মুকুলবাবুর
মার্স অভিযান
অরূপ
বন্দ্যোপাধ্যায়
মুকুল বৈরাগী বেজায় ভুলো মনের মানুষ। পেশার মধ্যে লেখা আর
নেশার মধ্যে ইস্কুলে পড়ানো। উলটোটা হলেই
ভালো হত - কিন্তু হয়েছে কী, একুশ বছর ধরে ইস্কুলে ইতিহাস পড়াতে পড়াতে,
পড়ানো তার নেশা হয়ে গিয়েছিল। আর লেখা? সেটাকে তিনি মনে করেন পেশা। মুশকিল হচ্ছে পেশা
হলে তাতে কিছু রোজগারপাতি হতে হয়। তা তিনি
রোজগারের চেষ্টায় কিছু লেখালেখি করে, রোজগারের দেখা না পেয়ে, এখন বলেন, “রোজগার কী
আর টাকা পয়সার মাপেই হয়? এই যে আমার লেখা পড়ে এত মানুষ আনন্দ পায়, তা রোজগারের চাইতে
কম কীসের? মানুষের ভালোবাসাই আমার পরম প্রাপ্য।”
মুকুলবাবু
ছোটোবেলায় জটায়ুর উপন্যাস পড়ে বড়ো হয়েছেন। কোন জটায়ু? আরে, লালমোহনবাবু, যিনি
ফেলুদার সঙ্গে জটিল সব রহস্য অনুসন্ধানের সঙ্গী হয়ে জটায়ু ছদ্মনামে দিস্তা দিস্তা
রোমহর্ষক কাহিনি লিখে গিয়েছেন। মুকুলবাবু ছোটোবেলা থেকে জটায়ুর ফ্যান। ইস্কুলের
ছেলেরা পাছে জেনে যায় তাদের মাস্টারমশাই এক রহস্য রোমাঞ্চ গল্প লিখিয়ে, তাই
মুকুলবাবু ছদ্মনামে লেখেন। ‘গরুড়’ নামে লেখকের লেখা বই দেখলে জানবে ওটা মুকুলবাবুর
লেখা। জটায়ুপ্রেমী মুকুলবাবু তার ছদ্মনাম ‘গরুড়’ রেখেছেন কেন, তা আমাকে জিজ্ঞেস কোরো
না, একমাত্র তিনিই এর হদিস দিতে পারবেন।
বিজ্ঞানীরা
ভুলো মনের হয়ে থাকেন, সেটা বহুজনশ্রুত। ইতিহাসের মাস্টার কেন ভুলো হতে যাবে - এই
যদি কেউ ভেবে বসে, তাহলে হয়ে যাবে মস্ত বড়ো ভুল। কেন সেটা বলি।
মুকুলবাবুর
আম্রপল্লির বাসাটা ছিল ভাড়ার। সেই বাসা ছোটো মনে হওয়ায় মুকুলবাবু তখন সবেমাত্র
তাম্রপল্লিতে ঘর ভাড়া করেছেন। বাড়ি থেকে আধ কিলোমিটার দূরে ছিল দুধের ডিপো। রোজ
তিনি ঘড়ির কাঁটা ধরে সকাল সাড়ে সাতটায় ডিপোতে যেতেন দুধ আনতে। বাড়ি থেকে দুধের
ডিপো পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া আর ফেরা, এই সময়টা ছিল গল্পের প্লট ভাঁজার উপযুক্ত সময়।
সেদিন অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছিল। বাদলা দিনে তিনি বেশ বুঝতে পারলেন, মাথায় একটা
গল্পের প্লট দানা বেঁধে উঠছে। তার গল্পের নায়ক মিলনকুমার মার্স আর জুপিটারের মধ্যে
দুর্দান্ত রকেট চালিয়ে ছুটে চলেছে। এস্টারয়েডস্ এড়িয়ে সেই ভীষণ পথে চলা বেজায়
কঠিন। রকেটের স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে, ফুটবল মাঠের দক্ষ খেলোয়াড়ের মতো মিলনকুমার মহাবেগে
ধেয়ে আসা বিশাল বিশাল পাথর এড়িয়ে এগিয়ে চলেছে মার্সের দিকে।
কমলালেবুর
রঙের মার্সের জমি ছুঁতে আর বেশি বাকি নেই, তখনি মুকুলবাবু চমক ভেঙে দেখলেন, তিনি
দুধের ডিপোর সামনে দাঁড়িয়ে। দোকানদার
একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে। চমক ভেঙে রোজকার মতো দুই লিটার দুধের প্লাস্টিকের থলে
কাঁধের ঝোলা ব্যাগে ভরে ফেলে আবার বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। পিছন থেকে
দোকানদার ছেলেটা চেঁচিয়ে উঠল, “কাকু, দামটা দিয়ে গেলেন না?”
