শরণ্যা
মুখোপাধ্যায়
।। ১।।
বিশাল হলঘরটার মধ্যে রাখা আছে নতুন মূর্তিটা। নানাধরণের মূর্তি আর অন্যান্য আর্টিফ্যাক্ট দিয়ে ভরাট ঘরটা কোনও মিউজিয়ামের থেকে কোনও অংশে কম নয়। তবে আজকের আসা নতুন মূর্তিটা কালেক্টর মাধবেন্দ্র রায়ের কালেকশনের পালকে একটা বড়ো মুকুট তাতে সন্দেহ নেই। মূর্তিটা বহু কষ্টে নিজের কালেকশনে রাখার অনুমতি আদায় করেছেন তিনি। আজকে রাতের ঘুমটা যে শান্তির হবে তাতে সন্দেহ নেই। রাত
প্রায় বারোটা। শহর কলকাতার বুকে প্রোমোটারের হাত গলে
এখনও দাঁড়িয়ে থাকা তিন মহলা বাড়িটার সবাই শুয়ে পড়েছে। প্রমাণ
সাইজ জানালাটার কাচের মধ্যে দিয়ে গলে এসেছে চাঁদের আলো। সেই আলোয় ঘরের আধোছায়ায় ঢাকা মূর্তিটা কেন যেন রহস্যময় দেখাচ্ছে। বাইরের জানালায় শোনা গেল এক অজানা রাতপাখির ডাক, আর ঠিক সেইসময়েই, একটা কাঁপন ধরল সারা বাড়িটায়, মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের জন্য। পলক পড়ল সদ্য আনা পাথরের মূর্তিটার চোখে।
।। ২।।
“এটা আর কাউকে বলে বিশ্বাস করানো যাচ্ছে না প্রমথেশবাবু। তাই শেষমেশ আপনার কাছেই ছুটে এসেছি। ওই মূর্তিটা স্বাভাবিক নয়। ওটা পাথরের বলে মনে হলেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওটা আসলে জীবন্ত, কিন্তু সেটা আমি প্রমাণ করতে পারছি না। আমি ওই মূর্তিটাকে রাখতে চাই না, যতবার ওটাকে বিদায় করার চেষ্টা করেছি, ব্যর্থ হয়েছি।”
বসে আছি আমার নিজের বাড়ির বৈঠকখানায়। প্রমথেশবাবু এসেছেন গতকাল। সময়টা শীতকাল। বড়োদিনের ছুটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার নিজের যাবার কথা ছিল ফালুটে, প্রমথেশবাবুর বাংলোয়, কিন্তু তার আগেই এই কেসটা এসে পড়ায়, উনি নিজেই এসেছেন কলকাতায়, আর বরাবরের মতো, আমার অনুরোধে আমার বাড়িতেই উঠেছেন। প্যারানর্ম্যাল
সোসাইটির ভূতপূর্ব মেম্বার অ্যাস্ট্রোফিসিসিস্ট প্রমথেশ চ্যাটার্জী শুধু আমার বন্ধু
মানুষই নন,
সেই
“রুরু” নামের নারকীয় জীবের হাত থেকে আমাকে ও আমার বন্ধুকে উদ্ধার করার
পর, আমি
ধীরে ধীরে হয়ে উঠি ওনার এক সহকারী। নাম-ধাম
পালটে, নিজে
সর্বজয় ছদ্মনামে “রুরু” গল্পটা প্রকাশ
করি। কিন্তু তারপর থেকেই ওনার সম্পর্কে অনেক
মানুষ জানতে পারেন। তারপর “অঘোরীর কবলে”, “মানুষখেকো”, “রিপু”... একের
পর এক আমাদের বিভিন্ন অভিযানে বেরিয়ে পড়া, আর সাফল্য। সেই
এডভেঞ্চারের স্বাদ নিতেই বার বার বেরিয়ে পড়ি প্রমথেশবাবুর
সঙ্গে। আর এরকম একটা ইণ্টারেস্টিং কেস পেয়ে আমিও উৎসুক হয়ে ছিলাম, কখন ভদ্রলোক দেখা করতে আসবেন সেই কথা ভেবে।
আমার এই গরীবের কুটিরে আজ হাজির হয়েছেন, মাধবেন্দ্র নারায়ণ রায়, কলকাতার প্রসিদ্ধ রায় ফ্যামিলির বর্তমান মালিক, যাঁদের
শ্বেতপাথরের তিন মহলা রাজবাড়ি হেরিটেজ তকমা পেয়েছে। যাঁদের বিস্তীর্ণ ব্যাবসা-বাণিজ্য শুধু আর্থিক ভাবেই স্বচ্ছল করেনি তাঁদের পরিবারকে, এক গগনচুম্বী আভিজাত্যও দিয়েছে। ঠিক সকাল ন’টার সময় যখন ভদ্রলোক এলেন তখন আমাদের চা-পর্ব সবে মিটেছে। চুনোট করা ধুতি, গরদের পাঞ্জাবির ওপর দামী কাশ্মীরি শাল, সব মিলিয়ে এক পুরোনো বনেদীয়ানা ঘিরে আছে ভদ্রলোককে। বছর তিরিশেক বয়স হবে। অকৃতদার, সুপুরুষ, এবং বয়স-অনুযায়ী বেশ গম্ভীর এক মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ। দেখলেই মনে একটা ভালো লাগা তৈরি হয়। তাঁরই সংগ্রহের একটি বিশেষ মূর্তি নিয়েই ভদ্রলোক সমস্যায় পড়েছেন আর সেই সূত্রেই প্রমথেশবাবুর কাছে আসা।
প্রমথেশবাবু সেই প্রথম দিনের
মতো আজও
গম্ভীর। রাজকীয় এক রহস্যময়তা তাঁকে ঘিরে রাখে
তাঁর সমাধান করা রহস্যগুলির মতোই। এই সেই
মানুষটা যাঁর
তত্ত্বাবধানে কতশত জটিল রহস্যের সমাধান হয়েছে, যার শেষের দিকের
