কোকো-কুকির কাণ্ডকারখানা
অনন্যা দাশ
কুকিটাকে ইদানীং আমি আর দু-চক্ষে দেখতে পারছি না। মাকে বলা যাবে না। মাকে বললে মা বলবেন, “কী ভাষা হয়েছে তোমার কোকো! ওই ঝন্টুটার সঙ্গে মিশে মিশে এই অবস্থা হয়েছে!”
মা’র মতে ঝন্টু পাড়ার বিচ্ছু শিরোমণি, কিন্তু সেটা ঠিক নয়। ঝন্টুর মাথায় খুব বুদ্ধি। সেই জন্যেই আমি ঝন্টুর সঙ্গে বন্ধুত্বটা করেছিলাম। কুকির সঙ্গে মোকাবিলা করতে গেলে আমার নিজের বুদ্ধিতে কাজ হয় না। ঝন্টুর সাহায্যের দরকার। আমার যমজ বোন হলে কী হবে, কুকি সব সময় আমার থেকে এক পা এগিয়ে। কী ভাবে এগিয়ে? সেটা কী করে বোঝাব? মানে শুধু ক্লাসে বেশি নম্বর পাওয়ার কথা বলছি না। সব কিছুতেই কুকি এগিয়ে। যেমন সেবার জেঠু আমাদের দুজনকে একটা করে টবের গাছ দিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “এর পরের বার যখন আসব তখন দেখব তোদের কার গাছ বেশি ভালো রয়েছে। সে প্রাইজ পাবে।”
আমার খুব ইচ্ছে ছিল প্রাইজটা আমি পাই, কিন্তু না, আমার গাছটা এক ইঞ্চিও বাড়ছিল না, কেমন মিইয়ে যাওয়া হলুদ মতন হয়ে ছিল আর কুকিরটা কী তরতাজা। রোজ নতুন নতুন সবুজ পাতা। জেঠু যখন চার মাস পর এলেন তখন ডেয়ারি মিল্ক চকোলেটটা কুকিই পেল। আমি জুল জুল করে তাকিয়ে দেখলাম। পরদিন আমি ঝন্টুকে ধরলাম। সে আমাদের বাড়িতে এল, কয়েকদিন পর আমাকে বলল, “বুঝতে পেরেছি। কাকিমা তোদের সকালে যে চিরতার জল খেতে দেন কুকি সেটা না খেয়ে গাছের টবে দিচ্ছে তাতেই গাছ ডগমগ হয়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছে।”
“অ্যাঁ!” মেয়েটার কী বুদ্ধি! তেতো জল নিজে না খেয়ে গাছকে দিয়ে তার বদলে চকোলেট পেয়ে গেল! তা এক মাঘে তো শীত যায় না। জেঠু তো আবার এসে গাছটাকে দেখবেন বলেছেন, তাই আমি পরদিন সকালে চিরতার জলের গেলাসটা নিয়ে গিয়ে ঢকঢক করে টবে সবটা ঢেলে দিলাম। তা টবের তলার ফুটো দিয়ে সব জল বেরিয়ে ঘরের মেঝেতে জমা হবে তা আমি কী করে বুঝব? চম্পা
মাসি সেই জলে পা হড়কে আছাড় খেয়ে পড়ল। তারপর এমন চেঁচাল যেন কেউ তাকে লাঠিপেটা করছে। অত চেঁচাবার কী আছে শুনি? ওই রকম পড়ে যাওয়া তো আমাদের সব সময়ই হচ্ছে। তা চম্পা মাসির চিৎকারের ফল যা হল, মা আমাদের দুজনকে সামনে দাঁড় করিয়ে চিরতার জল খাওয়াতে লাগলেন রোজ। জলের গেলাস নিয়ে চোখের আড়াল হওয়া চলবে না।
কুকিরও তো এখন গাছে জল দেওয়া মাথায় উঠেছে, সে রেগে আমাকে বলল, “তুইও যেমন মাথামোটা তোর ওই বন্ধুটাও তাই! তার কথা শুনে সব জলটা টবে ঢেলেছিস! তোর জন্যে এখন আমাকেও ওই বিশ্রী জিনিসটা পুরোটা খেতে হচ্ছে!”