মুকুলবাবু
বেজায় লজ্জিত। ছি ছি ছি, কী ভাবল ছেলেটা – মুকুলবাবুর মতো ভদ্র শিক্ষিত লোক দুধের
দাম না দিয়ে পালচ্ছেন? দাম মিটিয়ে আবার বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন। মিলনকুমারের রকেট
আবার চলতে শুরু করল মার্সের দিকে। যে করেই হোক মার্সের দানব থিটাকে হারিয়ে তাকে ফিরতে
হবে পৃথিবীতে। থিটার হাতে পরাজিত হয়ে মার্সের রাজা ওমেগা গ্রহাণু সেরেসে আশ্রয়
নিয়েছে। সেরেস হচ্ছে দুই গ্রহ মার্স আর জুপিটারের মধ্যের এ্যাস্টারয়েড বেল্টের
সবচাইতে বড়ো গ্রহাণু।
হেরো
রাজা ওমেগার পাঠানো সংকেত পৃথিবীতে চলে আসে ভারতের প্রেসিডেন্টের কাছে। তিনি আবার
ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর অধ্যক্ষ কিনা! তাই
তিনি অন্য তিন সেনাপ্রধানের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে, ইন্টেলিজেন্স বিভাগের সঙ্গে
যোগাযোগ করে মিলনকুমারের হাতে মার্সের দুরাত্মা থিটাকে হারানোর গুরুদায়িত্ব তুলে দিলেন।
রাজা ওমেগার আদেশে থিটাকে হারিয়ে ওমেগার হাতে রাজ্যপাট ফিরিয়ে দিয়ে মিলনকুমার ফিরে
যাবে পৃথিবীতে।
গল্পের
প্লট যখন ক্লাইম্যাক্সে, তখনই বাড়ির রাস্তা হারালেন মুকুলবাবু। অপরিচিত পাড়ায়
বিচিত্র বাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে মুকুলবাবু নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন, “পথিক, তুমি কি পথ
হারাইয়াছ?” দুর্ভাগ্যের কথা, কোনও উত্তর এলো না।
এই পাড়াটা
বেশ অভিজাত। এটাকে ঠিক তাম্রপল্লি বলে মনে হচ্ছে না। তাম্রপল্লিতে রাস্তা শুনশান
থাকে, হয় ইতিউতি দু-চারজন লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়োয় - মানে জগিং করে, আর না হয় বাড়ির
পোষা কুকুরের পিছনে দৌড়োয়। মুকুলবাবুর পুরোনো পাড়া আম্রপল্লিতে থাকে সাধারণ মানুষ।
আশ্চর্য ব্যাপার এখানে চারিদিকে লম্বা লম্বা মাথায় উঁচু বাড়ি। বাড়ির পোর্টিকোতে
ঢাউস ঢাউস গাড়ি নিঃশব্দে ঘুমোচ্ছে। কোনও লোকজনের দেখা নেই। কাউকে যে জিজ্ঞেস করে
নিজের বাড়ির হদিস জানবেন তার উপায় নেই।
সামনে
একটা টি পয়েন্ট দেখে মুকুলবাবু থমকে গেলেন। কিছুক্ষণ আগে মিলনকুমারকে কি অনায়াসেই
না পাথরের চাঁই এড়িয়ে, উড়িয়ে নিয়ে চলেছিলেন মার্সে। আর এখন টি পয়েন্ট থেকে ডান দিক
যাবেন, না বাম দিক, সে নিয়ে সংশয়ে পড়ে গেলেন।
এমন
সময় একটা লোক, উসকো খুসকো চুল, গালের দাড়ি হাওয়ায় উড়িয়ে টি পয়েন্ট থেকে মুকুলবাবুর
দিকে হেঁটে এল। কাছে আসতে শোনা গেলো, লোকটা গান গাইছে, “ডান দিকে রই না আমি বাম
দিকে রই না......।”
মুকুলবাবুর