বেশ কয়েকটার সাক্ষী আমি নিজে। মাধবেন্দ্রবাবু আসার পর আমরা দু’জনে বসলাম ওনার কথাগুলো শোনার জন্য। আর প্রমথেশবাবু বললেন ওনার পেটেন্ট কথাটা, “প্রথম থেকে শুরু করুন।” আর তারপরই উনি শুরু করলেন এক অদ্ভুত কাহিনি।
“বাবার ব্যাবসার হাল ধরেছি আজ পনেরো বছর হল। খুব ছোটো বয়সেই বাবার অসুস্থতার জন্য ব্যাবসায় যোগ দিই। তারপর নিজের চেষ্টায় আমাদের পারিবারিক কাঠের ব্যাবসা ছাড়াও আরও নতুন কয়েকটা এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের কারবার শুরু করি, আর সেটা লাভের মুখও দেখে। বাবার একমাত্র ছেলে আমি। ব্যাবসা বা সম্পত্তির কোনও অংশীদার নেই, বাড়িতে থাকার মধ্যে আছেন আমার মা, ঠাকুমা আমাদের বহুদিনের কাজের লোক বনমালীদা, আমাদের মালী, এক ঠিকে ঝি, আমার ড্রাইভার আর আমার বংশানুক্রমিক লাইব্রেরির এক বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান। ব্যাবসার কাজে আমাকে সারা দিনই ব্যস্ত থাকতে হয়। ব্যাবসা ছাড়া যে সখটা আমার সারা জীবনের সঙ্গী, সেটা হল অ্যান্টিক কালেকশন। এগুলো নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে আর কোনও কিছুতেই আমার তেমন কোনও উৎসাহ নেই। আর বিয়েও আমি করতে খুব একটা ইচ্ছুক নই। আমি এই পুরোনো সময়টার সঙ্গেই গাঁটছড়া বেঁধেছি বলতে পারেন।
আমার বাড়ির লাইব্রেরি বা ইংরেজ আমলের হেরিটেজ আসবাবপত্র বা আমাদের সম্পত্তির সঙ্গে যুক্ত কোনও কিছুতেই আমার তেমন কোনও অবদান নেই যেমনটা আছে এই ক্ষেত্রে। আমার নিজের চেষ্টায় একটি সংগ্রহশালা আমি গড়ে তুলেছি আমার বাড়িতে। তাতে পুরোনো মূর্তি থেকে শুরু করে পুরোনো যুগের মানুষদের ব্যবহৃত বিভিন্ন আর্টিফ্যাক্ট, রত্ন, পোষাক আরও অনেক কিছুই রয়েছে। তো আজ থেকে মাস দুয়েক আগে পশ্চিম মেদিনীপুরের মোগলমারীতে একটা খননকার্য হয়েছিল। যেখানে গুপ্তযুগের বেশ কিছু মূর্তিসহ আরও অনেক কিছুই উদ্ধার করা হয়। এখন আমার নিজের এক বন্ধু এই ব্যাপারটার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সে নিজে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের বড়ো অফিসার। সে জানে আমার এইসব বিষয়ে বিশেষ আগ্রহের কথা। তার আমন্ত্রণেই গিয়েছিলাম মোগলমারী। সেখানে আরও অনেক মূর্তি ছিল, জিনিসপত্র ছিল। আমি পৌঁছেছিলাম বিকালবেলায়। তখন ওরা পর পর আবিষ্কৃত মূর্তিগুলো ওদের সাইটেই সাজিয়ে রাখছিল। সেই পড়ন্ত বিকেলের আলোয় অন্য মূর্তিগুলোর থেকে একটু যেন আলাদাই লেগেছিল এই নারীমূর্তিটি। বন্ধুকে বুঝিয়ে উপযুক্ত দামেই মূর্তিটা আমার সংগ্রহশালায় আনার ব্যবস্থা করি। প্রথম যেদিন এটা আমার বাড়িতে এল, সেদিন আমার মনটা বেশ ভালোই ছিল বুঝতেই পারছেন, নতুন মূর্তিটার আনন্দে। কিন্তু সেদিন রাতেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়। রাত তখন ক’টা বলতে পারব না। অনেক রাত। হঠাৎ সারা বাড়িটা কেঁপে উঠল মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। বাকিরা কেউ টের না পেলেও আমি পেয়েছিলাম। কারণ আমি তখনও জেগে ছিলাম উত্তেজনায়, কেন জানি না। আগেও এরকম মূর্তি অনেক কিনেছি, সেগুলোও আমার খুবই পছন্দেরও বটে, কিন্তু এর মতো টান কখনও অনুভব করিনি আগে। বার বার মনে হচ্ছিল মূর্তিটা একবার গিয়ে দেখে আসি। যদিও যাইনি। কিন্তু ওই কাঁপনটা হবার পর ধড়মড় করে উঠে বসি। আমার সংগ্রহশালা বারমহলে, আর আমরা, মানে আমি, আমার মা ও ঠাকুমা থাকি ভিতরমহলে। ঠাকুমার ঘুম খুব কড়া, আর মা ঘুমের ওষুধ খায়। তাই ওদের ঘুম ভাঙেনি। কিন্তু, আমি, ঐ ঘটনার পর আর স্থির থাকতে পারিনি। ছুটে যাই বারমহলে। গিয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখি। কিন্তু সেটা সত্যি না মিথ্যা সেটা বুঝতে বুঝতেই ব্যাপারটা থেমে যায়।
“কী দেখলেন?”
