জলে চলে গাড়ি!
অমিতাভ সাহা
ডিজেল-পেট্রোলের মতো প্রাকৃতিক ইন্ধনের উৎস অপরিমিত নয়। দিনের পর দিন
মানুষের লাইফস্টাইল যত উন্নত হচ্ছে, ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করার প্রবণতা তত
বাড়ছে। গাড়ির সংখ্যা যত বাড়ছে, ডিজেল-পেট্রোলের ব্যবহার তত বাড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বায়ু দূষণ এবং গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের সমস্যা। অদূর
ভবিষ্যতে এসব প্রাকৃতিক ইন্ধনের ভাঁড়ার তলানিতে গিয়ে ঠেকবে, সন্দেহ নেই। তাই বিভিন্ন বিকল্প জ্বালানি দিয়ে গাড়ি চালানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা দীর্ঘদিন
থেকেই চলে আসছে। ইলেকট্রিক কার এখন ভারতে চালু রয়েছে এবং ভবিষ্যতে ব্যাপক হারে ইলেকট্রিক
কার তৈরি করে পরিবহণের ক্ষেত্রে ডিজেল–পেট্রোলের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার
পরিকল্পনা ভারত সরকারের আছে।
বিকল্প এনার্জি তৈরি করার একটি উপায় হল ফুয়েল সেল। এটি কোনও নতুন টেকনোলজি নয়। গত কয়েক দশক ধরে ফুয়েল সেল টেকনোলজি
ব্যবহার করে এনার্জি তৈরি করার প্রচেষ্টা হয়েছে। ফুয়েল সেলে সাধারণত ইনপুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়
হাইড্রোজেন গ্যাস। হাইড্রোজেন একটি অতিমাত্রায় দাহ্য পদার্থ এবং ফুয়েল হিসেবে
ব্যবহার করে এনার্জি তৈরি করা যেতে পারে।
ফুয়েল সেল অনেকটা ব্যাটারির
মতোই; এতে একটি পজিটিভ ও একটি নেগেটিভ টার্মিনাল থাকে আর মাঝখানে থাকে ইলেকট্রোলাইট
বা তড়িৎ-বিশ্লেষ্য পদার্থ (চিত্র ১)। পজিটিভ
টার্মিনালে সাপ্লাই করা হয় হাইড্রোজেন। টার্মিনাল প্ল্যাটিনামের তৈরি হয়, যা
ক্যাটালিস্টের কাজ করে। যখনই হাইড্রোজেন গ্যাস পজিটিভ টার্মিনালে পৌঁছায়, তখনই অক্সিডেশন ঘটে এবং হাইড্রোজেন ইলেকট্রন রিলিজ করে পজিটিভ চার্জড H+ আয়নে
রূপান্তরিত হয়।
এখন, H+
আয়ন স্বাভাবিকভাবেই নেগেটিভ টার্মিনালের বা ক্যাথোডের দিকে
আকৃষ্ট হয় এবং ইলেক্ট্রোলাইটের মধ্য দিয়ে চলাচল করে ক্যাথোডে
পৌঁছায়। কিন্তু ইলেকট্রন ইলেক্ট্রোলাইটের মধ্য দিয়ে যেতে পারে না। ফ্রি ইলেকট্রনগুলি একটি তারের
মধ্য দিয়ে পাস করে কারেন্ট তৈরি
করে তারের অপরপ্রান্তে যুক্ত ক্যাথোডে
পৌঁছায়। দুটি টার্মিনালের মাঝে লোড (ধরা যাক মোটর) দেওয়া থাকে, যা
এই কারেন্ট ব্যবহার করে চালানো যেতে পারে। ইলেকট্রনগুলি যখন ক্যাথোডে পৌঁছায়, তখন আগে থেকে উপস্থিত H+
আয়নগুলির সঙ্গে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে যুক্ত হয়ে জলে
পরিণত হয় (চিত্র ২)।
একটি সিঙ্গেল ফুয়েল সেল
