হচ্ছে।
রাতে ঘুমিয়ে স্বপ্ন
দেখলাম ইউনিসের পার্লারের। ইউনিস হেসে বলল, আমরা আসলে পরি। কেউ
কেউ আমাদের দেখা পায়। আমরা মানুষের মন ভালো করার চেষ্টা করি, না হলে
এই নিষ্ঠুর বাস্তব দুনিয়ায় তারা থাকবে কী করে? আর কী করেই বা গল্প কবিতা লিখবে!
তুমি খুব লাকি, তাই আমাদের দেখা পেলে। ভালো থেকো। আরও ভালো ভালো লেখার চেষ্টা করো।
আবার দেখা হবে আমাদের।
পরের দিন সকালে আবার
ছুটলাম পার্লারের উদ্দেশে। কুড়ি বছর কেটে গেছে, সেই ভাঙাচোরা বাড়িটা একইরকম
আছে। শরিকি বিবাদের কারণে বাড়িটা বিক্রি হচ্ছে না।
_____
ছবিঃ সোমঋতা চ্যাটার্জী
ছবিঃ সোমঋতা চ্যাটার্জী
এমন কেন সত্যি হয় না আহা...
ReplyDeleteভালো লাগল।
সহেলী,তোমার গল্পটা পড়ব বলেছিলাম । পড়লাম সাবলীল ছন্দে কাহিনি এগিয়েছে, পড়তে পড়তে প্রশ্ন মনে জেগেছে, কেমন করে এমন ঘটনা ঘটা সম্ভব! কিন্তু, শেষে পৌঁছে চমক দিলে তুমি! অভিনব তো বটেই, বাস্তব থেকে নিয়ে গেলে ফ্যান্টাসির জগতে...আসলে, যা হয় না, তাই তো আমরা চাই !শেলি ভট্টাচার্যের সুরে সুর মিলিয়ে আমিও বলতে চাই কবিগুরুর কবিতার ভাষায়, "এমন কেন সত্যি হয় না আহা!" সুন্দর লিখেছ তুমি সহেলী!
ReplyDelete