দেখলাম মূর্তিটার চোখের পাতা পড়ল। একবার না দু’বার, ভালোভাবে চোখ কচলে আরেকবার দেখতে যেতেই, দেখলাম কিচ্ছু নেই। সে রাতের মতো সেখানেই ঘটনা থেমে যায়। আর আমিও চোখের ভুল বলে গোটা ব্যাপারটা মেনে নিই। আসল ঘটনা শুরু হয় তার দিন দুই পরে। শরীর খারাপ থাকায় আমি সেদিনটা বাড়িতেই ছিলাম। মূর্তি সম্পর্কে অস্বস্তিটা যাচ্ছিল না। এ এক অদ্ভুত টানাপোড়েন, ঠিক বোঝাতে পারব না। কোনও একটা মূর্তি যা কিনা আমার নিজের কালেকশনেই আছে, সেটা এরকম বার বার করে দেখতে যাব কেন? ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। মূর্তিটা দেখে আসার ইচ্ছেটা প্রবল হল বেলার দিকে। তো গেলাম হল রুমে। গিয়েই চমকে গেলাম। দুটো অদ্ভুতদর্শন পাখি বসে আছে মূর্তিটার ওপর। গায়ের রং নীল, গলার কাছের পালকটা সাদা, চোখের মণি লাল।
আমি ঢুকে এতটাই চমকে গিয়েছিলাম যে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আর, বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, কিন্তু পাখি দুটোও সাদা ঘাড় বেঁকিয়ে আমার দিকেই তাকিয়েছিল স্পষ্ট দেখলাম, কিন্তু সেটাও ওই কয়েক
মুহূর্তই,
তারপরেই
কিন্তু আর তাদের দেখতে পেলাম না। মানে, কী বলব চোখের পলক পড়ার আগেই দেখলাম মূর্তির কাঁধের উপর পাখি্গুলো আর নেই। এত অবাক জীবনে কখনও হইনি। মাকে ডাকলাম সঙ্গে সঙ্গে। মা এলেও কিছুই বুঝতে পারল না। আর আমিও খুব বেশি কিছু ভাঙলাম না।
তারপরের দিন কিছু ঘটল না। শুধু রাতে একবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল একটা অদ্ভুত রাত পাখির ডাকে। চেনা কোনও ডাক নয়। একটা অদ্ভুত ডাক, যে ডাক শুনলে বুকের ভিতরটা কেমন করে ওঠে যেন। সারা রাত ভালো ঘুম হল না। ভোর রাতে ঝেঁপে বৃষ্টিও এল।
তার পরের দিন আরেকটা ঘটনা ঘটল। সেদিন দুপুর বেলায় খাবার পর কী মনে হতে একবার গেলাম হলের দিকে। সাধারণতঃ কালেকশন হল খোলাই থাকে ওই সময়ে ভিজিটরদের জন্য। কিন্তু গতদিন থেকে প্রবল বৃষ্টিতে কোনও ভিজিটর ছিল না, তাই দরজাটা তালা দেওয়া ছিল আর গার্ড দু’জনও সেই মুহূর্তে টিফিনে গিয়েছিল। আমি যখন কালেকশন হলে ঢুকি, তখন তাই কেউ ছিল না সেখানে, কিন্তু ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ‘মাণিক্য’ কথাটা শুনতে পাই। নারীকণ্ঠে কেউ যেন মাণিক্য নামের কাউকে ডাকছে। কিন্তু সেটাও মাত্র একবার। আর সেই ডাকটা এসেছে ঐ মূর্তি থেকেই, এ ব্যাপারেও আমি নিঃসন্দেহ। আবারও দেখলাম সেই পাখিটাকে, যেন মূর্তিটার পোষা পাখি, ঠিক বসেছে গিয়ে মেয়েটার কাঁধে। কিন্তু পলক ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই আবার সেই, পাখি উধাও!