খুব সামান্য পরিমাণ এনার্জি তৈরি করে, কিন্তু যদি একসঙ্গে বিপুল সংখ্যক ফুয়েল সেল
স্ট্যাক করা যায়, তাহলে তার থেকে বিপুল পরিমাণ এনার্জি তৈরি হতে পারে, যা দিয়ে
গাড়ি বা ট্রাক চালানো যেতে পারে।
চিত্র ১ ।। ফুয়েল সেলের ব্লক ডায়াগ্রাম |
চিত্র ২ ।। ফুয়েল সেলের কার্যপ্রণালী |
এখন সমস্যা হল, এই বিপুল
পরিমাণ হাইড্রোজেন আমরা পাব কোথা থেকে? সহজ উত্তর হল, জলের মধ্যে কারেন্ট ফ্লো করে
তড়িৎ-বিশ্লেষণ ঘটিয়ে জলকে (H2O)
হাইড্রোজেন (H2) এবং অক্সিজেনে (O2)
ভেঙে দেওয়া। এটা আমরা ক্লাস সেভেন-এইটে বিজ্ঞান বইতে
পড়েছি। তবু একটু বলি। যেহেতু জল তড়িতের কুপরিবাহী,
তাই জলে সামান্য অ্যাসিড মেশালে জল তড়িতের সুপরিবাহী হয়। অ্যাসিড
মিশ্রিত জলের মধ্যে দুইটি ইলেকট্রোড রেখে কারেন্ট ফ্লো করলে
জলের অণুগুলির বেশির ভাগ H+ এবং OH-
আয়নে ভেঙে যায়। H+ আয়নগুলি ক্যাথোডে যায় এবং
সেখানে প্রয়োজন মতো ইলেকট্রন গ্রহণ করে তড়িৎনিরপেক্ষ H পরমাণুতে পরিণত হয়। পরমাণুগুলি
আবার পরস্পর যুক্ত হয়ে H2
অণুতে পরিণত হয়। OH- আয়নগুলি অ্যানোডে যায় এবং
ওদের বাড়তি ইলেকট্রন বর্জন করে তড়িৎনিরপেক্ষ OH মূলকে পরিণত হয়। OH মূলকগুলি
পরস্পরের সঙ্গে বিক্রিয়া করে জল এবং অক্সিজেন উৎপন্ন করে (চিত্র
৩)।
ক্যাথোডে: H+ + e = H, H + H
= H2↑
অ্যানোডে: OH- -
e = OH, 4OH =
2H2O + O2↑
চিত্র ৩ ।। জলের সাধারণ তড়িৎ-বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া |
এভাবে আমরা ইলেট্রোলিসিসের
মাধ্যমে হাইড্রোজেন তৈরি করতে পারি কিন্তু এতে প্রচুর পরিমাণ এনার্জি প্রয়োজন হবে। শুধু
তাই নয়, এই হাইড্রোজেন স্টোর করা এবং ট্রান্সপোর্ট করা খুব
মুশকিল ব্যাপার। যেহেতু অত্যন্ত দাহ্য, তাই হাইড্রোজেন স্টোর করার জন্য ভীষণ মজবুত
ট্যাঙ্ক ব্যবহার করতে হবে, তা সত্ত্বেও লিকেজ
হবার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এবার যদি ফুয়েল
এফিসিয়েন্সি’র কথা বলি, তাহলে, হাইড্রোজেন ডিজেল-পেট্রোলের তুলনায় মাত্র ২০%
এফিসিয়েন্ট।
ধরে নিই, আমরা গাড়িতে
সোলার প্যানেল লাগিয়ে দিলাম এবং সোলার এনার্জি দিয়ে ইলেট্রোলাইজারে জলকে ভেঙে
হাইড্রোজেন তৈরি করে ফুয়েল সেলে পাঠিয়ে কারেন্ট তৈরি করে মোটর চালালাম। এটি একটি
কমপ্লিকেটেড প্রসেস এবং প্রত্যেকটি কম্পোনেন্টে
যে পরিমাণ এনার্জি কনজিউম হয়, তাতে সামগ্রিকভাবে হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলের এফিসিয়েন্সি
অনেক কমে যায়। যদিও এটি পলিউশন ফ্রি, তবু ব্যাপক হারে এর ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে
প্রশ্ন থেকেই যায়।
কিন্তু যদি জল দিয়ে গাড়ি
চলে!
