দীপিকা
মজুমদার
“এই
অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে গেলে কিছু কড়া নিয়ম মেনে চলতে হয় শুনেছি, সেগুলো কি সত্যি?”
গ্রীন গ্যালাক্সি সোসাইটির ভেতরে প্রবেশ করার সময়েই প্রশ্নটা করলাম।
আমার
প্রশ্নের কোনও উত্তর দিলেন না রিয়েল এস্টেট এজেন্ট মহিলা। সামান্য হেসে মাথা
নাড়লেন।
অর্থাৎ যা
শুনেছি সেটা সত্যি, মিথ্যে নয়। বেশ কয়েক জায়গায় খোঁজাখুঁজির পর এই অ্যাপার্টমেন্টটাই
কম ভাড়ায় পাওয়া গেল। একদম শহরের মাঝে যে
অ্যাপার্টমেন্টগুলো পেয়েছিলাম সেগুলোর আকাশ ছোঁয়া ভাড়া। মাসের শেষে ব্যাঙ্কে যা
আসবে তার অর্ধেকটা যদি বাড়ি ভাড়া দিতেই চলে যায় তাহলে সারাটা মাস খাবো কী আর জমাবই
বা কী? তাছাড়া চাকরির সবে শুরু আমার, এই সময়ে যদি দুটো পয়সা সঞ্চয়ই না রাখতে পারি
তাহলে আর নিজের জন্মস্থান ছেড়ে বাইরের শহরে চাকরি করতে আসার কী মানে?
এমন নয় যে
আমি শুরু থেকেই অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করেছি। বেশ কয়েকটা বাড়িও
দেখেছিলাম। কিন্তু সারা জীবন বাবার সরকারি আবাসনে থাকার অভ্যাস, ছুটির দিনে অন্তত
চারটে লোকের মুখ না দেখলে নিজেকে বড়ো অসামাজিক বলে মনে হয়। বাড়িতে একা থাকার নানারকম
ঝুঁকি আছে। সব নিজের হাতে দেখাশোনা করতে হবে। এই মুহূর্তে একজন কাজের লোক যে রাখব,
সেই আর্থিক ক্ষমতাও নেই। তাছাড়া আমার প্রচণ্ড ভূতের ভয়, একা একটা বাড়িতে থাকতে হবে
ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
অতএব সব
মিলিয়ে এই গ্রীন গ্যালাক্সি সোসাইটিই আমার পক্ষে সুবিধেজনক বলে মনে হল। জায়গাটা
মূল শহরের একটু বাইরের দিকে, আমার অফিস থেকেও গাড়িতে যাতায়াত করতে মিনিট চল্লিশ
সময় তো লাগবেই। সে হোক, শহরের ভিড়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকতে সবসময় ভালো লাগে না।
একটু নিরিবিলি হলে সপ্তাহান্তে বেশ স্বচ্ছন্দে থাকা যায়। মোটের ওপর জায়গাটা আমার
খারাপ লাগল না। কয়েকটা কড়া নিয়ম না হয় মেনেই চললাম। এমনিতে তো প্রতিদিন কতশত নিয়ম
ভাঙছি আমরা।
গেটের কাছে
গাড়িটা দাঁড়াতেই জলপাই সবুজ রঙের উঁচু বিল্ডিংগুলো নজরে পড়ে। গেটের আর্চের উপর
গোটা গোটা ইংলিশ হরফে লেখা - GREEN GALAXY SOCIETY. আমি অবশ্য
‘সবুজ নীহারিকা’ নাম দিয়েছি।
“ওসব
নিয়ম-টিয়ম নিয়ে বেশি ভাববেন না ম্যাডাম। জায়গাটা আপনার কেমন লাগছে বলুন?” আমাকে
চুপচাপ হাঁটতে দেখে রিয়েল এস্টেট এজেন্ট মহিলা জিজ্ঞেস করলেন।
অ্যাপার্টমেন্টের
ভেতরের বাগান দিয়ে ভারী ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে হাঁটছিলাম। বললাম, “এখনও তো ঘরই দেখলাম
না। আগে ঘর দেখি।” মুখে বললাম বটে। তবে পছন্দ হলে হাতে হাতে চেক দিয়ে আজই শিফট করে
যাব। তাই জিনিসপত্রও সব গুছিয়ে নিয়ে
এসেছি। আসলে হোটেলে থাকাটা আর পোষাচ্ছে না। একটা স্থায়ী থাকার জায়গা না হলে কাজেও
মন বসছে না।
“হ্যাঁ
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ম্যাডাম। ঘর দেখেই ডিসাইড করবেন। আপনার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।”
সবুজ
নীহারিকা সোসাইটির ভেতরে এ বি সি ডি করে মোট ছ’টা বিল্ডিং, সব ক’টাই জলপাই সবুজ
রঙের। জায়গায় জায়গায় আবার সাদার ছিটে। ঠিক যেন রাতের আকাশের গায়ে তারাদের সমাবেশ।
শুধু আকাশের রং সবুজ। শুধু নামেই সবুজ নয়, গাছপালা মিলিয়ে সবুজের বাহারও কম নয়।