সেদিন রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম, সেই পাথরের মেয়েটা জীবন্ত হয়ে উঠেছে আর ‘মাণিক্য’ নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসছে। ব্যাপারটা এতটাই জীবন্ত ছিল যে ঘুম ভেঙে ওঠার পরও আমার মনে হল মাণিক্য নামটা শুনতে পাচ্ছি। এ তো গেল এক রাতের কথা, কিন্তু এর পর থেকে প্রতি রাতেই এই স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করলাম। যদিও বিভিন্ন ঘটনা থাকত এক একটা স্বপ্নে, কিন্তু সব স্বপ্নেই ঐ মেয়েটা থাকত। কখনও দেখতাম যে মেয়েটা পালাচ্ছে, তার পিছনে বহু লোক মশাল জ্বালিয়ে ছুটছে, কখনও দেখতাম মেয়েটা কোনও পুরোনো প্রাচীরের গায়ে দাঁড়িয়ে গান গাইছে, কখনও দেখতাম মেয়েটা কথা বলছে সেই পাখিটার সঙ্গে। কী কথা তা বলতে পারব না, সবটাই খুব অস্পষ্ট কিন্তু খুব জীবন্ত। রাতের ঘুম মাথায় উঠল। সারাদিন বসে বসে মূর্তিটার কথা ভাবতাম, আর সারারাত ওইসব স্বপ্ন দেখতাম।
বিরক্ত হয়ে স্থির করলাম মূর্তিটা সরকারকে দিয়ে দেব। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে প্রথম দিনেই বাধা পেলাম। আমার যে বন্ধু এই গোটা ব্যবস্থাটা করে দিয়েছিল সে চলে গেছে বিদেশে। ছ-মাসের মধ্যে ফেরার কোনও কথা নেই। আমিও ছেড়ে দেবার বান্দা নই, ধরলাম আমার আরেক বন্ধুকে। যেদিন তার আসার কথা সেদিনই কলকাতা জুড়ে একটা পলিটিক্যাল ঝামেলা হল। সে আসতে পারল না। আর তারপর ত টানা চার-পাঁচ
দিন সব কিছু
বন্ধ হয়ে রইল। মাথায় খুন চেপে গেল। ঠিক করলাম নিজেই সংগ্রহশালা থেকে মূর্তিটা বার করে বাইরে ফেলে রেখে দেব, যা হয় হোক। মালী আর ড্রাইভারকে সেইমতো ডেকে নিলাম সেদিনই সকাল সকাল। কিন্তু বিধি বাম। একচুলও নড়াতে পারলাম না। আর সে রাতেই ঘটল ওই ঘটনাটা। রাত তখন প্রায় দুটো। এপাশ ওপাশ করছি, কিছুতেই ঘুম আসছিল না, এমন সময় কখন চোখটা লেগে গেছে বুঝতে পারিনি। ঘুমের মধ্যে দেখলাম মেয়েটা বসে আছে একটা গাছের তলায়। সোনালি ওড়নাটা হাওয়ার দাপটে উড়ছে। পরনে সবুজ ঘাগরাটা ছড়িয়ে আছে সারা গাছতলা জুড়ে, চোখে জল। কেমন অদ্ভুতভাবে যেন আমার দিকে তাকাল। সেটা দেখেই আমি ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। আর উঠেই সটান চলে গেলাম সংগ্রহশালায়। গিয়ে দেখি, জানি
না, বিশ্বাস করবেন কিনা…”
“দেখলেন পাথরের মূর্তির চোখে জল, তাই তো?”
প্রমথেশবাবুর বলা বাক্যের শেষ অংশটা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলেন মাধবেন্দ্রবাবু। “আপনি কী করে…”
“বলব মাধবেন্দ্রবাবু, তার আগে আপনার বাড়ি যাওয়া খুব জরুরি। আজ যেতে পারি?”
“নিশ্চয়ই, আমি তো গাড়ি নিয়েই এসেছি, চলুন!” অবাক গলায় বললেন অভিজাত ব্যবসায়ী।
।। ৩।।
উত্তর কলকাতার বুকে এখনও যে এই প্রাসাদোপম বাড়িটা টিকে আছে সেটা দেখে বড়ো ভালো লাগল। ইংরেজ
রাজত্বের সময়কালের অসামান্য কিছু স্থাপত্য রয়েছে বাড়িটিতে। এছাড়াও তাঁদের
বাড়ির দুই ব্যক্তিত্বের ইতিহাসে ভূমিকার জন্য, যাঁদের কথা আমি শুনেছি আমার বাবার কাছেই। স্বদেশীদের সাহায্য করা থেকে শুরু করে বাংলায় ডিকশনারি রচনার কাজও এ বাড়িতে হয়েছে। পা দিয়েই ভালো লাগছে, গাড়িটা ঢুকল পামবীথি দিয়ে। বিরাটাকার পোর্টিকোর সামনের নুড়ি বিছানো পথে নামলাম তিন জন। বেলা প্রায় বারোটা। ঢুকেই একটা বিশাল বসার ঘর, পুরোনো আসবাব আর একটা বিশালাকার মেরিন একোয়ারিয়াম পেরিয়ে ঢুকলাম ভিতরবাড়িতে। প্রথমেই গেলাম মাধবেন্দ্রবাবুর ঘরে। সেখানে একপ্রস্থ জলযোগের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু প্রমথেশবাবুর দেখলাম খাবার দিকে কোনও মন নেই, ঘুরে ঘুরে দেখছেন পুরোনো পেন্টিং, পঙ্খের কাজ করা দেওয়াল, টুকটাক অন্যান্য সামগ্রী।
“গোটা বাড়িটাই তো একটা মিউজিয়াম বলা চলে, আপনার!”