তারপর যখন সুলেখা মাসি বেড়াতে এলেন তখনও যে কাণ্ডটা হল সেটা আর না বলে পারছি না। মাসিরা দিল্লিতে থাকেন। অনেকদিন পর মাসি এলেন আমাদের বাড়িতে। তাও মেসো আর তিন্নিদিদি আসতে পারেনি কাজ আছে বলে। কুকি একেবারে মাসির সঙ্গে সেঁটে সেঁটে ছিল। মনে হয় উপহারের লোভে। সে যা হোক, আমার উপহারের দরকার নেই। আমি খেলতে চলে গেলাম ঝন্টুদের সঙ্গে, ফিরে এসে দেখি কুকি মাসিকে মিনির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে! মিনি হল কুকির আদরের বেড়াল। আমি তাকে একদম সহ্য করতে পারি না। তার প্রধান কারণ হল সে স্টুকে বিরক্ত করে।
মাসি, “ওমা কী মিষ্টি!” ইত্যাদি করে মিনিকে আদর করে চটকে মটকে দিলেন। মিনি আবার চটকানো সহ্য করতে পারে না তেমন, তাই সুযোগ পেয়েই বিদায় নিল। মাসি ব্যাগ থেকে বেশ কিছু টাকা বার করে কুকিকে দিয়ে বললেন, “মিনি
ভীষণ কিউট, ওর জন্যে আমার তরফ থেকে কিছু কিনে দিস প্লিজ।”
কুকি টুক করে টাকাটা নিয়ে লুকিয়ে ফেলল। আমি জানি মিনির জন্যে ও কিছু কিনবে না। তখন আমার মনে হল, মিনির থেকে আমার স্টু তো অনেক বেশি কিউট, মাসির সঙ্গে ওর পরিচয় করানো উচিত আমার। উপহার আমার চাই না, কিন্তু টাকা পেলে মন্দ হয় না। অবতারের সেকেন্ড পার্টটা দেখা হয়নি এখনও। টাকা পেলে বেশ কেমন হলে গিয়ে দেখতাম। যেমন ভাবা তেমন কাজ। আমি স্টুকে খাঁচা থেকে বার করে নিয়ে এসে মাসিকে বললাম, “মাসি, এই হল স্টু। মিনির থেকে ও বেশি কিউট না?”
স্টু আমার সাদা ইঁদুর। স্টুকে দেখে মাসির চোখ গোল গোল হয়ে গেল। প্রথমে কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলতে পারলেন না, মাছের মতন মুখ খুলছিল আর বন্ধ হচ্ছিল। তারপর এমন একটা চিল চিৎকার করলেন যে মার হাত থেকে ডালের বাসন পড়ে গেল। রান্নাঘরের সারা মেঝেতে ডাল। মাসির মুখ আর বন্ধ হচ্ছে না দেখে আমি লাফ দিয়ে মাসির মুখ বন্ধ করে দিলাম দুই হাত দিয়ে। আমি একটা বইতে পড়েছিলাম এক মহিলা ইঁদুর দেখে এমন চিৎকার করেছিলেন যে ইঁদুরটা ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে তাঁর হাঁ করা মুখের ভিতর ঢুকে গিয়েছিল আর তিনি ঢোঁক গিলে তাকে গিলে ফেলেছিলেন! স্টুর সঙ্গে এমনটা যাতে না হয় তাই সাবধানতার জন্যে আমাকে মাসির মুখটা বন্ধ করতে হল। মা এসে সব দেখেশুনে রেগেমেগে চিৎকার করতে লাগলেন, “কোকো তুমি জানো না সুলেখার ইঁদুরে প্রচণ্ড ভয়? ওর হার্ট অ্যাট্যাক হয়ে যেতে পারে। যাও এখুনি স্টুকে খাঁচায় রেখে এসো। কেন ওকে বার করেছ?”
