ভ্রমণ:: বোরাসুর বাঁকপথে (দ্বিতীয় পর্ব) - ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়


বোরাসুর বাঁকপথে
ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়

।। দ্বিতীয় পর্ব ।।

উনিশে জুন শ্যাওড়া বীডায় শিরশিরেনি
রাতে ঘুম ভালো না হলেও ভোরে আর বেরোলুম না৷ পাথরের ঘরে বসেই কাটালুম৷ রোদ্দুর না উঠলে বেরোতে ইচ্ছেই করছে না৷ ব্রেকফাস্ট মানে সেই কফি আর ম্যাগি৷ তাঁবু গুটিয়ে বেরোলাম দশটা দশ৷ একটু দেরি হল, কিন্তু খুব দূরে নয় বলে অসুবিধে হবে না হয়তো৷ চললুম আমরা সদলবলে শ্যাওড়া বীডার পথে, পেছনদিকে শেষবারের মতন তাকিয়ে দেখলুম রাথাডোর৷ মারিন্দা গাডের পাশে ওই বরফের চাদর আর তো দেখতে পাব না কোনোদিন৷ এগিয়ে চললুম৷ তাপস আর জয়া একটু পেছিয়ে৷ তাড়াহুড়োর কোনো দরকার নেই৷ সুলুকরাম আছে ওদের সঙ্গে৷ আমি একটু এগিয়ে গেলুম যদি শ্যাওড়া বীডায় গিয়ে তাঁবু খাটানো যায় তাড়াতাড়ি৷
বুড়োদা আর সন্দীপ প্রবল উৎসাহে চলেছে৷ হঠাৎ এত এনার্জি কোথা থেকে পেল কে জানে! সঙ্গে আছে রায় সিং-এর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা৷ এখানে রাস্তা বলে কিছু নেই৷ ডান দিকে নদী এঁকেবেঁকে পাথরের ফাঁক দিয়ে চলেছে উছলে উছলে৷ সূর্যের আলোয় চকচক করছে৷
সুলুকরাম কোথা থেকে দেখি আমাদের কাছে চলে এসেছে৷ ডান হাতের আঙুল দিয়ে দূরে নির্দেশ করে৷ সামনে অনেক দূরে বোরাসুর চূড়া৷ তার পাশে ঘুমিয়ে রয়েছে ছোট্টো সাদা চাদরে মোড়া এক চিলতে জায়গা৷ ওটাই বোরাসু পাস!
বোরাসু পাস! ওইখানে যেতেই হবে আমাদের৷ এতদিনের আশা, স্বপ্ন৷ এক ধোঁয়াশাময় স্বর্গরাজ্য!
নতুন উদ্যমে শুরু হল আমাদের চলা৷ পাহাড়ের ঢাল নেমে এসেছে নদীতে৷ শুকনো ঘাস আর বোল্ডারে ভর্তি জায়গাটা৷ আমাদের চলার পথ ঠিক চড়াই বা উৎরাই নয়৷ পাহাড়ের ঢাল বরাবর আড়াআড়িভাবে হাঁটতে হচ্ছে৷ পাহাড়ের নতি বেশ ভালোই, তাই মাঝে মাঝেই বেশ ঝামেলা হচ্ছে, খুব সতর্ক হয়ে চলেছি আমরা৷ পা ফসকে গেলেই সোজা নদীতে৷ তার প্রমাণও পেলুম৷ আমার পায়ে লেগে একটা পাথর গড়াতে শুরু করল; আরও অনেকগুলো পাথরে ধাক্কা খেয়ে নদীর ওপরের পাতলা বরফের স্তর ভেঙ্গে তলিয়ে গেল৷ পাথরের বদলে আমরা কেউ হলে কী হত... ভাববার দরকার নেই৷ অধিকাংশ জায়গায় ঘাসের চিহ্নও নেই৷ বড়ো বড়ো বোল্ডারে ভর্তি জায়গাটা৷ বেশ কয়েকটা বোল্ডার আবার একেবারেই আলগা৷ তার ওপর পা দিলেই নুড়ি-পাথর-মাটিশুদ্ধু নিচে হড়কে যাচ্ছে৷ কোনোরকমে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে হাত-পা দিয়ে সামনে এগোই৷ মাঝে মাঝে বরফের স্তর, কালো পাহাড়ের গায়ে সাদা ছোপ, পেছনে মারিন্দা গাড চলে গেছে রাথাডোরের দিকে বরফের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে...
অনেকটা যাবার পর সামনে এল বিরাট এক আইসফিল্ড, প্রায় কিলোমিটার দু’য়েক হবে৷ সাদা বরফ সামনে সোজা গিয়ে নীল আকাশে মিশে গেছে৷ বুড়োদা আমার সামনে৷ এখানে কোনো নদীর শব্দ নেই, হাওয়া-বাতাস যেন কোন মন্ত্রবলে থেমে আছে৷ পৃথিবী হঠাৎ নিশ্চুপ৷ ধবধবে সাদা বরফ আর ঘন নীল আকাশের সীমারেখায় বুড়োদার লাল রঙের জ্যাকেটের ওপর লাল-নীল রুকস্যাকের সে এক অনবদ্য ছবি৷ পৃথিবীতে এরকম জায়গা যে আছে কোনোদিন ভাবিনি৷ বরফ একেবারে ঝুরো৷ তার ওপর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে আমাদের৷ হাঁটু অবধি ঢুকে গেল একবার আমার ডান পা৷ তুলতে গিয়ে আরেক বিপত্তি, কোমর অবধি বরফের নিচে৷ অবশেষে পৌঁছোলুম শ্যাওড়া বীডা৷
জায়গাটার চেহারা দেখে বেশ ভয় লাগে৷ কেমন যেন গা ছমছমে ব্যাপার৷ সমস্ত জায়গা বরফে ঢাকা৷ ডান দিকে একটা গিরিশিরা, সেখানেও বরফ৷ সামনে বোরাসু আর কিছু নাম না জানা চূড়া৷ বরফের মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো জেগে রয়েছে পাথর আর কালচে সবুজ ভিজে ঘাসের ছোট্টো ছোট্টো টুকরো৷ এর মধ্যে রয়েছে হিমেল হাওয়ার প্রবল দৌরাত্ম্য৷ তাঁবু খাটাতে বেশ কসরত করতে হল৷ রাথাডোরে এদিক ওদিকে পাথরের আড়ালে গিয়ে হাওয়ার কবল থেকে একটু বাঁচা যেত, এখানে সে বালাই নেই৷ বিকেলের এক অদ্ভুত আলোয় যে আলোয় মনে হচ্ছে কোনো প্রাণ নেই, শ্যাওড়া বীডা এক শিহরণ জাগানো জায়গা৷ রাতে চাঁদের আলোয় তার মুখে কেমন যেন এক হিংস্র ক্রূর হাসি৷
এখানে তাঁবু খাটানোর জন্য সমতল জায়গা পাওয়া খুব মুশকিল৷ কোনোরকমে তাঁবুর ব্যবস্থা হল৷ তাপসের স্যাক থেকে বেরোলো এক প্যাকেট চিঁড়েভাজা৷ সেটা শেষ হতে না হতেই এল খিচুড়ি, মানে রাতের খাবার৷ এত তাড়াতাড়ি ডিনার আমরা অবাক চোখে রায় সিংকে জিজ্ঞেস করেই বেশ লজ্জা পেলুম৷ ছিঃ ছিঃ৷ সুলুকরামের দল তাঁবু খাটিয়েছে বেশ দূরে, একটা বড়ো পাথরের আড়ালে, যদি কিছুটা ঠাণ্ডা আটকানো যায়, যদি রাতে একটু ভালো করে ঘুমানো যায়...৷ এ সবই আমাদের কথা ভেবে, যাতে কালকে ওরা আমাদের আরও সাহায্য করতে পারে৷ তাই আজ একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তে চাইছে সবাই, আর তাছাড়া রাত হয়ে গেলে রান্না করে আমাদের তাঁবু অবধি অন্ধকারে আসা মুশকিল, যে কোনো জায়গায় বরফে পা ঢুকে যেতে পারে৷
একটু ভয় ভয় লাগছে - কেন জানি না৷ চিন্তাও হচ্ছে৷ কাল কী হবে কে জানে, পারব কি সেই অনেক দিনের ইচ্ছে বোরাসু গিরিবর্ত্ম পেরোতে? সুলুকরামের অবশ্য সাহস দিতে জুড়ি নেই৷ আমরা এইসব আলোচনা করছি... হঠাৎ খেয়াল হল সন্দীপ শুয়ে পড়েছে৷ শুধু শোয়া নয়, একেবারে ঘুমে কাদা৷ নাঃ, আর জেগে থাকার কোনো মানে হয় না৷

ওই যে বোরাসু পাস, ছবিতে নিচে বাঁ দিকের কোণে লেখক
বিশে জুন স্বপ্নের বোরাসু
শ্যাওড়া বীডার মতো ভয়ঙ্কর জায়গায় সারা রাত যে নির্বিঘ্নে কাটবে, ভাবতে পারিনি৷ মাঝরাতে একবার বাইরে বেরিয়েছিলুম এত ঠাণ্ডায় ঘুমানোর চেষ্টা করা বৃথা৷ চাঁদের আলো যে এত তীব্র হতে পারে আগে জানা ছিল না৷ চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে যেন৷ চারপাশের বরফের ওপর সে আলো মনে হচ্ছে এক হিংস্র হাসি৷ দূরে বোরাসু শৃঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে তার সমস্ত রহস্যময়তা নিয়ে৷ ‘ছলাৎ’ শব্দে চমকে উঠেছিলাম৷ পাথরের ওপর থেকে এক টুকরো বরফ পড়ল জলে৷ আমরা আট জন ছাড়া আর কেউ কোথাও নেই৷ আর কোনো মানুষ দেখতে হলে হাঁটতে হবে অন্তত তিন দিন৷ বেশ ভয়াবহ ব্যাপার! চাঁদনি রাতের এই ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ এবারের ট্রেকিং-এর এক অমূল্য প্রাপ্তি৷
কর্নফ্লেক্স খেয়ে তাঁবু গুটিয়ে বেরিয়ে পড়লুম বোরাসু পাসের ঊদ্দেশে৷ ঘড়িতে সকাল সাতটা৷ সেই বোরাসু পাস যাকে নিয়ে আমাদের কত কথা, কত কল্পনা৷ কীরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে আজ৷ যেভাবেই হোক যেতেই হবে আমাদের সব্বাইকে ওই পাস পেরিয়ে৷
বুড়োদাঃ ওরে বড্ড ঠাণ্ডা লাগছে... তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু কর... একেবারে জমে যাচ্ছি... উহুহু...