“কথাটা ঠিকই বলেছেন প্রমথেশবাবু, ঠাকুর্দার বাবার আমলে তৈরি বাড়ি, সেই আমলের সব কিছুই বাবা অত্যন্ত যত্ন সহকারে মেনটেন করেছেন। তারপর আমিও সেই চেষ্টাই করে চলেছি। আপনি জানেন আমাদের একটা ডুলি আছে, সেটা কোন যুগের কেউ জানে না। ঠাকুমার মুখে শুনেছি তিনি বিয়ে হবার পর ওই ডুলি চড়েই এ বাড়িতে আসেন। ও ডুলির নাকি হাজার বছর বয়স। যদিও এ কথাটা বাড়াবাড়ি। তবে শ-চারেক বছর বয়স হবে ডুলিটার। আমার আছে ওটা।”
“হুম চলুন, যাওয়া যাক আপনার সংগ্রহশালায়।”
পিতলের চকচকে হাতলওয়ালা মেহগনি কাঠের দরজা দুটো পেরিয়েই পৌঁছলাম রূপকথার রাজ্যে। কী নেই ঘরটায়, পাল সাম্রাজ্যের মহারাজের পাগড়ি, মোগল আমলের তলোয়ার থেকে শুরু করে রানি ভিক্টোরিয়ার আমলের মোহর পর্যন্ত। লম্বা হলঘরটার মধ্যে দিয়ে এক-পা এক-পা করে এগোতে এগোতেই কেমন একটা শিরশিরানির অনুভূতি হচ্ছিল, যেটা বাড়ল আমাদের আসল দ্রষ্টব্য জিনিসটির সামনে গিয়ে। একটি ফুট পাঁচেক লম্বা নারীমূর্তি। অসাধারণ কাজ শিল্পীর। একটি কিশোরী মুখ, মাথার চুল কিছুটা খোঁপার মতো বাঁধা, তাতে দুটি কাঁটা গোঁজা, আর কিছুটা খোলা, সেটা ঘাড়ের কাছে নেমে এসেছে। বড়ো জীবন্ত সুন্দর মুখ। ঘাগরা ও উড়নি পরিহিত মেয়েটি যেন এখুনি কথা বলে উঠবে। এই মূর্তি এত কাণ্ড ঘটাচ্ছে?
প্রমথেশবাবু দেখলাম মূর্তিটিকে দেখেই তন্ময় হয়ে গেলেন, ঘুরে ফিরে গোটা মূর্তিটি ভালো করে দেখলেন, আর কেন জানি না, চুলটা দেখে ওনার চোখদুটো জ্বলে উঠল। কিন্তু সেটা একবারই, তারপর
আবার সেই ভাবলেশহীন বিশ্লেষণাত্মক মুখোশটা ফিরে এল। নিস্পৃহ কণ্ঠে বললেন, আপনার লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে দেখা করব একবার।
মাধবেন্দ্রবাবুদের পৈতৃক লাইব্রেরিখানাও দেখবার মতো। লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোকের যথেষ্ট বয়স হয়েছে, সন্দেহ নেই তাতে। তাঁর সঙ্গে প্রমথেশবাবুর তো জমে গেল। ঘণ্টাখানেক ধরে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বইপত্র ভদ্রলোক দেখালেন আর প্রমথেশবাবু প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চললেন। এই বংশের ইতিহাস নিয়ে লেখা বইও রয়েছে ওই লাইব্রেরিতে। এখানে এসেই জানলাম বড়ো বংশের মধ্যে নিজেদের ইতিহাস লিখে যাবার একটা রেওয়াজ থাকে যেটা এই রায় বংশেও রয়েছে। কয়েকটি বই তো কয়েকশত বছরের পুরোনো। সেরকম একটি বই দেখলাম প্রমথেশবাবু নিবিষ্ট মনে দেখছেন। প্রত্যেকটি বই অমূল্য, কারণ পুরোনো বইগুলি প্রায় সবই হাতে লেখা ও আঁকা। অসংখ্য ছবিসমৃদ্ধ দুটি পুঁথিও রয়েছে দেখলাম, তার মধ্যে থেকে একটির ছবি তুলে নিতে বললেন প্রমথেশবাবু। আমি জানি পুরোনো পুঁথি সম্পর্কে প্রমথেশবাবুর পাণ্ডিত্য অগাধ, বুঝলাম এই লিপি থেকে কিছু পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করছেন উনি। বিনা বাক্যব্যয়ে আমার মোবাইল থেকে তুলে নিলাম বেশ কিছু ছবি। তারপরই কী হল জানি না। প্রমথেশবাবু সটান বাড়ি ফিরে এলেন।
বাড়ি ফিরে মুখে আর কোনও কথা নেই। বসে গেলেন ছবিগুলো নিয়ে রিসার্চে, আমার ল্যাপটপটা সেই যে অধিকার করলেন সে রাতে আর ফেরত পেলাম না সেটা।
।। ৪।।
তখন সকাল সাতটা হবে। প্রমথেশবাবুর ঠেলায় ঘুম ভেঙে গেল। “ওঠো ওঠো অরুণ! এ যে অবিশ্বাস্য ব্যাপার, চলো, আমাদের সাক্ষী হতেই হবে এই ঘটনার। আমি যা বুঝেছি তা যদি সত্যি হয় তাহলে আমরা এমন এক ঘটনার সাক্ষী হতে যাচ্ছি যে ঘটনা আজকের যুগে দাঁড়িয়ে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।”
