পার্থপ্রতিম মাইতি
প্রফেসর দত্তগুপ্ত নিজের প্রতিভার কুলকিনারা মাঝে মাঝে নিজেই খুঁজে
পান না৷ বরাবর তিনি দেখে এসেছেন তিনি চান এক আর জিনিসটা হয় এক।
তবে গ্যারাজের এককোণে অচল হয়ে পড়ে থাকা পুরোনো সুজুকি গাড়িটা সারাতে
গিয়ে হঠাৎ যখন দেখলেন কীভাবে যেন গাড়িটাকে তিনি একটা টাইম মেশিনে রূপান্তরিত করে ফেলেছেন
- তখন দত্তগুপ্ত বুঝলেন বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন।
টাইম মেশিন বাচ্চাদের খেলার জিনিস নয়। এ
এমন একটা জিনিস যা দিয়ে সত্যি সত্যি বাবার বিয়ে দেখা তো সম্ভব হয়ই,
এমনকি কনেও পরিবর্তন করে দেওয়া যায়।
আর তার ভবিষ্যত ফলাফলটা যে সুখকর হয় না তা বলাই বাহুল্য।
তবে প্রফেসরের নোবেল প্রাইজ পাওয়ার লোভটা একটু বাড়াবাড়ি রকমের
ছিল।
আর সেই লোভে আবিষ্কারের পুরো ব্যাপারটা তিনি ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে
দিলেন। মনে ভাবলেন,
এ নিশ্চয়ই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কোনও দিব্য ষড়যন্ত্র।
তাঁকে এ বছরের নোবেল প্রাইজ বিজেতা হিসেবেই হয়তো দেখতে চান তিনি।
ঈশ্বরের ঘাড়ে পুরো দায়িত্বটা তুলে দেওয়ার পর প্রফেসর দত্তগুপ্ত
পরম চিন্তামুক্ত অনুভব করলেন। আনন্দের
চোটে দু’হাত জড়ো করে প্রণামও ঠুকে ফেললেন একবার।
তারপর বাড়ির অতিথি জাপানি বিজ্ঞানী বাঁকাহাঁসিকে টাইম মেশিন আবিষ্কারের
খবরটা জানাতে গেলেন।
আর দশটা জাপানির মতোই বাঁকাহাঁসির মুখে কোনও আবেগ অনুভূতি সহজে
খেলে না। তাই সে প্রফেসরের আসন্ন নোবেলপ্রাপ্তির
সংবাদে ঠিক কতটা খুশি হল তা বোঝা গেল না।
নিষ্পৃহ গলায় শুধু জানাল - এ বছরের নোবেল প্রাইজ দুই মাস আগেই দেওয়া হয়ে গেছে।
প্রফেসর গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন,
খবর-টবর দেখেন না, তাই টের পাননি।
এবারে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন জার্মান বিজ্ঞানী হটেনটট ম্যুলর।
শুনে প্রফেসর এতটাই বিমর্ষ হয়ে পড়লেন যে বাঁকাহাঁসি কখন টুক করে
সরে পড়ল খেয়ালও করলেন না। শেষপর্যন্ত
হটেনটটের মতো একটা ছ্যাঁচড়া লোক পেল নোবেল! প্রফেসরের নোবেলের ওপর ভক্তিশ্রদ্ধাটাই উবে গেল।
হটেনটট, যে কিনা দত্তগুপ্তের
মস্তিষ্কপ্রসূত আইডিয়া ঝেড়ে নিয়ে সেটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিকে বেচে ফোকটে মিলিওনেয়ার
হয়ে বসেছিল একদিন - দত্তগুপ্তকে আর পাত্তাও দেয়নি।
প্রফেসর ঠিক করলেন নোবেল প্রাইজের লোভ তিনি ত্যাগ করবেন।
আর টাইম মেশিন বড়োই বিপজ্জনক জিনিস। সুজুকি
গাড়িটাকে তিনি ভেঙে ফেলবেন।
সার্ন, জেনেভা থেকে দরকারি ফোন
কল আসায় ভাঙার কাজটা পরের দিন সকাল পর্যন্ত স্থগিত রাখলেন।