মনে হল লোকটা অন্তর্যামী, ঠিক ধরে ফেলেছে উনি পথ হারিয়েছেন। সরু চোখে মুকুলবাবুর
দিকে তাকিয়ে লোকটা বলে উঠল, “পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?”
“তাম্রপল্লি-টা
কোনদিকে বলতে পারেন?”
লোকটা
আবার গান ধরল, “এ ভাই জারা দেখকে চলো, আগে ভি নেহি পিছে ভি......”
এ
তো আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেল, রাস্তা না বাতলে লোকটা শুধু গানই গেয়ে চলেছে। মুকুলবাবু
টি পয়েন্টের দিকে হাঁটা দিতে পিছন থেকে লোকটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠলে
মুকুলবাবুর নিজেকে বেশ অপমানিত বলে মনে হতে লাগল। যা থাকে কপালে – এই ভেবে, ডান
দিকেই হাঁটা দিলেন মুকুলবাবু। রাস্তার পাশে পাম গাছের নিচে একটা বাদামি রঙের কুকুর
শুয়েছিল। সেটা দিব্যি ঘুমোচ্ছিল, কিন্তু মুকুলবাবু কাছে আসতেই প্রথমে এক চোখ খুলে
তাকাল, তারপর হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে এল। মুকুলবাবু
এক ছুটে উলটো দিকে দৌড় লাগালেন।
কিন্তু
এ কী! শহরের পাকা রাস্তা তো নয় এখানে! এতো এবড়ো খেবড়ো ধু ধু প্রান্তর। চারিদিকে
কোনও গাছপালা নেই। লাল রুক্ষ মাটি। মিলনকুমারের রকেট যান এসে মুকুলবাবুর পাশে
ক্র্যাঁচ শব্দ করে থামল। রকেটের দরজা আপনা থেকেই খুলে গেল। ভিতরে
নীল মায়াবী আলো। মুকুলবাবু রকেটে উঠে বসলেন। রকেট শূন্যে উঠে গেল। মিলনকুমার
শক্ত চোয়াল নিয়ে ককপিটে বসে আছে। গোল জানলার কাচ দিয়ে দেখা গেল আরেকটা লাল রঙের
রকেট ধেয়ে আসছে মিলনকুমারের রকেটের দিকে। লেজার গানের আলো ঝলসে উঠল। মিলনকুমার সেই
আলো এড়িয়ে গেল নিপুণ হাতে রকেটের স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দিয়ে। শোঁ শোঁ শব্দে রকেট কখনও
ডান দিকে, কখনও বাম দিকে পাক খেয়ে তেড়ে গেল লাল রকেটের দিকে। রকেটের দোলায় ছিটকে
পড়লেন মুকুলবাবু।
“আরে
ও মশাই, বলি কেমন বোধ করছেন এখন?” লোকটা মুখের কাছে ঝুঁকে এল। লোকটার
নিশ্বাসের দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল মুকুলবাবুর। নিশ্চয়ই ব্যাটা দাঁত মাজেনি। গা
ঝেড়ে উঠে বসে মুকুলবাবু দেখেন তিনি রাস্তার পাশে ড্রেনের ধারে পড়ে আছেন। বোঝা গেল
এতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। আসলে কুকুরের তাড়া খেয়ে কতদূর দৌড়েছিলেন মনে নেই।
হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন সেটা জানান দিল পায়ের পাতা। ব্যথায় টনটন করছে। দুধের থলে
কোথায় পড়ে গেছে কে জানে। ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লেন মুকুলবাবু। ঝুঁকে এসেছিল যে লোকটা
তাঁকে এখন ভালো করে দেখলেন মুকুলবাবু। সাদা হাফ প্যান্ট আর কলার ছাড়া ক্রিম
