গল্প:: বাচ্চুর গোয়েন্দাগিরি - সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী


বাচ্চুর গোয়েন্দাগিরি
সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি

বুঝলি বুঙ্কি, চারপাশে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতি খুব বেড়ে গেছে
হ্যাঁ বাচ্চুদা, তা যা বলেছিস
কিন্তু এরকম তো চলতে দেওয়া যায় না!”
ঠিক ঠিক তাহলে কী করা যায় বল?”
আমাদের তো একটা দায়িত্ব আছে সমাজের প্রতি, কী বলিস?”
তা তো বটেই কিন্তু আমরাআমরা তো ছোটো!”
ইয়েস, আমরাই! আমাদেরই করতে হবে বড়োদের উপর আর কতদিন ভরসা করে থাকব? ছোটো বলে কি আমরা ফেলনা? ধর যদি আমি গোয়েন্দা হয়ে যাই আর তুই আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট?”
-আমি?”
হ্যাঁ তুই! কেন ভয় কীসের? তুই শুধু আমার কথা শুনে চলবি আর আমাকে হেল্প করবি মাঝে মাঝে পারবি না?”
মানে যেমন ওই ফেলুদার তোপসে?”
হ্যাঁ, যেমন শার্লকের ওয়াটসন, ব্যোমকেশের অজিত…”
ওহ তো দারুণ ব্যাপার হবে বাচ্চুদা! কিন্তু আমাদের কে ডাকবে বল তো গোয়েন্দাগিরির জন্য?”
শোন প্রথমেই তো কেউ ডাকাডাকি করবে না আমাদের নিজেদেরই যেচে কয়েকটা কেস হাতে নিতে হবে ছোটোখাটো কেস হলে তা- সই কিন্তু সেগুলো যদি ঠিকঠাক সল্ভ করে দিতে পারি, নিশ্চয়ই তখন বড়োরা আমাদের গুরুত্ব দেবে দেখিস
এটা মন্দ বলিসনি তাহলে প্রথমে কী দিয়ে শুরু করবি?”
চোখ কান খোলা রাখতে হবে বুঝলি তো? আমি কয়েকটা জিনিস জোগাড় করে রাখছি কাজের সুবিধার জন্য যেমন ধর আতশ কাচ, পেন, টুকটাক জিনিস নোট করার জন্য ছোটো ডায়রি, দেখবি সব গোয়েন্দার কাছেই এগুলো থাকে আর সবচেয়ে বড়ো হল মগজ আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে শুনতে হবে, দেখতে হবে কোনো সন্দেহভাজন কিছু চোখে পড়ে কিনা এলে সেখান থেকেই আমাদের অপারেশন চালু হবে জানবি, গোয়েন্দা হবার প্রথম শর্ত হল সবকিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখা একটা জিনিসও যাতে ফাঁকতালে চোখের আড়াল না হয়
বাহ, শুনেই তো কেমন রোমাঞ্চ হচ্ছে রে!”
দাঁড়া এখনই কী? আমাদের হয়তো অনেক দুর্ধর্ষ অপরাধীদের সঙ্গে মোলাকাত হবে সাবধানে এগোতে হবে
ঠিক তখনই বাইরের দরজার কলিং বেল বেজে উঠল বাচ্চু আর বুঙ্কি তড়িঘড়ি সেদিকে এগিয়ে যেতেই দেখল একটা পার্সেল হাতে নিয়ে একজন ডেলিভারি বয় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চুকে দেখে সে জিজ্ঞেস করে, “এটা বিমলেন্দু বাগচির বাড়ি তো?”
বাচ্চু একটু গম্ভীর গলায় বলার চেষ্টা করে, “হ্যাঁ, আমার বাবার নাম কেন?”
এই পার্সেলটা এসেছে ওনার নামে প্রিপেইড, তাই টাকা কিছু দিতে লাগবে না শুধু ডেলিভারি হয়েছে এটা জানিয়ে একটা সই করে দিতে হবে এখানেএকটা কাগজ এগিয়ে দেয় লোকটা, সঙ্গে পেন
বারো বছরের বাচ্চু তার দশ বছর বয়সি খুড়তুতো বোন বুঙ্কির দিকে সিরিয়াস মুখ করে তাকিয়ে বলে, “আমিই এটা নিয়ে নিচ্ছি বুঝলি? বাবাকে এখনই কিছু বলতে হবে না আগে দেখি কে পাঠিয়েছে, কী আছেবুঙ্কি ঘাড় নাড়ে
প্যাকেটটা নিয়ে দুই ভাই-বোন চাপা উত্তেজনা নিয়ে ভিতরের ঘরে ফিরে আসে তারপর সেটার উপর অতি মনোযোগ সহকারে ঝুঁকে পড়ে বাচ্চু পকেট থেকে ফস করে ছোট্ট একটা আতশ কাচ বের করল তারপর একচোখ বুজে প্যাকেটের গায়ের লেখাগুলো খানিকক্ষণ পড়ে সে বলল, “ব্যাপারটা সন্দেহজনক বুঝলি? প্রেরকের নাম লেখা নেই জিনিসটা সার্ভে করতে হবে আগে ভালোই হল কথায় বলে না, চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম? আমাদের গোয়েন্দাগিরির প্রথম সুযোগটাও ঘরের মধ্যেই কেমন পেয়ে গেলাম দেখ!”