নিশ্চয়ই বলবেন, এ তো
হাস্যকর ব্যাপার। জল কোনও দাহ্য পদার্থ নয়। জলের কোনও ফুয়েল প্রপার্টি বা ক্যালোরিফিক ভ্যালু নেই।
বিশ্বাস না হলেও এই
অবিশ্বাস্য কাজটি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে আই আই টি রুরকি’র কয়েকজন পড়ুয়া। তারা
মোটামুটি দু’বছর রিসার্চ করে ২০১৮ সালে এমন একটি ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরি করেছে, যেটি চালানোর
জন্য কোনও ডিজেল, পেট্রোল বা ইলেকট্রিক
লাগে না, জল দিয়ে চলে। শুধু জল বললে ভুল হবে, গাড়ি চালানোর জন্য প্রয়োজন হয় জল,
বায়ু ও অ্যালুমিনিয়াম। অ্যালুমিনিয়াম ব্যবহার করার কারণ হল, ভারত অ্যালুমিনিয়াম
প্রডাকশনে পৃথিবীর মধ্যে তৃতীয়। তাই ভারতে এর জোগান যথেষ্ট রয়েছে। গাড়ি থেকে কোনও কার্বন এমিশন হয় না, তাই দূষণমুক্ত এবং এটির দামও স্ট্যান্ডার্ড গাড়ির যা
দাম, তার আশেপাশেই পড়বে বলে জানিয়েছে তাঁরা। পড়ুয়ারা মিলে ইতিমধ্যেই
ব্যাঙ্গালুরুতে “লগ ৯ ম্যাটেরিয়াল” নামে একটি কোম্পানি খুলেছে এবং তাঁদের এই নতুন
টেকনোলজি ব্যবহার করে তৈরি গাড়িটির নাম দিয়েছে “রেঞ্জার”। গাড়ির মাস প্রোডাকশনের
জন্য তাঁরা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন নামী অটোমোবাইল কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
প্রথম যখন আই আই টি
রুরকি’র কয়েকজন পড়ুয়া মিলে রিসার্চ শুরু করেন, তখন তাঁদের পরিকল্পনা ছিল বর্তমানে যে
ইলেকট্রিক কার চালু আছে, তার প্রযুক্তিগত ডেভলপমেন্ট করা। কিন্তু, তাঁরা উপলব্ধি
করেন, এতে বিশেষ কিছু লাভ হবে না এবং ইলেকট্রিক কার দিয়ে ভারতের সমস্যা সমাধান হবে
না।
তাঁরা যে গাড়িটি তৈরি
করেছেন, সেখানেও ফুয়েল সেল টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে। এটি বেসিক্যালি একটি ব্যাটারি, যার মাঝখানে একটি অ্যালুমিনিয়াম প্লেট রাখা
হয় এবং প্লেটের দু’দিকে জল থাকে। জলের দুই দিকে “গ্রাফীন” নামক কার্বনের জালি
লাগানো থাকে। গ্রাফীন এক ধরনের কার্বন, যা ক্যাটালিস্টের কাজ করে। এর জোগান আমাদের
দেশে যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। তাই তাঁরা “গ্রাফিন” ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন।
গ্রাফীনের জালিদুটি বায়ুর
সংস্পর্শে থাকে। বায়ু যখন গ্রাফীন তারজালির মধ্য দিয়ে জলের সংস্পর্শে আসে, তখন
একটি কেমিক্যাল রিএকশন হয় যার ফলে অ্যালুমিনিয়াম প্লেট অ্যালুমিনিয়াম