সন্দীপঃ ইন্দ্রনীলদা, সেই বোরাসু পাস...
তাপস চিরকালীন সিরিয়াস, যতই হোক আমাদের ‘লিডার সাব’ বলে কথা৷ গম্ভীরভাবে এদিক ওদিক দেখে নিয়ে বলল, “খুব সাবধানে কিন্তু যেতে হবে আজ; তাড়াহুড়োর কোনো দরকার নেই৷ আর হ্যাঁ, বুড়োদার দিকে খেয়াল রাখিস, মাঝে মাঝে বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ে...
আমি সবার দিকে একবার দেখে নিয়ে ঘাড় নেড়ে কয়েকবার হ্যাঁ বলে নিজের স্যাকটা ঠিকঠাক করে নিলুম৷ এবার হাঁটা শুরু করতে হবে৷
চারিদিকে বরফ৷ সূর্য উঠব উঠব করছে৷ খুব ঠাণ্ডা লাগছে, তবে একটু হাঁটলেই হয়তো ঠিক হয়ে যাবে৷ শুরুতেই এক বিরাট জায়গা পড়ল বরফে ঢাকা৷ গোটা চারেক ইডেন গার্ডেনস্ অনায়াসে ঢুকে যায়৷ পিছনদিকে মারিন্দা গাড চলে গেছে৷ ডানদিকে একটা রিজ বা গিরিশিরা উঠে গেছে৷ এতদিন যে মারিন্দা নদী আমাদের সঙ্গী ছিল, সে রিজের ওপাশে বরফের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে হারিয়ে গেছে৷
বেশ মজাই লাগছে৷ কেন জানি আমাদের মধ্যে এখন প্রবল উৎসাহ, কালকের ভয় ভয় ভাব একেবারে উধাও৷ বরফে পা ঢুকে যাচ্ছে৷ একটু পরে এল বিচ্ছিরি চড়াই, বোল্ডারের ওপর দিয়ে৷ এরপর আবার বরফ এবং শুধুই বরফ৷ পেরিয়ে এলুম লমজুং গ্লেসিয়ার৷
আমরা এখন বেশ কিছুটা উঠে এসেছি৷ ওপর থেকে দেখলুম ডান দিকে যে বরফের দেয়াল উঠেছে শ্যাওড়া বীডার যেখানে আমরা তাঁবু খাটিয়েছিলুম তার পাশ থেকে, তার ওপারে আর এক গ্লেসিয়ার সেখান থেকে আরেক নদী বেরিয়েছে বোধহয়৷ এ এক অপূর্ব সুন্দর জায়গা৷ স্বর্গ যদি কোথাও থাকে সে হয়তো এখানেই৷ প্রথমে সুলুকরাম, তারপর বুড়োদা, আমি আর রায় সিং৷ একটু পেছনে জয়া, তাপস, সন্দীপ আর বাহাদুর৷ আমরা একটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে৷ মাথার ওপর গাঢ় নীল রঙের আকাশ৷ নিচের দিক থেকে ওরা সবাই আস্তে আস্তে উঠে আসছে৷ লাল-নীল-হলুদ উইণ্ডচিটারগুলো সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে ধবধবে সাদা বরফের ওপর৷ কালো খয়েরি ছোটো বড়ো বোল্ডার এদিক ওদিক মাথা তুলে উঁকি দিচ্ছে৷ আবার হাঁটা শুরু৷ কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ার তেজ বেশ ভালোই৷
কখনও হাঁটু অবধি, কখনও বা কোমর অবধি ঢুকে যাচ্ছে বরফের মধ্যে৷ শিয়ালদার বৈঠকখানা বাজার থেকে কুড়ি টাকা দিয়ে কেনা মিলিটারির সেকেণ্ড-হ্যাণ্ড হান্টার জুতো আর পেরে উঠল না৷ একেবারে ভিজে গেছে৷ কিছু করার নেই, আর কোনো জুতো নেই৷ এটা দিয়েই চালাতে হবে৷ এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় বরফের মধ্যে ভিজে জুতো পরে হাঁটতে গিয়ে যা হবার তাই হল৷ পায়ের যেন আর সাড় পাচ্ছি না৷ যেদিকে দৃষ্টি যায়, সবুজের চিহ্ন নেই কোনো৷ ফলে অক্সিজেনের অভাব বেশ বোঝা যায়৷ একটু হাঁটলেই হাঁপিয়ে উঠছি৷
বেশ খানিকটা যাবার পর বরফের ওপরেই বসে পড়লুম আমি আর বুড়োদা৷ সুলুকরাম আর রায় সিং বসে আছে ফুট দশেক দূরে৷ আমরা বসেছি এক ঢালে৷ সামনে বরফের এক বিশাল মাঠ, নেমে গেছে নিচে৷ তারপর মোটামুটি সমতল জায়গা একটা৷ কিন্তু তারপর আর কিছু দেখা যাচ্ছে না৷ এটা হতেই পারে যে সামনে একটা খাড়াই নেমে গেছে, অর্থাৎ পড়ে গেলে সোজা কয়েকশো ফুট নিচে৷ আমরা এসেছি ওই বাঁদিকের কোণ দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বরাবর৷ দু’পাশের পাহাড় থেকে ছোটো ছোটো বরফের টুকরো গড়িয়ে পড়ছে৷ কানে আসছে চড়চড় করে বরফ ফাটার শব্দ৷
বসেই আছি আমরা চার জন৷ অনেকক্ষণ হয়ে গেল, কারুর দেখা নেই৷ একটু চিন্তাও হচ্ছে৷ মিনিট চল্লিশেক পরে বাহাদুরকে একটা ছোট্টো বিন্দুর মতো দেখা গেল৷ যাক, নিশ্চিন্ত৷ আবার ওঠা৷ আকাশ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে কখনও কখনও৷ আসলে পুরো জায়গাটাই ঢেকে যাচ্ছে মেঘে, সামনে কাউকেই তখন আর দেখা যাচ্ছে না৷ একটা সময় মনে হল আর বোধহয় পারব না৷
সঙ্গের জল একদম শেষ৷ বরফের পরিমাণ খুব বেড়েছে৷ হাঁটতে গিয়ে প্রায় সবসময়ই পা ঢুকে যাচ্ছে হাঁটু অবধি, কখনও কখনও কোমর অবধিও৷ সবার কাছে একটু করে গ্লুকন-ডি দেওয়া হয়েছিল৷ সেটা বার করে একটু মুখে দিলুম৷ সুলুকরাম আর রায় সিং এগিয়ে গেছে পাসের দিকে যাতে আমরা রাস্তা ভুল না করি৷ এই বিশাল প্রান্তরের মধ্যে যদি কেউ রাস্তা হারিয়ে অন্য দিকে চলে যায়, তাকে খুঁজে বার করা খুব শক্ত৷ তার মধ্যে মাঝেমধ্যেই মেঘে ঢেকে যাচ্ছে চারিদিক৷ পেছনদিকে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেলুম না৷ যেটুকু গ্লুকন-ডি ছিল আমার কাছে, সেটা বরফের ওপর রেখে দিলুম এই ভেবে যে যদি কারুর দরকারে লাগে; একটাই তো রাস্তা, পায়ের ছাপ দেখে হয়তো বুঝতে পারবে৷