খাঁচায় রেখে এসো বলা সোজা, কিন্তু স্টুকে পেলে তো খাঁচায় ভরব! মাসির পিলে চমকানি চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে আমি তো স্টুকে হাত থেকে পালিয়ে যেতে দিয়েছি। এখন সে কোথায় কোন ফার্নিচারের পিছনে লুকিয়ে বসে আছে সেটা বার করতেই দম বেরোবে। তাই শুনে মাসি আঁ আঁ করে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন প্রায়। শেষে মা মাসিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন আর আমি কুকিকে নিয়ে ঘরের আনাচে কানাচে খুঁজে স্টুকে পেয়ে তাকে খাবারের লোভ দেখিয়ে খাঁচায় ভরলাম। এর পর বেশ কিছুদিন মা আর মাসি দুজনেই আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলেননি। কুকি মাসির দেওয়া টাকা দিয়ে এটা সেটা কেনে আর আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে মুচকি মুচকি হাসে।
তবে কুকির মাথায় যতই বুদ্ধি থাকুক, গরমের ছুটিতে তার মাংসের কাটলেটটা হাওয়া হয়ে যেতে সে আমাকে বলল, “তুই আর ঝন্টু মিলে যদি উদ্ধার করে দিতে পারিস আমার কাটলেটটা কে খেয়েছে তাহলে তোদের ওই নতুন সিনেমাটা দেখার জন্যে পয়সা দেব।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে ঝন্টুকে খবর দিলাম। সিনামার নাম শুনে সেও হাজির। সিনেমা দেখানোর লোভ দেখালে ঝন্টু কী আর থাকতে পারে? আমি তাকে বললাম, “কাটলেট চোরকে খুঁজে বার করতেই হবে! নাহলে পাড়ার কেউ আর তোকে এটা সেটা খুঁজে দিতে ডাকবে না। তোর গোয়েন্দা নামটা মাটিতে মিশে যাবে!”
কুকি শুনে হেসে কুটিকুটি হয়ে বলল, “থাক অনেক হয়েছে, অত ড্রামা করতে হবে না। ভারি তো গোয়েন্দা।”
ঝন্টু বলল, “কাটলেটকে শেষ কখন দেখা গিয়েছিল এবং কোথায়? প্রথম থেকে সব কিছু বলতে হবে।”
কুকি বলল, “প্রথম থেকেই বলি। আজ দুপুরে খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল, ছুটির দিনে যেমন হয়, তাই বিকাশকাকু চায়ের সঙ্গে খাওয়ার জন্যে কাটলেট নিয়ে আসতে মা যখন সবাইকে দিলেন তখন আমি কাটলেট শুদ্ধু প্লেটটাকে নিয়ে সোজা ওই কাচের আলমারিটার ওপর তুলে রেখে দিলাম পরে খাব বলে। ঘণ্টা দুয়েক পরে ঘরে ঢুকে দেখি প্লেটে কয়েকটা গুঁড়ো পড়ে রয়েছে, কাটলেট হাওয়া! দরজা বন্ধ করা ছিল তাই মিনিকে দোষ দেওয়া যাবে না। তার ঘরে ঢোকার উপায় ছিল না। সে তো বাইরে থেকে ছিটকিনি খুলতে পারবে না। কোনো মানুষের কাজ এটা। বাবা নয়, কারণ বাবা বিকাশকাকুর সঙ্গে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। যখন ফিরলেন তখন কাটলেট গন।”
ঝন্টু বলল, “ঠিক আছে, তাহলে সাসপেক্ট কে কে?”