কালারের টি শার্ট, হাতে একটা ওয়াকিং স্টিক। দেখে বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের মনে হচ্ছে।
“যাচ্ছিলেন
কোথায়? আর এখানে পড়ে জ্ঞান হারালেন কীভাবে? বাড়ি কোথায় আপনার?” সব ক’টা প্রশ্ন
টর্পেডোর মতো ধেয়ে এল মুকুলবাবুর দিকে। তিনি অসহায়ের মতো চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে দুধের
প্যাকেট খুঁজতে খুঁজতে শুধু বললেন, “তাম্রপল্লি।”
“আরে
তাম্রপল্লি তো এখান থেকে বেশ দূর! বরং চলুন, আমার বাড়িতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে
যাবেন ‘খন। একটু চা-ও খাওয়া যেতে পারে। আমিই না হয় গাড়িতে আপনাকে ছেড়ে আসব।
ভদ্রলোকের
একতলা বাড়ির সামনেটা গোলাকৃতি। সেখানে একটা ছোট্ট গাড়ি বারান্দা। ছোটো বাগানে অনেক
রকম গাছ লাগিয়েছেন – পাম, সুপুরি, নারকেল। কিছুটা জায়গা কেটে সেখানে ফুলের কেয়ারি।
ছায়া ছায়া শীতল বাড়িটা যেন ঝুম মেরে দাঁড়িয়ে। বাইরের বারান্দায় দু-তিনটি চেয়ার
পাতা, একটা বেতের টেবিল। মুকুলবাবুকে চেয়ারে বসিয়ে ভদ্রলোক
ভিতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর একটা সাদা তোয়ালে দিয়ে শরীরের ঘাম মুছতে মুছতে বেরিয়ে
এসে বললেন, “কেমন লাগছে আমার বাড়ি?”
মুকুলবাবু
ঘাড় নেড়ে জানালেন, তার ভালো লাগছে। পায়ের ব্যথাটা এখনও চিনচিন করে বেশ কষ্ট
দিচ্ছে। দুধের প্যাকেট দুটো মহাকাশ যাত্রার পথে হারিয়ে ফেলে এখন আফসোস হচ্ছে। বাড়ি
গেলে আজ কপালে কী আছে কে জানে। গিন্নীর কাছে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না।
চাকরের
হাতে বিরাট ট্রেতে চেপে চায়ের সরঞ্জাম আসা দেখে বোঝা গেল, লোকটা বেশ বড়োলোক। চায়ের
ট্রে সামনের ছোট্ট বেতের টেবিলে রেখে চাকর দু’হাত জড়ো করে নমস্কার করল। মুকুলবাবু
পায়ের ব্যথায় এমনিই কাতর, তাই ঠোঁট ফাঁক করে একটু হাসবার চেষ্টা করলেন। সুদৃশ্য
ট্রেতে সাদা রঙের টি পট, দুধের ছোট্ট পট আর একটা বোন চায়নার প্লেটে সুগার কিউব
রাখা। ঢেউ খেলানো কারুকার্য করা প্লেটে কয়েকটা ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট, কিছু ভাজা
সল্টেড কাজু। মুকুলবাবুর নিজেকে এর কাছে বেশ দীনহীন বলে মনে হল। আজ সকালে নিজের
হাতে চা করে যে কাপটায় প্রাতঃকালীন প্রথম চুমুক দিয়েছিলেন, সেটার চিড় খাওয়া
হ্যান্ডেলের কথা মনে পড়ে গেল।
“নিন,
চা খান। আপনার ক’টা কিউব লাগে?” ভদ্রলোক সামনের বেতের গোল চেয়ারে বসতে বসতে
মুকুলবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন।
“আমি,
ওই... না, মানে একটা... না না... সুগার আছে কিনা...”