একটু পরিষ্কার হওয়াতে সামনে দেখতে পেলুম বোরাসু পাস৷ মনে হল খুব কাছে (পরে বুঝেছিলুম আরও এক ঘন্টার পথ)৷ বেশ খানিকটা সোজা গিয়ে ভীষণ খাড়াই উঠে বোরাসু চূড়ার পাশে বোরাসু পাস৷ আর পেছন ফেরা নয়৷ বিপজ্জনক কয়েকটা আইস্‌‌ফল জোন, পেঁজা তুলোর মতো বরফের ঢাকা জায়গা পেরিয়ে, ভিজে জুতোর মধ্যে আঙুলের যন্ত্রণা, নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছি সোজা উঠে এলুম হাঁসফাঁস করতে করতে আমি আর বুড়োদা বোরাসু পাসে৷ ঘড়িতে তখন বারোটা বেজে দশ৷ বোরাসু পাসের উচ্চতা ১৭,৩০০ ফুট আর বোরাসুর চূড়া আরও এক হাজার ফুট উঁচু৷


পাসের ওপর বরফ আর পাথর শুধু৷ বসার জায়গা খুঁজে পাওয়া মুশকিল৷ একটা পাথরের খাঁজে ছোট্টো এক জায়গা, সেখানেই গুটিসুটি মেরে বসলুম দু’জনে৷ পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা৷ জুতো খুলতে গিয়ে সুলুকরামের ধমকে নিরস্ত হলাম৷ হাওয়ার জোর এখানে সাংঘাতিক৷ আমরা যেদিক থেকে পাসের ওপর এলুম সেটা উত্তরপ্রদেশ (এখন উত্তরাখণ্ড), আর যেদিক দিয়ে নেমে যাব সেটা হিমাচল প্রদেশ৷ কী অদ্ভুত; দু’দিকের আবহাওয়া কিন্তু যেন আলাদা৷ একদিকে মাঝে মাঝে মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, তখন কিন্তু পাসের অন্যদিকের আকাশ নীল কিন্নরের পাহাড়গুলোর মাথায় বরফ পড়েছে, তার ওপর খেলা করছে সূর্যের আলো আর মেঘ৷ যতদূর দেখা যায় শুধু বরফ আর বরফ৷
দূরে দেখতে পেলুম সন্দীপকে৷ সুলুকরাম একটা আইস অ্যাক্স নিয়ে আবার নিচে নেমে গেল৷ আমরা বসে আছি, হাওয়ার দাপটে নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই৷ সন্দীপকে দেখলুম আরও কাছে এসেছে৷ সুলুকরামের সঙ্গে কী যেন কথা হল ওর৷ হঠাৎ ঘন মেঘে ঢেকে গেল সামনের সমস্তটাই৷ দু’জনের কাউকেই আর দেখা যাচ্ছে না৷ বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল৷ সন্দীপের দেখা নেই! হঠাৎ ঘন মেঘের চাদরের ভেতর দিয়ে ওর ডাক শুনতে পেলুম - “ইন্দ্রনীলদা--আ, কাউকে পাঠাও, আমি আটকে গেছি।”
তাড়াহুড়ো করে রায় সিংকে পাঠানো হল৷ পরে জানলাম যে ওর ডান পা বরফের মধ্যে আটকে গিয়েছিল, বার করতে পারছিল না৷ রায় সিং কিছুটা বরফ খুঁড়ে বার করেছে৷ পাসের ওপর সন্দীপ এসে পৌঁছল বারোটা চল্লিশ৷
হাড় কাঁপিয়ে দেওয়া ঠাণ্ডা, হাত বার করতে পারছি না৷ সন্দীপ এসে চুপচাপ একটা পাথরে বসে পড়ল৷ কোনো কথা বলছে না৷ হয়তো ওরও শরীর খারাপ করেছে একটু৷ জিজ্ঞেস করলুম, “জল খাবে?
প্রায় দেখা যায় না এমন আস্তে ঘাড় নেড়ে বলল, “হ্যাঁ।”
“আমার কাছে জল নেই৷ তোমার কাছে কি আছে?
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল৷ উত্তর দেবার ক্ষমতা নেই ওর৷ আমি ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে ওর স্যাকের পাশ থেকে জলের বোতল বার করে দেখলুম একটুখানি জল রয়েছে মাত্র৷ ছিপি খুলে ওর হাতে দিলাম; কোনোরকমে মুখে ঢালতে পারল ওই কয়েক ফোঁটা জল৷ জল শেষ৷ তিন জনের কাছে আর এক ফোঁটাও জল নেই!
সামনে রায় সিং আধশোয়া অবস্থায় ঘুমোচ্ছে ওর আবার জ্বর হয়েছে৷ স্যাক থেকে বার করে একটা ওষুধ দিলুম৷ দূরে, বহু দূরে, যেখানে সমতল বরফের সেই বিশাল প্রান্তর শেষ হয়েছে, সেখানে তিনটে বিন্দুর মতো তাপস, জয়া আর সুলুকরাম৷
খুব আস্তে আস্তে এগোচ্ছে ওরা৷ তাড়াহুড়োর দরকার কী, আস্তে আসাই ভালো৷ তবে খুব আস্তে এলে আবার দেরি হয়ে যাবে, কারণ এখান থেকে আমাদের ক্যাম্প করার জায়গাটা খুব কাছে নয়৷ কে একজন শুয়ে পড়ল ওই বরফের ওপরই!
আজকের হাঁটা বেশ কষ্টকর৷ কিন্তু করার কিছুই নেই, আসতেই হবে এই বোরাসু পাসে৷ পাস পেরিয়ে নেমে গিয়ে তবেই তাঁবু খাটানো যাবে৷ না হলে এই বিশাল বরফের মাঝে, যেখানে কোনো জল নেই, হাওয়ার ধাক্কায় ঝুরো বরফ পাউডারের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে, ক্যাম্প করা অসম্ভব প্রায়৷ ইতিমধ্যে রায় সিং ঘুম থেকে উঠে একটু সুস্থ বোধ করাতে নিচে নেমে গেল যদি ওদের কোনো সাহায্য করা যায়৷ বাহাদুর এগিয়ে এসেছে অনেকটা৷ এখন ঠিক পাসের নিচে৷ পাসের ওপরে যেখানে আমরা বসে আছি, সেইখানটা খুব বড়ো নয়, আর খুব খাড়া৷ একটু পরে বাহাদুরের মাথা দেখতে পেলুম, পাসের খুব কাছে এসে বমি করল হঠাৎ৷ এর মধ্যে ওর আবার অল্টিচিউড সিক্‌‌নেস হলেই তো আরও বিপত্তি৷ ডিহাইড্রেশন-ও হতে পারে৷
দূরে তিনটে বিন্দু দাঁড়িয়ে আছে৷ ওরা ভাবছিল যদি আজকের রাতটা ওখানেই তাঁবু খাটায় আর আমরা পাস পেরিয়ে কোথাও ক্যাম্প করি, তারপর আগামীকাল পাস পেরিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে; সুলুকরামের ধমকানিতে এই চমৎকার পরিকল্পনা ত্যাগ করতে হল, না হলে আরও বিপদ বাড়ত৷
এদিকে পাসের ওপর আর বসে থাকা যাচ্ছে না৷ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর সেই সঙ্গে হাওয়ার প্রবল দাপট৷ সন্দীপ আর বাহাদুর একেবারে চুপ৷ এর মধ্যে বুড়োদার উত্তেজিত কন্ঠ৷
“ওরে আর পারছি না, বড্ড ঠাণ্ডা৷ আমি চললুম নিচে।”
“কোন দিকে যাবে? কোনো রাস্তা দেখা যাচ্ছে না৷ তাছাড়া তুমি কি জান যে কোথায় আজ থাকব আমরা?