তড়িঘড়ি উঠে তৈরি হয়ে নিলাম। কিছুতেই প্রমথেশবাবুর মুখ থেকে কোনও কথা এখন বার করতে পারব না। তাই যা বলছেন সেই অনুযায়ী কাজ করাই বিধেয়।
মাধবেন্দ্রকে ফোন করে বাড়িতে থাকতে বললেন প্রমথেশবাবু। আর কেন জানি না বললেন আজ রাতে আমরা ওনার বাড়িতেই থাকব। উনি যেন প্রস্তুত থাকেন। কিছুই বুঝতে পারলাম না। বার দুয়েক পুঁথিটার ব্যাপারে জানতে চাইবার পর শুধু ‘হুম’ বলে থেমে গেলেন।
বিকেল নাগাদ পৌঁছলাম মাধবেন্দ্রবাবুর বাড়ি। ভদ্রলোকও আমার মতোই অন্ধকারে। ওনার বাড়ি গিয়েই প্রমথেশবাবু চলে গেলেন মিউজিয়ামে, বার
বার করে দেখলেন মূর্তিটা। সেইসঙ্গে লাইব্রেরিতে ওই দ্বিতীয় পুঁথিটাও। সব কিছু ভালোভাবে দেখার পর আমরা ফিরে এলাম মাধবেন্দ্রবাবুর ঘরে। সন্ধ্যার জলখাবার খাবার পর প্রমথেশবাবু আবার চলে গেলেন মিউজিয়ামে, এবার ডুলিটা দেখলেন ভালো করে। ডুলিটার গায়ে বহু অদ্ভুত ছবি আঁকা আছে। সবই পুরোনো দিনের। সেটাও প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে দেখলেন। যাই হোক, আমি আর মাধবেন্দ্র বসে নানা ধরনের আলোচনায় মাতলাম। তার মধ্যে বেশির ভাগটাই ওদের ফ্যামিলির ইতিহাস-সংক্রান্ত গল্প। ওদের ফ্যামিলির নাকি বহু পুরোনো গল্প আছে। সেই গল্প নাকি গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময় পর্যন্ত বিস্তৃত। এসব গল্পে গল্পে রাত হয়ে গেল। প্রমথেশবাবু আসতেই আমরা খেয়ে নিলাম। সব কাজ মিটিয়ে বাড়ির বাকিরা শুতে যাবার পর কালেকশন হলে জমা হলাম আমরা তিন জন। এর মধ্যে আমাদের দু’জনের উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে গেছিল। কী হতে চলেছে এই শতবছরের প্রাচীন হলঘরটায়?
ঘরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিলেন প্রমথেশবাবু। গার্ডদের আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছিলেন মাধবেন্দ্রবাবু। ঘরটার সব আলো নিভিয়ে শুধুমাত্র পাথরের মেয়েটি যেখানে আছে, সেই জায়গায় স্পট আলো জ্বালিয়ে রাখলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, “মাধবেন্দ্রবাবু, আজ যা দেখতে চলেছেন তা নিজের চোখে না দেখলে কেউই বিশ্বাস করবেন না। আর আপনাকে বলি ভয় পাবেন না। যা হতে চলেছে, তা দেখে আপনার একটা শক লাগতে পারে, সেজন্য মানসিকভাবে আপনাকে প্রস্তুত করার জন্যই এই কথাগুলো বলা।”
“আমাকে কী করতে হবে প্রমথেশবাবু?” বিহ্বল স্বরে জিজ্ঞেস করলেন মাধবেন্দ্রবাবু।
“এগিয়ে আসুন, এই দেখুন মূর্তির মাথায় দুটো কাঁটা দেখতে পাচ্ছেন? একটা একটু সাদা, আরেকটা একটু বেশি কালো? ওর মধ্যে কালো কাঁটাটা মাথা থেকে খুলুন, আপনি পারবেন খুলতে। খুলে নিয়ে কালো কাঁটাটা পায়েতে থাকা আঙটের সঙ্গে লাগিয়ে দিন। আস্তে আস্তে।”
মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথা অনুযায়ী কাজ করলেন মাধবেন্দ্রবাবু। প্রথম কয়েক সেকেন্ড কিছুই হল না। তারপর হঠাৎই ডেকে উঠল এক রাতপাখি, অদ্ভুত করুণ স্বরে। আর আমরা তিনজনই স্থির মস্তিষ্কে শুনলাম একটা নাম, “মাণিক্য”। আর তারপরেই দেখলাম জীবনের অদ্ভুততম দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটা। পাথরের মূর্তিটা যেন খোলস ছাড়ছে ধীরে ধীরে, ধুলোতে অন্ধকার হয়ে গেল জায়গাটা। আর সেই ধুলোর মেঘ পরিস্কার হতেই দেখলাম সামনে জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে আছে পুরাতনী নারীমূর্তিটি, জীবন্ত, বছর আঠারোর এক তরুণী। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মাধবেন্দ্রের দিকে, আর মাধবেন্দ্র মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে আছে তার দিকে। একবার শুধু ডেকে উঠল একটি অজানা নাম ধরে, “নয়নিকা”, … ব্যস। তারপর দু’জনেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। প্রমথেশবাবু আর আমি মিলে যে কী কষ্ট করে দু’জনকে মাধবেন্দ্রের শোবার ঘর পর্যন্ত নিয়ে এলাম, সে কথা আর কী বলব।