মূল ড্রাইভওয়ের পাশে সার দেওয়া দেবদারু গাছ। তার পেছনেই
সবুজ চাপ চাপ ঘাস। অ্যাপার্টমেন্ট তৈরির আগে এখানে যে কয়েকটা বড়ো বড়ো বৃক্ষ ছিল
সেগুলোকেও সযত্নে এড়িয়ে বিল্ডিং বানানো হয়েছে। সব মিলিয়ে এই পরিবেশ বান্ধব ব্যাপারটা
আমায় মুগ্ধ করেছে। সপ্তাহের ছ’টা দিন শহরের যানজটের ক্যাঁচক্যাঁচানি ছেড়ে একটা দিন
এই সবুজের মাঝে কাটানো যাবে।
কিছুটা হেঁটে
যেতেই একটা দোকান দেখা গেল। আজকাল
অ্যাপার্টমেন্টগুলোর ভেতরে সবরকম সুবিধে মজুদ রাখা হয়। আমি দোকানটার দিকে দেখতে
দেখতে এগিয়ে চলেছিলাম। দোকানের বাইরে বড়ো বড়ো বোর্ডে লেখা আছে ‘গ্যালাক্সি থিম
আইসক্রিম’।
“কিছুদিন
আগেই নিউ ইয়ার পার্টি হল এই সোসাইটিতে। বাচ্চাদের জন্য ছিল গ্যালাক্সি থিম
আইসক্রিম - ব্লু বেরি অ্যান্ড বীটরুট সস্ উইথ স্প্রিঙ্কলড সেসামে সীড।”
“বাহ! দারুণ
তো!” এই অ্যাপার্টমেন্টের সব কিছুই যেন আধুনিকতায় মোড়া। সবরকম আধুনিক বিলাসবহুল
ব্যবস্থা। তবে ভাড়াটা তুলনায় একটু বেশিই কম এটাই যা আশ্চর্যের।
আমার মনের
কথাটা রিয়েল এস্টেট এজেন্ট মহিলা ধরতে পারলেন কিনা কে জানে। বললেন,
“সবরকম সুবিধেই পাবেন এখানে ম্যাডাম। এমনকি এদের নিজস্ব ট্রাস্টও আছে। রাতবিরেতে
অসুস্থ হয়ে পড়লেও অ্যাম্বুলেন্সের জন্য চিন্তা করতে হয় না। ট্রাস্টের তরফ থেকেই
সুব্যবস্থা রয়েছে।”
এই
অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবস্থা একটু বেশি রকমই ভালো যেন।
কথায় কথায় ডি-ব্লকের
বিল্ডিঙের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে মহিলা কোথাও যেন উধাও হয়ে গেলেন।
মিনিট খানেক পর হাতে একটা চাবি নিয়ে ফিরে এসে বললেন, এই বিল্ডিঙের সাত তলায় একটা
টু-বিএইচকে খালি আছে। আপনাকে দেখিয়ে দিই? পছন্দ হলে এটাই ফাইনাল করে নেবেন না হয়।”
আমি দেখলাম
সাত তলার জানালা বন্ধ। সেখান থেকে সরাসরি বাইরের বাগানটা দেখা যায়। জানালা দিয়ে দু’চারটে
লোকজনের মুখও দেখা যাবে, মন্দ নয়। মহিলাকে বললাম, “বেশ চলুন দেখে আসি।”
* * *
দুই কামরার
ঘর। সঙ্গে খাট বিছানা আর রান্নাঘরের প্রয়োজনীয় টুকটাক জিনিসপত্র মজুদ আছে।
আনাজপাতি, মশলা কিনলেই আপাতত চলে যাবে। দুটো ঘরের
মধ্যে একটা বেড রুম, অন্যটা স্টাডি হিসেবে ব্যবহার করব ভেবেছি। পিঠ থেকে ব্যাগটা
নামিয়ে চেক্ সই করতে গিয়েও মনে হল কয়েকটা ব্যাপারে আরও একটু ভালো করে জেনে নেওয়া
উচিত। একটু ইতস্তত করে বললাম, “আচ্ছা ম্যাডাম। শুনেছিলাম এই অ্যাপার্টমেন্টের কেউ
ওদের নিয়ম-টিয়ম ভঙ্গ করলে বেশ মোটা টাকা ফাইন দিতে হয়, সেটা ভাড়ার তুলনায় অনেকটাই
বেশি। কথাটা কি সত্যি?”
আমার প্রশ্ন
শুনে মহিলা বেশ বিরক্তই হলেন। এই বিল্ডিঙে
আসার আগে চাবির সঙ্গে একটা কালো মলাট দেওয়া মোটা ফাইল বগলদাবা করে এনেছিলেন। সেই
ফাইল খুলে এক গোছা কাগজ আমার সামনের টেবিলে নামিয়ে দিয়ে বললেন, “এই নিয়মগুলো পড়ে
এখানে একটা সই করে দেবেন।”
একগোছা কাগজ
টেনে নিয়ে পাতা ওলটাতে শুরু করলাম। কি জানি কেমন সব উদ্ভট নিয়ম লেখা আছে এখানে।
নিয়ম এক -
গ্যারেজ ছাড়া সোসাইটির ভেতরে কোনোরকম যানবাহন পার্ক করা যাবে না। যানবাহন বের করার
পর এবং রাখার পর গ্যারেজ বন্ধ করা বাধ্যতামূলক। অন্যথায় ১০০০ টাকা জরিমানা।
“অ্যাঁ!
সামান্য গাড়ি পার্ক করা নিয়ে এত টাকা জরিমানা?” প্রথম নিয়মেই বড়োসড়ো ধাক্কা।
মহিলা আমতা
আমতা করে বললেন, “বাইরে গাড়ি রাখার দরকারটাই বা কী? চুরি-টুরি হয়ে গেলে...”