“মা, চম্পামাসি, দাদু আর কোকো। ঠাম্মা মাংস খান না। তাই ঠাম্মা বাদ।”
সর্বনাশ! মেয়ে আমাকেও সন্দেহ করছে! আগেই বলেছি কুকি অনেক দিক থেকেই আমার থেকে এগিয়ে আর গোদের ওপর বিষফোঁড়া হল সে আমার চেয়ে প্রায় ইঞ্চি ছয়েক লম্বা! সবাই আমাকে কেবল বলে, কোকো তুই কুকির কাছে লম্বাতেও হেরে গেলি! সেটা সব সময় আমাকে কষ্ট দেয়, কিন্তু এই বারটা ওই জন্যেই আমি বেঁচে গেলাম মনে হয়।
আমি বললাম, “আমি খাইনি! আমি তো দুপুরে ঘুমোচ্ছিলাম। তাছাড়া ওই আলমারির ওপর কিছু রাখলে আমার হাত যায় না মোটেই। আমি দেখতেই পাই না আলমারির ওপর কী আছে তা তোর কাটলেট কী করে নামিয়ে খাব?”
কুকি শুনে একটু ভেবে বলল, “তা ঠিক। তুই ঘুমোচ্ছিলি। তবে গন্ধ শুঁকে যদি বুঝতেও পারিস যে কাটলেট রয়েছে তাহলেও হাত পেতিস না। আমাকেই কষ্ট করে প্রায় দুই আঙ্গুলে ব্যালে ডান্সারের মতন দাঁড়িয়ে ওটা রাখতে হয়েছিল। তুই যাতে নাগাল না পাস সেই জন্যেই ওখানে রাখা! আর ঘরে চেয়ার-টেয়ার কিছু নেই যে উঠে নিয়ে নিবি। অন্য ঘর থেকে কিছু টেনে নিয়ে যেতে গেলে আমি টের পেয়ে যেতাম! দুম দাম শব্দ হত। তুই আস্তে কিছু করতে পারিস না। এটা কেউ নিঃশব্দে করেছে। তাই কোকো আপাতত সাসপেক্ট লিস্ট থেকে বাদ।”
আমি স্বস্তির
নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক বাবা খুব জোর বেঁচে গেছি এ যাত্রা। চোর অপবাদ মাথায় নিয়ে বাঁচা যায় না। আর ওর কাটলেট খেয়েছি বলে কুকি জীবন ছারখার করে দিত, সেটা আলাদা।
আমরা তিনজন মিলে চললাম পুলিশের মতন সবাইকে জেরা করতে। ঝন্টু সিনেমা দেখে দেখে একেবারে পেকে ঝুনো, সে বলল, “সব কিছু খেয়াল রাখতে হবে। মিথ্যে বলছে কিনা সেই সবের ওপর নজর রাখতে হবে। কথা বলার সময় চোখ নামিয়ে ফেলছে কিনা, বা হাত দিয়ে মুখ ঢাকছে কিনা সেই সব দিকে খেয়াল রাখতে হবে।”
প্রথমেই মা’র কাছে যাওয়া হল। মা সব শুনে বললেন, “নাহ, আমি ডায়েট করছি। পাঁচ কেজি কমিয়েছি কিন্তু আরও কমাতে হবে। কাটলেট আমি নিজেরটাই অর্ধেক টুকরো খেয়েছি। ব্যস ওই টুকুই বরাদ্দ আজকের জন্যে। ভাজা জিনিস বেশি খাওয়া চলবে না ডায়েট চার্টে বলেছে। মিনি খায়নি তো?”
“না, দরজা বন্ধ ছিল, মিনি ঢুকতে পারবে না। চম্পামাসিকে জিজ্ঞেস করব?”
“খবরদার না! তোমরা গোয়েন্দা হয়ে ঘুরছ এদিকে মাথায় হাওয়া ভরা! চম্পা কাটলেট বাড়িতে আসার অনেক আগেই কাজ সেরে চলে গেছে। কাল সকালে আবার আসবে। আর ও মোটেই ওই রকম করে আলমারির মাথা থেকে জিনিস নামিয়ে খাবে না। ওর খেতে ইচ্ছে হলে আমাকে বলবে।”
“ও তাহলে তো শুধু দাদু রইল পড়ে!”