এসব কাজের মধ্যে বাঁকাহাঁসি কোথায় অদৃশ্য হল প্রফেসর আর তার খবর
রাখলেন না।
পরের দিন সকালে সুজুকি গাড়িটাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
আর সেই গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে বাঁকাহাঁসিও অন্তর্ধান করল।
সুজুকির চাকার দাগ গ্যারাজের দরজা পর্যন্ত গিয়ে তারপর অদৃশ্য হয়ে
গেছে দেখা গেল।
বাঁকাহাঁসি এখন সেটাকে নিয়ে অতীত কি ভবিষ্যতে সময়ের কোন মাত্রায়
কী করে বেড়াচ্ছে তার খবর পাওয়ার আর কোনও উপায় নেই।
প্রফেসর দত্তগুপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী হলেও একজন
ভালো মানুষ। আর ভালো মানুষেরা একটু ভোলেভালা
হয়। দত্তগুপ্তও দু-আড়াই দিনের ভেতরে
সব ভুলে নিজের রোজকার কাজে ডুবে গেলেন।
সপ্তাহে তিন দিন তিনি বাড়ির কাছের কলেজটাতে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের
ক্লাস নেন।
পরমাণুবিদ্যা পড়াতে গেলে জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকি শহরে পরমাণু
বোমা বিস্ফোরণ কথাপ্রসঙ্গে চলে আসে।
প্রফেসর খুব মরমী চালে ঘটনাটা বলেন। সবাই
মন দিয়ে শোনে।
আজ ক্লাসে দেখলেন ছাত্রছাত্রীরা উসখুস করছে।
যেন সবাই একটু বিভ্রান্ত।
দত্তগুপ্ত কী একটা ভেবে মুখ শুকনো করে ফার্স্ট বেঞ্চে বসা ছাত্রীকে বললেন,
“কী বলছ? এটম বম্ব কি জাপানে তাহলে...”
উত্তরে যা শুনলেন তারপর আর তাঁর ক্লাস নেওয়া হয়নি।
অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটি নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন কলেজ থেকে।
পরের দশটা বছর নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন টাইম মেশিন তৈরির কাজে।
আগের বারে সুজুকি গাড়িটা হঠাৎ করে কীভাবে টাইম মেশিন হয়ে গেছিল
সে ব্যাপারে তাঁর নিজেরই কোনও ধারণা ছিল না। এবারে
হিসেব কষে বুদ্ধি খাটিয়ে তা পুনরাবিষ্কার করতে দশ-দশটা বছর লেগে গেল।
মাঝখানের সময়টায় ভয়ে খবরের কাগজ খুলতেন না দত্তগুপ্ত।
এটম বম্ব ফেলার মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যে রাতারাতি ইতিহাসের
পাতা থেকে গাপ করে দিতে পারে, সেই বাঁকাহাঁসি টাইম মেশিনটা নিয়ে গত দশ বছরে কী করেছে
না করেছে তা ভাবলেও তাঁর বুক ধড়ফড় করে। ইতিহাস
নিয়ে এই ধুলোখেলার পেছনে যে তাঁরই আবিষ্কৃত টাইম মেশিন তা পৃথিবীর লোক যদি জানতে পারে
তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলাবে না যাবজ্জীবন কোনটা দেবে তাও তিনি ভেবে উঠতে পারেননি।
এই পরিবর্তিত বিশ্বের মানুষজনের সঙ্গে একাত্মতাও তাঁর কেটে গিয়েছিল।
বাড়ি থেকে বেরোননি দশ বছর। বিজ্ঞান