হাইড্রক্সাইডে কনভার্ট হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, যার দ্বারা গাড়ি চালানো যায় (চিত্র
৪)।
চিত্র ৪ ।। অ্যালুমিনিয়াম বেসড ফুয়েল সেল টেকনোলজি (আইআইটি
রুরকি’র আবিষ্কার)
একবার অ্যালুমিনিয়াম এবং
জল ভরলে গাড়িটি ১০০০ কিলোমিটার যেতে পারে। এর পর নতুন অ্যালুমিনিয়াম প্লেট লাগাতে
হবে। আর ১ লিটার জলে গাড়িটি ৩০০ কিলোমিটার চলবে। এই গাড়িটির মাস প্রোডাকশন চালু
হলে জায়গায় জায়গায় অ্যালুমিনিয়াম স্টেশন বানাতে হবে। যেরকম আমরা গাড়িতে ডিজেল-পেট্রোল
ভরার জন্য পেট্রোল পাম্পে গিয়ে থাকি, ভবিষ্যতে সেরকম অ্যালুমিনিয়াম স্টেশন বানানোর
প্রয়োজন হবে। একবার অ্যালুমিনিয়াম প্লেট লাগানোর খরচ পড়বে ৩০০০/- টাকা।
এই গাড়ির সুবিধা হল, বর্তমানে
বাজারে যে ইলেকট্রিক কার চালু আছে, তা একবার চার্জ করলে মোটামুটি ২০০ থেকে ২৫০
কিলোমিটার যেতে পারে আর ব্যাটারি ডিসচার্জ হয়ে গেলে চার্জ করতে মিনিমাম আধ ঘন্টা
সময় লাগে। আর এই গাড়িতে আমাদের শুধু অ্যালুমিনিয়াম প্লেট চেঞ্জ করতে হবে, যা মাত্র
দশ মিনিটের ব্যাপার এবং নতুন প্লেট লাগানোর পর গাড়ি আবার ১০০০ কিলোমিটার চলবে। এর
দাম ইলেকট্রিক গাড়ির থেকে সস্তা হতে পারে।
তবে, এই গাড়ির অসুবিধা হল,
ব্যাটারিটি অনেকটা স্পেস নেয়, যেমনটা ছবিতে দেখানো হয়েছে (চিত্র ৫)। গাড়ির পেছনের
সিটে ব্যাটারিটি বসানো হয়েছে। কিন্তু আইআইটি’র ছাত্ররা দাবি করেছেন, খুব শিগগির এই
ব্যাটারিটি গাড়ির ডিকিতে চলে যাবে এবং পেছনের
সিটের পুরো স্পেস পাওয়া যাবে। আর গাড়ির বর্তমান ম্যাক্সিমাম স্পিড ৮০ কিলোমিটার
প্রতি ঘণ্টা। কিন্তু পড়ুয়ারা দাবি করেছেন, ভবিষ্যতে এই টেকনোলজি’র উৎকর্ষসাধন ঘটিয়ে আরও বড়ো গাড়ি বানানোর পরিকল্পনা তাঁদের রয়েছে, যা ১৫০-১৬০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা
স্পীড দেবে।
চিত্র ৫ ।। গাড়ির পেছনের সিটে বসানো অ্যালুমিনিয়াম বেসড ফুয়েল সেল
|
বর্তমান বছরের (২০১৯)
শেষের দিকে এই গাড়িটি ভারতের মার্কেটে লঞ্চ করার কথা আছে। দেখা যাক, এই গাড়ির ভবিষ্যৎ কী হয়। এটি
নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার এবং এই ধরনের আবিষ্কার আরও অজস্র তরুণ
যুবকদের দেশের কাজে লাগে এমন কিছু নতুন আবিষ্কারের প্রেরণা জোগাবে, সন্দেহ নেই।
তথ্যসূত্রঃ
_____
No comments:
Post a Comment