“ও তাই তো৷ ঠিক আছে, আমি তাহলে যে দিক থেকে এসেছি, সেই দিকে চললুম৷ শ্যাওড়া বীডা।”
“গেলে একা যেতে হবে৷ আমি কিন্তু যেতে পারব না।”
“ও আমি ঠিক চলে যাব৷ আরে এই তো এলুম, ওই একই রাস্তা দিয়ে ঠিক চলে যাব শ্যাওড়া বীডা।”
“শ্যাওড়া বীডায় থাকবে কোথায়? কাল রাতে তাঁবুতে ছিলুম সে খেয়াল আছে? আর সে তাঁবু তো এখন আমাদের সঙ্গে৷ ওখানে কি তোমার জন্য কেউ হোটেল খুলেছে এর মধ্যে?
“ঠিক আছে৷ কোনো ব্যাপার নয়৷ আমি রাথাডোর চলে যাব।”
“বেশ যাও৷ তা ওখানে কে তোমায় থাকতে দেবে? আসার সময় কোনো ঘরবাড়ি দেখেছ? আমরা তো ছিলুম সেই পাথরের ইগ্‌‌লুতে৷ মনে আছে!
“ওরে বাবা! ওখানে খুব ঠাণ্ডা! আরে ঠিক আছে, ঠিক আছে৷ আমি একেবারে হর্-কি-দুন চলে যাব৷ ওখানে তো ট্রেকার্স হাট আছে।”
মাথা পুরো খারাপ হয়ে গেছে বুড়োদার৷ হর্-কি-দুন এখান থেকে তিন দিনের পথ৷ বুড়োদাকে নিরস্ত করার আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে বললুম, “সামনে যে বরফে ঢাকা জায়গা দেখতে পাচ্ছ, তার নিচে অনেক জায়গায় ফাটল আছে, একবার ঢুকে গেলে কেউ জানতেও পারবে না।”
“ওরে বাবা৷ তাহলে এখানেই বসে থাকি৷ কিন্তু বেশিক্ষণ থাকলে তো ঠাণ্ডায় জমে মরে যাব।”
যাক, কাজ হল এ যাত্রায়৷ তবে কথাটা বুড়োদা খুব ভুল বলেনি৷
সন্দীপ এখন পুরো মৌনীবাবা হয়ে গেছে৷ মুখে কোনো কথা নেই, চোখে কোনো ভাষা নেই৷ ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক করে আকাশের দিকে চেয়ে আছে৷ জাগতিক কোনো কিছুতেই তার আর কিছু যায় আসে না৷ আসলে ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে যাকে বলে একেবারে বম্‌‌কে গেছে৷
চতুর্থ বিন্দু, মানে রায় সিং ওদের কাছে গেল৷ তাপস এখন একাই হাঁটছে৷ পাসের ওপর এল তিনটে দশ৷ আবার বসে থাকা বাকিদের জন্য। আরও কিছুক্ষণ পর, ওরা তিনজন - সুলুকরাম, রায় সিং আর জয়া উঠে এল পাসের ওপর তিনটে পঞ্চাশ৷
ব্যস, বোরাসু পাসে আমরা সব্বাই৷ পাঁচ বছর ধরে যে স্বপ্ন আর ইচ্ছে ছিল আমাদের, দেখা হলেই নিজেদের বলতাম যে কবে যাব বোরাসু পাস, আজ সেটা পূর্ণ হল৷ রায় সিং বলল যে পাসের ওপর মিনিট পনেরোর বেশি থাকাই যায় না; আর আমরা ছিলুম প্রায় চার ঘন্টা৷ যখন নিচে বাকিদের আনতে গিয়েছিল ওরা, ভাবছিল পাসের ওপর আমরা কেউ যেন কোলাপ্স করে না যাই, আর সেটা হলেই সর্বনাশ! তাকে এই পাসের ওপরেই রেখে যেতে হবে (অবশ্য জীবিত অবস্থায় নয়)! কিন্তু এখন সব ভুলে গেলুম পাসে বসে ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া, বাড়ি ফিরতে পারব কিনা তার অনিশ্চয়তা, কয়েকজনের শরীর খারাপ, আরও আরও অনেকটা পথ যেতে হবে আজকে ক্যাম্প করার জন্য আর সেটা যে কতদূর, কোনো আইডিয়া নেই, সঙ্গে একফোঁটাও জল নেই সব ভুলে গেলুম৷


এবার নামার পালা৷ সামনে পাসের ওপর থেকে হিমাচলের দিকে তাকিয়ে দেখলুম খাড়া উৎরাই৷ সবাই খুব তাড়াতাড়ি নেমে এলুম মাঝে মাঝে গ্লিসেডিং করে৷ গ্লিসেডিং ব্যাপারটা খুব মজার৷ প্রচণ্ড বেগে নিচের দিকে নেমে আসছি চোখে মুখে বরফের কুচি ছিটকে লাগছে, জামা-প্যান্ট সব ভিজে যাচ্ছে পুরো ব্যাপারটাই বেশ রোমাঞ্চকর, মানে যাকে বলে থ্রিলিং৷ কিছুটা হাঁটা বরফের মধ্যে পা ডুবিয়ে, মাঝে মাঝে গ্লিসেডিং, এক-আধবার আছাড় খাওয়া, সেটাও বেশ মজার; কারণ বরফের মধ্যে আছাড় খেলে কিছুই লাগছে না, পুরোটাই তো ঝুরো বরফ! বাঁ দিকে সোজা নেমে গেছে পাহাড়ের ঢাল৷ পেছনে সূর্য ডুবছে৷ যত সময় যাচ্ছে হাওয়ার দাপটও বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে৷ চরিদিকে কোনো রং নেই, শুধু সাদা আর কালো৷ সূর্য এখনও লাল হতে অনেক দেরি৷ সূর্য এখন ঠিক তাপসের পেছনদিকে, তাই ওকে ভালো বোঝা যাচ্ছে না৷ সূর্যের তীব্র আলোর ব্যাকগ্রাউণ্ডে একটা অসাধারণ সিল্যুয়েট তৈরি হয়েছেতাপসের লম্বা কালো ছায়া সাদা চকচকে বরফের ওপর পড়েছে৷ সে এক অপূর্ব দৃশ্য৷ আজ এত বছর পরেও আমার মনে গেঁথে রয়েছে৷ এর জন্যই তো হিমালয়ের কাছে বার বার ফিরে আসা৷
জুক্কিয়া গ্লেসিয়ারে যখন তাঁবু খাটানো হল, ছ’টা বেজে গেছে৷ পেছনে বোরাসুর ঢালে এখনও গ্লিসেডিং-এর দাগ দেখা যাচ্ছে৷ আজ সারাদিন শুধু কর্নফ্লেক্স খেয়ে এগারো ঘন্টা হাঁটতে হয়েছে, পুরোটাই বরফের ওপর দিয়ে৷ সবাই বড্ড ক্লান্ত আজ৷
তাঁবু খাটিয়ে ঢুকে যে অবস্থায় আছি সেইভাবেই পড়ে গেলুম৷ ম্যাট্রেস পাতার এনার্জিও আর নেই৷ সুলুকরাম এর মধ্যে স্টোভ ধরিয়ে রেডি করে ফেলেছে৷ কফি খেয়ে কোনোরকমে ম্যাট্রেস পেতে জুতো খুলে ভেতরের স্লিপিং ব্যাগ বার করি৷ খিচুড়ি এল প্রায় তার সঙ্গে সঙ্গেই৷ শুয়ে পড়লুম সবাই৷ ঘুম কি আসবে? দেখা যাক৷ কেউ আর ঠিক নিজের মধ্যে নেই৷ শরীর আর চলছে না৷ এই ঠাণ্ডায় ঘুম আসা খুব শক্ত৷ তবে খেল দেখাল সন্দীপ আর বুড়োদা! স্লিপিং ব্যাগে ঢুকতে না ঢুকতেই ঘুমে একেবারে কাদা! এত কষ্টের মধ্যেও হেসে ফেললুম৷
রাত কত হল কে জানে৷ ঘুম অনেকক্ষণ ভেঙ্গে গেছে৷ অন্ধকারে কাউকে গুঁতো মেরে কারুর পা মাড়িয়ে তাঁবু খুলে বাইরে এলুম৷
চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক৷ দূরে বোরাসু পাস৷ পরিষ্কার আকাশে লক্ষ-কোটি তারার ঝকমকানি৷ মাথার ওপর সপ্তর্ষিমণ্ডল তাকিয়ে হাসছে৷ এক অজানা ছোট্টো পাহাড়ি নদীর কুল কুল শব্দ৷ পাথরের ফাঁকে হালকা আওয়াজ, কোনো নিশাচর প্রাণীর চকিত পদক্ষেপ হয়তো৷
পাশে মৃদু শব্দ পেয়ে ফিরে দেখি কোন ফাঁকে তাপস এসে দাঁড়িয়েছে আমার পাশে৷ আমরা সেই কত ছোটোবেলা থেকে বন্ধু৷ ঠিক টের পেয়েছে আমি বাইরে বেরিয়েছি৷
“উফ্ ইন্দ্র, কী দৃশ্য! ভাবা যায়৷ এইজন্যই আসা, কী বল্,” অপার তৃপ্তির সঙ্গে তাপসের বিহ্বল কন্ঠস্বর৷
আমি কিছু উত্তর দিতে পারলাম না৷ শুধু ওর দিকে আস্তে আস্তে ফিরে তাকালাম৷ চারিদিকে অপার শান্তি, অনাবিল সৌন্দর্য, বাঁধভাঙ্গা জ্যোৎস্নার প্লাবন, ঝিরঝিরে ফিসফিসে হিমেল বাতাসের শব্দ শব্দেরও এত রূপ...!