সংগঠনগুলিও দত্তগুপ্তের নাম খরচের খাতায় ফেলে দিয়েছিল।
এই সময়টায় দত্তগুপ্তের সামনে একটাই লক্ষ্য ছিল।
পৃথিবীর কোনও পুলিশ বাঁকাহাঁসির মতো সময় নিয়ে ছিনিমিনি খেলা অপরাধীকে
ধরতে পারবে না, সময় তার হাতের মুঠোয়।
বাঁকাহাঁসিকে নিবৃত্ত করার একটাই উপায়। তা
হল আরেকটা টাইম মেশিন তৈরি করা৷
আর সেটাই প্রফেসর দত্তগুপ্ত করেছেন। করেছেন
সারা বিশ্বের থেকে নিজেকে গুপ্ত করে নিয়ে। টাইম
মেশিন আবিষ্কার করেছেন তিনি। সময়
লেগেছে দশ বছর।
মেশিনের টাইম রেগুলেট করলেন প্রফেসর৷ ২০১০ সালের ১ লা এপ্রিল,
সকাল আটটা বারো।
সময়টা তাঁর মনে আছে দশ বছর পরেও৷ ঠিক ওই সময়েই সুজুকির ভেতর তিনি
বুঝতে পেরেছিলেন ঘটনাচক্রে একটা টাইম মেশিন আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
পুরোনো মেশিনটার স্মৃতিতে নতুনটাও একটা ভিন্টেজ সুজুকি কারের ভেতরেই
বানিয়েছেন। সেইম মডেল,
সেইম ডিজাইন, এমনকি গাড়ির রঙ আর নাম্বার প্লেট-টাও
এক৷
ইগনিশন বাটনটা দাবানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড একটা ঝটকা।
মাথায় খানিক ঝিমঝিম।
যখন সম্বিত ফিরল দত্তগুপ্ত নিজেকে পুরোনো গ্যারেজের কারশেডের ভেতরে
দেখলেন। দশ বছর আগে রোদের রঙ কি আলাদা
ছিল? চারদিকটা যেন পুরোনো বাংলা ছবি।
টেকনিকালার।
গাড়িতে, থুড়ি মেশিনে চাবি দিতে ভুললেন না দত্তগুপ্ত।
অতীতের সব ভুল এবার তিনি নির্ভুল করবেন।
পকেটে হাত দিলেন, পিস্তলটা ঠিকঠাক রয়েছে। ২০১০
সালে এটা তাঁর ছিল না। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।
টাইম মেশিনে করে হঠাৎ যদি বাঁকাহাঁসি উপস্থিত হয় এই ভয়ে করিয়েছিলেন।
এখনও টাইম মেশিন বাঁকাহাঁসির হাতে পড়েনি। আর
তা হতেও তিনি দেবেন না।
গাড়ি, থুড়ি টাইম মেশিনের দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই বাঁকাহাঁসি।
তখনই গুলি করে শয়তানটার খুপরি উড়িয়ে দেওয়ার একটা ইচ্ছা জেগেছিল
তাঁর মনে।
তারপর নিজেকে বোঝালেন, এটা ২০১০; বাঁকাহাঁসি এখনও টাইম মেশিন চুরি করেনি।
ভবিষ্যৎ অপকর্মের ভিত্তিতে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না।
জাপানি বিজ্ঞানীটি দত্তগুপ্ত কিছু বলবেন ভেবে চুপটি করে দাঁড়িয়েছিল।
প্রফেসর শেষমেশ নিজেই একটু বাঁকা হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, “হঠাৎ ভারতেই
কেন এলে বাঁকাহাঁসি এত জায়গা থাকতে?” মনে মনে ভাবলেন - আমাকে বাঁশ দিতে, আবার কেন!
বাঁকাহাঁসি একটু হাসার চেষ্টা করে নিষ্ফল হয়ে বলল, “আমার বাবা
মারা যাবার আগে বলে গিয়েছিলেন আমি যেন একবার বুদ্ধের দেশে যাই।
বাবার শেষ ইচ্ছাকে সম্মান দিতেই বলতে পারেন।”
বাঁকাহাঁসি বলে চলল, “আমার বাবার ক্যানসার ছিল...