।। ৫।।
রাত প্রায় তিনটে। বসে আছি মাধবেন্দ্রের শোবার ঘরে। জ্ঞান ফিরে এসেছে মাধবেন্দ্রের। নয়নিকা অবশ্য এখনও অজ্ঞান। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। “কী, এবার গল্পটা বলবেন তো?” মাধবেন্দ্রের দিকে ফিরে বললেন প্রমথেশবাবু।
“বলছি প্রমথেশবাবু, আমি ভাবতেই পারছি না এটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে… আমার ভাষা হারিয়ে গেছে প্রমথেশবাবু, আপনি বরং…”
“আচ্ছা, শুরুটা আমিই করে দিচ্ছি। শুনুন তাহলে, আমরা যে নেশার জন্য নানাদিকে ঘুরে বেড়াই এবং বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় ভরে ওঠে আমার ও আমার সঙ্গী অরুণেশের ঝুলি, তাতে একটা প্রশ্ন শুনতে হয়, বা করেও থাকি প্রায়শঃই, সেটা হল, ভূতে বিশ্বাস করি কিনা বা অপরপক্ষ করেন কিনা। আজ আমি একটা অন্য প্রশ্ন করছি আপনাকে, রূপকথায় বিশ্বাস করেন আপনি? জানি আপনার উত্তরটা এখন “হ্যাঁ”-ই হবে। আজ যে আমরা এক জীবন্ত রূপকথা চাক্ষুষ করলাম, যা এই পৃথিবীতে, এই যুগে আর কারোর হয়েছে কিনা তাতে ঘোর সন্দেহ আছে। যখন প্রথম মাধবেন্দ্রবাবুর সমস্যাটা শুনি তখনই আমার মনে সন্দেহটা হয়েছিল, তাই ওনার বাড়ি এসে লাইব্রেরিটায় এতক্ষণ সময় দিয়েছিলাম। জানতে পারি অন্যান্য অনেক পুরোনো বংশের মতো মাধবেন্দ্রবাবুদের বংশেও নিয়ম আছে নিজেদের ইতিহাস লিখে রাখার। তাই লাইব্রেরিয়ানের কাজ শুধুমাত্র বইগুলির দেখাশোনা করাই নয়, ইতিহাস লিখে যাওয়াও। আপনাদের এই লাইব্রেরিয়ানও সে কাজ করছেন। এই লাইব্রেরিতেই খুঁজে পেলাম প্রায় হাজার বছর আগের দুটি লিপি। সৌভাগ্যবশতঃ এই ধরণের লিপি নিয়ে আমার আগ্রহ থাকার দরুণ কিছুটা হলেও পাঠোদ্ধার করতে সমর্থ হলাম আমি। গুপ্ত যুগের শুরু মোটামুটি ৩৩০ খ্রীষ্টাব্দে ধরা হয়, এবং তা চলেছিল প্রায় ৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই সাম্রাজ্যের শেষের দিকে বৈনগুপ্ত নামে এক রাজার কথা জানা যায়, যাঁর রাজত্ব সম্পর্কে বিশেষ কিছুই ইতিহাসে জানা যায় না। তবে তাঁর গভীর অতিলৌকিকতা অনুরাগের কথা লেখা আছে এই পুঁথিতে। সেই বৈনগুপ্তের এক কন্যা ছিল, যার পুত্রের নাম ছিল মাণিক্য! এই মাণিক্য প্রেমে পড়েন এক সাধারণ ঘরের কৃ্ষক কন্যার যার নাম নয়নিকা। এই প্রেম মেনে নেননি দুই পরিবারের কেউই। তখন এক রাতে মাণিক্য আর নয়নিকা ঠিক করেন যে তাঁরা পালিয়ে যাবেন। যেমন কথা তেমন কাজ, এক পূর্ণিমার রাতে তাঁরা দু’জনে মিলে রওনা দেন। মাণিক্য ঘোড়ায়, আর নয়নিকা ডুলিতে চার বিশ্বস্ত বেহারার কাঁধে চড়ে। কথা ছিল দু’জনে রাজ্যের শেষ প্রান্তে কোনও একটি বিশেষ স্থানে মিলিত হবেন ও সেখান থেকে দু’জনে রওনা দেবেন নিরুদ্দেশের পথে। কিন্তু দুর্ঘটনাক্রমে এই ডুলিবাহকদের মধ্যে একজন বিশ্বাসঘাতক রাজা বৈনগুপ্তকে খবরটা জানিয়ে দেয়। রাজা তৎক্ষণাৎ লোক পাঠিয়ে মেয়েটিকে ধরে আনেন ও তাকে জীবন্ত কবর দেবার ব্যবস্থা করেন। এখন, যে মাঠে ওকে কবর দেওয়া হয়, তার পাশেই একটি গাছে থাকত সেই দুটি পাখি। আজ্ঞে হ্যাঁ, ব্যঙ্গমা আর ব্যঙ্গমী।এদের অস্তিত্ব ছিল এক সময়ে, যদিও আজ আর তা প্রমাণের কোনও উপায় নেই। আর হ্যাঁ, ডুলি, আপনাদের বাড়িতে কোনও এক অজানা উপায়ে সেই ডুলিটিও রয়ে গেছে, যাতে এই পুরো গল্পটিই আঁকা আছে, কিন্তু আপনারা কেউ কোনোদিন মন দিয়ে সেটা দেখেননি। সবই দৈব যোগাযোগ!