আমি
দু’নম্বর নিয়মের দিকে এগিয়ে গেলাম।
নিয়ম দুই -
সোসাইটির ভেতরে ঘোরাঘুরি করার সময়, বাইরে থেকে প্রবেশ করার সময় অথবা বেরোনোর সময়
ধূসর অথবা কালো রঙের পোশাক ছাড়া অন্য কোনও রং ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। অন্যথায় ৫০০
টাকা জরিমানা।
আমি নিজের
টি-শার্ট-এর দিকে দেখলাম। উজ্জ্বল সমুদ্র সবুজ টি-শার্ট আর নীল জিন্স পরে আছি।
অবাক হয়ে মহিলার দিকে তাকালাম। এবারও উনি আমতা আমতা করে জবাব দিলেন, “লোয়ার
গার্মেন্ট নিয়ে তেমন সমস্যা নেই। সঙ্গে একটা কালো জ্যাকেট রাখবেন। এটা তেমন
স্ট্রিক্ট রুলের মধ্যে পড়ে না। আপনাকে তিন বার সুযোগ দেওয়া হবে।”
উদ্ভট নিয়মই
বটে! আমি কী রঙের জামাকাপড় ব্যবহার করব সেই ব্যক্তি স্বাধীনতাতেও হস্তক্ষেপ? আমি
আর না থেমে পরের নিয়মগুলো পড়তে শুরু করলাম।
নিয়ম তিন -
বাগানের ফুল গাছের দিকে যাওয়া অথবা হাত দেওয়া কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। বাড়িতে ছোটো
বাচ্চা অথবা পোষা জীবজন্তুর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। বিশেষ করে পিটুনিয়া ফুলের ঝোপের
দিকে যাওয়ার আগে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে অনুরোধ করা হচ্ছে। অন্যথায় ১০০০ টাকা
জরিমানা।
আশ্চর্য!
সামান্য ফুল গাছে হাত দেওয়ার জন্যও এক হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে? তবে এটা নিয়ে
বিশেষ ভাবনার কিছু নেই। অনেক পার্ক বা পাবলিক সেকটারের বাগানে এমন নির্দেশিকা
থাকে। আমি পরের নিয়ম পড়ায় মন দিলাম।
নিয়ম চার -
মাসের প্রথম তিন দিনের মধ্যে ভাড়া সোসাইটির নির্দিষ্ট ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা করে
দিতে হবে। এর জন্যে অ্যাপার্টমেন্টের কেয়ার টেকারকে বার বার বিরক্ত করা বা সময়
চাওয়া নিয়ম বিরুদ্ধ। অন্যথায় মাসের চতুর্থ দিন থেকে প্রতি এক দিনের হিসেবে ১০০
টাকা করে জরিমানা ধার্য হবে।
একটু বেশিই
যেন কঠোর নিয়মগুলো।
নিয়ম পাঁচ -
প্রতিদিনের আবর্জনার মধ্যে পচনশীল আবর্জনা, যেমন সবজির খোসা, উচ্ছিষ্ট খাবার, মাছ
মাংসের হাড় ইত্যাদি এবং প্লাস্টিকের প্যাকেট ইত্যাদি আবর্জনা আলাদা করে ফেলতে হবে।
এর জন্য ধূসর ও কালো রঙের ডাস্টবিন আলাদা করা আছে। নির্দিষ্ট আবর্জনা নির্দিষ্ট
ডাস্টবিনে ফেলতে হবে। অন্যথায় ৩০০০ টাকা জরিমানা।
ভালো নিয়ম।
এই নিয়মটাই এতক্ষণে যথাযথ নিয়ম বলে মনে হল আমার। তবে এই নিয়মের জন্য সরাসরি তিন
হাজার টাকা জরিমানা, একটু বাড়াবাড়িই। অবশ্য নতুনত্ব কিছু নেই। উদ্ভট কয়েকটা নিয়মের
জন্য যদি পাঁচশ বা হাজার টাকা জরিমানা রাখা যায় তাহলে পরিবেশ পরিছন্ন রাখার জন্য
তিন হাজার টাকা ঠিকই আছে।
তবে আসল
খটকাটা হয়তো লুকিয়ে ছিল ছয় নম্বর নিয়মে।
নিয়ম ছয় - রাত্রি
বারোটা থেকে রাত্রি তিনটে অবধি সোসাইটির গেট বন্ধ থাকে। এই সময়ের মধ্যে সোসাইটির
ভেতরে ঘুরে বেড়ানো, বাইরে যাওয়া অথবা বাইরে থেকে ভেতরে আসা নিষিদ্ধ। একান্ত
প্রয়োজন অথবা আপৎকালীন প্রয়োজনে সোসাইটির কেয়ার-টেকারের সঙ্গে আগে যোগাযোগ করতে
হবে। ঐ সময়টুকু ঘরের ভেতরে চিৎকার করা অথবা জোর শব্দে বাদ্যযন্ত্র বাজানো, টিভি
চালানো নিষিদ্ধ। দরজা জানালা, এমনকি ঘরের ভেতরের উজ্জ্বল আলোও ঐ সময় বন্ধ রাখতে
হবে অথবা পুরু পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। নিয়মভঙ্গ হলে ৩০০০ টাকা জরিমানা।
আমি আর
স্থির থাকতে না পেরে মহিলাকে প্রশ্ন করেই বসলাম। “আচ্ছা এই অ্যাপার্টমেন্টে কী
এলিয়েন থাকে? এত ফালতু নিয়ম তো মানুষে বানায় বলে হয় না।”
আমার
প্রশ্নে রিয়েল এস্টেট এজেন্ট মহিলা যেন ঘাবড়ে গেলেন। বললেন, “এলিয়েন? এলিয়েন কেন
থাকবে? মানুষই থাকে। একটু কড়া নিয়ম না হলে সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলা যায় না ম্যাডাম।
আমাদের গ্রীন গ্যালাক্সি সোসাইটির ট্রাস্টের উদ্দেশ্যই হল সুস্থ ও স্বচ্ছ পরিবেশ
গড়ে তোলা। মানুষের মন ও স্বাস্থ্যও তো এর বাইরে নয়, তাই না?”