“আরে
মশাই সকালে উঠে দৌড়োন। কত আর বয়েস হবে আপনার! আমি এই আটষট্টিতেও সুগার-টুগার
কিচ্ছু ঢুকতে দিইনি শরীরে, বুঝলেন কিনা। আপনি আমার থেকে ছোটোই হবেন। নিন নিন শুরু
করুন।”
মুকুলবাবু
কাজুর কয়েকটা টুকরো মুখে ফেলে চোখ বুজলেন। আঃ, কতদিন কাজু খাওয়া হয়নি। এমন একটা
জীবন যদি পাওয়া যেত! কী করে মানুষ বড়োলোক হয়ে যায় কে জানে! আর ঠিক সেই সময়, যেই না
চায়ের কাপটা হাত বাড়িয়ে নিয়েছেন, অমনি সামনের লোকটা দেখতে দেখতে একটা দানব হয়ে
উঠল। ভীষণ লম্বা কান, ঠিকরে পড়া চোখ, নির্লোম মাথা দেখে মুকুলবাবু বুঝতে পারলেন,
এই-ই হচ্ছে মার্সের দস্যু, থিটা। ভয় পেয়ে মুকুলবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, “মিলনকুমার!
কোথায় তোমার লেজার গান? দানবটাকে বধ করো, এক্ষুনি।”
মুকুলবাবুর
চিৎকারে বড়োলোক বাড়ির চাকর সেগুন কাঠের ভারী দরজা ঠেলে বারান্দায় এসে অবাক হয়ে
মুকুলবাবুর দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর তার শরীরে স্টিল রঙের স্পেস স্যুট,
মাথায় হেলমেট, কোমরে লেজার গান দেখতে পেলেন মুকুলবাবু। দানব থিটা মুকুলবাবুর দিকে
ঝুঁকে এল। মুকুলবাবু চিৎকার করে উঠলেন।
বারন্দার চালে বসা কাকেরা কা কা শব্দে উড়ে গিয়ে বাগানের পাম গাছের মাথায় বসে
চেঁচামেচি করতে লাগল। আশ্চর্যের ব্যাপার, মিলনকুমার কিন্তু থিটার উপর আঘাত হানল
না। বরং থিটার কানের কাছে কী যেন বলে উঠল। মুকুলবাবু জ্ঞান হারালেন, চোখে নেমে এল
গাঢ় অন্ধকার। তিনি যেন অন্ধ কুয়োর মধ্যে সাঁ সাঁ করে নিচে নেমে যেতে লাগলেন। হাতের
চায়ের কাপটা ফসকে গিয়ে অন্ধকারে কোথায় আছড়ে পড়ল শব্দ করে।
চোখ খুলতেই
মুকুলবাবু দেখলেন বিছানার পাশে তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। এইমাত্র ঘুম ভাঙল। কতক্ষণ
ঘুমিয়ে আছেন কে জানে? মাথাটা একটু ভারী মনে হচ্ছে। শুধু মাথা ছাড়া শরীরের বাকি
অংশরা বোধহয় ধর্মঘট করেছে। হাত পা কিছুই নাড়ানো যাচ্ছে না। চারিপাশের শব্দগুলো
একটু একটু করে বাড়ছে। মুকুলবাবুর স্ত্রী কীসব বলে যাচ্ছেন, কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না।
ঠোঁট নড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে, তিনি কিছু একটা বলে চলেছেন মুকুলবাবুর পিছনে দাঁড়ানো
কারও দিকে। একটু একটু করে স্ত্রীর কণ্ঠস্বর পরিষ্কার হল। শুনতে পেলেন, “যে দিন
থেকে ওই ইস্কুলের চাকরিটা নেই, সেদিন থেকেই দেখছি কেমন যেন অন্যরকম। মাঝে মধ্যে
বিড়বিড় করে কীসব বকে যায়। রাত জেগে লেখালেখি করে, সারা রাত ঘরের মধ্যে পায়চারি করে
আমার ঘুমের দফারফা করে... কী আর বলি আপনাকে। জানতাম একদিন একটা কাণ্ড বাধাবে।
ভাগ্যিস আজ আপনি ছিলেন। আদাড়ে বাদাড়ে পড়ে থাকলে তো জানতেই পারতাম না। আপনাকে কী
বলে যে ধন্যবাদ...”