যা হোক, সেই পাখি দুটি নয়নিকাকে এই অবস্থায় দেখে খুবই দুঃখিত হয়। যখন বৈনগুপ্তের লোক মেয়েটিকে বেঁধে রেখে তার কবর খুঁড়ছিল, সেই ফাঁকে দুটি মন্ত্রপুতঃ কাঠি নয়নিকাকে দেয় ব্যঙ্গমা
আর ব্যঙ্গমী। যার দুটিকেই তারা নয়নিকার চুলে গুঁজে দেয় আর কানে কানে একটি বিশেষ মন্ত্র বলে দেয়। সেই মন্ত্রের গুণে নয়নিকার নশ্বর দেহ নষ্ট না হয়ে প্রস্তরীভূত হয়ে যায়। নয়নিকার মৃত্যুর কথা শুনে মাণিক্য যখন প্রবল শোকে আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়, তখন ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী
মাণিক্যকে গিয়ে বলে, যে সে আবার জন্ম নেবে, আর তখন নয়নিকা তার কাছে আবার ফিরে আসবে, কিন্তু সে থাকবে ঘুমন্ত। তাকে জাগাতে গেলে তার মাথায় দেওয়া দুটি কাঠির মধ্যে কালোটিকে তার পায়ের আঙটের মধ্যে লাগাতে হবে, তবেই তার ঘুম ভাঙবে। আর সে জাগলেই পূর্বজন্মের সব কথা মনে পড়ে যাবে মাণিক্যর। তাই মূর্তিটি বাড়িতে আনার পর থেকে মাধবেন্দ্র অস্থির থাকতেন। যদিও তিনি তখনও বোঝেননি যে তিনিই মাণিক্য। নয়নিকা এ বাড়িতে আসার পর আপনার ছোঁয়া পেতেই অল্প হলেও জেগে ওঠে। কিন্তু সে ওই পাথরের দেহ থেকে বার হতে পারছিল না। অতীতের বেড়াজাল পার হয়ে তাকে ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী জানিয়ে দেয় যে, যে করেই হোক তাকে মাধবেন্দ্রকে দিয়ে ঐ কালো কাঠিটা নিজের পায়ের আঙুলে লাগাতেই হবে। আর তাই ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী নিজেদের মায়া-ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাতে এই বাড়ি থেকে আপনি নয়নিকাকে বার করতে না পারেন। আজ তার ফল আপনার চোখের সামনেই। এবার বলুন, কী কী বাদ দিলাম।”
“আপনি যাদু জানেন। অজ্ঞান হয়ে যাবার পর আমি পুরো ঘটনাটাই নিজের চোখের সামনে দেখতে পাই। আর আপনি তার মধ্যে থেকে কিচ্ছু বাদ দেননি প্রমথেশবাবু।”
“সবই গুরুর
আশীর্বাদ মাধবেন্দ্রবাবু। আপনাদের যোগ ঘটিয়ে দেবার জন্য এক অনুঘটকের প্রয়োজন ছিল। আর আমার ভাগ্যে ছিল সেই অনুঘটক হওয়া। তবে আমার কথা যদি শোনেন তাহলে বলব বিয়েতে আর দেরি করবেন না। পুরোনো সময়ের সঙ্গে গাঁটছড়াটা এবার বেঁধেই ফেলুন। আর নয়নিকা যাতে আস্তে আস্তে এ যুগের উপযোগী হয়ে উঠতে পারে তা দেখার দায়িত্ব আপনার। তবে ও যে কিছুই বুঝতে পারছে না তা কিন্তু না। বুদ্ধিমতী মেয়ে ত! যাক, নিমন্ত্রণটা যেন পাই।”
উঠে দাঁড়ালেন প্রমথেশবাবু, সঙ্গে আমিও। ভালো লাগছে আজ খুব। কোনও কেস সল্ভ করে এত আনন্দ আগে পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। জ্ঞান ফিরে এসেছে মেয়েটার। হাস্যমুখ অতীতের রাজকুমার আর তার ভবিষ্যৎ রানিকে পিছনে ফেলে রেখে উদিত সূর্যের সঙ্গে আমরা রওনা দিলাম আবার নতুন কোনও রহস্যের খোঁজে।
_____
ছবিঃ জয়িতা বিশ্বাস
ছবিঃ জয়িতা বিশ্বাস
দারুণ লাগলো৷ খুব ভালো৷ আরো এরকম লেখার আশায় রইলাম৷
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ
Deleteঅপূর্ব, এক নিশ্বাসে পড়লাম, অন্য রকম রূপকথা
ReplyDelete