হিসেব করে
দেখলাম আমি এক মাসে যদি সব ক’টা নিয়ম ভাঙি তাহলে মোটামুটি সাড়ে আট হাজার টাকা
জরিমানা দিতে হবে। প্রতি মাসের শেষ দিনে রাত্রি বারোটার মধ্যে আমার স্যালারি এসে
যায় এটাই যা আশার কথা, না হলে ঘর ভাড়া দিতেও প্রতিদিন একশো টাকার জরিমানার পারা
চড়ে যেত।
এত কম ভাড়ায়
এত সহজে হয়তো এর চেয়ে ভালো থাকার জায়গার ব্যবস্থা করতে পারব না। তাই দু-একটা উদ্ভট
ও কড়া নিয়ম জেনেও কাগজের শেষে সই করে দিলাম।
রিয়েল
এস্টেট এজেন্ট মহিলা ঘর ভাড়া বাবদ তিন মাসের অগ্রিম চেক ও সই করা কাগজগুলো নিয়ে
প্রস্থান করলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, কাগজগুলোর একটা প্রতিলিপি আর একজন ঘর
পরিষ্কার করার লোক আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন।
আমি ব্যাগ
থেকে একটা চাদর বের করে বিছানার গদির উপর পেতে ক্লান্ত শরীরটা ছেড়ে দিলাম। মাথাটা
ঝিমঝিম করছিল আমার। এই ভাবেই শুরু হল সবুজ নীহারিকায় আমার প্রথম দিন।
* * *
প্রথম
কয়েকদিন সবুজ নীহারিকায় বেশ ভালোভাবেই কাটল। আশেপাশের অ্যাপার্টমেন্টের দু-একজন প্রতিবেশীর
সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছে। মোটেই তাঁদের এলিয়েন বলে মনে হয়নি,
প্রত্যেকেরই হাশিখুশি ভদ্র ব্যবহার। তবে একটা সাধারণ বিষয় সকলের মধ্যেই খেয়াল
করেছি, এই সোসাইটির নিয়ম সম্পর্কে কেউ যেন কথা বলতে আগ্রহী নয়। এরকম উদ্ভট নিয়ম
কেন জিজ্ঞেস করলে কেউ কিছু বলতে পারে না। অথবা বলতে চায় না। এর পেছনে যে ঠিক ভয়
কাজ করে তা নয়, এরা সকলেই যেন বিষয়টা দৈনন্দিন কাজের মতোই স্বাভাবিক মনে করে।
আমার
অ্যাপার্টমেন্টে কেউ এলে সব সময় ধূসর বা কালো একটা জ্যাকেট চড়িয়ে আসতে দেখেছি।
দেখাদেখি আমিও একদিন অফিস ফিরতি পথে দুটো কালো জ্যাকেট কিনে নিলাম। ধূসর
রঙটা মোটেই পছন্দ নয় আমার। ট্রাস্টের লোকজন এবং কেয়ার-টেকার ও ম্যানেজারের সই সহ
নিয়মাবলির কাগজপত্র আমার হাতে এসে গিয়েছিল পরের দিনই। এখনও ব্যক্তিগত যানবাহন
যেহেতু কেনা হয়নি তাই প্রথম নিয়ম অনুসরণ বা ভঙ্গ করা কোনোটাই আমার ক্ষেত্রে খাটে
না। খুব সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খেয়ে আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হয়, ন’টার
মধ্যে অফিসে পৌঁছে যাওয়ার সময়। তাই রাত্রি দশটার মধ্যে প্রতিদিনের আবর্জনা
নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে এগারোটার মধ্যে আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়ি। ডাস্টবিনটা
ঠিক যেখানে রাখা আছে তার পেছনেই লাল নীল সাদা গোলাপি বেগুনি রঙের পিটুনিয়া ফুলের
ঝোপ। এই ফুলের ঝোপ থেকেই আমার প্রথম সন্দেহ শুরু হয়।
বেশ
কয়েকদিনের আবর্জনা জমে ছিল। প্লাস্টিক প্যাকেট ও নানারকম আবর্জনায় ভরে উঠেছিল দুটো
ব্যাগ। ঘড়িতে সময় দেখলাম সাড়ে দশটা বাজে। ব্যাগ দুটো তুলে লিফটে চড়ে নিচে এলাম।
বাইরেটা আজ যেন অদ্ভুত রকমের শান্ত। শীতের শেষ, বাগানে ফুল পাখির সমাহার দেখলেই
বোঝা যায় বসন্ত এসে গেছে। অথচ সূর্য ডোবার পর কেমন যেন গা ছমছমে পরিবেশ। বাইরের
দোকানটায় একটা টিমটিমে আলো জ্বলে, সেটাও এগারোটার পর বন্ধ হয়ে যায়।
হেঁটে
ডাস্টবিনের কাছে এলাম। প্রায় একজন মানুষ সমান দুটো ডাস্টবিন, একটা কালো একটা ধূসর।
ধূসর ডাস্টবিনে আনাজের খোসা আর কালো ডাস্টবিনে প্লাস্টিকের আবর্জনা ফেলে পেছন ফিরতেই
কেমন একটা অনুভূতি হল। কী যেন একটা ঠিক নেই, একটা অন্যরকম ব্যাপার। ঘুরে দাঁড়ালাম
ডাস্টবিনের দিকে। এখানে এমন কিছু একটা আছে যা বদলে গেছে, কিন্তু এই বদলটা আমার
চোখে ধরা দিচ্ছে না। কিছু যেন একটা নেই, অথবা আছে কিন্তু উপস্থিতিটা অস্বস্তিকর।
জানি নিয়ম