দাদুকে জিজ্ঞেস করতে দাদু দুঃখ করে বললেন, “তোমরা এই বুড়ো মানুষটাকে সন্দেহ করলে শেষ পর্যন্ত? আমার তো দাঁতের পাটি সারাতে গেছে। দুটো দাঁত ভেঙে গিয়েছিল। যতদিন না ওটা আসছে ততদিন আমি সব গলা গলা খাবার খাচ্ছি। এখন মাংসের কাটলেট তো স্বপ্নে ছাড়া খেতে পারব না!”
ঝন্টু বলল, “তাহলে তো কোকোই থাকছে। আমার মনে হচ্ছে এটা কোকোরই কাজ!”
আমি রেগে ঝন্টুর দিকে তাকালাম। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না ও এই ভাবে আমাকে বাসের তলায় ঠেলে ফেলে দেবে!
আমি ফোঁসফোঁস করে বললাম, “তুই আমার বন্ধু না শত্রু?”
ঝন্টু মুচকি হেসে বলল, “সিনেমা যে দেখাবে আমি তার বন্ধু!”
আমার ইচ্ছে করছিল ঝন্টুকে এক ঘুসি মেরে ওর মুখ থেকে ওই বিশ্রী হাসিটা দূর করতে।
এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাই ঝন্টুকে রহস্যের সমাধান অসমাপ্ত রেখেই চলে যেতে হল।
কুকি রাগে গজগজ করতে করতে বলল, “তুই নিজে হয়তো খাসনি, কিন্তু স্টুয়ার্টকে খাইয়ে দিসনি তো? তুই হাত না পাস ও তো দিব্বি আলমারির মাথায় উঠে যেতে পারে।”
আমি বললাম, “হায় হায়! তুই কী রে কুকি? বেচারা স্টু মাসির সঙ্গে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার পর থেকে খাঁচা থেকে বেরোয়নি পর্যন্ত! খুব অত্যাচার হচ্ছে বেচারার ওপর, কিন্তু মা’র কড়া নিষেধ তো আর অমান্য করতে পারি না!”
গুম হয়ে চেয়ারে গিয়ে বসল কুকি। দু-মিনিট বসেই উঠে পড়ে গদি সরিয়ে দেখতে শুরু করল। ওই যে এক রাজকন্যার গল্প ছিল না যে সাতটা তোশকের তলায় রাখা একটা মটরের দানার জন্যে সারা রাত ঘুমোতে পারেনি? কুকি হচ্ছে সেই রকম। আমি কিচ্ছু টের পাই না, কিন্তু ও ঠিক বুঝতে পারে। তিনটে গদির তলা থেকে ‘ভূতুড়ে হাওয়াই চটি রহস্য’ বইটা টেনে বার করল। একেবারে চটি বই। কী করে বুঝল কে জানে।
“এটা এখানে কোথা থেকে এল?”
আমি মাথা চুলকালাম। ঝন্টু এই বইটা নিয়েছিল পড়তে। অয়নের বই। অয়ন তাড়া দিচ্ছিল বইটা ফেরত দেওয়ার জন্যে। নাকি অনেক লাইন। আমি পড়ে নিয়ে ঝন্টুকে পড়তে দিয়েছিলাম। তা চেয়ারের গদির তলায় লুকিয়ে রেখেছে কেন?
আমি আমতা আমতা করে বললাম, “ওটা ঝন্টুকে পড়তে দিয়েছিলাম। অয়নের বই।”
“ইস, তোরা আর বই পাস না! কী সব বস্তাপচা বই!”
“আরে বস্তাপচা নয়,” আমি প্রতিবাদ করলাম, “দারুণ ভয়ের!”
“তা ভালো,” কুকি খেঁকিয়ে উঠল, “এখানে কেন? যে বসবে তাকে ভয় পাওয়াবি বলে?”