একুশে জুন বুঙ্গায় আজ বিশ্রাম
রাতে তো ভালো ঘুম হয়নি, ভোর রাতে একটু চোখ জুড়ে এসেছিল৷ এই জায়গাটা অনেকটা ফাঁকা৷ যদিও চারিদিকে বরফ আর পাথরে ভর্তি৷ এখানে রোদ আসে একটু তাড়াতাড়ি৷ জুক্কিয়া গ্লেসিয়ারের ওপর আরাম করে রোদ পোহানো হল৷ উঠতে আর ইচ্ছেই করছে না৷ সুলুকরাম, রায় সিং আর বাহাদুর তো ঘুমিয়েই পড়ল৷ অবশেষে তাঁবু গুটিয়ে যখন বেরোনো হল বুঙ্গার উদ্দেশে, দশটা বেজে গেছে৷
আজ কোনো তাড়াহুড়ো নেই৷ সুলুকরামকে বলে দিয়েছি যে আজ কিন্তু আস্তে আস্তে যাব, সে যত রাতই হোক না কেন৷
একটা বরফের মাঠ পেরিয়ে সামনে একটা রিজ পড়ল৷ বেশ ভালোরকমই উঁচু৷ আল্‌‌গা বোল্ডারে ভর্তি৷ চড়াই তো এতদিন ধরে কত ভেঙ্গেছি, কিন্তু এটা উঠতে টের পেলুম যে এর ব্যাপারটাই আলাদা৷ একটু পায়ের চাপ পড়লেই ঝুর ঝুর করে পাথর আর মাটি ধ্বসে যাচ্ছে৷ ভালো করে দাঁড়ানোই যাচ্ছে না৷ মাঝে মাঝে হনুমানের মতো দু’হাত আর দু’পা দিয়ে শরীরটাকে এদিক ওদিক দুলিয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়ে অনেক কষ্টে উঠে এলুম রিজের ওপর৷ পুরো গ্লেসিয়ারটাই দেখা যাচ্ছে এখান থেকে৷ বিশাল এক উঁচুনিচু প্রান্তর৷ নিচের দিকে এঁকেবেঁকে চলে গেছে জলের স্রোত, বরফ আর পাথরের মধ্যে দিয়ে লুকোচুরি খেলতে খেলতে৷ সামনে ঝকঝক করছে বোরাসুর চূড়া আর তার পাশে চুপটি করে শুয়ে রয়েছে বোরাসু পাস৷ পাশে নাম-না-জানা আরও গোটাকয়েক বরফে ঢাকা চূড়া৷ একটু দূরে এক ছোট্টো গ্লেসিয়াল লেক৷ নীলচে সবুজ জল৷ এগিয়ে চললুম আমরা৷
বেশ খানিকটা পাথরে ভর্তি পথ পেরিয়ে, একবার চড়াই তো আর একবার উৎরাই, পিঠের স্যাকের ওজন যেন বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে... এসে পৌঁছলুম বুঙ্গা৷ পুরো জায়গাই হলুদ মরা ঘাসে ভর্তি৷ পাশেই একটা ছোট্টো নদী বয়ে চলেছে কুল কুল করে৷ যেদিকে তাকাই সেই দিকেই পাহাড়, কোনোটার মাথায় বরফ, কোনোটার মাথায় আবার শুধুই কালচে বাদামি পাথর৷ পূর্বদিকে এক অসাধারণ সুন্দর চূড়া একটা শিং-এর মতো নীল আকাশের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে৷ ঘন নীল আকাশ, তার ওপরে জেগে থাকা সাদা বরফের চূড়াগুলোর ওপর সূর্যের আলো পড়েছে, চারিদিকের পাহাড়-পর্বত-প্রকৃতি হেসে হেসে খেলা করছে৷ কোথাও ছোটো ছোটো মেঘের কুণ্ডলী তৈরি হচ্ছে...
আজ আর কোনো কাজ নয়, সারাদিন বিশ্রাম৷ সন্দীপের আবার আজ একটু শরীর খারাপ ওর মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ শ্বাসকষ্ট হয়৷ আজ একটু হচ্ছে৷ আসলে সন্দীপ হচ্ছে যাকে বলে পাহাড়ি চিতা যেদিন বোরাসু পাস পেরোলুম আমরা, শেষদিকে যখন আর পেরে উঠছিলুম না, তখন কিছু হয়নি ওর, আসলে এখন সমতলের দিকে যাচ্ছি, তাই হয়তো শরীর চাইছে না পাহাড় ছেড়ে যেতে৷ মনে হয়, আজ বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে ও৷
এখানে চারিদিকে কোনো গাছ নেই এখনও পর্যন্ত৷ ট্রি-লাইনের অনেক ওপরে এই জায়গাটা৷ শুকনো ঘাসে ভরা জমি যেখানে আমাদের তাঁবু ফেলা হয়েছে৷ সারাদিন শুয়ে-বসে থাকা, গল্প-গুজব আড্ডা, গতকাল বোরাসু পাস পেরোতে গিয়ে আমাদের করুণ অবস্থার কথা এইসবের মধ্যে দিয়েই বেশ কেটে গেল৷ তাপসের স্যাক থেকে আবার বেরোল সার্ডিন মাছের কৌটো৷ রাতের খাওয়া খিচুড়ি আর সার্ডিন মাছ - জমজমাট ব্যাপার৷ ডান পায়ে হাঁটুর ব্যথা ভোভেরানের দৌলতে বেশি বাড়তে পারছে না৷ তবে আজ আবার আবিষ্কার করলুম যে বাঁ পায়ের চেটোতে মনে হচ্ছে একটু ব্যথা ব্যথা করছে৷

বাইশে জুন সবুজ জায়রি
আজ সকালে যখন বেরোলাম, আকাশে অল্প অল্প সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে৷ যদিও আটটা কুড়ি, সূর্যের দেখা পেলাম সবে৷ জায়গাটার প্রায় সব দিকই আড়াল করে রেখেছে পাহাড়৷ আজকের রাস্তা বোল্ডারের ওপর দিয়ে৷ রিজের ওপর দিয়ে সোজা কিছুটা হাঁটার পর ডান দিকের ছোট্টো সরু নদীর ধারে নেমে আসতে হল৷ তারপর আবার ওই আগের রিজের ওপর উঠে এলুম৷ আল্‌‌গা বড়ো বড়ো পাথরে ভর্তি৷ তার ওপর পা ফেলে ফেলে খুব সাবধানে আসতে হচ্ছে৷ বিরাট বিরাট পাথরগুলো এমনই আলগা যে পা ফেলতেই টলমল করছে৷ কিন্তু আসল ব্যাপারটা টের পাওয়া গেল রিজের বাঁ দিকে আবার নেমে নদীর কাছে আসার সময়৷ খাড়া উৎরাই৷ নামা বেশ মুশকিল আলগা ছোটো-বড়ো বোল্ডারের ওপর দিয়ে৷ একটা বোল্ডার গড়াতে শুরু করলে আরও ছোটো-বড়ো বোল্ডারের সংসার নিয়ে গড়াতে গড়াতে একেবারে নিচে নদীতে৷ তার সঙ্গে গুড়গুড় শব্দ, বেশ গা ছমছমে ব্যাপার৷ তবে এর মধ্যে কিন্তু একটা অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ মেশানো মজাও রয়েছে৷ রায় সিং-এর পরেই আমি আর সন্দীপ আজ সন্দীপ অনেক ভালো৷ দু’জনেই ব্যাপারটা বেশ জমিয়ে উপভোগ করছি একটি বোল্ডারও স্থানচ্যুত না করিয়া, একবারের জন্যও পদস্খলন হইল না আমাদের নামিয়া আসিলাম নদীবক্ষে৷
মাঝে মাঝে বরফের চাদরের ওপর দিয়ে যেতে হচ্ছে, যে বরফের নিচ দিয়ে কিন্তু নদী বয়ে চলেছে৷ এদিক ওদিক বরফের ফাটল চোখে পড়ল বেশ কয়েকটা৷ খুব সাবধানে চলতে হচ্ছে৷ হাঁটার সময় পায়ের নিচের বরফের আস্তরণ ভেঙ্গে যে কোনো সময়ে নদীর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা জলে ঝপাৎ হওয়ার সম্ভাবনা৷ ভাগ্য ভালো, এ যাত্রায় সেরকম কিছু ঘটল না৷