বিরুদ্ধ, কিন্তু পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম পিটুনিয়া ফুলের ঝোপের কাছে। নিয়মাবলিতে
লেখা আছে - ‘...বিশেষ করে পিটুনিয়া ফুলের ঝোপের দিকে যাওয়ার আগে বাড়তি সতর্কতা
অবলম্বন করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।’ আশ্চর্য ব্যাপারটা এবার আমার চোখে ধরা পড়ল। এই
ক’দিন দেখেছি রঙবেরঙের পিটুনিয়াগুলোকে। কোনোটা লাল, কোনোটা শকিং পিঙ্ক, আবার গাঢ়
বেগুনি অথবা হলদে। কিন্তু এখন আমার সামনে যে পিটুনিয়াগুলো ফুটে আছে সেগুলো সব সাদা
অথবা কালো। ফুলগুলো শুধু ফুটেই নেই, তিরতির করে কাঁপছে, অথচ এখন বাতাসের লেশমাত্র
নেই। যেন এগুলো ফুল নয়, মানুষ। নিজেদের
মধ্যে কথা বলছে কি? আকার আয়তনেও যেন আগের চেয়ে দ্বিগুণ।
খুট্ করে
কোথাও একটা শব্দ হল। আমি তাকিয়ে দেখলাম পিটুনিয়ার ঝোপের কাছে দাঁড়িয়ে আছি আমি। কেউ
দেখে ফেলার আগে কালো জ্যাকেটটার পকেটে হাত ঢুকিয়ে লিফটের দিকে দৌড়ে চলে গেলাম।
সারা রাত
ঘুম এল না, একটা চাপা অস্বস্তি নিয়ে রাতভর এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দিলাম। ভোরের দিকে
চোখ লেগে গিয়েছিল, উঠতে দেরি করে ফেলেছি। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় কালো জ্যাকেটটা
গায়ে চড়াতে ভুলে গিয়েছিলাম। অফিস থেকে ফিরে দরজা খুলেই দেখি দরজার তলায় একটা সাদা
খাম পড়ে। খামের ভেতরে লেখা আছে - গতকাল রাতে পিটুনিয়ার ঝোপের দিকে যাওয়ার জন্য
সোসাইটির ট্রাস্টের তরফ থেকে আমার ১০০০ টাকা জরিমানা ধার্য হয়েছে। এর সঙ্গে আমাকে
উজ্জ্বল রঙের জামাকাপড় পরে বাইরে না যাওয়ার জন্য সতর্ক করা হয়েছে।
আশ্চর্য!
আমি কোনো গাছে হাত দিইনি, শুধু ঘাসের ওপর দাঁড়িয়েছিলাম মাত্র, তাতেই হাজার টাকা
জরিমানা? এবার বিষয়টা বিরক্তির চেয়েও বেশি রাগের উদ্রেক করল। কোনো ঘটনার পেছনে
যুক্তি থাকবে না এ হতেই পারে না। সিদ্ধান্ত নিলাম এরকম উদ্ভট নিয়মের পেছনে
যুক্তিগুলো খুঁজে বের করবই।
পরের দিন
ঘরের আলো বন্ধ করে ডাস্টবিনে আবর্জনা ফেলে আর ঘরে ফিরলাম না, সিঁড়ির তলার
অন্ধকারটায় লুকিয়ে রইলাম। আমার মন বলছিল পিটুনিয়া বাগানেই রহস্যটা লুকিয়ে আছে।
সিঁড়ির ঠিক সামনের ড্রাইভওয়েটার পেছনেই পিটুনিয়ার ঝোপটা।
মোবাইল
ইচ্ছে করেই ঘরে রেখে এসেছিলাম, হাত ঘড়িতে সময় দেখলাম বারোটা দশ। আজও পিটুনিয়াগুলো
সাদা কালো হয়ে আছে, গতকালের মতোই আয়তনে বড়ো এবং একইরকম তিরতির করে কাঁপছে। ঠিক সেই সময়েই খুট্ করে একটা শব্দ হল কোথাও।
আমি ফুলগুলোর দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইলাম। হঠাৎ বাগানের সোনালি আলোটা দপ্ দপ্
করতে করতে বন্ধ হয়ে গেল। আরও ঘন কালো অন্ধকার যেন চেপে ধরেছে
বাগানটাকে। কিন্তু আশ্চর্য, আমি পিটুনিয়াগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ওদের গা থেকে
যেন ঝাপসা নরম একটা আলো ঠিকরে পড়ছে। যে আলোয় চোখ ধাঁধাঁয় না, কিন্তু দেখা যায়।
বাগানে কোনও
প্রাণের চিহ্ন নেই, সোসাইটি একদম নির্জন। না, নির্জন নয়! বাগানে কেউ একজন আছে।
পিটুনিয়ার ঝোপের আড়াল থেকেই বেরিয়ে এল লম্বা কালো জোব্বা পরা একটা লোক। লোকটার চলন
ঠিক মানুষের মতো নয়, লাফিয়ে লাফিয়ে অদ্ভুত ভাবে হাঁটে। ডাস্টবিনের কাছে এসে
বাগানের চারপাশ মাথা ঘুরিয়ে দেখল একবার। তারপর কালো ডাস্টবিনের ঢাকনা খুলে
বিন-ব্যাগটা দু’হাতে বার করল।
আমি প্রথমে
ভেবেছিলাম সোসাইটির জমাদার আবর্জনা তুলতে এসেছে। কিন্তু আশপাশে কোনও গার্বেজ ট্রাক
নেই। ঠিক তখনই আমাকে অবাক করে দিয়ে বিন-ব্যাগটা দু’হাতে তুলে ধরে হুডি পরা কালো
মাথার ভেতরে ঢুকিয়ে নিল। আমি কি ঠিক দেখলাম? পুরো প্লাস্টিকের
বিন-ব্যাগটা লোকটা গিলে ফেলল এক নিমেষে! এটা দেখার পরই আমার মুখ থেকে একটা ভয়
মিশ্রিত বিস্ময়কর শব্দ বেরিয়ে এল - “আঁক!”