“ঝন্টু নিয়ে এসেছিল মনে হয়, আমি আজ সকালেই ওকে বলেছিলাম বইটা নিয়ে আসতে, অয়ন চাইছে। কিন্তু…”
“বুঝতে পেরেছি! তুই যখন ঘুমোচ্ছিলি তখন ঝন্টু এসেছিল বই নিয়ে। আমার কাটলেট খেয়ে, বই চেয়ারের গদির তলায় লুকিয়ে রেখে পালিয়েছে। মনে করেছিল বইটা পরে এসে তোকে বার করে দিয়ে দেবে, কিন্তু ভুলে গেছে।”
“ঝন্টু কাটলেট খেয়েছে?”
“আর কে খাবে? এই দ্যাখ, বইতে তেলের ছোপ। কাটলেট খেয়ে তেলা আঙুলে বইটাকে ধরেছে। তুই যদি আর ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেছিস তাহলে মাকে বলে দেব ও চোর।”
“কিন্তু বাড়িতে ঢুকল কী করে?”
“বাবা আর বিকাশকাকু বেরিয়ে যাওয়ার পর দরজাটা খোলা ছিল মনে হয়।”
“কিন্তু ও তো দোষ স্বীকার করবে না কিছুতেই!”
কুকি একটু ভেবে নিয়ে বলল, “ওকে হাতে নাতে ধরতে হবে। আমি তোকে ফন্দিটা বাতলে দিচ্ছি।”
পরদিন মা পাশের বাড়ির স্নিগ্ধা মাসির বাড়ি যেতেই ঝন্টুকে ফোন করলাম, “তুই বইটা দিলি না তো। অয়ন আবার ফোন করেছিল। ওর চাই।”
“ও আচ্ছা আচ্ছা। আমি এখুনি নিয়ে আসছি।”
“একটু পরে আয়, আমি এখন ঘুমোতে যাচ্ছি,” আমি কুকির শিখিয়ে দেওয়া বুলি বললাম।
“ঠিক আছে,” বলল বটে ঝন্টু, কিন্তু একটু পরেই সে এসে হাজির হবে আন্দাজ করে আমি আর কুকি বাড়ির দরজা খুলে রেখে রুদ্ধশ্বাসে তার জন্যে লুকিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই হল, একটু পরেই ঝন্টু চুপি চুপি এসে দরজা ঠেলে ঢুকল। প্রথমেই সে বাইরের ঘরের চেয়ারের গদির তলায় হাত ঢুকিয়ে বইটা বার করে নিল। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে চট করে ছিটকিনি দেওয়া ঘরের ছিটকিনি খুলে কাচের আলমারির ওপর রাখা প্লেটে চকোলেট কেকের টুকরোটা দেখতে পেল। হাত বাড়িয়ে যেই না সেটাকে নামিয়েছে অমনি কুকি আর আমি মাসির কাছ থেকে শেখা চিৎকারটা করলাম। তারপর যা হল সেটা আর না বলাই ভালো। ঝন্টু খেয়াল করেনি বইতে কুকি লাল রং মাখিয়ে রেখেছিল। ওর হাত লাল রঙে মাখামাখি, একেবারে যাকে বলে ‘কট রেড হ্যান্ডেড’! মোবাইলের ক্যামেরায় আলমারির ওপর থেকে প্লেট নামানোর ছবিও তোলা হয়েছে। সব মিলিয়ে ঝন্টু স্বীকার করতে বাধ্য হল যে কুকির কাটলেট সেই খেয়েছিল।
ঝন্টু আর আমাদের বাড়িতে আসে না, আর আমিও ওকে ডাকি না। একা একাই কুকির সঙ্গে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছি। ঠিক করেছি ওকে জিততেই না হয় দিলাম, হাজার হোক আমারই বোন তো। শান্তির আবহাওয়া কতদিন চলবে জানি না। সিনেমাটা দেখাবে বলেছে, তাই ততদিন ভালো হয়ে থাকি!
----------
ছবি – সুকান্ত মণ্ডল