অনেক অনেক দূরে, যেখানে বাদামি-কালো পাহাড়ের সারি সামনের তুষারাবৃত পর্বতমালায় ধাক্কা খেয়ে বাঁ দিকে বেঁকে গেছে, সম্ভবত ওইখানে একটা নদী বয়ে চলেছে, তার একটু আগে ডান দিকে একটু উঁচু জায়গা৷ সেখানে, শুধু সেখানেই এক টুকরো সবুজ৷ চারিদিকের বরফের ধবধবে সাদা রং, কালো-বাদামি আরও নানান রং-এর পাথর আর শুকনো ঘাসের হলুদ রং-এর মাঝে অনেকদিন পর দেখলুম ঘন সবুজ৷ এ সবুজ কোনো রঙের প্যালেটে দেখিনি কোনোদিন, এ সবুজ চোখে আরাম দেওয়া নরম এক সবুজ৷ সে এক অপূর্ব অনুভূতি৷ ওটাই জায়রি ওখানেই তাঁবু ফেলা হবে আজ৷
প্রচণ্ড উত্তেজনায় লাফাতে লাফাতে (বোল্ডারের ওপর দিয়ে) আমি আর সন্দীপ চলতে লাগলাম, ফলে যা হবার তাই হল৷ পথ হারিয়ে নদীর ধারে নেমে এলুম৷
সন্দীপ ভীষণ কনফিডেন্স নিয়ে বলল, “এসে গেছি, চিন্তা নেই, সামনেই জায়রি, ওই ওপরে উঠলেই।”
ওপরে উঠে দেখলুম যে জায়রি তখনও অনেক দূরে, শুধু দূরের সবুজ টুকরোটা একটু কাছে এসেছে মাত্র৷ যাই হোক, এবার আর ওপর-নিচ নয়, সোজা এগিয়ে চললুম৷ প্রচুর ফুল ফুটে রয়েছে, তার পাতাগুলোও খুব সুন্দর দেখতে, একটু অদ্ভুত রকমের৷ জায়রি পৌঁছলুম দুপুর পৌনে দু’টো৷
শুকনো কর্নফ্লেক্স আর চানাচুর খেতে খেতেই রায় সিং কফি দিয়ে গেল৷ তাঁবু খাটিয়ে ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই এল ডালের স্যুপ৷ আঃ, আজ সব কিছু কীরকম যেন ভালো লাগছে, আরাম লাগছে৷ দু’দিকে পাহাড় কোনোটার গায়ে সবুজ ভেলভেট, কোথাও খয়েরি রঙের বিচিত্র রক ফেস, তাদের মাথায় রয়েছে বরফ৷ এত কম উচ্চতায় পাহাড়ের মাথায় বরফ দেখা যাচ্ছে হিমাচলের স্নো-লাইন অনেক নিচে বলেই বোধহয়৷ কিছু পরে বৃষ্টি নামল৷ তাঁবুর মধ্যে বসে আড্ডা দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই৷ এক নাগাড়ে বেশ কিছুক্ষণ বৃষ্টি, থামল সাড়ে ছ’টা নাগাদ৷ সুলুকরাম আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ আগুন জ্বেলে - কাঠের আগুন - খিচুড়ি চাপিয়ে দিয়েছে৷ কাল ছিটকুল৷ বাঁ পায়ের ব্যথা বেশ বেড়েছে৷

তেইশে জুন - ছিটকুল
জায়রি থেকে ছিটকুলের উদ্দেশে শুরু হল আমাদের যাত্রা সাতটা চল্লিশ বাজে৷ পেছন দিকে এখনও দেখা যাচ্ছে বোরাসু পাস৷ আর তার দিকে তাকালেই মনে আসছে দু’দিন আগের স্মৃতি৷ ভয়, ভালো লাগা, রোমাঞ্চ, একটু শিহরন - সব মিলিয়ে ওই দিকে তাকালেই কেমন যেন বিভোর হয়ে যাচ্ছি৷
বাঁ পায়ের ব্যথা বেশ বেড়েছে৷ পা ফেলতে গেলেই লাগছে৷ কিন্তু কিছু করার নেই, ছিটকুল পৌঁছোতেই হবে আজ৷ পিঠের স্যাক খুব ভারি লাগছে৷ অজস্র ফুল ফুটে রয়েছে চারিদিকে - হলুদ, লাল, কমলা, গোলাপি, নীল৷ রঙের আবার কত রকমফের৷ কত রকমের নীল রঙের ফুল দেখলাম কোনোটা গাঢ় নীল, কোনোটা আকাশি, কোনোটা আবার একটু বেগুনির দিকে৷ আর গোলাপি থেকে লাল পর্যন্ত কত রকমের আর কত রঙের ফুল!
আস্তে আস্তে সবুজ গাছের রাজ্যে - যাকে বলে ট্রি-লাইন-এর মধ্যে ঢুকে পড়লাম আমরা৷ প্রায় সবই ভুজ গাছ৷ সকালে সূর্যের আলো পাতার ফাঁক দিয়ে এক পাতা থেকে আরেক পাতায় লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে, আর গাছগুলোও হাওয়ার তালে তালে নেচে নেচে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে তাদের দেশে৷ প্রায় চার দিন পরে সবুজ দেখছি৷ সত্যি সবুজ রং যে কত আরামদায়ক, সেটা এখন বুঝতে পারছি৷ হালকা বেগুনি রঙের রডোডেনড্রনের ঝোপ৷ এ এক স্বপ্নের মতো - আমরা হেঁটে চলেছি ভুজ গাছের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, পাতার রং উজ্জ্বল অথচ হালকা সবুজ, গাছগুলোর গোড়া থেকে অনেকটা ওপর অবধি মোটা মোটা ডালের ওপরের পাতলা ছাল উঠে উঠে ঝুলছে, সেই উজ্জ্বল হালকা বাদামি-সাদায় সূর্যের আলোর আঁকিবুঁকি, ভোরের মোলায়েম আলো গাছের ফাঁক দিয়ে দিয়ে আমাদের গায়ে খেলা করছে, মাথার ওপর ঘন নীল আকাশ, যেদিকে তাকাই বরফঢাকা পাহাড়ের চূড়া...
হিমাচলের সঙ্গে গাড়োয়ালের বেশ তফাৎ৷ বরফঢাকা পাহাড়, ফুল আর গাছপালা মিলিয়ে সব যেন একটু অন্যরকম৷ আরও কিছু পরে এসে পড়লাম এক বুগিয়ালে৷ বেশ বড়ো বুগিয়াল৷ হলদে সবুজ ঘাসে ভরা জায়গা সমুদ্রের ঢেউ-এর মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে আর আমরা এগিয়ে চলেছি তার মধ্য দিয়ে৷ নদীর জলোচ্ছ্বাসের শব্দ কানে আসছে, সামনেই সেই নদী, যেটা পেরিয়ে আমরা যাব ছিটকুল৷ সুলুকরাম আগে আগে যাচ্ছিল, সঙ্গে আছে সন্দীপ৷ সকালে রওনা হবার আগে সুলুকরাম বলেছিল যে অনেক সময় এই নদীর ওপর একটা বরফের ব্রিজ তৈরি হয় আর সেটা দিয়ে নদী পেরোতে পারলে প্রায় চার কিলোমিটার রাস্তা কমে যায়৷ পায়ের যা অবস্থা, প্রাণপণে প্রার্থনা করছিলুম যেন নদীর ওপর ওই সুন্দর সেতু থাকে, আর তাছাড়া আবার একটু বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে পারব সেটা ভেবে উৎসাহ আরও বেড়ে গিয়েছিল৷
দেখতে পাচ্ছি সুলুকরাম বেশ দূরে, বোধহয় নদীর কাছে পৌঁছে গেছে৷ আমরা আর একটু কাছে যেতেই একগাল হেসে বলল নদীর বরফ গলে গেছে, সেই আমাদের বহু আকাঙ্খিত বরফের ধবধবে সাদা সেতু এ যাত্রায় দেখা হল না৷ নদীর প্রবল জলোচ্ছ্বাস, পাথর থেকে পাথরে ধাক্কা খেয়ে চলেছে আপন মনে৷ আমাদের যাবার কথা ছিল বাঁ দিকে, কিন্তু নদী পেরোতে হলে এখন যেতে হবে ডান দিকে, মানে একেবারে উলটো দিকে৷ সে অনেকখানি হাঁটা৷ বাঁ পায়ের ব্যথা যেন হঠাৎ করে বেড়ে গেল মনে হচ্ছে!