শব্দটা
লোকটা শুনতে পেয়েছে, চমকে দিয়েছে ওকে। আবার দু’পাশে দেখে নিয়ে লোকটা লাফাতে লাফাতে
পিটুনিয়া ঝোপের পেছনে চলে গেল। প্রথমটায় ভয়
পেয়েছিলাম, কিন্তু সোসাইটির বাইরের কোনও বদমাইশ লোক অথবা চোর ঢুকে এইসব করছে ভেবে
দৌড়ে গেলাম পিটুনিয়া ঝোপের পেছনে। তখন বাগানের আলোটাও জ্বলে উঠেছে, আর অদ্ভুতভাবে
পিটুনিয়াগুলোর কম্পনও বন্ধ হয়ে গেছে। আমি এদিক ওদিক দেখতে গিয়ে বুঝলাম ঠিক আমার
পেছনেই কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। সোসাইটির গেট কি আজ খোলা থেকে গিয়েছিল? এ কি সাধারণ চোর
নয়, কোনও খুনি? আতঙ্কে জ্ঞান হারালাম আমি।
* * *
“এখন কেমন
আছেন আপনি?” মাথার ঝিমঝিম ভাবটা নিয়ে চোখ মেলে তাকাতেই দেখলাম লোকটাকে। মাথায় উশকোখুশকো
কাঁচা-পাকা চুল, এক মুখ সাদা দাড়ি নিয়ে একজন বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে আছেন আমার সামনে।
হাতে একটা বড়ো কফি মগ।
সোফার উপর
উঠে বসলাম। এটা আমার ঘর নয়, অচেনা কোনও জায়গা। আমি অবাক চোখে এদিক ওদিক তাকাতেই
বয়স্ক লোকটি বললেন, “এটা আমার ঘর। তুমি বাইরে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলে। এখন এই হট
চকোলেটটা খেয়ে নাও, ভালো লাগবে।”
আমি
দ্বিধাগ্রস্ত হাতে মগটা নিতে গিয়ে বললাম, “আপনি কে?”
“আমি শশধর
মল্লিক। এই গ্রীন গ্যালাক্সি সোসাইটির কেয়ার-টেকার।”
কেয়ার-টেকার
শুনে আশ্বস্ত হলাম। হট চকোলেটের মগে চুমুক দিলাম, দারুণ স্বাদ, একটু ঝাঁঝালোও।
আমাকে চুপ
থাকতে দেখে বৃদ্ধ বললেন, “পিটুনিয়া ঝোপের পেছনে এই সময় আপনি কী করছিলেন? আপনি কি জানেন
এই মুহূর্তে আপনি সোসাইটির দুটো গুরুত্বপূর্ণ নিয়মভঙ্গ করেছেন?”
আমি সজোরে
মাথা নাড়লাম, “হ্যাঁ জানি। কিন্তু ঐ লোকটা...”
আমার মুখের
কথা কেড়ে নিয়ে বৃদ্ধ বললেন, “কোন লোকটা? যে ডাস্টবিনের আবর্জনা ঝোলা শুদ্ধু খেয়ে
ফেলেছে?”
বললাম,
“হ্যাঁ, আপনি দেখেছেন? দেখেছেন ঐ লোকটাকে?”
বৃদ্ধ আমাকে
হাত তুলে শান্ত হতে ইশারা করলেন। বললেন, “এত কিছু তোমার দেখা উচিত হয়নি। এর জন্য
তোমাকে এখান থেকে বের করেও দিতে পারি। একটার পর একটা নিয়ম ভেঙেছ তুমি? তবে এই
মুহূর্তে তোমার মনে যে কৌতূহল তা অবশ্যই নিবারণ করব।
“বছর খানেক
আগে যখন এই গ্রীন গ্যালাক্সি নির্মাণ শেষ হল, লোকজন সবে থাকতে শুরু করেছে, তখন
হঠাৎ একটা চিঠি এল আমার কাছে। চিঠিটা কে পাঠিয়েছে, কোত্থেকে এসেছে কিছুই লেখা নেই।
তিন কূলে আমার কেউ নেই, প্রাইমারি স্কুলে বিজ্ঞানের মাস্টারি করে অবসর নিয়েছি কয়েক
বছর আগে। এই সোসাইটির ভেতরে একটা ঘর আর কেয়ার-টেকারের দায়িত্ব নিয়ে বাকিটা জীবন
দিব্যি কেটে যাবে ভেবেছিলাম। আমাকে কে চিঠি পাঠাবে?