“আরে
এসব আর বলবেন না ম্যাডাম। যে কোনও মানুষ হলে যা করত, আমিও তাই করেছি। ভাবলাম
হার্টের গোলমাল আছে। চায়ের কাপ হাতে নিতে না নিতেই উনি যেই চোখ উলটে ফেললেন, আমি
ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো, মিলনকুমার কে? নাম ধরে ডাকতে ডাকতে
অজ্ঞান হয়ে গেলেন। আমার চাকরটা যদি ঝট করে ওঁকে ধরে না ফেলত, উনি চেয়ার থেকে পড়েই
যেতেন। ভাগ্যিস সে সব কিছু...”
“যা
ভেবেছি তাই। আসলে ওর গল্পের নায়কের নাম মিলনকুমার। ওই সব ছাইপাঁশ গল্প লিখে লিখে
মাথাটা একেবারে গেছে। কতবার বলেছি, বড়োদের জন্য গল্প লিখতে পার, ছোটোদের গল্প লিখে
কী হবে, এক পয়সা রোজগার হবে না...”
“দাঁড়ান
দাঁড়ান, কী বললেন? গল্প লেখেন, মানে ছোটোদের গল্পকার? বাঃ, এ তো খুব ভালো কথা! কী
মুকুলবাবু, কী বই লিখেছেন এ যাবৎ? আমার তো পাবলিকেশন হাউস আছে। একবার উঠে পড়ুন
দেখি, আপনার গল্প না হয় আমি ছেপে দেব। এবার থেকে না হয় ছোটোদের গল্পের বই ছাপব।”
মুকুলবাবু
উঠে বসতে যেতে তার স্ত্রী হাঁ হাঁ করে চেঁচিয়ে উঠলেন, “এখন উঠছ যে! শরীর ভালো নেই
তোমার... ডাক্তার বলেছে একদম রেস্ট, মাথারও...”
মুকুলবাবু
বলেন, “ধুত্তেরি, নিকুচি করেছে শরীরের... সাক্ষাৎ ভগবান দর্শন হল আজ... কী বলে যে
ধন্যবাদ দেব আপনাকে...”
প্রকাশক
ভদ্রলোক বলেন, “আগে সুস্থ হয়ে নিন। তারপর না হয় আপনার মিলনকুমারের গল্প শুনব
জমিয়ে।”
_____
ছবিঃ
অতনু দেব
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteভীষণ ভালো লাগল।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteদারুণ লাগল
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteধন্যবাদ
DeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteThis story is another example of the author's exclusive signature style of storytelling. Enjoyable reading experience.
ReplyDeleteধন্যবাদ কৌশিক
Deleteআম্রপল্লি না তাম্রপল্লি, মুকুলবাবু আসলে থাকেন কোথায়?
ReplyDelete