উপায় নেই৷ হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম আমরা এদিকে ওদিকে৷ সন্দীপ ওর স্যাক থেকে বার করে এক টুকরো লজেন্স দিল৷ আমি বাড়িতে খুব একটা লজেন্স খাই না, কিন্তু এই নদীর ধারে, ঘন সবুজের ওপরে ঘন নীল আকাশের ক্যানভাসে এক রাশি ধবধবে বরফঢাকা পাহাড়চূড়ার সারি সেখানে এই লজেন্সের যে কী স্বাদ বলে বোঝানো যাবে না৷ ক্লান্ত আমরা সবাই, একটু যেন চোখ জুড়িয়ে এসেছিল৷
এবার আবার হাঁটার পালা৷ পাক্কা আড়াই থেকে তিন ঘন্টা সময় বেশি লাগবে ছিটকুল পৌঁছতে৷ নদীর তীরে নেমে এলাম৷ নদীর এত কাছে এসে যাচ্ছি যে জলের ছিটে লাগছে মাঝেমধ্যে৷ কিছুটা যাবার পরে দেখি নদীর পাড় খাড়া নদী থেকে উঠে গেছে, ফলে আর যাবার জায়গা নেই৷ অগত্যা উঠে আসতে হল আবার সেই সবুজের মাঝে৷ এই ভাবেই একবার ওঠা, একবার নামা৷ কিছু পরে রানিকাঁটায় এসে পড়লাম৷ এখানে আগে সৈন্যদের ছাউনি ছিল৷ তারই ধ্বংসাবশেষ কয়েকটা পাথরের ঘর রয়ে গেছে এখনও৷ উত্তর দিকে সোজা গেলে তিব্বত৷ আমরা বাঁ দিকে ঘুরে কাঠের সেতু পেরিয়ে নদীর অন্য পাড়ে এসে যেদিক থেকে এসেছিলাম সেই দিকেই আবার চলতে শুরু করলাম৷ বরফের সেতু না পেয়ে বেশ কষ্ট হয়েছিল, কিন্তু তার জন্য তো আমরা আরও কিছুক্ষণ পাহাড় জঙ্গল আর নীল আকাশের মাঝে থাকতে পারলাম৷
রাস্তা মোটামুটি ভালোই পায়ে চলা পথ নদীর ধার বরাবর৷ আর কোথাও থামা নেই, সোজা ছিটকুল৷ অদ্ভুতদর্শন মাথা নিয়ে বরফের পাহাড়গুলো কিন্তু আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে৷ আর পাশে বয়ে চলেছে সেই উছল নদী৷ নদীর নাম বাস্পা৷ ভুজ গাছের সারি শেষ হয়ে শুরু হল পাইনের জঙ্গল৷ পথের আশেপাশে পড়ে থাকা দু-একটা পাইনের কোন কুড়িয়ে স্যাকের মধ্যে পুরে ফেললাম৷ তারপর মিলিটারি ক্যাম্প৷ দূরে পাহাড়ের গায়ে দু-একটা ছোটো ছোটো বাড়ি৷ অবশেষে ছিটকুল পৌঁছলুম৷ ঘড়িতে দেখি প্রায় আড়াইটে৷ শেষ দিকে হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছিল; বাঁ পা আর যেন ফেলতে পারছিলুম না৷
ছিটকুল গ্রাম অপূর্ব সুন্দর৷ এখনকার ছিটকুলের সঙ্গে কিন্তু তুলনা করলে মুশকিল৷ এখানে কোনো থাকার জায়গা নেই৷ সুলুকরাম একটা বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করল আমাদের সকলের জন্য৷ ছিটকুলের লোকসংখ্যা চারশো চৌষট্টি৷ শ’খানেকের বেশি ঘর-বাড়ি আছে বলে মনে হল না৷ গ্রামের মাঝে এক বড়ো মন্দির৷ মন্দিরে পুজো হয় একদম ভোরবেলা আর রাত্তিরে সবার কাজের শেষে৷ যে যার নিজের কাজ সেরে রাত্তির আটটা - সাড়ে আটটা নাগাদ জমায়েত হয় মন্দির চত্বরে৷ এই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় এক জায়গায় আগুন জ্বেলে ঘিরে বসে গল্প-গুজব, পুজোর প্রসাদ আর পানীয়-মাংস সহকারে চলে রাত অবধি আড্ডা৷ সব জায়গাই খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন৷ শুনলাম এখানে আরও একটা মন্দির আছে, আর আছে এক গুম্ফা৷ অতি বৃদ্ধ এক লামা আছেন এই গুম্ফার দায়িত্বে৷ লামা আর গুম্ফার দর্শনে আসা যাবে কালকে৷
আজ গেলাম দৌলত সিং নেগি নামে এক ভদ্রলোকের বাড়ি৷ সেখানে আমাদের আবার বিখ্যাত ‘টিবেটান টি’ খেতে দিল৷ সেই বিখ্যাত চা মুখে দেবার পর আমার তো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা৷ ফেলতেও পারছি না, ওরা কী ভাববে, কোনোরকমে গিলে নিয়ে যখন শেষ হল, বলে কী আর একটু নেব নাকি? সর্বনাশ৷ এই চা আবার!
“নেহি নেহি, বহুত বড়িয়া, লেকিন পেট ভর গিয়া,” মাতৃভাষা আর হিন্দি মিশিয়ে কোনোরকমে ম্যানেজ করে এ যাত্রায় রক্ষা পেলাম৷
সুলুকরামের কোনো এক পূর্বপুরুষ আগে এই গ্রামে বসবাস করত৷ পরে বোরাসু পাস পেরিয়ে ওসলায় বাড়ি তৈরি করে থাকতে শুরু করে সেখানে৷ ছিটকুলের লোকজন তিব্বত থেকে লবণ আর পশম নিয়ে আসত, আর নিয়ে আসত ওসলা থেকে আনাজপাতি৷ অন্যদিকে ওসলার লোকেরা ছিটকুল থেকে নিয়ে যেত লবণ৷ এই যাতায়াতের পথে সবাইকেই পেরোতে হত বোরাসু পাস৷ এ ছাড়া এই দুই জায়গার মধ্যে যোগাযোগের আর কোনো রাস্তা ছিল না৷ কালক্রমে সভ্যতার অগ্রগতিতে সিমলা হইতে ছিটকুল আর দেরাদুন হইতে সাঁকরি বাস চলাচল শুরু হইলে বোরাসু পাস গুরুত্বহীন হইয়া পড়ে৷ তাছাড়া এখন তো আর ইচ্ছে হলেই তিব্বতে যাওয়া যায় না৷ অথচ ভাবতে অবাক লাগে ভারতের সঙ্গে তিব্বতের কয়েক হাজার বছর ধরে যোগাযোগ ছিল নিবিড়, আসাযাওয়ার পথে ছিল না কোনো বাধা৷ তাই এই পাস যা এক কালে গমগম করত দুই প্রদেশের মানুষের যাতায়াত, কথাবার্তায়, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানে, এখন বরফে ঢাকা অবস্থায় পড়ে থাকে হিমালয়ের কোলে৷ জেগে ওঠে তখনই, যখন কিছু উৎসাহী পাগল অ্যাডভেঞ্চারের আশায় বরফে আছাড় খেয়ে হাঁটু ডুবিয়ে এগিয়ে আসে সতের হাজার তিনশো ফুটের পাসের কাছে৷ ভাবতে অবাক লাগে, যে পথে আমরা মরতে বসেছিলুম, সেটা আগে ছিল দুটো জায়গার মানুষজনের জীবনধারণের এক প্রধান সড়ক৷
রাত্তিরের খাওয়া তৈরি৷ পায়ের ব্যথা বেড়েছে খুব৷ তাও খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম৷ খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাজির হলাম মন্দির চত্বরে৷ মাঝখানে এক চাতালের চারিদিকে ছোটো ছোটো ঘর, তাতে দেব-দেবীর মূর্তি৷ কোনো আতিশয্য নেই৷ নেই কোনো আড়ম্বর৷ মন্দিরগুলোর ভেতরে টিম টিম করে আলো জ্বলছে৷ চাতালের মাঝখানে আগুন ঘিরে গোল করে বসে রয়েছে লোকজন৷ ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক ওদিকে আরও কিছু মানুষ৷ ফিসফিসে কথাবার্তার শব্দ ভেসে আসছে কানে৷ কখনও বা হঠাৎ করে কেউ চেঁচিয়ে উঠে চমকে দিচ্ছে আমাদের! আকাশে চাঁদের আলো নেই৷ তাই বাইরে তাকালে অন্ধকারের মাঝে দূরে দূরে কয়েকটা আলোর বিন্দু ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷ আলো-আঁধারি এই পরিবেশ কেমন যেন রহস্যময়৷ এদিক ওদিক যাওয়ার পথে আমাদের দিকে লোকগুলো কেমন করে যেন তাকাচ্ছে৷ একটু অদ্ভুত লাগছে, একটু ভয় ভয়ও যে লাগছে না সেটা অস্বীকার করতে পারছি না৷ হঠাৎ দেখি সুলুকরাম কোনো এক জটলা থেকে উঠে এল সটান আমাদের দিকে৷ চমকে উঠেছিলাম ওর গলার স্বরে৷ পাহাড়ের মানুষ তো খুব ভালো হয়, তাহলে আমরা খামোখা ভয় পাচ্ছি কেন! সুলুকরামের হাসির শব্দে আমরা বেশ বোম্‌‌কে গেলুম৷ ও যা বলল তার সারমর্ম হল আমরা প্রায় কোনো সোয়েটার বা জ্যাকেট ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছি দেখে এখানকার লোকজন ঘাবড়ে গেছে৷ তাই আমাদের দিকে মাঝে মাঝে বেশ সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে৷ ভাবছে আমরা হয়তো অন্য কোনো গ্রহ থেকে আসছি! আর সেটাতেই আমাদের অস্বস্তি হচ্ছিল৷ যাক, মানুষগুলো ভালোই৷ ওরা বেচারা কী করে বুঝবে আমাদের গত কয়েকদিন ধরে বরফের মধ্যে থেকে শীত লাগা ব্যাপারটাই চলে গেছে!