“খাম খুলে
দেখলাম একটা সাদা কাগজের উপর বাংলায় টাইপ করে আমার নামে লেখা চিঠি। চিঠিতে
প্রেরকের নাম পরিচয় কিছু নেই, তবে আমার সম্পর্কে বেশ খোঁজখবর রাখেন বলে মনে হল।
মাস্টারি জীবনে ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞানের প্রদর্শনী করানোর সময় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি
নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার অভ্যাস শুরু হয়েছিল। তাই আমার উপর একটা গুরু দায়িত্ব দেওয়া
হচ্ছে। এই দায়িত্ব নির্বিঘ্নে অতি গোপনীয়তার সঙ্গে যদি পালন করতে পারি তাহলে
তাঁদের এই গবেষণা সফল হবে।”
“তাঁদের!
কাদের?” হট চকোলেটে চুমুক দিতে দিতে চোখ বড়ো বড়ো করে প্রশ্ন করলাম বৃদ্ধকে।
বৃদ্ধ মৃদু
হেসে ঘরের জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে ইশারা করে দেখালেন। জানালার বাইরে কালো
আকাশ ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলাম না। বৃদ্ধ আবার বলতে শুরু করলেন, “চিঠি আসার
কয়েকদিন পর একটা বড়ো পার্সেল এল আমার কাছে। পার্সেলের ভেতরে অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি,
এই যন্ত্রপাতি সম্পর্কে আগে কোনোদিন শুনিনি, দেখিওনি। সঙ্গে একটা একশো পাতার
ম্যানুয়াল বুক। সেই বই পড়ে পড়ে যন্ত্রপাতিগুলোকে জোড়া দিলাম। জোড়া দিয়ে যেটা দাঁড়াল
সেটা দেখতে এরকম।”
কথাটা বলেই
বৃদ্ধ সোফার পেছনে রাখা লম্বা জিনিসটার ওপর থেকে সিল্কের ঢাকাটা সরিয়ে দিলেন।
এতক্ষণ খেয়াল করিনি এটা। পেছন ফিরে দেখি সেই অন্ধকারে দেখা লাফিয়ে লাফিয়ে চলা কালো
জোব্বা পরা লম্বা মানুষটা যে ডাস্টবিন থেকে খাবার চুরি করছিল। আমি ভয়ে সোফা ছেড়ে
উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “এটা কী?”
“এটা প্লাস্টিকখেকো
যন্ত্র।”
“অ্যাঁ!”
“হ্যাঁ,
এখনও ট্রায়ালে আছে। একে আরও উন্নত করার জন্য বিস্তর গবেষণা চলছে। আর একে চালনা
করার দায়িত্ব আমার। এ যদি ঠিকঠাক কাজ করতে পারে তাহলে পৃথিবী থেকে যত প্লাস্টিক
আবর্জনা আছে তা কয়েকদিনের মধ্যেই সরিয়ে ফেলা সম্ভব হবে।”
আমি লম্বা
যন্ত্রটার কাছে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। হুডির আড়ালে ধাতব যন্ত্রাংশের কাঠামো, ঠিক
মানুষের মতোই। না, মানুষ নয়, সিনেমায় দেখা রোবটের মতোই। মাথার ওপর জ্বল জ্বল করছে
কুচকুচে কালো দুটো চোখ, পিঠের সঙ্গে লেগে আছে একটা সোলার প্যানেল। ওটা দিয়ে
নিশ্চয়ই সূর্যের আলোয় চার্জ নেয় যন্ত্রটা। বললাম, “আপনি এই যন্ত্রটার কথা সবাইকে
জানাচ্ছেন না কেন? জানালে তো এরকম আরও যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব।”
বৃদ্ধ
বললেন, “যন্ত্রটা আমার বানানো নয়, আমি শুধু জুড়ে দিয়েছি। যারা ওটা পাঠিয়েছে, সময়
হলে তারাই এসে নিয়ে যাবে। আর এই যন্ত্র সম্পর্কে পৃথিবীর মানুষ জানলে আর রক্ষা
নেই। মানুষ নিজের স্বার্থে সুন্দর পৃথিবীর উপর অত্যাচার করেছে। এই যন্ত্র পেলে
বিক্রি করে একদল মানুষ শুধু মুনাফা লুঠতেই ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তাছাড়া, এটার মালিক
আমার উপর নজর রাখছে প্রতিনিয়ত।”
“নজর রাখছে?
কীভাবে?”
“বৃদ্ধ জানালার
পর্দা সরিয়ে পিটুনিয়ার ঝোপের দিকে দেখালেন। বললেন, “ঐ ফুলগুলো দেখেছ? ওগুলো সত্যি
কোনও ফুলগাছ নয়। এক একটা র্যাডার। ওগুলোর মাধ্যমে এই গ্রীন গ্যালাক্সির সমস্ত খবর
প্রতিনিয়ত ওদের কাছে চলে যায়।”
পিটুনিয়াগুলোকে
দেখে আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল। ওগুলো দিনের বেলায় রঙিন আর রাতে সাদা কালো হয়ে যায়,
নিশ্চয়ই সূর্যের আলোর প্রভাবে। বললাম, “এই সোসাইটির যে উদ্ভট সব নিয়ম, এগুলো আপনার
বানানো?”