হিরোসিমায় ৬ আগস্ট যে বিস্ফোরণ হয়, আমার দাদু দিদিমা দু’জনে সঙ্গে সঙ্গে
ঝলসে মারা যায়। মা পরে হাসপাতালে।
বাবাও রেডিয়েশন থেকে রক্ষা পায়নি। আর
আমার ভবিতব্য দেখুন, আমিও শেষমেশ হলাম কিনা একজন পরমাণুবিজ্ঞানী।
এটাই কি ভগবান বুদ্ধের ইচ্ছা?”
বিষণ্ণ হাসি বাঁকাহাঁসির ঠোঁটে। অব্যক্ত
যন্ত্রণায় সারা মুখ কুঁচকানো।
নিথর হয়ে বসে থাকা প্রফেসরের সামনে সে বলে, “এসবের শুরু কোথা থেকে
জানেন? আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯৩৯-এর আগস্টে আমেরিকায় বসে
যেদিন মার্কিন সরকারের নিউক্লিয়ার প্রজেক্টের অনুরোধপত্রে স্বাক্ষর করলেন।
অন্তত তাঁর তো বোঝা উচিত ছিল মানুষ এখনও ওই বিশাল শক্তির যোগ্য
হয়ে ওঠেনি৷ উনি সেদিন সই না করলে কোনোভাবেই...”
“বুঝতে তিনি পেরেছিলেন বাঁকাহাঁসি। তবে
তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল,” হাতটা সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন প্রফেসর,
আঙুলে ঝুলছে টাইম মেশিনের চাবি, “যাও বাঁকাহাঁসি, গুরুদেবের কাছ থেকে ঘুরে এসো। তাঁকে
বলো পরমাণু শক্তি নয়, আমরা পরমাণু অস্ত্রবিহীন
পৃথিবীর দাবীদার।”
প্রফেসর দত্তগুপ্তর আর বর্তমানে ফিরে আসা হয়নি।
বাঁকাহাঁসিও আর ফিরে আসেনি টাইম মেশিন নিয়ে।
মাঝখান থেকে হিরোসিমা নাগাসাকির পরমাণু বিপর্যয় ইতিহাসের পাতা
থেকে বেমালুম মুছে গিয়েছিল।
দত্তগুপ্ত বরাবরই এটা ভাবেন, সমস্ত বড়ো বড়ো ঘটনার সূচনা হয় তুলনায় নগণ্য বিষয়কে কেন্দ্র করে।
ম্যাপে খুঁজে পাওয়া যাবে না এমন ক্ষুদ্র দেশ বসনিয়ায় একটি ছোট্ট
খুনের ঘটনা ঘটল আর তাকে কেন্দ্র করে বেঁধে গেল বিশ্বব্যাপী মহাযুদ্ধ।
সে যুদ্ধ আবার শেষ হল এমনভাবে এক চুক্তির মাধ্যমে যে বিশ বছর যেতে
না যেতে আবার যুযুধান গোটা পৃথিবী, মারা গেল লক্ষ লক্ষ মানুষ।
বাঁকাহাঁসি না ফিরে এসে ইতিহাসের ওই ছোট্ট ছোট্ট ভুলগুলো ঠিক করতে গেল নাকি!
ইতিহাস নিয়ে পড়েননি বলে প্রফেসর নিজেকে ছোট্ট করে একটা ধন্যবাদ
দিলেন।
তাঁর মনে হল, তিনি যে গ্যারাজে
সুজুকি গাড়িটা সারাতে গিয়েছিলেন সেটাও তো একটা ছোট্ট ঘটনা।
তবে কোন গাড়িটা তিনি আগে বানালেন? টাইম ট্রাভেল
করে কারশেডে যখন পৌঁছোলেন তখন তো সেখানে দুটো গাড়ি ছিল না! তবে
কী...
প্রফেসর দত্তগুপ্তের বিজ্ঞ মস্তিষ্ক এবার গুলিয়ে যেতে আরম্ভ করল।
মনে মনে বললেন - ডিম আগে না মুরগি আগে! টাইম মেশিন কি হাতের মোয়া!
এই জগতে কিছুই তাহলে ‘হঠাৎ’ করে হয় না।
No comments:
Post a Comment