চব্বিশে জুনভোরের ছিটকুল
যদিও কাল সারাদিন খুব পরিশ্রম হয়েছিল, তাও ভোর হতে না হতেই ঘুম ভেঙে গেল৷ আরে, ভোরবেলায় তো সেই গুম্ফার লামাকে দেখা যাবে! লাফিয়ে উঠে সোজা গেলাম গুম্ফায়৷ লামা প্রদীপ জ্বালাতে ব্যস্ত৷ দাঁড়িয়ে রইলাম সিঁড়িতে৷ প্রদীপ জ্বালানো শেষ হতে লামাই আমাদের ডেকে ভেতরে আসতে বললেন৷
ছোট্টো জায়গা৷ দেওয়ালে আঁকা ছবিগুলো অসাধারণ৷ বুদ্ধের বিভিন্ন মুদ্রায় বসা অবস্থার ছবি৷ কিছু কিছু ছবি আবার কীরকম ভয়ঙ্কর দেখতে৷ রং খুব উজ্জল৷ ঘরের ভেতরে আরও একটা ছোট্টো ঘর সেখানে রয়েছে বুদ্ধের একটা মূর্তি৷ সামনে প্রদীপ জ্বলছে অনেকগুলো৷ লামার বয়স মনে হল অন্তত নব্বই৷ চোখে খুবই কম দেখেন৷ গোল গোল কালো ফ্রেমের সস্তার চশমা চোখে৷ আমাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পও হল৷ প্রসাদ দিলেন আমাদের, হাতে অজস্র বলিরেখা৷ হাতড়ে হাতড়ে গিয়ে বসলেন একটা ড্রামের সামনে৷ শুরু হল লামার সকালের প্রার্থনা৷ এরই মধ্যে কোথা থেকে এক ছোট্ট ছেলে কাঁসরের পাশে এসে বসল৷ তিব্বতী ভাষায় লামার মন্ত্রোচ্চারণ, বড়ো কাঁসর ঘন্টার শব্দ, ড্রামের গুরুগম্ভীর আওয়াজ, দূর থেকে ভেসে আসা বাস্পা নদীর শব্দ - ভোরের কিন্নরের আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল৷ সব কিছু ছেড়েছুড়ে জীবনের শেষ লগ্নে এসে বুদ্ধের প্রতি, গুম্ফার প্রতি, এখানকার প্রত্যেক জিনিসের প্রতি লামার কী অসম্ভব ভালোবাসা, কী প্রগাঢ় ভক্তি অবাক বিস্ময়ে আর শ্রদ্ধায় আপনা থেকেই আমাদের মাথা নত হয়ে আসে৷ ছোট্টো ঘরে অনেকগুলো পুঁথি, লাল শালুতে মোড়া৷ আমার আবার তিব্বতী ভাষার প্রতি একটা দুর্বলতা আছে, কিন্তু ভাষা না জানায় সেই আফশোশ থেকেই গেল৷ অনেকক্ষণ রইলাম আমরা৷ পুজো শেষ হলে লামা এসে বসলেন সামনের চাতালে৷ ভোরের মিষ্টি রোদ্দুর লামাকে প্রণাম জানাল৷ বেরিয়ে এলাম গুম্ফা থেকে৷ এখানে না এলে আমাদের কিন্নর দর্শন অসম্পূর্ণ থেকে যেত৷
জলখাবার খেয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেরোতে বেরোতেই দুপুর গড়িয়ে গেল৷ বাস এল দু’টোর পরে৷ সাংলা হয়ে রেকং পিও পৌঁছোলাম সন্ধের মুখে৷ কাল কল্পা যাবার ইচ্ছে৷ কল্পা এখান থেকে বারো কিলোমিটার দূরে৷

পঁচিশে জুনফিরে আসার পালা
সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হল৷ বাঁ পায়ের তালুর ব্যথা সাংঘাতিক বেড়েছে৷ ওই অবস্থায় অনেক ঘুরে অবশেষে একটা অ্যাঙ্কলেট পেলাম৷ বাসে করে কল্পা৷ ছোট্টো সুন্দর আধা গ্রাম, আধা শহর৷ বাচ্চাদের স্কুল চত্বরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি - এখান থেকে কৈলাস দেখা যায় অনেক দূরে শিবের জটার ওপর সাপের ফণার মতো৷
কিন্নর মানে রূপকথার দেশ, কিন্নরীদের বাসস্থান, স্বপ্ন এখানে ভেসে বেড়ায়৷ সবাইকেই খুব সুন্দর দেখতে, চোখের হাসি, সারল্য মুগ্ধ করে দেয়৷ বয়স্কদের সবার গড়ন যেন একইরকম৷ মুখে অজস্র বলিরেখা, মহিলাদের নাকে কানে গলায় বড়ো বড়ো গয়না ঝোলে৷ আর প্রাণখোলা হাসি এদের সর্বক্ষণের অলঙ্কার৷ আগামীকাল সিমলা যাওয়ার কথা৷ সেখান থেকে কালকা হয়ে বাড়ি৷ বোরাসু পাস পেরিয়ে কিন্নরের ইতিকথা আপাতত এখানেই শেষ৷
এবার বাড়ি ফেরার পালা৷ ফিরে যেতে হবে সেই রোজকার জীবনে৷ অনেক দিনের পুরোনো হয়ে যাওয়া পরিচিত পৃথিবীতে৷ মনটা হঠাৎ কেন জানি উদাস হয়ে গেল৷ বোরাসু গিরিবর্ত্মের সেই ভয়ঙ্কর অ্যাডভেঞ্চার, শ্যাওড়া বীডার নিস্তব্ধ রাত্রি, হর্-কি-দুনের ফুলে ফুলে ঢাকা সবুজ উপত্যকা, তালুকা-সীমা-ওসলার নিষ্পাপ দেবশিশুর দল, সব কেমন যেন মনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে লাগল৷ কিন্তু আবার যে আসতে হবে এইখানে৷ এই হিমালয়ের গভীর অন্দরে৷ এখানে যে আছে অপার শান্তি, সভ্যতা থেকে অনেক দূরে নির্মল আলো-হাওয়া-বাতাসের আদুরে ছোঁয়া আর নীল আকাশের বুকে তারাভরা রহস্যের হীরকদ্যুতি; আর আছে মন-ভালো-করা আনন্দে ভরা অন্য এক পৃথিবী...
(সমাপ্ত)
_____
ফোটোঃ তাপস মণ্ডল

No comments:

Post a Comment