বৃদ্ধ হেসে
মাথা নাড়লেন। বললেন, “হ্যাঁ, সোসাইটির ভেতরে কোনও যানবাহন রাখা নিষিদ্ধ, কারণ
পেট্রোলের গন্ধে আর লাল নীল উজ্জ্বল রঙের প্রতিফলনে র্যাডারগুলো কর্মক্ষমতা
হারায়। ঠিক সেই কারণেই উজ্জ্বল রঙের পোশাকও এই সোসাইটিতে নিষিদ্ধ। যন্ত্রটা দিনের
একটা বিশেষ সময়ে সূর্যের আলোয় শক্তি সঞ্চয় করে, তাই পিটুনিয়া বাগানের পেছনে আমার
ঘরের এদিকে সকলের আসা বন্ধ করতেই জরিমানার ব্যবস্থা করেছি। জরিমানা না দিতে হলে
কোনও নিয়মকে মানুষ নিয়ম বলে পাত্তা দেয় না। রাত বারোটা থেকে তিনটের মধ্যে সোসাইটির
সব ক’টা ডাস্টবিনের প্লাস্টিক সংগ্রহ করে ওটা আবার আমার কাছে ফিরে আসে। তাই
ঐ সময়টা বাগানে কারও বেরোনোও নিষেধ।”
“এই নিয়মগুলো
ট্রাস্টের লোকেরা মেনে নিল?”
“আমি বলেছি
পেট্রোলের গন্ধ, উজ্জ্বল রঙ, জোর শব্দ এসবে আমার অসুবিধে হয়। বাগানে এদিক ওদিক পড়ে
থাকা আবর্জনাও পরিবেশ বান্ধব সোসাইটিতে বেমানান। আর আমার অনুমতি ছাড়া আমার বাড়ির
আশেপাশে কেউ ঘুরঘুর করবে এটা আমি বরদাস্ত করব না। তাছাড়া জরিমানার বেশ মোটা অঙ্কের
টাকা ওদের খাতায় জমা পড়ে বলে জোরালো কোনও আপত্তি কেউ করেনি।”
“হুম,
বুঝলাম।” মগের হট চকোলেট শেষ হয়েছিল অনেকক্ষণ। আমি
মগটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বললাম, “আমাকে এত কথা যে বললেন, আমি যদি এগুলো কাউকে
বলে দিই?”
বৃদ্ধ এবার
রহস্যময় হাসি হাসলেন। বললেন, “পার্সেলে আরও একটা জিনিস এসেছিল, সুস্বাদু হট চকোলেট।”
ঠিক তখনই
পুরো ঘরটা আমার সামনে দুলতে শুরু করল। মনে হল আমার শরীর পালকের মতো হালকা হয়ে
গেছে, আমি যেন আকাশের গায়ে উড়ে বেড়াচ্ছি। আকাশের রং উজ্জ্বল জলপাই সবুজ, দূরে একটা
ঝাপসা নরম আলো, আর চারদিকে সেসামে সীডের মতো ছড়িয়ে আছে নক্ষত্র।
* * *
পরের দিন
সকালে যখন চোখ খুললাম ঘড়িতে তখন সকাল দশটা। মাথা আর শরীর বেশ ভারী হয়ে আছে। দিনটা
রবিবার, তাই অফিস যাওয়ার তাড়া নেই। কিন্তু শরীর এত ভারী হয়ে আছে কেন বুঝতে পারলাম
না। রাতে কখন ঘুমিয়েছি? শুধু মনে আছে ডাস্টবিনে আবর্জনা ফেলে ঘরের দিকে ফিরছিলাম।
তারপর ঠিক কী হয়েছিল আমার মনে নেই। উঠতে গিয়ে সাইড টেবিলের ওপর রাখা সাদা খামটা
দেখতে পেলাম। এতে কী আছে? খামটা খুলে দেখলাম। ভেতরে লেখা আছে -
মিস লাহিড়ী,
আপনি এই এক
সপ্তাহের মধ্যে বেশ কয়েকটি নিয়মভঙ্গ করেছেন। কিন্তু প্রথমবার বলে প্রত্যেকটি জরিমানা
মকুব করা হল। আপনার কাছে রাখা নিয়মাবলি আরও একবার ভালোভাবে পড়তে অনুরোধ করা হচ্ছে।
আশা করি দ্বিতীয়বার আপনাকে এটা মনে করিয়ে দিতে হবে না।
গ্রীন
গ্যালাক্সি সোসাইটি ট্রাস্ট
মনে পড়ল,
সেদিন কালো জ্যাকেট পরে বেরোতে ভুলে গিয়েছিলাম, আর পিটুনিয়া বাগানের দিকে গিয়েছিলাম
হয়তো। গিয়েছিলাম কি? ধুর! কিছুই মনে নেই।
মাথাটা ভার হয়ে আছে। এক মগ কড়া কফি নাহলে মাথার জটগুলো খুলবে না।
কফির মগ
হাতে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। নিচে সুন্দর রঙবেরঙের পিটুনিয়া ফুটে আছে। পেছনেই
ঘাসের জমির ওপারে একটা ঘর। ঘরের সামনে একটা আরাম কেদারায় খবরের কাগজ হাতে একজন
বৃদ্ধ বসে আছেন। মাথা উশকোখুশকো কাঁচা-পাকা চুল, সাদা
ধবধবে দাড়ি। কেন জানি না মনে হল এই লোকটার নাম শশধর, পদবী মনে পড়ছে না। কোথাও কি
দেখেছি একে? হবে হয়তো। সোসাইটির ভেতরেই দেখেছি, মনে পড়ছে
না।
No comments:
Post a Comment