বুঙ্কি বলে, “কিন্তু প্যাকেটের ভিতরে কী আছে সেটা বাইরে থেকে বুঝবি কী করে?”
বাচ্চু সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটে একটা আঙুল ঠেকিয়ে বলে, “শ্শ্‌! কী একটা আওয়াজ পাচ্ছি যেন প্যাকেটের ভিতর থেকে দাঁড়া তো একবারবলেই সে প্যাকেটের উপর কান রেখে আরও নিচু হয়ে বসে তার পরমুহূর্তেই তড়াক করে ছিটকে উঠে বড়ো বড়ো চোখ করে বলে, “টাইম বোম! বুঙ্কি, টাইম বোম! টিকটিক করে শব্দ হচ্ছে! আমার সন্দেহই ঠিক এটা কোনো ভয়ানক সন্ত্রাসবাদীর কাজ!”
বুঙ্কি থতোমতো খেয়ে শুধু বলতে যাচ্ছিল, তাদের বাড়িতে সন্ত্রাসবাদীরা হঠাৎ টাইম বোম পাঠাতে যাবে কেন? তার আগেই বাচ্চু বলে উঠল, “বুঙ্কি, কুইক! যা বলছি চটপট করে ফেল একটা বালতিতে জল ভরে নিয়ে আয় কী হল? হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস যে! তুই না আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট?”
বুঙ্কি আর কী বলে! গোয়েন্দার শাগরেদ হয়েছে আর খাটাখাটনি করবে না? বেচারি তড়িঘড়ি কলঘর থেকে একটা ছোটো প্লাস্টিকের বালতিতে জল ভরে টেনে আনল সেখানে আর বাচ্চু বিনা বাক্যব্যয়ে প্যাকেটটা নিয়ে তার মধ্যে চুবিয়ে দিয়ে বলল, “ব্যস! এবার নিশ্চিন্ত জানিস, বম্ব স্কোয়াডের লোকজন এইভাবেই জলের মধ্যে বোম ফেলে সেগুলো নিষ্ক্রিয় করে, টিভিতে দেখেছি বোমের সার্কিটটার বারোটা বাজিয়ে দিলে আর ওটা ফাটবে না
সর্বনাশ! এসব কী করছিস তোরা? ওগো, দেখে যাও তোমার ছেলে আর ভাইঝির কাণ্ড!” কখন যে বাচ্চুর মা পায়ে পায়ে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন সেটা কেউই খেয়াল করেনি ততক্ষণে তাঁর গলা শুনে বাচ্চুর বাবাও এসে গেছেন সেখানে, তিনি কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন, হাতে মোবাইলটা ধরা তাঁরও পিছনে বাচ্চুর কাকিমা, মানে বুঙ্কির মা- হাজির বাচ্চু সবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, অমনি তার বাবা চেঁচিয়ে বললেন, “হতচ্ছাড়া, তোদের কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই? জানিস ওটা কী ছিল? শিগগির জল থেকে তোল প্যাকেটটা!”
বাচ্চু আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করল, “কিন্তু ওর মধ্যে যে বোম ---” তার কথা শেষ হওয়ার আগেই বাচ্চুর বাবা অপেক্ষা না করে নিজেই জলে ভেজা প্যাকেটটা তুলে ফেলেছেন তারপর মিনিট খানেকের কসরতে নেতিয়ে যাওয়া আস্তরণ খসিয়ে সেটার ভিতর থেকে বের করে আনলেন সেই ভয়াবহ সন্দেহজনক বস্তুটা! জিনিসটা আর কিছুই না, খুব সুন্দর দেখতে একটা টেবিল ঘড়ি তার ডায়ালের ভিতর ভারি সুন্দর কয়েকটা পুতুল সেট করা ছিল কিন্তু সেখানেও জল ঢুকে সব এলোমেলো করে দিয়েছে ঘড়িটা তো বন্ধ হয়েই গেছে এবার বাচ্চুর মুখের অবস্থাটা হল দেখার মতো বুঙ্কি গুটিগুটি পায়ে তার মায়ের কাছে এগিয়ে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়েছে ততক্ষণে ভাবখানা এমন যে, যা করার দাদা- করেছে, সে কেবল অনুগত শিষ্যার মতো হুকুম তামিল করেছে মাত্র বাচ্চুর বাবা তখন বলে চলেছেন, “হতভাগা, আগামী সপ্তাহে তোর জন্মদিন তাই তোর বড়োমামা ফোন করেছিলেন একটু আগে আমায় তিনিই দিল্লি থেকে তোর জন্য এই সারপ্রাইজ গিফটটা পাঠিয়েছিলেন, আর তুই কিনা…”
বেচারার গোয়েন্দাগিরির প্রথম প্রচেষ্টাই এভাবে মাঠে মারা, থুড়ি জলে ডুবে যাবে, তা বোধহয় সে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি ঘড়িটার জন্য আফসোসও হচ্ছিল বেজায় নাহ, বাস্তবিকই তারসময় খারাপযাচ্ছে
----------
ছবি - লেখক

1 comment: